Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কুহেলিকা – কাজী নজরুল ইসলাম

    কাজী নজরুল ইসলাম এক পাতা গল্প153 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কুহেলিকা – ০৩

    কুহেলিকা – ০৩

    তখন স্বদেশযুগের বান ডাকিয়াছে। ইংরেজ তাহার রাজত্ব ভাসিয়া যাওয়ার ভয় না করিলেও ডুবিয়া যাওয়ার আশঙ্কা একটু অতিরিক্ত করিয়াই করিতেছিল। ঘরের ঘটিবাটি সে সামলাইতেছিল না বটে, কিন্তু বাঁধ সে ভালো করিয়াই বাঁধিতেছিল। জাহাঙ্গীর তখনও বালক, – স্কুলে পড়ে। এমনই দিনে ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’ মন্ত্রে এই কল্পনাপ্রবণ কিশোরকে দীক্ষা দিলেন তাহারই এক তরুণ স্কুলমাস্টার প্রমত্ত। প্রমত্ত যে বিপ্লববাদী, এ ভীষণ সংবাদ স্কুলের কয়েকটি বিপ্লবপন্থী ছাত্র ব্যতীত হয়তো বিধাতাপুরুষও জানিতেন না। তবে সি.আই.ডি. প্রভু জানিতেন কি না, বলা দুষ্কর। বিধাতাপুরুষে আর সি.আই.ডি. মহাপুরুষে এইটুকু তফাত! যাহা পূর্বোক্ত পুরুষের অগোচর, তাহা শেষোক্ত মহাপুরুষের নখদর্পণে! – এক দিন একটি ছাত্র গান করিতেছিল – ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে!’

    প্রমত্ত হাসিয়া বলিল, ‘এ গান কাকে উদ্দেশ করে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, জানিস?’ ছেলেটি উৎসাহের সহিত বলিয়া উঠিল, ‘কেন স্যার, ভগবানকে উদ্দেশ করে।’ প্রমত্ত ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘উঁহু, তুই জানিসনে। রবীন্দ্রনাথ শ্রীমৎ টিকটিকি বাবাজিকে স্মরণ করে ভক্তিভরে এ-গান রচনা করেছিলেন।’ ছেলেদের উৎসাহ দেখে কে! সেইদিন হইতে কাহাকেও টিকটিকি বলিয়া সন্দেহ হইলেই, এমনকি দেয়ালে টিকটিকি দেখিলে, তাহারা তারস্বরে গাহিত, –

    ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।’

    প্রমত্তকে ছাত্রদের সকলে শ্রদ্ধা করিত, ভালোবাসিত – ভালো শিক্ষক বলিয়াই নয়, সে সকলকে অন্তর দিয়া ভালোবাসিতে জানিত বলিয়া। উঁচু ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্রই তাহাকে প্রমতদা বলিয়া ডাকিত।

    প্রমত্তের – একা প্রমত্তের কেন, যে কোনো বিপ্লবনায়কেরই – কোনো কার্যের কারণ জিজ্ঞাসার অধিকার কোনো বিপ্লববাদীরই ছিল না, তবুও তাহারা প্রমত্তের জাহাঙ্গীরকে ‘মাতৃমন্ত্রে’ দীক্ষা দেওয়া লইয়া একটু চড়া রকমেরই প্রতিবাদ করিল। প্রমত্ত কোনো বড়ো দলের নায়ক ছিল না। তবুও তাঁহাকে অশ্রদ্ধা করিবার সাহস বড়ো বড়ো বিপ্লব-নায়কদেরও হয়নি। ভবিষ্যতে প্রমত্ত এক জন বড়ো বিপ্লবনায়ক হইবে, এ-ভয়ও দলের ছোটো-বড়ো দলের সকলেই করিত। সুতরাং এ-প্রতিবাদের উত্তর সে তাহারই অধীন বিপ্লববাদীদের না দিলেও পারিত, কিন্তু লোকটি আসলে ছিল একটু বেশি রকমের ভালো-মানুষ! কাজেই নিয়ম-বিরুদ্ধ হইলেও সে ইহা লইয়া বেশ একটু তর্ক করিল। বলিল, ‘দেখো, আমাদের অধিনায়ক বজ্রপাণি মহাশয়কে আমি আমার ভগবানের চেয়েও শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তাঁর এমতকে মানতে যথেষ্ট ব্যথা পাই যে বাংলার মুসলমান ছেলে বিপ্লববাদীর আদর্শকে গ্রহণ করতে পারে না। অবশ্য, তাঁর স্পষ্ট নিষেধ থাকলে আমি জাহাঙ্গীরকে এ দলে নিতে পারতাম না। তা সে যত ভালো ছেলেই হোক। তোমরা বলবে, অধিকাংশ মুসলমান ছাত্রই হয় চাকুরি-লোভী, না হয় ভীরু। কিন্তু ওদের সব ছেলেই যে ওই রকমের, তা বিশ্বাস করবার তো কোনো হেতু দেখিনে। তাছাড়া, আমরা ওদের চেয়ে কম চাকুরি-লোভী, কম ভীরু – এ বিশ্বাস করতে আমার লজ্জা হয়।

    দেশপ্রেম ওদের মধ্যে জাগেনি – ওদের কেউ নেতা নেই বলে। আর, ধর্ম ওদের আলাদা হলেও এই বাংলারই জলবায়ু দিয়ে তো ওদেরও রক্ত-অস্থি-মজ্জার সৃষ্টি। যে-শক্তি যে-তেজ যে-ত্যাগ তোমাদের মধ্যে আছে, তা ওদের মধ্যেই বা থাকবে না কেন? তা ছাড়া আমি মুসলমান ধর্মের যতটুকু পড়েছি, তাতে জোর করেই বলতে পারি যে, ওদের ধর্ম দুর্বলের সান্ত্বনা “অহিংসা পরমধর্ম”কে কখনও বড়ো করে দেখেনি! দুর্বলেরা অহিংসার যত বড়ো সাত্ত্বিক ব্যাখ্যাই দিক না কেন, ও জিনিসটা মুসলমানেরা অভ্যাস করেনি বলে ওতে ওদের অগৌরবের কিছু নাই!

    আজকাল এক দল অতিজ্ঞানী লোক বীর-ধর্ম রাজসিকতাকে বিদ্রুপ করে তাদের কাপুরুষতার তামসিকতাকে লুকোবার চেষ্টা করছে, কিন্তু আমি তাঁদের জিজ্ঞেস করি – শুধু কি বুদ্ধ খ্রিস্ট নিমাই-ই বেঁচে আছেন বা থাকবেন? রাম, কৃষ্ণ, অর্জুন, আলেকজান্ডার, প্রতাপ, নেপোলিয়ন, গ্যারিবল্ডি, সিজার – এঁরা কেউ বেঁচে নেই – না থাকবেন না? কত ব্যাস-বাল্মীকি-হোমার অমর হয়ে গেলেন এই গাথা লিখেই। তোমরা হয়তো বলবে, অনাগত যুগে এদের কেউ বড়ো বলবে না, কিন্তু তোমাদের সে অনাগত যুগ আসতে আসতে পৃথিবীর পরমায়ু ফুরিয়ে যাবে। তা ছাড়া সাত্ত্বিক ঋষিরা, অহিংস কবিরা অনাগত যুগের অবতারের যে কল্কি বা মেহেদি মূর্তির কল্পনা করেছেন, তাকে তো নখদন্তহীন বলা চলে না। যাক, কী বলতে কী সব বলছি। দ্যাখ, নেংটি-পরা বাবাজিদের এই অহিংসবাদ আমায় এত আহত করে তোলে যে তখন আর আমার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না! আমি বলছিলাম কী–’

    ইহারই মধ্যে একটি টলস্টয়-ভক্ত ছিলে বলিয়া উঠিল, ‘কিন্তু প্রমতদা, আমরা মার খেয়েই মারকে জয় করব – এ কি একেবারেই মিথ্যা?’

    প্রমত্ত উত্তেজিত স্বরে বলিল, ‘তা হলে আমরা বহুদিন হল জয়ী হয়ে গেছি! কারণ, আমরা নির্বিকার চিত্তে এত শতাব্দী ধরে এত মার খেয়েছি যে, যারা মেরেছে তারাই শেষে দিকশিক মেরে গেছে। আমাদের আর্য মেরেছে, অনার্য মেরেছে, শক মেরেছে, হূন মেরেছে! আরবি ঘোড়া মেরেছে চাঁট, কাবলিওয়ালা মেরেছে গুঁতো, ইরানি মেরেছে ছুরি, তুরানি হেনেছে তলওয়ার, মোগল-পাঠান মেরেছে জাত, পর্তুগিজ-ওলন্দাজ-দিনেমার-ফরাসি ভাতে মারতে এসে মেরেছে হাতে, আর সকলের শেষে মোক্ষম মার মেরেছে ইংরেজ। মারতে বাকি ছিল শুধু মনুষ্যত্বটুকু – যার জোরে এত মারের পরও এ জাত মরেনি – তাই মেরে দিলে ইংরেজ বাবাজি! এত মহামারির পরও যদি কেউ বলেন, “আমরা এই মরে মরেই বাঁচছি”, তবে তাঁর দর্শনকে আমি শ্রদ্ধা করি – কিন্তু বুদ্ধিকে প্রশংসা করিনে। তাঁর বুদ্ধি-স্থানের ভালো করে চিকিৎসা হওয়া উচিত। যাক, এ নিয়ে আমাদের আলোচনা নয়। আমি বলছিলাম, সত্যিই কি আমাদের এ আন্দোলন থেকে মুসলমানদের বাদ দেব? ওদের অনেক দোষ আছে স্বীকার করি, কিন্তু ওরা সরল-বিশ্বাসী ও দুঃসাহসী! ওদের হাতে বাঁশ আছে সত্যি, কিন্তু তা ওরা পেছনে লুকিয়ে রাখতে জানে না, একেবারে নাকের ডগায় উঁচিয়ে ধরে – এই যা দোষ। ওতে আমাদের কাজ হয় না। ওদের গুপ্তি-মন্ত্রে দীক্ষা দিলে হয়তো ভাবীকালে সেরা সৈনিক হতে পারত।’

    প্রমত্ত কী যেন ভাবিতে লাগিল। মনে হইল, ভাবীকালের দুর্ভেদ্য অন্ধকারে সে ক্ষীণ দীপশিখা লইয়া কী যেন হাতড়াইয়া ফিরিতেছে!

    জাহাঙ্গীরের প্রিয়বন্ধু অনিমেষ বলিয়া উঠিল, ‘প্রমতদা, জাহাঙ্গীরকে আমাদের দলে নেওয়ায় অন্তত আমার কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। সে হিন্দু কি মুসলমান, তা ভেবে দেখিনি! তাকে আমি দেখেছি মানুষ হিসাবে! সে হিসাবে সে আমাদের সকলের চেয়েই বড়ো। কিন্তু এ নিয়ে শেষে আমাদের মধ্যে একটা মনান্তর বা বাধে। আমরা বিপ্লববাদী, কিন্তু গোঁড়ামিকে আজও পেরিয়ে যেতে পারিনি – ধর্মকে বাদ দিয়ে মানুষকে দেখতে শিখিনি। এর জন্যে দায়ী আমাদেরই প্রতিদ্বন্দ্বী আর-এক বিপ্লব-সংঘের অধিনায়ক। আপনি বোধ হয় বুঝেছেন প্রমতদা, আমি কাকে মনে করে একথা বলছি!’ প্রমত্ত ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসিল। অনেকেই সে-হাসির অর্থ বুঝিল না।

    অনিমেষ বলিয়া যাইতে লাগিল, ‘তিনি এবং তাঁর দল কী বলেন, জানেন? বলেন, “আমরা ডান হাত দিয়ে তাড়াব ফিরিঙ্গি এবং বাম হাত দিয়ে খেদাব নেড়ে! সন্ধি করব লন্ডন এবং মক্কা অধিকার করে!” – তারা মুসলমানকে ইংরেজের চেয়ে কম শত্রু মনে করে না!’

    প্রমত্ত হাসিয়া বলিল, ‘আর ওই অধিনায়ক সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত করে বিলেত ও মক্কা থেকে কী আনবেন – বলতে পারিস?’

    ছেলেরা এক বাক্যে স্বীকার করিল, তাহারা বলিতে পারে না।

    প্রমত্ত বলিল, ‘তিনি বিলেত গেলে হয়ে আসবেন ট্যাসু, খেয়ে আসবেন হ্যাম, নিয়ে আসবেন মেম। আর মক্কা গেলে হয়ে আসবেন হাজি, খেয়ে আসবেন গোশত এবং নিয়ে আসবেন দাড়ি! সন্ধিপত্র আর আনতে হবে না!’

    ছেলেরা হাসিয়া লুটাইয়া পড়িল। প্রমত্ত বলিয়া যাইতে লাগিল, ‘দেখ, এই বাংলাদেশে গাঁজার চাষ করে গভর্মেন্ট তত সুবিধে করতে পারেনি, যত সুবিধে তাদের করে দিয়েছে আমাদের মহাপুরুষেরা আমাদের মস্তিষ্কে ধর্মের চাষ করে, আমাদের দাঁতের গোঁড়া ভাঙবার জন্যে ইংরেজের শিল নোড়া হয়ে উঠেছে আমাদের ধর্ম। – ইংরেজের ভারত-শাসনের বড়ো যন্ত্র কী, জানিস? আমাদের পরস্পরের প্রতি এই অবিশ্বাস, পরস্পরের ধর্মে আন্তরিক ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা! এই ভেদ-নীতিই ইংরেজের বুটকে ভারতের বুকে কায়েম করে রাখলে – “আদম্‌স পিকে” আদমের পদচিহ্ন যেমন অক্ষয় হয়ে রইল।’

    সমরেশ একটু অতিরিক্ত হিন্দু। সে বলিয়া উঠিল, ‘আচ্ছা প্রমতদা মুসলমানকে বাদ দিয়েও তো আমরা স্বাধীন হতে পারি।’

    প্রমত্ত বলিল, ‘নিশ্চয়, অনেক দেশই তাদের স্বদেশবাসীর অন্তত বারো আনা লোকের বিরুদ্ধাচরণ সত্ত্বেও স্বাধীন হয়েছে; কিন্তু আমরা তা পারব না। কেউ যদি পারে ইংরেজ ও মুসলমানকে একসাথে তাড়াতে, তাড়াক। অন্তত আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। তবে অন্য যেসব দেশ স্বাধীন হয়েছে, তারা স্বদেশবাসীর বিরুদ্ধাচরণ সহ্য করেছিল – তাদের তাড়াবার পাগলামি তো তাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করেনি।

    যে বিপ্লবাধিপ বলেন – আগে মুসলমানকে তাড়াতে হবে, তিনি ভুলে যান যে তাঁর এ অতিক্ষমতা যদি থাকতও, তা হলেও চতুর ইংরেজ প্রাণ থাকতে তা হতে দিত না। যেদিন ভারত এক জাতি হবে সেইদিন ইংরেজকেও বোঁচকা-পুঁটলি বাঁধতে হবে। এ কথা শুধু যে ইংরেজ জানে তা নয়, রামা শ্যামাও জানে। “হিন্দু” “মুসলমান” এই দুটো নামের মন্ত্রৌষধিই তো ইংরেজের ভারত-সাম্রাজ্য রক্ষার রক্ষা-কবচ। … আমার কিন্তু মনে হয় কী, জানিস? ইচ্ছা করলে আমরা অনায়াসে এদেশের মুসলমানদের জয় করতে পারি। তবে তা তরবারি দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে। অন্তত একটা স্থূল রকমের শিক্ষাদীক্ষার সঙ্গে ওদের পরিচিত না করে তুললে, “কালচার”-এর সংস্পর্শে না আনলে ওদের জয় করতে পারব না। ওদের জয় করা বা স্বদেশ-প্রেমে উদ্‌বুদ্ধ করা মানেই ইংরেজের হাতের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া!’

    সমরেশ বলিল, ‘কিন্তু প্রমতদা, ওদের গোঁয়ার্তুমি আর আবদারের যে অন্ত নেই। মানি, ওরা ইংরেজের হাতের অস্ত্র, আমরা দেশের কিছু করতে গেলেই মামারা দেবে ওদের লেলিয়ে! কিন্তু উপায় কী? “কনসেশন” দিয়ে দিয়ে ওদের তৃতীয় রিপুটাকে প্রচণ্ড করে তোলায় আমাদের যা হবার তা তো হবেই, ওদের নিজেদেরও চরম অকল্যাণ হবে। ওরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা কোনোদিনই করবে না!’

    প্রমত্ত – ‘কনসেশন আমিও দিতে বলিনে। আমিও বলি, সমর-যাত্রার অভিযানের সাথি যদি খোঁড়া হয়, তবে তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে পথে ফেলে যাওয়াই কল্যাণকর। কিন্তু অভিযান তো আমাদের শুরু হয়নি সমরেশ! এটা রিক্রুটমেন্টের, কাঁচা সৈনিক-সংগ্রহের যুগ – আমরা স্রেফ প্রস্তুত হচ্ছি বই-তো নয়। অনাগত অভিযানের সৈনিক ওরাও হতে পারে কিনা – তা পরীক্ষা করে দেখলে আমাদের দেশোদ্ধারের তারিখ এগিয়ে না যাক, অন্তত পিছিয়ে যাবে না। এখনই তুমি বলছিলে ওদের গোঁয়ার্তুমি আর আবদারের কথা। এ কথা একা তুমি নয়, আমাদের অনেক নেতাই বলছেন! কিন্তু রোগ নির্ণয় করলেই তো রোগের চিকিৎসা হল না। তর্কের কাতিরে মেনে নিলাম – ওরা অতিমাত্রায় আবদেরে, ওরা হয়তো ইংরেজ রাজ্যটাকে মামাবাড়িই মনে করে। কিন্তু এর মূলে কতদিনের অজ্ঞতা, কুসংস্কার, অশিক্ষা পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে – তা দেখেছ কি? সেই কথাই তো বলছিলাম যে, এইগুলো আমাদের সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে দূর করতে হবে। আমাদের ছড়িয়ে পড়তে হবে ওদের মধ্যে ওদের শিক্ষিত করে তোলার জন্যে, ওদের রক্তে স্বদেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার জন্যে। দেখবে, আজ যারা তোমার প্রতিবন্ধক, কাল সে তোমার সবচেয়ে বিশ্বাসী ও বড়ো সহযোগী হয়ে উঠবে। ওদের ঘৃণা করে খেপিয়ে না তুলে ভালোবেসে দেখতে দোষ কি?’

    সমরেশ – ‘কিন্তু প্রমতদা, ওদের মোল্লা-মউলবিরা তা কখনও হতে দেবে না। জানি না, হয়তো বা ওদের মউলবি-মোল্লা এবং আমাদের ধর্মধ্বজরা ইংরেজের গুপ্তচর। ওরা তখন সাধারণ মুসলমানদের এই বলে খেপিয়ে তুলবে যে, ওদের হিন্দু করে তোলার জন্যই আমাদের এই অহেতুকি মাথাব্যথা। আমাদের এ “নিরুপাধিক” প্রেমচর্চাকে তারা বিশ্বাস করবে না, শ্রদ্ধার সহিত গ্রহণ করবে না।’

    প্রমত্ত – ‘আমি তাও ভেবে দেখেছি। জানি, মুসলমান জনসাধারণের অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি হবে মোল্লা-মউলবির। তাদের রুটি মারা যাবে যাতে করে, তাকে তারা প্রাণপণে বাধা দেবেই। কিন্তু এ ভূতেরও ওঝা আছে, – সে হচ্ছে মুসলমান ছাত্রসমাজ। তরুণ মুসলিমকে যদি দলে ভিড়াতে পারি, তা হলে ইংরেজ আর মোল্লা-মউলবি এ দুই জোঁকের মুখেই পড়বে চুন। এই জন্যই আমি বেছে বেছে মুসলমান ছাত্র নিতে চাই আমাদের দলে এবং এইখানেই আমার সঙ্গে অন্যান্য বিপ্লব-নেতার বাধে খিটিমিটি।’

    সমরেশ – ‘আপনার ভবিষ্যৎ-দৃষ্টির প্রশংসা করি প্রমতদা, কিন্তু অধিকাংশ মুসলমান ছাত্রই জাহাঙ্গীর তো নয়ই, জাহাঙ্গীরের ভূতও নয়। তারা মনে করে, আমাদের স্বদেশি আন্দোলন মানে হিন্দুরাজের প্রতিষ্ঠা, কাজেই তারা এতে যোগদান করাকে মনে করে পাপ। তারাও সব হা-পিত্যেশ করে তীর্থের কাকের মতো আরব-কাবুল-ইরান-তুরানের দিকে চেয়ে আছে – কখন ওই দেশের মিয়াঁ সাহেবরা এসে ভারত জয় করে ওদের ভোগ করতে দিয়ে যাবে। ওরা ভুলে যায় নাদির শা তৈমুরের কথা!’

    প্রমত্ত – ‘মুসলমানেরা যদি হিন্দুরাজের ভয় করেই, তাতে তাদের বড়ো দোষ দেওয়া চলে না সমরেশ! মাতৃ-সমিতির অধিনায়কদের মতও নাকি হিন্দুরাজেরই প্রতিষ্ঠা। তাদের এ ভয় আমাদের আন্তরিকতা, বিশ্বাস ও ত্যাগ দিয়ে দূর করতে হবে। নইলে পরাধীন ভারতের মুক্তি নেই। মাতৃ-সমিতির মতো আমাদের সংঘেও যদি ওই মত হত যে মুসলমানকে এ দেশ থেকে তাড়াতে হবে, তা হলে দেশকে যতই ভালোবাসি না কেন, এ সংঘে আমি যোগদান করতাম না। মুসলমানদের যদি কোনো দোষত্রুটি থাকেই, তবে তার সংশোধনের সাধনা করব। তাদের তাড়াবার পাগলামি যেন আমায় কোনোদিন পেয়ে না বসে। আর, ইরান তুরানের দিকে যে ওরা চেয়ে আছে, তাতে ওদের খুব বেশি দোষ দেওয়া চলে না। দুর্বল মাত্রেই পরমুখাপেক্ষী। নিজেদের শক্তি নেই, ওরা তাই অন্য দেশের মুসলমানদের পানে চেয়ে তাদের শক্তিহীনতার গ্লানিতে একটু সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা করে; – যদিও ওরা নিজেরাই জানে যে ওদের জন্যে ইরান তুরান আরব কাবুল কারুরই কোনো মাথাব্যথা নেই। আমাদের সাধনা হবে – ওদের ওই পরদেশমুখী মনকে স্বদেশের মমতা দিয়ে ভিজিয়ে তোলা। যে মাটি ওদের ফুলে ফলে শস্যে জলে জননীর অধিক স্নেহে লালন-পালন করছে, সেই সর্বংসহা ধরিত্রীর, মূক মাটির ঋণের কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। তাদের রক্তে এই মন্ত্র জ্বালা করে ফিরবে যে জননীর স্তন্যপানের যদি কোনো ঋণ থাকে, তবে তারও চেয়ে বড়ো ঋণ আমাদের দেশজননীর কাছে – যার জলবায়ু ও রসধারায় আমাদের প্রাণ-মন-দেহ অনুক্ষণ সঞ্জীবিত হয়ে উঠছে – যে দেশ আমার পিতার জননী, আমার জননীর জননী!… ওদের রক্তে এ মন্ত্র ইনজেক্ট করতে পারবি তোরা কেউ সমরেশ? সেদিন ভারতের যে রাজরাজেশ্বরী মূর্তি আমি দেখব, তা আমি আজও দেখছি – আজও দেখছি আমার মানস-নেত্রে! গা দেখি সমরেশ, অনিমেষ! শোনা আমায় সেই সঞ্জীবনী-মন্ত্র! শোনা সেই গান –

    ‘দেবী আমার, সাধনা আমার,
    স্বর্গ আমার, আমার দেশ!’

    প্রমত্ত চক্ষু বুজিল। তাহার মুদিত চক্ষু দিয়া বিগলিত ধারে অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। ছেলেরা তাহার পায়ের ধুলায় ললাট ছোঁয়াইয়া গাহিতে লাগিল, –

    ‘দেবী আমার, সাধনা আমার,
    স্বর্গ আমার, আমার দেশ!’

    গাহিতে গাহিতে তাহাদেরও চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিল।

    প্রমত্ত সম্মুখে প্রসারিত ভারতবর্ষের প্রাণহীন মানচিত্রকে বারে বারে মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিতে লাগিল!

    সমরেশ প্রমত্তের পায়ের ধুলা লইয়া বলিল, ‘এতদিন আপনাকে ভুল সন্দেহ করেছি প্রমতদা, যে, হয়তো মুসলমানের প্রতি আপনার কোনো একটা গোপন দুর্বলতা বা আকর্ষণ আছে। সত্যিই আমরা বিপ্লব-সেনা হবার অধিকারী হয়তো আজও হইনি, আজও আমরা জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে ভারতের সকলকে ভালোবাসতে পারিনি। আমাদের দেশপ্রেম হয়তো স্রেফ উত্তেজনা, হয়তো ত্যাগের বিলাস। হয়তো আমরা গোঁড়ামিরই রক্ষীসেনা – ধর্মের নবতম পান্ডা। আপনি ঠিকই বলেছেন প্রমতদা, আমরা কেউই আজও দেশ-সৈনিক হতে পারিনি।’

    অনিমেষ হাসিয়া বলিল, ‘ঠিক বলেছে সমর, আমরা ধর্মের ষাঁড় – বিপ্লবদেবতার কেউ নই!’

    প্রমত্ত চক্ষু মুছিয়া সিক্তস্বরে বলিল, ‘আমার ভারত এ-মানচিত্রের ভারতবর্ষ নয় রে অনিম! আমি তোদের চেয়ে কম ভাবপ্রবণ নই, তবু আমি শুধু ভারতের জল বায়ু মাটি পর্বত অরণ্যকেই ভালোবাসিনি! আমার ভারতবর্ষ – ভারতের এই মূক-দরিদ্র-নিরন্ন পর-পদদলিত তেত্রিশ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ। আমার ভারতবর্ষ ইন্ডিয়া নয়, হিন্দুস্থান নয়, গাছপালার ভারতবর্ষ নয়, – আমার ভারতবর্ষ মানুষের যুগে যুগে পীড়িত মানবাত্মার ক্রন্দন-তীর্থ। কত অশ্রুসাগরে চড়া পড়ে পড়ে উঠল আমার এই বেদনার ভারতবর্ষ! ওরে, এ ভারতবর্ষ তোদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমানের মসজিদের ভারতবর্ষ নয় – এ আমার মানুষের – মহা-মানুষের মহা-ভারত!’

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleযুগবাণী – কাজী নজরুল ইসলাম
    Next Article গানের মালা – কাজী নজরুল ইসলাম

    Related Articles

    কাজী নজরুল ইসলাম

    অগ্নিবীণা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    চক্রবাক – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    ভাঙার গান – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    বাঁধনহারা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    মৃত্যুক্ষুধা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    দোলনচাঁপা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }