কাঙাল মালসাট – ১
১
কাতার দিয়ে কাটা মুন্ডু আদি গঙ্গার পাড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে। অর্থাৎ রাতে ভয়াবহ কিছু ঘটেছে। বস্তা করে মুন্ডুগুলো ডাঁই করে রেখে সটকেছে? ধড়গুলোর তাহলে কী হল? কুপিয়ে কাটা না পোঁচ দিয়ে দিয়ে? মুন্ডুগুলো কি ব্যাটাছেলের না ফিমেল? এরকমই ছিল একটি ভাষ্য। অপরটি হল সাইক্লোনজনিত ঘোলাটে আকাশের তলায় খলবলিয়ে মাথার খুলি নাচছে। আগে অনেকগুলো নাচছিল। কিন্তু যেই পুলিশ এল অমনি বাকিগুলো ভ্যানিশ হয়ে মাত্র তিনটে রইল। আর পুলিশ যখন ভাবছে পা বাড়াবে কি বাড়াবে না, নতুন কোনো কেচ্ছায় জড়িয়ে পড়ার মন্দ-ভালো সাত-পাঁচ ঠিক সেই সময় ওই তিনটে খুলিও মুচকি হেসে উদ্বেল জোয়ারে লোপাট হয়ে গেল। পাবলিক এই সূত্র ধরে উবু হয়ে বসেছিল কিন্তু সন্ধেবেলায় বেসরকারি একটি বাংলা চ্যানেলের সংবাদে দেখা গেল লম্বামুখো এক পুলিশ অফিসার বলছে যে ওই খুলিগুলো শিরিটির শ্মশান থেকে এসেছিল। এক জোয়ারে এসেছিল, পরের জোয়ারে আবার ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। পুলিশেরই অন্য একটি মহলের মতে তথাকথিত ওই ‘ডান্সিং স্কালস’ শিরিটির মাল নয়, ক্যাওড়াতলার। জোয়ারের টানে পলিব্যাগ, হাওয়াই চটি, কলার খোলা, ফুল ইত্যাদি ইন্যানিমেট অবজেক্টের সঙ্গে ডাউন সাউথ মহাবীরতলায় চলে গিয়েছিল।
মনে হয় এই বিচিত্র ও বিশিষ্ট ঘটনাটি সম্বন্ধে পাবলিক বা পুলিশ যা-ই ভাবুক না কেন আমাদের উচিত হবে একটি স্বতন্ত্র অবস্থানই গ্রহণ করা বা যে কোনো অবস্থানই পরিহার করে চলা। ঘটনাটি ঘটেছিল ২৮ অক্টোবর ১৯৯৯ – শুধু তারিখটা মনে রাখতে হবে। আগে থেকে সব জেনে যারা ঘটনা এলে সেই পরিচিত হাসিটি হাসে তাদের গেঁড়ে মদনা না বলার কোনো কারণ আছে কি? অগণিত করোটি শোভিত এই শতাব্দীর শেষ লগ্নে কী ভেবেছিলেন আপনারা? বুলবুলিপাখি ডিগবাজি খাবে? পাড়ায় পাড়ায় নহবৎ বসবে? সাধনার যে স্তরে ইলবিলা ইড়বিড়া ভেদাভেদ ঘুচে গিয়ে বিশুদ্ধ সত্বপ্রধান অজ্ঞানোপহিত চৈতন্যের আভা দেখা যায় বাঙালি তার ধারে কাছেও নেই। অতএব কেঁদে ককিয়ে লাভ তো হবেই না, উপরন্তু বিপদ বাড়বে। জাতির এরকমই এক মহাসংকট কালে শ্রী কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ (১৮৬১-১৯০৭) হিন্দি ভাষায় একটি গান লিখেছিলেন, যেটি ১৯০৬ সালে কলকাতার কংগ্রেস সম্মেলনে সগৌরবে গাওয়া হয়েছিল-
ভেইয়া দেশকা এ কেয়া হাল।
খাক মিট্টি জহর হোতি সব, জহর হোই জঞ্জাল।
হিন্দি গান শুনলেই সকলেই ভাবে সিনেমার গান। এ গান সে গান নয়। শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের কালীপ্রসন্ন সম্বন্ধে আরও জানিয়েছেন। ‘স্বদেশী সভায় তিনি একটি নূতনত্বের আমদানি করেন; উহা – সভার সূচনায় ও শেষে স্বদেশপ্রেমোদ্দীপক সঙ্গীতের আয়োজন। নিজে সুগায়ক না হইলেও সঙ্গীত রচনায় তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ক্ষমতা ছিল। স্বদেশী সভায় যোগদানকালে তিনি দুইজন বেতনভোগী সুকন্ঠ গায়ককে সঙ্গে রাখিতেন…’। ঠিক এরকম না হলেও কাছাকাছি কোনো সুরে মন বেঁধে আমাদের করোটি নৃত্যের ব্যাপারটি ভাবতে হবে। তবে যদি কিছু হয়। আপাতত এটুকুই আয়ত্তে থাকলে যথেষ্ট যে, খুলি-ডান্সের অনুষ্ঠানটি আরও বড়, অভাবনীয়রকমের বড় এক প্রকাণ্ড কাণ্ডের ইঙ্গিত।
এই বার আমরা অবলীলায় চার দিন পেছিয়ে যেয়ে ২৪ অক্টোবর, ১৯৯৯-এর আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় চতুর্থ পৃষ্ঠা অর্থাৎ ১২ নং পাতার নিম্নার্ধে মনোনিবেশ করব। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, এরকম আমরা অবশপাঠক হিসেবে করেই থাকি যেহেতু এইটুকু বুদ্ধি আমাদের হয়েছে যে, পিছিয়ে পড়ার চাইতে পা পিছলে আছাড় খেয়ে পড়াও ভাল। কর্মখালির পাঁচটি কলামের মধ্যে বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়টিতে একটি বিজ্ঞাপন রয়েছে যার বয়ান,
দেশ বিদেশ ভ্রমণ
২৭ বৎসর সম্মানিত বিশ্ববিখ্যাত যাদুকর আনন্দ-র সাংস্কৃতিক দলের জন্য আকর্ষক সুন্দর তরুণ, তরুণী, কী বোর্ড প্লেয়ার, ড্রামার, বেঁটেমানুষ, অনুভবি ছুতোর মিস্ত্রি লাইসেন্সড পারসন, ম্যানেজার এবং ইলেকট্রিসিয়ান চাই। আকর্ষণীয় বেতন, শিক্ষা, আসা-যাওয়া, খাওয়া-থাকা, মেডিক্যাল সুবিধা। তিনদিনের মধ্যে যোগাযোগ করুন। সময় : সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ঠিকানা : যাদুঘর আনন্দ, C/o ম্যাজেস্টিক হোটেল, রুম নং ২০৭, ৪সি ম্যাডান স্ট্রিট, কলি-৭২ (নিউ সিনেমার পাশে)।
প্রথমেই আমরা এই ভেবে সচকিত হই যে, ভোজবাজির চেয়েও রহস্যমণ্ডিত এই কাকতালীয় কাণ্ড। ২৪ তারিখের পর থেকে যোগাযোগের তিনদিন ধরলে ২৫, ২৬ ও ২৭ গেল- চতুর্থ দিবসেই খুলির নৃত্যানুষ্ঠান! ম্যাজিকের কি এই তবে শুরু? আমরা জানি যে, পুলিশ আমাদের আবেদনে কর্ণপাত করবে না; কিন্তু ব্যাপারটি কি যথেষ্ট রহস্যঘন নয়? এ বিষয়ে পুলিশের চেয়ে রসবেত্তা আর কে হতে পারে? এরপরেই সন্দিগ্ধ মনে যে ফ্যাকড়া ক্রমেই আস্তানা গাড়ে তা হল নামের এই মিল অর্থাৎ যাদুকর আনন্দ ও আনন্দবাজার পত্রিকা – আনন্দের ভেতরে আনন্দ- একি নিছকই ভবেশ্বরের খেলা না পিশাচসিদ্ধ হেঁয়ালি না ঘোমটাপরা ওই ছায়ার মায়াময় হাতছানি? তবে আমাদের মনের এই ফ্যাকড়াকে কেউ যেন আনন্দবাজার পত্রিকার মতো সুমহান প্রতিষ্ঠানের পেছনে কাঠি করার অপচেষ্টা বলে না ভাবেন। দুইহাতে সংবাদ ও সাহিত্যের মন্দিরা যে প্রতিষ্ঠান নিয়তই বাজিয়ে চলেছে তার পোঙায় লাগতে যাওয়া মোটেই ফলপ্রসূ হতে পারে না। উল্টে হুলো হয়ে যেতে পারে।
এই হুলো কী বস্তু তার একটি টিপিকাল কেস হল মিঃ বি কে. দাস এর জীবন। ঘটনাটি আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে কোনোমতেই জড়িত নয়। মিঃ দাস ইংরেজি ভাষায় স্বল্প দৈর্ঘ্যের উপন্যাস লিখতেন। মাত্র দুটিই তিনি লিখেছিলেন – ‘দ্যা মিসচিভাস ইংলিশম্যান’ এবং ‘অ্যান অ্যাফেয়ার উইথ অ্যালিগেটরস’। তখন কলকাতার নামী ইংরেজি দৈনিক ছিল ‘দ্যা ডেইলি প্লেজার’ – সেখানে গ্রন্থ সমালোচনার পাতা দেখতেন মিঃ প্যান্টো এবং ওই পাতাতেই ‘লিটেরারি স্নিপেটস’ লিখতেন মিঃ পি.বি.। মিঃ বি.কে. দাস বার বার তাঁর নিজের খরচে বার করা দুখানি চটি নভেল নিয়ে উপরোক্ত পত্রিকার দরজায় কত কড়া নেড়েছেন তা গোনা যায় না। রিসেপশনে একটা গুঁফো গুন্ডা বসত। তার নাম মিঃ শান্টু। এর নামে মার্ডার কেস ছিল বলেও জনশ্রুতি ছিল। এর কাজ ছিল লোক তাড়ানো। মিঃ বি.কে. দাস চার চারবার মিঃ শান্টু-র কাছে মিঃ প্যান্টো ও মিঃ পি.বি.-র জন্য দুখানি করে বই রেখে এসেছিলেন। প্রতিবারই নক্সাদার বিলেতি মার্বেল কাগজের মোড়কে লাল রিবনে বাঁধা অবস্থায়। মোট আট প্যাকেট ‘দ্যা মিসচিভাস ইংলিশম্যান’ ও ‘অ্যান আফেয়ার উইথ অ্যালিগেটরস’ জলে গেল। কী হয়েছিল জানা যায়নি। অনুমান করা যায় যে মিঃ প্যান্টো ও মিঃ পি.বি. ওই দুটি উপন্যাস ফেলে দিয়েছিলেন। অথবা ফেলে দেবেনই এরকম অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা থেকে মিঃ শান্টু রিভিউ সেকশনে বইগুলো পাঠায়নি। এবং মার্বেল পেপারের মোড়ক দিয়ে নিজের সংগ্রহের পর্নোগ্রাফির ফটো বইগুলোর মলাট দিয়েছিল এবং বইগুলো ওজনে ঝেড়ে দিয়েছিল – এমন হতেই বা বাধা কোথায়? কিন্তু মিঃ বি.কে. দাস ফঙ্গবেনে ধাঁচের ছিলেন না, যেমন মোটা ঘাড় তেমন ছিল তাঁর নলেজ ও রোখ। তিনি লেখা ছেড়ে দিয়ে আসামের জঙ্গলে ময়াল সাপের ভয়াল জগতে পাড়ি দিলেন- ময়ালের বাচ্চা ধরে এনে নানা চিড়িয়াখানায় সাপ্লাই দেওয়াই ছিল তাঁর কাজ। এবং এই কাজ করতে করতেই তিনি ফৌৎ হন। ভালুকের ছানা টুপিতে ভরে আনবার সময় সহসা, দুর্ভাগ্যবশত, সেই ছানাটির অভিভাবকরা এসে পড়েছিল। ভালুক শাবক সম্পর্কিত এই নির্মম অথচ যুক্তিসঙ্গত ঘটনাটি ঘটার মাত্র সাত দিন আগে কটকে পোয়েট-ফ্রেন্ড জি.এস. রায়কে তিনি বাংলায় একটি চিঠি লিখেছিলেন। যা পরে উইতে খেয়ে নেয়। এই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘ মিঃ প্যান্টো-র প্যান্টোমাইম আর টলারেট করা যায় না। রিভিউ যদি নাও হয় ‘লিটেরারি স্নিপেটস’- এ একবার মেনশন হইতে পারিত। এই পি.বি-টি কে? আমি বাংলা ভালো জানি না কিন্তু এটার নাম পরার্থলোভী বকরাক্ষস বা পায়ুকামী বোম্বেটে দিয়াই স্যাটিসফায়েড থাকিলাম। ভাবনা করিয়াছি কয়েকখানি পাইথন লইয়া উহাদের গায়ে দিব। বেষ্টন করিয়া ভক্ষণ করিবে।’
আজকাল কেন বহুদিনই স্বল্প দৈর্ঘ্যের উপন্যাস নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলে আসছে। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত শ্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর ‘কাশ্মীরে বাঙালী যুবক’ একটি উদাহরণ। তবে লেখক এ ঘাটে বেশিদিন জল খাননি। ‘অল্প বয়সে একবার কেবল ইংরাজী শিলিং উপন্যাসের অনুকরণে, কতগুলি ছোট উপন্যাস বাঙ্গালায় লিখিবার ইচ্ছা হইয়াছিল।’ উপন্যাসটি মোটের উপর কেউ কেউ ভালো বললেও লেখকের ভাষায় ‘ঐরূপ বই লিখিয়া কিংবা পড়িয়া, কেহ কি এখনকার দিনে সময় নষ্ট করিতে ইচ্ছা করে?’ শ্রীসুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বলিলেন বইখানি তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর ভাল লাগিয়াছে, তবে তাঁর কাকা পড়িয়া কিছু বলেন নাই।’ এই কাকাটি রবীন্দ্রনাথ। যাই হোক মিঃ বি.কে দাস-এর মত একেবারেই স্বতন্ত্র ও অভিনব। ‘এখনকার পাঠক খচ্চর ও তালেবর হইয়া উঠিয়াছে। এদের জন্যে নো রাইটার শুড ওয়েস্ট হিজ টাইম। কেহবা বলে পাঠকের সময় কম। মাই ফুট! আমি বলি লেখকের সময় কম।’ তত্ব হিসেবে এটি কতটা ভারালো সে না হয় বিজ্ঞজনেরা বুঝবেন। আমরা জানলাম যে লিটেরারি এসটাব্লিশমেন্ট লেখককে কী করতে পারে। আজ যদি কোনো লেখক আনন্দবাজারকে খচায় তার কী দশা হবে ভেবে আতঙ্কিত হওয়া যাক।
আজকাল বাঙালি জীবনে বিশিষ্ট বাঙালিদের জীবনী পড়ার রেওয়াজ প্রায় নেই। যদি কোথাও থেকে থাকে তাহলে সেই গুণবান পাঠক যেন ঔপন্যাসিক মিঃ বি.কে. দাস-কে বৈমানিক বিনয়কুমার দাস (১৮৯১-১৯৩৫)-এর সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলেন। বৈমানিক মিঃ বি.কে. দাস-এর একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হল ‘ব্যাঁটরা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ নামক কারখানা প্রতিষ্ঠা। ১৯৩৫ সালের ২৮ এপ্রিল বেলা ১০টা। ভাবলেই গায় কাঁটা গজায়। দমদমা খপোত ঘাঁটির নিকটস্থ গৌরীপুর গ্রামের আকাশ। বিনাশক শক্তির এমনই গোঁ যে বি.কে.দাস-এর বিমান ও ডি.কে রায়ের বিমানে ধাক্কা লেগে গেল। তখন এখনকার মতো উন্মত্ত বিমান আনাগোনা হত না। আকাশও সস্তা ছিল। পাওয়াও যেত প্রচুর। বাঙালি অবশ্য অচিরেই সেই শোক কাটিয়ে ওঠে। তার জিনগত অভ্যাসই হল আলুথালু হয়ে হাঁউমাঁউ করা, পরক্ষণেই পাল্টি খেয়ে দাঁত ক্যালানো। এই প্যাটার্ন অ-বাঙালি অর্থাৎ নাগা, রুশ, জার্মান বা হাবসি ইত্যাদির মধ্যে দেখা যায় না।
এখান থেকে লেনিনীয় নির্দেশে এক পা আগে-র পরে যদি দুই পা পিছোনো যায় তাহলে সেই আনন্দবাজার প্রসঙ্গ পাওয়া যাবে। আমাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এমনই হওয়া বরং শ্রেয় যে আনন্দবাজার পত্রিকা ও ম্যাজিসিয়ান মিঃ আনন্দ আলাদা, দুই-এরই কক্ষপথ ভিন্ন, ডি.এন.এ ইত্যাদি দুরূহ ছকে গঙ্গা গঙ্গা ফাঁক, অতএব একটিকে খপ করে ধরে ক্লোন করলে অন্যটি হবে না। যাদুকর আনন্দ ‘বেঁটে মানুষ’ চেয়েছেন ‘বেঁটে লেখক’ চাইলে বরং সন্দেহের অবকাশ থাকত। তবে একথা না বলা বোধহয় অন্যায় হবে যে আনন্দবাজার না থাকলে মুষ্টিমেয় যে কয়জন বাঙালি লেখক মালদার হয়ে উঠেছেন তাঁদেরও এতটা ফুলে ফেঁপে ওঠা সাধ্যে কুলোতো না। হাতে হ্যারিকেন হয়ে যেত। বাঙালিদের মধ্যে কিন্তু হ্যারিকেন হাতে লেখকের ঘাটতি নেই। সাধারণ রঙ্গালয়ের গোড়ার দিকে যে মাদি ও মদ্দারা থিয়েটারে ভিড়ত তাদের সম্বন্ধে রসরাজ অমৃতলাল বসু যা লিখেছিলেন তা হ্যারিকেন হাতে লেখকদের ক্ষেত্রেও খেটে যাচ্ছে,
নিজ পরিবার মাঝে বিরক্তিকারণ।
কুটুম্ব সমাজে লজ্জা নিন্দার ভাজন।।
দেশের দশের পাশে শ্লেষ ব্যঙ্গ হাসি।
সরে গেছে বাল্যসখা তাচ্ছিল্য প্রকাশি।।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ট্র্যাজিক ফিগার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩১৯ সালের ২১ আশ্বিন আমেরিকার ইলিনয় থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে বলেছিলেন,
বিদ্যালয়ের আর্থিক সঙ্কটের কথা শুনিয়া দেশে ফিরিবার জন্য আমার মন টলিয়াছিল। কিন্তু আমার এখানকার বন্ধুরা বারম্বার আমাকে আশ্বাস দিতেছেন যে আমার বই ছাপার ভালরূপ ব্যবস্থা করিতে পারিলে বিদ্যালয়ের আয় সম্বন্ধে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যাইতে পারে। সেইজন্য আশাপথ চাহিয়া বসিয়া আছি। কিন্তু বই বিক্রি করিয়া কিছু পাইব এ কথা বিশ্বাস করিবার ভরসা আমার চলিয়া গিয়াছে।
আজ কলকাতায় যখন বইমেলা হয় তখন আনন্দ পাবলিশার্স-এর সামনে বাঙালি যেভাবে দীর্ঘ লাইন লাগায় তা দেখলে মনে হয় আহা! এমন একটি নয়নাভিরাম দৃশ্য যদি রবীন্দ্রনাথ দেখতেন তাহলে তাঁর কি সাতিশয় আনন্দই না হত!
আমাদের জানা আছে যে রবীন্দ্রনাথকে ট্র্যাজিক ফিগার বলার জন্য অনেকেই কুপিত হবেন এবং নুলো হলেও আস্তিন গুটোবেন। তাঁদের আমরা আগেভাগেই জানিয়ে রাখি যে, এরপর যে রামধোলাই তাঁরা খেতে চলেছেন তা কিন্তু ঝাপটের ঢাল দিয়ে ঠেকানো সম্ভব নয়।
-নলেন! ন-লে-ন! এই গুয়োর ব্যাটা নলেনের বাচ্চা! কানে কি হোগলা গজিয়েচে?
ভদি ছাদ থেকে চেঁচাচ্ছে। কাকের দল ছাদের এককোণে কাকবলির খৈ খাচ্ছে। ভাঙা টবে মরা তুলসীগাছ। তার গোড়ায় পচাফুল। ন্যাড়া ছাদে শ্যাওলা। খোবলা হঁ×টের ফাঁকে গোল গোল গেঁড়ি। বটের চারা বেরিয়েছে। ছাদে রোজকার মতোই তেলচিটে, ধার ছেঁড়া মাদুর পাতা। তার ওপরে রাখা তুলো ভরা বার্লির পুরনো জং ধরা টিনের কৌটো, মান্ধাতার আমলের একটি ম্যাগনিফাইং লেন্স, লাল নীল কাচের টুকরো, ইঁট চাপা দেওয়া একটি সেইদিনের আনন্দবাজার পত্রিকা যার ফর ফর করে ওড়ার চেষ্টা নিরন্তর। ভদি ন্যাড়া ছাদের ধারে গিয়ে তলায় উঠোনের দিকে তাকায়। নলেন পেতলের সাজিতে টগর ফুল তুলে তুলে রাখছে।
– গাঁক গাঁক করে চিল্লোচ্চি শালা, কানে ঢুকচে না?
– আঁজ্ঞে, শুনতে পাইনি। যাব?
– হ্যাঁ, যাবে! ক্যাওড়াতলায় যকন মুখে নুড়ো জ্বালব তোর তকন যাবি। বেচামণি কী করচে?
– গিন্নিমা তো পাইখানায়।
— বেরুলে বলবি ঝটপট চান-ফান সেরে চাবির গোছটা বের করতে। ক-ঘর ভরল?
— আঁজ্ঞে, দুটো। তিন আর এক।
— আরও আসবে। তুই ব্যাটাও ধোয়া-পাখলা করে চান সেরে ফেলবি। গঙ্গাজল আনতে হবে।
— কেন? এত সকালে।
— যা বলচি তাই কর। আজ শালা চাকতির ঘর খোলা হবে। মা! মা গো! মা!
২৪ অক্টোবর, রবিবার, সকালে এমনটিই হয়েছিল। ভদি যাদুকর আনন্দর বিজ্ঞাপনটি পড়ে এবং গূঢ় নির্দেশ পায় যে চাকতির ঘর খুলতে হবে। হ্যারিকেনের ভূতুড়ে আলোর দপদপানিতে এ পর্যন্তই এখন দেখা থাকল।
শীত পড়তে অল্প বিস্তর দেরি। কিন্তু শীতের কবিতা লেখা শুরু হয়ে গেছে। একটি স্যাম্পেল দেখা যেতে পারে।
ঐ দ্যাখো ঢুলু ঢুলু গ্রাম,
মাঝে মাঝে হাঁটে জলপিঁপিঁ,
ক্যাঁতামুড়ি চাষা, চাষা-বউ
নাক ডেকে যায় ফুলকপি।
অনবদ্য এ কবিতাটি কার? ভদিই বা কে? চাকতির ঘরে কী আছে? হঠাৎ এই কবিতাটিই বা শান্টিং করা হল কেন?
‘হুজ্জুত-এ বাঙ্গালা, হিকমৎ- এ- চীন!