Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কানাইয়ের কথা

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প1117 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কানাইয়ের কথা

    ॥ ১ ॥

    নসু কবরেজ প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে বলরামের নাড়ী ধরে বসে রইলেন। শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে বলরামের সতের বছরের ছেলে কানাই কবরেজের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। আজ দশ দিনহল তার বাপের অসুখ। কোনো কিছু খাবারে তার রুচি নেই; এক টানা দশ দিন না খেয়ে সে শুকিয়ে গেছে, তার চোখ কোটরে বসে গেছে, তার সর্বাঙ্গ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তিন ক্রোশ পায়ে হেঁটে কানাই নসু কবরেজের কাছে গিয়ে তাঁর হাতে পায়ে ধরে তাঁকে নিয়ে এসেছে তার বাপের চিকিৎসার জন্য। এ রোগের নাম কী তা কানাই জানে না। কবরেজ জানেন কি? তাঁর চোখের ভ্রূকুটি দেখে কেমন যেন সন্দেহ হয়। মোট কথা এ যাত্রা তার বাপ না বাঁচলে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। আপন লোক বলতে তার আর কেউ নেই। নন্দীগ্রামে দু বিঘে জমি আর একজোড়া হাল বলদ নিয়ে থাকে বাপ-ব্যাটায়। ক্ষেতে যা ফসল হয় তাতে মোটামুটি দুবেলা দু মুঠো খেয়ে চলে যায় দুজনের। কানাইয়ের মা বসন্ত রোগে মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে, আর এখন বাপের এই বিদ্‌ঘুটে ব্যারাম।

    ‘চাঁদনি’, নাড়ী ছেড়ে মাথা নেড়ে বললেন কবরেজ মশাই। নসু কবরেজের খ্যাতি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে। তাঁর নাড়ী জ্ঞান নাকি যেমন-তেমন নয়। তিনি জবাব দিয়ে গেলে রোগীকে বাঁচানো শিবের অসাধ্যি, আর তিনি ওষুধ বাতলে গেলে রোগী চাঙ্গা হয়ে উঠবেই। কিন্তু চাঁদনি আবার কী? ‘আজ্ঞে?’ ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করল কানাই।

    ‘চাঁদনি পাতার রস খাওয়াতে হবে, তাহলেই রোগ সারবে। সংস্কৃত নাম চন্দ্রায়ণী। আর রোগের নাম হল শুখ্‌নাই।’

    ‘চাঁদনি একটা গাছের নাম বুঝি?’ ঢোক গিলে জিগ্যেস করল কানাই।

    নসু কবরেজ ওপর নীচে মাথা নাড়লেন দুবার। কিন্তু তাঁর চোখ থেকে ভ্রূকুটি গেল না।

    ‘কিন্তু চাঁদনি ত যেখানে সেখানে পাবে না বাপু’, শেষটায় বললেন তিনি।

    ‘তবে?’

    ‘বাদড়ার জঙ্গলে যেতে হবে। একটা পোড়ো মন্দির আছে মহাকালের। তার উত্তর দিকে পঁচিশ পা গেলেই দেখবে চাঁদনি গাছ। কিন্তু সে তো প্রায় পাঁচ ক্রোশ পথ; পারবে যেতে?’

    ‘নিশ্চয়ই পারব,’ বলল কানাই। ‘হাঁটতে আমার কোনো কষ্ট হয় না।’

    কথাটা বলেই কানাইয়ের আরেকটা প্রশ্ন মাথায় এল।

    ‘কিন্তু গাছ চিনব কি করে কবরেজ মশাই?’

    ‘ছোট ছোট ছুঁচলো বেগনে পাতা, হলদে ফুল আর মন-মাতানো গন্ধ। বিশ হাত দূর থেকে সে গন্ধ পাওয়া যায়। স্বর্গের পারিজাতকে হার মানায় সে গন্ধ। তিন চার হাতের বেশি উঁচু নয় গাছ। একটি পাতা বেটে রস খাওয়ালেই আর দেখতে হবে না। ব্যারাম বাপ-বাপ বলে পালাবে, আর শরীর দুদিনেই তাজা হয়ে যাবে। তবে সময় আছে আর মাত্র দশ দিন। দশ দিনের মধ্যে না খাওয়ালে…’

    নসু কবরেজ আর কথাটা শেষ করলেন না।

    ‘আমি কাল সক্কাল-সক্কাল বেরিয়ে পড়ব, কবরেজ মশাই,’ বলল কানাই। ‘গণেশ খুড়োকে বলব আমি যখন থাকব না তখন যেন বাবাকে এসে দেখে যায়। খাওয়ানো ত যাবে না বোধ হয় কিছুই?’

    নসু কবরেজ মাথা নাড়লেন। ‘সে চেষ্টা বৃথা। এ ব্যারামের লক্ষণই এই। পেটে কিছুই সহ্য হয় না, আর দিনে দিনে শরীর শুকিয়ে যেতে থাকে। তবে চাঁদনির রস এর অব্যর্থ ওষুধ। আর, ইয়ে, ব্যারাম সারবার পর বাকি কথা হবে…’

    পড়শী গণেশ সামন্তকে বাপের দিকে একটু নজর রাখার কথা বলে পরদিন ভোর থাকতে গুড়-চিঁড়ে গামছায় বেঁধে নিয়ে কানাই বেরিয়ে পড়ল বাদড়ার জঙ্গলের উদ্দেশে। পৌঁছতে পৌঁছতে. সেই বিকেল হয়ে যাবে, কিন্তু কানাই পরোয়া করে না। বাপকে সে দেবতার মতো ভক্তি করে আর বাপও ছেলেকে ভালোবাসে প্রাণের চেয়েও বেশি। দিব্যি সুস্থ মানুষটার হঠাৎ যে কী হল! —দেখতে দেখতে শুকিয়ে আধখানা হয়ে গেল।

    পথ জানা নেই, তাই একে তাকে জিগ্যেস করে করে চলতে হচ্ছে। বনের নাম শুনে সকলেই জিগ্যেস করে, ‘কেন, সেখানে আবার কী?’ শুনে কানাই বুঝতে পারে বনটা খুব নিরাপদ নয়, কিন্তু তা হলে কী হবে? বাপের জন্য চাঁদনি পাতা জোগাড় করতে সে প্রাণ দিতে প্রস্তুত।

    সূর্যি যখন লম্বা লম্বা ছায়া ফেলতে শুরু করছে তখন একটা ধানক্ষেতের ওপারে কানাই দেখল একটা গভীর বন দেখা যাচ্ছে। ক্ষেত থেকে এক কৃষক কাঁধে লাঙল নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। তাকে জিগ্যেস করে কানাই জানল ওটাই বাদড়ার বন। কানাই পা চালিয়ে এগিয়ে চলল।

    শাল সেগুন শিমূলের সঙ্গে আরো কত কী গাছ মেশানো ঘন বনে সূর্যের আলো ঢোকে না বললেই চলে। এই বিশাল বনে তিন চার হাত উচু গাছ খুঁজে পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? তবে কাছে মন্দির আছে সেই একটা সুবিধে।

    বিশ পঁচিশ হাত ভেতরে ঢুকতেই একটা হরিণের পাল দেখতে পেল কানাই। তাকে দেখেই হরিণগুলো ছুটে পালালো। হরিণ ত ভালো, কিন্তু তেমন জাঁদরেল কোনো জানোয়ার যদি সামনে পড়ে? যাই হোক, সে ভেবে কোনো লাভ নেই। তার লক্ষ্য হবে এখন একটাই; প্রথমে মহাকালের মন্দির, তারপর চাঁদনি গাছ খুঁজে বার করা।

    মন্দির দেখতে পাবার আগে কিন্তু গন্ধটা পেল কানাই। তত জোরালো নয়; মিহি একটা গন্ধ, কিন্তু তাতেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

    এবার একটা মহুয়া গাছ পেরিয়ে পোড়ো মন্দিরটা চোখে পড়ল। দিন ফুরিয়ে এসেছে, তবে মন্দিরের চারপাশটায় গাছ একটু পাতলা বলে পড়ন্ত রোদ এখানে ওখানে ছিটিয়ে পড়েছে।

    ‘তুই কেরে ব্যাটা?’

    প্রশ্নটা শুনে কানাই চমকে তিন হাত লাফিয়ে উঠেছিল। এখানে অন্য মানুষ থাকতে পারে এটা তার মাথাতেই আসে নি। এবার মুখ ঘুরিয়ে দেখল একটা গোলপাতার ছাউনির সামনে তিন হাত লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা একটা লোক ভুরু কুঁচকে চেয়ে আছে তার দিকে।

    ‘তুই যা খুঁজছিস তা এখানে পাবি না,’ এবার বলল বুড়ো কয়েক পা এগিয়ে এসে। সে কি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে নাকি?

    ‘কী খুঁজছি তা তুমি জান?’ জিগ্যেস করল কানাই।

    ‘দাঁড়া দাঁড়া, একটু মনে করে দেখি। তোকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু এখন আবার মন থেকে হঠাৎ ফস্‌কে গেল। একশো ছাপ্পান্ন বছর বয়সে স্মরণশক্তি কি আর জোয়ান বয়সের মত কাজ করে?’

    বুড়ো মাথা হেঁট করে ডান হাত দিয়ে গাল চুলকে হঠাৎ আবার মাথা সিধে করে বলল, ‘মনে পড়েছে। চাঁদনি। তোর বাপের অসুখ, তার জন্য চাঁদনি পাতা নিতে এসেছিস তুই। ওই মন্দিরের উত্তর দিকটায় ছিল আজ দুকুর অবধি। কিন্তু সে ত আর নেই! গিয়ে দেখ—শেকড় অবধি তুলে নিয়ে গেছে।

    কানাইয়ের বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে গেছে। এতটা পরিশ্রম মাঠে মারা যাবে? সে মন্দির লক্ষ করে এগিয়ে গেল। উত্তর দিক। উত্তর দিক কোনটা? হ্যাঁ, এইটে। ওই যে গর্ত। ওইখানে ছিল গাছ—শেকড় অবধি তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু কে?

    কানাইয়ের চোখে জল। সে বুড়োর কাছে ফিরে এল।

    ‘কে নিল সে গাছ? কে নিল?’

    ‘রূপসার মন্ত্রী সেপাই-সান্ত্রী নিয়ে এসে গাছ তুলে নিয়ে গেছে। রূপসার প্রজাদের ব্যারাম হয়েছে—শুখ্‌নাই ব্যারাম—বিশদিনে না খেয়ে হাত পা শুকিয়ে মরে যায় তাতে। একমাত্র ওষুধ হল চাঁদনি পাতার রস।

    কানাইয়ের আর কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। সে চোখে অন্ধকার দেখছিল। কিন্তু বুড়ো একটা অদ্ভুত কথা বলল।

    ‘চাঁদনি এখানে নেই বটে, কিন্তু আমি যে দেখছি তোর বাপ ভালো হয়ে উঠবে।’

    কানাই চমকে উঠল।

    ‘তাই দেখছেন? সত্যি তাই দেখেছেন? কিন্তু ওষুধ না পেলে কি করে ভালো হবে? এ গাছ আর কোথায় আছে সে আপনি জানেন?’

    বুড়ো মাথা নাড়ল। ‘আর কোথাও নেই। এই একটি মাত্র জায়গায় ছিল, তাও এখন চলে গেছে রূপসার রাজ্যে।’

    ‘সে কতদূর এখান থেকে?’

    ‘দাঁড়া, একটু ভেবে দেখি।’

    বুড়ো বোধ হয় আবার ভুলে গেছে, তাই মনে করার চেষ্টায় মাথা হেঁট করে টাক চুলকোতে লাগল।

    ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ত্রিশ ক্রোশ পথ। বিশাল রাজ্য।’

    এবার কানাইয়েরও মনে পড়েছে। বলল ‘রূপসা মানে যেখানের তাঁতের কাপড়ের খুব নামডাক?’

    ‘ঠিক বলেছিস। রূপসার শাড়ি ধুতি চাদর দেশ-বিদেশে যায়। এমন বাহারের কাপড় আর কোথাও বোনা হয় না।’

    ‘আপনি এত জানলেন কি করে? আপনি কে?’

    ‘আমি ত্রিকালজ্ঞ। আমার নাম একটা আছে। তবে এখন মনে পড়ছেনা। ভালো কথা, তোকে ত একবার রূপসা যেতে হচ্ছে। চাঁদনির খোঁজ তোকে করতেই হবে।’

    ‘কিন্তু কবরেজ বলেছে দশ দিনের মধ্যে বাপকে ওষুধ খাওয়াতে না পারলে বাপ আর বাঁচবে না। তার মধ্যে একদিন ত চলেই গেল।’

    ‘তাতে কী হল। যা করতে হবে ঝটপট করে ফেল।’

    ‘কী করে করব? ত্রিশ ক্রোশ পথ। সেখানে যাওয়া আছে, গাছ খুঁজে বার করা আছে, ফেরা আছে…।’

    ‘দাঁড়া, মনে পড়েছে।’

    বুড়ো এবার তার কুটিরের মধ্যে ঢুকে একটা থলি বার করে আনল। তারপর তার থেকে তিনটে গোল গোল জিনিস বার করল—একটা লাল, একটা নীল, একটা হল্‌দে।

    ‘এই দ্যাখ’, লালটা হাতে তুলে বলল বুড়ো। ‘এটা একরকম ফল। এটা খেলে তুই হরিণের চেয়ে তিন গুণ জোরে ছুটতে পারবি। এক ক্রোশ পথ তোর যেতে লাগবে তিন মিনিট। তার মানে দেড় ঘণ্টায় তুই পৌঁছে যাবি রূপসা। এই তিনটেই ফল, আর তিনটেই তোকে দিলাম।’

    ‘কিন্তু হলদে আর নীল ফল খেলে কী হয়?’

    ‘এই ত মুশকিলে ফেললি’, বলে বুড়ো আবার মাথা হেঁট করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর এপাশ ওপাশ মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘উঁহু, মনে পড়ছে না। তবে কিছু একটা হয়, আর সেটা তোর উপকারেই লাগবে। যদি কখনো মনে পড়ে তবে তোকে জানাব।’

    ‘কী করে জানাবে? আমি ত চলে যাব।’

    ‘উপায় আছে।’

    বুড়ো আবার থলির ভিতর হাত ঢুকিয়ে এবার একটা ঝিনুক বার করল, সেটা প্রায় হাতের তেলোর সমান বড়। সত্যি বলতে কি, কানাই এত বড় ঝিনুক কখনো দেখেনি। ঝিনুকটা কানাইকে দিয়ে বুড়ো বলল, ‘এটা সঙ্গে রাখবি। আমার কিছু বলার দরকার হলে আমি তোকে নাম ধরে ডাকব। তোর নাম কানাই ত?’

    ‘হ্যাঁ।’

    ‘সেই ডাক তুই এই ঝিনুকের মধ্যে শুনতে পাবি। ওটা তোর ট্যাঁকে থাকলেও শুনতে পাবি। তারপর ঝিনুকটাকে কানের উপর চেপে ধরলেই তুই পষ্ট আমার কথা শুনতে পাবি। আমার কথা যখন শেষ হবে তখন ঝিনুকে শোনা যাবে সমুদ্রের গর্জন। তখন আবার ঝিনুকটা ট্যাঁকে খুঁজে রাখবি।’

    কানাই ঝিনুকটা নিয়ে তার ট্যাঁকেই রাখল। বুড়ো এবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘আজ ত সন্ধে হয়ে গেল। তুই এখন রূপসা গিয়ে কিছু করতে পারবি না। আমি বলি আজ রাতটা আমার কুটিরেই থাক, কাল ভোরে রওনা হবি। তাহলে ওখানে সারা দিনটা পাবি, অনেক কাজ হবে। আমার ঘরে ফলমূল আছে, তাই খাবি এখন।’

    কানাই রাজি হয়ে গেল। তার ইচ্ছে করছিল তখনই লাল ফলটা খেয়ে রওনা দেয়; বুড়োর কথা ঠিক কিনা সেটা পরখ করে দেখতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু সেটাকে সে দমন করল। সকালে রওনা দেওয়াই সব দিক দিয়ে ভালো হবে।

    ‘ভালো কথা’, বলল বুড়ো, ‘মনে পড়েছে। আমায় লোকে জগাইবাবা বলে ডাকে। তুইও তাই বলিস।’

    ॥ ২ ॥

    পরদিন সকালে লাল ফলটা খেয়ে জগাইবাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় পা দিতেই কানাই বুঝল তার গায়ের রক্ত যেন টগবগ করে ফুটছে। তারপর হাঁটতে গিয়ে দেখল হাঁটলে চলবে না—দৌড়তে হবে। সে দৌড় যে কী বেদম দৌড় সে আর কী বলব। রাস্তার দুপাশে গাছপালা ঘরবাড়ি মানুষজন গরু ছাগল সব তীরবেগে বেরিয়ে যাচ্ছে উল্টোদিকে, পায়ের তলা দিয়ে মাটি সরে যাচ্ছে শন্‌ শন্‌ করে, দুকানের পাশে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে কানে প্রায় তালা লাগে, দেখতে দেখতে দুদিকের দৃশ্য বদলে যাচ্ছে—গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে মাঠ, মাঠ থেকে বন, বন থেকে আবার গ্রামে। পথে দুটো নদী পড়ল, মুহূর্তের মধ্যে সে নদী কানাইয়ের পায়ের তলা দিয়ে বেরিয়ে গেল, পায়ের গোড়ালিটুকুও ভিজবার সময় পেল না।

    সূর্য মাথায় ওঠার আগে কানাই বুঝতে পারল সামনে একটা বড় শহর দেখা যাচ্ছে। সে তখনই দৌড়ান বন্ধ করে হাঁটতে শুরু করল। বাকি পথটুকু এমনিভাবে হেঁটেই যাবে, নইলে অন্য পথচারীরা কী ভাববে? তাকে নিয়ে একটা হৈচৈ পড়ে এটা কানাই মোটেই চায় না।

    শহরে ঢোকবার মুখে একটা তোরণ, তার দুদিকে দুজন সশস্ত্র সেপাই। এটা আগে থেকে জানা ছিল না, তাই কানাইকে একটু মুশকিলেই পড়তে হয়েছিল। সেপাইরা কানাইকে দেখেই তার পথ রোধ করতে গিয়েছিল, তাই নিরুপায় হয়ে কানাইকে সামান্য একটু দৌড় দিতে হয়েছিল। ফলে কানাই এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেল যেখান থেকে তোরণটা এত দূরে যে সেটাকে প্রায় দেখাই যায় না।

    আর কোনো ভাবনা নেই। কানাই এখন একটা বাজারের মধ্যে দিয়ে চলেছে। দুদিকে দোকানপাট, তাতে নানারকম জিনিসের মধ্যে কাপড়ই বেশি, আর সেই কাপড়ের বাহার দেখে কানাই ত থ। দেশ-বিদেশের লোকেরা সে কাপড় দেখছে, দর করছে, কিনছে। কিন্তু একটা জিনিস দেখে কানাইয়ের ভারী অদ্ভুত লাগল। যারা সে কাপড় বেচছে তাদের কারুর মুখে হাসি নেই। আর, আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, হাটের এখানে সেখানে হাতে বল্লমওয়ালা সেপাইরা ঘোরাফেরা করছে।

    কানাইয়ের ভারী কৌতূহল হল! সে একটা কাপড়ের দোকানে গিয়ে দোকানদারকে জিগ্যেস করল, ‘এই শহরের নাম কি রূপসা?’ লোকটা মুখে কিছু না বলে কেবল মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল। এবার কানাই বলল, ‘তা তোমরা সবাই এত গম্ভীর কেন বল ত? কেনা-বেচা ত বেশ ভালোই হচ্ছে; তবু তোমাদের মুখে হাসি নেই কেন?’

    লোকটা এপাশ ওপাশ দেখে নিয়ে বলল, ‘তুমি বুঝি ভিন দেশের লোক?’

    কানাই বলল, ‘হ্যাঁ; আমি সবে এখানে এলাম।’

    ‘তাই তুমি জান না’, বলল দোকানদার। ‘এখানে মড়ক লেগেছে।’

    ‘মড়ক?’

    ‘শুখনাইয়ের মড়ক। এখন তাঁতি পাড়ায় লেগেছে, কিন্তু ছড়িয়ে পড়তে আর কতদিন? তাঁতিরা সব না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে।’

    ‘কিন্তু—’

    কানাই ওষুধের কথাটা বলতে গিয়ে বলল না। আশ্চর্য ব্যাপার!–মন্ত্রী গিয়ে চাঁদনি গাছ নিয়ে এসেছে, তাও কেন তাঁতিদের অসুখ সারছে না? এই গাছের পাতায় কি তাহলে কাজ দেয় না? একটা আস্ত গাছে কত পাতা হয়? চার-পাঁচশো ত বটেই। তার একটা খেলেই একটা লোকের অসুখ সারার কথা। কিন্তু সে গাছ তাহলে গেল কোথায়?

    কানাই উঠে পড়ল। তার মনে পড়ে গেছে যে এখানে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হল চাঁদনির পাতা জোগাড় করা। কিন্তু সেই গাছ তার নাগালে আসবে কি করে? মন্ত্রীমশাই সে গাছ কোথায় রেখেছেন সেটা সে জানবে কি করে?

    কানাই হাঁটতে আরম্ভ করল। বাজার ছাড়িয়ে সে দেখল একটা পাড়ার মধ্যে এসে পড়েছে। এখানে চারিদিক থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। এটাই কি তাঁতিপাড়া?

    রাস্তার ধারে একটা বুড়ো বসে আছে দেখে কানাই তার দিকে এগিয়ে গেল।

    ‘হ্যাঁ গো, এটা কি তাঁতি পাড়া।’ কানাই জিগ্যেস করল।

    বুড়ো মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এটাই তাঁতি পাড়া। তবে তাঁতি আর এখানে বেশিদিন নেই। চারটে করে তাঁতি রোজ মরছে ব্যারামে। শশী গেল, নীলমণি গেল, লক্ষ্মণ গেল, বেচারাম গেল—আর কি! এ রোগের ত কোনো চিকিৎসা নেই। আমায় এখনো ধরেনি রোগে, তবে ধরতে আর কত দিন?’

    ‘চিকিৎসা নেই বলছ কেন? একটা গাছের পাতার রস খেলেই ত এ ব্যারাম সারে। সে গাছ ত তোমাদের মন্ত্রীমশাই বাদড়ার জঙ্গলে গিয়ে নিয়ে এসেছেন।’

    ‘তাঁতিদের তাতে লাভটা কী? সে গাছ তো মন্ত্রীমশাই আমাদের দেবেন না।’

    ‘কেন, দেবে না কেন?’

    ‘আমাদের রাজা বড় সর্বনেশে।’ বুড়ো এদিক ওদিক সন্দেহের দৃষ্টি দিল। তারপর গলা নামিয়ে বলল, ‘এ রাজা পিশাচ। পেয়াদারা বল্লমের খোঁচা মেরে তাঁতিদের দিয়ে কাপড় বোনায়। যারা বোনে না তাদের শূলে চড়ায়। রূপসার কাপড় বিদেশ থেকে সদাগর এসে কিনে নিয়ে যায়। যা টাকা আসে তার চার ভাগের তিন ভাগ যায় রাজকোষে। তাঁতিরা সব এক জোটে রাজাকে হটিয়ে তার ছেলেকে সিংহাসনে বসাবে ঠিক করেছিল। সে কথা কেউ গিয়ে তোলে রাজার কানে। আর সেই সময় লাগে এই মড়ক। রাজা চায় তাঁতিরা সব মরুক। তাই ওষুধ এনে সরিয়ে রেখেছে।’

    কানাইয়ের মনটা শক্ত হয়ে উঠল। এমন শয়তান রাজা এই রূপসার রাজ্যে? সে যে-করে হোক চাঁদনির পাতা এনে দেবে তাঁতিদের জন্য। যে-করে হোক্‌!

    বুড়ো বলে চলল, ‘রাজা শয়তান, কিন্তু তার যে ছেলে রাজকুমার, সে সোনার চাঁদ ছেলে। তোমারই মতন বয়স তার। সে যদি রাজা হয় তাহলে দেশের সব দুঃখু দূর হবে।’

    ‘এই রাজাকে সরাবার কোনো রাস্তা নেই বুঝি?’

    ‘সে কি আর আমরা জানি? আমরা মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ, আমরা শুধু দুঃখু পেতেই জানি।’

    আরো একটা কথা জিগ্যেস করার ছিল বুড়োকে।

    ‘রাজবাড়িটা কোন দিকে বলতে পার?’

    ‘এই রাস্তা দিয়ে সোজা গেলে রাজপথ পড়বে। বাঁয়ে ঘুরে দেখবে দূরে রাজার কেল্লার ফটক দেখা যাচ্ছে। তবে তোমায় সেখানে ঢুকতে দেবে না। পাহারা বড় কড়া।’

    কানাই বুড়োর কাছে বিদায় নিয়ে কিছুদূর গিয়েই রাজপথে পড়ল। বাঁ দিকে ঘুরে সত্যিই দেখল দূরে কেল্লার ফটক দেখা যাচ্ছে।

    কানাই ইতিমধ্যে মতলব এঁটে নিয়েছে। সে এমনি ভাবে হেঁটে গিয়ে যখন ফটক থেকে বিশ হাত দূরে, প্রহরী তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে, তখন সে দিল ফটক লক্ষ করে বেদম ছুট।

    চোখের পলকে কানাই প্রথম ফটক দ্বিতীয় ফটক পেরিয়ে পৌঁছে গেল একটা বাগানে। এখানে আশেপাশে কোনো লোক নেই দেখে কানাই থামল। বাঁ দিকে বাগান, তাকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে আছে শ্বেত পাথরের দালান।

    কানাই কী করবে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলল। বাগানে ফুলের ছড়াছড়ি, চারিদিক রঙে রঙ, কে বলবে এই দেশে শুখ্‌নাইয়ের মড়ক লেগেছে!

    এই ফুলের মধ্যেই কি চাঁদনি গাছ রয়েছে? ছোট ছোট ছুঁচলো বেগুনী পাতা আর হল্‌দে ফুল। যদি এরই মধ্যে থাকে তাহলে তার কাজ অনেক সহজে হয়ে যায়।

    এদিক ওদিক দেখতে দেখতে কানাই এগোচ্ছিল, হঠাৎ তার পিঠে পড়ল একটা হাত, আর আরেকটা হাত তার কোমরটা জড়িয়ে ধরে কোলপাঁজা করে তুলে নিল।

    কানাই দেখল সে এক অতিকায় প্রহরীর হাতে বন্দী।

    ॥ ৩ ॥

    প্রহরী কানাইকে সোজা নিয়ে গেল রাজসভায়। কানাই দেখল রাজা সিংহাসনে বসে আছেন, আর তাঁকে ঘিরে রয়েছে সভাসদরা। রাজা যে শয়তান সেটা তাঁর কুৎকুতে চোখ, ঘন ভুরু আর গালপাট্টা দেখলেই বোঝা যায়।

    ‘এটাকে কোত্থেকে পেলি?’ রাজা কানাইয়ের দিকে চোখ রেখে পেয়াদাকে জিগ্যেস করলেন।

    ‘মহারাজ, এ অন্দরমহলের বাগানে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছিল।’

    ‘এ ব্যাটা ফটক দিয়ে ঢুকল কি করে? দু দুটো সশস্ত্র প্রহরী রয়েছে সেখানে!’

    ‘তা জানি না মহারাজ!’

    ‘হুঁ। বলবন্ত আর যশোবন্তকে শূলে চড়াও। ফটকে নতুন প্রহরী মোতায়েন করো। এ রাজ্যে কাজে ফাঁকির শাস্তি মৃত্যু।

    মহারাজের পাশে দু-তিনজন কর্মচারী আদেশ পালন করার জন্য হাঁ হাঁ করে উঠল।

    রাজা এবার কানাইয়ের দিকে দৃষ্টি দিলেন।

    ‘তোর ব্যাপার কী শুনি। তোর নাম কী?’

    ‘আজ্ঞে আমার নাম কানাই।’

    ‘কোত্থেকে আসছিস?’

    কানাই ঠিকই করেছিল যে রাজার কাছে সে সব কথা সত্যি বলবে না। সে বলল, ‘আজ্ঞে পাশের গাঁ থেকে।’

    ‘কাগমারি?’

    ‘আজ্ঞে হাঁ।’

    ‘বাগানে কী খুঁজছিলি?’

    ‘কই, কিছু খুঁজিনি ত। শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম।’

    রাজা যেন একটু নিশ্চিন্ত হলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে; এখন একে হাজতে পোরো। পরে এর বিচার হবে।’

    তিন মিনিটের মধ্যে কানাই দেখল যে সে কারাগারে বন্দী। গরাদওয়ালা দরজা খড়াং শব্দে বন্ধ হতেই সে হতাশ হয়ে কারাগারের এক কোণে বসে পড়ল। আর আট দিন বাকি আছে। তার মধ্যে চাঁদনির পাতা নিয়ে দেশে ফিরতে না পারলে তার বাপকে সে চিরতরে হারাবে।

    এমন হতাশ কানাইয়ের কোনোদিনও লাগেনি। জগাইবাবার কথা মনে পড়ল তার। নীল আর লাল ফল দুটো আর ঝিনুকটা এখানে তার ট্যাঁকে রয়েছে। কিন্তু কই, জগাইবাবা ত তাকে আর ডাকল না। ওগুলো দিয়ে কী কাজ হয় তাও জানা গেল না।

    কয়েদখানার একটা মাত্র খুপ্‌রি জানালা; সেটা পশ্চিম দিকে হওয়াতে তার ভিতর দিয়ে বিকেলের রোদ এসে পড়েছে। কমলা রঙের রোদ দেখে কানাই বুঝল যে সূর্য অস্ত যাবার মুখে।

    ক্রমে সেই আলোটুকুও চলে গিয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। ঘরের বাইরে একজন প্রহরী, সে সেখানে টহল ফিরছে। তার পায়ের একটানা খট্‌ খট্‌ শব্দে কানাইয়ের চোখে ঘুম এল, আর দশ মিনিটের মধ্যেই কানাই ঘুমে ঢলে পড়ল।

    এই ভাবে জেগে ঘুমিয়ে, কয়েদখানার অখাদ্য খাওয়া খেয়ে, তিনদিন চলে গেল। সময় আর মাত্র পাঁচ দিন। সন্ধ্যা হয়-হয়, কানাইয়ের চোখে ঘুমের আমেজ, মন থেকে আশা প্রায় মুছে এসেছে, এমন সময় সে হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল। বাইরে প্রহরী এখনো টহল দিচ্ছে, কে যেন এর মধ্যে বাইরে একটা মশাল জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে, তার আলোয় ফটকের গরাদের লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে কারাগারের মেঝেতে।

    কিন্তু কানাইয়ের ঘুমটা ভাঙল কেন?

    কান পাততেই কানাই কারণটা বুঝল।

    তার ট্যাঁকের ঝিনুক থেকে একটা শব্দ আসছে।

    ‘কানাই! কানাই! কানাই!’

    কানাই তাড়াতাড়ি ঝিনুকটা বার করে কানের উপর চেপে ধরল। তার পরেই সে পরিষ্কার শুনতে পেল জগাইবাবার কথা।

    ‘শোন্, কানাই, মন দিয়ে শোন্। আরো কিছু কথা মনে পড়েছে। তোর কাছে যে নীল ফলটা আছে সেটা খেলে তোর মধ্যে অদৃশ্য হবার শক্তি আসবে। কিন্তু অদৃশ্য হতে গেলে আগে একটা কথা বলে নিতে হবে। সেটা হল “ফক্কা”। সেটা বললেই তোকে আর কেউ দেখতে পাবে না। আবার যখন নিজের চেহারায় ফিরে আসতে চাইবি, তখন বলতে হবে “টক্কা”। বুঝলি?’

    ‘হ্যাঁ, বুঝেছি, মনে মনে বলল কানাই।

    ‘আচ্ছা, এবার আরেকটা কথা বলি—সেটাও হঠাৎ মনে পড়ল। রূপসার রাজা তার ছেলেকে বন্দী করে রেখেছে প্রাসাদের ছাতের কোণে একটা ঘরে। বাবাকে হটিয়ে ছেলে সিংহাসনে না বসা অবধি রূপসার কোনো গতি নেই; শুখ্‌নাই অসুখে সারা দেশ ছারখার হয়ে যাবে। রাজাকে এক সদাগর এক লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে একটা পান্না বিক্রী করে আজ থেকে সাত বছর আগে। এই পান্না রাজার গলার হারে বসানো। এই পান্নায় জাদু আছে; এটাই যত নষ্টের গোড়া। বুঝছিস?’

    কানাই বুঝেছে ঠিকই, কিন্তু চাঁদনির পাতা কি করে পাওয়া যাবে সেই নিয়ে ত জগাইবাবা কিছুই বললেন না!

    ঝিনুকের ভিতর আবার কথা শোনা গেল।

    ‘চাঁদনি উদ্ধার করায় বড় বিপদ। কিন্তু তারও রাস্তা আছে।’

    ‘কী রাস্তা?’

    ‘সেটা মনে পড়ছে না, বলল জগাইবাবা। ‘পড়লে বলব।’

    ব্যস্, কথা শেষ। কানাই কানে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছে। সে ঝিনুটাকে আবার ট্যাঁকে খুঁজে নিল।

    প্রহরী এখনো টহল দিচ্ছে। লম্বা টহল, তার গোড়ায় আর শেষটায় প্রহরী কানাইয়ের দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। বাঁ দিকে একবার প্রহরী অদৃশ্য হতেই ট্যাঁক থেকে নীল ফলটা বার করে কানাই টপ্‌ করে মুখে পুরে দিল। তারপর প্রহরী ডান দিকে অদৃশ্য হতেই কানাই ধাঁ করে বলে দিল ‘ফক্কা!’

    প্রহরী ফেরার পথে কয়েদখানার দিকে দেখেই চমকে উঠল। তার টহল থেমে গেল।

    সে প্রথমে গরাদের ফাঁক দিয়ে ভিতরে দেখল—এ-কোণ, ও-কোণ, সে-কোণ।

    তারপর মশালটা গরাদের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে আবার দেখল।

    তারপর মশাল রেখে চাবি দিয়ে ফটক খুলে অতি সন্তর্পণে ভিতরে ঢুকল। তার চোখে অবাক ভাবটা তখন দেখবার মতো।

    কানাই এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছিল। প্রহরীকে বেশ কিছুটা ভিতরে ঢুকতে দিয়ে টুক্‌ করে পাশ কাটিয়ে খোলা ফটক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল।

    পা টিপে টিপে কোনো শব্দ না করে দুজন প্রহরীর নাকের সামনে দিয়ে কানাই বেরিয়ে এসে পৌঁছাল একটা ঘোরানো সিঁড়ির মুখে।

    সেই সিঁড়ি দিয়ে সে উঠতে লাগল উপরে। নির্ঘাৎ এ সিঁড়ি ছাতে গিয়ে পৌঁছেছে।

    হ্যাঁ, কানাইয়ের আন্দাজে ভুল নেই। সিঁড়ি উঠে গিয়ে একটা দরজার মুখে পৌঁছেছে, সেই দরজা পেরোতেই কানাই দেখল সে ছাতে এসে পড়েছে।

    পেল্লায় ছাত, এক কোণে একটা ঘর। তাতে একটা জানালা। সেই জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা টিমটিমে আলো। ঘরের দরজার বাইরে বসে আছে একটা প্রহরী, তার মাথা হেঁট।

    অদৃশ্য কানাই এগিয়ে গেল প্রহরীর দিকে। যা আন্দাজ করেছিল তাই; প্রহরী মুখ হাঁ করে ঘুমোচ্ছে, তার নাক দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে।

    ঘরের দরজায় একটা বড় তালা ঝুলছে। বোধহয় তারই চাবি রয়েছে প্রহরীর কোমরে গোঁজা।

    কানাই খুব সাবধানে প্রহরীর ঘুম না ভাঙিয়ে চাবিটা বার করে নিল। তারপর সেটা তালায় ঢুকিয়ে একটা প্যাঁচ দিতেই খুট্‌ করে তালা খুলে গেল। কী ভাগ্যি এই শব্দেও প্রহরীর ঘুম ভাঙেনি।

    এবার দরজা খুলে অদৃশ্য কানাই ঘরের ভিতর ঢুকল। ঘরে একটা টেমি জ্বলছে, আর একটা খাটিয়ায় চোখে অবাক দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে তারই বয়সী একটি ফুটফুটে ছেলে। ঘরের দরজা খুলল, অথচ কাউকে দেখা যাচ্ছে না, তাতে রাজকুমারের মুখ হাঁ হয়ে গেছে। একি ভেলকি নাকি?

    দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে কানাই এবার খাটের দিকে ঘুরে ফিফিস্ করে বলল, ‘টক্কা!’—আর অমনি তার চেহারা দেখা যাওয়াতে রাজকুমার আরো চমকে উঠে ফিস্‌ফিসিয়ে জিগ্যেস করল, ‘তুমি কে? কোনো জাদুকর নাকি?’

    ফিস্‌ফিসিয়েই কথা হল, যদিও প্রহরীর নাক ডাকানি থেকে মনে হয় বাজ পড়লেও তার ঘুম ভাঙবে না।

    কানাই রাজকুমারকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল। রাজকুমার বলল, ‘গাছের কথা তুমি বলছ বটে, কিন্তু সে গাছ তুমি পাবে কি করে? সে তো সহজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।’

    ‘কি করে পাব তা জানি না’, বলল কানাই, ‘কিন্তু গাছের পাতা আমার চাই-ই। শুধু আমার বাবার জন্য নয়; তোমাদের এখানে তাঁতিরা সব মরতে বসেছে। তাদের জন্য পাতা লাগবে। কম করে হাজার পাতা ত থাকবেই সে গাছে; তাতে হাজার লোকের প্রাণ বাঁচবে।’

    ‘আমিও ত তাদের বাঁচাতে চাই’, বলল রাজকুমার। ‘বাবাকে আমি সে কথা বলেছিলাম। বাবা তাতেই আমাকে বন্দী করে রাখার হুকুম দিলেন। বাবা নিজের ছাড়া আর কারুর ভালো চান না। নিজের ভালো মানে যত বেশি টাকা আসে কোষাগারে ততই ভালো। ধর্মেকর্মে বাবার মতি নেই, প্রজাদের মঙ্গলের চিন্তা নেই, আমি যে তার নিজের ছেলে তার জন্যেও মায়া-মমতা কিচ্ছু নেই।’

    কানাই বলল, ‘আচ্ছা, তোমার বাবার গলার হারে একটা জাদুপান্না আছে, তাই না?’

    ‘তা ত বটেই। সাত বচ্ছর আগে এক সদাগর বাবাকে সেটা বেচে। সেই থেকে বাবার একটা দিনের জন্যও কোনো অসুখ হয়নি, আর বাবার অত্যাচারও বেড়ে গেছে তিন গুণ। এখানকার তাঁতিরা তাঁকে সিংহাসন থেকে সরাবার ফন্দি করেছিল। হয়ত তারা সে কাজে সফল হত, কিন্তু সেই সময়ই লাগে শুখ্‌নাইয়ের মড়ক।’

    কানাই একটু ভেবে বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা বল দেখি। রাজামশাইয়ের শোবার ঘরটা কোথায়? আমি ত ইচ্ছা করলে অদৃশ্য হতে পারি। আমি যদি তার গলা থেকে হারটা খুলে নিয়ে আসি?’

    রাজকুমার গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।

    ‘বাবার শোবার ঘর রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে। কিন্তু তার দরজায় প্রহরী ছাড়াও একটা ভয়ানক হিংস্র কুকুর পাহারা দেয়। সে তোমাকে দেখতে না পেলেও তোমার গন্ধ পাবে, আর পেলেই চীৎকার শুরু করবে। না, ওভাবে হবে না। অন্য উপায় দেখতে হবে। যা করতে হবে দিনের বেলা।

    কানাই একটুক্ষণ চুপ করে ভেবে বলল, ‘তোমাকে ত এবার পালাতে হবে। আমি যখন এসেই পড়েছি, তখন আর তুমি বন্দী থাকবে কেন? রাজবাড়ি ছাড়া তোমার কোনো ঠাঁই আছে?’

    ‘তা আছে’, বলল রাজকুমার। ‘তাঁতিদের মধ্যে আমার এক বন্ধু আছে, তার নাম গোপাল। তার এক বিধবা মা ছাড়া আর কেউ নেই। আমার নিজের মা-কে হারিয়েছি আমি তিন বছর বয়সে। গোপালের মা-কে আমি নিজের মায়ের মতো ভালোবাসি। বাবা গোপালের সঙ্গে মিশতে দেন না আমাকে; কিন্তু আজ যদি তার কাছে যাই, সে আমাকে ফিরিয়ে দেবে না।’

    ‘তার বাড়িতে কি দুইজনের জায়গা হবে?’

    ‘হবে বই কি। তিনজনে এক ঘরে মাদুর পেতে শুয়ে থাকব। আমার খুব অভ্যাস আছে।’

    ‘তাহলে চলো, চাঁদের আলোয় বেরিয়ে পড়ি।’

    ‘কিন্তু ফটকে প্রহরী আছে যে?’

    ‘প্রহরী আমাদের কিছু করতে পারবে না। তোমাকে পিঠে করে নিয়ে আমি ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যাব। কেউ আমাদের নাগাল পাবে না।’

    ‘সত্যি বলছ?’

    ‘সত্যি।’

    ‘কিন্তু যে আমার এমন বন্ধুর কাজ করল, তার নামটা ত এখনো জানলাম না।’

    ‘আমার নাম কানাই।’

    ‘আর আমার নাম কিশোর।’

    ‘তবে চলো যাই এবার। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে সোজা নেমে যাবো।’

    ‘বেশ। নীচে সিঁড়ির মুখে দরজা পেরোলেই বাগান।’

    ‘সেইখান থেকেই দেবো ছুট?’

    ॥ ৪ ॥

    গোপালদের বাড়ি তাঁতি পাড়ার এক প্রান্তে। সেখানে শুখ্‌নাই রোগ এখনো পৌঁছায়নি, কিন্তু কবে এসে পৌঁছবে তার ঠিক কি? গোপালের মা সেই কথা ভেবে কানাই আর কিশোরকে বলেছিলেন, ‘আমার এখানে থাকার বিপদটা কী ত জান। সেটা ভেবেও কি তোমরা তিনজনে একসঙ্গে থাকতে চাও?’

    তিনজনেই মাথা নেড়ে বলেছিল—হ্যাঁ, তারা তাই চায়। সেই সঙ্গে কানাই বলেছিল, ‘আপনি ভাববেন না। শুখ্‌নাই রোগের ওষুধ আছে রাজবাড়িতে। সে ওষুধ আমি জোগাড় করবই যে করে হোক। তাহলে আর কারুর ব্যারাম থাকবে না।’

    কিন্তু মুখে বলা এক, আর কাজে আরেক।

    তিনদিন কেটে গেল, তবু কাজ এগোল না একটুও। আর মাত্র দুদিন আছে কানাইয়ের বাপ, তারপরেই তার আয়ু শেষ। এদিকে ঝিনুকেও আর কোনো কথা শোনা যায়নি। জগাইবাবা এমন চুপ কেন?

    এর মধ্যে অবিশ্যি আরো অনেক কাণ্ড ঘটে গেছে। কানাই আর রাজকুমার দুজনেই কয়েদী অবস্থা থেকে পালিয়েছে দেখে রাজবাড়িতে হুলস্থূল পড়ে গেছে। এ জিনিস কেমন করে হয়? যে প্রহরী দুজন পাহারায় ছিল তাদের দুজনকেই শূলে চড়ানো হয়েছে। কানাই আর কিশোরকে ধরার জন্য শয়ে শয়ে সেপাই সারা রাজ্যে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। গোপাল তাঁতির সঙ্গে যে রাজকুমারের ভাব ছিল সেটা রাজা জানতেন, তাই গোপালের বাড়িতেও পেয়াদা পাঠিয়েছিলেন। ঠিক সেই সময় কানাই বুদ্ধি করে ‘ফক্কা’ বলে অদৃশ্য হয়ে পেয়াদার হাত থেকে বল্লম টেনে নিয়ে তাকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দিয়েছে; পেয়াদা এই ভেল্‌কিতে ভড়কে গিয়ে দিয়েছে চম্পট।

    তারপর থেকে গোপালের বাড়িতে আর কেউ আসেনি।

    আজ কানাই আর সবুর সইতে না পেরে কিশোরকে বলল, ‘হ্যাঁ ভাই, সেই জাদুপান্না না সরাতে পারলে ত আর চলছে না। একবার একটু ভেবে বল দেখি তোমার বাবা একা কখন থাকেন, তার কাছাকাছি যাবার সুযোগটা কখন পাওয়া যায়।’

    কিশোর বলল, ‘জাদুপান্না নিলেই যে সব গোল মিটে যাবে তেমন ভেবো না। বরং উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হতে পারে, বাবার রাগ সপ্তমে চড়ে যেতে পারে।’

    কানাই বলল, ‘তাও চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? তুমি একবার একটু ভেবে বল।’

    কিছুক্ষণ চোখ বুজে ভেবে রাজকুমার বলল, ‘একটা কথা মনে পড়েছে।’

    ‘কী কথা?’

    ‘বাবা রোজ ভোরে সূর্যোদয়ের সময় রাজবাড়ির অন্দরমহলের দীঘিতে স্নান করতে যান। সেই সময় প্রহরী থাকে দূরে; বাবার কাছাকাছি কেউ থাকে না।’

    ‘তবে আর কী!’ বলল কানাই, ‘এই ত সুযোগ। কাল ভোরে আমি রাজবাড়ি যাব অদৃশ্য হয়ে। দেখি তোমার বাবার সঙ্গে দীঘিতে গিয়ে কিছু করা যায় কিনা।’

    পরদিন সূর্য ওঠার আগেই কানাই ‘ফক্কা’ বলে অদৃশ্য হয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে রাজবাড়ি পৌঁছে দীঘির শ্বেতপাথরে বাঁধানো ঘাটের কাছেই একটা বকুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রইল। পূব আকাশে পদ্মের রং ধরেছে কিন্তু সূর্য তখনও ওঠেনি।

    কিছু পরে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই কানাই খট্‌ খট্‌ শব্দ শুনে বুঝল রাজা খড়ম পায়ে ঘাটে আসছেন।

    ওই যে রাজা! রাজার গা খালি। পরনে কেবল ধুতি আর কাঁধের উপর একটা রেশমের উত্তরীয়। উত্তরীয়টা ঘাটের পাশের বেদীতে রেখে রাজা খড়ম খুলে সিঁড়ির দিকে এগোলেন। গলার হারের পান্নাতে সূর্যের আলো পড়ে যেন তার থেকে আগুন বেরোচ্ছে।

    এবার রাজা জলে নামলেন। কানাইও এগিয়ে গেল ঘাটের সিঁড়ির দিকে, তারপর ধীরে ধীরে সেও জলে নেমে রাজার সাত হাত দূরে গলা জলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

    রাজা যেই ডুব দিলেন, অমনি কানাইও ডুব দিয়ে সাঁতরে এগিয়ে এসে পলকের মধ্যে রাজার গলা থেকে হার খুলে নিয়ে আবার ডুব সাঁতার দিয়ে দীঘির উল্টো পারে গিয়ে জল থেকে উঠল।

    ততক্ষণে রাজা দিশেহারা হয়ে জলে তাঁর হার খুঁজছেন আর ‘প্রহরী, প্রহরী’ বলে ডাকছেন।

    প্রহরী ছুটে এল। ‘কী হল মহারাজ?’

    ‘এই সেই শয়তান রাঘব বোয়ালের কাজ। আমার গলা থেকে হার খুলে নিয়ে গেল। খবর দিয়ে দে। দরকার হলে দীঘির জল সেঁচতে হবে। হার আমার ফেরত চাই।’

    ইতিমধ্যে অদৃশ্য কানাই হাতের মুঠোয় হার নিয়ে রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এক ছুটে মুহূর্তের মধ্যে চলে এল একেবারে গোপালের বাড়ি। তারপর ‘টক্কা’ বলে আবার নিজের চেহারায় ফিরে এসে রাজকুমারকে দেখিয়ে দিল যে তার কাজ সে করে এসেছে।

    কিন্তু এর ফলে রাজার মধ্যে কোনো পরিবর্তন এল কিনা সেটা কী করে বোঝা যাবে?

    কানাইয়ের সে বুদ্ধিও মাথায় এসে গেছে। সে বলল, ‘আমি কাল অদৃশ্য হয়ে রাজসভায় যাবো। রাজার হাবভাব কিরকম সেটা দেখে আসব।’

    তাই ঠিক হল, আর কানাই পরদিন রাজসভায় গিয়ে হাজির হল।

    সভাসদরা এসে গেছেন, কিন্তু রাজা তখনো আসেননি।

    কানাই পিছনের দিকে এক কোণায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগল।

    সময় চলে যায়, কিন্তু রাজার দেখা নেই।

    প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষার পরে রাজামশাই এসে ঢুকলেন রাজসভায়।

    কিন্তু কই, রাজার চেহারায় ভালোর দিকে পরিবর্তনের ত কোনো লক্ষণ নেই। চোখে ত সেই একই শয়তানের দৃষ্টি, কেবল ঠোঁটের কোণে ব্যাঁকা হাসির বদলে আজ প্রচণ্ড রাগ।

    রাজা সিংহাসনে বসে চারিদিকে একবার লাল চোখে দেখে নিয়ে বললেন, ‘আমার রাজ্যে মহা শয়তান এক জাদুকরের আবির্ভাব হয়েছে। সে নিজে কয়েদখানা থেকে প্রহরীর চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে, আমার ছেলেকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিয়েছে, আমার গলা থেকে আমার সাধের পান্নার হার খুলে নিয়েছে। গতকাল ভোরে দীঘিতে ডুব দেবার সময় এই ঘটনা ঘটে। আমি ভেবেছিলাম এ বোয়াল মাছের কাণ্ড, কিন্তু দীঘির জল সেঁচে সেই বোয়াল মাছকে ধরেও সে হার পাওয়া যায়নি। আজ থেকে শাসন হবে আরো দশগুণ কড়া। যতদিন সেই জাদুকর আর রাজকুমারকে খুঁজে না পাওয়া যায়, ততদিন হাটবাজার সব বন্ধ। লোকে না খেয়ে মরে মরুক!’

    এই ভীষণ কয়েকটা কথা বলে রাজা সিংহাসন ছেড়ে চলে গেলেন। কানাই একেবারে মুসড়ে পড়ল। জাদুপান্না খুলে নিয়ে ফল আরো খারাপ হল। এখন কী উপায়?

    কানাই গোপালের বাড়ি ফিরে এল।

    তার কাছ থেকে সব শুনে-টুনে কিশোর আর গোপালের মুখও শুকিয়ে গেল। একে দেশে মড়ক, তার উপর রাজার এই মূর্তি! সারা দেশ ত ছারখার হয়ে যাবে।

    কানাই তখন মনে মনে ভাবছে—আর একদিন মাত্র সময়। এই একদিনের মধ্যে চাঁদনির পাতা জোগাড় না হলে সে বাবাকে হারাবে।

    দূর থেকে ঢ্যাঁড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে ঘোষণা। আজ থেকে বাজারে কেনাবেচা বন্ধ। সেই সঙ্গে এও ঘোষণা হচ্ছে যে রাজকুমার আর জাদুকরকে যে ধরে দিতে পারবে তাকে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হবে। ঢ্যাঁড়ার দুম্‌ দুম্‌ শব্দ ক্রমে এদিকে এগিয়ে আসছে। তাঁতি পাড়াতেও ঘোষণা হবে।

    এই ডামাডোলের মধ্যেই কানাই হঠাৎ চমকে উঠল।

    তার নাম ধরে কে ডাকে ক্ষীণ স্বরে?

    সে তৎক্ষণাৎ ট্যাঁক থেকে ঝিনুক বার করে কানে দিল। পরিষ্কার শোনা গেল জগাইবাবার কথা।

    ‘শোন্ কানাই, মন দিয়ে কাজের কথা শোন্। কাল সকালে এক প্রহরে তুই যাবি রাজবাড়ির অন্দরমহলের বাগানের ঈশান কোণে। সেই কোণে জলে ঘেরা একটা ছোট্ট দ্বীপে চাঁদনি গাছ পোঁতা আছে। সেই গাছ তোকে উদ্ধার করতে হবে।’

    ‘কী করে জগাইবাবা?’

    ‘সেটা হবে তোর নিজের বুদ্ধি আর সাহসের জোরে। কাজটা সহজ নয়। বুঝলি?’

    ‘বুঝলাম, কিন্তু—’

    ‘কিন্তু কী?’

    ‘হল্‌দে ফলের গুণ কী সেটা ত বললেন না।’

    ‘এখনো মনে পড়েনি। পড়লে বলব। আগে তোর বাপকে বাঁচাবার ব্যবস্থা কর। তার প্রায় শেষ অবস্থা। তবে পাতার রস খেলেই সে চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আসি।’

    ঝিনুকের মধ্যে আবার সমুদ্রের গর্জন।

    কানাই সব ঘটনা বলল কিশোর আর গোপালকে। ‘কাল এক প্রহর’, সব শেষে বলল কানাই। ‘কালই এসপার নয় ওসপার।’

    ॥ ৫ ॥

    জগাইবাবার নির্দেশ মতো কানাই সকাল থেকেই অদৃশ্য হয়ে বাগানে হাজির হল। তারপর বাগানের ঈশান কোণে গিয়ে যা দেখল তাতে তার চক্ষুস্থির। একটা ছোট্ট দ্বীপে চাঁদনি গাছটা পোঁতা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই এক-মানুষ উঁচু গাছটার গোড়ায় পেঁচিয়ে আছে একটা শঙ্খচূড় সাপ, যার এক ছোবলেই একটা মানুষ পায় অক্কা। আর দ্বীপটাকে ঘিরে আছে একটা পাঁচ হাত চওড়া পরিখা, তাতে কিলবিল করছে পাঁচ-সাতটা কুমীর। কানাই যখন পৌঁছাল তখন সেই কুমীরগুলোর দিকে কোলা ব্যাঙ ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে একটা লোক, আর সেগুলো কপ্‌ কপ্‌ করে গিলে খাচ্ছে কুমীরগুলো। একটা ব্যাঙ সাপটার দিকেও ছুঁড়ে দেওয়া হল, আর সেটা তক্ষুনি সে মুখে পুরে গিলতে আরম্ভ করল।

    খাওয়া শেষ হলে কানাই দুগ্গা বলে কাজে লেগে গেল। আজই শেষ দিন, আজ তাকে যে করে হোক চাঁদনির পাতা জোগাড় করতেই হবে।

    বাগানের এক পাশে পাঁচিলের ধারে কিছু বাঁশ পড়ে আছে। অদৃশ্য কানাই তার থেকে দুটো বাঁশ নিয়ে সেগুলোকে পরিখার পাঁচিলে এমনভাবে শুইয়ে রাখল যে বাঁশের অন্য দিক দ্বীপের উপর গিয়ে পড়ে। ফলে বেশ একটা সেতু তৈরি হয়ে গেল কুমীর বাঁচিয়ে দ্বীপে যাবার জন্য।

    কিন্তু সাপের কী হবে?

    তার জন্য চাই অস্ত্র।

    কানাই বাগানের ফটকে গিয়ে দেখলে সেখানে হাতে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে একটা সেপাই দাঁড়িয়ে আছে। অদৃশ্য কানাই তার হাত থেকে একটানে তলোয়ারটা বার করে নিল। তারপর সেপাইকে হতভম্ব করে দিয়ে শূন্য দিয়ে সে তলোয়ার নিয়ে বাঁশের সেতুর উপর দিয়ে দ্বীপে পৌঁছে এক কোপে শঙ্খচূড়ের মাথা শরীর থেকে আলগা করে দিল। তারপর তলোয়ারটাকে পরিখার জলে ফেলে অদৃশ্য কানাই এক হ্যাঁচকায় শেকড়শুদ্ধ চাঁদনি গাছটাকে তুলে সেতু পেরিয়ে এসে ঝড়ের বেগে চলে এল গোপালের বাড়ি। তারপর ‘টক্কা’ বলে সে নিজের চেহারায় ফিরে এল।

    গোপাল কানাইয়ের হাতে গাছ দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘চলো যাই ঘরে ঘরে পাতা বিলিয়ে আসি।’

    ‘তাই যাও’, বলল কানাই। ‘তবে একটা পাতা আমি নিচ্ছি। আমি আবার ফিরে আসব বিকেল পড়তে না পড়তেই। আজই শেষ দিন; আজ আমার বাবাকে বাঁচাবার শেষ সুযোগ।’

    তীরের বেগে দেখতে দেখতে নন্দীগ্রামে তার বাড়িতে পৌঁছে গেল কানাই। বাবা বিছানায় পড়ে আছে, তার শরীরের প্রত্যেকটি হাড় গোনা যায়।

    ‘কানাই, এলি?’ ক্ষীণ স্বরে জিগ্যেস করল বলরাম কৃষক।

    কানাই তখন পাতার রস বার করতে শুরু করছে। বেগুনী পাতার বেগুনী রস।

    ‘এই নাও বাবা, খেয়ে নাও।’

    কোনো মতে ঘাড় উঁচু করে রস খেয়ে ‘আঃ’ বলে একটা আরামের নিশ্বাস ফেলে আবার বালিশে মাথা দিল বলরাম। আর তার পরমুহুর্তেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা দিল। ‘অনেক আরাম বোধ করছি রে কানাই! তুই আমাকে বাঁচালি এ-যাত্রা।’

    কানাই বাবাকে বলল তার একবার রূপসা যেতে হবে, সেখানকার খবর নেওয়া দরকার। কাজ সেরেই সে আবার ফিরে আসবে।

    ‘তা যা’, বলল বলরাম, ‘তবে যাবার আগে কিছু ফল আর এক বাটি দুধ রেখে যাস খাটের পাশে। মনে হচ্ছে খিদে পাবে।’

    কানাই বাবার ফরমাশ পালন করে রূপসা গিয়ে হাজির হল।

    শহরের চেহারাই বদলে গেছে। তাঁতি পাড়ায় ঘরে ঘরে হাসিমুখ দেখতে দেখতে কানাই পৌঁছাল গোপালের বাড়ি। কিশোরও রয়েছে সেখানে, কিন্তু তার মুখ গম্ভীর।

    ‘কী ভাবছ কিশোর?’ জিগ্যেস করল কানাই।

    ‘ভাবছি বাবার কথা’, বলল কিশোর। ‘বাবারও ব্যারাম হয়েছে।’

    ‘অ্যাঁ, সে কি! কী করে জানলে?’

    ‘ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে গেল। বলল রাজার অসুখ; রাজা আমাকে দেখতে চায়। আমি যেখানেই থাকি যেন গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি।’

    ‘ব্যারাম মানে কী ব্যারাম?’ জিগ্যেস করল কানাই।

    ‘শুখ্‌নাই। তাঁতির যা অসুখ; তোমার বাপের যা অসুখ, বাবারও সেই অসুখ। আর তার একমাত্র ওষুধ এখন আমাদের কাছে।’

    ‘তা বেশ ত’, বলল কানাই, সে ওষুধ তাকে দাও, কিন্তু একটা শর্তে।’

    ‘কী শর্ত?’

    ‘তিনি যেন রোগ সারলেই রাজকার্য ছেড়ে তীর্থে যান। আর তাঁর জায়গায় তুমি বসো সিংহাসনে।’

    ‘আমিও তাই ভাবছিলাম’, বলল কিশোর।

    ‘একটা কথা বলব?’ হঠাৎ বলে উঠল গোপাল তাঁতি।

    ‘কী কথা ভাই?’ জিগ্যেস করল কিশোর।

    ‘তুমি রাজা হলে আমায় একটা নতুন তাঁত দেবে? যেটা আছে সেটা আমার ঠাকুরদাদার। তাতে ভালো বোনা যায় না।’

    ‘নিশ্চয়ই দেব’, বলল কিশোর। ‘তুমি হবে তাঁতির সেরা তাঁতি। তোমার বোনা কাপড় পরে আমি সিংহাসনে বসব।’ তারপর কানাইয়ের দিকে ফিরে বলল, ‘চলো যাই বাবার কাছে।’

    কানাইয়ের পিঠে চড়ে এক মুহূর্তে প্রাসাদের অন্দর মহলে পৌঁছে গেল কিশোর। রাজবাড়িতে শোকের ছায়া পড়েছে। রাজার অসুখের একমাত্র ওষুধ চাঁদনির পাতা ভেলকির বশে রাজার উদ্যান থেকে উধাও হয়ে গেছে। আর বিশ দিন মাত্র আয়ু তাঁর।

    রাজার শোবার ঘরের বাইরে প্রহরী কিশোর আর কানাইকে দেখে চমকে উঠল, কিন্তু তাদের কোনো বাধা দিল না। কিশোর আর কানাই সোজা গিয়ে ঢুকল রাজার ঘরে।

    রাজা শয্যা নিয়েছেন, পাশে রাজ কবিরাজ মাথায় হাত দিয়ে বসে রাজার প্রশ্নের উত্তরে বলছেন আর কোনো জায়গায় চাঁদনি গাছ নেই, আর এ-রোগের আর কোনো চিকিৎসাও নেই।

    ঠিক সেই সময় গিয়ে উপস্থিত হল কিশোর আর কানাই।

    ‘তুই এলি!’ ছেলেকে দেখে কাতর কণ্ঠে বলে উঠলেন রাজা। ‘তবে তোর সঙ্গে এ কেন?’ এ যে পিশাচসিদ্ধ জাদুকর!’

    ‘না বাবা’, বলল কিশোর। ‘এ হল রূপসার ভবিষ্যৎ মন্ত্রী।’

    ‘অ্যাঁ!’

    ‘হ্যাঁ বাবা। আমি সঙ্গে করে তোমার ওষুধ এনেছি। এই ওষুধ তোমাকে দেব যদি তুমি কথা দাও যে অসুখ সারলেই তীর্থে চলে যাবে চিরকালের মতো।’

    ‘তা কেন দেব না কথা’, বললেন রাজা, ‘যত নষ্টের গোড়া ছিল ওই জাদুপান্না, যদিও রোগের হাত থেকে ওটাই আমাকে এতদিন রক্ষা করেছে। সেই পান্না যাবার পর থেকেই আমার দেহে আর মনে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আমি বুঝেছি কত ভুল করেছি। আমি যাবো তীর্থে, আর তুই বসবি আমার জায়গায় সিংহাসনে। রূপসার গৌরব ফিরিয়ে আনবি। লোকে ধন্য ধন্য করবে।’

    রাজকুমার এবার তার হাতের মুঠো খুলে ধরল বাপের সামনে। সেই মুঠোয় চাঁদনির বেগুনী পাতা, তার সৌরভে রাজার শয়নকক্ষ ভরপুর হয়ে গেল।

    রাজা সেরে উঠলেন একদিনেই।

    তিনদিন পরে যুবরাজের অভিষেক হল। রাজা নিজে তার হাত ধরে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন ছেলেকে, তার পরনে গোপালের তৈরি পোষাক। তারপর কিশোর কানাইকে বসিয়ে দিল মন্ত্রীর আসনে। ইতিমধ্যে কানাই নন্দীগ্রামে গিয়ে তার বাবাকে নিয়ে এসেছে, কিশোর বলরামকে থাকবার ঘর দিয়েছে, তার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

    চারদিকে শাঁখ বাজছে, রোশন চৌকিতে সানাই বাজছে, তারই মধ্যে মন্ত্রীর আসনে বসে কানাই শুনতে পেল জগাইবাবার ডাক।

    ‘কানাই! কানাই! কানাই!’

    কানাই রাজসভার মধ্যেই ট্যাঁক থেকে ঝিনুক বার করে কানে দিল। খ্যান খ্যান করে শোনা গেল জগাইবাবার কথা।

    ‘তোর ত আস্পর্ধা কম না—তোর বিদ্যেবুদ্ধি নিয়ে তুই রূপসার মন্ত্রীর আসনে বসেছিস?’

    ‘কি করব জগাইবাবা’; মনে মনে বলল কানাই, ‘আমি কি আর নিজে থেকে বসেছি?—এরা আমায় বসিয়েছে।’

    ‘তবে শোন বলি’, এলো জগাইবাবার কথা। ‘অ্যাদ্দিনে মনে পড়েছে। সেই হলদে ফলটা আছে ত?’

    ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আছে!’

    ‘এইবার সেইটে খেয়ে নে। সেটা খেলে তোর বিদ্যেবুদ্ধি হাজার গুণ বেড়ে যাবে। মন্ত্রীগিরি কীভাবে করতে হয়, রাজাকে মন্ত্রণা কীভাবে দিতে হয়, দেশের মঙ্গল কিসে হয়, দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন কাকে বলে—সব জানতে পারবি। তখন আর তোকে বেমানান লাগবে না, কেউ বলবে না তুই বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে গেছিস। বুঝেছিস?’

    ‘বুঝেছি জগাইবাবা, বুঝেছি।’

    ‘তাহলে আসি।’

    ঝিনুকে আবার সমুদ্রের গর্জন।

    কানাই ঝিনুকটা আবার ট্যাঁকে গুঁজে তার পাশ থেকে হলদে ফলটা বার করে মুখে পুরল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসুজন হরবোলা – সত্যজিৎ রায়
    Next Article জবর বারো – সত্যজিৎ রায়

    Related Articles

    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }