Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কিরীটী অমনিবাস ৫ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত এক পাতা গল্প397 Mins Read0

    ০৬-১০. সেই রাত্রেই মৃণাল সেন

    ০৬.

    সেই রাত্রেই মৃণাল সেন সুব্রতর গৃহে এসে হাজির হল।

    কি ব্যাপার? মনে হচ্ছে আপনি যেন একটু উত্তেজিত? সুব্রত বলে।

    আপনার কথাই ঠিক সুব্রতবাবু। মৃণাল জবাবে বলে, মৃত ব্যক্তির ব্রেনের মধ্যে রিভলভারের গুলি পাওয়া গিয়েছে একটা।

    তাহলে তো আপনার অনুমানই ঠিক হল। অ্যাক্সিডেন্ট বা সুইসাইড নয়। ডেফিনিটলি এ কেস অফ মার্ডার-হোমিসাইড!

    সুব্রত ধীরে ধীরে কথাগুলো বললে।

    হ্যাঁ। কিন্তু—

    চলুন কাল সকালেই একবার আগরপাড়ায় দেশবন্ধু কলোনীতে যাওয়া যাক।

    দেশবন্ধু কলোনীতে!

    হ্যাঁ–মিঃ গাঙ্গুলীর সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার, মিঃ রায় যখন তার চিঠি পেয়ে সেখানে গিয়েই নিহত হয়েছেন।

    বেশ—তাহলে কাল সকালেই আমি আসব।

    মৃণাল সে রাত্রের মত বিদায় নেয়।

    পরের দিন বেলা প্রায় নটা নাগাদ সুব্রতসহ মৃণাল সেন আগরপাড়া থানায় গিয়ে জলধরবাবুকে সঙ্গে নিয়ে দেশবন্ধু কলোনীর দিকে রওনা হল। অবশ্য সুব্রতর গাড়িতেই।

    নতুন কলোনী। সবে গড়ার মুখে। এখানে-ওখানে বিক্ষিপ্ত ভাবে খান পনেরো-ষোল বাড়ি উঠেছে। কাঁচা রাস্তা।

    কলোনীর একেবারে শেষপ্রান্তে খোলা মাঠের একধারে ছোট একতলা একটা সাদারঙের বাড়ি, সলিটারি কর্নার। সামনে ছোট একটা বাগান। লোহার গেট। গেটের একপাশে লেখা সলিটারি কর্নার, অন্য পাশে এস গাঙ্গুলী লেখা নেম প্লেট।

    লোকটি সাহেবী-ভাবাপন্ন বোঝা যায়।

    গেটের পরেই লাল সুরকীর রাস্তা। আর দুপাশে মেহেদীর কেয়ারী। শীতের রৌদ্রে ঘন সবুজ দেখায়।

    গেটের বাইরেই গাড়ি রেখে সুব্রত, মৃণান ও জলধর চাটুজ্যে ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করলেন।

    সামনেই একটা বারান্দা। কয়েকটি বেতের চেয়ার ও টেবিল পাতা। পর পর ঘরগুলো দেখা যায়। তিনটে দরজা। দুটো বন্ধ, অন্যটায় একটা ঘন নীল রঙের পর্দা ঝুলছে।

    ওরা ডাকবে কি ডাকবে না ইতস্তত করছে এমন সময় মধ্যবয়সী একটা ভৃত্য বের হয়ে এল পর্দা তুলে ঘর থেকে।

    পরনে তার পরিষ্কার ধুতি ও ফতুয়া।

    কাকে চান?

    মিঃ গাঙ্গুলী বাড়িতে আছেন?

    হ্যাঁ। সাহেব বাড়িতেই আছেন।

    জলধর চাটুজ্যেই কথা বললেন, সাহেবকে খবর দাও, বলগে কয়েকজন ভদ্রলোক এসেছেন, দেখা করত চান।

    সাহেব তো এসময় কারও সঙ্গে দেখা করেন না।

    বল গিয়ে থানা থেকে দারোগাবাবু এসেছেন।

    ভৃত্য এবার আর কোন প্রতিবাদ করল না। ওদের বাইরের ঘরে বসিয়ে ভিতরে খবর দিতে গেল।

    ছোট ড্রইংরুম কিন্তু পরিপাটি ভাবে সাজানো। গৃহস্বামীর রুচির পরিচয় দেয়।

    একটু পরেই একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। পরনের পায়জামা ও ড্রেসিং গাউন। পায়ে চপ্পল। বয়েস ষাটের কাছাকাছি হবে। মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল কিন্তু বেশির ভাগই পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। মুখখানা রুক্ষ। চোয়ালের হাড় দুটো ব-এর আকারে দুপাশে ঠেলে উঠেছে। চোখ দুটো ছোট ছোট কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত। লম্বা বলিষ্ঠ দেহের গড়ন। বুকের ও হাতের পেশীগুলো সজাগ। দৈহিক শক্তিরই পরিচয় দেয়।

    আপনারা! ভদ্রলোকই প্রশ্ন করলেন।

    কথা বললেন জলধর চাটুজ্যে, আপনিই বোধ হয় মিঃ গাঙ্গুলী?

    হ্যাঁ। কিন্তু আপনারা–

    আমি এখানকার থানার ও. সি. আর ইনি লালবাজার থেকে আসছেন, ইন্সপেক্টার মৃণাল সেন। জলধর চাটুজ্যে বললেন।

    মিঃ গাঙ্গুলীর চোখের দৃষ্টি কুঞ্চিত হল যেন।

    আমার কাছে কি কোন দরকার ছিল?

    হ্যাঁ। নচেৎ আসব কেন বলুন! মৃদু হেসে জলধর চাটুজ্যে বলেন কথাটা।

    কি দরকার বলুন তো।

    বসুন!

    মিঃ গাঙ্গুলী বসলেন একটা সোফায়।

    বলুন।

    মিঃ গাঙ্গুলী, কলকাতার রায় অ্যান্ড কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেক্টার মিঃ এম. এন রায়কে আপনি তো চেনেন? কথাটা বলে মৃণাল সেনই।

    হ্যাঁ—সে আমার বিশেষ বন্ধু। কিন্তু কি ব্যাপার?

    আপনার এখানে গত শনিবার তার আসার কথা ছিল, মানে আপনি তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কথা বলে এবারে সুব্রত।

    আমি ডেকে পাঠিয়েছিলাম মহেন্দ্রকে?

    হ্যাঁ—চিঠি দিয়ে!

    হোয়াট ননসেন্স—আমি আবার তাকে কবে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠালাম।

    সে কি? আপনি ডেকে পাঠাননি চিঠি দিয়ে? সুব্রত কথাটা পুনরাবৃত্তি করে।

    মোটেই না।

    সুব্রত এবার চিঠিটা বের করে দেয়।-দেখুন তো এই চিঠিটা।

    চিঠিটা গাঙ্গুলী হাতে করে নিয়ে দেখলেন। পড়লেন, তারপর বললেন, ফানি! এ চিঠি আপনারা কোথায় পেলেন?

    এ চিঠি আপনার লেখা তো?

    কস্মিনকালেও নয়।

    আপনার নয়?

    নিশ্চয়ই নয়। প্রথমত আমার বাড়িতে কোন টাইপরাইটিং মেসিন নেই। দ্বিতীয়ত টাইপ করতেই আমি জানি না আর এ যদিও হুবহু প্রায় নকল করার চেষ্টা হয়েছে তবু এটা আমার সই নয়। কিন্তু এ চিঠি কোথা থেকে আপনারা পেলেন?

    বলছি—

    আচ্ছা মিঃ রায়ের সঙ্গে আপনার শেষ দেখা কবে হয়েছিল?

    গত মাসে। মাসের প্রথম দিকে কলকাতায় গিয়েছিলাম একটা কাজে। সেখানে অফিসে গিয়ে দেখা করি।

    তারপর আর দেখা হয়নি?

    না।

    তার কোন খবর জানেন না?

    না। কিন্তু কি ব্যাপার? এনিথিং রং!

    গতকালের সংবাদপত্র পড়েন নি?

    সংবাদপত্র আমি পড়ি না। কিন্তু ব্যাপার কি?

    গত শনিবার আপনার বন্ধু মিঃ রায় এখানে এই আগরপাড়ায় কোন অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন!

    হোয়াট? কি—কি বললেন? গাঙ্গুলী যেন অস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠেন, মহেন্দ্র খুন হয়েছে? সে নেই? না, না-এ আপনি কি বলছেন!

    দুঃখের সঙ্গেই বলছি কথাটা মিথ্যা নয় মিঃ গাঙ্গুলী।

    আমার-আমার যেন কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ইন্সপেক্টার। মহেন্দ্র হ্যাজ বিন কিল্ড। আর আমারই বাড়ি থেকে কিছু দূরে তার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে।

    আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী! সুব্রত এবার কথা বলে।

    কিন্তু মিঃ গাঙ্গুলী কোন সাড়া দিলেন না। আপন মনেই বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, নলিনী আগেই গেছে। মহেন্দ্রও চলে গেল। বাকি রইলাম আমি। বুঝতে পারছি আমার যাবার সময় হয়েছে। আমার দিনও হয়ত ফুরিয়ে এসেছে।

    .

    ০৭.

    মিঃ গাঙ্গুলী। আবার ডাকে সুব্রত।

    জানেন ইন্সপেক্টার, দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব আমাদের-নলিনী গেল ক্যানসারে আর মহেন্দ্র গেল পিস্তলের গুলিতে।

    আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী, ঐ চিঠিটার মধ্যে যে একটা চিঠির কথা আছে—

    হ্যাঁ—ঐ এক বিচিত্র ব্যাপার!

    কি রকম?

    চিঠিটা আমি ব্যাঙ্ক থেকে দিনসাতেক হল এনেছি। চিঠি ঠিক বলব না। একটা ত্রিকোণাকার কাগজের টুকরোর মধ্যে পর পর কতগুলো অঙ্ক বসানো।

    অঙ্ক!

    হ্যাঁ।

    দেখতে পারি চিঠিটা?

    হ্যাঁ, বসুন, আনছি।

    মিঃ গাঙ্গুল ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে হাতে একটা সিলমোহর ভাঙা লম্বা লেফাফা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন।

    এই দেখুন এর মধ্যেই আছে সে কাগজ।

    সুব্রত হাত বাড়িয়ে লেফাফাটা নিল–-উপরে ইংরাজীতে লেখা—মণীন্দ্র গাঙ্গুলী। কোণে লাল কালিতে লেখা পারসোন্যাল।

    সুব্রত খাম থেকে কাগজটা বের করল।

    মিথ্যে নয়, সত্যিই ত্রিকোণাকার একটা কাগজ এবং তার মধ্যে পর পর কতকগুলো অঙ্ক বসানো। আর নিচের কোণে ইংরাজীতে লেখা অ্যালফাবেট।

    মিঃ গাঙ্গুলী বলেন, দেখলেন তো, আমি তো মশাই ওর মাথামুণ্ডু অর্থ কিছুই খুঁজে বের করতে পারিনি। অথচ মজা কি জানেন, নলিনের মত লোক মরার আগে যে আমাদের সঙ্গে একটা ঠাট্টা-তামাসা করে গিয়েছে তাও ভাবতে পারা যায় না।

    আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী।

    বলুন। মহেন্দ্রবাবুর চিঠিটা আপনি দেখেছেন?

    হুঁ, দেখছি বৈকি। সেটাও ঠিক আপনিই একটা ত্রিকোণ কাগজে এমনি কতকগুলো অঙ্ক লেখা।

    আপনার মনে আছে চিঠির অঙ্কগুলো?

    না মনে নেই, তবে—

    তবে?

    আমি একটা কাগজে অঙ্কগুলো টুকে এনেছিলাম।

    কেন?

    কারণ ভেবেছিলাম—মানে তখনও তো আমার চিঠিটা আমি দেখিনি, যদি ঐ অঙ্কগুলোর কোন অর্থ বা সূত্র আমার চিঠি থেকে খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ সে লিখেছিল আমরা যৌথভাবে যেন তার অর্থের দায়িত্ব নিই।

    সে কাগজটা আছে—

    আছে। দেখবেন?

    আনুন তো!

    মিঃ গাঙ্গুলী ভিতরে গিয়ে একটা মোটা অমনিবাস ডিটেকটিভ গল্পের বই নিয়ে এলেন। তার মধ্যে কাগজটা ছিল।

    কাগজের মধ্যে অমনি কতকগুলো অঙ্ক। এবং সেটাও যদিও ত্রিকোণাকার-হয়ত এমনি হবে।

    সুব্রত পাশাপাশি দুটো কাগজ রেখে একবার দুবার তিনবার লেখাগুলো পড়ল, অঙ্কগুলোর কোন অর্থ যদি বের করা যায়। কিন্তু কোন হদিসই যেন পায় না সুব্রত।

    পারবেন না মশাই, পারবেন না। মিঃ গাঙ্গুলী বলেন, আমিও অনেক ভেবেছিদু দিন দু রাত, কিন্তু কেন হদিসই করতে পারিনি।

    আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী, আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন কি, আপনার বন্ধুর হাতে অনেক টাকা ছিল?

    করি—কারণ নলিন ছিল যেমন সত্যবাদী তেমনি সিরিয়াস টাইপের মানুষ এবং মধ্যে মধ্যে তার অসামান্য চরিত্রের মধ্যে যে একটা সহজ কৌতুক প্রকাশ পেত।

    কৌতুক!

    এটা আর কৌতুক ছাড়া কি বলুন তো?

    আচ্ছা মিঃ গাঙ্গুলী!

    বলুন।

    আপনাদের এই চিঠির ব্যাপার আর কেউ জানে?

    না। আমরা দুই বন্ধু ছাড়া আর কে জানবে!

    আচ্ছা, ডাঃ চৌধুরীর আপনার বলতে তো তার একমাত্র ভাগ্নে ডাঃ নীরেন সান্যাল এবং তিনিই তো ডাঃ চৌধুরীর সব কিছু পেয়েছেন?

    হ্যাঁ।

    তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় নেই?

    থাকবে না কেন? ভেরি নাইস বয়-যেমন ভদ্র তেমনি বিনয়ী।

    তিনি আপনার বন্ধুর এই চিঠির কথা জানতেন না?

    না।

    আপনারাও বলেননি?

    না, প্রয়োজন মনে করিনি।

    কেন প্রয়োজন বোধ করেননি?

    কারণ তাকে যদি নলিনীর জানাবার ইচ্ছাই থাকত তবে আমাদের দুই বন্ধুকে বা কেন এত সাবধানতার সঙ্গে ব্যাপারটা জানিয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আমাদের দুজনকে ছাড়া আর কেউ জানুক তার ইচ্ছা ছিল না।

    আচ্ছা আপনি কি সত্যিই মনে করেন মিঃ গাঙ্গুলী, চিঠির এই অঙ্কগুলোর মধ্যে থেকে আপনার বন্ধু মিঃ রায়ও কোন কিছু বের করতে পারেননি?

    না। আমি বা মহেন্দ্র কেউ ওর কোন মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি।

    আচ্ছা একটা কথা মিঃ গাঙ্গুলী, সুব্রত আবার প্রশ্ন করে, আপনি ও মহেন্দ্রবাবু নিশ্চয়ই মিঃ চৌধুরীর ঐ চিঠির ব্যাপারে আলোচনা করেছেন?

    তা করেছি।

    তাহলে সে-সময়ও তো কেউ আপনাদের আলোচনা শুনে চিঠির ব্যাপারটা জানতে পারে!

    সে আর এমন অসম্ভব কি?

    আর একটা কথা মিঃ গাঙ্গুলী—

    বলুন। আপনি তো মধ্যে মধ্যে বাড়ি থেকে বের হন?

    বিশেষ না—তবে–

    তবে?

    মধ্যে মধ্যে কলোনীতে যে পান্থনিবাস রেস্টুরেন্টটা আছে—সেখানে গিয়ে বসি। পান্থনিবাসের প্রোপ্রাইটার ঋষি লোকটা চমৎকার কফি বানায়—সেই কফির লোভেই মধ্যে মধ্যে সেখানে যাই। তাছাড়া কোথাও বড় একটা আমি যাই না।

    সাধারণত কখন রাত্রে শোন?

    তা রাত দশটা।

    সেদিন—মানে শনিবারও রাত দশটায়ই শুতে গিয়েছিলেন?

    না, সেদিন একটু আগেই যাই-রাত সাড়ে নটায়। বেজায় ঠাণ্ডা পড়েছে কদিন। সেদিন আবার ঠাণ্ডাটা একটু বেশিই পড়েছিল।

    তাই। আচ্ছা, সেদিন পান্থনিবাসে গিয়েছিলেন?

    হ্যাঁ।

    কতক্ষণ ছিলেন?

    সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত। দোকানে লোকজন ছিল না তেমন। আমি আর ঋষি বসে বসে গল্প করছিলাম।

    ঋষির সঙ্গে আপনার তাহলে বেশ আলাপ আছে?

    তা আছে। আঠারো বছর বয়সের সময় লোকটা জাহাজের খালাসী হয়ে বিলেত যায়। সেখানে বছর চল্লিশ ছিল। তারপর বিশ্রী একটা খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ে ও আর ওর বর্মিনী স্ত্রী

    বর্মিনী স্ত্রী নাকি লোকটার?

    হ্যাঁ, মালার বাবাও বিলেতে মশলার একটা দোকান করেছিল। সেখানে চাল ডাল সব কিছু পাওয়া যেত। ঋষি ঐ দোকানে চাল ডাল কিনতে যেত, দুজনায় আলাপ হয়–তারপর বিয়ে হয়।

    তারপর ঋষির কথা বলুন, কি খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়েছিল বলছিলেন?

    হ্যাঁ—অ্যারেস্ট হবার আগেই সে ও তার বর্মিনী স্ত্রী কৌশলে বিলেত থেকে পালায়–তারপর হংকং হয়ে যুদ্ধের ঠিক শুরুতে ইন্ডিয়াতে এসে পৌঁছায়। তারপর এখানে এসে ঘুরতে ঘুরতে আগরপাড়ার এই কলোনীতে একটা জায়গা কিনে ছোট একটা বাড়ি করেছে। সেই বাড়িরই বাইরের অংশে একটা রেস্তোরাঁ খুলেছে। রেস্তোরাঁর প্রধান আকর্ষণই ঐ কফি :

    হুঁ , তাহলে আপনি সেদিন ছটার পর ফিরে আসেন—সোজা বাড়িতেই তো আসেন?

    , একটু এদিক ওদিক ঘুরেছি। ঠাণ্ডা চিরদিনই আমার ভাল লাগে।

    কখন তাহলে ফিরলেন বাড়িতে?

    রাত সোয়া আটটা প্রায়।

    আচ্ছা আজ তাহলে আমরা উঠব মিঃ গাঙ্গুলী, হয়ত আবারও আপনাকে বিরক্ত করতে আসতে পারি। মৃণাল সেন বলল।

    না, না—বিরক্ত কি, আসবেন—নিশ্চয়ই আসবেন, ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম।

    .

    ০৮.

    সবাই উঠে পড়েছিল, হঠাৎ সুব্রত বলে, মিঃ গাঙ্গুলী, আপনার এই চিঠিটা আর ঐ কপিটা আমি নিতে পারি? এ দুটো কপি করে দু-এক দিনের মধ্যেই আপনাকে পাঠিয়ে দেব।

    বেশ তো-নিয়ে যান!

    আচ্ছা তাহলে চলি–নমস্কার।

    নমস্কার। সকলে সলিটারি কর্নার থেকে বের হয়ে এল।

    গেট দিয়ে বের হয়ে সকলে এসে গাড়িতে উঠে বসল।

    গাড়ি চলতে শুরু করে। সুব্রত গাড়ি চালাচ্ছিল-স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে সামনের দিকে চেয়েছিল সে যেন একটু অন্যমনস্ক। মৃণাল সেন পাশেই বসেছিল।

    জলধর বললেন, আমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবেন স্যার।

    হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। সুব্রত মৃদুকণ্ঠে বলে।

    থানায় জলধর চাটুজ্যেকে নামিয়ে দিয়ে ওরা বি. টি. রোড ধরে। বেলা তখন প্রায় সাড়ে বারোটা হবে।

    এ সময়টা বি. টি. রোডে ট্রাফিকের একটু ভিড়ই থাকে। বিশেষ করে যুদ্ধের সময় মিলিটারি ট্রাকের ও জীপের চলাচলটা একটু বেশিই।

    অনেকগুলো ইউনিট ও ক্যাম্প ব্যারাকপুরে-মিলিটারিদের যাতায়াতও তাই একটু বেশি বি. টি. রোডে।

    ভদ্রলোককে কেমন মনে হল সুব্রতবাবু? মৃণাল সেন প্রশ্ন করে। তদন্তে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেল ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে।

    কি?

    ভদ্রলোক ঐ টাইপ করা চিঠিটা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। উনি কিছুই জনেন না ও সম্পর্কে।

    কিন্তু আমার মনে হয় কথাটা উনি মিথ্যে বলেছেন।

    মিঃ সেন, মিঃ গাঙ্গুলী মিথ্যে বলেননি। কারণ সত্যিই ওঁর মহেন্দ্র রায়কে আগরপাড়ায় ডেকে আনবার জন্য কোন চিঠি লেখবার প্রয়োজন ছিল না।

    ছিল না বলতে চান!

    হ্যাঁ। তা যদি থাকত তো উনি এত সহজে চিঠি দুটো আমাকে দিয়ে দিতেন না। তাছাড়া টাইপ করতে জানলেও এবং টাইপিং মেসিন থাকলেও বন্ধুকে একটা একান্ত। ব্যক্তিগত চিঠি টাইপ করে কেউ সাধারণত দেয় না। এক্ষেত্রে তাই মনে হচ্ছে, হত্যাকারী অত্যন্ত চালাক—সে জানত ঐ এক ঢিলেই হয়ত পাখি কাত হবে।

    কি বলছেন?

    ব্যাঙ্কের চিঠির ব্যাপার যখন ঐ চিঠির মধ্যে উল্লেখ করা ছিল তখন হত্যাকারী জানত সুনিশ্চিত ভাবেই যে মহেন্দ্রনাথ অমন একটা চিঠি পেয়ে রীতিমত ইন্টারেস্টেড হয়ে উঠবেন এবং যাবেনও বন্ধুর কাছে। তারপর সমস্ত ব্যাপারটা ভেবে দেখুন, কতখানি ভেবে কাজ করেছে হত্যাকারী। প্রথমত, শনিবারটা সে বেছে নিয়েছিল এবং সময়টা সন্ধ্যার দিকে। কারণ সে জানত শনিবারে ডেলি প্যাসেঞ্জারদের তিনটে সাড়ে তিনটের পর আর ভিড় থাকবে না। এই গেল এক নম্বর। দুই নম্বর, হত্যাকারী মহেন্দ্রনাথকে ভাল করেই চিনত এবং এও জানত তিনি সন্ধ্যার পর তার অন্ধপ্রায় ড্রাইভারকে নিয়ে বেরুবেন না—গেলে ট্রেনেই যাবেন। তারপর তৃতীয় নম্বর, মহেন্দ্রনাথ ট্রেনে গেলেও চারটার পর যাবেন। কারণ শনিবারেও তিনি বিকেল সাড়ে চারটা পাঁচটা পর্যন্ত অফিসের কাজ করতেন। অতএব যেতে যেতে যাঁর সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে।

    শীতের ছোট বেলা, সাড়ে পাঁচটাতেই অন্ধকার হয়ে যায়। এবং শনিবার চারটের পর যে ট্রেনটা আগরপাড়া হয়ে যায় সেটা পৌনে আটটা নাগাদ আগরপাড়া পৌঁছায়। শনিবার ঐ সময়টা স্টেশনে তেমন ভিড়ও থাকে না। কাজেই–

    কি?

    কেউ যদি ঐ সময় স্টেশনে এসে মিঃ গাঙ্গুলীকে রিসিভ করে তবে তিনি সঙ্গে যাবেন এবং বড় একটা কারও সেটা নজরে পড়বে না। বুঝতে পারছেন বোধহয় মিঃ সেন, আমি কি বলতে চাইছি। হত্যাকারী মহেন্দ্রনাথকে স্টেশনে কাউকে দিয়ে রিসিভ করায়, তারপর তাকে বলে হয়ত, মিঃ গাঙ্গুলী পাঠিয়ে দিয়েছেন তাকে নিয়ে যেতে। ধরুন লোকটা যদি একটা সাইকেল-রিকশাওয়ালাই হয় মহেন্দ্র নিশ্চয়ই ঐ রিকশাওয়ালার সঙ্গে যাবেন, কারণ ইতিপূর্বে তিনি কখনও আগরপাড়ায় সলিটারি কর্নারে আসেননি, পথ চেনেন না। বরং খুশিই হবেন মিঃ গাঙ্গুলী লোক পাঠিয়েছেন দেখে, তারপর ব্যাপারটা ভেবে নিন—অন্ধকারে পথের মাঝখানে হত্যাকারী ওৎ পেতে ছিল-মহেন্দ্রনাথকে ক্লোজ রেঞ্জ থেকে গুলি করা এমন কিছু একটা শক্ত কাজ নয়।

    কিন্তু—

    ভাবছেন বোধ হয় গুলির শব্দটা, তাই না? কিন্তু তাও তো চাপা দেওয়া যেতে পারে। ধরুন যদি রিভলবারের সঙ্গে সাইলেন্সর লাগানো থাকে কিংবা রাস্তাটা নির্জন–হয়ত কারও কানে পৌঁছায়নি শব্দটা।

    তা যেন হল কিন্তু মৃতের মুখটা অমন করে মিউটিলেট হল কি করে?

    আমার অনুমান, সাধারণত শনিবার রাত্রে মিল থেকে যে সব ওয়াগান ভর্তি করে সেগুলো গুডস্ ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। তেমনি কোন ওয়াগনের ট্রাক্সন হুকের সঙ্গে হয়ত হত্যাকারী মৃতদেহটা আটকে দিয়েছিল বা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। ওয়াগন চলার সময় হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ঐভাবে মুখটা ও পরিধেয় জামা-কাপড় ক্ষতবিক্ষত ও ছিন্নভিন্ন হয়েছে যাতে করে মৃতদেহ দেখলে, পুলিসের মনে হয় ব্যাপারটা স্রেফ একটা আত্মহত্যা-মার্ডার নয় আদৌ।

    তাহলে আপনি বলতে চান, হত্যাকারী মহেন্দ্রনাথকে বেশ ভালভাবেই চিনত—তার হ্যাবিটস্ পর্যন্ত জানত?

    নিশ্চয়ই। এখন নিশ্চয়ই হত্যাকারীর একটা রূপ আপনি কল্পনা করতে পারছেন মিঃ সেন মনে মনে!

    হ্যাঁ, কিছুটা আমার মনে হচ্ছে—

    কি? মিঃ গাঙ্গুলীকেও এক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে না।

    কেন?

    মহেন্দ্রনাথের কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছিলেন। ধরুন সেই টাকা যাতে করে শোধ আর না দিতে হয় তাই–

    না, যে বন্ধুকে অমন করে টাকা দিতে পারে তার ধারের ব্যাপারে চিন্তার কোন কারণ থাকতে পারে না। ভাল কথা, মহেন্দ্রনাথের বালিগঞ্জের বাড়িতে একবারও কি গিয়েছেন?

    না।

    সেখানে কিন্তু একবার আপনার যাওয়া উচিত ছিল।

    যাব ভাবছি কাল।

    হ্যাঁ চলুন, দুজনাই একসঙ্গে যাব—তার দুই পুত্র ও কন্যা সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার।

    পরের দিন সকালের দিকে সুব্রত ও মৃণাল সেন বালিগঞ্জে মহেন্দ্রনাথের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হল। মৃণাল সেন ইতিপূর্বে ঐ বাড়িতে আসেনি বটে তবে সুব্রত চিনত।

    ধনী ব্যক্তি মহেন্দ্রনাথ।

    বালিগঞ্জে লেকের কাছে গড়িয়াহাট অঞ্চল সেই যুদ্ধের সময়ে তেমন ডেভালাপড হয়নি।

    অনেক নারকেল বাগান, জঙ্গল ও ধানজমি।

    তারই মধ্যে এদিকে-ওদিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে লেককে কেন্দ্র করে কিছু কিছু পয়সাওয়ালা লোক বেশ কিছুটা করে জায়গা নিয়ে বড় বড় বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করেছেন।

    মহেন্দ্রনাথ তাঁদেরই অন্যতম।

    বুদ্ধিমান চতুর ব্যবসায়ী তিনি। জানতেন ও বুঝতে পেরেছিলেন ক্রমশ ঐ অঞ্চলটা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে—লেকের জৌলুসে বিশেষ একটি এলাকায় পরিণত হবে।

    সুব্রতরা যখন মহেন্দ্রনাথের বালিগঞ্জের ভবনে এসে পৌঁছাল তখন বেলা আটটা হবে। দরোয়ান মৃণাল সেনের পুলিসের পোশাক দেখে তাকে আটকাল না। গেট খুলে দিল।

    গেট দিয়ে ঢুকে সোজা ওরা এসে পোর্টিকোর সামনে গাড়ি থামাল। বাড়িটা অনেকখানি জায়গা নিয়ে। সামনে বেশ খানিকটা বাগান, তাছাড়া টেনিস লনও আছে।

    বাড়িটা যেন অত্যন্ত নিস্তব্ধ। কোথাও কোন যেন সাড়াশব্দ নেই।

    সুব্রত কলিংবেলটা টিপল।

    একটু পরেই উর্দিপরা একজন বেয়ারা বের হয়ে এল।

    কাকে চান?

    সুরেনবাবু বাড়িতে আছেন? সুব্রতই প্রশ্ন করে।

    আছেন।

    একবার ডেকে দাও তো।

    ভিতরে এসে বসুন।

    মনে হল যেন মৃণাল সেনের, পুলিসের ইউনিফর্ম দেখে বেয়ারা একটু অবাকই হয়েছে। সে তাদের এনে ড্রইংরুমে বসাল।

    ড্রইংরুমটি সুন্দরভাবে সাজানো।

    দামী সোফা-পুরু কার্পেট মেঝেতে। দেওয়ালে দু-চারটি দামী ল্যান্ডস্কেপ।

    সুব্রত ও মৃণালকে বেশিক্ষণ বসে থাকতে হল না।

    একটু পরেই সুশ্রী, বেশ বলিষ্ঠগড়ন এক যুবক ঘরে এসে ঢুকল।

    সুব্রতকেই লক্ষ্য করে যুবক বলে ওঠে, কতক্ষণ এসেছ?

    এই আসছি। লেট মি ইনট্রোডিউস, ইনি মৃণাল সেন ইন্সপেক্টার, তোমার দাদার ব্যাপারটা ইনিই তদন্ত করছেন। মিঃ সেন—এই সুরেন, মহেন্দ্রনাথের ছোটভাই, আর্টিস্ট।

    মৃণাল সেন দেখছিল। আদৌ আর্টিস্টের মত চেহারা নয় সুরেন্দ্রনাথের। বরং পালোয়ান বা অ্যাথলেটের মত চেহারাটা।

    পরনে পায়জামা ও গরম পাঞ্জাবি। পায়ে চপ্পল।

    মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা।

    কঠিন চোয়াল, খাড়া নাক। হাতের কজি বেশ মোটা—আঙুলগুলো মোটা মোটা।

    সুরেন, মিঃ সেন তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান। সুব্রত বলে।

    বেশ তো-বলুন না—উনি কি জানতে চান। সুরেন্দ্র মৃদুকণ্ঠে বললে।

    আপনি তো এই বাড়িতেই থাকেন?

    মৃণাল সেনের প্রশ্নে তার মুখের দিকে তাকিয়ে সুরেন্দ্র মৃদুকণ্ঠে বলে, হ্যাঁ।

    আচ্ছা মিঃ রায়, শনিবার দুর্ঘটনার দিন তার সঙ্গে শেষ কখন আপনার দেখা হয়েছিল?

    বেলা তখন পৌনে পাঁচটা হবে-বেরুচ্ছিলেন তিনি। পোর্টিকোতে আমার সঙ্গে দেখা।

    তাহলে সেদিন তিনি অফিস থেকে বাড়িতে এসে তারপর আগরপাড়া গিয়েছিলেন?

    সেই রকমই মনে হয়।

    আপনার সঙ্গে আপনার দাদার সে-সময় কোন কথা হয়েছিল?

    না।

    আচ্ছা মিঃ রায়, সেদিন যাবার সময় আপনার দাদার পরনে কী জামা-কাপড় ছিল মনে আছে নিশ্চয়?

    আছে। গরম সুট পরনে ছিল। আর হাতে ছিল গ্রেট কোটটা।

    কি রঙের?

    কালো রঙের।

    হাতে আর কিছু ছিল না?

    হ্যাঁ, আর ফোলিও ব্যাগটা ছিল।

    পায়ে কি জুতো ছিল?

    কালো ডার্বি সু।

    আচ্ছা সুরেন–

    সুব্রতর ডাকে সুরেন্দ্র এবারে সুব্রতর মুখের দিকে তাকাল।

    তোমাকে সেদিন একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তোমার দাদার উইলের ব্যাপারটা কিছু জান–মানে উইলে কি ভাবে তিনি তার সম্পত্তি ভাগ করে গেছেন।

    না।

    ঐ একটি মাত্র শব্দের মধ্যে দিয়ে যেন সুব্রতর মনে হল বেশ একটা বিরক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল।

    তুমি জান না কিছু?

    না। হি ওয়াজ এ পিকিউলিয়ার সর্ট অফ ম্যান-বিচিত্র স্বভাবের এক লোক ছিলেন। আমাদের কারও পরে—এমন কি নিজের সন্তানদের পরেও তার কোন মায়ামমতা ছিল না। সেক্ষেত্রে যদি শুনি তিনি তার সব কিছু থেকে আমাদের সকলকেই বঞ্চিত করে গিয়েছেন-ওয়েল-ইট ওন্ট বী এ সারপ্রাইজ অ্যাট অল টু এনি অফ আস-আমরা কেউ এতটুকুও বিস্মিত হব না। আর হয়ত তাই কিছু করেছেন।

    একথা তো তুমি আমায় বলনি সুরেন। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদেরও কি তেমন স্নেহের চোখে দেখতেন না?

    তাই যদি হত তাহলে কি ছেলেমেয়েরা স্ত্রীর মৃত্যুর পর মামার বাড়িতে চলে যেত এবং কুন্তলা সেখানেই কি মানুষ হত। আসলে মানুষটা ছিল অত্যন্ত সেলফিশ-স্বার্থপর।

    তার স্ত্রী কতদিন হল মারা গেছেন?

    বৌদি?

    হ্যাঁ।

    কুন্তলার যখন আট বছর বয়স সেই সময়ে মারা যান বৌদি দীর্ঘদিন পরে আবার সন্তান হতে গিয়ে। সৌরীন-দাদার বড় ছেলের বয়স তখন ষোল ও ছোট ছেলে ভবেনের বয়স ছিল বোধ করি বারো-তেরো।

    এমন তো হতে পারে সুরেন, তোমার দাদা তোমাদের বৌদিকে অত্যন্ত ভালবাসতেন, তাই তার মৃত্যুতে সংসার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে?

    কে জানে? হয়ত ভালবাসতেন!

    হুঁ। তোমার ভাইঝি বাড়িতে আছেন?

    কে, কুন্তলা?

    হ্যাঁ।

    আছে। মিঃ সেন তার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চান।

    বেশ তো–তোমরা বোস—আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি তাকে।

    সুরেন্দ্র উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

    মৃণাল সেন সুরেন্দ্রর গমনপথের দিকে চেয়ে থাকে।

    .

    ০৯.

    কুন্তলা এল।

    প্রায় নিঃশব্দেই এসে যেন কুন্তলা ঘরে প্রবেশ করল।

    বাইশ-তেইশ বছর বয়স হবে। রোগা ছিপছিপে গড়ন। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম যাকে বলে। মুখখানি কিন্তু ভারি সুন্দর—বিশেষ করে ছোট কপাল-টানা জ্ব-নাক ও চিবুক। সব কিছুর মধ্যে এমন চমৎকার একটা সামঞ্জস্য আছে যাতে করে সমগ্র

    মুখখানিকে অপূর্ব একটি লাবণ্য দিয়েছে।

    মাথায় বেশ দীর্ঘ কেশ। তৈলহীন রুক্ষ। পরনে সাধারণ একখানা কালোপাড় শাড়ি। গায়ে সাদা ব্লাউজ। হাতে একগাছি করে সোনার বালা। পায়ে চপ্পল।

    সুব্রতই আহ্বান জানায়। বলে বসুন মিস রায়। কু

    ন্তলা একটা সোফায় বসল ওদের মুখোমুখি।

    সুব্রতই কথা বলে, আপনার এই বিপদের সময় আপনাকে এভাবে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে আমরা দুঃখিত ও লজ্জিত। কিন্তু বুঝতেই পারছেন—উপায় নেই বলেই

    কুন্তলা কোন কথা বলে না। চুপ করে থাকে।

    কয়েকটা কথা আমাদের জানবার ছিল মিস্ রায়!

    কুন্তলা সুব্রতর দিকে মুখ তুলে তাকাল।

    গত শনিবার কোন সময় আপনার বাবা অফিস থেকে ফিরে আসেন?

    বোধ হয় সাড়ে চারটে হবে।

    কখন আবার বের হয়ে যান?

    পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি ছিলেন না। এসেই বের হয়ে যান—চা ও খাননি।

    কোথায় যাচ্ছেন কি বৃত্তান্ত এসব সম্পর্কে আপনার সঙ্গে আপনার বাবার কোন কথাবার্তা হয়েছিল?

    হ্যাঁ, বলেছিলেন আগরপাড়ায় মণীন্দ্র কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। পরের দিন সকালে ফিরবেন এবং দেরি হলে সোজা অফিসেই চলে যাবেন।

    কেন যাচ্ছেন আগরপাড়া সে-সম্পর্কে কিছু বলেননি?

    না।

    আচ্ছা কুন্তলা দেবী, শুনেছি আপনাদের মা মারা যাবার পর আপনি আপনার মামাদের ওখানে চলে যান।

    হ্যাঁ-আমি, দাদা, ছোড়দা—তিনজনেই গিয়ে থাকি।

    তাহলে আপনারা দীর্ঘদিন মামার বাড়িতেই কাটিয়েছেন।

    হ্যাঁ। বছর দুই হল বি. এ. পাস করবার পর মামীমা মারা গেলেন। তখন বাবা বললেন এখানে চলে আসতে-মামীমার শ্রাদ্ধ চুকে গেলে বাবা গিয়ে সঙ্গে করেই আমাকে নিয়ে আসেন, সেই থেকে বাবার কাছেই আছি।

    আর আপনার দাদারা?

    দাদা ইন্টারমিডিয়েট পাস করবার পর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। তখন থেকে সে হস্টেলেই ছিল আর ছোটদাও ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত মামার বাড়িতে ছিল। তারপর এই বাড়িতে চলে আসে।

    আপনারা যখন মামার বাড়িতে ছিলেন, মিঃ রায় আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন না বা আপনারা এখানে মধ্যে মধ্যে আসতেন না?

    বাবাই মধ্যে মধ্যে যেতেন। আমরা কখনও আসিনি। তবে এখানে চলে আসবার বছরখানেক আগে থাকতে বাবা মধ্যে মধ্যে আমাকে গাড়ি পাঠিয়ে এখানে নিয়ে আসতেন। পাঁচ-সাতদিন এখানে আমি থেকে আবার ফিরে যেতাম।

    আপনাদের বাবা আপনাদের মধ্যে সবচাইতে কাকে বেশি ভালোবাসতেন বলে মনে হয় আপনার?

    বাবা তার সন্তানদের কাউকেই কম ভালবাসতেন না। তবে অত্যন্ত চাপা ও গম্ভীর। প্রকৃতির মানুষ বলে কিছু প্রকাশ পেত না।

    হুঁ। আচ্ছা আপনার বাবার বন্ধু ডাঃ নলিনী চৌধুরীকে আপনি চিনতেন?

    হ্যাঁ, নলিনী কাকা তো প্রায়ই মামার বাড়িতে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন।

    আপনাদের ঐ নলিনী কাকা আপনার বাবা ও মণীন্দ্র কাকার নামে মৃত্যুর পূর্বে ব্যাঙ্কে দুখানা চিঠি রেখে গিয়েছিলেন, আপনি সে-চিঠি সম্পর্কে জানেন কিছু?

    শুনেছিলাম—তবে সে চিঠি কিসের—কি তাতে লেখা ছিল জানি না।

    চিঠির কথাটা শুনেছিলেন কার কাছে?

    বাবার কাছেও শুনেছি, আর—

    আর কার কাছে শুনেছেন?

    নীরেনের কাছেও শুনেছি।

    নীরেন!

    ডাঃ নীরেন সান্যাল দাদার বন্ধু। নলিনী কাকার ভাগ্নে।

    সুব্রত লক্ষ্য করল নীরেনের কথা বলবার সময় কুন্তলার মুখটা যেন একটু রাঙা হয়ে উঠল। সে চোখ নামাল।

    সুব্রত এবার প্রশ্ন করে, ডাঃ নীরেন সান্যালের সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?

    দাদার সঙ্গে প্রায়ই মামার বাড়িতে আসত-সেখানেই অনেকদিনের পরিচয়।

    আচ্ছা মিস রায়, যাবার সময় আপনার বাবার হাতে কিছু ছিল, আপনার মনে আছে?

    হ্যাঁ, তার ফোলিওটা ছিল।

    কেমন দেখতে সেটা?

    কালো রঙের মরক্কো লেদারের তৈরি। উপরে বাবার নাম মনোগ্রাম করা সোনার জলে।

    ভাল কথা, আপনার যে দাদা আর্মিতে কাজ করেন, এখন কোথায় আছেন জানেন?

    শুনেছি ইস্টার্ন ফ্রন্টে। তবে কোথায় জানি না।

    শেষ কবে ছুটিতে আসেন?

    মাস আষ্টেক আগে।

    আপনার ছোড়দা?

    একটু যেন ইতস্তত করল কুন্তলা, তার পর মৃদুকণ্ঠে বললে, ছোড়দা এখন বেরিলিতে পোস্টেড্‌।

    আর একটা কথা—আপনার বাবার উইল সম্পর্কে কিছু জানেন আপনি?

    না। মাত্র গতকালই আমাদের সলিসিটার এসেছিলেন। তার কাছে শুনলাম বাবার উইল আছে। আগামী কাল সেই উইল পড়ে শোনাবেন তিনি বলে গেছে।

    আচ্ছা আজ আর আপনাকে বিরক্ত করব না। আপনি যেতে পারেন।

    কুন্তলা উঠে দাঁড়াল। নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

    সেদিনের মত ওরা বিদায় নিল মহেন্দ্র রায়ের বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে।

    .

    দিন দুই পরে।

    মিঃ মুখার্জী-রায় অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজারের বাড়ির বাইরের ঘরে বসে কথা হচ্ছিল।

    সুব্রত, মৃণাল সেন ও মিঃ মুখার্জী কথা বলছিল।

    গতকাল সন্ধ্যায় উইল পড়া হয়ে গিয়েছে।

    মহেন্দ্র রায় তার ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিটের চার লক্ষ টাকার মধ্যে এক লক্ষ টাকা তার মেয়ে কুন্তলাকে—নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাই সুরেন্দ্রকে ও বালিগঞ্জের বাড়িতে যতদিন তারা বেঁচে থাকবে তাদের থাকবার অধিকার দিয়ে গিয়েছেন।

    বাকি দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা নানা প্রতিষ্ঠানে দান করে গিয়েছেন। এবং কুন্তলা ও সুরেন্দ্রর অবর্তমানে বাড়িটাও রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করে গিয়েছেন অবলা বিধবাদের একটা আশ্রম করবার জন্য।

    আর কোম্পানির স্বত্বের অর্ধেক দিয়ে গিয়েছেন কুন্তলাকে, অর্ধেক মিঃ মুখার্জীকে।

    দুই ছেলে কোম্পানি থেকে দেড় হাজার টাকা করে মাসোহারা পাবে মাত্র। তাদের আর কিছু দেননি।

    কোম্পানির আয় বাৎসরিক চার লক্ষ টাকার মত।

    মিঃ রায়ের সম্পত্তির পরিমাণ শুনে সুব্রত সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল।

    ঐ সঙ্গে আর একটা কথা জানা গিয়েছে। ঐ শেষোক্ত উইলটি মৃত্যুর মাত্র দুমাস আগে করেছিলেন নাকি মহেন্দ্র রায় আগের উইলের বদলে।

    আগের উইলে-মেয়েকে অর্ধেক দিয়ে বাদবাকি নগদ টাকা দুই ছেলেকে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন।

    বাড়িটার অবিশ্যি আগের উইলের মতই ব্যবস্থা ছিল—আর কোম্পানির অর্ধেক ছিল মিঃ মুখার্জীর ও বাদবাকি অর্ধেক তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করা ছিল।

    সে সম্পর্কেই আলোচনা চলছিল মিঃ মুখার্জীর বসবার ঘরে।

    আচ্ছা মিঃ মুখার্জী, আপনি যখন উইলের অন্যতম সাক্ষী ছিলেন, আপনি হয়ত জানেন কেন হঠাৎ তিনি তাঁর উইলটা আবার বদলেছিলেন? সুব্রত প্রশ্ন করে।

    ঠিক বলতে পারব না, তবে–

    কি?

    মনে হয়, হয়ত ছেলেদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি উইলটা বদলেছিলেন।

    কেন, বাপ-ছেলেদের মধ্যে কি তেমন সম্প্রীতি ছিল না?

    না। কোনদিনই তেমন প্রীতির সম্পর্ক ছিল না বাপ ও ছেলেদের মধ্যে।

    কেন—কোন কারণ ছিল কি বাপ ও ছেলেদের মধ্যে সম্প্রীতি না থাকার?

    আমার মনে হয় কারণ একটা হয়ত ছিল—

    কি?

    স্যারের একটা আনম্যারেড শালী ছিল—

    ছিল কেন বলছেন?

    গত বছর তিনি একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান।

    অ্যাক্সিডেন্ট!

    হ্যাঁ, বাড়ির বাথরুমের সুইচে ইলেকট্রিক কারেন্টের শক খেয়ে মারা যান। ঐ শালীর সঙ্গে স্যারের ঘনিষ্ঠতা ব্যাপারটা তার স্ত্রীর মৃত্যুর বছরখানেক আগে থাকতেই নাকি গড়ে উঠেছিল। এবং মৃত্যুর পর বেশি হয়।

    মিঃ রায়ের ঐ শ্যালিকা কি তার বালিগঞ্জের বাড়িতেই থাকতেন?

    না—তিনি থাকতেন শ্যামবাজারে একটা বাড়ি নিয়ে। শ্যামবাজারের একটা স্কুলের তিনি হেডমিস্ট্রেস ছিলেন।

    হুঁ। আচ্ছা মিঃ মুখার্জী, মিঃ রায়ের ছেলেদের রিসেন্ট কোন খবর জানেন?

    বড় সৌরীন্দ্রর কোন সংবাদ জানি না, তবে ছোট ছেলে ভবেন্দ্ৰ ঐ দুর্ঘটনার দিনসাতেক আগে এক দ্বিপ্রহরে তার বাবার সঙ্গে অফিসে দেখা করতে এসেছিল।

    অফিসে?

    হ্যাঁ। আমার আর মিঃ রায়ের অফিস কামরা পাশাপাশি। আমি হঠাৎ একটা চেঁচামেচি শুনে ব্যাপারটা কি জানবার জন্য স্যারের অফিসঘরের দিকে যাই। সেই সময় দড়াম করে দরজা খুলে ভবেন্দ্র মিঃ রায়কে শাসাতে শাসাতে রাগতভাবে বের হয়ে গেল দেখলাম।

    শাসাতে শাসাতে বের হয়ে গেলেন!

    হ্যাঁ, ভবেন্দ্ৰ বলছিল, ওল্ড ভালচার-বুড়ো শকুনি, তোমাকে আমিও দেখে নোব।

    তারপর?

    আমি স্যারের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। দেখি তিনিও অত্যন্ত উত্তেজিত-বলছেন, রাস্কেল! তারপর আমাকে দেখে বললেন, আর কখনও যেন ও আমার অফিসে না ঢুকতে পারে! দারোয়ানদের স্ট্রিট অর্ডার দিয়ে দেবে মুখার্জী।

    অতঃপর সুব্রত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি মিঃ রায়ের অফিসে কতদিন কাজ করছেন—মানে বর্তমান পোস্টে?

    প্রায় বছর দশেক হবে।

    তার আগে?

    তার আগেও তার কোলিয়ারিগুলো দেখাশোনা করতাম আমি।

    .

    ১০.

    কিছু মনে করবেন না মিঃ মুখার্জী—উইলে আপনাকে মিঃ রায় অনেক কিছু দিয়েছেন

    শুনলাম! সুব্রত বলে।

    মিঃ মুখার্জী বললেন, মিঃ রায় মানে মহেন্দ্র রায়ের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে।

    সম্পর্ক!

    হ্যাঁ। আমরা মামাতো-পিসতুতো ভাই। আমার মা অর্থাৎ ওঁর পিসিমার কাছেই মিঃ রায় মানুষ হয়েছিলেন। কারণ ওঁর বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর সেই সময় আমার মামীমা–মহেন্দ্র রায়ের মা মারা যান। উনি তাই বলতেন পিসিমার ঋণ নাকি উনি জীবনে শোধ করতে পারবেন না।

    আপনি যে মিঃ রায়ের আত্মীয় কথাটা কিন্তু সেদিন বলেননি। সুব্রত মৃদুকণ্ঠে বলে।

    না, বলিনি। দেখুন সুব্রতবাবু, বড়লোকের আত্মীয়তা ঘোষণা করবার মধ্যে গৌরব অনুভব করা একটা থাকতে পারে, কিন্তু মর্যাদা নেই হয়ত।

    সুব্রত মিঃ মুখার্জীর কথা শুনে একবার তার মুখের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু সে বলবার আগেই মিঃ মুখার্জী পুনরায় বললেন, আমাদের পরস্পরের মধ্যে বর্তমানের অবস্থার এমন এক আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়ে গিয়েছিল যে, কেউ হয়ত অতীতের সে সম্পর্কের কথাটা কখনও মনে করতাম না পরবর্তীকালে।

    সুব্রত ঐ সম্পর্কে আর কোন আলোচনা করল না–সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। বললে, মিঃ মুখার্জী, আপনি সেদিন বলেছিলেন মিঃ গাঙ্গুলী এদেশে ফিরে এসে তার বন্ধু মিঃ রায়ের কাছ থেকেই অর্থসাহায্য নিয়ে আগরপাড়ায় বাড়ি করেছিলেন।

    হ্যাঁ!

    টাকার পরিমাণটা হয়ত আপনি জানেন–

    জানি। হাজার চল্লিশ হবে।

    আচ্ছা কি শর্তে মিঃ রায় তার বন্ধুকে টাকাটা দিয়েছিলেন।

    বিশেষ কোন শর্তই ছিল না।

    মানে? যখন সুবিধা হবে টাকাটা দেবেন এই আর কি!

    কিন্তু একজন যিনি জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে পৌঁচেছেন, যাঁর সর্বস্ব গেছে, তার পক্ষে আর এত টাকা শোধ করার সম্ভাবনা কোথায়?

    মিঃ মুখার্জী চুপ করে থাকেন।

    অবিশ্যি যদি আর কোন কারণ থেকে থাকে—

    থাকলেও আমি জানি না। হুঁ। আচ্ছা কোন ডিড হয়নি লেনদেনের? হয়েছিল।

    সে ডিডটা একবার দেখতে পারি?

    কাল অফিসে আসবেন, দেখাব।

    অফিসে আছে বুঝি?

    না। মিঃ রায়ের বাড়িতেই আছে। কাল আনিয়ে রাখব সেখান থেকে।

    সেদিনকার মত বিদায় নিল ওরা।

    দুজনে এসে গাড়িতে উঠে বসল। সুব্রত নিঃশব্দে গাড়ি চালাচ্ছিল।

    মৃণাল সেন প্রশ্ন করে, কোন দিকে যাচ্ছেন?

    এন্টালিতে।

    সেখানে?

    একবার ডাঃ নীরেন গাঙ্গুলীর সঙ্গে দেখা করবেন না?

    নীরেন গাঙ্গুলী!

    হ্যাঁ-ডাঃ নলিনী চৌধুরীর ভাগ্নে। আর আর—

    নীরেন গাঙ্গুলীর কথা বলতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন না, কুন্তলা দেবীর মুখের রঙের আভাস!

    আপনি তাও নজর করে দেখেছেন? হাসতে হাসতে মৃণাল সেন বলে।

    তা দেখতে হয় বৈকি। কিন্তু তার আগে একবার বরাহনগরে যাব মেজর সাহেবের ওখানে।

    মেজর সাহেব!

    হ্যাঁ, মেজর রণদা সিনহা। এদেশে ফায়ার আর্মসে অতবড় এক্সপার্ট খুব কম পাবেন মিঃ সেন।

    অতঃপর সুব্রত মেজর সাহেবের পরিচয় দিল। মেজর রণদা সিনহা গত মহাযুদ্ধে সামান্য সৈনিকের চাকরি নিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে উন্নতি করে মেজর পদে উন্নীত হন।

    বছর সাতেক হল চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন।

    রিটায়ার করার পর বরাহনগরে অনেকখানি জায়গাসমেত একটা বাগানবাড়ি কিনে বসবাস করছেন। কোন ঝামেলা নেই সংসারে। স্বামী আর স্ত্রী।

    একমাত্র ছেলে, সেও আর্মির চাকরিতে বিদেশে।

    একবার একটা কেসে আর্মস-সংক্রান্ত ব্যাপারে ওপিনিয়ানের জন্য কিরীটীর সঙ্গে রণদা সিনহার বরাহনগরের আদি নিবাসে গিয়েছিল। সেই সময়ই আলাপ হয় ওদের। ভারি আমুদে ও রসজ্ঞ লোকটি।

    মধ্যে মধ্যে তারপরও সুব্রত ওদিকে গেলে মেজর সিনহার আদি নিবাসে গিয়েছে। আড্ডা দিয়ে এসেছে।

    বেশ লম্বা-চওড়া এবং রসিক প্রকৃতির মানুষটি।

    ওরা যখন আদি নিবাসে গিয়ে পৌঁছল, মেজর সিনহা তৃতীয়বার চা নিয়ে বসেছিলেন।

    মাথায় একমাথা পাকা চুল। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।

    পরনে পায়জামা ও স্লিপিং গাউন।-মুখে একটা মোটা সিগার।

    সুব্রতকে দেখে কলস্বরে অভ্যর্থনা জানান সিনহা, আরে সুব্রতচন্দ্র যে-সু-স্বাগতম।

    সুব্রত বসতে বসতে বলে, আড্ডা দিতে আজ নয় কিন্তু—

    তবে?

    একটা ওপিনিয়ন নিতে এসেছি।

    কি ব্যাপার?

    সুব্রত পকেট থেকে একটা কাগজে মোড়া বুলেট বের করল।

    দেখুন তো মেজর সাহেব এই বুলেটটা!

    বুলেটটা হাতে নিয়ে একবার মাত্র চোখ বুলিয়ে সিনহা বললেন, কোথায় পেলেন এটা? এটা তো দেখছি আর্মি রিভলভারের গুলি!

    আর কিছু-অন্য বিশেষত্ব আছে বুলেটটার গায়ে?

    বিশেষত্ব–দাঁড়ান দেখি। একবার লেন্সটা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হয় তাহলে!

    বলতে বলতে মেজর উঠে গেলেন ভিতরে এবং কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে বললেন, হ্যাঁ, বুলেটার গায়ে খুব ফাইন খাজ কেটে গেছে। তাতে মনে হয়

    কি?

    যে রিভলভার থেকে এটা ফায়ার করা হয়েছিল তার গায়ে ভিতরের ঐ ধরনের কোন খাঁজ আছে, যে জন্য ফায়ারের পর বুলেটের গায়ে খাঁজ কেটে গেছে।

    আর কিছু নেই তো?

    না। কিন্তু এটা পেলেন কোথায়, ব্যাপারটাই বা কি?

    একজন নিহত ভদ্রলোকের মাথার মধ্যে পাওয়া গিয়েছে বস্তুটি।

    সত্যি?

    হ্যাঁ, সেই ভদ্রলোককে সম্ভবত ঐ গুলিটির সাহায্যেই হত্যা করা হয়েছে।

    রিয়েলি! কিন্তু যে ধরনের রিভলভারের সাহায্যে ঐ গুলিটা ছোঁড়া হয়েছিল সেই রিভলভার তো কোন আর্মির লোকের কাছে ছাড়া থাকা সম্ভবপর নয়, বিশেষ করে এই যুদ্ধের সময়!

    সেই কারণেই তো আপনার ওপিনিয়নটা নিলাম মেজর। আচ্ছা আজ তাহলে উঠি–অবিশ্যি ব্যালেস্টিক একজামিনেশনের জন্যও পাঠানো হবে বুলেটটা।

    উঠবেন?

    হ্যাঁ।

    বাঃ, তা কি করে হয়? এক কাপ চা অন্তত–

    আজ নয় মেজর, অন্য একদিন। আজ একটু তাড়া আছে। সুব্রত বলল উঠতে উঠতে।

    কিন্তু এটা ভাল হচ্ছে না রায়সাহেব!

    কেন?

    কেন কি, রহস্যের দরজার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে রেখে আপনি বিদায় নিচ্ছেন।

    সুব্রত মৃদু হেসে বলে, শীঘ্রই আবার একদিন আসব। চলুন মিঃ সেন।

    সুব্রত মৃণাল সেনকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।

    চলন্ত গাড়িতে বসে মৃণাল সেন প্রশ্ন করে, মহেন্দ্রনাথের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে তার ব্রেন ম্যাটারের মধ্যে যে বুলেটটা পাওয়া গিয়েছিল ওটা সেই বুলেটটাই তো?

    সুব্রত সামনের দিকে চেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল, মৃদুকণ্ঠে বললে, হ্যাঁ।

    সুব্রতবাবু, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে—

    কি?

    মিঃ গাঙ্গুলী সন্দেহের তালিকায় একেবারে শীর্ষস্থানে!

    কেন?

    আপনি যাই বলুন প্রথমত সিঙ্গাপুরে ছিলেন—যুদ্ধের সময় কোনমতে পালিয়ে এসেছেন। তার পক্ষে অবশ্যই একটা ৩৮ আর্মি রিভালভার সংগ্রহ করা এমন অসম্ভব কিছু নয়। শুধু তাই নয়, মোটিভ যদি ধরেন তো চল্লিশ হাজার টাকা যেটা তিনি তার বন্ধুর কাছ থেকে ধার করেছিলেন—এক্ষেত্রে ধারই বলব কারণ ডিডে যখন শোধ করবার একটা কথা আছে

    তারপর? বলুন, থামলেন কেন?

    ঐ ডাঃ চৌধুরীর চিঠিটা। ওটাকে আমি একেবারে কিছু না বলে উড়িয়ে দিতে যেন কিছুতেই পারছি না। আমার কেন যেন ধারণা

    কি?

    ঐ চিঠির মধ্যে কোন একটা রহস্য আছে, যে রহস্যটা হয়ত ভদ্রলোক আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন বা চিঠিটার কোন সমাধানের ইঙ্গিত খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই বন্ধুকে কৌশলে একটা টাইপ করা চিঠি দিয়ে ডেকে এনে সে-রাত্রে হত্যা করেছেন।

    অসম্ভব কিছুই নয়, কিন্তু—

    কি?

    একটা কথা কিন্তু ভাববার আছে এর মধ্যে। মিঃ গাঙ্গুলী মানুষটা যে বোকা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না। সেক্ষেত্রে তিনি অমনভাবে একটা কাচা কাজ করবেন, ব্যাপারটা যেন ঠিক মেনে নিতে পারছি না।

    কাচা কাজ কেন বলছেন সুব্রতবাবু?

    নয়ত কি?

    একটু পরিষ্কার করে বলুন সুব্রতবাবু, মৃণাল সেন বলে।

    ধরুন তার হত্যা করবার ইচ্ছাই যদি থাকত বন্ধুকে কোন কারণে, ঐভাবে তাঁকে তিনি তার এলাকায় ডেকে আনতে যাবেন কেন একটা চিঠি দিয়ে? সেক্ষেত্রে তার উপরেই

    যে প্রথম সন্দেহ আসবে সেটা কি তিনি বোঝেননি? না না, ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছেন। ঠিক তত সহজ নয় হয়ত মিঃ সেন!

    মৃণাল সেন আর কোন কথা বলে না। চুপ করেই থাকে।

    এন্টালীতে একটা গলির মধ্যে বাড়িটা ডাঃ নলিনী চৌধুরীর। দোতলা বাড়ি। লাল রঙের। পাড়াটা অনেক দিনের পুরানো-বাড়িটাও পুরানো। ঐ বাড়িটাই ভাড়া নিয়ে একসময় ডাঃ নলিনী চৌধুরী তার ল্যাবোরেটারি গড়ে তুলেছিলেন দোতলায়।

    দোতলায় সর্বসমেত চারখানি ঘর। একটা ছোট ঘরে তিনি থাকতেন ও শুতেন–বাদবাকি তিনটে ঘরে তার ল্যাবোরেটারি। একটা ঘর থেকে অন্য ঘরে যাতায়াত করা যেত মধ্যবর্তী দরজাপথে।

    নলিনী চৌধুরী বিয়ে-থা করেন নি। সংসারে আপনারজন বলতে ছিল ঐ একটিমাত্র ভাগ্নে নীরেন সান্যাল। নীরেনের যখন অল্প বয়েস, বছর আট-দশ, সেই সময় থেকেই নীরেনকে বোনের কাছ থেকে চেয়ে এনেছিলেন ডাঃ চৌধুরী।

    নীরেনের মা-বাবাও আপত্তি করেননি—কারণ অনেকগুলি সন্তান, দৈন্যের সংসারে সকলকে মানুষ করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। আনন্দেই তাই নীরেনকে ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কোন একদিন।

    নীরেনকে কলকাতায় নিয়ে এসে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন ডাঃ চৌধুরী। তারপর সে ক্রমে পাশ করে এম. এস-সি।

    এম. এস-সি. পড়িয়েছিলেন ভাগ্নেকে ডাঃ চৌধুরী ইচ্ছা করেই। তাঁর কেমিস্ট্রিতে একজন সহকারীর প্রয়োজন ছিল।

    নীরেনও তার মামাকে হতাশ করেনি। পরে ডক্টরেট পেয়েছিল।

    ভাল ভাবেই পাশ করে মামার সঙ্গে তার ল্যাবোরেটারিতে রিসার্চের সাহায্য করতে লাগল। তারপর হঠাৎ একদিন ডাঃ চৌধুরীর হল ক্যানসার এবং তার মৃত্যুর পর

    ডাঃ সান্যাল ল্যাবোরেটারি চালাতে লাগলেন।

    ডঃ নীরেন সান্যালকে তার ল্যাবোরেটারির মধ্যেই পাওয়া গেল।

    বাড়িটা নিচের ঘরগুলোর একটা ড্রইংরুম ও অন্য দুটো স্টোররুম রূপে ব্যবহৃত হয়।

    বাকি ঘরটায় ভৃত্য গোপাল থাকে।

    ঐ গোপালই নীরেনকে দেখাশোনা করে। রান্না থেকে শুরু করে সব কাজই সে করে।

    গোপালকে বলতেই সে বললে, ডাক্তারবাবু ওপরে তার ল্যাবরেটারি ঘরে আছেন। চলে যান।

    সুব্রত গোপালের কথাটা শুনে যেন একটু অবাকই হয়।

    কারও ল্যাবোরেটারি ঘরে যে অমন সোজা চলে যাবার নির্দেশ মিলতে পারে তার যেন ঠিক ধারণা ছিল না। কিন্তু সে-সম্পর্কে সে কোন কথা বলে না। গোপালের নির্দেশমত মৃণালকে সঙ্গে নিয়ে সুব্রত সোজা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।

    সিঁড়ির মুখেই একটি ব্যস্ত যুবকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দোতলায়।

    হাতে তার একটি তরল পদার্থপূর্ণ টেস্টটিউব।

    যুবকটিকেই জিজ্ঞাসা করে সুব্রত, ডাঃ সান্যাল আছেন?

    হ্যাঁ আছেন—যান, ঐ পাশের ঘরে যান। হাত দিয়ে ইশারা করে ঘরটা দেখিয়ে দিল যুবক।

    ঘরের মধ্যে ঢুকে ওরা দাঁড়াল। ঘরভর্তি সব যন্ত্রপাতি। র‍্যাকে র‍্যাকে নানা আকারের শিশিতে নানা রঙের সব ওষুধ। বুনসেন বার্নারে একটা কাচের আধারে কি যেন ফুটছিল।

    তার সামনে একটা আরামকেদারায় গা ঢেলে আরাম করে সিগারেট টানছিল একটা যুবক।

    বাঙালীদের মধ্যে অমন স্বাস্থ্যবান চেহারা সচরাচর বড় একটা চোখে পড়ে না। লম্বায় খুব বেশি হবে না, কিন্তু নিটোল স্বাস্থ্য।

    টকটকে ফর্সা গায়ের রং। যেন ইউরোপীয়দের মত। মাথার চুল ব্যাকব্রাস করা। চোখে চশমা। চোখেমুখে একটা প্রখর বুদ্ধির দীপ্তি আছে। পরনে একটা পায়জামা ও তার উপরে একটা অ্যাপ্রন্।

    পদশব্দেই মুখ তুলে তাকিয়েছিল যুবক। এবং তাকিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল এবং পুলিসের ইউনিফর্ম পরিহিত মৃণাল সেনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি চাই?

    আমরা ডাঃ সান্যালের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। মৃণাল সেন বলে। আমিই ডাঃ সান্যাল।

    ওঃ নমস্কার। আমার নাম মৃণাল সেন। আমি একজন ইন্সপেক্টার, লালবাজার থেকে আসছি আমরা।

    লালবাজার থেকে! বলুন তো কি ব্যাপার?

    একটু দরকার ছিল আপনার সঙ্গে। ওঃ!

    তা বেশ চলুন পাশের ঘরে যাওয়া যাক। চলুন।

    পাশের ঘরটা একটা লাইব্রেরি। চারদিকের আলমারি ও র‍্যাকে বই ঠাসা। চেয়ার ও টেবিল সেখানে ছিল। মৃণাল সেন ও সুব্রতকে বসতে বলে নিজে একটা চেয়ার টেনে নেয় নীরেন।

    কি দরকার বলুন তো ইন্সপেক্টার?

    কথা বললে সুব্রতই, ডাঃ সান্যাল, আপনি নিশ্চয়ই সংবাদপত্রে পড়েছেন রায় অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টার একটা দুর্ঘটনায় গত শনিবার মারা গেছেন?

    আমি জানি।

    পেপারেই বুঝি সংবাদটা জানতে পারেন প্রথম?

    না। তবে? মহেন্দ্রবাবুর মেয়ে কুন্তলা আমাকে ফোন করে জানায়।

    কবে?

    সংবাদটা পাবার কিছু পরেই।

    কুন্তলা দেবীদের সঙ্গে আপনি অনেকদিন পরিচিত, তাই না ডাঃ সান্যাল?

    ওর দাদা সৌরীন্দ্র আমার ক্লাসফ্রেন্ড ও বিশেষ বন্ধু।

    আচ্ছা ডাঃ সান্যাল, আপনার মামা ডাঃ চৌধুরী মারা যাওয়ার আগে তার দুই বন্ধুর নামে, মানে মিঃ রায় ও মিঃ গাঙ্গুলীর নামে, ব্যাঙ্কে দুখানা চিঠি জমা দিয়ে যান—আপনি সে সম্পর্কে কিছু জানেন?

    কুন্তলার মুখে একবার শুনেছিলাম বটে চিঠির কথা!

    আর কিছু চিঠি সম্পর্কে জানেন না?

    না, জানবার প্রয়োজনও বোধ করিনি।

    মিঃ রায় ও মিঃ গাঙ্গুলীর সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই যথেষ্ট পরিচয় ছিল, জানাশোনাও ছিল। তাদের মুখে শোনেননি কিছু ঐ চিঠি সম্পর্কে কখনও?

    না।

    আচ্ছা ডাঃ চৌধুরী মারা যাওয়ার আগে কি নিয়ে রিসার্চ করছিলেন?

    স্নেকৎ ভেনাম নিয়ে।

    আচ্ছা আপনার আর এক মামা ছিলেন না বর্মায়?

    হ্যাঁ, বড়মামা জীবন চৌধুরী বরাবর বর্মাতে ছিলেন।

    শোনা যায় তিনি যুদ্ধ বাধার সঙ্গে সঙ্গেই প্রভৃত অর্থ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।

    সেই রকম একটা কানাঘুষা শুনেছিলাম বটে।

    কার কাছে?

    তা ঠিক মনে নেই।

    ব্যাপারটা আপনি বিশ্বাস করেননি বুঝি?

    না।

    কেন?

    বড়মামাকে দেখলে ও তার চালচলন দেখলেই বুঝতে পারতেন কেন—তাছাড়া যে লোকটা কোনদিন লেখাপড়া করেনি, অল্প বয়সে জাহাজের খালাসী হয়ে পালিয়ে যায়, তার পক্ষে বড়লোক হওয়া একমাত্র আলাদীনের প্রদীপ হাতে পাওয়ারই সামিল।

    কিন্তু আমি শুনেছি-আপনার বড়মামা প্রচুর অর্থ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন এবং সেই অর্থ তিনি তাঁর ছোট ভাইকে অর্থাৎ ডাঃ নলিনী চৌধুরীকেই দিয়ে যান মৃত্যুর পূর্বে।

    কার কাছে শুনলেন এ আরব্য উপন্যাসের গল্প?

    যার কাছেই শুনে থাকি না কেন, তিনি যে একটা নেহাত গল্প বানিয়ে বলেননি–তাই আমাদের ধারণা।

    নীরেন সান্যাল প্রত্যুত্তরে হাসল। কোন জবাব দিল না।

    সুব্রত আবার বলে, ডাঃ চৌধুরী যখন হাসপাতালে তখনই খবরটা পান তিনি। কথাটা আপনার না জানার কথা নয় হয়ত।

    না, আমি কিছু জানি না।

    আপনার ছোটমামা আপনাকে কিছু বলেননি?

    না।

    আচ্ছা আপনাদের আইন-পরামর্শদাতার নামটা জানতে পারি?

    কালীপদ চক্রবর্তী। জোড়াবাগানে থাকেন তিনি-হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন।

    আচ্ছা আপনার বড়মামার কোন আইন-পরামর্শদাতা ছিলেন?

    তা জানি না।

    আচ্ছা ডাঃ সান্যাল, আপনাকে বিরক্ত করলাম, কিছু মনে করবেন না—এবারে আমরা উঠব।

    না, না—মনে করব কেন? কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো-এসব কথা কেন জিজ্ঞাসা করছিলেন?

    কারণ পুলিসের ধারণা মহেন্দ্রনাথের মৃত্যুর ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়।

    বলেন কি!

    হ্যাঁ, ব্যাপারটা মার্ডার বলেই মনে হয় আমার। মৃণাল সেন বলে।

    ও নো-ইউ ডোক্ট একজ্যাক্টলি মিন ইট!

    সুব্রত সে কথার জবাব না দিয়ে বলে, আচ্ছা চলি-নমস্কার।

    সুব্রত অতঃপর মৃণাল সেনকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকিরীটী অমনিবাস ৭ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
    Next Article কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    Related Articles

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.