Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কায়াহীনের কাহিনী – মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়

    মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প122 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    লাট্টুর ঘূর্ণি

    এ আমার আরও ছেলেবেলাকার গল্প৷

    আমার দাদার ভারি লাট্টুর শখ ছিল৷ তিনি যেখানে যা পয়সা পেতেন, তাই দিয়ে লাট্টু ও লেত্তি কিনতেন৷ এমনি করে ছোটো-বড়ো কতরকম আকারের এবং লাল-নীল প্রভৃতি কতরকম রঙের কত যে লাট্টু তাঁর ভাণ্ডারে জমা হয়েছিল, তার ইয়ত্তা নেই৷ সেই সব লাট্টু নিয়ে, মাটিতে একটা প্রকাণ্ড গোল দাগ কেটে, তার মধ্যে একটার পর একটা, একটার পর একটা লাট্টু ঘুরিয়ে তিনি যখন ফেলতেন, তখন মনে হত যেন দেখতে দেখতে মাটির বুকের উপরে একখানি ছোট্ট মরসুমি ফুলের খেত বিচিত্র রঙের ঝলমলানি নিয়ে গজিয়ে উঠল৷ লাট্টুর সেই শোভা এখনও যেন আমার চোখে লেগে আছে৷ দাদার মতন তেমনতর লাট্টু ঘোরাতে এ পর্যন্ত আমি আর কাউকে দেখলাম না৷ আমার চোখে তিনি ছিলেন লাট্টুখেলার ওস্তাদ শিল্পী৷

    দাদার দেখে দেখে আমারও লাট্টু ঘোরাবার খুব ইচ্ছে হত; কিন্তু উপায় ছিল না৷ দাদা আমাকে লাট্টুর গায়ে হাত পর্যন্ত দিতে দিতেন না-পাছে লাট্টু খারাপ হয়ে যায়৷ লাট্টুকে তিনি যেন প্রাণের চেয়েও ভালোবাসতেন৷ তাদের কত আদর-যত্ন ছিল; গায়ে একটু ময়লা লেগে থাকবার জো ছিল না৷ কোনো রকমে তাদের গায়ে একটু চোট লাগলে, মনে হত সে চোট বুঝি দাদার বুকেই লেগেছে৷ আমি বড্ড কাকুতি-মিনতি করলে, তিনি কখনো কখনো লাট্টুর গায়ে একটিবার আমাকে শুধু হাত বুলোতে দিতেন৷ লাট্টুর সেই স্পর্শটুকুতেই আমার যে কী আনন্দ হত! কিন্তু তবু মন থেকে লাট্টুঘোরাবার লোভ ছাড়তে পারতাম না! বাবা-মা যে কেন আমায় একটা লাট্টু কিনে দেননি, তা আমি এখন ঠিক বলতে পারি না এবং আমিও যে কেন লাট্টুর জন্য মায়ের কাছে কোনোদিন বায়না ধরিনি, তাও আমার মনে পড়ে না৷ কেবল মনে পড়ে সেই ছেলেবেলায় লাট্টু ঘোরাবার কী ব্যাকুলতাই না বুকের মধ্যে ছটফট করে ঘুরে বেড়াত! দাদা কিছুতেই লাট্টু ছুঁতে দিতেন না, বোধ হয় সেই জন্যেই ওই ব্যাকুলতা দিন দিন অত প্রবল হয়ে উঠেছিল-আমায় যেন খেপিয়ে তুলেছিল৷

    দাদা স্কুলে গেলে আমি সারা দুপুরটা বাড়িময় তার লাট্টুর গুপ্ত আস্তানা খুঁজে খুঁজে বেড়াতাম৷ কিন্তু তিনি এমন করে লুকিয়ে রাখতেন, যে কিছুতেই তা বার করতে পারতাম না৷ মন আরও ছটফট করত৷ এমনিতর সারাদিন লাট্টু লাট্টু করে এক একদিন রাত্রে লাট্টুর স্বপ্ন দেখতাম৷ কী আনন্দ! রাশি রাশি লাট্টু-লাল, নীল, সবুজ, হলদে, বেগুনি, আরও কত রঙের-যেন শিলাবৃষ্টির মতো আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে! দু-হাতে চেপে, বুক দিয়ে ধরে, সে লাট্টুর রাশি আঁকড়ে রাখা যায় না-উপচে উপচে পড়ে! কিন্তু হায়, স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গে সেই লাট্টু মিলিয়ে যেত, আর তার সেই আনন্দও মুষড়ে আসত!

    এমনিতর এবং আরও কতরকম লাট্টুর স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখতাম৷ এবং স্বপ্নের মধ্যেই মাঝে মাঝে মনে হত যে এ তো স্বপ্ন! কিন্তু তাতে লাট্টু পাওয়ার আনন্দ কিছুমাত্র কম হত না৷ কেবল এই দুঃখ হত যে ওই লাট্টুগুলোকে কিছুতেই স্বপ্নের আবরণ থেকে ছিন্ন করে আমার নির্জন দুপুর বেলাকার খেলাঘরের মধ্যে এনে ফেলতে পারছি না! তখন এই পেয়েও না পাওয়ার জন্যে বুকটা হায় হায় করতে থাকত; আর কেবলই মনে হত-স্বপ্ন কি সত্য হয় না?- স্বপ্ন কি সত্য হয় না?

    একরাত্রে এক স্বপ্ন দেখলাম-এক পরি এসে আমার কপালে একটি চুমু খেয়ে আমার হাতে একজোড়া লাট্টু দিলেন৷ কিন্তু পরি চলে যেতেই ওই লাট্টুজোড়া দু-জোড়া পাখা বার করে আমার কাছ থেকে পাখির মতো উড়ে গেল৷ আমি এত ডাকলাম, আর ফিরে এল না৷ কী দুষ্টু! পরির দেওয়া লাট্টু নিশ্চয় আসল লাট্টু৷ সে স্বপ্নের মতো নিশ্চয় ভেঙে যেত না৷ কিন্তু তারা ছিল দুষ্টু, তাই আমাকে ছেলেমানুষ পেয়ে ফাঁকি দিয়ে নিজের যেখানে খুশি পালিয়ে গেল!

    ছেলেমানুষের মনের দুঃখ দেখে বোধ হয় দেবতার দুঃখ হল৷ তিনি আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করলেন৷ একদিন দুপুরে দাদার পড়বার ঘরে ঢুকে আমি দাদার নতুন-পাওয়া প্রাইজ বইয়ের ছবি দেখছি, এমন সময় মাথার উপর খসখস একটা আওয়াজ হয়ে ঠিক সেই স্বপ্নে দেখা লাট্টু-বৃষ্টির মতো টপটপ করে তিন-চারটে লাট্টু টেবিলের ওপরে এসে পড়ল৷ আর আমাদের কালো পুষিটা আলমারির ঠিক উপরে যে ছোট্ট ঘুলঘুলিটা আছে, তার থেকে লাফিয়ে, আলমারির মাথা হয়ে, টেবিলের উপরে পড়ে, ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷

    পুষিটা সোনার পুষি! তাকে সেদিন আমি কত আদর করলাম৷ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আর তার ল্যাজ ধরে টানব না৷ আমার পাত থেকে একটু করে মাছ তাকে রোজ দেব৷ যে লাট্টুর সন্ধান আমি এতদিন এত কষ্ট করেও পাইনি, এই পুষি সেই সন্ধান এক মুহূর্তে দিয়ে গেল৷

    আমি টেবিলের উপর দাদার বসবার টুলটা চাপিয়ে সেই ঘুলঘুলির নাগাল পেলাম৷ নাগাল পেলাম না তো, যেন হাতে স্বর্গ পেলাম! সেই অন্ধকার ঘুলঘুলির মধ্যেই দাদার লাট্টুর ভাণ্ডার! আরব্য উপন্যাসের চল্লিশ দস্যুর গল্পের গুহার মধ্যে লুকানো গুপ্ত রত্নভাণ্ডারের মতোই যেন দাদার এই লাট্টুর ভাণ্ডার-থাকে থাকে সাজানো-লাল, নীল, নানা রঙের লাট্টু-হিরে মণিমাণিক্যের মতো জ্বলজ্বল করছে! তবে দাদার এই রত্নগুহার এই সুবিধে ছিল যে চল্লিশ দস্যুর গুহার মতো এর দরজা দিনরাত বন্ধ থাকত না এবং এর মধ্যে থেকে রত্ন লুটে নেবার জন্যে দরজা খুলতে কোনো মন্ত্রের দরকার হত না৷ তবে ধরা পড়লে, দস্যু সর্দারের হাতে কাশিমের মতো দাদার হাতে আমার প্রাণটি যাবার ভয় ষোলো আনাই ছিল!

    সেদিন দুপুর বেলাটা আমার কী আনন্দেই কাটল৷ এতদিনকার মনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে৷ লাট্টুর জন্যে দাদার কাছে যত বকুনি খেয়েছিলাম, তার সমস্ত ব্যথা আজ যেন জুড়িয়ে গেল৷ আমি একটা লেত্তি নিয়ে ঠিক দাদার মতো করে লাট্টুর গায়ে জড়িয়ে, ঠিক তেমনই করে হাত ঘুরিয়ে, মেঝের উপর লাট্টু ফেলতে লাগলাম! বার কয়েক লাট্টু ঘুরল না৷ কিন্তু আমি দাদার ভাই তো! পাঁচ-সাতবারের পরই আমার হাতের গুণ বুঝে লাট্টু ঠিক ঘুরতে শুরু করল৷ সে যতই ঘোরে আমি ততই মেতে উঠি৷ এবং তার গুঞ্জনধ্বনি যতই কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে, ততই মন আনন্দে লাফাতে থাকে৷ হঠাৎ দেয়াল ঘড়ি থেকে তিনটের ঘা খেয়ে আমি চমকে উঠলাম৷ তাড়াতাড়ি লাট্টুগুলোর গা থেকে ধুলো-ময়লা মুছে সেগুলোকে সেই ঘুলঘুলির মধ্যে লুকিয়ে রেখে, দাদার পড়বার ঘর থেকে পিটটান দিলাম৷ দাদার যে এইবার স্কুল থেকে আসবার সময় হয়েছে৷

    এরপর থেকে আমার আর লাট্টুর দুঃখ রইল না৷ এক ছুটির দিন ছাড়া রোজ দুপুরে দাদার পড়বার ঘরে আমি মনের সাধে লাট্টু ঘোরাতাম৷ কিন্তু এই দুঃখ হত যে একলব্যের মতো এই নির্জন সাধনায় আমি লাট্টু ঘোরানোতে যে কত বড়ো ওস্তাদ হয়ে উঠেছি, তা দাদাকে দেখাতে পারলাম না! আমার লাট্টু ঘোরানো দেখে দাদা যে কতখানি চমকে উঠবে, তা মনে মনে কল্পনা করেই আমি আনন্দ পেতাম৷

    কিন্তু চিরদিন সমান যায় না৷ গ্রীষ্মের ছুটি এসে পড়ল৷ দাদার স্কুল যাওয়া বন্ধ, আমার লাট্টু ঘোরানোও বন্ধ৷ মনের মধ্যে আবার তেমনই ছটফটানি শুরু হল৷ দাদার কাছে লাট্টু চেয়ে আবার তেমনই বকুনি খেতে লাগলাম; আবার তেমনই ঘুমের ঘোরে আবোলতাবোল লাট্টুর স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করলাম৷

    যখন এমনি করে লাট্টুর শোকে মনের দুঃখে দিন কাটছে, তখন একদিন মামার বাড়ি থেকে বিয়ের নিমন্ত্রণ এল৷ ছোটোমামার বিয়ে৷ সেদিন আমার পেটের অসুখ৷ মা কেবল দাদাকে নিয়েই সকাল বেলায় নিমন্ত্রণ গেলেন৷ আমি ভুখাই-চাকরের কাছে পড়ে রইলাম৷ নিমন্ত্রণ যেতে পারলাম না বলে সেদিন আমার একটুও দুঃখ হল না৷ বরং লাট্টু ঘোরাবার এই মহা সুযোগ পেয়ে মনটা আনন্দে নৃত্য করতে লাগল৷

    মা আর দাদা চলে যেতেই আমি সেই ঘুলঘুলি থেকে এক গাদা লাট্টু বার করে এনে মনের সাধে ঘোরাতে শুরু করে দিলাম৷ আজ আর ভয় নেই৷ সারাদিন তো নয়ই, রাত্রেও দাদা আজ বাড়ি ফিরবেন না-ফিরতে সেই কাল বিকেলে৷ কী আনন্দ!-কী আনন্দ!

    আমি সারাদিন লাট্টু ঘুরিয়ে, সেদিন আর লাট্টুগুলোকে ঘুলঘুলিতে তুললাম না৷ শোবার সময়, বিছানার চারদিকে সেগুলোকে সাজিয়ে রেখে, তার মধ্যে শুয়ে পড়লাম৷ এ পাশে ফিরি লাট্টু, ও পাশে ফিরি লাট্টু, মাথার শিয়রে লাট্টু, পায়ের তলায় লাট্টু-কী মজা!

    লাট্টুর কথা ভাবতে ভাবতে কখন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না, হঠাৎ ঘুমের ঘোরে একবার মনে হল-চোরে যদি লাট্টু চুরি করে নিয়ে যায়? কী সর্বনাশ? আমি ধড়মড় করে উঠে বসবার চেষ্টা করলাম-লাট্টুগুলোকে লুকিয়ে রাখবার জন্যে; কিন্তু পারলাম না কিছুতেই! গা একেবারে এলিয়ে রইল৷ তারপর আবার কখন ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না৷

    এবার জেগে উঠে দেখি অন্ধকার ঘরের মধ্যে যেন এক টুকরো চাঁদের কুচি এসে পড়েছে! ঠিক মোমে গড়া পুতুলের মতো একটি কচি ছেলে আমার বিছানা থেকে একটি লাল রঙের লাট্টু নিয়ে মেঝের উপরে বসে খেলা করছে৷ ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল, টানা টানা দুটি বড়ো চোখ-ঠিক যেন আমার সেই ছোটো ভাইটি, যে ভাই আমার মারা গেছে-যাকে আমি ভারি ভালোবাসতাম, যে মারা যেতে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কত কেঁদেছিলাম৷

    বুঝলাম ছেলেটি লাট্টু চুরি করতে এসেছে৷ কিন্তু সত্যি বলছি, তাকে চোর বলতে আমার ইচ্ছে হল না৷ অমন সুন্দর ছেলে কখনো চোর হয়? ও যে আমার ছোটো ভাই! ও যদি লাট্টুগুলো আমার কাছে চায়, আমি এখনই সব দিয়ে দিতে পারি- তার জন্যে দাদা আমায় মেরেই ফেলুন, আর কেটেই ফেলুন!

    আমি বিছানা থেকে নেমে তার কাছে যেতেই সে তার সেই টানা টানা চোখ দু-টি আমার পানে তুলে মিষ্টি মিষ্টি কথায় বলল-“দাদা, আমায় একটা লাট্টু দেবে?”

    আমিও ঠিক এমনি করে দাদার কাছে লাট্টু চেয়েছি কতবার, আর তার বদলে পেয়েছি বকুনি কেবল৷ সে যে কী কষ্ট! সে কষ্ট আমার মনে এখনও গাঁথা আছে৷ সে দুঃখ আমার এই নতুন পাওয়া ছোটো ভাইটিকে আমি দিতে পারব না৷ আমি বললাম-“নাও ভাই তুমি লাট্টু-তোমার যেটা খুশি!” হাসিতে তার মুখ ভরে উঠল৷ সে সেই লাল লাট্টুটি হাতে নিয়ে বলল- “আমায় এটা দিয়ে দিলে?-একেবারে?”

    আমি বললাম-“হ্যাঁ ভাই!”

    সে বলল-“জম্মের শোধ?”

    আমি বললাম-“হ্যাঁ, জম্মের শোধ৷”

    সে বলল-“কী মজা!-কী মজা!” বলে আনন্দে দুই হাত তুলে লাফাতে লাগল; তার পর বলল-“দাদা তুমি লাট্টু ঘোরাও না, আমি দেখি!”

    আমি মহা উৎসাহে একটার পর একটা লাট্টু নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে শুরু করে দিলাম৷ নানা রঙের লাট্টু রাত্রের অন্ধকারের উপর বিচিত্র রং ছড়িয়ে কালো রাত্রিটাকে রঙিন করে তুলতে লাগল৷ আর তাদের ঘূর্ণির ঘন-গুঞ্জন স্তব্ধ বাতাসের ফাঁকে ফাঁকে অপরূপ সুরের বাঁশি বাজিয়ে চলতে লাগল!

    ছেলেটির কী আনন্দ! আমি ঘুরন্ত লাট্টু মাটি থেকে তুলে নিয়ে তার কাঁধে-মাথায় বসিয়ে দিই-তবু তারা ঘোরে দেখে সে অবাক! কখনো সেই লাট্টু নিজের আঙুলের নখের ছোট্ট ঘেরটুকুর মধ্যে বসিয়ে রেখে তাকে ঘোরাই, কখনো মাটিতে না ফেলে শূন্য থেকেই ঘুরন্ত লাট্টু হাতের উপর তুলে নিই, কখনো দু-হাতে দুটো লাট্টু নিয়ে ঘুরিয়ে ফেলতে না ফেলতেই এ হাতের লাট্টু, ও হাতে ধরে নিই, ও হাতেরটা এ-হাতে নিই এমন করে যত কসরত তাকে দেখাই, ততই সে আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে-আর আমায় বাহবা দেয়৷

    তার এই বাহবাতে আমি মেতে উঠতে লাগলাম; যত কিছু বিদ্যে দাদার দেখাদেখি আয়ত্ত করেছিলাম, একবার নয় পাঁচ-দশবার করে তাকে সব দেখাতে লাগলাম৷ তারও যেন দেখে আর সাধ মিটছিল না-যতই দেখে, ততই তার আনন্দ, ততই তার বিস্ময়! লাট্টু ঘোরানো দেখিয়ে দাদাকে বিস্মিত করে দেব মনে মনে আকাঙ্খা ছিল, কিন্তু তা পারিনি৷ আজ এই নতুন পাওয়া ছোট্ট ভাইটিকে বিস্মিত করে দিয়ে সে ক্ষোভ আমার মিটল৷

    ছেলেটি বলল-“দাদা, তুমি কী চমৎকার লাট্টু ঘোরাও! কী সাফ তোমার হাত!”

    আমি বললাম-“তুমি শেখো না-তুমিও ওইরকম পারবে!”

    সে ছলছল চোখে বলল-“কে আমায় শেখাবে?”

    আমি বললাম-“কেন, আমি!”

    সে উৎফুল্ল হয়ে উঠল৷ আমি তার বাঁ-হাতে লাট্টু, ডান হাতে লেত্তি দিয়ে তার হাতে ধরে তাকে লাট্টু ঘোরানো শেখাতে আরম্ভ করলাম৷ কী কোমল তার হাত দু-খানি! কী বুদ্ধিভরা উজ্জ্বল তার চোখ দু-টি! সে অল্পক্ষণেই আমার কাছ থেকে লাট্টু ঘোরানো শিখে নিল৷ তার পর সে ঘরময় ছুটে ছুটে লাট্টু ঘুরিয়ে বেড়াতে লাগল৷ সে তো ছোটাছুটি নয়-সে যেন আনন্দের ছন্দ ভরা অপরূপ নৃত্য! আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম৷ দেখতে দেখতে ছেলেটি যেন লাট্টু-খেলার ভেলকি শুরু করে দিল৷ সে এমনই লাট্টু ঘোরাতে লাগল যে কখনো পাঁচ-সাতটা লাট্টু মিলে যেন একটি ফুলের তোড়ার মতো গড়ে উঠল, কখনো যেন বিভিন্ন রঙে গাঁথা একগাছি ফুলের মালা হয়ে গেল৷ কখনো তারা এঁকেবেঁকে চলা নদীর স্রোতের মতো বহে গেল, কখনো যেন তারা সমস্বরে গেয়ে উঠল, কখনো বা হেলেদুলে নানা ভঙ্গিতে নৃত্য করতে লাগল-আরও কত কী হল আমি বলতে পারি না; আমি নির্বাক হয়ে সেই অদ্ভুত কাণ্ড দেখতে লাগলাম৷ এ কি জাদুকর? না মায়াবী?

    চোখের সামনে নানা আকারে নানা ভঙ্গিতে ক্রমাগত লাট্টু ঘোরা দেখতে দেখতে আমার মাথার ভেতরে যেন একটা ঘূর্ণি জেগে উঠতে লাগল৷ মনে হতে লাগল-যেন রাত্রি ঘুরছে, রাত্রির অন্ধকার ঘুরছে৷ আকাশ ঘুরছে, তারা-নক্ষত্র-তারাও ঘুরছে-সেই লাট্টুর সঙ্গে সঙ্গে, তারই তালে তালে! সে কী মহা ঘূর্ণি! মাথা ঠিক রাখা যায় না, পা ঠিক রাখা যায় না৷ মনে হল যেন আমি ঘুরতে ঘুরতে ঠিকরে বিছানার উপর গিয়ে পড়লাম৷

    পরদিন দাদা নিমন্ত্রণ থেকে ফিরে বাড়িতে এক কুরুক্ষেত্র কাণ্ড বাধিয়ে বসলেন৷ তাঁর একটা লাল লাট্টু খোয়া গেছে৷ কে নিয়েছে-তাই নিয়ে মহা হইচই! আমি চুপ৷ আমি যে সেই লাট্টুটি গত রাত্রে আমার সেই ছোটো ভাইটিকে দিয়ে দিয়েছি সেকথা আর সাহস করে দাদাকে বলতে পারলাম না৷ কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম৷ কুঞ্জদাসী দাদাকে বলে দিল যে কাল সে আমাকে লাট্টু নিয়ে খেলতে দেখেছে৷ দাদা আর কথাটি নয়, একেবারে ধাঁ করে এসে সজোরে একটি চড় আমার গালে কসিয়ে দিলেন৷ আমি সেই চড় খেয়ে ঘুরে পড়ে গেলাম-জ্ঞান হল কতক্ষণ পরে জানি না৷ জেগে দেখি মায়ের কোলে শুয়ে আছি-কপালে জলপটি বাঁধা৷ দাদা যে কোথায় দেখতে পেলাম না৷

    সন্ধ্যার দিকে সমস্ত শরীর আচ্ছন্ন করে আমার খুব জ্বর এল৷ মা আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলতে লাগল-“বাবা, তুমি ভালো হও, আমি তোমায় অনেক লাট্টু কিনে দেব৷” মায়ের এই কথগুলো আমার বেশ লাগছিল; কিন্তু জ্বরের আচ্ছন্নতায় তাঁর কোনো কথারই উত্তর দিতে পারলাম না৷ মা আমায় লাট্টু দেবেন-অনেক লাট্টু-রাশি রাশি লাট্টু-ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম৷

    কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না, ঘুম ভেঙে দেখি আমার সেই কালকের ছোটো ভাইটি ঘরে এসেছে৷ কিন্তু আজ তার মুখখানি মলিন, কান্নার ভারে চোখ দু-টি যেন বুজে আসছে৷ আমি বলতে গেলাম-তোমার কী হয়েছে ভাই? কিন্তু কথা কইতে পারলাম না; সর্বাঙ্গ জ্বরে এমনই ঝিমিয়ে ছিল! সে আস্তে আস্তে এসে আমার শিয়রের কাছে দাঁড়াল৷ মা পাশে শুয়েছিলেন, তাঁকে ইশারা করে ডেকে বললাম-“দেখো মা, কে এসেছে!” কিন্তু তিনি যেমন ঘুমিয়েছিলেন, তেমনই ঘুমিয়ে রইলেন৷ আমার তো গলার আওয়াজ বার হয়নি, কেমন করে তাঁর ঘুম ভাঙবে?

    ছেলেটি তার সেই ননির মতো নরম হাত দিয়ে অতি আস্তে আস্তে আমার সেই গালটি বুলিয়ে বুলিয়ে দেখতে লাগল-যে গালে দাদা সজোরে এক চড় কসিয়েছিলন৷ হাত বুলোতে বুলোতে তার চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে লাগল৷ সে গুনগুন করে বলতে লাগল-“অ্যাঁ! এমনই করে মেরেছে! আহা, আমার জন্যেই তোমায় মারলে! না জানি তোমার কত লেগেছে!”

    কী মিষ্টি তার স্পর্শ! কী মিষ্টি তার গলার স্বর৷ আমার ভারি ভালো লাগছিল তার সেই হাত বুলানো, তার সেই কথা শুনতে৷ কত কথা তাকে বলবার ইচ্ছা হচ্ছিল, কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না৷

    টুপ করে আবার এক ফোঁটা চোখের জল আমার গায়ে পড়ল৷ আমি বললাম-“কাঁদো কেন, ভাই?” সে শুনতে পেল না৷ সে মনে করল আমি বুঝি ঘুমিয়ে আছি৷ কিন্তু আমি যে জেগে, সে কথাও তাকে বোঝাতে পারলাম না৷ শুধু এইটুকু বুঝলাম-ছোটো ভাই না হলে দাদাকে এমনতর ভালোবাসে কে? সে আমার মাথায় হাত বোলাতে লাগল, আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম৷

    পরদিন সকালে আমার জ্বর ছেড়ে গেল৷

    ভুখাই চাকর বিছানা রৌদ্রে দিতে গেলে দাদার সেই হারানো লাট্টুটি বেরিয়ে পড়ল৷ সে বলল-আগের দিন আমি যখন লাট্টু নিয়ে ঘুমাই, তখন কীরকম করে একটা লাট্টু গড়িয়ে খাটের গদির পাশে ঢুকে গিয়েছিল৷

    সকলে সমস্বরে বলল-তাই হবে৷ কিন্তু আমার মন বলল-আমার সেই ছোটো ভাইটি পাছে দাদা আমায় আবার মারে, সেই দুঃখে ওই লাল লাট্টুটি ফিরিয়ে দিয়ে গেছে৷

    কিন্তু কেন সে ফিরিয়ে দিল?

    দাদা না হয় মেরেছে, কিন্তু আমি তো সে জন্যে একটুও দুঃখ করিনি, আমার সেই ছোটো ভাইটির উপর অভিমান করিনি৷ তবে কেন সে লাট্টু ফিরিয়ে দিয়ে গেল?

    সে কি জানে না, কত আদর করে ওই লাট্টুটি আমি তাকে দিয়েছিলাম! সে ফিরিয়ে দিতে আমার কত দুঃখ হয়েছে! আমি যদি জানতাম, সে লাট্টু ফিরিয়ে দিতে এসেছে, কখনো তাকে ফেরাতে দিতাম না-হাতে ধরে তাকে সেটা আবার ফিরিয়ে দিতাম৷

    অসুখ সারবার পর মা আমায় অনেক রকমের লাট্টু কিনে দিয়েছিলেন, সেসব লাট্টু আমি খুব যত্নের সঙ্গে তুলে রেখেছিলাম৷ যেদিন আবার আমার সেই ছোটো ভাইটি আসবে, তাকে সবগুলো দিয়ে দেব৷ কিন্তু সে তো আর একদিনও এল না৷ কেন?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্য লাস্ট ডন – মারিও পুজো
    Next Article পদ্মাবতী নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }