Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কুটু মিয়া – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প132 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৩. ঘরের বাতি নেভানো

    ঘরের বাতি নেভানো। শুধু একটা ঘরেরই না, সব ঘরের বাতি নেভানো। আলাউদ্দিনের ঘরে টিভি চলছে। টিভি স্ক্রিনের নীলচে আলোয় তাঁর ঘরটা আলোকিত। বারান্দায় বাতি জ্বলছিল, কিছুক্ষণ আগে কুটু মিয়া সেই বাতিও নিভিয়ে দিয়েছে।

    খাটের ওপর আলাউদ্দিন পা দুড়িয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। তার একটা পা। কোলবালিশে রাখা। দুটা কোলবালিশ কুটু মিয়া গত পরশু কিনে এনেছে। মাখনের মতো মোলায়েম কোলবালিশ। আলাউদ্দিন খুব আরাম পাচ্ছেন। নরম কোলবালিশে একটা পা উঠিয়ে দেয় যে এত আনন্দময় তা তিনি আগে বুঝতে পারেন নি। বুঝতে পারলে অনেক আগেই কোলবালিশ কিনতেন।

    আলাউদ্দিনের হাতে টিভির রিমোট কনট্রোল। ক্যাবল লাইনে সতেরোটা চ্যানেল দেখা যায়। তিনি সতেরোটাই দেখেন। আগে প্রতিটি চ্যানেল বদলাবার আগে চার পাঁচ মিনিট দেখতেন। এখন কোনোটাই এক দেড় মিনিটের বেশি দেখেন না। কিছু বোঝার আগেই পর্দার দৃশ্য বদলে যায়। এই ব্যাপারটা তার খুবই ভালো লাগে। এই গান, এই খেলা, এই নাচ, এই খবর…

    তার লেখার টেবিলটা এখন খাটের সঙ্গে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি প্রয়োজনীয় জিনিস টেৰিলে আছে। একবার টিভি দেখা শুরু করলে বিছানা থেকে নামার প্রয়োজন পড়ছে না। সিগারেটের প্যাকেট আছে, এঐে আছে, ম্যাচ আছে। তাঁর সর্দির ধাচ। একটু পর পর নাক ঝাড়তে হয়। সে জন্যে এক বাবা টিস্যু পেপার আছে। মাঝে মাঝে কান চুলকাতে তার খুবই আরাম লাগে। কান চুলকার এক বাক্স কটন বাড আছে। পানির বোতল আছে। গ্লাস আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই আয়োজনের জন্য কুটুকে কিছু বলতে হয় নি। সব মে নিজ থেকে করেছে। তাঁর আরামের দিকে কুটুর নজর দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। আগে তোষকের বিছানায় ঘুমাতেন, এখন ঘুমাচ্ছেন ফোমের বিছানায়।

    অতিরিক্ত আরাম আয়াসের কারণ একটা ক্ষতি হচ্ছে লেখালেখি হচ্ছে না। হস্তরেখা বিজ্ঞান-এর শিররেখার চ্যাপ্টারটা এখনো শেষ হয় নি। বই শেষ করাটা খুবই জরুরি। রয়েলটির টাকাটা পাওয়া যাবে। একশ টাকা দামের বই যদি হয় সাড়ে বার পার্সেন্ট রয়েলটি হিসেব করলে খারাপ হয় না। তবে টাকা পয়সার সমস্যা নিয়ে আলাউদ্দিন এখন দুশ্চিন্তা করছেন না। হঠাৎ করে কিছু টাকা তার হাতে চলে এসেছে। এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকায় বসত বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। দেশের বাড়ি যাওয়া হয় না। মানুষ হয়েছে শহরবাসী। খামাখা বাড়ি পড়ে থাকবে। গরু-ছাগল চড়বে। দরকার কী!

    একলা পঁচিশ হাজার টাকা আলাউদ্দিন ব্যাংকে জমা দেন নি। ঘরেই আছে। সুটকেসে তালাবন্ধ আছে। সুটকেসের চাবি আছে টেবিলের ড্রয়ারে। এটা নিয়ে। তিনি কোনো দুশ্চিন্তা বোধ করেন না। কারণ কুটু মিয়া টাকা পয়সার ব্যাপার অসম্ভব সৎ। তাছাড়া সারা দিন তো তিনি ঘরেই থাকেন। বেশির ভাগ সময় আধসোয়া হয়ে খাটের ওপরই থাকেন। এক ধরনের বিশ্রাম। এই বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। বিশ্রামের সময় টিভি দেখতে দেখতে নানান কথা চিন্তা করতে তার ভালো লাগে।

    বেশির ভাগ সময় যে কল্পনাটা করেন তা হচ্ছে–হামিদা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। দুজনে বড় একটা খাটে আধাশোয়া হয়ে আছেন। দুজনের হাতেই টিভির রিমোট কন্ট্রোল। টিভি দেখতে দেখতে দুজনে গল্প করছেন। চ্যানেল বদলাচ্ছেন। কখনো তিনি বদলাচ্ছেন, কখনো বদলাচ্ছে হামিদ।

    আলাউদ্দিন কিছুক্ষণের জন্যে টিভি বন্ধ করলেন। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কুটু মিয়া বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে দিল। টিভি বন্ধ হলে কোথাও না। কোথাও বাতি জ্বলে উঠবে। আলোর অভাব হবে না। আলাউদ্দিন মনে মনে বললেন, ভেরি হও। যতই দিন যাচ্ছে কট মিয়াকে তার ততই পছন্দ হচ্ছে। আলাউদ্দিন হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে পিরিচ দিয়ে ঢাকা গ্লাসটা নিলেন। গ্লাসে টমেটোর রস। গত কয়েক দিন হলো রাতের খাবারের আগে কুটু মিয়া দু গ্লাস টমেটোর রস বানিয়ে দিচ্ছে। টক টক, ঝাল ঝাল। অতি সুস্বাদু পানীয়। এর সঙ্গে সে ভদকা না না মিশাচ্ছে কি-না তিনি জানেন না। জানতে চাচ্ছেন না। যদি দুএক চামচ মিশিয়েও দেয় তাহলে দিল। তিনি তো আর বলেন নি কটু আমাকে ভদকা দিয়ে টমেটো সস দাও। তোমাদের পাইলট স্যার যে রকম খেলেন সে রকম। ব্লাড়িমরি না কী যেন নাম। কুটু যা করছে নিজ দায়িত্ব করছে। তাকেও ঠিক দোষ দেয়া যায় না। এইসব জিনিসই সে বানিয়ে অভ্যস্ত। আসল কথা হলো ক্রিনিসটা খেতে ভালো। দুটা গ্লাস খাওয়ার পর শরীরে চনমনে ভাব আসে। আবার একই সঙ্গে আলসেমিও লাগে।

    আলাউদ্দিন হাতের গ্লাস শেষ করে টেবিলে রাখলেন। শব্দ করে যে রাখলেন তা না। স্বাভাবিকভাবেই রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা গ্লাস ভর্তি টমেটো জুস নিয়ে কুটু ঢুকল। খালি গ্লাসটা নিয়ে চলে গেল। আস্থা কুটু কি আড়াল থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে? তাকিয়ে না থাকলে তো বোঝা সম্ভব না– গ্লাস কখন খালি। হলো? কুটুর তো এটা করা ঠিক না। সে আড়াল থেকে তাকিয়ে থাকবে কেন? আলাউদ্দিন তাকে এই ব্যাপারটা কঠিন গলায় বুঝিয়ে দেবার জন্যে ডাকলেন। কুটু। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল। কুটুর গা থেকে মশলার গন্ধ আসদু। কিছু একটা ব্রাধছিল। নিশ্চয়ই। মশলার গন্ধেই তার ক্ষিধে লেগে গেল। কুটুকে কী জন্যে ডেকেছেন ভুলে গিয়ে বললেন, আজকের রান্না কী কুটু।

    কৈ মাছের ঝোল।

    আলাউদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, শুধু কৈ মাছের ঝোল?

    সাথে একটা মুরগি রাঁধছি।

    মুরগির ঝোল?

    জ্বি না, একধরনের ফ্রাই। পাইলট স্যারের খুব পছন্দের রান্না ছিল। সপ্তাহে তিন চার দিন খাইতেন। দুইটা মুরগি তিনি একা খাইতেন।

    বলো কী?

    ঠিক মতো রান্না হইলে দুইটা মুরগি খাওয়া কোনো ব্যাপার না স্যার। আপনিও পারবেন।

    আমি কীভাবে পারব? আমি কি বক রাক্ষস নাকি? মুরগি কটা বেঁধেছ?

    দুইটা।

    সর্বনাশ! তুমি তো আমাকে ফতুর বানিয়ে ছাড়বে। দিনে দুটা মুরগি মানে মাসে ষাটটা মুরগি। বৎসরে সাতশ বিশটা মুরগি। যাই হোক, জিনিসটার প্রিপারেশন কী?

    কুটু মাথা নিচু করে বলল, এইটা বলা নিষেধ।

    নিষেধ মানে? কার নিষেধ?

    কুটু চুপ করে রইল। আলাউদ্দিন উদার গলায় বললেন, থাক বলতে হবে না। জেনেই আমি কী করব? আমি তো আর রাধতে বসব না। শোন কুটু, আমি শ্রোমার কাজকর্মে সন্তুষ্ট।

    শুকরিয়া।

    শুধু সন্তুষ্ট না। খুবই সন্তুষ্ট। বাঙালির সমস্যা হলো তার প্রশংসা সহ্য করতে পারে না। একটু প্রশংসা করলেই তার লাফ দিয়ে মাথায় উঠে যায়। এই জন্যে প্রশংসা করা বাদ দিয়েছি।

    কুটু কিছু বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আলাউদ্দিন হড়বড় করে কথা বলেই যাচ্ছেন। কথা বলতে তার খুবই ভালো লাগছে। ব্লাডিমেরি নামের জিনিসটার গুণ বা দোষ হলো এটা খেলেই কথা বলতে ইচ্ছে করে। পেটের ভেতর যত কথা আছে সব বুলবুলের মতো পেট থেকে বের হতে শুরু করে।

    কুটু!

    জ্বি স্যার।

    আমি তোমার কাজে কর্মে সন্তুষ্ট।

    একবার বলেছেন সার।

    একবার বলেছি তো কী হয়েছে? আরেকবার বলব। দরকার হলে আরো দশবার বলব। আমি তোমার কাজে কর্মে সন্তুষ্ট। আমি তোমার কাজে কর্মে সন্তুষ্ট। আমি তোমার কাজে কর্মে সন্তুষ্ট…

    আলাউদ্দিন আঙুল গুণে গুণে দশবার বললেন। তার হাতের ব্লাডিমেরির গ্লাস শেষ হয়েছে। তিনি গ্লাস নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন তোমার বানানো এই টমেটোর রস আমার পছন্দ হয়েছে। টমেটোর রসে তুমি কী দিয়েছ না দিয়েছে জানতে চাচ্ছি না। হয়তো ভদকা দিয়েছ ৷ দিয়ে থাকলে খুবই অন্যায় করেছ। আমি তোমাকে বলেছিলাম মদ ফাদ আমি খাই না। আমি শিক্ষক মানুষ। ভদ্রঘরে সন্তান। আমার পিতা ছিলেন বিশিষ্ট আলেম। মৃত্যুর দিনও তার নামাজ কাজা হয়। নাই। বুঝতে পারছ?

    জি স্যরি।

    তবে টমেটোর রস অতি সুখাদ্য। দুগ্লাস খাওয়ার পর মনে হয় আরো দুগ্লাস খাই। তোমার পাইলট সার কয় গ্লাস খেত?

    উনার জন্যে জগ ভর্তি বানায়ে রাখতাম। কোনো কোনো দিন পুরা জগ শেষ করতেন। কোনো কোনো দিন জগ থেইকা ঢাইলা সামান্য খাইতেন।

    আমার জন্যেও তাই করবে। যতটুক খাই খাব। ইচ্ছা হলে খাব। ইচ্ছা হলে খব না।

    জি আচ্ছা।

    খানা কি তৈরি হয়েছে?

    জি।

    তাহলে খানা দাও।

    যদি চান আরেক গ্লাস ব্লাডিমোরি বানায়ে দেই। রাত দশটা এখনো বাজে নাই। এখনই খানা খাইয়া ফেলবেন?

    সেটাও একটা কথা। এখনই খানা খেয়ে ফেলা ঠিক না। পারে আবার ক্ষিধা লাগতে পারে। দাও তোমার ঐ জিনিস আরেক গ্রাম।

    আপনার একটা চিঠি ছিল স্যার। চিঠিটা দিব? চিঠি কখন এসেছে?

    সন্ধ্যাবেলায় আসছে। আপনি আরাম কইরা টিভি দেখতেছিলেন এই জন্যে তখন দেই নাই। এখন টিভি দেখছেন না এই জন্যে চিঠির কথা তুললাম।

    ভালো বিবেচনা দেখিয়েছ। এই যে বললাম তোমার বিবেচনায় আমি সন্তুষ্ট। চিঠি নিয়ে আস। চিঠি আর জুস একসঙ্গে দাও। জুস খেতে খেতে চিঠি পড়ব। তার মজা অন্যরকম। চিঠি আবার আমাকে কে লিখবে! আমাকে চিঠি লেখার লোক নাই। এটা একদিক দিয়ে ভালো। ঝামেলা নাই। ঠিক না?

    জ্বি ঠিক।

    দাঁড়িয়ে আছ কেন? চিঠি আর জুস নিয়ে আস।

     

    চিঠি লিখেছেন হাজী একরামুল্লাহ। তিনি লিখেছেন–

    আলাউদ্দিন

    দোয়াবরেষু,

    বুধবারে তোমার হস্তরেখার পুস্তকটির পাণ্ডুলিপি আমাকে পৌছাইয়া দেওয়ার কথা। বুধবার চলিয়া গিয়াছে, আজ শনিবার। তোমার কোনোই সংবাদ নাই। এমন ঘটনা পূর্বে কখনো ঘটে নাই। আশা করি তোমার কোনো অসুখ বিসুখ হয় নাই। অসুখ হউক বা যাই হউক একটি সংবাদ তুমি দিতে পারিতে। নিজে আসিতে না পারিলে ও টেলিফোনের মাধ্যমে সংবাদটি দেওয়া যাইত। আমার বাসা এবং দোকানের টেলিফোন নাম্বার তোমার কাছে আছে। সম্প্রতি আমার মোবাইল নাম্বার ও তোমাকে দিয়াছি। তোমার নীরবতার আমি। কোনোই অর্থ বুঝিতে পারিতেছি না।

    আমার মনে একটি ক্ষীণ সন্দেহ দেখা দিয়াছে। সন্দেহের ব্যাপারটি খোলাখুলি তোমাকে বলি। কোনোরকম অস্পষ্টতা থাক আমি কাঞ্ছনীয় মনে করি না। আমার সন্দেহ হামিলা বানুকে বিবাহের ব্যাপারে তোমার মত নাই। যেহেতু প্রস্তাব আমি দিয়াছি; চক্ষুলজ্জায় বিবাহ মত নাই— এই কথা বলিতে পারিতেছ না। এই সমস্যায় পড়িয়া তুমি আমার নিকট আসা বন্ধ করিয়াছ।

    দীর্ঘদিন একা থাকিয়া থাকিয়া তোমার অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। এই বয়সে বিবাহিত জীবনের কল্পনা মনে ভীতির সঞ্চার করে। ইহাই স্বাভাবিক। তুমি ইহা নিয়া কেন সংকোচ বোধ করিতেছ? মনের দিক হইতে সাড়া না পাইলে অবশ্যই তুমি বিবাহ করিবে না।

    পত্র পাঠ করিবা মাত্র বাংলাবাজারে চলিয়া আসি। হস্তরেখা বিজ্ঞানের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হইলে সঙ্গে নিয় আসি। পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ না হইলে ও যাহা হইয়াছে নিয়া আসিবা। আমি কম্পােজ ধল্লাইয়া দিব। খোজ নিয়া জানিয়াছি ইদানীং ক্রিকেট খেলার উপর লেখা বই ভালো চলিতেছে। ক্রিকেটের উপর একটি দশ ফর্মার বই অতি দ্রুত তোমাকে দিয়া লেখাইতে চাই। ক্রিকেট বিষয়ে লেখার জন্য প্রয়োজনীয় বইপত্র সংগ্রহ করার জন্যে তোমার বাংলাবাজার আসা প্রয়োত্তান।

    আজ এই পর্যন্তই।

    দোয়া গো, হাজী একরামুল্লাহ

    পুনশ্চ : রয়েলটি বাবদ প্রাপ্ত এগারো হাজার পঁচিশ টাকা দোকানের ক্যাশিয়ার মালেক মিয়ার কাছে দেওয়া আছে।

    টাকাটা সংগ্রহ করিও। চিঠি পড়ে আলাউদ্দিন স্বস্তি পেলেন। এমনিতেই তার মন আনন্দে ছিল। সেই আনন্দ অনেক বাড়ল। নিজেকে মহাসুখী মানুষদের একজন মনে হতে লাগল। টমেটো জুসটা খেতে এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি ভালো লাগছে। এই গ্রাস শেষ করার পরও তা হবে বলে মনে হচ্ছে না। পাইলট সাহেবের মতো ব্যবস্থা করতে হবে। জগ ভর্তি জুস থাকবে। নিজের ইচ্ছামতো যাবেন। কিছুক্ষণ পরপর কুটু মিয়াকে ডাকতে হবে না। কুটু মিয়ার জন্যেও ভালো। একবারে বানিয়ে রেখে দেয়া। বারবার বানাতে হবে না।

    আলাউদ্দিন রিমোট কন্ট্রোলে টিভি ছাড়তে যাবেন— কুটু মিয়া ঘরে ঢুকল, বিড়বিড় করে বলল, স্যার আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে আসছে।

    এত রাতে কে ভাসলো?

    পাশের ফ্লাটের সাইফুল্লাহ সাহেব।

    নিয়ে এসো। এখানে নিয়ে এসো।

    এইখানে আনার দরকার নাই।

    ঠিক বলে। এখানে মানার দরকার নাই। খাচ্ছি টমেটো জুস, হয়তো ভাববে অন্যকিছু খাচ্ছি। শুধু যে মনে করলে তা না মারো দশজনকে গিয়ে বলবে। বাঙালির স্বভাবই এই রকম। স্বভাবের কারণে বাঙালি কিছু করতে পারল না। কাজ করার সময়ই বাঙালির নাই। সারাক্ষণ এর কথা তার কাছে লাগাচ্ছে, কাজ করার সময় কোথায়? ঠিক বলছি না?

    জ্বি স্যার ঠিক বলছেন। উনি বসার ঘরে বইসা আছেন।

    কে বসার ঘরে বসে আছে?

    সাইফুল্লাহ সাহেব।

    সাইফুল্লাহ সাহেব বসার ঘরে বসে আছেন কেন?

    আপনাকে একটু আগে বলছি।

    একটু আগে কী বলেছ আমি ভুলে গেছি।

    সাইফুল্লাহ সাহেব আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। কী কথা জানি বলবেন।

    আলাউদ্দিন নিতান্ত অনিচ্ছায় বিছানা থেকে নামলেন। একবার বিছানায় উঠে পড়লে আর নামতে ইচ্ছে করে না। সাইফুল্লাহ না এলেও বিছানা থেকে নামতে হতো। প্রস্রাবের বেগ হয়েছে। কষ্ট করে চেপে রেখেছেন। এখন মনে হয় তলপেট ফেটে যাচ্ছে। বিছানাতেই বাথরুম করা যাচ্ছে এমন ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো।

     

    সাইফুল্লাহ আলাউদ্দিনকে দেখে অবাক হয়ে বলল, ভাই আপনার শরীর খারাপ?

    আলাউদ্দিন বললেন, না তো।

    দেখে মনে হচ্ছে শরীরে পানি এসেছে। হাত-পা ফুলে গেছে।

    আলাউদ্দিন কিছু বললেন না। সাইফুল্লাহ তাড়াতাড়ি বিদেয় হলে তিনি বাঁচেন। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে পারেন। টমেটো জুসের গ্লাসটায় এখনো অর্ধেকের মতো আছে। গ্লাসটা শেষ করা দরকার।

    সাইফুল্লাহ গলা নামিয়ে বলল, আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছিলাম।

    বলুন।

    কথা আসলে একটা না, দুটা। কোনটা আগে বলব বুঝতে পারছি না।

    যে কথাটা শুনতে ভালো লাগবে সেটা আগে বলুন।

    দুটা কথাই শুনতে খারাপ লাগবে।

    আলাউদ্দিন বসলেন। কাঠের চেয়ারে বসে তিনি আরাম পাচ্ছেন না। বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় থেকে থেকে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। শুয়ে না পড়া পর্যন্ত ভালো লাগে না। সাইফুল্লাহ কথাগুলি তাড়াতাড়ি শেষ করলে তিনি নিজের জায়গায় চলে যেতে পারেন। কোলবালিশে পা রেখে শুয়ে পড়তে পারেন।

    প্রফেসর সাহেব, কাটা হচ্ছে আমি আপনার ফ্রিজে দুই বোতল ভদকা রেখেছিলাম। আমার বন্ধুর জিনিস। সে রাখতে দিয়েছিল। গত সপ্তাহে বোতল দুটা ফেরত নিয়েছি কিন্তু ভিতরে জিনিস নাই— পানি।

    আপনার কথা বুঝলাম না।

    দুটা বোতলের ভদকা সরিয়ে নিয়ে পানি ভরে রেখেছে।

    কে সরিয়ে রেখেছে?

    কে সরাবে আপনার কাজের ছেলে কুটু না ঘুটু কী যেন নাম।

    সে ভদকা কী করেছে?

    খেয়ে ফেলেছে। কিংবা বিক্রি করে দিয়েছে।

    বলেন কী?

    আমি তাকে ইনটারোগেট করেছি। কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না। এমনভাবে তাকায় যেন আমার কোনো প্রশ্নই বুঝতে পারছে না। এই চিড়িয়া জোগাড় করেছেন কোত্থেকে?

    আলাউদ্দিন জবাব দিলেন না। সাইফুল্লাহ বলল, যত তাড়াতাড়ি পাবেন একে বিদায় করেন। যে ভদকার বোতলের ভদকা সরিয়ে পানি ভরে রাখতে পারে সে ছোটখাট চোর না। বড় চোর।

    চিন্তার বিষয়।

    অবশ্যই চিন্তার বিষয়। আপনি একা থাকেন, কখন আপনাকে কী করবে আপনি বুঝতে পারবেন না। দুপুরে ঘুমিয়ে আছেন, পেটে ছুরি মেরে টাকা পয়সা নিয়ে চলে গেল।

    আলাউদ্দিন হাই তুলতে তুলতে বললেন, দ্বিতীয় খারাপ কথাটা কী?

    সাইফুল্লাহ গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, আপনাকে তো ফ্ল্যাট সাবলেট দিয়েছিলাম। পুরো ফ্ল্যাটটাই এখন আমার দরকার। বাবা অসুস্থ। ঢাকায় থেকে চিকিৎসা করাবেন।

    ফ্ল্যাট করে ছাড়তে হবে?

    যত তাড়াতাড়ি পারেন এত ভালো। বাবাকে আমার ইমিডিয়েটলি ঢাকায় আনা দরকার।

    উনার কী হয়েছে?

    ওল্ড এজ ডিজিজ। স্পেসিফিক কিছু না। সর্দি, কাশি, বুকে ব্যথা।

    আলাউদ্দিন হাই তুলতে তুলতে বললেন, আচ্ছা। এখন তার ঘনঘন হাই উঠছে। মনে হচ্ছে চেয়ারে বসা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়বেন।

    কবে নাগাদ ছাড়তে পারবেন?

    দেখি, যত তাড়াতাড়ি পারি।

    এক সপ্তাহের মধ্যে পারলে আমার খুব উপকার হয়।

    আলাউদ্দিন মুম ঘুম চোখে বললেন, আচ্ছা। কিছু ভেবে যে বললেন তা না। তিনি চাচ্ছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাইফুল্লাহকে বিদায় করতে।

    সাইফুল্লাহ বলল, ঢাকা শহরে ভাড়া বাড়ির এখন আর ক্রাইসিস নাই। এত ফ্লাট হয়েছে। মানুষের চেয়ে ফ্ল্যাট বেশি। যেখানে যাবেন টু লেট। প্রফেসর সাহেব একটু চেষ্টা নেন, যেন সাতদিনের মধ্যে বাড়িটা খালি করতে পারেন। খুব উপকার হয়।

    আলাউদ্দিন আবারো হাই তুলতে তুলতে বললেন, আচ্ছা।

     

    দুটি মুরগির বিশেষ ভাজার পুরোটাই আলাউদ্দিন খেয়ে ফেললেন। শেষ টুকরাটা মুখে দিয়ে বললেন, খেতে খারাপ না। এরচে ভালো ভালো কথা বলা উচিত ছিল, কিন্তু আলাউদ্দিনের মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। শরীর দুলছে। এখন ভালো ভালো কথা বলার সময় না। তাছাড়া বাঙালিকে বেশি প্রশংসা করতে নেই। প্রশংসা করলেই বাঙালি এক লাফে আকাশে উঠে যায়। আকাশে উঠে গেলেও ক্ষতি ছিল না— আকাশ থেকে থুথু ফেলা শুরু করে। সেই থুথু এসে গায়ে পড়ে। এই জন্যেই বাঙালিকে মাঝে মাঝে কঠিন কঠিন কথা বলে সাইজ করতে হয়। আলাউদ্দিন ঠিক করলেন কুটু মিয়ার মুরগির ভাজা যত ভালোই হোক তাকে আজ সাইজ করতে হবে। ঘুমুতে যাবার আগে তাকে ডেকে পাঠাবেন এবং ইচ্ছামতো সাইজ করে দেবেন। সাইজ করার মতো কর্মকাণ্ড সে করছে। তিনি দেখেও নাদেখার ভান করছেন।

    এই যেমন আরেক ভদ্রলোকের বোতলের জিনিস উধাও। বোতল আছে, জিনিস নাই। পানি ভরে দিয়ে দিয়েছে। অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে। এর শাস্তি দিতেই হবে।

    তারপর আছে অন্ধকারে তার রান্না করার বিষয়টা। তিনি অনেক দিন থেকেই লক্ষ করছেন রাতেরবেলায় রান্নার সময় ঘরের সব আলো নেভানো থাকে। চুলার আগুনের শিখায় কিছুটা ভালো হয়। কটু হয়তো সেই আলোতেই দেখতে পায়। অনেকের দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে। কুটু হয়তো সেই অনেকের মধ্যে একজন। তবুও অন্ধকারে রান্না করা ঠিক না। পাতিলের ভেতর কোনো পোকামাকড় উড়ে পড়বে। কুটু সেটা দেখতে পাবে না। চিকেন ফ্রাই-এর পাশাপাশি মিডিয়াম সাইজ একটা মাকড়সাও ফ্রাই হয়ে পড়ে থাকল। তিনি পিয়াহ মনে করে খেয়ে ফেলবেন। কে জানে হয়তো এর মধ্যে খেয়েছেনও। এটা তো হতে দেয়া যায় না। কুটুকে এই বিষয়ে ধরতে হবে। কঠিন ধরা ধরতে হবে। আজ কুটুর ক্ষমা নেই। আজ কুটুকে সাইজ করা হবে। আজ হলো মহান সাইজ দিবস।

    আলাউদ্দিন বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। তার মুখে জর্দা দেয়া মিষ্টি পান। জর্দার পরিমাণ বেশি হয়েছে। একেকবার পানের রস গিলছেন আর মাথা কেমন চুকুর দিয়ে উঠছে। এই চক্করটা ভালো লাগছে। খুবই আরামের চক্কর। আলাউদ্দিনের আঙুলের ফাকে সিগারেট। কুটু লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিল। আলাউদ্দিন সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, কুটু তোমাকে আজ কিছু কথা বলব।

    কুটু বলল, জি আচ্ছা।

    আলাউদ্দিন বললেন, কথাগুলি কঠিন। শুনে তুমি হয়তো মনে কষ্ট পাবে। কষ্ট পেলেও আমার কিছু করার নেই।

    কুটু বলল, জি আচ্ছা।

    আলাউদ্দিন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে কথা বলার জন্যে প্রস্তুত হলেন। কী বলবেন মনে পড়ছে না। মাথা একেবারেই ফাকা হয়ে আছে। যে সব কথা বলবেন বলে ঠিক করেছিলেন সে সব কথা পয়েন্ট আকারে একটা কাগজে লিখে রাখা দরকার ছিল। বিরাট ভুল হয়েছে।

    কুটু!

    জ্বি স্যার।

    তোমার অনেক জিনিস আছে যা আমার অপছন্দ। এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলব। তুমি যদি নিজেকে বদলাতে পার তাহলে তুমি থাকবে, বদলাতে না পারলে চলে যাবে। ভাত ফেললে কাকের অভাব হয় না। বেতন ফেললে বাবুর্চি পাওয়া যায়। বুঝতে পারছ?

    জি।

    আলাউদ্দিন অনেক চেষ্টা করলেন, কুটুকে সাইজ করার মতো কোনো কথাই মনে পড়ল না। তিনি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন— কুটু ঠিক আছে তুমি যাও। কথাবার্তা আজকের মতো মুলতবি। ঘুমের আগে আগে কঠিন কথাবার্তা না হওয়া ভালো। এতে সুনিদ্রার ব্যাঘাত হয়। একটা কাজ কর— আমাকে জর্দা দিয়ে আরেকটা পান দাও। জর্দা বেশি করে দিবে।

    জি আচ্ছা।

    আর টিভিটা চালু করে দাও। সাউন্ড দিও না। শুধু ছবি। টিভি দেখতে দেখতে ঘুমাব।

    জ্বি আচ্ছা।

    তুমি মনে করো না যে তুমি ছাড়া পেয়ে গেলে। মামলা ডিসমিস হয়ে গেল। আসলে সাময়িক বিরতি। আদালত আবার বসবে। আমি নিজেই বাদি, আমিই বিচারক। তোমার খবর আছে কুটু মিয়া।

    জর্দা ভর্তি পান মুখে নিয়ে আলাউদ্দিন ঘুমিয়ে পড়লেন। টিভি চলতে থাকল।

     

    এক সময় আলাউদ্দিনের ঘুম ভাঙল। কোনো কারণ ছাড়াই তার বুক ধ্বক করে। উঠল। এই ঘরে কিছু একটা হয়েছে। ঘরটা বদলে গেছে। কোনো কিছুই মনে হচ্ছে আগের মতো নেই। ঘর ভর্তি ধোয়া। এত ধোয়া কোত্থেকে এলো। কোথাও কি আগুন লেগেছে! খড় পোড়ার গন্ধ ও নাকে আসছে। নাক জ্বালা করছে। খাটের নিচ থেকে গোঙানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। হাঁটাহাঁটি হচ্ছে। মাঝে মাঝে ক্ষীণ গলায় কেউ একজন বলছে— বাঁচান, আমারে বাঁচান। সে কথা শেষ করতে পারছে না। তার আগেই কেউ একন তার মুখ চেপে ধরছে। আবারো হুটোপুটি হচ্ছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ।

    আলাউদ্দিন টিভির দিকে তাকালেন। টিভি খোলা আছে। নাটকের মতো কী যেন হচ্ছে। মারামারির দৃশ্য। ঘটনা কি এ রকম যে টিভিতে মারামারি হচ্ছে, কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে শব্দটা আসছে খাটের নিচ থেকে। এটাই তো যুক্তিসঙ্গত কথা। কিন্তু ঘরে এত ধোয়া কেন? আলাউদ্দিন ক্ষীণ স্বরে ডাকলেন, কুটু মিয়া!

    খাটের নিচ থেকে কেউ একজন ভারী শ্লেষ্মা জড়িত গলায় বলল, জি স্যার।

    গলাটা কার? কুটু মিয়ার গলা? সে খাটের নিচে কী করছে? কাকে সে চেপে ধরেছে। আলাউদ্দিন আবারো কাপা কাঁপা গলায় বললেন— কুটু মিয়া?

    জ্বি।

    খাটের নিচে কী করছ?

    কুটু জবাব দিল না। খাটের নিচের হুটোপুটি অনেক বাড়ল। এখন গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। আলাউদ্দিন বললেন, কী হচ্ছে ওখানে?

    কুটু চাপা গলায় বলল, বালিশ দেন। স্যার, তাড়াতাড়ি একটা বালিশ দেন।

    কী দিব?

    বালিশ।

    বালিশ দিয়ে কী হবে? হারামজাদার মুখের উপর বালিশ চাইপা ধরব।

    কার মুখের উপর বালিশ চেপে ধরবে?

    কটু জবাব দিল না। আলাউদ্দিন হতভম্ব হয়ে দেখলেন খাটের নিচ থেকে একটা হাত বের হয়ে আসছে। ময়লা নোংৱা হাত। বড় বড় নখ। পাখির নখের মতো বেঁকে গেছে। হাতটা কেন আসছে? তাকে ধরার জন্যে? আলাউদ্দিন ভয়ে শিটিয়ে গেলেন।

    বালিশ দেন।

    আলাউদ্দিন একটা বালিশ কুটুর হাতের দিকে এগিয়ে দিলেন। খাটের নিচ থেকে আঁ আঁ শব্দ হচ্ছে। বালিশে চাপা দিয়ে কাউকে কি মারা হচ্ছে? কোনো একটা সূরা পড়া উচিত। কোনো সূরা মনে আসছে না। তিনি কি দুঃস্বপ্ন দেখছেন? হ্যাঁ এটাই হবে। দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছু না। স্বপ্নটা ভেঙে গেলেই দেখবেন সব স্বাভাবিক আছে। তখন তিনি কুটুকে ডেকে চা দিতে বলবেন। চা খাওয়ার আগে গোসল করা দরকার। শরীর ঘামে ভিজে গেছে। স্বপ্নটা কখন ভাবে? চিৎকার করে কুটকে ডাকলে কি ঘুম ভাঙলে? আলাউদ্দিন ফুসফুস ফাটিয়ে চিক্কার করলেন— কুটু! কুটু! গলা দিয়ে ফ্যাস ফ্যাস জাতীয় আওয়াজ হলো। এই স্বপ্ন মনে হয় ভাবে না। স্বপ্ন চলতেই থাকবে। মেয়েলি গলায় কে যেন কাঁদছে। দেয়ালে শব্দ হচ্ছে। সাইফুল্লাহলের বাড়িতে কি? না-কি এটা স্বপ্ন। আলাউদ্দিন ক্লান্ত হতভম্ব গলায় ডাকলেন, কুটু।

    তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বসার ঘরের বাতি জ্বলে উঠল। থপথপ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কুটু আসছে।

    কুটু! কুটু তুমি কোথায়?

    দরজা ঠেলে কুটু ঢুকল।

    আলাউদ্দিন ধরা গলায় বললেন, বাতি জ্বালাও।

    কুটু বাতি জ্বালাল। আলাউদ্দিন বললেন, দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

    কুটু বলল, চা খাইবেন স্যার?

    আলাউদ্দিন বলেন, চা খাব।

    চা আনতেছি।

    আলাউদ্দিন বললেন, তুমি কি কোনো চিৎকার, হুটোপুটির শব্দ শুনেছ?

    কুটু বলল, জ্বি না।

    আলাউদ্দিন বললেন, শোনার কথাও না। স্বপ্ন দেখছি আমি। তুমি কেন শব্দ শুনবে! কুৎসিত স্বপ্ন। ধোয়া, চিৎকার, বালিশ দিয়ে মুখ চাপাচাপি।

    চা নিয়া আসি স্যার।

    যাও নিয়ে আস। চা আনার আগে একটা কাজ কর— আমার বালিশটা নিচে পড়ে গেছে। ধাক্কা খেয়ে খাটের নিচে চলে গেছে। বালিশটা দাও।

    কুটু খাটের সামনে উপুড় হয়ে বসে বালিশটা এনে আলাউদ্দিনের হাতে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো। আলাউদ্দিন বালিশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বালিশের এক পিঠে ছোপছোপ রক্ত লেগে আছে। টাটকা রক্ত, এখনো শুকিয়ে কালচে হয় নি।

    আয়াতুল কুরশি সূন্নাটা মনে পড়েছে। আলাউদ্দিন বিড়বিড় করে আয়াতুল কুরশি পড়ছেন…

    আল্লাহু লাইলাহা ইল্লাহুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম। লতা খুজুহু সিনাতাও ওয়ালা নাওম! লাহু মা ফিছছামাওয়াতে ওয়াল আরদ্বি…

     

    খুবই আশ্চর্যজনকভাবে রাতে আলাউদ্দিনের ভালো ঘুম হলো। ঘুমের ভেতর তিনি স্বপ্নও দেখলেন। কাটা কাটা স্বপ্ন। একটা স্বপ্নে তার বাবা মুনশি মোহম্মদ দুশির তাকে জিজ্ঞেস করছেন, রোজা ভেঙ্গেছিস কী জন্যে? তিনি বললেন, এটা তো রমজান মাস না। এখন রোজা রাখার প্রশ্ন আসছে কে? উত্তর শুনে মুনশি মোহম্মদ ছগির খুব রেগে গিয়ে বললেন– পরহেজগার আদমির জন্যে সারা বছরই রমজান মাস। রোজা ভেঙ্গেছিস, তার শাস্তি আগামী জুম্মাবারে মুসুল্লিদের সামনে এক লক্ষার কানে ধরে উঠবোস করবি। আলাউদ্দিন বললেন, জ্বি আচ্ছা। এরপর শুরু হলো কানে ধরে উঠবোসের স্বপ্ন দেখা। ছাড়া ছাড়াভাবে এই স্বপ্ন চলল ঘুম না ভাঙ্গা পর্যন্ত। তিনি উঠবোস করেই যাচ্ছেন, মুসুল্লিরা হো হো করে হাসছে। ঘুম থেকে উঠে তিনি চা খেলেন। হো হো হাসির শব্দের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। টিভিতে দর্শকদের উপস্থিতিতে কী একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। উপস্থাপকের প্রতিটি কথায় দর্শক হাসছে। আলাউদ্দিন আগ্রহ নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে রইলেন। টিভির সাউন্ড অফ করা ছিল। এখন সাউন্ড আছে। আলাউদ্দিন সাউন্ড অফ করে দিলেন। তিনি রাতে যে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন এটা ভেবে তার একটু হাসিই পেল। হামিদা বানু ঠিকই বলেছে— উত্তপ্ত মস্তিষ্কের চিন্তা। শুধু যখন কুটুর কাছে শুনলেন গতকাল রাতে সাইফুল্লাহ সাহেবের বাড়িতে কী নাকি সমস্যা হয়েছে, সাইফুল্লাহ সাহেবের মাথা ফেটে গেছে, রক্তে বাড়ি ভেসে গেছে, শেষ রাতে এম্বুলেন্স এসেছে, পুলিশ এসেছে— তখন সামান্য খটকার মতো লাগল।

    আলাউদ্দিন বললেন, পুলিশ এসেছিল কেন?

    কুটু বলল, জানি না স্যার। সাইহি সাহেবের বাসায় কাইল রাইতে যে মেয়েটা ছিল পুলিশ তারে ধইরা নিয়া গেছে।

    মেয়ে কী করেছে?

    জানি না স্যার।

    মেয়েটা কে?

    গার্মেন্টসের এক মেয়ে। সাইফুল্লাহ সাহেবের এখানে একেক সময় একেক মেয়ে থাকে। নানান ভ্যাজাল।

    ভ্যাজাল তো বটেই।

    উনার যে অবস্থা দেখলাম স্যার, নাক মুখ দিয়া রক্ত পড়তেছে। কাউরে চিনতে পারে না। বাঁচে কি-না সন্দেহ।

    দেখতে গিয়েছিলে?

    জ্বি না। সিঁড়ি দিয়া নামানির সময় দেখলাম। মন খারাপ হইয়া গেল। কে জানে কী বৃত্তান্ত।

    মন খারাপ হবার কথা। হাজার হোক প্রতিবেশী।

    স্যার, চা আরেক কাপ দিব?

    আলাউদ্দিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দাও। তিনি মাথা থেকে পুরো ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। নাশতা খেয়েই আজ বাংলাবাজার চলে যাবেন।

    বালিশটা আরেকবার দেখতে ইচ্ছা করছে। কাল রাতে মনে হয়েছিল রক্ত লেগে আছে। এখনও কি তাই? রক্ত শুকিয়ে হয় কালো। কালো কোনো দাগ কি বালিশে আছে। আলাউদ্দিন দুটা বালিশই উল্টে পাল্টে দেখলেন। কোনো দাগ নেই। তিনি অনিন্দিত গলায় ডাকলেন, মাই ডিয়ার কুটু! আরেক কাপ চা দাও।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগৌরীপুর জংশন – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article কিছুক্ষণ – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }