Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রঙ্কিণীর রাজ্যপাট এবং অন্যান্য – নবনীতা দেবসেন

    August 30, 2025

    আনা ফ্রাঙ্ক-এর ডায়েরি

    August 30, 2025

    আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ১ (অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ)

    August 30, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কাজল – তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

    তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প169 Mins Read0

    ০৪. বিবাহের পর মাস তিনেক কাটিয়াছে

    চতুর্থ পরিচ্ছেদ

    বিবাহের পর মাস তিনেক কাটিয়াছে। বৃষ্টি তেমন হইতেছে না। আকাশের রঙ কটা, তামার মতো। গরমে দেশসুদ্ধ লোক হাঁপাইয়া উঠিয়াছে। মাটিতে বড়ো বড়ো ফাটল, বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে মুখব্যাদান করিয়া রহিয়াছে। গরমে কাকদের স্বরভঙ্গ হইয়াছে, ডাকিলে তীব্র কা-কা শব্দের বদলে একটা ফ্যাসফ্যাস শব্দ বাহির হইতেছে মাত্র। লোকে প্রতি দণ্ডে একবার আকাশের দিকে তাকাইয়া মেঘ আসিল কিনা দেখিতেছে।

    অপু স্ত্রী-পুত্ৰকে মালতীনগরে রাখিয়া নিশ্চিন্দিপুরে গেল। হৈমন্তীকে সে দেশের বাড়িতে রাখিবে। মালতীনগর ভালো জায়গা হইতে পারে, কিন্তু মালতীনগরের সহিত তাহার আত্মিক যোগাযোগ নাই। যদি গৃহী হইতে হয়, নিশ্চিন্দিপুরে সে গৃহী হইবে!

    রাধারমণ চাটুজ্যের কাছে খোঁজ করিতে বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেল। তাহদের পুরানো ভিটার কাছেই ছোট পাকাবাড়ি, মন্দ নহে। দামও অপুর কাছে সস্তা বলিয়া বোধ হইল। নিজেদের ভিটায় নূতন করিয়া বাড়ি তুলিতে গেলে যা খরচ পড়ে, তাহা এখন অপুর পক্ষে জোগাড় করা মুশকিল। বাড়ি একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছে–তাহার উপর বাড়ি তোলা অনেক ঝামেলার কাজ। ফলে অপু এই বাড়ি কেনাই মনস্থ করিল।

    রাধারমণ হাসিয়া বলিলেন–আমাদের বাড়ির কাছে হল। আমরা দু’ভাই ও বাড়ির একেবারেই পাশেই থাকি কিনা। বেশ গল্প-টল্প করা যাবে। আপনার মতো পড়শী পাওয়া, বুঝলেন কিনা, রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার।

    অপু প্ৰথমে রাধারমণের গায়েপড়া ভাবটা পছন্দ করে নাই, কিন্তু পরে লোকটাকে ভালো লাগিয়া গেল। একটু বেশি কথা বলিলেও চাটুজ্যে লোক মন্দ নহে।

    মালতীনগরে ফিরিবার আগে অপু একবার জঙ্গলাবৃত পুরানো ভিটার সামনে গিয়া দাঁড়াইল। মনে মনে বলল–বৌ নিয়ে আবার আসছি তোমাদের কাছে ফিরে। দেখলে তো, কোথাও থাকতে পারলুম না। তোমরা আশীৰ্বাদ করো, কাজল যেন মানুষ হয়। যেন ওর জীবনে পূর্ণতা আসে।

    হৈমন্তীকে লইয়া নিশ্চিন্দিপুরে আসিলে বেশ বড়ো রকমের হৈ-চৈ হইল। রানি আগে হইতেই অপুর কেনা বাড়িতে আসিয়া প্রস্তুত হইয়াছিল। আরও অনেকে আসিয়া ভিড় জমাইয়াছিল উঠানে। অপুরা আসিতেই রানি সবার আগে আসিয়া অভ্যর্থনা করিল, হৈমন্তীর পিঠে হাত দিয়া তাহাকে ঘরের ভিতর লইয়া গেল।

    গোলমাল মিটিলে অপু বলিল–বৌ কেমন লাগল রানুদি?

    –সুন্দর হয়েচে। চমৎকার বৌ হয়েচে। তুই যে বিয়েথাওয়া করে আবার এসে গ্রামে উঠেছিস, তাতে যে কী খুশি হয়েচি, তা আর–এবার মন দিয়ে সংসারধর্ম কর। বড্ড বাউণ্ডুলে হয়ে গিয়েছিলি তুই।

    সর্বাপেক্ষা খুশি হইয়াছে কাজল। এই কদিন তাহাকে স্কুলে যাইতে হইতেছে না, পড়া মুখস্থ করিতে হইতেছে না। বাবা বলিয়াছে, গ্রামের কাছেই স্কুলে ভর্তি করিবে। তাহাতে যে দু’একদিন লাগিবে, তাহা বেশ মজায় কাটিয়া যাইবে।

    নিশ্চিন্দিপুরে ফিরিবার সময় অপু ছেলের কথা ভাবিয়াছিল। শেষে ভাবিল–কী আর হবে, গ্রামের স্কুলেই ভর্তি করিয়ে দিই। বাদবাকি পড়া আমি নিজে দেখব’খন। আমি নিজেও তো একসময় গ্ৰাম্য স্কুলে পড়েচি, আমার কি পড়াশুনো কিছুই হয়নি?

    প্রতিবেশীরা ফিরিয়া গিয়াছে। কাজল রানির সহিত তাহদের বাড়ি গিয়াছে। দুপুরে অপু ঘরে ঢুকিয়া বলিল–প্রথম দিন আর বেশি কিছু রান্না করতে হবে না। যাহোক একটা ছেচকি-টেচকি কিছু নামিয়ে ফেলো। এমনিতেই আসার কষ্ট গেছে–রানুদি ডাল আর তরকারি পাঠিয়ে দেবে বলেছে। বলেছে, নতুন বৌ এল, তাকে খাটালে গায়ের নিন্দে হবে যে।

    হৈমন্তী মুখ তুলিয়া নতুন ঘরকন্না করিবার আনন্দে হাসিল। সঙ্গে সঙ্গে অপুর মনে একটা আনন্দেব রেশ ছড়াইয়া পড়িল। সে সংসাব করিতেছে স্ত্রী-পুত্ৰ লইয়া। সবাই খুশি। চারিদিক বেশ কেমন ভরিয়া উঠিয়াছে।

    সে হৈমন্তীকে জিজ্ঞাসা করিল–তুমি অনেক বড়ো বড়ো জায়গায় ঘুরেচো বাবার সঙ্গে। এই অজ পাড়াগাঁয়ে থাকতে পারবে তো?

    –পাববো মশাই, পারবো। আমি সে রকম মেয়ে নই, তা হলে তোমাকে বিয়ে করতাম না। ববং শহরই আমার ভালো লাগে না।

    –বিকেলে তোমাকে নিয়ে নদীতে যাবো গা ধুতে। এই পেছন দিয়েই পথ, বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে। দেখো, খুব ভালো লাগবে।

    –তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। বেলা পড়ে এলো যে, কাজল কই?

    –সে রানুন্দির ওখানে খাবে। না, না, শুধু আমাকে নয়, তোমারটাও বাড়ো–একসঙ্গে নিয়ে বসে যাই।

    –তুমি খেয়ে ওঠে তো আগে, তারপর আমি বসবো।

    বিকাল হইয়া আসিতেই অপু, হৈমন্তীকে লইয়া পুরানো ভিটার কাছে গেল।

    —এই আমার পৈতৃক ভিটে হৈমন্তী। এখানে আমার জন্ম। ওই যে আকন্দগাছ দেখছ–ওখানে একটা ঘর ছিল, সেই ঘরে। আমার বাবা-মার পুণ্যস্মৃতিমণ্ডিত মাটি এখানকার।

    হৈমন্তী ভিটার দিকে মুখ করিয়া গলায় আঁচল দিয়া মাটিতে উপুড় হইয়া প্ৰণাম করিল। বলিল–তাদের তো দেখলাম না। কপাল করে আসি নি শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ঘর করবো। তঁদের আশীৰ্বাদ যেন পাই। কাজলকে যেন মানুষ করে তুলতে পারি।

    ব্যাপারটা আদৌ নাটকীয় হইল না। বরং হৈমন্তীর সাষ্টাঙ্গে প্ৰণাম করিবার মধ্যে অপু অনেক কিছু দেখিতে পাইল। সকাল হইতেই নানা মিশ্র অনুভূতিতে তাহার বুক ভরিয়া উঠিতেছিল। বৌ লইয়া জঙ্গলাকীর্ণ ভিটার সামনে দাঁড়াইয়া তাহার মনে হইল মায়ের স্নেহ, বাবার আশীৰ্বাদ যেন তাহাদের দুইজনকে ঘিরিয়া ধরিয়াছে। এতদিন বাদে অতীতের দিনগুলির সহিত যেন একটা যোগাযোগ স্থাপিত হইল।

    রানুপিসি নানা কাজে ব্যস্ত ছিল, তাহাকে বলিয়া কাজল বেড়াইতে বাহির হইল। রানি বলিয়া দিল–বেশি দেরি করিস নে, দূরে যাস নে।

    গ্রামের প্রান্তে যে মাঠ আছে তাহার আল ধরিয়া পড়ন্ত বেলায় হাঁটিতে কাজলের খুব ভালো লাগে। মাঠের মধ্যে দূরে দূরে লোক থাকে, অধিকাংশ সময়েই মাঠ ফাঁকা। ওয়াইড ওয়ার্লড ম্যাগাজিন হইতে শোনা গল্পগুলির পটভূমি হিসাবে এই ফাঁকা মাঠ ও বন্য ঝোপ তাহার মনে আধিপত্য বিস্তার করে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রচণ্ড গরমে মরুভূমির ভিতর হীরকসন্ধ্যানী দুইটি দলের মধ্যে যে ভীষণ সংঘর্ষ হইয়াছিল, এই মাঠে সে তাহা প্রত্যক্ষ করিতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার গরমের সহিত সংগতি রাখিবার জন্য সে হাতের উলটা পিঠ দিয়া শক্ত আলোর উপরকার উত্তাপ অনুভব করে। মনে মনে ভাবে, আফ্রিকার মরুভূমির বালিও এমনি গরম। বাবার কাছে গল্প শুনিয়া সে লক্ষ করিয়াছে, যাবতীয় রোমাঞ্চকর ঘটনা আফ্রিকাতেই ঘটিয়া থাকে। আফ্রিকা তাহার কাছে বহস্যোব দেশ। বড়ো হইলে সে আফ্রিকায় যাইবে, বাওবাব গাছ (বাবার কাছে নাম শুনিয়াছে) দেখিবে।

    সূর্য দিগন্তরেখা স্পর্শ করিয়াছে। কাজল তাকাইয়া দেখিল মস্ত লাল সূৰ্যটা আস্তে আস্তে দিগন্তের নিচে নামিয়া পড়িতেছে। ততক্ষণে একটু ঠাণ্ডা বাতাস ছাড়িয়াছে। আলেব পাশে ছোট ছোট ঝোপের মধ্য দিয়া হালকা শব্দ তুলিয়া হাওয়া বহিতেছে। কেহ কোথাও নাই। যত দূর দৃষ্টি যায়, উদার বিশাল মাঠ পড়িয়া আছে। বিকালে কেমন একটা ছায়া ছায়া ভাব নামিতেছে। বাতাসেব অদ্ভুত শব্দ। এর মধ্যে একলা দাঁড়াইয়া থাকিবার যে একটা ভয়মিশ্রিত আনন্দ আছে, তাহা কাজলকে অভিভূত করে। ঠিক ভয় নহে, একটা অচেনা অনুভূতি। এই সময়, দিন ও বাত্রিব সন্ধিক্ষণে বাড়ি হইতে দূরে মাঠের ভিতর পৃথিবীটাকে যেন অচেনা বোধ হয়।

    ফিরিবে বলিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইতেই কাজলের সেই লোকটার সহিত দেখা হইয়া গেল। মানুষটার হাতে খঞ্জনী, পরনে আটহাত খাটো মোটা ধুতি। নাকে বসকলি, বগলে ছাতা–তাপ্পি মারা, কাঁধে ঝুলি। আপন মনে আসিতেছিল, সামনে কাজলকে দেখিয়া খঞ্জনীটা দ্রুত লয়ে একবার বাজাইয়া দিল। কাজল প্ৰথমে ভয় পাইয়াছিল। পরে লোকটার চোখের দিকে তাকাইয়া বুঝিল, এ চোখ যাহার, তাহাকে ভয় পাইবার কোন কারণ নাই।

    লোকটা হাসিয়া বলিল— বেড়াচ্ছেন বুঝি বাবাজি? ভালো, বেড়ানো ভালো। বেড়ালে মানুষের চোখ ফোটে–তাঁর দুনিয়াটার রূপ দেখতে পায় মানুষ–

    -কার দুনিয়া?

    লোকটা আর একবার দ্রুত খঞ্জনী বাজাইয়া ওপরে আকাশের দিকে দেখাইয়া বলিল–ওই ওখানে যিনি থাকেন, তার। সবই তো তার বাবাজি।

    সম্পূর্ণটা না পারিলেও, কাজল লোকটার কথার খানিকটা অর্থ ধরিতে পারিল। বেশ কথা বলে মানুষটি। কাজল বলিল–তুমি বুঝি অনেক বেড়িয়েচ?

    লোকটা মৃদু হাসিল।

    –বেড়ানো আর হল কোথায়? অকাজেই বড্ড বেলা হয়ে গেল। হ্যাঁ, কিছু কিছু ঘুরেছি বাবাজি। বেশির ভাগটাই না-দেখা রইল।

    খঞ্জনী বাজাইয়া লোকটা ভাঙা বেসুরো গলায় দুকলি গান গাহিল–

    ও মন তুই পোড়া সুখে রাইলি ভুলে
    যখন তোর মনের পদ্ম উঠল দুলে
    প্রভুর পদপরশনে–

    কাজল লোকটাকে ভালোবাসিয়া ফেলিল। সুন্দর মানুষ। গান গাহিতে পারে–গল্প করিতে পারে, আর কী চাই? বলিল–তোমার কী তাড়াতাড়ি আছে? এইখানটায় বসে আমার সঙ্গে একটু গল্প করে যাও না।

    লোকটা ছাতাটা আলোর গায়ে হেলান দিয়া রাখিয়া বসিল।

    –তুমি যদি থাকতে বলো, তবে আমার কোন তাড়া নেই।

    অনেক গল্প হইল লোকটার সহিত। লোকটা সুন্দর গল্প করিতে জানে। সাধারণ ঘটনাও তাহার বলিবার গুণে চিত্তাকর্ষক হইয়া ওঠে। একটি মেয়ের বাপের বাড়ির গাঁয়ে সে ভিক্ষা করিতে যাইত প্রায়ই। মেয়েটির কবে বিবাহ হইয়া গিয়াছে, সে খবর পায় নাই। একদিন না জানিয়াই তাহার শ্বশুরবাড়িতে ভিক্ষা চাহিয়া দাঁড়াইতে বাপের বাড়ির চেনা বলিয়া মেয়েটি তাহাকে অনেক কথা লুকাইয়া বলিয়াছে। ইহাতে লোকটা খুব খুশি।

    —জগতে কেউ কারুর নয় বাবাজি। আপন মনে করলেই আপন, পর ভাবলেই পর।

    গল্প শেষ হইলে সে ঝুলির ভিতর হইতে একটি পাকা আম বাহির করিল।

    –তুমি এটা নাও খোকন। বাড়ি গিয়ে খেয়ো।

    –না, তোমার জিনিস। আমি কেন নেবো?

    –আমার আর কই? এটা তোমারই, আমি তোমাকে দিচ্ছি।

    –নিশ্চিন্দিপুর এই তো কাছেই। একদিন যেয়ে না। আমাদের বাড়ি।

    –যাব, নিশ্চয় যাব।

    খঞ্জনীতে আওয়াজ তুলিয়া গুনগুন করিতে করিতে সে বিদায় লইল। দুই পা হাঁটিয়াই কাজল তাহাকে ডাকিল- তোমার নাম তো বলে গেলে না?

    সে ফিরিয়া বলিল–আমার নাম রামদাস বোষ্টম।

    স্বল্প আলাপেই রামদাস কাজলের মনে গভীর ছাপ রাখিয়া গেল। কেমন সুন্দর জীবন, একা এক বেড়ায় মাঠে-ঘাটে, ঘরবাড়ির ঠিক নাই। কোন বন্ধন নাই–আবার পিছুটান নাই বলিয়া দুঃখও নাই। খোলা আকাশের নিচে একা খঞ্জনী বাজাইয়া ফেরে।

    সন্ধ্যার আরছা অন্ধকারে কাজল বাড়ির পথ ধরিল।

    বিকালে নদীতে স্নান করিতে যাইবার কথা ছিল।

    অপু আর হৈমন্তী গল্প করিতে করিতে অনেক দেরি করিয়া ফেলিল।

    হঠাৎ খেয়াল হইতে অপু ধড়মড় করিয়া মাদুরের উপর উঠিয়া বসিল-ওই যাঃ, এ যে প্রায় অন্ধকার হয়ে এলো, চল চল, আর কথা নয়। দু’খানা গামছা, তোমার শাড়ি, আমার ধুতি, আর শিশিতে একটু তেল নাও-ওবেলা তেল মাথায় দিতে ভুলে গেছি। একেবারে ঘাটে মেখে নেব।

    তাড়াতাড়ি গোছগাছ করিয়া বাহির হইতে আরও পনেরো মিনিট দেরি হইল। হৈমন্তী জিজ্ঞাসা করিল–কাজল এলো না যে?

    –রানুদির ওখানে আছে, সন্ধে উতরে গেলে রানুদিই দিয়ে যাবে’খন।

    অন্ধকার নামিতেছে। নদীর পথে ঝোপে-ঝাড়ে বেশ অন্ধকার ঘনাইয়াছে। বাগান দিয়া যাইবার সময় একটা কী জন্তু ঝরাপাতার উপর দিয়া খড় খড় শব্দ করিয়া দূরে সরিয়া গেল। হৈমন্তী বলিল–ও কী গো?

    –ভয় পেয়েছে? কিছু না, শেয়াল-টয়াল হবে হয়তো কিংবা বেজি!

    —সুন্দর লাগছে কিন্তু, না? শহরে এ সময় গোলমাল, গাড়ির ভেঁপু, মানুষের ভিড়। তার চেয়ে এই ভালো। মনের শান্তির চেয়ে বড়ো জিনিস নেই।

    –তুমি যে একেবারে নাটুকে কথাবার্তা বলতে শুরু করলে।

    –না গো, এই আমার মনের কথা। আমি এই চেয়েছিলাম। শহর আমার ভালো লাগে না। যখনই তোমার লেখা প্ৰথম পড়েছি, মনে হয়েছে–

    –কী মনে হয়েছে?

    হৈমন্তী অপুর দিকে তাকাইল।–না, সে আমার বলতে লজ্জা করে।

    –আহা, বলেই না। আন্দোকটা যখন বললে

    –প্রথম তোমার লেখা পড়েই মনে হয়েছিল–এ মানুষটার সঙ্গে আমার খুব মিল খাবে। প্রকৃতি যে এত ভালোবাসে–

    দুইজনে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া হাঁটিল। বেশ কেমন সন্ধ্যায় নদীতে স্নান করিতে যাওয়া বনপথ বাহিয়া এইসব শাস্তি ছাড়িয়া সে কীসের অন্বেষণে ঘুরিতেছিল সমুদ্রপারে?

    বাঁশবাগানের মধ্যে হৈমন্তী হঠাৎ থামিয়া গেল। চারিদিকে তাকাইয়া বলিল–শোনো।

    –কী?

    –একটা মজার ব্যাপার হয়েছে।

    –তোমার তো দেখি দুপুর থেকে খালি মজার ব্যাপারই ঘটছে। কী ব্যাপার?

    –মালতীনগর থেকে আসবার আগে পত্রিকায় একটা গল্প দিয়ে এসেছি না? সেই গল্পে একটা বাঁশবাগানের বর্ণনা আছে। মনে মনে একটা বাঁশঝাড়ের কল্পনা করে লিখেছিলাম। হঠাৎ এখানটায় দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখে মনে হচ্ছে অবিকল যেন আমার কল্পনাব সেই বাগানটা। কেমন আশ্চর্য, না?

    অপুর বেশ ভালো লাগিল ঘটনাটা। হৈমন্তী এ গ্রামের বউ হইয়া আসিবে, ইহা যেন ভগবানই স্থির করিয়া রাখিয়াছেন। নিজের অতীত জীবনটা এই আনন্দের মুহূর্তে গোটানো মানচিত্রের মতো চোখের সামনে খুলিয়া গেল। বহু কষ্ট গিয়াছে, জীবনযুদ্ধে বহু রণক্ষেত্রের সে সৈনিক। এখন পুরস্কারের দিন-সার্থকতার দিন।

    অন্ধকার ঝোপে ঝোপে কীটপতঙ্গের ঐকতান শুরু হইয়াছে। বাতাসে দিনশেষের আমেজ আর একটা বন্য গন্ধ।

    অপু বলিল–নাও, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চল। সন্ধে উতরে গেল—

    এক-একদিন রাত্রিতে চাঁদ থাকিলে মাদুর পাতিয়া তারা বারান্দায় শোয়। বাবার পাশে মাদুরে শুইয়া কাজল চাঁদ নক্ষত্র আকাশ পৃথিবী সম্বন্ধীয় অজস্র বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন করিতে থাকে। অপুকে তাহার উত্তর দিতে হয়। অপু মাঝে মাঝে কাজলকে বিশ্বসাহিত্যের গল্প শোনায-কাজল মনোযোগ দিয়া শোনে। বেশি রাত হইলে অপু ভাবে কাজল ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সে গল্প থামাইয়া বলে-কী রে, ঘুম পেয়েছে?

    অমনি কাজল বলে, বাবা আমার ঘুম পায়নি। থামলে কেন? বলো–

    অপুকে গল্প চালাইতে হয়। এইভাবে কিছুদিনের মধ্যেই কাজল বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কয়েকটি গ্ৰন্থ শুনিয়া ফেলিল।

    একদিন অপু কাজলকে ডাকিয়া বলিল–নে, চল। কাল আমার সঙ্গে কলকাতা চল। যাদুঘর যাবি বলছিলি, কাল যাদুঘর দেখাব’খন। আমারও এমনি কাজ আছে কয়েকটা-সেই সঙ্গে সেরে ফেলব।

    পরদিন সকালে অপু ছেলেকে লইয়া কলিকাতা রওনা দিল। কাজল একটা ঘিয়ে. রঙের হাফপ্যান্ট আর সাদা শার্ট পরিয়াছে। হৈমন্তী চুল আঁচড়াইয়া দিয়াছে পরিপাট করিয়া। যাইবার সময় অপুকে বলিয়া দিয়াছে–ওকে ভালো করে দেখেশুনে নিয়ে যাবে। যা দুষ্টু–

    কাজল অনেকদিন বাদে কলিকাতা আসিল। আবার সেই বড়ো বড়ো বাড়ি, লোকজন, হৈ-চৈ, রাস্তায় গাড়ির ভেঁপু, ট্রামের ঘণ্টা। সব মিলিয়া জিনিসটা মন্দ লাগে না। বাবা তাহাকে বলিয়াছে বড়ো হইলে তাহাকে কলিকাতার কলেজে পড়াইবে। কলিকাতার বড়ো বড়ো কলেজের গল্প বাবা তাহার নিকট করিয়াছে, সেখানে লাইব্রেরিতে কত বই আছে–তাহা নাকি গণিয়া শেষ করা যায় না। ওই সমস্ত বই সে পড়িবে।

    অপুর কাজ ছিল বিকালে। খুব সকালে রওনা হওয়ায় তাহারা বেশি বেলা হইবার আগেই কলিকাতা পৌঁছিয়াছিল। ট্রামে করিয়া অপু এসপ্ল্যানেড আসিয়া নামিয়া বলিল–এইটুকু চল হেঁটে যাই। কেমন দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে।

    যাদুঘরে ঢুকিতেই কাজলের সেই অদ্ভুত ভাবটা হইল–যাহা সে কিছুতেই কাহাকেও বুঝাইয়া উঠিতে পারে না। মাথার মধ্যে কেমন একটা ঝিম-ঝিম ভাব। যাদুঘরের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে, তাহা কাজলকে পুরানো দিনের কথা মনে করাইয়া দেয়। নিজের জীবনের কথা নহে, বাবার কাছে শোনা ইতিহাসের কথা-মানবসৃষ্টির আগেকার পৃথিবীর কথা। সমস্ত আবেদনটা সে ঠিক ধরিতে পারে না। কিন্তু তাহার মনে হয়, এই জীবনের বাহিরে আর একটা বৃহত্তর জীবন তাহাকে হাতছানি দিয়া ডাকিতেছে।

    সারাদিন ভারি আনন্দে কাটিল। প্রাচীন স্তূপ হইতে গুহামানবের মাথার খুলি পর্যন্ত সবকিছুই কাজলের কাছে সমান আকর্ষণীয়। প্রাচীন জীবজন্তুর কঙ্কালগুলি যে ঘরে আছে, সে ঘর ছাড়িয়া কাজল আর নড়িতে চায় না। উল্কাপিণ্ডটার সামনে দাঁড়াইয়া উত্তেজনায় তাহার চোখ কোটর হইতে বাহির হইয়া পড়ে আর কী! ফসিলের ঘরে সে অপুকে জিজ্ঞাসা করে–তুমি যে বলেছিলে পলিমাটিতে তারামাছের ফসিল আছে, সে কই বাবা?

    এ সমস্ত অত্যন্ত পক্কতার লক্ষণ সন্দেহ নাই–কিন্তু অপু কাজলকে এইভাবেই মানুষ করিয়াছিল। এই বয়সে অন্যরা যাদুঘরে গিয়া মুগ্ধ বিস্ময়ে চতুর্দিক একবার দেখিয়া আসে মাত্র। কক্ষ হইতে কক্ষান্তরে ঘুরিয়া পা ব্যথা করিয়া বেতের ঝুড়িতে আনা জলখাবার খাইয়া মা-বাবার সহিত বাড়ি ফিরিয়া যায়। কিন্তু কাজল বুঝিতে চায়, কাজল অনুভব করে।

    বিকালে যাদুঘর বন্ধ হইবার সময় অপু বলিল–চল, এবার আমার কাজটা সেরে আসি। বইএর দোকানের দিকে যেতে হবে।

    পাবলিশারের কাছে কিছু টাকা পাওনা ছিল। দোকানে ঢুকিতেই মালিক হাসিয়া বলিল–আসুন অপূর্ববাবু, বসুন। এবার তো অনেকদিন বাদে এলেন। আপনার ও বইটার স্টক প্রায় শেষ। নতুন এডিশন সম্বন্ধে একটু কথাবার্তা বলে নিতে হয়। এটি কে? বাঃ বেশ বেশ।

    অপুর এসব আজ ভালো লাগিতেছিল না। সকালে খুব আনন্দ করিয়া বাহির হইয়াছিল বটে, কিন্তু দুপুরের পর হইতেই শরীরটা ভালো বোধ হইতেছিল না। বুকের কাছটায় কেমন একটা ব্যথাব্যথা ভাব। এখন আবার নতুন এডিশন সম্বন্ধে বাক্যালাপের ঝামেলা আসিয়া জুটিল।

    সমস্ত কথা মিটিতে প্ৰায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগিল। অপুর মাথা ঘুরিতেছিল। বুকের যন্ত্রণাটাও বেশ বাড়িয়াছে। কেন যে হঠাৎ এমন হইল, বোঝা যাইতেছে না। শরীর লইয়া পূর্বে সে কখনও চিন্তায় পড়ে নাই। দোকান হইতে বাহির হইয়া সে কাজলের হাত ধরিয়া রাস্তা পার হইবার জন্য ফুটপাথ হইতে পিচের রাস্তায় নামিতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীটা যেন তাহার পায়ের নিচু হইতে সরিয়া যাইতে লাগিল হু-হু করিয়া। সে যতই পা নামাইতেছে, পা আর রাস্তায় ঠেকিতেছে না। ফুটপাথ হইতে রাস্তা এত নিচু?

    পরীক্ষণেই বুকের বেদনটা বাড়িয়া উঠিল। মাটিতে পড়িতে পড়িতে সে হাত বাড়াইয়া কাজলকে ধরিতে গেল। কাজল যেন অনেক দূরে সরিয়া গিয়াছে, তাহাকে আর ধরা যাইতেছে না। সব দূরে সরিয়া গিয়াছে। সে একটা অন্ধকার অতল গহ্বরের মধ্যে পড়িতেছে।

    প্রকাশক ভদ্রলোক দোকান হইতে ছুটিয়া আসিলেন, রাস্তায় লোক জমা হইয়া গেল। কাজলের হাত-পা কেমন ঝিমঝিম করিতেছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হতবুদ্ধি হইয়া সাহায্যকারীদের মুখের দিকে কয়েকবার তাকাইয়া দেখিল মাত্র। বাবা পড়িয়া গিয়াছে। ব্যাপারটা তাহার বিশ্বাস হইতেছিল না। তাহার কাছে বাবা সর্বশক্তিমান, বাবার ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য। বাবাকে মাটিতে পড়িতে দেখিয়া কাজলের সমস্ত হৃদয় আতঙ্কে সংকুচিত হইয়া আসিল। অপুকে উহারা ধরাধরি করিয়া দোকানের ভিতর তুলিয়া আনিল। কাজলকে কেহ ডাকিল না। সে নিজেই আস্তে আস্তে হাঁটিয়া সবার পিছন পিছন দোকানে ঢুকিয়া দেখিল, তাহার বাবাকে একটা বেঞ্চির উপর শোওয়াইয়া জলের ছিটা দিয়া বাতাস করা হইতেছে। কাঠের একটা টেবিলে হেলান দিয়া সে ভাবিবার চেষ্টা করিল, বাবার কিছুই হয় নাই-ঘটনাটা একটা দুঃস্বপ্ন। স্বপ্ন ভাঙিয়া গিয়া এখনই দেখিবে সে বাবার পাশে শুইয়া আছে, গল্প শুনিতে শুনিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল।

    মিনিট কুড়ি বাদে অপু তাকাইল। সে চিৎ হইয়া শুইয়া আছে, ওপরে যেন কালো কড়িকাঠ, চারপাশে লোকের কণ্ঠস্বর। বুকে কাহারা একটা ওজন চাপাইয়া দিয়াছে যেন। এটা কোন জায়গা? সে এখানে শুইয়া কেন? একটু বাদেই সমস্ত কিছু মনে পড়িতে সে আচ্ছন্নের মতো হাত বাড়াইয়া বলিল–খোকা কোথায় গেল? খোকা?

    কলিকাতার সেদিনকার সেই ঘটনার পর হইতেই অপুর শরীর খুব ভালো যাইতেছে না। কলিকাতার ভালো স্পেশালিস্ট দেখাইয়াছে। ডাক্তার বলিয়াছে, ব্লাডপ্রেসার আছে, কিডনিও ভালো কাজ করিতেছে না। খাওয়ার ব্যাপারে নজর রাখিতে হইবে। লবণ কম খাইতে বলিয়াছে। অপু হাসিয়া বলিয়াছিল–এই বয়সে প্রেসার হয়? বলিয়াই তাহার মনে হইয়াছিল, খুব একটা কম বয়স তাহার নয়, দেখিতে দেখিতে বয়স বেশ বাড়িয়াছে।

    ডাক্তার বলিলেন–সাধারণত এই বয়সে প্রেসার হয় না। আমার মনে হয়, কিডনির জন্যে এরকম হচ্ছে। কতকগুলো ওষুধ দিলাম, খেয়ে দেখুন কেমন থাকেন।

    ওষুধ খাইয়া অপু বিশেষ উপকারবোধ করিল না। মাঝে মাঝে শরীর খারাপ লাগে, সে আমল দেয় না। হৈমন্তীর কড়া পাহারার জন্য নিয়মের হেরফের হইতে পারে না, খাওয়া শোওযা ইত্যাদি বাঁধা সময়ে করিতে হয়। অপুর স্বাস্থ্যের জন্য হৈমন্তী বড়ো উদ্বিগ্ন–সে কোথাও বাহির হইলে না ফেরা পর্যন্ত হৈমন্তী ঘর-বাহির করে। দেরি হইলে কাজলকে বলে-দেখা তো খোকা একটু এগিয়ে কাঁঠালতলার কাছে, তোর বাবা এলো নাকি–

    অপু বেশিক্ষণ ঘরে থাকিতে পাবে না। তাহার ছেলেবেলা যেন আবার ফিরিয়া আসিয়াছে। বৈকালে রৌদ্র পড়িতে না পড়িতে ছেলেকে লইয়া বাহির হইয়া পড়ে। মাঠে ঘাটে ঘুরিতে ঘুরিতে সন্ধ্যা উতরাইয়া যায়। কোনদিন একই বেড়াইতে যায়। বিকালগুলি তাহার একান্ত নিজস্ব, ব্যক্তিগত। কোন কারণেই একটা বিকাল সে কাহাকেও দিয়া দিতে পারে না। অসুস্থ হইবার পর হইতেই অপুর কেমন একটা ভাব হইয়াছে। প্রায়ই সে বিষণ্ণ মুখে কী যেন ভাবে। প্রকাশকদের নিকট পাওনা টাকার আগে সে হিসাব রাখিত না, এখন বড় একটা খাতা বানাইয়াছে। তাহাতে টাকাকড়ির কথা লিখিয়া রাখে। নিশ্চিন্দিপুরে হৈমন্তীর নামে কিছু জমি কিনিয়াছে, নূতন উপন্যাসখানির টাকা দিয়া হৈমন্তীকে গহনা গড়াইয়া দিয়াছে। হৈমন্তী একদিন চটিয়া বলিল–এ সব শুরু করলে কী! নবাব-বাদশা হয়েছ নাকি? রাজ্যের জমি-জমা, গয়না-পত্তর–এসব তোমার কাছে আমি কবে চেয়েছিলাম?

    –তুমি চাও নি হৈমন্তী, আমি দিচ্ছি।

    হৈমন্তীর ঠোঁট কাঁপিয়া উঠিল–কেন দিচ্ছ? আমি এ সব চাই না।

    –এ সবে তোমার প্রয়োজন নেই, আমি জানি। কিন্তু কাজলের তো ভবিষ্যৎ আছে। প্রথম জীবনটা যেন ওকে কষ্ট করতে না হয়। তারপর চাকরি-বাকরি করলে ওই তোমার ভার নেবে। অন্তত ততদিন–

    হৈমন্তীর চোখে কিসের একটা ঝলক খেলিয়া গেল। সে অপুর কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল–আমার ভার! শুধু আমার ভার। কেন, তুমি–তোমার ভার নেবে না? বলো?

    অপু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পর আস্তে বলিল–হ্যাঁ, আমার ভরও নেবে বইকি। তাবপরই সে হাসিয়া ব্যাপারটা লঘু করিতে গেল বটে, কিন্তু নিজেই বুঝিল হাসিবার জনা তাহাকে চেষ্টা করিতে হইতেছে।

    গম্ভীর হইয়া থাকে সে। মন তা বলিয়া খুব খারাপ নহে। কেমন একটা আনন্দে সে বুঁদ হইয়া অস্তিত্বকে উপভোগ করে। শত কোটি নক্ষত্র এবং নীহারিকার ভিতর নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করিবার তীব্র আনন্দ অন্য সমস্ত কিছু তুচ্ছ করিতে শিখাইয়াছে। মৃত্যুকে সে ভয় করে না। কারণ মৃত্যুর আগেই সে জানিতে পারিয়াছে জীবন কাহাকে বলে। জীবনকে যে জানিতে পারিয়াছে, মৃত্যুকে তাহার ভয় কী?

    আকাশটা দুপুরে ধকধক করিয়া জুলে, বিকালের দিকে স্নিগ্ধ হইয়া আসে। সন্ধ্যায় বাতাসে দিনশেষের সুর বাজে। অন্ধকার ঘন হইলে অপু নদীর ধাবে ঘাসে ছাওয়া ঢালু জমিতে শুইয়া দেখে আকাশে তারা ফুটিয়া উঠিতেছে। তাহার ছোটবেলায্য যেমন উঠিত। এ সময়টা সে নৌকায় কবিঘা নদীর উপর বেড়াইত। ছোটবেলাটা কত দূরে চলিয়া গিয়াছে।

    মনে কোন দুঃখ নাই, কেমন উদার আনন্দ। পাড়ের নিচে নদীর বহিয়া যাইবার সহজ ভঙ্গির মতো আনন্দ। নদীর ওপারে দিগন্তের উপর উল্কাপাত হইল। বুপালী আগুনের তীব্র শিখা সন্ধ্যা আকাশে একটা উজ্জ্বল সরলরেখা টানিয়া দিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে অপুর মনে সুদূরের চিন্তা জাগিয়া উঠিল। উল্কাটি এক বিশাল বিশ্বের দূত–মহাজগতের সংবাদবাহক। তাহার মনটা হঠাৎ বড়ো হইয়া, ব্যাপ্ত হইয়া দেখিতে দেখিতে যেন সমস্ত আকাশে ছড়াইয়া গেল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleতৃতীয় পুরুষ – তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article তারানাথ তান্ত্রিক – তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

    অলাতচক্র – তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 22, 2025
    তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

    তারানাথ তান্ত্রিক – তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 22, 2025
    তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

    তৃতীয় পুরুষ – তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 22, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রঙ্কিণীর রাজ্যপাট এবং অন্যান্য – নবনীতা দেবসেন

    August 30, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রঙ্কিণীর রাজ্যপাট এবং অন্যান্য – নবনীতা দেবসেন

    August 30, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রঙ্কিণীর রাজ্যপাট এবং অন্যান্য – নবনীতা দেবসেন

    August 30, 2025

    আনা ফ্রাঙ্ক-এর ডায়েরি

    August 30, 2025

    আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ১ (অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ)

    August 30, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.