Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কালো যাদুকর – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প114 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৬. অদ্ভুত একটা গল্প

    আমি আমার জীবনের অদ্ভুত একটা গল্প লিখছি। যারা গল্পটি পড়বেন তাদের যে বিশ্বাস করতে হবে এমন না। বিশ্বাস করার কোন দরকার নেই। আবার অবিশ্বাস করারও দরকার নেই। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝিটা করলেই হল। আমরা সব সময় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি জগতে বাস করি। কে জানে হয়ত এই জগতই সত্যি।

    আমার মা খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। মা’র কোন স্মৃতি আমার মনে নেই। শুধু একটা স্মৃতি আছে—আমি একটা জলচৌকিতে উবু হয়ে বসে আছি, মা আমার মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালছেন—আমার প্রচন্ড শীত লাগছে। আমি শীতে কাপছি। মাথায় পানি ঢালার সময় মা’র হাতের কাচের চুড়িতে টুন টুন শব্দ হচ্ছে। আমার কাছে মা’র স্মৃতি হচ্ছে—ঠান্ডা পানি ঢালার শব্দ, চুড়ির টুন টুন শব্দ। ব্যাস এই পর্যন্তই, মা’র চেহারার কোনো স্মৃতি আমার নেই। তিনি দেখতে কেমন ছিলেন? তাঁর কি মায়া মায়া চোখ ছিল? তিনি কি পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রাখতেন? কিছু জানি না।

    মা’র মৃত্যুর দু’বছর পর বাবা আবার বিয়ে করেন। নতুন মা’র কথা আমার খুব মনে আছে।

    নতুন মা’র চেহারা খুব সুন্দর ছিল। তিনি হাসি খুশি ধরনের ছিলেন। স্বভাবটা ছিল ছটফটে ধরনের। অনেকটা চুড়ই পাখির মত। কোথাও বেশিক্ষণ স্থির হয়ে থাকতে পারতেন না। নতুন মা আমাকে খুব আদর করতেন। আসল মা’র আদর কেমন তাতো জানি না নতুন মা’র আদর পেয়েই আমার আনন্দের সীমা ছিল না। তিনি আমাকে গ্রহণ করেছিলেন—বন্ধু হিসেবে, খেলার সাথী হিসেবে। নতুন মা’র বয়স অল্প ছিল। তার খেলার সঙ্গীর প্রয়োজন ছিল। আমার বাল্যকাল এবং কৈশোর কেটেছে খুবই সুখে। আমার সুখ স্থায়ী হল না। আমার যখন তের বছর বয়স তখন নতুন মা মারা গেলেন।

    নিজের মা’র মৃত্যুতে আমি কষ্ট পাইনি। নতুন মা’র মৃত্যুতে আমি প্রথম কষ্ট পেলাম। নতুন মাও সম্ভবত অন্য ভূবনে যাত্রার আগে আমার কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছিলেন। কারণ তিনি মৃত্যুর আগে আগে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন– আহারে আমি চইল্যা গেলে আমার টগররে কে দেখব?

    তখন তার নিজের একটি মেয়ে আছে। তারও ফুলের নামে নাম—পারুল। খুবই আশ্চর্যের কথা একবারও তিনি তাঁর মেয়ের কথা বললেন না। একবারও বললেন না, আমার পারুলরে কে দেখব? তিনি কাঁদতে লাগলেন আমার কথা ভেবে।

    মা’র মৃত্যুর পর বাবা আমাকে ডেকে বললেন–বুঝলি টগর, আমার কপালে সংসার নেই। বিয়েদী আর করব না। তোর ছোট বোনটাকে তো বড় করা লাগবে—দুইজনে মিলে পারব না?

    আমি বললাম, পারব।

    বাবা বললেন, শিশু মানুষ করা কঠিন ব্যাপার। দুইজনে মিলে এই কঠিন কাজটা সমাধা করতে হবে। উপায় কী? তবে মেয়ে তো, একটু বড় হলে দেখবি আমাদের আর তাকে পালতে হচ্ছে না উল্টা সেই আমাদের পালছে। কয়েকটা বছর ধৈর্য ধরে তার বোনটাকে বড় করতে হবে। আগের মতো আর বাইরে ঘোরাঘুরি করা যাবে না। বেশির ভাগ সময় এখন ঘরেই থাকতে হবে।

    বাবা খুব অস্থির প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি ছোট-খাট ব্যবসা করতেন। কোন ব্যবসাতেই মন বসাতেন বলে মনে হয় না। একটা ব্যবসা মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেলে সেটা ছেড়ে তিনি অন্য ব্যবসা ধরতেন। তাঁর ঘুরে বেড়ানোরও খুব সখ ছিল। তাঁর কথা হল—মানবজীবন অল্প দিনের। এই অল্পদিনে যা দেখার দেখে নিতে হবে। মৃত্যুর পর দেখার কিছু নেই। দোজখে যে যাবে—সে আর দেখবে কী—তার জীবন যাবে আগুন দেখতে দেখতে। আর বেহেশতেও দেখার কিছু নেই। বেহেশতের সবই সুন্দর। যার সবই সুন্দর তার সৌন্দর্য বোঝা যায় না। সুন্দর দেখতে হয় অসুন্দরের সঙ্গে।

    খুবই ভারী ধরণের কথা। বাবা ভারী ভারী কথা বলতে পছন্দ করতেন।

    মা’র মৃত্যুর পর বাবার অস্থির স্বভাবের তেমন কোন পরিবর্তন হল না। তিনি আগের মতই রইলেন। বরং অস্থিরতা সামান্য বাড়ল। মূলত আমি একাই বোনের দেখাশোনা করতে লাগলাম। বাড়িতে একটা কাজের মহিলা ছিল। তাকে আমরা রহিমা খালা ডাকতাম। রহিমা খালা খুব দায়িত্ববান মহিলা ছিলেন। সংসার তিনি একাই সামলাতে লাগলেন। যদিও আগে বলেছি আমি বোনের দেখাশোনা করতে লাগলাম আসল ঘটনা সেরকম নয়। আমার বোন একা একাই বড় হতে লাগল। সে খেলতো নিজের মনে—হেঁটে বেড়াতে নিজের মনে। তার স্বভাব চরিত্র এবং আচার আচরণে বড় ধরনের অস্বাভাবিকতা ছিল। যা আমার কম বয়সের জন্যে আমি ধরতে পারিনি। রহিমা খালা ঠিকই ধরেছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে বলতেন—পারুল জানি কেমন কইরা হাঁটা চলা করে। বগার লাহান ঠ্যাং ফেলে, কেমুন কইরা জানি দেহে। রহিমা খালা এই কথাগুলি নিজেকেই বলতেন। কাজেই আমিও তেমন গুরুত্ব দেইনি।

    পারুলের যে অস্বাভাবিকতাটা আমার চোখে পড়ত তা হল সে অন্ধকারে সারাবাড়ি হেঁটে বেড়াতে পারত। ভাবটা এমন যেন সে অন্ধকারে দেখতে পায়। আসল ব্যাপারটা ছিল পুরো অন্যরকম। সে চোখে কিছুই দেখত না, সে জন্মান্ধ ছিল। তার টানা টানা সুন্দর চোখ দেখে এ ব্যাপারটা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। বাবা বেখেয়ালী ধরনের মানুষ তাঁর ধরতে পারার কথা নয়, আর আমার বয়সতো নিতান্তই অল্প। মা বেঁচে থাকলে অবশ্যই ধরতে পারতেন।

    ব্যাপারটা যখন ধরা পড়ল তখন পারুলের বয়স চার। আমরা সবাই হতভম্ব হয়ে পড়লাম। অন্ধকারে তার অনায়াসে হাঁটাহাঁটির অর্থ তখনই পরিষ্কার হল। তার কাছে আলো এবং অন্ধকার আলাদা কিছু ছিল না। দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও পারুলের অন্যসব ইন্দ্রিয় অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ছিল। পাঁচ বছর বয়সেই সে সবকিছু নিজের মতো করে করতে পারত।

    বাবা অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। সংসারে এমনিতেই তাঁর মন ছিল না। এর পর মন আরও উঠে গেল।বেশিরভাগ সময়ই তিনি বাইরে বাইরে থাকতে শুরু করলেন। বাড়িতে যতক্ষণ থাকতেন গম্ভীর হয়ে বসে থাকতেন। তীক্ষ্ণ দৃস্টিতে দেখতেন পারুল নিজের মনে খেলছে। নিজের মনে কথা বলছে। বাবা তাঁর। মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। বড় বড় ডাক্তার দেখালেন। ডাক্তাররা বললেন—জন্ম ত্রুটি, কনজেনিটাল ডিফেক্ট। কিছু করার নেই।

    পারুল দেখতে পায় না এনিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা ছিল না। সে ছিল মনের আনন্দে। ছোটাছুটি করছে হৈ চৈ করছে। মনের আনন্দে গান করছে। ‘ট’ উচ্চারণ করতে পারত না বলে আমাকে সে ভকত অগর ভাই। যখন ‘ট’ উচ্চারণ করতে শিখল তখনও আমি অপর ভাই হয়ে রইলাম। পারুলের অন্ধকার ও নিঃসঙ্গ জীবনে আমিই ছিলাম একমাত্র সঙ্গী। তার বুদ্ধি ছিল অসাধারণ। একবার সে আমাকে বলল, অগর ভাই, আমাকে পড়া শেখাও। তখন আমি পড়ি ক্লাস টেনে। আমার এমন কী বিদ্যা যে একটা অন্ধ মেয়েকে পড়া শিখাব? কতগুলি বর্ণ আছে—স্বরবর্ণ কিছু আছে ব্যাঞ্জন বর্ণ এদের আলাদা ধ্বনি আছে। ধ্বনিগুলি তাকে শুনাতে পারব। কিন্তু বর্ণগুলি তো সে কোনদিন দেখবে না। কাগজের উপর বর্ণগুলি বড় বড় করে লিখে তার উপর দিয়ে পারুলের আঙুল বুলিয়ে নিলে সে কিছুটা আঁচ হয়ত পাবে। কিন্তু যুক্তবর্ণ বুঝব কী করে? আর বুঝতে পারলেও এতকিছু সে মনে রাখবে কী করে? আমি খুবই অনাগ্রহের সঙ্গে কাগজে “অ” লিখে শুরু করলাম। এবং অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম পুরো ব্যাপারটা পারুল শিখল অস্বাভাবিক দ্রুততায়। সে যত না আনন্দিত হল তার চেয়ে একশগুণ আনন্দিত হলাম আমি নিজে।

    পারুল বেশিরভাগ সময় খুব হাসিখুশি থাকত। তবে সে সত্যি হাসিখুশি থাকত, না—হাসিখুশি থাকার ভান করত তা আমি জানি না। তবে মাঝে মাঝে মন খারাপ করত। মন খারাপটা বেশির ভাগ সময় হত যখন কোন একটা জিনিস সে বুঝতে চাইত অথচ আমি তাকে বুঝাতে পারতাম না। যেমন রঙ আসলে কী? পারুল জানতে চাইল, আম যখন কাঁচা থাকে তখন তার রঙ তোমরা বল সবুজ পাকলে হয় হলুদ। এর মানে কী? একটা কাঁচা আমের গন্ধ একরকম, পাকা আমের গন্ধ আরেক রকম এটা আমি বুঝতে পারি। গন্ধ না শুকে হাত দিয়ে ছুঁয়েও বোঝা যায় কোনটা কাঁচা কোনটা পাকা। কিন্তু হাত দিয়ে ছুঁয়ে, গন্ধ না খুঁকে দূর থেকে তুমি কী করে বলবে কোনটা কঁচা কোনটা পাকা?

    রঙ দেখে।

    সেই রঙটা কী? একটা জিনিসের অনেকগুলি রঙ কেন হয়? কীভাবে হয়?

    আমি বুঝতে পারি না। হতাশ বোধ করি। যে চোখে দেখতে পায় তার কাছে রঙের ব্যাপারটা যত সহজ, যে দেখতে পায় না তার কাছে এটা ততই কঠিন।

    এক সময় লক্ষ্য করলাম পারুলের বেশিরভাগ প্রশ্নেরই আমি জবাব দিতে পারছি না। তার প্রশ্নগুলি ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।

    অগর ভাইয়া তুমি প্রায়ই বল চাঁদের আলো সুন্দর। তা হলে কি সূর্যের আলো অসুন্দর?

    অসুন্দর না তবে চাদের আলো বেশি সুন্দর। চাঁদের আলো নরম।

    আলোর ভেতর নরম আর শক্ত কী? তুমি তো আর আলো হাত দিয়ে ধরতে পারছ না।

    কথার কথা বললাম।

    সূর্যের আলো গায়ে লাগলে আমি বুঝতে পারি। চাঁদের আলো বুঝতে পারি কেন?

    ঐ যে বললাম চাঁদের আলো খুব হালকা।

    হালকা বলছ কেন? আলোর কি ওজন আছে?

    পারুল আমি বুঝতে পারছি না।

    তুমি একবার বলেছি পৃথিবীতে সব মিলিয়ে মাত্র সাতটা রঙ। আসলেই কি তাই?

    হ্যাঁ সাতটা রঙ। তবে একটা রঙের সঙ্গে অন্য রঙ মিলে নতুন রঙ তৈরি হয়।

    বুঝতে পারছি না।

    চিনি সঙ্গে যদি সামান্য লবন মেশানো হয় তাহলে খাবারে যমেওন মিষ্টি স্বাদ থাকে তার সঙ্গে সঙ্গে একটু লোনা স্বাদও থাকে। অনেকটা এ রকম?

    তার মানে কি এই যে পৃথিবীতে রঙের কোনো সীমা নেই?

    হ্যাঁ তাই।

    আরো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বল আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

    আমি তাকে বুঝাতে পারি। আমি নিজে যেমন হতাশ হই—পারুল তার চেয়ে বেশি হতাশ হয়। সে প্রাণপণে চেষ্টা করে তার হতাশা চেপে রাখার। সেই চেষ্টা ফলবতী হয় না।

    পারুল যতই বড় হতে থাকল তার ভেতর থেকে হাসি খুশি ভাব ততই কমে যেতে লাগল। এবং তার প্রশ্নগুলিও ততই অদ্ভুত হতে লাগল। যেমন সে একদিন জিজ্ঞেস করল–

    অগর ভাইয়া একটা মেয়ে যখন একটা ছেলেকে পছন্দ করে—মানে এই ইয়ে ধর ভালবাসে তখন কি সেই ভালবাসারও রঙ আছে?

    না।

    না কেন? সব কিছুর রঙ আছে ভালবাসার রঙ থাকবে না কেন? থাকতেই হবে। ভালবাসার খুব সুন্দর রঙ থাকবে। ঘৃণার থাকবে কুৎসিত রঙ। অবহেলার এক রকম রঙ আবার অভিমানের অন্য রকম রঙ।

    আমি হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকি। পারুল প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যায়। মনে হয়ে সে যেন রেগে যাচ্ছে।

    আচ্ছা আবেগের কোন রঙ নেই?

    শব্দের? শব্দের কী কোন রঙ আছে?

    গাছের পাতা যখন বাতাসে কাঁপে তখন কি তার রঙ বদলে যায়?

    পারুল গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বলে—আমার মনে হয় শব্দের রঙ আছে। তোমরা ভালমত দেখতে পার না বলে বুঝতে পার না। বৃষ্টি পড়ার শব্দের এক রকমের রঙ, আবার পাখি যখন ডাকল তখন আরেক রকম রঙ। মুরগি যখন জবাই করার আগে চিৎকার করতে থাকে তখন তার চিৎকারের এক রকম রঙ। আবার স্বাভাবিক অবস্থায় যে যখন ডাকে তখন অন্য রকম রঙ।

    আমি চুপ করে যাই পরুলও চুপ করে যায়। এবং একটা সময় আসে যখন এ জাতীয় কথাবার্তা সে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। বেশির ভাগ সময় সে কাটাতে থাকে আমাদের বাড়ির পেছনের পুকুর পাড়ে। আমি দূর থেকে লক্ষ্য করি সে পুকুরের পাড় ঘেসে হাঁটে আর আপন মনে কথা বলে।

    বাবা একদিন বললেন, মেয়েটার হল কী বলতো? পাগল হয়ে গেল নাকি? পুকুরের চারদিকে শুধু চক্কর দেয়। পুকুরটা কি কাবা শরীফ যে তার চারপাশে চক্কর দিতে হবে? নিষেধ করিস তো। কোন দিন পা পিছলে পুকুরে পড়বে। সাঁতার জানে না। একসিডেন্ট করবে।

    বাবার কথা একদিন ফলে গেল। পারুল পা পিছলে পুকুরে পড়ে গেল। আমরা কেউ তা জানতেও পারলাম না। আমরা জানলাম দুপুরের পর যখন পারুল পুকুরে ভেসে উঠছে।

    পারুল পা পিছলে পুকুরে পড়েছিল না-কি নিজে ইচ্ছা করে পুকুরে নেমে গিয়েছিল এ বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। দৃষ্টিহীন মানুষ অসম্ভব সাবধানী হয়। কলার খোসায় পা পিছলে সাধারণ মানুষ পড়ে, দৃষ্টিহীন মানুষরা পড়ে না। তাছাড়া পুকুর পাড়ের মাটির প্রতিটি ইঞ্চি পারুলের পরিচিত। সে তার ক্ষুদ্র জীবনে খুব কম করে হলেও এক লক্ষবার পুকুরের চারদিকে হেঁটে ফেলেছে।

    যে রাতে পারুল মারা যায় তার আগের রাতে আমার সঙ্গে সে যে সব কথা বলেছে তার থেকেও খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আমরা দুজন রাতের খাবার খাচ্ছি—বাবা বাইরে। তিনি রাতেই ফিরবেন, কিন্তু ফিরতে দেরি হবে। পারুল ভাত মাখতে মাখতে হালকা বলল, অগর ভাইয়া মৃত্যুর আগে আগে অন্ধ মানুষ নাকি চোখে দেখতে পায়। বধিরও কানে শুনতে পায়? কথাটা কি সত্যি?

    আমি বললাম, কে বলেছে?

    রহিমা খালা বলেছে।

    ঠিক বলেনি।

    পারুল গম্ভীর গলায় বলল, আমার মনে হয় ঠিকই বলেছি। মৃত্যুর আগে শেষবারের মত মানুষ প্রাণ ভরে পৃথিবী দেখবে এটাই স্বাভাবিক। বুঝলে ভাইয়া আমি আর কিছু চাই না শুধু একবারের মত রঙ ব্যাপারটা কী দেখতে চাই।

    আমি নিজে মনে করি পারুল মারা গেছে–রঙ কী সেটা একবারের জন্যে হলে ও দেখতে গিয়ে। আমার এই ধারণার কথা আমি বাবাকে বলিনি। বললে তিনি খুব কষ্ট পেতেন।

    পারুলের মৃত্যুর পর বাবা এমন ভাব করলেন যেন তিনি খুশি হয়েছেন। পারুলকে কবর দেয়া হল পুকুর পাড়ে। কবর দেয়ার পরে বাবা আর আমি চুপচাপ বারান্দায় বসে আছি। বাবা বললেন—ভালই হয়েছে বুঝলি উগর। মেয়েটা মরে গিয়ে বেঁচেছে। আমি আসলে খুশিই হয়েছি। আই এম এ হ্যাপী ম্যান। মেয়েটার বিয়ে দিতে পারতাম না, কষ্টে কষ্টে জীবন কাটত। তাই না?

    আমি বললাম, হ্যাঁ।

    আমি যতদিন থাকতাম মেয়েটাকে দেখতাম। তারপর আমি যখন মারা যেতাম তখন কী হত? তুই থাকতি তোর নিজের সংসারে নিয়ে। পারুল তোর সঙ্গে থাকলে তোর বৌ হয়ত সেটা পছন্দ করত না। ঠিক না?

    হ্যাঁ।

    যা হয়েছে ভালই হয়েছে। ঠিক না টগর?

    হুঁ ঠিক।

    চুপচাপ বারান্দায় বসে থেকে কী করবি? যা ঘুমুতে যা।

    আমি ঘুমুতে গেলাম। বাবাও ঘুমুতে গেলেন। কিছুক্ষণ পরই শুনি বাবা। বিকট চিৎকার করে কাঁদছেন। আমি বললাম, কী হয়েছে বাবা? বাবা বললেন, মেয়েটা একা একা ভয় পাচ্ছে।

    আমি বললাম, চল আমরা দু’জন কবরের পাশে বসে থাকি।

    বাবা তৎক্ষণাৎ বিছানা থেকে নেমে বললেন, চল যাই।

    আমরা দু’জন বাকি রাতটা পারুলের কবরের পাশে চুপচাপ বসে কাটিয়ে দিলাম। ভোরবেলা আমি ঘরে ফিরলাম জ্বর নিয়ে। তেমন জ্বর না, সামান্য শরীর গরম। মাথা ঝিমঝিম। সেই জ্বর আর কাটে না। এক দু’দিন ভাল থাকি আবার জ্বর আসে।

    শরীর দুর্বল হতে থাকল। এক সময় চোখ ঘোলাটে হয়ে গেল। কিছুদিন পর এমন অবস্থা হল যে আমি বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারি না। কিছুই খেতে পারি না। সামান্য পানি মুখে দিলেও বমি হয়ে যায়। নানান ধরণের চিকিৎসা হতে থাকল। এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজী, ইউনানী। আধি ভৌতিক চিকিৎসাও হল। কেউ কেউ বললেন আমাকে জ্বীনে ধরেছে। সেই জ্বীন তাড়াবার ব্যবস্থাও হল। হলুদ পুড়িয়ে নাকের কাছে ধরা। শুকনো মরিচ পুড়িয়ে ধোয়া দেয়া। ভয়াবহ ব্যাপার। কোন লাভ হল না। বাবা আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। ঢাকার ডাক্তাররা অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বললেন—আমার যা হয়েছে তার নাম জন্ডিস। খুব খারাপ ধরনের জন্ডিস। হেপাটাইটিস বি। লিভার পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। ডাক্তারদের নাকি করার কিছু নেই। বাবা আমাকে দেশের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন।

    এক রাতে আমার অবস্থা খুব খারাপ হল। রহিমা খালা কান্নাকাটি শুরু করলেন। আমি বাবাকে ডেকে বললাম, আমার খুবই খারাপ লাগছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। দম আটকে আসছে। তুমি আমাকে কোলে করে বারান্দায় নিয়ে যাও। খোলা বাতাসে আমি বোধ হয় নিঃশ্বাস নিতে পারব। বাবা আমাকে কোলে তুলে নিলেন। তবে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গেলেন না। বাড়ির পেছনে নিয়ে গেলেন। আমাদের বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে বড় একটা শিউলি গাছ ছিল। প্রতি বছর এই গাছে অসংখ্য ফুল ফুটতো। বাবা সরাসরি গাছের কাছে নিয়ে গেলেন এবং আমাকে অদ্ভুত একটা কথা বললেন—

    বাবা বললেন, টগর তোর যে অসুখ হয়েছে সেই অসুখ সারাবার সাধ্য মানুষের নেই। আমি একটা শেষ চেষ্টা করব। অন্য রকম এক চিকিৎসা। সাধু ধরনের একজন মানুষ এই চিকিৎসায় ভাল হয়েছেন। তাঁর মুখ থেকে শোনা। সব চেষ্টাই তো করা হল—এটাও এক ধরনের চেষ্টা।

    আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, কী চেষ্টা?

    তোকে আমি শিউলি গাছের নীচে বসিয়ে দিব। তুই দুই হাতে শক্ত করে গাছটাকে জড়িয়ে ধরে থাকবি আর মনে মনে বলবি, গাছ তুমি আমার অসুখটা তোমার নিজের শরীরে নিয়ে আমাকে সুস্থ করে দাও। পারবি না?

    আমি বললাম, পারব। বাবাকে খুশি করার জন্যেই বললাম পারব।

    ডুবন্তু মানুষ বাঁচার জন্যে খরকুটো ধরে। বাবাও তাই করছেন। কিছু না পেয়ে গাছের হাতে আমাকে তুলে দিচ্ছেন। বাবা যে ভাবে গাছ ধরতে বললেন, সেই ভাবে ধরলাম এবং মনে মনে বললাম, হে গাছ তুমি আমার রোগ তোমার নিজের শরীরে নিয়ে আমাকে সুস্থ করে দাও।

    বাবা বললেন, টগর। তোকে এই যে আমি গাছের সঙ্গে জুড়ে দিলাম আর তুলব না। তুই খুব মন লাগিয়ে গাছকে বল তোকে সারিয়ে দিতে।

    আমি গাছ জড়িয়ে ধরে বসে আছি। আমার অসম্ভব দুর্বল শরীরে কিছু না ধারে বসে থাকাও সম্ভব না। আমি যা করছি তা যে খুব অস্বাভাবিক কিছু তাও মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যা করছি, ঠিকই করছি।

    রহিমা খালা বাবাকে বললেন—আপনের কি মাথাটা খারাপ হইছে? আপনে করতাছেন কী? এইটা কেমন চিকিৎসা? অসুখ হইছে পুলার। মাথা খারাপ হইছে আপনের।

    বাবা বললেন, তুমি কথা বলবে না রহিমার মা। একটা কথাও না।

    এই অবস্থায় কতক্ষণ থাকব?

    জানি না।

    আমার অসুখ এই পর্যায়ের ছিল যে আমি বেশির ভাগ সময়ই ঘোরের মধ্যে থাকতাম। চারপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে বুঝতে পারতাম না।

    গাছ জড়িয়ে ধরার পর পরই আমি ঘোরর মধ্যে চলে গেলাম। প্রবল ঘোর। মাঝে মাঝে ঘোর কমে, আমি আবছা ভাবে দেখি বাবা পাশেই বসে আছেন। আমি যতবারই চোখ মেলি ততবারই বাবা বললেন—কথা বল। গাছের সঙ্গে কথা বল।

    আমি ফিস ফিস করে বলি—হে গাছ তুমি আমার রোগ তোমার শরীরে নিয়ে আমাকে সারিয়ে দাও। হে গাছ তুমি আমার রোগ তোমার শরীরে নিয়ে আমাকে সারিয়ে দাও। হে গাছ তুমি…

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকে কথা কয় – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article মেঘের ওপর বাড়ি – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }