Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কাল তুমি আলেয়া – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প766 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কাল তুমি আলেয়া – ১৩

    তেরো

    গোটা কারখানায় একটা নিঃশব্দ প্রতিবাদ পুষ্ট হয়ে উঠেছে। কোনো। কথা-কাটাকাটি নেই, তর্কাতর্কি নেই, কোনরকম বিরুদ্ধ-আচরণ নেই, অথচ ভিতরে ভিতরে কেউ কিছু বরদাস্ত করতে রাজি নয় যেন। সেই কিছুটা কি, ধীরাপদ সঠিক ঠাওর করে উঠতে পারে না।

    কারখানার মানসিক পরিবর্তন এসেছে একটা, তাই শুধু অনুভব করে।

    হিমাংশু মিত্রের কোনো নির্দেশ কেউ অমান্য করেনি এ পর্যন্ত। এমন কি ছেলেও না। প্রসাধন বিভাগের নতুন বিলডিং উঠবে শহরের আর এক প্রান্তে। বাপের নির্দেশে মুখ বুজে সেখানে তার তত্ত্বাবধানে লেগে আছে সে। নতুন শাখা চালু করার ব্যবস্থাপত্র নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। তবু হিমাংশুবাবু ঠিক যেন খুশি নন। তাঁর মুখের আত্মপ্রত্যয়ী হাসির ভাবটুকু কমে আসছে, প্রসন্নতায় টান ধরছে। ধীরাপদর মনে হয়, যা তিনি করাচ্ছেন তাই হচ্ছে, যা তিনি চাইছেন তা হচ্ছে না। কি চাইছেন আর কি হচ্ছে না জানে না।

    সিতাংশু দিনে একবার করে আসে কারখানায়। বিকেলের দিকে, ছুটির আগে। কাজ সেরেই আসে বোঝা যায়। কারণ হিমাংশুবাবু খোঁজখবর করেন, কাগজ-পত্র দেখেন। ইদানীং তিনি প্রায়ই দিনে দুবার করে আসছেন কারখানায়। সকালে আসেনই, বিকেলের দিকেও মাঝে মাঝে আসেন। ছেলের সঙ্গে দেখা হয়। কোন একটা কাজ হয়নি শুনলে খুশি হন বোধ হয়, কিন্তু সেও বড় শোনেন না। ধীরাপদর এক-এক সময় মনে হয়, কাজ করানো আর কাজ করা নিয়ে বাপে- ছেলেতে নীরব রেষারেষি চলছে একটা।

    সিতাংশুর এখানকার কাজের দায়িত্ব বেশির ভাগ ধীরাপদর ঘাড়ে এসে পড়েছে। দায়িত্ব নেবার লোক আরো ছিল, কিন্তু বড় সাহেবের এই-ই নির্দেশ। এটা ব্যক্তিগত অনুগ্রহ না তার কাজের প্রতি আস্থা সে-সম্বন্ধে ধীরাপদ নিঃসংশয় নয়। নিজের কর্মতৎপরতার অনেক অনুকূল নজির মনে মনে খাড়া করেছে। যেমন, ও আসার পর থেকে বিজ্ঞাপনের উন্নতি হয়েছে, প্রচারের কাজ ভালো হচ্ছে, সেল বেড়েছে, বাইরের ডাক্তাররা সুখ্যাতি করছেন, এমন কি কর্মচারীরাও তার সদয় ব্যবহারে কিছুটা তুষ্ট। কিন্তু এর কোনোটাই ধীরাপদ একেবারে নিজ বিচক্ষণতার পর্যায়ে ফেলতে পারছে না।

    লাবণ্য সরকার ঘরে আসে কম, ফাইল পাঠায় বেশি। কারখানার ফাইল, মেডিক্যাল হোমের ফাইল। বড় সাহেবের ব্যবস্থা নির্বিবাদে মেনে নিয়েছে, কোনো আপত্তি বা অভিযোগ নেই। অথচ তার এই নিরাসক্ত চালচলন আর ব্যবহারও নিঃশব্দ প্রতিবাদের মতই মনে হয় ধীরাপদর। লাবণ্য বিকেল পর্যন্ত কাজ করে, তার পর সিতাংশু এলে দুজনে একসঙ্গে বেরিয়ে যায়।

    এও যেন নীরব অথচ স্পষ্ট প্রতিবাদ কিছুর।

    অসুখের পরে কাজে যোগ দেবার পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে ধীরাপদ বাড়তি কাজের দায়িত্ব নিয়েছে। ঠিক সাত দিনের মাথায় বড় সাহেব প্রস্তাব করলেন, অফিসের পর সন্ধ্যার দিকে তাঁর বাড়িতে জরুরী আলোচনার বৈঠক বসবে। কারখানা প্রসঙ্গে আলোচনা, আসন্ন দশম বার্ষিকী উৎসবের বিধি-ব্যবস্থার আলোচনা, প্রসাধন-শাখার ব্যবস্থাপত্রের আলোচনা। এক কথায় যাবতীয় সমস্যালোচনা আর পরিকল্পনার বৈঠক হবে সেটা। বড় সাহেব থাকবেন, ছোট সাহেব থাকবে, ধীরাপদ থাকবে, অমিতাভ থাকে ভাল নয়ত প্রয়োজনে সিনিয়র কেমিস্ট জীবন সোমকে ডাকা হবে।

    লাবণ্য সরকারের থাকা সম্ভব নয়। কারণ তার সে সময়ে মেডিক্যাল হোমের অ্যাটেন্ডান্স। সেটা অপরিহার্য।

    প্রথম দিন দুই আলোচনার নামে বসেই কেটেছে এক রকম। বড় সাহেব পরে এসেছেন, আগে উঠেছেন। কিন্তু তারা দু’জন সময়মত এসেছিল কিনা খোঁজ নিয়েছেন। তারা বলতে ধীরাপদ আর সিতাংশু। অমিতাভ আসেনি, আসবে কেউ আশাও করেনি। আলোচনা কিছুই হয়নি, ব্যবসায়ের উন্নতি প্রসঙ্গে ভালো ভালো দু-পাঁচটা কথা শুধু বলেছেন। অপ্রাসঙ্গিক হালকা রসিকতাও করেছেন একটু-আধটু। তাঁর হয়ে বক্তৃতা লিখে লিখেই নাকি ধারাপদর মুখখানা আজকাল অত বেশি গম্ভীর হয়ে পড়েছে, অল্প বয়সের গম্ভীর মুখ দেখলে তাঁর মত বুড়োরা কি ভাবেন, মেয়েরা কি ভাবে, ছোটরা কি ভাবে ইত্যাদি। কেয়ারটেক বাবুকে ডেকে চা-জলখাবারের অর্ডার দিয়েছেন। ছেলে কতদূর কি এগোল না এগোল সেই খবর করেছেন একটু। চা-জলখাবার আসতে নিজের হাতে টেবিলের কাগজপত্র সরিয়ে দিয়েছেন।

    বিকেলের এই আলোচনা-বৈঠকে বড় সাহেবকে আবার আগের মতই খুশি দেখেছে ধীরাপদ।

    কিন্তু মুখ গম্ভীর ধারাপদর নয়, মুখ সারাক্ষণ থমথমে গভীর সিতাংশুর। তার দিকে না চেয়েই বড় সাহেব সেটা লক্ষ্য করেছেন, তারপর ধীরাপদকে ঠাট্টা করেছেন।

    আর ঠিক সেই মুহূর্তে ধীরাপদর চোখের সম্মুখ থেকে একটা রহস্যের পরদা খণ্ড খণ্ড হয়ে ছিঁড়ে গেছে। এমন নির্বোধ তো ও ছিল না কোনো কালে, এই জানা কথাটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে এত দেরি! আসলে লাবণ্য সরকারের কাছ থেকে ছেলেকে সরিয়ে রাখতে চান বড় সাহেব, তফাতে রাখতে চান। সেটা হয়ে উঠছিল না বলেই একটা অকারণ ক্ষোভের আঁচ লাগছিল সকলের গায়ে। এদের দুজনকে একসঙ্গে দেখা বা দুজনের একসঙ্গে বম্বে যাওয়ার খবরে তাঁর বিরূপ ভাব ধীরাপদ নিজেই তো কতবার লক্ষ্য করেছে। প্রসাধন শাখায় হোক লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিয়োগ, টাকা যার আছে, ও টাকা তার কাছে কিছুই নয়—ছেলেকে সরাতে হবে, তফাতে রাখতে হবে। সেই জন্যেই প্রসাধন-শাখা বিস্তার। আর সেই জন্যে অসময়ের এই আলোচনা-বৈঠকের ব্যবস্থা যে-সময়ে নির্বাক প্রতিবাদে লাবণ্য সরকার আর সিতাংশু মিত্র সকলের নাকের ডগা দিয়ে হনহন করে কারখানা থেকে যায়, যে-সময়টা মেডিক্যাল হোমে লাবণ্য সরকারের অপরিহার্য হাজিরার সময়।

    ধাঁধার জবাব মিলে যাচ্ছে।

    ধারণাটা সেদিন আরো বদ্ধমূল হয়েছে মানকের কথা শুনে। অবশ্য সে শোনাতে আসেনি কিছু, বরং চাপা আগ্রহে শুনতেই এসেছিল কিছু। সুযোগ-সুবিধে বুঝে ঝাড়ন হাতে টেবিল-চেয়ার ঝাড়-মোছ করতে এসেছিল মানকে। বড় হলঘরে ধীরাপদ একা বসেছিল। বড় সাহেব আসেননি তখনো। ছোট সাহেব একবার এসে ঘুরে গেছে, বাবা এলে তাকে ভিতর থেকে ডেকে আনতে হবে।

    ধীরাপদর সামনের টেবিলটাই মানকে আগে ঝেড়ে মুছে দেওয়ার দরকার বোধ করল। কাছে একটা মানুষ আছে যখন একেবারে মুখ বুজে থাকা যায় কি করে, ক্ষোভ কি কম জমে আছে? ঘর-দোর একদিন না দেখলে কি অবস্থা হয় সেটা ও ছাড়া আর কে জানে? তারিফ নেবার বেলায় অন্য লোক। গোটা জীবনটা তো এই এক জায়গায় গোলামী করে কেটে গেল, তবু আশা বলতে থাকল কি? যেদিন পারবে না, দেবে দূর করে তাড়িয়ে। বাস, হয়ে গেল!

    ধীরাপদকে শুনিয়ে আপনমনে খানিক গজগজ করে হঠাৎ কাছে ঝুঁকে এলো মানকে। চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, বাবু, ছোট সাহেব রাজি হলেন বুঝি?

    ধীরাপদ প্রশ্নটা সঠিক বুঝে উঠল না। মানকের মুখে চাপা আগ্রহ আর অনধিকার চর্চার সঙ্কোচ।

    কিসে রাজি হলেন?

    ওই য়ে বিয়ের! কেয়ার টেক বাবু বলছিলেন, আসছে ফাল্গুনেই হতে পারে –আপনি জানেন না?

    ধীরাপদ জানে না গোছের মাথা নাড়ল। কৌতূহল মেটাতে এসে কিছুটা কৌতূহলের খোরাক দিতে পেরেছে বলেও মানকের তৃপ্তি একটু। বড় সাহেবের নেকনজরের এই ভালো মানুষটাকে তেমন চটকদার খবর কিছু দিতে পারলে আখেরে ভালো ছাড়া আর কি হতে পারে? অতএব যতটা জানে আর যতটা ধারণা করতে পারে, প্রসন্ন উত্তেজনায় তার সবটাই বিস্তার করে ফেলল সে।

    …রাজকন্যের সঙ্গে বিয়ে হবার কথা। রাজকন্যে নয়, ভুল বলল, কেয়ারটেক বাবু বলেছিলেন মিনিসটারে’র কন্যে। মিনিসটার মন্ত্রী না বাবু? কেয়ারটেক বাবু তো আবার ইনরিজি বলতে পেলে বাংলা বলেন না! তাঁকে অর্থাৎ হবু শ্বশুরকে এই বাড়িতেই ওরা বারকতক দেখেছে। মেয়ে নিয়েও বেড়াতে এসেছিলেন একদিন। পরীর মত মেয়ে। দু গালে আপেলের মত রঙ বোলানো আর ঠোঁট দুটো টুকটুক করছে লাল —’লিপটিকে’র লাল, চিত্তির-করা পটে-আঁকা মুখ একেবারে। সেই রেতেই তো বড় সাহেবের কি রাগ ছোট সাহেবের ওপর—ছোট সাহেব যে বাড়ি ছিলেন না!

    মনের মত শ্রোতা পেয়ে চাপা আনন্দে আরো একটু কাছে ঘেঁষে এসেছে মানকে। —আসল কথা কি জানেন? ছেলে এ বিয়েতে নারাজ, তাঁর বোধ হয় মেম-ডাক্তারকেই মনে ধরেছে-কাউকে বলবেন না যেন আবার বাবু!

    ধীরাপদ মাথা নাড়তে আশ্বস্ত হয়েছে। মানকের আর কি, সব তো শোনা কথা, কেয়ার-টেক বাবর বলা কথা। তাঁর তো ‘সব্বকথায়’ আড়ি পাতার সুবিধে—যতক্ষণ বাড়ি থাকেন সাহেবরা আর জেগে থাকেন, দোরগোড়ায় ততক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তো তাঁকে——তাঁরই শোনার সুবিধে সব। তিনি বলছিলেন, এই বিয়ে নিয়েই ছেলেতে বাপেতে মন-কষাকষি। আর বলছিলেন, বড় সাহেবের ইচ্ছে যখন হয়েছে বিয়ে হবেই, এই ফাল্গুনেও হতে পারে।

    এরপরেই মানকের বিরূপতা কেয়ার টেক বাবুকে কেন্দ্র করে। কেয়ার-টেক বাবু নাকি ওকে শাসিয়েছেন, বিয়েটা হয়ে গেলে ও টেরটি পাবে! ও যেন কাজ না করেই এতকাল আছে ‘এ বাড়িতে—খায়-দায় আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমোয়! হাতে-পায়ে খেটে খায়, ওর ভয়টা কিসের? আর বিয়ে হচ্ছে ভালই তো হচ্ছে—ছেলেমেয়ে না থাকলে গেরস্ত-বাড়ি তো মরুভূমির মত-কি বলেন বাবু, ভয়টা কিসের?

    ধীরাপদ মাথা নেড়ে আবারও আশ্বাস দিয়েছে, ভয় নেই। নিজের অগোচরে মানকে একটা সত্যি কথাই বলে ফেলেছে। বাড়িটাকে গৃহস্থ-বাড়ি বলে কখনো মনে হয়নি বটে, আর এ-বাড়ির মানুষ ক’টিও যেন ঘরের মানুষ নয়। এত নিরাপদ সচ্ছলতা সত্ত্বেও ছন্নছাড়ার মত এদের জীবন শুধু ভাসছেই, কোথাও নোঙর নেই।

    গৃহস্থ-তত্ত্ব নিয়ে তেমন মাথা ঘামানো হয়ে ওঠেনি ধীরাপদর। বড় সাহেব বা ছোট সাহেবের হাবভাব রকম সকমের অর্থ স্পষ্ট। কিন্তু লীবণ্য সরকারের এই পরিবর্তনের অর্থ কী? সে হঠাৎ এত গম্ভীর কেন? অমিতাভ ঘোষের প্রতি সেদিনের সেই গোপন দুর্বলতা সত্যি হলে- সত্যি বলেই বিশ্বাস ধারাপদর—তার তো এ ব্যবস্থায় খুশি হবার কথা!

    ….নাকি ছোট বিপদের আড়ালে ছিল, এখন বড় বিপদের সম্ভাবনা কিছু? যে ধাঁধাটা সেদিন অমন সুন্দর মিলে গিয়েছিল, সেটা তেমন আর মিলছে না এখন। আবারও জট বেধেছে কোথায়।

    ছোট একটা ঘটনায় অমিতাভ ঘোষের নীরব অসহযোগিতা স্পষ্টতর হয়ে উঠল। প্রহসন কৌতুকাবহ।

    ভাবনা সত্ত্বেও ধীরাপদর হাসিই পেয়েছে। আরো হাসি পেয়েছে লাবণ্যর দুরবস্থা দেখে। সরকারী স্বাস্থ্যনীতির দৌলতে ওষুধের কারখানায় বছরে দু-পাঁচটা বড়সড় অর্ডার আসে। শুধু এখানকার নয়, বিভিন্ন রাজ্য সরকারেরও। এবারের যে অর্ডারটা এসেছে সেটা খুব বড় না হলেও তেমন ছোটও নয়। কিন্তু ছোট হোক বড় হোক, চুক্তি অনুযায়ী সেটা সরবরাহ করাই চাই। অন্যথায় সুনাম নষ্ট, মর্যাদা হানি।

    কোনো ওষুধের দেড় লক্ষ ইনজেকশান অ্যামপুলের অর্ডার। বছর দুই আগে এই ইনজেকশানই আর একবার সরবরাহ করা হয়েছিল। আবারও চাই। আগের বারে এর প্রধান কর্মকর্ত্রী হিসেবে লাবণ্য সরকারের নাম স্বাক্ষর ছিল। অর্থাৎ, ওষুধ তার তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়েছিল।

    কিন্তু কাজটা আসলে করিয়েছিল অমিতাভ ঘোষ। তার প্রীতির আমেজে তখনো ঘা পড়েনি এমন করে। লাবণ্যকে মর্যাদা এবং পরিচিতি লাভের এই সুযোগটুকু দিতে চীফ কেমিস্টের দ্বিধা ছিল না তখন

    এ-সব ওষুধের ফরমুলা বা উপাদান-সমষ্টি ক্রেতা বিক্রেতা নির্মাতা সকলেরই চক্ষুগোচর। গোপন নেই কিছুই। ফরমূলা আর পরিমাণ বা পরিমাপ লিখেই দিতে হয়। তবু প্রস্তুত-প্রণালীর মধ্যে প্রত্যেক কোম্পানীরই গোপন বৈশিষ্ট্য কিছু থাকে, যা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এই প্রস্তুত-প্রণালী বা প্রোসেসিং এর দক্ষতা যে উপেক্ষার বস্তু নয়, সেটা শুধু ধীরাপদ নয়, লাবণ্য সরকারও এই প্রথম বোধ হয় তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছিল।

    ওষুধ এবারে তৈরি হচ্ছিল সিনিয়র কেমিস্ট জীবনবাবুর তত্ত্বাবধানে। কিন্তু প্রতিবারই স্যাম্পল করে দেখা গেল ওষুধ ঘোলাটে দেখাচ্ছে কেমন, আর অ্যামপুলে তলানির মত পড়ছেও একটু। সপার্ষদ জীবন সোম অনেক কিছু করলেন। ওষুধের ঘোলাটে ভাবটা যদিও বা কাটানো গেল, তলানি থেকেই যাচ্ছে। ওদিকে হাতে সময়ও বেশি নেই।

    কিন্তু সমস্যার পরোয়া আর যে করুক, অমিতাভ ঘোষ করবে না। তার সাফ জবাব, ও ওষুধ আগের বারে যে তৈরি করিয়েছে সে-ই করুক, তার দ্বারা হবে না। অর্থাৎ লাবণ্য সরকার করুক। আগের বারে সে-ই করিয়েছে। কাগজে-কলমে তার স্বাক্ষর আছে।

    লাবণ্য সরকারের ডাক পড়েছিল। তাকে যেতে হয়েছিল। কিন্তু দু বছর আগে যে কাজ সে পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছে শুধু, এতদিনে মন থেকে তা ধুয়ে মুছে গেছে। তার সঙ্কট। আর সেই জন্যেই পরিস্থিতিটা সকলের উপভোগ্য যেন।

    সমাধান না হলে ছোট সমস্যাও বড় হয়ে দাঁড়ায়। রাগে দুঃখে লাবণ্যই হয়ত সিতাংশুকে বলেছে ব্যাপারটা। ছেলের ক্রুদ্ধ অভিযোগ থেকে বাপেরও জানতে বাকি থাকেনি। কোম্পানীর সুনাম আর মর্যাদার ‘প্রশ্ন যেখানে সেখানে এ-সব ছেলেমানুষি আর কতকাল বরদাস্ত করা হবে?

    ছেলের মত বড় সাহেব অতটাই উগ্র হয়ে ওঠেননি। ব্যাপারটা বুঝে নেবার পর লাবণ্যর বিব্রত মুখের দিকে চেয়ে হাসি গোপন করেছেন বলে মনে হয়েছিল ধীরাপদর। বড় সাহেবের কাছে সত্যি জবাবদিহিই করে গেছে লাবণ্য সরকার। আগের বারের কাজটা সে নিজে হাতে করেনি, পাশে ছিল। তাকে সই করতে বলা হয়েছিল, সে সই করেছিল।

    তারা চলে যেতে হিমাংশুবাবু সরস মন্তব্য করেছেন, এবারেও পাশে থাকলে গোল মেটে কিনা সে চেষ্টাই তো আগে করা উচিত ছিল, কি বল?

    কিন্তু সমস্যাটা হালকাও নয়, হাসিরও নয়। বড় সাহেব ভুরু কুঁচকে ভেবেছেন

    তারপর।

    সকলেই একটা দ্রুত নিষ্পত্তি আশা করছে, ফয়সালার কথা ভাবছে। এ ধরনের ছোটখাটো গোলযোগে এই ব্যতিক্রম নতুন। আগে মেঘ অনেকটা একদিকেই ঘনাত, একতরফাই গর্জাত। তখন সময়ের দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করা হত খানিকটা।

    এখন বিপরীতমুখী দুটো মেঘ দেখছে ধীরাপদ। সংঘাতের আশঙ্কা

    চুপচাপ অপেক্ষা করার মত সময় কম হাতে। এই পরিস্থিতিতে আপাতত যা করে রাখা উচিত, সে দিকটা কেউ ভাবছে না। চিঠি লিখে বা তদবির করে ইনজেকশান সরবরাহের নির্দিষ্ট সময়ের মেয়াদ বাড়িয়ে রাখা দরকার। কোনো কোম্পানীর পক্ষে সেটা গৌরবের নয় বটে, কিন্তু তেমন প্রয়োজনে অস্বাভাবিকও কিছু নয়। সে চেষ্টা ধীরাপদ নিজেই করে দেখতে পারে। কিন্তু করবে কি করে, বড় সাহেবের কোনো নির্দেশ নেই। ভাগ্নেকে ডেকে হুকুম না করুন অনুরোধ করতে পারতেন। তাও করেছেন মনে হয় না।

    বাপের কাছে নালিশ পেশ করেও সিতাংশুর মেজাজ জুড়োয়নি। ধীরাপদর ঘরেও এসেছিল সেই দিনই। কড়া মন্তব্য করেছে, কোম্পানীর প্রোসেসিং মেথড কারো নিজস্ব সম্পত্তি নয়—সেটা তাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া দরকার, নিজে কাজ করুক না করুক গেলবারে ও ওষুধ কি ভাবে তৈরি হয়েছিল তা সে দেখিয়ে-শুনিয়ে বুঝিয়ে দিতে বাধ্য।

    স্পষ্ট করে জানিয়ে কে দেবে অথবা কে তাকে এই বাধ্যতার মধ্যে টেনে নিয়ে আসবে সেটা মুখের ওপর জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারেনি বলেই ধীরাপদ চুপ করে ছিল। সিতাংশু সমস্যাটা বড় করে দেখছে কি মনের ক্ষুব্ধ মুহূর্তে একটা ওলটপালট গোছের বোঝাপড়াই বেশি চাইছে, সঠিক বোঝা ভার। বাড়ির সান্ধ্যবৈঠকে আবার এই প্রসঙ্গই উত্থাপন করেছিল সে। কিন্তু হিমাংশুবাবু এক কথায় সে আলোচনা বাতিল করে দিয়েছেন। বলেছেন, তুই পারফিউমারি ডিভিশান নিয়ে আছিস সেদিকটাই ভাব না এখন, এ নিয়ে মাথা গরম করবার দরকার কি—

    ধীরাপদর ধারণা, দরকার দুই কারণে। প্রথম, তার বর্তমান মনের অবস্থায় মাথা গরম করার মতই খোরাক দরকার কিছু। দ্বিতীয়, মানকের রাজকন্যের কাহিনীটা গোপন ষড়যন্ত্র নয় হিমাংশু মিত্রের। তাই ছেলের বিয়ে দিয়ে রাজকন্যে ঘরে আনার অভিলাষ লাবণ্যরও একেবারে না জানার কথা নয়। এ অবস্থায় নিজের অবিমিশ্র প্রীতির নজির – হিসাবে লাবণ্যর সঙ্কট মোচনের চেষ্টাটা সিতাংশুর পক্ষে স্বাভাবিক। লাবণ্যের এই হেনস্থার কারণ অমিতাভ না হয়ে আর কেউ হলে তাকে ভাল করেই শিক্ষা দিতে পারত। শিক্ষা দিয়ে নিজের এই বিড়ম্বনার মুহূর্তে লাবণ্যকে- তুষ্ট করা যেত।

    সেটুকুও পারা যাচ্ছে না বা করা যাচ্ছে না।

    দু দিন ধরে লাবণ্য সরকারও ধীরাপদর ঘরে আগের থেকে বেশি আসছে একটু। সরকারী সাপ্লাইয়ের গোলযোগের ব্যাপারটা বড় সাহেবের কানে ওঠার পর থেকে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে একটি কথাও উত্থাপন করেনি বা কোনরকম আগ্রহ দেখায়নি। শুধু ফাইল আনা-নেওয়া বা নোট-বিনিময়ের ব্যাপারটা আগের মত হাতে-হাতে বা মুখে- মুখে সম্পন্ন করছে।

    দুটো দিন ধীরাপদও একেবারে চুপচাপ ছিল, তারপর সে-ই তুলল কথাটা। না তুলেই বা করবে কি, ওদিকে সিনিয়র কেমিস্ট জীবনবাবু নির্লিপ্ত। তাঁর কোন দায়- দায়িত্ব নেই যেন। তাঁকে হুকুম করলে ওই ফরমুলা নিয়ে তিনি অন্যভাবে ওষুধ তৈরি করে দিতে পারেন। আগে কি হয়েছিল না হয়েছিল সে ভাবনা তাঁর নয়।

    যে ফাইলের খোঁজে এসেছিল লাবণ্য সরকার, সেটা তার হাতে না দিয়ে ধীরাপদ বলল, বসুন। তারপর ফাইল এগিয়ে দিতে দিতে সরল ভাবেই জিজ্ঞাসা করল, সরকারী অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা হল কিছু?

    বসতে বলা সত্ত্বেও লাবণ্য বসত কিনা সন্দেহ, প্রশ্ন শুনে বসল। হাতের কাছে ফাইলটা টেনে নেবার ফাঁকে নিজেকে আরো একটু সংযত করে নিল হয়ত।– ব্যবস্থা হল কিনা সেটা তো আমার থেকে আপনার অনেক ভালো জানার কথা, বড় সাহেব আপনাকে বলেননি কিছু?

    সেদিন বড় সাহেবের কাছে লাবণ্য জবাবদিহি করে আসার পরেও শুধু ধীরাপদই তাঁর ঘরে ছিল—সেই ইঙ্গিত। মাথা নাড়ল, কাজের কথা কিছু বলেননি। ভাবল একটু, আমার মনে হয় লেখালেখি করে সাপ্লাইয়ের মেয়াদটা আরো কিছু বাড়িয়ে নেওয়ার

    দরকার।

    সেই দরকারের পরামর্শটা কি বড় সাহেবকে আমি দেব?

    ধীরাপদ ফিরে জিজ্ঞাসা করল, আমাকেই বলতে বলছেন?

    লাবণ্য চুপচাপ রইল খানিক, সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, না বলাই ভালো, বললে গোলমালটা মিটে যেতে পারে।

    অর্থাৎ গোলমালটা মিটলে আপনাদের মজা মাটি।

    কারখানার এ পরিস্থিতি ভালো লাগছিল না, আলোচনার উদ্দেশ্যই প্রধান ছিল। কিন্তু সেটা আর হল না, টিপ্পনীটা একেবারে মুখ বুজে হজম করার মত নয়। বিশ্বাস তো করেই না, উল্টে মজা দেখার দলের একজন ভাবে তাকেও। মুখের হাসিটুকু আবরণ মাত্র, ভিতরে ভিতরে ধীরাপদত্ত তেতে উঠল!

    লাবণ্য জিজ্ঞাসা করল, আর কিছু বলবেন?

    .না…। এই যখন ভাবেন, কি বলার আছে!

    লাবণ্যর এরপর ওঠার কথা, উঠে চলে যাবার কথা। উঠল না। আবারও কিছু বলার ইন্ধন পেল বোধ হয়। মুখের দিকে চেয়ে থেকে হাসতে চেষ্টা করল একটু। হাসির আভাসে চাপা বিদ্বেষটুকু ঝলসে উঠল এবার। বলল, অর্ডার সাপ্লাইয়ের আর মাত্র ছ-সাত দিন বাকি, সবাই যে-রকম চুপচাপ বসে আছেন কি আর ভাবতে পারি?

    ঠাণ্ডা দুই চোখ ধীরাপদর মুখের ওপর আটকে আছে তেমনি। জবাবের প্রতীক্ষা করল একটু।—রোজই তো দুবেলা বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা হয় শুনি, তাঁর সঙ্গে এ পরামর্শটা করে ওঠার সময় আপনি এতদিনেও পেয়ে ওঠেননি বোধ হয়?

    বিদ্বেষের হেতু বোঝা গেল। এত কথার মধ্যে এই ব্যক্তিগত খোঁচাগুলি না থাকলে ধীরাপদ তার সদ্য দুর্গতির দিকটাই বড় করে দেখত। সে-চেষ্টাও করল না আর, আলোচনার মেজাজ আগেই গেছে। নির্লিপ্ত জবাব দিল, বড় সাহেব সব জেনেও কিছু বলছেন না যখন, পরামর্শ আর কি করব? এই ব্যাপারে আমার থেকেও হয়ত আপনার ওপরেই তিনি বেশি নির্ভর করে আছেন।

    লাবণ্যর মুখভাব বদলাল, চকিত বিস্ময়। তিনি কিছু বলেছেন?

    ঘুরিয়ে জবাব দিল, না, ওই সেদিনের পরে এ সম্বন্ধে আর কিছু বলেন নি। সেদিন কি বলেছেন?

    বক্তব্যের জালটা মনোমত গুটিয়ে এনেছে ধীরাপদ। দ্বিধাগ্রস্ত জবাব দিল, তাঁর ধারণা আপনি ইচ্ছে করলেই এই সামান্য গণ্ডগোল মিটে যেতে পারে।

    কি করে?

    পাশে থাকার কথাটা বলে উঠতে পারল না। বলল, আগের মতই অমিতবাবুর সঙ্গে মিলে-মিশে কাজ করে।

    সাদা পর্দায় রঙ ঠেকানো যায় না, ধীরাপদর সাদা মুখ সত্ত্বেও রঙ গোপন থাকল না। যে-ভাবেই বলুক লাবণ্যর যেটুকু বোঝবার বুঝে নিল।

    একটা মানুষকে একেবারে গোটাগুটি দুই চোখের আওতার মধ্যে নিয়ে আসতে সময় মন্দ লাগে না। লাবণ্য তাই নিয়ে এসেছে. সময়ও লেগেছে। তারপর খুব ঠাণ্ডা আর শান্ত মুখে বলেছে, বড় সাহেবের এই ধারণাটা আগে একবার তাহলে তাঁর মুখ থেকেই শুনে নিই, কি বলেন?

    স্ত্রীলোকের সকল তর্জন সয়, ভাতের তর্জন নয়। সেই গোছেরই হয়ে দাঁড়াল উক্তিটা। সেই রকমই কণ্ঠস্বর। ধীরাপদ মুখ তুলল। চোখে চোখ রাখল। দৃষ্টি-বিনিময় নয়, দৃষ্টি-বর্ষণ করল একপ্রস্থ। তারপর নিঃশঙ্ক জোরালো জবাব দিল, সেই ভালো। আমার কথাটাও বড় সাহেবকে বলবেন অনুগ্রহ করে, যেটুকু প্রশংসা লাভ হয়…. লাবণ্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, ঘর ছেড়ে বাইরে এসেছে, বারান্দা ধরে নিজের ঘরে চলে গেছে। ধীরাপদর তখনো চোখ সরেনি, পলক পড়েনি, তখনো যেন দেখছে চেয়ে চেয়ে।

    প্রীতি নয়, দরদ নয়, সেই দেখায় অকরুণ গ্রাসের নেশা।

    লাল বস্তুটির সঙ্গে স্নায়ুর বিশেষ একটা যোগ আছে। লালের মত লাল কিছুর সান্নিধ্যে উত্তেজনা বাড়ে, উদ্যম বাড়ে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে হিমাংশু মিত্রের টকটকে লাল গাড়িটার সামনে এসে পড়লে ধীরাপদর স্নায়ু একটা নাড়াচাড়া খায় কেমন, কিছুক্ষণের জন্য অন্তত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

    বিশেষ করে সেই গাড়িটা যখন চারুদির বাড়ির সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।

    আগেও দেখেছে। আগেও তাই হয়েছে।

    কিন্তু ফেরা শক্ত। কারণ ড্রাইভারকে ফিরতে বলা শক্ত। লাল গাড়ির একেবারে পিছন ঘেঁষে স্টেশান ওয়াগনটা থামিয়েছে সে। ধীরাপদ অন্যমনস্ক ছিল। তাছাড়া সামনের দিকে মুখ করে না বসে হাত-পা ছড়িয়ে আড়াআড়ি হয়ে বসেছিল। গাড়িটা থামতে ঘাড় ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গে অতি পরিচিত লালের ধাক্কা।

    সাড়াশব্দ না পেয়ে ড্রাইভার পিছন ফিরে চেয়ে আছে। নামা দরকার। ধীরাপদ একটু ব্যস্তসমস্ত ভাবেই নেমে পড়ল। আর একবারও পায়ে হেঁটে চারুদির বাড়ির আঙিনায় ঢুকে পড়ে এই লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। দেখে নিঃশব্দে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু সেই আসা বা যাওয়ার কোনোটাই সকলের অগোচরে ঘটেনি। পার্বতী দেখেছিল। চারুদি অনুযোগ করেছিলেন।

    আজ আর পায়ে হেঁটে নয়, কোম্পানীর স্টেশান ওয়াগনে একেবারে জানান দিয়েই ভিতরে ঢুকেছে সে। এতক্ষণে শুধু পার্বতী বা চারুদি নয়, ওই লাল গাড়ির মালিকও টের পেয়েছেন নিশ্চয়, কেউ এলো। তাছাড়া চারুদির জানাই আছে কে এলো, কে আসবে। ফেরার প্রশ্ন ওঠে না।

    …কিন্তু এই লাল গাড়ি এ সময়ে এখানে থাকার কথা নয়। ঘণ্টাখানেকও হয়নি চারুদি টেলিফোন করেছিলেন তাকে। তাঁরই তাগিদে আসা। তাগিদটা জরুরী মনে হয়েছিল ধীরাপদ। এ-সময়ে লাল গাড়ি কি তাহলে চারুদিও প্রত্যাশা করেননি? ধীরাপদ অবশ্য একটু আগেই এসে পড়েছে।

    বাইরের ঘরে যে অবাঙালী ভদ্রলোকটি বসে, তাঁকে আগেও কোথায় দেখেছিল হয়ত। এই বাড়িতেই কি…? মনে পড়েছে, এই বাড়িতেই। চারুদির সেই ফুলের সমঝদার, ফুল-বিশেষজ্ঞ। অমিতাভ ঘোষকে সঙ্গে করে চারুদি নিজের মোটরে করে যেদিন ওকে সুলতান কুঠি থেকে এখানে ধরে এনেছিলেন, সেই দিন দেখেছিল। বাইরে লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে না থাকলে ধীরাপদ এ-সময় এই লোকের উপস্থিতির দরুন বিরক্ত হত। এখন খারাপ লাগল না। লোকটির কোলের ওপর একপাঁজা বিলিতী সাপ্তাহিক। দীর্ঘ প্রতীক্ষার জন্য প্রস্তুত মনে হল। মুখ তুলে ভদ্রলোক একবার দেখে নিলেন শুধু। ধীরাপদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে।

    আপনি ভিতরে আসুন। অন্দরের দোরগোড়ায় পার্বতী।

    ভিতরের দরজা অতিক্রম করে ধীরাপদ দাঁড়িয়ে পড়ল। দ্বিধাগ্রস্ত।

    মা ও ঘরে আছেন। পার্বতীর যান্ত্রিক নির্দেশ-ওঁরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। উনি নয়, ওঁরা। ধীরাপদ আবারও হকচকিয়ে গেল। কিন্তু পার্বতীর অভিব্যক্তিশূন্য মুখ দেখে কিছু আবিষ্কার করার উপায় নেই।

    সামনের ঘরটা ছাড়িয়ে যাবার আগেই চারুদির গলা ভেসে এলো। — ধীরু এলো নাকি রে, ভেতরে আসতে বল!

    জবাব না দিয়ে পার্বতী আবার ঘুরে দাঁড়াল শুধু। পুরুষের এই দ্বিধা আর সঙ্কোচ তার কাছে একেবারে অর্থহীন যেন।

    পায়ে পায়ে ধীরাপদ ঘরে এসে দাঁড়াল। পায়ের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে ছিলেন চারুদি। পরনের বেশ-বাস আর মুখের হালকা প্রসাধন দেখে মনে হল, কোথাও বেরুবেন বা এই ফিরলেন কোথাও থেকে। হাতের কাছে বিছানার ওপর একটা ক্যাটালগের মত কি।

    এসো, তাড়াতাড়িই তো এসে গেছ। খাট ছেড়ে মাটিতে নেমে দাঁড়ালেন চারুদি, গাড়িতে এলে বুঝি, বোসো।

    খাটের একদিকে বসতে বসতে মুখের সপ্রতিভ ভাবটুকুই শুধু বজায় রাখতে চাইছিল ধীরাপদ। কিন্তু সেটা পারা যাচ্ছে না নিজেই বুঝছে। সকালে কারখানায় হিমাংশু মিত্রের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তখনো তো হাত তুলে নমস্কার করেনি ধীরাপদ, অথচ এখন করে বসল। ঘরের মাঝামাঝি আরামকেদারায় গা এলিয়ে হিমাংশুবাবু পাইপ টানছেন, নমস্কারের জবাবে হাত-মাথা একটু নড়েছে কি নড়েনি। মনে হল, ওর অস্বস্তিটা টের পেয়েছেন বলেই চোখ দুটো বেশি হাসি-হাসি দেখাচ্ছে।

    চারুদি আর একটু কাছে এসে দাঁড়িয়ে কিছুটা গম্ভীর মুখে টেলিফোনের অসমাপ্ত অনুযোগটাই আগে শেষ করে নিলেন।- তোমাদের ব্যাপারখানা কি, এখানে একটা লোক পড়ে আছে, কারো মনেই থাকে না? না ডাকলে বা না তাগিদ দিলে কেউ আসবে না, কেমন?

    তোমাদের বা কেউ বলতে আর কে, সেটা অনুমানে বোঝা গেল। আর কেউ আসে না কেন ধীরাপদর অজ্ঞাত। আসে না তাও এই প্রথম শুনল। এই ক’দিনের কাজের ঝামেলায় চারুদির কথা মনেও পড়েনি ধারাপদর। কিন্তু তার আগে যে ও অসুখে পড়েছিল সেটা চারুদিরও মনে নেই বোধ হয়!

    ধীরাপদর হয়ে জবাবটা হিমাংশু মিত্র দিলেন।—হি ইজ রিয়েলি ভেরি বিজি-ই নাও। ফলে চারুদি আগে তাঁকেই শায়েস্তা করতে উদ্যত হলেন যেন।-এত ব্যস্ত কিসের, ওকে ভালো মানুষ পেয়ে সকলের সব কাজ ওর ঘাড়ে চাপাচ্ছ তোমরা?

    জবাব না দিয়ে হিমাংশুবাবু সকৌতুকে ঠোঁটের পাইপটা দাঁতের আশ্রয়ে রাখলেন। চারুদি ধীরাপদর দিকে ফিরলেন আবার, ছদ্ম তর্জনের সুরে বললেন, আমি ও-সব শুনতে চাইনে, তোমার আসল মালিক আমি, মনে আছে তো? সেটা ভুলেছ কি চাকরি গেল—

    হাসতে লাগলেন।

    হিমাংশুবাবুর রসিকতা আরো পরিপুষ্ট। পাইপটা হাতে নিয়ে ধীরাপদর উদ্দেশে বললেন, তুমি ওঁর চাকরিটা নিরাপদে রিজাইন দিয়ে ফেলতে পারো, আমি তোমাকে এর থেকে অদ্ভুত সম্মানের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে রাজী আছি।

    দায়ে পড়েই চারুদিকে চোখ রাঙাতে হল আবার, দ্যাখো লোক কাড়তে যেও না বলে দিচ্ছি। হেসে ফেললেন, তোমার ওপর সেই কবে থেকে রাগ ওর জানো না তো?

    ধীরাপদর মনে হল, ওর উপস্থিতিটা এঁরা যেন একটু বেশি সহজভাবে নিয়েছেন। কিন্তু ধীরাপদর সহজ হওয়া দূরে থাক, শেষের পরিহাসে অস্বস্তির একশেষ।

    চারুদিও আর বাড়ালেন না, ওর দিকে চেয়ে বললেন, তুমি একেবারে চুপচাপ কেন, মুখও তো শুকনো দেখি- বোসো, খাবার দিতে বলি। হিমাংশুবাবুর দিকে ফিরলেন, তোমার কথা থাকে তো সেরে নাও, একটু বেরুতে হবে—বাইরে ভদ্রলোক অনেকক্ষণ বসে আছেন, একবার দেখা দিয়ে আসি।

    পার্বতীকে খাবার দিতে বলে বসবার ঘরের দিকে গেলেন ফুল-বিশেষজ্ঞকে দেখা দিতে। এইখানে বসে আপাতত জলযোগের ইচ্ছে ছিল না ধীরাপদর, কিন্তু কি জানি কেন বাধাও দিতে পারল না। এখানে তাকে ডেকে এনে কোন কথা সেরে নেওয়া হবে সেটা আঁচ করার তাগিদে খেয়ালও ছিল না হয়ত।

    হিমাংশুবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, অমিত এলো না… ফ্যাক্টরীতে ছিল না বুঝি? ধীরাপদ অবাক আবারও। চারুদি টেলিফোনে তাকেই আসতে বলেছেন, আর কারো নামোল্লেখ করেননি। সে কথা না বলে মাথা নাড়ল শুধু, ছিল না।

    কাল এসেছিল?

    ধীরাপদ নিরুত্তর।

    তার কি উদ্দেশ্য, কি অভিযোগ, জানো কিছু? ক’-দিন আসছে না? প্রথম জবাবটা এড়িয়ে ধীরাপদ বলল, লাইব্রেরিতে আসেন প্রায়ই —।

    নির্জলা সত্যি নয়, সেটা ওর বিব্রত মুখের দিকে চেয়েই বোঝার কথা। লাইব্রেরীতে আসার প্রসঙ্গে আর এক জিজ্ঞাসার দিকে ঘুরলেন তিনি। –অনেক দিন ধরেই কি পড়াশুনা নিয়ে আছে শুনছি আর অ্যানালিটিক্যালএ এসে কিসব পরীক্ষা-টরীক্ষাও করে নাকি—কি করে, কি পড়ে?

    কি করে ধীরাপদ জানে না, আর কি পড়ে জানতে যাওয়ার ফলে তো সেদিন বিষম সঙ্কট নিজেরই। বইয়ের নামটাও মনে নেই!

    হিমাংশুবাবুর মুখ দেখে মনে হল, ভাগ্নের সম্বন্ধে তার এই কিছু না-জানাটা তিনি ঠিক আশা করেন না। মুখে অবশ্য সেটা বলেননি। বলেছেন, আবার কিছু পড়াশুনার জন্য বা দেখাশুনার জন্য বাইরে যেতে চায় তো যেতে পারে— বলে দেখতে পারো।

    মন্দ প্রস্তাব কিছু নয়, তবু কি জানি কেন ধীরাপদর ভাল লাগল না খুব। ভালো— বোধ হয় আর একজনেরও লাগল না। চারুদির। ঘরে ফিরে এসে খাটের দিকে এগোতে এগোতে তিনিও শুনলেন। হিমাংশুবাবুর দিকে তাকালেন একবার, তারপর ধীরাপদর পাশে বসে বললেন, গেলে তো ভালই হয়, এখানে বসে বসে শুধু শরীর নষ্ট। যায় যদি, এবারে আমিও ওর সঙ্গে যেতে রাজি আছি, তাহলে আর গেলবারের মত সাত-তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে চাইবে না।

    অমিত ঘোষ গেলে তিনিও দীর্ঘদিন বাইরে থাকতে প্রস্তুত! ধীরাপদর ধারণা, কথা ক’টা হিমাংশুবাবুকেই শোনালেন তিনি।

    ওদিকে মুখের মোটা পাইপটা হাতে চলে এসেছে। ইজিচেয়ারের হাতলে মৃদু মৃদু ঠুকছেন ওটা। অর্থাৎ কথা না বুঝলে তিনি নাচার। একটু বাদে ধীরাপদর দিকে ঘুরে বসলেন, ওই সরকারী অর্ডারটার কি হল?

    এসে পর্যন্ত ধীরাপদ যে ভাবে মুখ বুজে আছে, নিজেরই বিসদৃশ লাগছে। কিন্তু এও মুখ বুজে থাকার মতই প্রশ্ন। বলল, একভাবেই তো আছে, কিছু হয় নি।

    অমিত কি বলে, করবে না? বিরক্তির সুর।

    কথা হয়নি…

    তাকে বলোই নি কিছু এখনো পর্যন্ত? শুধু বিরক্ত নয়, এবারে বিস্মিতও একটু। কবে আর বলবে, কিছু যদি না-ই হয় চুপ করে বসে আছ কেন, অর্ডার ক্যানসেল করে দাও। জীবনবাবু কি বলেন, পারবেন?

    চেষ্টা করছেন।—

    মন-রাখা উত্তর যে সেটা তিনিও বুঝলেন। চেষ্টার ওপর ভরসা না রেখে নির্দেশ দিলেন, কালকের মধ্যেই অমিতের সঙ্গে দেখা করে জেনে নাও কি করবে, হবে কি হবে না কি বলে আমাকে জানাবে। চুপচাপ খানিক।— তোমাকে যা বলব ভেবেছিলাম… তোমারও আর সকলের মত তাকে পাশ কাটিয়ে চলার দরকার নেই, সে তোমাকে পছন্দ করে। তাকে একটু বুঝিয়ে বলা দরকার, কেউ তার শত্রু নয় এখানে, সকলেই তার গুণ বোঝে। নতুন সিনিয়র কেমিস্ট নেওয়া হয়েছে কাজের সুবিধের জন্যে। তার সঙ্গেই পরামর্শ করে নেবার কথা, শুধু অপমানের ভয়েই এরা কেউ এগোতে চায় না তার কাছে। জীবন সোম এসেছেন বলে আপত্তি হয় তো দেখেশুনে অন্য লোক নিক, আমি তাঁকে পারফিউমারী ব্রাঞ্চে সরিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু ব্যবসা ব্যবসার মতই চলা দরকার, এইভাবে চলে কি করে? তাছাড়া হাসি নেই আনন্দ নেই ধৈর্য নেই -নিজে তো অসুখে পড়ল বলে! সুযোগ-সুবিধেমত কথাবার্তা কয়ে দেখো, ডোন্ট কিপ হিম অফ!

    অমিত ঘোষের সঙ্গে হৃদ্যতা বজায় রেখে চলার একটু-আধটু আভাস বড় সাহেব আগেও দিয়েছেন। এ-রকম স্পষ্ট নির্দেশ এই প্রথম। ধীরাপদ অনুগত গাম্ভীর্যে কান খাড়া করে শুনছে। এইজন্যেই আজ এখানে ডেকে আনা হয়েছে তাকে। এর পিছনে সমস্যা বড় কি চারুদির মন রাখার দায়টা বড়, চকিতে সেই সংশয়ও উকিঝুঁকি দিল।

    শাড়ির আঁচলটা টেনে গলায় জড়াতে জড়াতে চারুদি নিস্পৃহ সুরে বললেন, ধীরু হয়ত ভাবছে ভাগ্নেকে এ-সব তুমি নিজে না বলে ওকে বলতে বলছ কেন-

    হিমাংশুবাবুর বক্তব্য শেষ। আর বিশ্লেষণ প্রয়োজন বোধ করলেন না। সহজ তৎপরতায় ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ধীরাপদর গোবেচারা মুখের ওপর একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করে লঘু জবাব দিলেন, ওটুকু বোঝার মত বুদ্ধি ওর আছে, আচ্ছা বোসো

    তোমরা—

    দরজার কাছে ঘুরে দাঁড়ালেন, আজ বাড়ির মিটিং-এ আসছ না তো? জবাবের অপেক্ষা না করে নিজেই আবার বললেন, থাক আজ।

    বারান্দায় তাঁর পায়ের শব্দ মেলাবার আগেই চারুদি ঘুরে বসে হাসি চেপে জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়িতে কিসের মিটিং?

    ধীরাপদ ফিরে তাকালো।

    মেম-ডাক্তারের কাছ থেকে ছেলে আগলে রাখার মিটিং? চারুদি হাসতে লাগলেন, কি বিপদেই না পড়েছ তুমি!

    নিজের স্বচ্ছ-চিন্তার গর্ব কমে আসছে ধীরাপদর। সেও হাসছে বটে, কিন্তু বিস্ময় কম নয়। বাড়ির মিটিং-এর খবর মানকে দিয়ে থাকবে, ওবাড়ির খবর চারুদি রাখেন। কিন্তু মিটিং-এর আসল তাৎপর্যও তা বলে মানকের বোঝার কথা নয়। ধীরাপদ আলোচনার আসরে বসে যা আবিষ্কার করেছিল, চারুদি দূর থেকেই তা জেনে বসে আছেন।

    গলায় জড়ানো আঁচলটা আবার কাঁধের ওপর বিন্যাস করলেন চারুদি। – সারাক্ষণ এমন মুখ করে বসেছিলে কেন, বড় সাহেবের সামনে ও-রকমই থাকো বুঝি?

    ধীরাপদ বলল, না, একসঙ্গে দুদফা ঘাবড়েছি বলে—বড় সাহেবকে এখানে দেখে, আর চাকরির নতুন দায়িত্ব পেয়ে।

    নতুন দায়িত্ব কিসের? আগে জানতে না? চারুদি ভ্রুকুটি করলেন, বড় সাহেব প্রশংসা করলে কি হবে, তোমার বুদ্ধিসুদ্ধির ওপর আমার কিন্তু ভরসা কমছে।

    হেসে গাম্ভীর্য তরল করে নিলেন। গল্প করতে বসলেন যেন তারপর। ধীরাপদর শরীর কেমন আছে এখন, এত বড় অসুখটা হয়ে গেল, খুব সাবধানে থাকা দরকার। সেই বউটি কেমন আছে, তোমার সোনাবউদি? বেশ মেয়ে, অসুখের সময় আপনজনের মতই সেবা-যত্ন করেছে, চারুদি নিজের চোখেই দেখেছেন—একদিন ধীরাপদ তাকে যেন নিয়ে আসে এখানে। মেম-ডাক্তারের খবর কী? ধীরাপদর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করে এখন? সিতাংশু প্রসাধন-শাখায় চলে গেল, ফলে ধারাপদর মাইনে আর মান- মর্যাদা বাড়ল আরো মেয়েটা সহ্য করছে মুখ বুজে? না করে করবে কি, সুবিধে বুঝলে অন্যত্র চলে যেত, নিজের সুবিধে ষোল আনা বোঝে কিন্তু এখানকার মত এত সুবিধে আর কোথায় পাবে?

    আলাপটা অরুচিকর হয়ে ওঠার মুখে চারুদি সামলে নিলেন। ধীরাপদর মনে হল, বাইরের ঘরে ফুল-বিশেষজ্ঞটি তাঁর অপেক্ষায় বসে, তাও ভুলে গেছেন। ওদিকে পার্বতীরও হয়ত খাবার দেবার কথা মনে নেই।

    তেমনি মন্থর গতিতে আলাপ-বিস্তারে মগ্ন চারুদি। অবতরণিকা থেকে অমিতাভ প্রসঙ্গে এসেছেন। ভিতরে ভিতরে ছেলেটা ভালো রকম নাড়াচাড়া খেয়েছে আবার একটা, আগে এ-রকম হলে মাসির কাছেই বেশি আসত, এখন আসেই না বলতে গেলে, চিঠি লিখে আর টেলিফোন করে করে চারুদি হয়রান–কাজের গণ্ডগোলটাই আসল ব্যাপার নয় নিশ্চয়, ও-সব কাজ-টাজের ধার ধারে না ছেলে, কাজ করতে যেমন ওস্তাদ কাজ পণ্ড করতেও তেমনি। শুধু এই জন্যে মেজাজ দিনকে দিন এমন হবার কথা নয়—ধীরাপদ কি কিছুই জানে না কি হয়েছে? কিছু না?

    … অবশ্য মন-মেজাজ ভালো না থাকলে বাতাস থেকে ঝগড়া টেনে তোলা স্বভাব ছেলের, তা বলে এতটা হবে কেন—ওই মেম-ডাক্তারই আবার বিগড়ে দিলে কিনা কে জানে, কি যে দেখেছে সে ওই মেয়ের মধ্যে সে-ই জানে, এত সবের পরেও হাসলে আলো কাঁদলে কালো—সেদিকেই আবার নতুন কিছু জট পাকাচ্ছে কি না…ধীরাপদ কি কিছুই লক্ষ্য করে নি? কিছু না?

    অমিতকে বাইরে পাঠানোর প্রস্তাবটা সত্যিই যেন আবার ধীরাপদ না জানিয়ে বসে তাকে, ও ছেলে কি বুঝতে কি বুঝে বসে থাকরে ঠিক নেই। এ-দিকে যেমন একটা কিছু বলে বসে থাকলেই হল, ওদিকেও তেমনি একটা কিছু ধরে বসে থাকলেই হল—চারুদির সবদিকে জ্বালা। ভাগ্নের সব রাগই সব সময় শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ে মামার ওপর। এবারের রাগে আবার মামার সঙ্গে মাসিকে জুড়েছে। মাসি কি করল? মাসি কারো সাতে আছে না পাঁচে আছে?… অমিত বলে কিছু? ধীরাপদ কি কোনো আভাস পায়নি? কিছু না?

    কিন্তু এটা চারুদি আশা করেন নি। কণ্ঠস্বরে আশাভঙ্গের সুর। ধীরাপদ যে কিছুই জানবে না, কিছুই লক্ষ্য করবে না, কোনো কিছুতে থাকবে না, তা চারুদি আদৌ আশা করেন না। বরং উল্টো আশা তাঁর। দিনকে দিন কেমন হয়ে যাচ্ছিল ছেলেটা, কাউকে আপন ভাবত না— মামার আর মামাতো ভাইয়েরই আর ওই মেম-ডাক্তারের কোনো লোককেই সে আপন ভাবে না, বিশ্বাস করে না। এর মধ্যে ধীরাপদ আসাতে চারুদি হয়তো নিশ্চিত হয়েছিলেন—ভেবেছিলেন ছেলেটা এবারে কাজের জায়গায় একজনকেও অন্তত কাছে পাবে, মাথা ঠাণ্ডা হবে। ভাই যাতে হয়, সে-জন্যে চারুদি কম করেন নি –ধীরাপদর অজস্র প্রশংসা করেছেন তার কাছে, ছেলেবেলার গল্প করেছেন—শুনে শুনে ছেলে একদিন রেগেই গেছে, তোমার ধীরু-ভাইয়ের মত লোক ভূ-ভারতে হয় না, থামো এখন। আবার নিজেই এক-একদিন এসে আনন্দে আর প্রশংসায় আটখানা, তোমার ধীরু-ভাইয়ের বুকের পাটা বটে মাসি, দিয়েছে বড় সাহেবের সামনেই ছোট সাহেবকে ঢিট করে—ওই অ্যাকসিডেন্টে কে পুড়ে গিয়েছিল, তার হয়ে তুমি কি করেছিলে, ভাই নিয়ে কথা— আর একদিন তো এসে রেগেই গেল আমার ওপর, মামাকে বলে ধীরুবাবুর মাইনে বাড়িয়ে দিচ্ছ না কেন—ওই মাইনেয় ও-রকম লোক কদিন টিকবে?—গোড়ায় গোড়ায় এতটা দেখে চারুদির ভারী আশা হয়েছিল, ছেলেটার বল-ভরসা বাড়বে এবার, মতিগতিও ফিরবে কিন্তু আজ দেখছেন যে-ই কে সেই। ছেলেটা যে একা সেই একা কি হল কেন এ-রকম হল ধীরাপদর জানা দূরে থাক, একটা খবর পর্যন্ত না রাখাটা কেমন কথা!

    মুখ বুজে শুনছিল ধীরাপদ। একটানা খেদের মত লাগছিল। শুধু খেদ নয়, খেদের সঙ্গে অভিযোগও স্পষ্ট। ভিতরে ভিতরে ধীরাপদর চকিত বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে কি একটা। চারুদির মুখে আজ এত কথা শোনার পর মনে হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে নিজের সংযোগ-বৈচিত্র্যের রহস্যটা আবার নতুন করে ভাবতে বসলে নতুন কিছু আলোকপাত হতে পারে।

    কিন্তু চারুদির মুখে চোখ আটকালে ভাবতে পারা সম্ভব নয় কিছু। ধীরাপদ ছোটখাটো ধাক্কা খেল একটা। চারুদির বেশ বাসে প্রাচুর্যের লাবণ্য, চারুদির প্রসাধনে পরিতৃপ্তির মায়া, কিন্তু চারুদির চোখের গভীরে ও কি? ক্ষুব্ধ হতাশা আর আশার দারিদ্র্য আর আশ্বাসের করুণ আবেদন। নিঃস্ব, রিক্ত।

    দরজার কাছে পার্বতী দাঁড়িয়ে। খাবার নিয়ে আসেনি, কর্ত্রীকে বলবে কিছু। ধীরাপদর দৃষ্টি অনুসরণ করে চারুদি সচকিত হলেন।—কি রে?

    বাইরের ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করছেন মা আজ আর বেরুবেন কিনা।

    চারুদি যথার্থই অপ্রস্তুত। দেখেছ। একেবারে মনে ছিল না, কি লজ্জা! বসতে বল, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

    খাট থেকে নেমে দাঁড়ালেন। কিন্তু পার্বতী আড়াল হবার আগেই ফিরে আবার ডাকলেন তাকে. হ্যারে পার্বতী— মামাবাবুর পাবার কই? বিরক্তি আর বিস্ময়, আমার খেয়াল নেই আর তুইও ভুলে বসে আছিস?

    সবটা শোনার আগে কিছু বলার রীতি নয় পার্বতীর, দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ধীরাপদ তাড়াতাড়ি তার দোষটাই ঢাকতে চেষ্টা করল।— আমার এখন খাবার কোন ভাড়া নেই, চলো—

    তার ব্যস্ততা দেখেই যেন পার্বতী শান্তমুখে জানান দিল, খাবার আনছি। কর্ত্রীর দিকে তাকালো, আপনি ঘুরে আসুন, মামাবাবু খেয়ে যাচ্ছেন।

    পার্বতীর মুখের দিকে চেয়ে চারুদি এক মুহূর্ত থমকালেন মনে হল, তারপরে এই ব্যবস্থাটাই মনঃপূত হল যেন।—তাই দে, উনুন ধরিয়ে করতে গেলি বুঝি, হিটারে করলেই হত। যা আর দেরি করিসনে, আমার আর বসার জো নেই—

    একলা খাওয়ার জন্যে বসে থাকার কথা ভাবতেও অস্বস্তি, অথচ এর পর আপত্তি করাটা আরো বিসদৃশ। কিন্তু এই মুহূর্তে চারুদির আবার কি হল? পার্বতী প্রস্থানোদ্যত, সেদিকে চেয়ে হঠাৎ চারুদি কি দেখলেন, কি চোখে পড়ল। ভুরুর মাঝে ঘন কুঞ্চন, দৃষ্টিটা কটকটে।—এই মেয়ে, শোন তো?

    ডাক শুনে ধীরাপদ আরো ঘাবড়ে গেল। পার্বতী আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এদিকে আয়।

    কর্ত্রীর দিকে চেয়ে শান্তমুখে পার্বতী সামনে এসে দাঁড়াল।

    চারুদি উষ্ণ-চোখে তার আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার।– তোর শাড়ি নেই না জামা নেই না মাথার তেল-চিরুনি নেই—কি নেই? ক’ ডজন ‘কি আনতে হবে বল?

    পার্বতী তেমনি নীরব, তেমনি নির্লিপ্ত। চেয়ে আছে।

    চারুদি আরো রেগে গেলেন, সংয়ের মত দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? ওই বাক্স-বোঝাই – জামা-কাপড় এনে উনুনে দিলে তবে তোর আক্কেল হবে? ঠিক দেব একদিন বলে রাখলাম—নিজেকে বাড়ির ঝি ভাবিস তুই, কেমন? ঝি-ও এর থেকে ভালো থাকে —যা দূর হ চোখের সমুখ থেকে

    আসতে বলা হয়েছিল, এসে দাঁড়িয়েছিল। যাবার হুকুম হল, চলে যাচ্ছে। মাঝখান থেকে ধীরাপদই কাঠ!

    তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিরুপায় মুখে হেসেই ফেললেন চারুদি।—বলে বলে আর পারিনে, বাক্সভরতি জামা-কাপড়, অথচ যেদিন নিজে হাতে না ধরব সেদিনই ওই অবস্থা। ভূমি বোসো, না খেয়ে পালিও না, এর ওপর না খেয়ে গেলে আমাকে একেবারে জ্যান্ত ভস্ম করবে, চেনো না ওকে-

    আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, নিজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলেন একবার। শাড়ির আঁচলটা বিন্যস্ত করলেন একটু—আমি যাই, ভদ্রলোক এতক্ষণ বসে আছেন, লজ্জার কথা…অমিতের সঙ্গে কি কথা হয় না হয় আমাকে জানিও, আর তুমি মাঝে-মধ্যে সময় করে এসো—আসবে তো, নাকি আবার টেলিফোন করতে হবে?

    চারুদি চলে গেলেন।

    গাড়িটা এখনো ফটক পেরিয়েছে কিনা সন্দেহ, খাবারের থালা হাতে পার্বতী এসে দাঁড়িয়েছে। কর্ত্রীর বেরুনোর অপেক্ষায় ছিল, এ-রকম মনে হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। মেঝেতে থালা গেলাস রেখে ঘরের আলনা থেকে একটা সুদৃশ্য আসন এনে পেতে দিল, তারপর দরজার পাশে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।

    ধীরাপদর ইচ্ছে করছিল খুব সহজ মুখে ওর সঙ্গে কথা কইতে আর দেখতে। খাবার আনতে সত্যি দেরি কেন হল জিজ্ঞাসা করতে আর দেখতে। চারুদির বকুনি খেয়ে রাগ না করার কথা বলতে আর দেখতে। কিন্তু সহজ হওয়া গেল না। তার থেকে সহজ আসনে এসে বসা। খাবারের দিকে চোখ পড়তে আঁতকে ওঠার সুযোগ পেল-দেখারও।

    এত খাব কি করে?

    কিন্তু জবাবে কেউ যদি চলতি সৌজন্যের একটা কথাও না বলে চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আরো বিড়ম্বনা।

    একটা প্লেট নিয়ে এসো, কিছু তুলে নাও।

    আপনি খান!

    ধীরাপদ যেন ছাত্রাবস্থায় ফিরে এসেছে— সামনে গুরুমশাই দাঁড়িয়ে, মুখে পরীক্ষাসূচক গাম্ভীর্য। খাবার নাড়াচাড়া শুরু করল সে। অমিতাভ ঘোষের সঙ্গে প্রথম দিন এ বাড়িতে পার্বতী-দর্শনের প্রহসনটা মনে পড়ছে। হাঁকাহাঁকি করে বার বার তাকে ডেকে আনার পর পার্বন্তী মোড়া এনে সামনাসামনি বসতে তবে ঠাণ্ডা হয়েছিল। কিন্তু আজ তার এই নীরব উপস্থিতিতে ধীরাপদ ঠাণ্ডা হয়েই আসছিল, খাওয়াটা পরিশ্রমের ব্যাপার মনে হচ্ছিল। অথচ পার্বতীর রান্নার হাত দ্রৌপদীর হাত।

    আমি যাই, আপনার অসুবিধে হচ্ছে।

    ধীরাপদ ফাঁপরে পড়ে গেল, সে কি মুখ বুজে ভাবছিল না? সত্য চাপা দিতে হলে ডবল সরঞ্জাম লাগে, ধীরাপদ দ্বিগুণ ব্যগ্র। – না না, আমার অসুবিধে কি! একমাত্র অধুবিধে ভূমি সামনে থাকাতে কিছুটা রুমালে তুলে পকেটে চালান করতে পারছি না—দাঁড়িয়ে কেন, বোসো না।

    এমন স্তুতিতেও পার্বত্য-পালিশে ফাটল ধরানো গেল না। চোখের কালো তারার গভীরে নিমেষের কৌতুক ব্যঞ্জনাটুকুও তেমন ঠাওর করা গেল না। বসবে ভাবেনি, কিন্তু দেয়াল ঘেঁষে পার্বতী বসে পড়ল। মূর্তির অবস্থানভঙ্গীর পরিবর্তন শুধু।

    কেউ কেউ আবোল-তাবোল বকতে পারে, কথা কয়ে শূন্যতা ভরাট করতে পারে। পরিস্থিতি-বিশেষে সেটা কম গুণের নয়। ধীরাপদ শুধু এলোমেলো ভাবতে পারে, ভেষে ভেবে ছোট শূন্যকে বড়, বড় শন্যকে ছোট শূন্য করে তুলতে পারে। আর দায়ে পড়লে কথার পিঠে কথা কইতে পারে। আপাতত বিষম দায়েই পড়েছে, কিন্তু কথার পিঠ নেই।

    পার্বতী এত গম্ভীর কেন? অমিত ঘোষের সামনে যেমন পাথর করে রাখে মুখখানা, আজ সারাক্ষণই তেমনি। তার থেকেও বেশি। পার্বতী কি ওকে বলবে কিছু? খাবার আনতে দেরি করল, চারুদিকেও অপেক্ষা না করে ঘুরে আসতে বলল। চারুদি থমকে তাকিয়েছিলেন ওর দিকে, পরে কি ভেষে ব্যবস্থাটা অনুমোদনই করেছিলেন যেন। তারপরেই অবশ্য পার্বতীর বেশবাসের দিকে চোখ পড়তে কড়া বকুনি লাগিয়েছেন।

    খাবার চিবুতে চিবুতে ধীরাপদ তাকালো একবার। পরনের শাড়ি-ব্লাউজ সাদাসিধে বটে, কিন্তু অমন তেতে ওঠার মত অপরিচ্ছন্ন কিছু নয়। বরং এতেই ওকে মানায় ভালো। পাহাড়ে বুনো জঙ্গল শোভা, গোলাপ-রজনীগন্ধা নয়। বকুনি খেল বলে ধীরাপদ ওকে সান্ত্বনা দেবে একটু?

    হেসে বলল, ‘চারুদির শেষ বয়সে শুচিবাইয়ে না দাঁড়ায়, ছেলেবেলা থেকেই দেখছি সব একেবারে তকতকে চাই,, একটু এদিক-ওদিক হলেই রেগে আগুন!

    চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে পার্বতী শুনল। তারপর জবাব দিল, আপনি আসছেন জানলেও সাজগোজ করতে হবে আগে কখনো বলেন নি!

    ধীরাপদ জলের গেলাসের দিকে হাত বাড়ালো। অনেকক্ষণই জল খায় নি। কিন্তু জলও যে সব সময়েই তরল পদার্থ তাই বা কে বললে? গেলাস নামালো।

    …অর্থাৎ, আর কারো আসার সম্ভাবনা থাকলে বেশবিন্যাস করতে হয়। তখন না করলে নয়। ধীরাপদর মনে পড়ল, আর একদিন নিজের হাতে পার্বতীর কেশবিন্যাস করে দিচ্ছিলেন চারুদি। সেদিনও অমিতাভ ঘোষের আসার কথা ছিল।

    ধীরাপদ তাড়াতাড়ি আলাপের প্রসঙ্গ বদলে ফেলল। খাওয়ার তন্ময়তায় পার্বতীর ওইটুকু জবাব খেয়াল না করাটা এমন কি…। বলল, চারুদির বোধহয় ফিরতে দেরি হবে, ফুলের খোঁজে গেলেন বুঝি?

    কিন্তু পার্বতী খেয়াল করাবে ওকে। তেমনি ভাবলেশশূন্য, নিষ্পলক। সামান্য মাথা নেড়ে সায় দিল। বলল, টেলিফোনে খবর পেয়েই ভদ্রলোককে আসতে বলেছেন, আপনি আসছেন মনে ছিল না। বাগান করার সময় অমিতবাবু যে ফুলের কথা বলতেন সেই ফুলের চারা এসেছে।

    পার্বতী যেন ঘাটের কিনারায় বসে নির্বিকার মুখে ধীরাপদর মনের অতলে টুপটুপ করে কথার ঢিল ফেলছে একটা করে আর কৌতূহলের বৃত্তটা কত বড় হল তাই নিরীক্ষণ করছে চেয়ে চেয়ে। ধীরাপদরও আলাপ চালু রাখার বাসনা। সাদাসিধেভাবে জিজ্ঞাসা করল, অমিতবাবু ফুল ভালবাসেন বুঝি?

    পার্বতী নিরুত্তর। চেয়ে আছে। জবাব দেবার মত প্রশ্ন হলে জবাব দেবে। এটা জবাব দেবার মত প্রশ্ন নয়। কিন্তু ধীরাপদ প্রশ্ন হাতড়ে খোঁজার চেষ্টা আর করছে না। এক অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে গিয়ে খাবারের থালার দিকে মন দিয়েছে। অস্বস্তি লাঘবের চেষ্টায় নিজের অগোচরে হাত-মুখ দ্রুত চলছে আর একটু।

    আপনার শরীর এখন ভালো?

    মুখ ভরাট, ধীরাপদ তাড়াতাড়ি তার দিকে ফিরে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ খুব ভালো। অসুখের সময় পার্বতী তাকে দেখতে গিয়েছিল মনে পড়ল। সেও কম অপ্রত্যাশিত নয়। মুখ খালি করে বলল, অসুখের সময় তুমি এসেছিলে শুনেছি, ঘুমুচ্ছিলাম বলে ডাকতে দাও নি!

    আবারও জবাব দেবার মত প্রসঙ্গ পেল বুঝি পার্বতী। পেল না, রচনা করে নিল। বলল, মা সেদিন সকালে অমিতবাবুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা কয়ে ভেবেছিলেন উনি আপনাকে দেখতে যাবেন। মার শরীর সেদিন ভালো ছিল না, তাই আমাকে আপনার খবর নিয়ে আসতে পাঠিয়েছিলেন। উনি এলে তাঁকেও নিয়ে আসতে বলেছিলেন।

    একটু আগে চারুদি এই পার্বতীর সম্বন্ধেই মন্তব্য করে গেছেন, চেনো না ওকে! খাওয়া ভুলে সঙ্কোচ ভুলে ধীরাপদ চেয়ে আছে তার দিকে। চেনে না বটে! কেউ চেনে কিনা সন্দেহ! অমিত ঘোষের ফোটো অ্যালবামের উন্মুক্ত-যৌবনা পার্বতীকে চেনা বরং সহজ! পুরুষ-তৃষ্ণার সামনে বিগত এক সন্ধ্যার সেই প্রত্যাখ্যানের বর্ম আঁটা পার্বতীকেও জানাও বরং সম্ভব, কিন্তু একে কে চিনেছে কে জেনেছে?

    ধারাপদর তখনো পাশ কাটানোর চেষ্টা। বলল, চারুদি অমিতবাবুকে ছেলের মতই ভালবাসেন।

    পার্বতীর কণ্ঠস্বর আরো ঠাণ্ডা শোনালো।— ছেলের মত! ছেলে হলে মায়ের অত ভয় থাকত না!

    ধীরাপদ মন দিয়ে খাচ্ছে আবারও।

    আপনি এখন কি করবেন?

    ধীরাপদ সচকিত। প্রশ্নটা কানে বিঁধছে বটে, স্পষ্ট হয়নি। খাবারের থালা থেকে হাত তুলে জিজ্ঞাসু চোখে ফিরে তাকালো।

    পার্বতী বলল, অমিতবাবুর মন না পেলে মায়ের কাছে আপনার কোনো দাম নেই! ধীরাপদর মুখও নড়ছে না আর। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে শুধু। পার্বতী অপেক্ষা করল একটু। কিন্তু সে কি করবে সে জবাবের দরকার নেই, পরিস্থিতিটাই বোঝানো দরকার ছিল যেন। আরো শাস্ত্র, আরো নিরুত্তাপ গলায় পার্বতী সরাসরি নিজের বক্তব্যটাই বলল এবারে। —আর অমিতবাবু এখানে আসা বন্ধ করলে সেটাও আমার দোষ হয়। আমার অন্য জায়গা নেই…মা রেগে থাকলে অসুবিধে। আপনি দয়া করে মাঝে মাঝে তাঁকে মায়ের কাছে পাঠাতে চেষ্টা করবেন।

    ধীরাপদ কখন উঠেছে, মুখ-হাত ধুয়ে কখন আবার সেই খাটেই এসে বসেছে, থালা-বাসন তুলে নিয়ে পার্বতী কতক্ষণ চলে গেছে—কিছুই খেয়াল নেই। অন্ধকার থেকে আলোয় আসাই রীতি। কিন্তু অন্ধকার থেকে হঠাৎ একটা জোরালো আলোর মধ্যে এসে পড়লে বিভ্রম। চোখ বসতে সময় লাগে।

    ….বেরুবার আগে চারুদিও তাহলে বুঝে গেছেন, পার্বতী ওকে বলবে কিছু। বুঝেই প্রচ্ছন্ন আগ্রহে পুষ্প-বিশারদের সঙ্গে বেরিয়ে গেছেন তিনি। আর বুঝেছিলেন বলেই সমস্ত দিন পরে পার্বতীর ওই অবিন্যস্ত রুক্ষমূর্তি হঠাৎ চক্ষুশূল হয়েছে। পুরুষ-দরবারে রমণীর রঙশূন্য আবেদনের ওপর চারুদির ভরসা কম বলেই অমন তেতে উঠেছিলেন। পাছে পার্বতীর সেই একান্তে বলাটা রমণীর একান্ত আবেদনের মত মনে না হয় ধীরাপদর, পাছে পরিচারিকার আবেদনের মত লাগে। পার্বতী যাই বলুক, চারুদির ইচ্ছার অনুকুল হবে যে তা তিনি ধরেই নিয়েছিলেন। পার্বতী এমন বলা বলবে জানবেন কেমন করে? পার্বতী এ-রকম বলতে পারে তাই জানেন কিনা সন্দেহ!

    চারুদির একটানা খেদ শুনতে শুনতে যে চকিত বিশ্লেষণ মনে উঁকিঝুঁকি দিয়েছিল, তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটিতে রাতারাতি তাকে এমন সমাদরের আসনে এনে বসানোর এত আগ্রহ আর এত আন্তরিকতার পিছনে চারুদির নিভৃত প্রত্যাশা যেমন স্পষ্ট তেমনি আশ্চর্য। এতদিনের রহস্যের দরজাটা পার্বতী চোখের সমুখে সটান খুলে দিয়ে গেল।

    ….অমিতাভ ঘোষ ছেলের মত, ছেলে নয়। চারুদির হারানোর ভয়। অমিত ঘোষের মনে ধরবে বলে পার্বতীর বেশবিন্যাস আর সাজসজ্জার দিকে খরদৃষ্টি চারুদির। অমিত ঘোষ ভালবাসে বলে চারুদির ফুলের বাগান আর ফুলের খোঁজ। অমিত ঘোষকে ধরে আনার আশায় চারুদির পার্বতীকে সুলতান কুঠিতে অসুখের খবর করতে পাঠানো। চারুদির যা কিছু আর যত কিছু সব অমিতাভ ঘোষের জন্য।

    পার্বতীও। আর ধীরাপদ নিজেও।

    অমিত ঘোষের মন না পেলে চারুদির চোখে তার কোনো দাম নেই। পার্বতীরও নেই। ওই অবিচল-মূর্তি রমণী-হৃদয়ের মর্মদাহ ধীরাপদ অনুভব করেছে। কিন্তু তবু পার্বতীর কিছু সান্ত্বনা আছে। তার অন্তস্তলের এই ক্ষুব্ধ অশান্ত আলোড়নের চারুদি যত বড় উপলক্ষই হোন—উপলক্ষই, তার বড় নন। পার্বতীর নিজস্ব কিছু দেবার আছে যা নেবার মত। সেইখানেই আসল যাতনা পার্বতীর। সেই যাতনা যত দুরূহ হোক, নারী-পুরুষের শাশ্বত বিনিময়ের দাক্ষিণ্যে পুষ্ট।

    কিন্তু ধীরাপদ কি আছে? সে কি করবে?

    ….অমিতাভ ঘোষ ছেলের মত, ছেলে নয়। চারুদির হারানোর ভয়। এই ভয়টাই সে দূর করবে বসে বসে? এইটুকুর জন্যেই যা কিছু?

    কি করবে ধীরাপদ? এইটুকুই বা সে করবে কেমন করে? খানিক আগে পার্বতী জিজ্ঞাসা করেছিল, সে এখন কি করবে? জবাব চায়নি, নিজের কথা বলার জন্যে বলেছিল। কিন্তু সেই জবাবটাই এখন খুঁজছে ধারাপদ, কি করবে সে?

    টেলিফোন হাতে পার্বতী ঘরে ঢুকল। প্লাগ পয়েন্ট প্লাগ করে দিয়ে তার সামনে খাটের ওপর রাখল টেলিফোনটা।—একজন মহিলা ডাকছেন আপনাকে, নাম বললেন না। পার্বতীর ঘর ছেড়ে চলে যাবার অপেক্ষায় নয়, বিস্ময়ের ধাক্কায় ধীরাপদর টেলিফোনে সাড়া দিতে সময় লাগল একটু।

    এখানে আবার কোন মহিলা টেলিফোনে ডাকতে পারে তাকে? কার জানা সম্ভব?

    হ্যালো!

    আমি ধীরাপদবাবুকে খুঁজছি। গম্ভীর অথচ পরিচিত কণ্ঠ যেন।

    আমি ধীরাপদ।

    আমি লাবণ্য সরকার।

    অমন নিটোল ভরাট কণ্ঠস্বর কার আর? ধীরাপদর ধরতে পারার কথা! অত গম্ভীর বলেই পারেনি। শুধু গম্ভীর নয়, কড়া রকমের গম্ভীর।

    বক্তব্য, ধারাপদকে এক্ষুনি একবার তার নার্সিংহোমে আসতে হবে। বিশেষ জরুরী। হিমাংশুবাবুর বাড়িতে রাতের বৈঠকে তাকে পাওয়া যাবে ভেবে সেইখানে টেলিফোন করেছিল। হিমাংশু মিত্র এই নম্বরে ডাকতে বলেছেন। নার্সিংহোমে তার এক্ষুনি আসা

    দরকার একবার।

    ধীরাপদ বিষম অবাক।— আমি তো নার্সিং হোমটা ঠিক চিনিনে…কিন্তু কি ব্যাপার? ড্রাইভারকে বলবেন, সে চেনে। আপনি দয়া করে তাড়াতাড়ি আসুন। অসহিষ্ণু তপ্ত তাগিদ। ঝপ করে টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article সেই অজানার খোঁজে – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }