Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কানাইয়ের কথা

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প1117 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ফার্স্ট ক্লাস কামরা

    আগের আমলের ফার্স্ট ক্লাস কামরা—বাথরুম সমেত ফোর বার্থ বা সিক্স বার্থ কম্পার্টমেন্ট—আজকাল উঠেই গেছে। এটা যে সময়ের গল্প, অর্থাৎ নাইনটীন সেভেনটি—তখনও মাঝে মাঝে এক আধটা এই ধরনের কামরা কী করে জানি ট্রেনের মধ্যে ঢুকে পড়ত। যাদের পুরোন ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা আছে, সেই সব ভাগ্যবান যাত্রী এমন একটি কামরা পেলে মনে করত হাতে চাঁদ পেয়েছে।

    রঞ্জনবাবুও ঠিক তেমনই বোধ করলেন গাড়িতে উঠে। প্রথমে তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি। এই ধরনের কামরায় শেষ কবে তিনি চড়েছেন তা আর মনে নেই। পয়সাওয়ালা বাপের ছেলে, তাই ফার্স্ট ক্লাসে চড়ার অভ্যাস ছেলেবেলা থেকেই। একক কামরা উঠে গিয়ে যখন ছয় কামরা বিশিষ্ট করিডর ট্রেন চালু হল, তখন রঞ্জনবাবু বুঝলেন আরেকটা আরামের জিনিস দেশ থেকে উঠে গেল। গত কয়েক বছর থেকেই এ জিনিসটা লক্ষ করে আসছেন তিনি। বাপের ছিল ব্যইক্‌ গাড়ি। পিছনের সীটে চিত হয়ে পা ছড়িয়ে বসে কত বেড়িয়েছেন সে গাড়িতে। তারপর এল ফিয়াট-অ্যামবাসাডরের যুগ। আরামের শেষ। বৃটিশ আমলে টেলিফোন তুললে মহিলা অপারেটর বলতেন ‘নাম্বার প্লীজ’; তারপর নম্বর চাইলেই লাইন পাওয়া যেত নিমেষের মধ্যে। আর এখন ডায়াল করতে করতে তর্জনীর ডগায় কড়া পড়ে যায়। সমস্ত কলকাতা শহর থেকেই যেন আরাম জিনিসটা ক্রমশঃ লোপ পেয়ে যাচ্ছে। ট্রামে বাসে তাঁকে চড়তে হয়নি কোনদিন, কিন্তু মোটর গাড়িতেই বা কী সুখ আছে? ট্র্যাফিক জ্যামের ঠেলায় প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে, গাড্‌ডায় গাড়ি পড়লে শরীরের হাড়গোড় আলগা হয়ে আসে।

    রঞ্জনবাবুর মতে এ সবই আসলে দেশ স্বাধীন হবার ফল। সাহেবদের আমলে এমন মোটেই ছিল না। কলকাতাকে তখন সত্যিই একটা সভ্য দেশের সভ্য শহর বলে মনে হত।

    রঞ্জনবাবুর বছর তিনেক আগে ছ’মাস কাটিয়ে এসেছেন লণ্ডন শহরে। সাহেবরা বাঁচতে জানে, সুনিয়ন্ত্রিত জীবনের মূল্য জানে, সিভিক সেন্স কাকে বলে জানে। ঘড়ির কাঁটার মতো লণ্ডন টিউবের গতিবিধি দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়। আর যেমন মাটির নিচে, তেমন মাটির উপরে। ওখানেও ত জনসংখ্যা নেহাত কম নয়, কিন্তু কই, বাসস্টপে ত ধাক্কাধাক্কি নেই, গলাবাজি নেই, কণ্ডাক্টরের হুঙ্কার আর বাসের গায়ে চাপড় মারা নেই। ওদের বাস ত একদিকে কাৎ হয়ে চলে না যে মনে হবে এই বুঝি উল্টে পড়ল।

    বন্ধুমহলে রঞ্জনবাবুর উগ্র সাহেবপ্রীতি একটা প্রধান আলোচনার বিষয়। ঠাট্টারও বটে আর সেই কারণেই হয়ত রঞ্জনবাবুর বন্ধুসংখ্যা ক্রমে কমে এসেছে। শহরে যেখানে সাহেব প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে, সেখানে অনবরত সাহেব আর সাহেবী আমলের গুণকীর্তন কটা লোক বরদাস্ত করতে পারে? পুলকেশ সরকার ছেলেবেলার বন্ধু তাই তিনি এখনো টিকে আছেন, কিন্তু তিনিও সুযোগ পেলে বিদ্রূপ করতে ছাড়েন না। বলেন, ‘তোমার এ দেশে জন্মানো ভুল হয়েছে। তোমার জাতীয় সংগীত হল গড় সেভ দ্য কুইন, জনগণমন নয়। এই স্বাধীন নেটিভ দেশে তুমি আর বেশিদিন টিকতে পারবে না।’

    রঞ্জনবাবু উত্তর দিতে ছাড়েন না।—‘যাদের যেটা গুণ, সেটা অ্যাডমায়ার না করাটা অত্যন্ত সংকীর্ণ মনের পরিচায়ক। বাঙালীরা কলকাতা নিয়ে বড়াই করে—আরে বাবা, কলকাতা শহরের যেটা আসল বিউটি, সেই ময়দানও ত সাহেবদেরই তৈরি। শহরের যা কিছু ভালো সে ত তারাই করে দিয়ে গেছে। শ্যামবাজার বাগবাজার ভবানীপুরকে ত তুমি সুন্দর বলতে পার না। তবে এটাও ঠিক যে ভালোগুলো আর ভালো থাকবে না বেশি দিন। আর তার জন্য দায়ী হবে এই নেটিভ বাঙালীরাই।’

    মধ্যপ্রদেশের রায়পুর শহরে দুই বন্ধুতে গিয়েছিল ছুটি কাটাতে। রঞ্জন কুণ্ডু একটা সাহেবী নামওয়ালা সদাগরী অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। পুলকেশ সরকার একটি বড় বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। এবার পুজো ঈদ মিলিয়ে দুজনেরই দশ দিনের ছুটি পড়ে গেল। রায়পুরে দুজনের কমন ফ্রেণ্ড মোহিত বোসের সঙ্গে এক হপ্তা কাটিয়ে গাড়িতে করে বস্তারের অরণ্য অঞ্চল ঘুরে দেখে দুজনের একসঙ্গে কলকাতা ফেরার কথা ছিল। পুলকেশবাবু একবার বলেছিলেন ভিলাইতে তাঁর এক খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে দুদিন কাটিয়ে ফিরবেন, কিন্তু রঞ্জনবাবু রাজি হলেন না। বললেন, ‘এসেছি একসঙ্গে, ফিরবও একসঙ্গে। একা ট্র্যাভেল করতে ভালো লাগে না ভাই।’

    শেষ পর্যন্ত স্টেশনে গিয়েও পুলকেশবাবুকে থেকেই যেতে হল। ভিলাই রায়পুর থেকে মাত্র মাইল দশেক। পুলকেশবাবু আসতে পারবেন না জেনে খুড়তুতো ভাই সশরীরে এসে হাজির হলেন দাদাকে বগলদাবা করে নিয়ে যাবার জন্য। ভিলাইয়ের বাঙালীরা বিসর্জন নাটক মঞ্চস্থ করবে পুজোয়, পুলকেশবাবুর থিয়েটারের নেশা, ভাইয়ের অনুরোধ তিনি যদি গিয়ে নির্দেশনার ব্যাপারে একটু সাহায্য করেন। পুলকেশবাবু আর না করতে পারলেন না।

    রঞ্জনবাবু হয়ত খুবই মুসড়ে পড়তেন, কিন্তু পুরোন ফার্স্ট ক্লাস কামরাটি দেখে তিনি এতই বিস্মিত ও পুলকিত হলেন যে বন্ধুর অভাবটা আর অত তীব্রভাবে অনুভব করলেন না। আশ্চর্য এই যে, সেকালের হলেও কামরার অবস্থা দিব্যি ছিমছাম। সব কটি আলোরই বালব রয়েছে, পাখাগুলো চলে, সীটের চামড়া কোথাও ছেঁড়া নেই, বাথরুমটিও পরিপাটি।

    আরো বড় কথা হচ্ছে ফোর বার্থ কামরায় রঞ্জন কুণ্ডু আর পুলকেশ সরকার ছাড়া আপাতত আর কেউ যাত্রী নেই। পুলকেশবাবু খোঁজ নিয়ে জানালেন, ‘তুমি রাউরকেলা পর্যন্ত একা যেতে পারবে। সেখানে একটি যাত্রী উঠবেন, তারপর আর কেউ নেই। দুটো আপার বার্থ সারা পথই খালি যাবে।’

    রঞ্জনবাবু বললেন, ‘তোমাকে এই পুরোন কামরার আরামের কথা অনেকবার বলেছি, আপশোস এই যে এতে ট্র্যাভেল করার সুযোগ পেয়েও নিতে পারলে না।’

    বন্ধু হেসে বললেন, ‘হয়ত দেখবে কেল্‌নারের লোক এসে তোমার ডিনারের অর্ডার নিয়ে গেল।’

    ‘ওটা বলে আবার মন খারাপ করে দিও না’, বললেন রঞ্জনবাবু। ‘ট্রেনে খাবার কথা ভাবতে গেলে এখন কান্না আসে। আমাদের ছেলেবেলায় কেল্‌নারের লাঞ্চ আর ডিনারের জন্য আমরা মুখিয়ে থাকতাম।’

    রঞ্জনবাবু অবিশ্যি বন্ধুর বাড়ি থেকে লুচি তরকারি নিয়ে এসেছেন টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে। রেলের থালিতে তাঁর আদৌ রুচি নেই।

    যথাসময়ে বোম্বে মেল ছেড়ে দিল। ‘কলকাতায় দেখা হবে ভাই’, বললেন পুলকেশ সরকার। ‘তোমার জার্নি আরামদায়ক হবে তাতে সন্দেহ নেই।’

    গাড়ি ছাড়ার পরে রঞ্জনবাবু মিনিট খানেক শুধু কামরার মধ্যে পায়চারি করলেন। এ সুখ বহুকাল পাননি তিনি। আজকালকার কামরায় ট্রেন ছাড়লে পরে সীটে বসে পড়া ছাড়া আর গতি নেই। বাইরে করিডর আছে বটে, কিন্তু তা এতই সংকীর্ণ সেখানে হাঁটা চলে না। এক স্টেশন এলে প্ল্যাটফর্মে নেমে পায়চারি করা যায়, তাছাড়া সারা রাস্তা অনড় অবস্থা।

    কিছুক্ষণ হাঁটার পর কোন সীটটা দখল করবেন এই নিয়ে একটু চিন্তা করে শেষে রায়পুরের প্ল্যাটফর্মের দিকের সীটটায় বসে সুটকেস থেকে একটা বালিশ ও একটা ডিটেকটিভ বই বার করে শুয়ে পড়লেন রঞ্জনবাবু। এখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। অন্ধকার হয়ে যাবে একটুক্ষণের মধ্যেই। তবে বই পড়া বন্ধ করার প্রয়োজন নেই, কারণ মাথার পিছনে রীডিং লাইট আছে, এবং সেটা জ্বলে।

    নটায় রায়গড় পেরোনর পর থেকেই একটা ঘুমের আমেজ অনুভব করলেন রঞ্জনবাবু। বিলাসপুরে লোক এসেছিল ডিনারের অর্ডার নিতে। রঞ্জনবাবু স্বভাবতই তাকে না করে দিয়েছেন। এবারে, টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খাওয়াটা সেরে নীল লাইট ছাড়া আর সব কটা আলো নিভিয়ে দিয়ে রঞ্জনবাবু বেঞ্চিতে গা এলিয়ে দিলেন। দেওয়া মাত্র মনে পড়ল রাউরকেলায় যাত্রী ঢুকবে ঘরে। আজকাল করিডর ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাসে কোনো যাত্রী উঠলে কন্ডাক্টর গার্ডই তার ব্যবস্থা করে দেয়। এই পুরোন গাড়িতে তাঁকেই উঠে দরজা খুলতে হবে। তাহলে কি দরজাটা লক্‌ করবেন না? যদি ঘুম না ভাঙে? ক্ষতি কি লক্‌ না করলে? যিনি আসবেন তিনিই না হয় লক্‌ লাগিয়ে নেবেন। আর এমন কিছু মাঝ রাত্তির নয় তো, রাউরকেলা আসে বোধহয় সাড়ে দশটা নাগাদ। চিন্তার কোন কারণ নেই।

    বেদম বেগে ছুটে চলেছে বোম্বাই মেল। কামরার দোলানিতে কারুর কারুর ভালো ঘুম হয় না, কিন্তু রঞ্জনবাবুর হয়। কোথায় যেন পড়েছিলেন যে মা শিশুকে কোলে দোল দিয়ে ঘুম পাড়ানোর স্মৃতি শিশু বড় হলেও তার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে, তাই ট্রেনের দোলানিতে ঘুম পাওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। ছেলেবেলায় ফার্স্ট ক্লাসে খাওয়া কেল্‌নারের চিকেন কারি অ্যাণ্ড রাইস আর কাস্টার্ড পুডিং-এর মধুর স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে রঞ্জনবাবু নিদ্রাসাগরে তলিয়ে গেলেন।

    ‘গরম চায়! চায় গরম!’

    ঘুমটা ভাঙল খোলা জানালার বাইরে থেকে ফেরিওয়ালার ডাক শুনেছি স্টেশন। প্ল্যাটফর্মের ল্যাম্পপোস্ট থেকে আলোর রশ্মি টেরচা ভাবে কামরায় ঢুকে তাঁর নিজের শরীর ও মেঝের খানিকটা অংশে পড়েছে।

    ‘হিন্দু চায়! হিন্দু চায়!!’

    কী আশ্চর্য অপরিবর্তনশীল এই স্টেশনের ফেরিওয়ালার ডাক। মনে হয় একই লোক ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি স্টেশনে ঠিক একই ভাবে ডেকে চলেছে আবহমানকাল থেকে।

    জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে স্টেশনের নাম দেখতে পেলেন না রঞ্জনবাবু। রাউরকেলা নয় ত?

    নামটা মনে পড়তেই রঞ্জনবাবুর চোখ চলে গেল বেঞ্চির বিপরীত দিকে। একটা টুং টুং আওয়াজ কানে এসেছিল ঘুমটা ভাঙামাত্র। এবার আবছা নীল আলোয় দেখলেন একটি লোক বসে আছে বেঞ্চিতে। তার সামনে দুটো বোতল ও একটি গেলাস। গেলাসে পানীয় ঢাললেন ভদ্রলোক এইমাত্র। এবার সেই পানীয় চলে গেল তার মুখের দিকে।

    মদ খাচ্ছেন নাকি সহযাত্রী? উনিই কি রাউরকেলায় উঠেছেন? এটা কি তাহলে চক্ৰধরপুর? বড় স্টেশন বলেই ত মনে হচ্ছে।

    রঞ্জনবাবু আগন্তুকের দিকে চেয়ে দেখলেন। মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, তবে একটা বেশ তাগড়াই গোঁফ রয়েছে ভদ্রলোকের সেটা বোঝা যায়। পরনে শার্ট ও প্যাণ্ট, তবে নীল আলোতে তাদের রঙ বোঝা মুশকিল।

    রঞ্জনবাবুকে নড়াচড়া করতে দেখেই বোধহয় আগন্তুক তাঁর সম্বন্ধে হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠলেন। মদের গন্ধ পাচ্ছেন রঞ্জনবাবু। তাঁর নিজের ওসব বদ অভ্যাস সেই, কিন্তু চেনাশোনার মধ্যে অনেকেই ড্রিংক করে। পার্টি-টাটিতেও যেতে হয় তাঁকে। কাজেই কোন্‌ পানীয়ের কী গন্ধ সেটা মোটামুটি জানা আছে। ইনি খাচ্ছেন হুইস্কি।

    ‘ইউ দেয়ার।’

    সোজা রঞ্জনবাবুর দিকে মুখ করে ঘড়ঘড়ে গলায় হাঁক দিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক।

    গলা এবং উচ্চারণ শুনে রঞ্জনবাবুর বুঝতে বাকি রইল না যে যিনি উঠেছেন তিনি হচ্ছেন সাহেব। এ গলার দানাই আলাদা।

    ‘ইউ দেয়ার!’ আবার হাঁক দিয়ে উঠলেন অন্ধকারে বসা সাহেবটি। নেশা হয়ে গেছে এর মধ্যেই, নইলে আর এত মেজাজের কী কারণ থাকতে পারে?

    ‘আপনি কিছু বলতে চাইছেন কি?’ ইংরিজিতে প্রশ্ন করলেন রঞ্জনবাবু। মনে মনে বললেন পুরোন ফার্স্ট ক্লাসের সঙ্গে মানানসই বটে এই সাহেব সহযাত্রী।

    ‘ইয়েস’ বললেন সাহেব। ‘গেট আউট অ্যাণ্ড লীভ মি অ্যালোন।’

    অর্থাৎ ভাগো হিঁয়াসে। আমি একা থাকতে চাই।

    এবার রঞ্জনবাবু বুঝলেন যে সাহেবের নেশাটা বেশ ভালোমতোই হয়েছে। কিন্তু কথাটার ত একটা উত্তর দিতে হয়। যথাসাধ্য শান্তভাবে বললেন, ‘আমারও রিজার্ভেশন রয়েছে এই কামরায়। আমরা দুজনেই থাকব এখানে—তাতে ক্ষতিটা কী?’

    গার্ডের হুইস্‌লের সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের ভোঁ শোনা গেল, আর পর মুহূর্তেই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বোম্বে মেল আবার রওনা দিল। রঞ্জনবাবু আড়চোখে স্টেশনের নামটা দেখে নিলেন। চক্রধরপুরই বটে।

    এখন ঘরে নীল নাইট লাইট ছাড়া আর কোনো আলো নেই। রঞ্জনবাবু সাহেবটিকে একটু ভালো করে দেখার জন্য এবং মনে আরেকটু সোয়াস্তি আনার জন্য অন্য বাতি জ্বালানোর উদ্দেশ্যে সুইচের দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন, কিন্তু সাহেবের ‘ডোণ্ট!’ হুঙ্কার তাঁকে নিরস্ত করল। যাই হোক্‌ এতক্ষণে রঞ্জনবাবুর চোখ অন্ধকারে সয়ে গেছে। এখন সাহেবের মুখ অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট। গোঁফ জোড়াটাই সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে। চোখ দুটো কোটরে বসা। নীল আলোতে গায়ের রঙ ভারী ফ্যাকাসে মনে হচ্ছে। মাথার চুল সোনালী না সাদা সেটা বোঝার উপায় নেই।

    ‘আমি নিগারের সঙ্গে এক কামরায় থাকতে রাজি নই। তোমায় বলছি তুমি নেমে পড়।’

    নিগার! উনিশশো সত্তর সালে ভারতবর্ষে বসে কোনো ভারতীয়কে নিগার বলার সাহস কোনো সাহেবের হতে পারে এটা রঞ্জনবাবু ভাবতে পারেননি। বৃটিশ আমলে এ জিনিস ঘটেছে এ গল্প রঞ্জনবাবু শুনেছেন। সব সময়ে যে বিশ্বাস হয়েছে তা নয়। সাহেবদের সম্বন্ধে অনেক মিথ্যে অপবাদ রটিয়েছে বাঙালীরা। আর যদি বা সত্যি হয়ে থাকে, সে সব সাহেব নিশ্চয়ই খুব নিম্নস্তরের। ভদ্র সাহেব, সভ্য সাহেব যারা, তারা ভারতীয়দের সঙ্গে এ ধরনের ব্যবহার কখনই করতে পারে না।

    রঞ্জনবাবুর বিস্ময়ের ভাবটা কেটে গেছে। তবে এখনও ধৈর্যচ্যুতি হয়নি। মাতালের ব্যাপারে ধৈর্যহারা হলে চলে না। সুস্থ অবস্থায় এ সাহেব কখনই এ ধরনের কথাবার্তা বলতে পারত না।

    রঞ্জনবাবু সংযতভাবে বললেন, ‘তুমি যে ভাবে কথা বলছ, সেরকম কিন্তু আজকাল আর কোনো সাহেব বলে না। ভারতবর্ষ আজ বছর পঁচিশেক হল স্বাধীন হয়েছে সেটা বোধ হয় তুমি জান।’

    ‘হোয়াট?’

    কথাটা বলেই সাহেব রঞ্জনবাবুকে চমকে দিয়ে ট্রেনের শব্দ ছাপিয়ে হো হো করে অট্টহাস্য করে উঠলেন।

    ‘কী বললে তুমি? ভারত স্বাধীন হয়েছে? কবে?’

    ‘নাইনটীন ফর্টি সেভন। অগাস্ট দ্য ফিফটীনথ্‌।’

    কথাটা বলতে গিয়ে রঞ্জনবাবুর হাসি পাচ্ছিল। স্বাধীনতার এতদিন পরে নিজের দেশে বসে কাউকে তারিখ সমেত খবরটা দিতে হচ্ছে এটা একটা কমিক ব্যাপার বৈকি!

    ‘ইউ মাস্ট বি ম্যাড!’

    ‘আমি ম্যাড নই সাহেব’, বললেন রঞ্জনবাবু। ‘আমার মনে হয় তোমার নেশাটা একটু বেশি হয়েছে।’

    ‘বটে?’

    সাহেব হঠাৎ তাঁর ডান দিকে বেঞ্চির উপর থেকে একটা জিনিস তুলে নিলেন।

    রঞ্জনবাবু সভয়ে দেখলেন সেটা একটা রিভলভার, আর সেটা সটান তাঁরই দিকে তাগ করা।

    ‘সী দিস?’ বললেন সাহেব। ‘আমি আর্মির লোক। আমার নাম মেজর ড্যাভেনপোর্ট। সেকেণ্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। আমার মত অব্যর্থ নিশানা আর কারুর নেই আমার রেজিমেণ্টে। আমার হাত কাঁপছে কি? তোমার শার্টের তৃতীয় বোতামের ডান দিকে আমার লক্ষ্য। ঘোড়া টিপলে সেইখান দিয়ে গুলি ঢুকে সোজা জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তোমার আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। ভালো চাও ত বেরিয়ে পড়। একে ত নিগার। তার উপরে উন্মাদ, এটা কত সাল জান? নাইনটীন থার্টিটু। আমাদের অনেক উত্যক্ত করেছে তোমাদের ওই নেংটি পরা নেতা। স্বাধীনতার স্বপ্ন তোমরা দেখতে পার, কিন্তু সেটা বাস্তবে পরিণত হবে না কখনই।’

    ফার্স্ট ক্লাস কামরা

    এবার সত্যিই প্রলাপ বকছেন সাহেব। উনিশশো সত্তর হয়ে গেল নাইনটীন থার্টিটু? নেংটি পরা নেতা গান্ধীজী মারা গেছেন তাও হয়ে গেছে তেইশ বছর।

    ‘কাম অন নাউ, গেট আপ।’

    সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছেন। রঞ্জনবাবু লক্ষ করলেন তাঁর পা টলছে না। সবে শুরু করলেন কি তাহলে মদ থেকে? কিন্তু এত উল্টোপাল্টা বকছেন কেন? উনিই কি তাহলে উন্মাদ?

    ‘আপ! আপ!’

    রঞ্জনবাবুর গলা শুকিয়ে গেছে। তিনি সীট ছেড়ে মেঝেতে নামতে বাধ্য হলেন। সেই সঙ্গে প্রায় তাঁর অজান্তেই তাঁর হাত দুটো উপরের দিকে উঠে গেল।

    ‘নাউ টার্ন রাউণ্ড অ্যাণ্ড গো টু দ্য ডোর।’

    সাহেব বলে কি? কমপক্ষে ষাট মাইল বেগে চলেছে মেল ট্রেন। তিনি কি চলন্ত অবস্থায় তাঁকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে চান?

    এই অবস্থাতেও কোনো মতে একটি কথা উচ্চারণ করতে সমর্থ হলেন রঞ্জনবাবু।

    ‘শুনুন মেজর ড্যাভেনপোর্ট—এর পরেই টাটানগর। গাড়ি থামলে আমি যাব অন্য কামরায়—কথা দিচ্ছি। চলন্ত গাড়ি থেকে নামিয়ে আমাকে মেরে ফেলে আপনার কি লাভ?’

    ‘টাটানগর? ও নামে কোনো স্টেশন নেই। তুমি আবার আবোল তাবোল বকছ।’

    রঞ্জনবাবু বুঝলেন যে এটা উনিশশো বত্রিশ সাল সেটা যদি সাহেব বিশ্বাস করে বসে থাকেন তাহলে অবিশ্যি টাটানগর বলে কোনো স্টেশন থাকার কথা নয়। এখানে প্রতিবাদ করাটা খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বলে বললেন, ‘ঠিক আছে, মেজর ড্যাভেনপোর্ট আমারই ভুল। তবে এর পর অন্য যে কোনো স্টেশনে গাড়ি থামুক, আমি নেমে যাব। ঘণ্টাখানেকের বেশি তোমার নিগারের সঙ্গ বরদাস্ত করতে হবে না কথা দিচ্ছি।’

    সাহেব যেন একটু নরম হয়ে বললেন, ‘মনে থাকে যেন, কথার নড়চড় হলে তোমার লাশ পড়ে থাকবে লাইনের ধারে এটা বলে দিলাম।’

    সাহেব গিয়ে তাঁর জায়গায় বসে হাত থেকে রিভলভার নামিয়ে রাখলেন বেঞ্চির এক পাশে। রঞ্জনবাবু এ যাত্রা প্রাণে মরেননি এটা ভেবে খানিকটা ভরসা পেয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন। সাহেব যাই বলুন, এর পরের স্টেশন যে টাটানগর সেটা রঞ্জনবাবু জানেন। আসতে আরো এক ঘণ্টা দেরি। এই সময়টুকু তিনি এই কামরাতেই আছেন। তারপর কপালে কী আছে জানা নেই। অন্য ফার্স্ট ক্লাস কামরায় জায়গা পাবেন কি? সেটা জানা নেই। জানার উপায়ও নেই।

    ড্যাভেনপোর্ট সাহেব আবার মদ্যপান শুরু করেছেন। সাময়িকভাবে তাঁর সামনের বেঞ্চের যাত্রীর কথাটা তিনি যেন ভুলেই গেছেন। রঞ্জনবাবু আধ বোজা চোখে চেয়ে রয়েছেন তাঁর দিকে। এমন এক বিভীষিকাময় ঘটনার মধ্যে তাঁকে পড়তে হবে কে জানত? পুলকেশ থাকলে এ জিনিস ঘটত কি? না, তা ঘটত না। তবে এর চেয়েও সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারত। পুলকেশ রগচটা মানুষ। তাছাড়া শারীরিক শক্তি রাখে যথেষ্ট। তার দেশাত্মবোধ প্রবল। কোনো সাদা চামড়ার কাছ থেকে অপমান হজম করার লোক সে নয়। হয়ত ধাঁ করে একটা ঘুঁষিই লাগিয়ে দিত। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় এক গোরাকে ঘুঁষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেবার গল্প সে এখনো করে।

    ট্রেন চলেছে রাতের অন্ধকার ভেদ করে। মিনিট দশেক পরে রঞ্জনবাবু অনুভব করলেন যে এই বিপদের মধ্যেও গাড়ির দোলানিতে তাঁর মাঝে মাঝে একটা তন্দ্রার ভাব আসছে।

    এই অবস্থাতেই একটা নতুন চিন্তা তাঁকে হঠাৎ সম্পূর্ণ সজাগ করে দিল।

    সাহেবের কোনো মালপত্র নেই। ব্যাপারটা অদ্ভুত নয় কি? একটা সামান্য হাত-বাক্সও কি থাকবে না? শুধু মদ, সোডার বোতল, গেলাস আর রিভলভার নিয়ে কি কেউ ট্রেনে ওঠে?

    আর উনিশশো বত্রিশ সাল, নেংটি পরা নেতা, টাটানগর নেই—এসবেরই বা মানে কি?

    মানে কি তাহলে একটাই যে সাহেব আসলে জ্যান্ত সাহেব নন, তিনি ভূত?

    মেজর ড্যাভেনপোর্ট নামটা কি চেনা চেনা লাগছে?

    হঠাৎ ধাঁ করে রঞ্জনবাবুর একটা কথা মনে পড়ে গেল।

    বছর পাঁচেক আগে ব্যারিস্টার বন্ধ নিখিল সেনের বাড়িতে আড্ডায় কথা হচ্ছিল। বিষয়টা সাহেব প্রীতি এবং সাহেব বিদ্বেষ। কে বলেছিল ঠিক মনে নেই, কিন্তু বোম্বে মেলেই একবার এক বাঙালীকে ফার্স্ট ক্লাস কামরা থেকে নামিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল এক গোরা সৈনিক। নামটা মেজর ড্যাভেনপোর্টই বটে। কাগজে বেরিয়েছিল খবরটা। সালটা জানা নেই, তবে থার্টিটু হওয়া আশ্চর্য না। সাহেবের হিসেবে একটু ভুল হয়েছিল। সেই বাঙালী ছিলেন অসীম সাহস ও দৈহিক শক্তির অধিকারী। অপমান হজম করতে না পেরে সাহেবকে মারেন এক বিরাশি শিক্কা ওজনের ঘুঁষি। সাহেব উল্টে পড়েন এবং বেঞ্চির হাতলে মাথায় চোট লেগে তৎক্ষণাৎ মারা যান।

    রঞ্জনবাবু অনুভব করলেন তাঁর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কিন্তু এই অবস্থাতেও সামনের লোকটার দিকে আরেকবার না চেয়ে থাকতে পারলেন না তিনি।

    মেজর ড্যাভেনপোর্ট হাতে গেলাস নিয়ে বসে আছেন। নাইট লাইটের আলো এমনিতেই উজ্জ্বল নয়; আলোর শেডও অপরিষ্কার, বাল্‌বের পাওয়ারও বেশি নয়। তার উপর গাড়ির ঝাঁকুনি। সব মিলিয়ে সাহেবের দেহটাকে অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। হয়ত এই কামরাতেই সাহেবের মত্যু হয়েছিল—১৯৩২ সালে। আর তখন থেকেই এই পুরোন আমলের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় রোজ রাত্তিরে……

    রঞ্জনবাবু আর ভাবতে পারলেন না। সাহেব আর তাঁর দিকে দৃকপাত করছেন না; তিনি মদ নিয়ে মশগুল হয়ে বসে আছেন।

    চেয়ে থাকতে থাকতে রঞ্জনবাবু অনুভব করলেন যে তাঁর চোখের পাতা আবার ভারী হয়ে আসছে। ভূতের সামনে পড়ে মানুষের ঘুম পেতে পারে এটা তিনি প্রথম আবিষ্কার করলেন। মেজর ড্যাভেনপোর্ট একবার নেই, একবার আছেন। অর্থাৎ চোখের পাতা বন্ধ হলে নেই, আবার খুললেই আছেন। একবার যেন সাহেব তাঁর দিকে চাইলেন। তারপর যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসা একটা কথা বার কয়েক এলো তাঁর কানে—‘ডার্টি নিগার…ডার্টি নিগার…’

    তারপর রঞ্জনবাবুর আর কিছু মনে নেই।

    রঞ্জনবাবুর যখন ঘুম ভাঙল তখন জানালার বাইরে ভোরের আলো। সামনের বেঞ্চে কেউ নেই। রাত্রের বিভীষিকার কথা ভেবে তিনি একবার শিউরে উঠলেন, কিন্তু পরক্ষণেই ফাঁড়া কেটে গেছে বুঝতে পেরে হাঁপ ছাড়লেন। এ গল্প কাউকে বলা যাবে না। প্রথমত, কেউ বিশ্বাস করবে না; দ্বিতীয়ত, তিনি যে সাহেব ভূতের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করেছেন এটা খুব জাহির করে বলার ঘটনা নয়। ডার্টি নিগার। কথাটা তাঁর আঁতে লেগেছিল বিশেষ ভাবে, কারণ তাঁর নিজের রং রীতিমতো ফরসা। অনেক রোদে পোড়া সাহেবের চেয়ে বেশি ফরসা! এই রঙের জন্য লণ্ডনে অনেকে তাঁকে ভারতীয় বলে বিশ্বাস করেনি। আর তাঁকেই কিনা বলে ডার্টি নিগার!

    সঙ্কল্প অনুযায়ী তাঁর ট্রেনের অভিজ্ঞতাটা রঞ্জনবাবু কাউকেই বলেননি। তবে তাঁর মধ্যে উগ্র সাহেবপ্রীতির ভাবটা যে অনেকটা কমেছে সেটা তাঁর কাছের লোকেরা অনেকেই লক্ষ করেছিল।

    ঘটনার দশ বছর পরে একদিন সন্ধ্যায় তাঁর নিজের বাড়িতে বন্ধু পুলকেশের সঙ্গে বসে কফি খেতে খেতে রঞ্জনবাবু ব্যাপারটা উল্লেখ না করে পারলেন না।

    ‘সেভেনটিতে রায়পুর থেকে ফেরার সেই দিনটার কথা মনে পড়ে?’

    ‘বিলক্ষণ।’

    ‘তোমাকে বলি বলি করেও বলিনি, এক সাহেব ভূতের পাল্লায় পড়ে কী নাজেহাল হয়েছিলাম জান না।’

    ‘মেজর ড্যাভেনপোর্টের ভূত কি?’

    রঞ্জনবাবুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।

    ‘সে কি? তুমি জানলে কী করে?’

    পুলকেশবাবু তাঁর ডান হাতটা বন্ধুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

    ‘মীট দ্য গোস্ট অফ মেজর ড্যাভেনপোর্ট।’

    রঞ্জনবাবুর মাথা ঝিম ঝিম করছে।

    ‘তুমি! তা তুমি অ্যান্দিন—?’

    ‘বলে ফেললে ত সমস্ত ব্যাপারটাই ব্যর্থ হত ভাই। আমার উদ্দেশ্য ছিল তোমার মধ্যে থেকে সাহেব প্রীতির ভূতটা তাড়ানো। ঘটনাটা যদি তুমি বিশ্বাস না কর, তাহলে কাজটা হবে কি করে? আমি নিগার বলছি, আর সাহেব নিগার বলছে—দুটোর মধ্যে তফাত নেই?’

    ‘কিন্তু কী ভাবে—?’

    ‘ভেরি ইজি’, বললেন পুলকেশ সরকার। ‘তোমার কামরাটা দেখেই ফন্দিটা আমার মাথায় আসে। গাড়ি ছাড়ার পর তোমার পাশের ফার্স্ট ক্লাস বগিটাতে উঠে পড়ি। আমার ফার্স্ট এড বক্স থেকে তুলে নিয়ে গোঁফ করেছিলাম। তাছাড়া নো মেক আপ। আমারই কামরায় একটি গুজরাটি বাচ্চার হাতে দেখলাম একটা খেলার রিভলভার। এক রাতের জন্য ধার চাইতে খুশি হয়ে দিয়ে দিল। তার বাপের সঙ্গে হুইস্কি ছিল। সেটাও চেয়ে নিলাম। অবিশ্যি কেন নিচ্ছি সেটাও বলতে হল। আমি নিজে খেয়েছি শুধু জল। হুইস্কির বোতলটা খোলা রেখেছিলাম যাতে তুমি গন্ধ পাও। ব্যস্‌। বাকি কাজ করেছিল তোমার কামরার নীল আলো, আর তোমার কল্পনা।…আশা করি কিছু মনে করনি ভাই।’

    রঞ্জনবাবু বন্ধুর হাতটা দুহাতে চেপে ধরলেন বটে, কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলেন না।

    তাঁর বিস্ময়ভাবটা কাটতে লাগবে আরো দশ বছর।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসুজন হরবোলা – সত্যজিৎ রায়
    Next Article জবর বারো – সত্যজিৎ রায়

    Related Articles

    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }