Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    দ্য জাহির – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    ভুলবে সে গান যদি – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেরী সাহেবের মুন্সী – প্রমথনাথ বিশী

    প্রমথনাথ বিশী এক পাতা গল্প546 Mins Read0

    ১.০১-০৫ চাঁদপাল ঘাট

    কেরী সাহেবের মুন্সী
    প্রমথনাথ বিশী

    প্রথম প্রকাশ, আশ্বিন ১৩৬৫ চতুর্বিংশ মুদ্রণ, শ্রাবণ ১৪১৪
    মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, ১০ শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলকাতা ৭০০০৭৩ হইতে এস. এন. রায় কর্তৃক প্রকাশিত ও অটোটাইপ, ১৫২ মানিকতলা মেন রোড, কলকাতা-৭০০০৫৪ হইতে তপন সেন কর্তৃক মুদ্রিত

    উৎসর্গ–
    শ্রীদেবেশচন্দ্র রায়
    প্রীতিভাজনেষু

    লেখকের বক্তব্য

    বছর পনেরো আগে রামরাম বসুর জীবন নিয়ে কিছু একটা লিখবার ইচ্ছা হয়, তখন ধারণা ছিল না যে তা ঠিক কি আকার ধারণ করবে। তার পরে বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ কবে বিস্মিত হয়ে গেলাম। রামরাম বসু প্রসঙ্গে উইলিয়াম কেরীকে পেলাম। বুঝলাম যে যে-সব মহাপ্রাণ ইংরেজ এদেশে এসেছেন, উইলিয়াম কেরী তাঁদের অগ্রগণ্য। কেরীর ধর্মজীবন, ধর্মপ্রচারে আগ্রহ, বাংলা গদ্য সৃষ্টিতে নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় অভিভূত করে দিল আমাকে। তখন ধীরে ধীরে কেরী ও রামরাম বসুকে অবলম্বন করে কাহিনীটি রূপ গ্রহণ করে উঠল।

    এই কাহিনীকে পাঠক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে গ্রহণ করবেন কিনা জানি না, করলে আমার আপত্তির কারণ নেই। ১৭৯৩ থেকে ১৮১৩ সালের ইতিহাস এর কাঠামো। জ্ঞানত কোথাও ইতিহাসের সত্য থেকে বিচ্যুত হই নি। কেবল একটি বিষয়ে কিছু স্বাধীনতা নিয়েছি, দ্বারকানাথ ঠাকুরের বয়স কিছু বাড়িয়ে দিয়েছি। আর কিছুই নয়, রবীন্দ্রনাথের পিতামহকে কাহিনীর মধ্যে আনবার লোভ সম্বরণ করতে পারি নি।

    ইতিহাসের সত্য ও ইতিহাসের সম্ভাবনা ঐতিহাসিক উপন্যাসকারের উপাদান। ইতিহাসের সত্য অবিচল, তাকে বিকৃত করা চলে না। ইতিহাসের সম্ভাবনায় কিছু স্বাধীনতা আছে লেখকের। সত্যের অপব্যবহার করি নি, সম্ভাবনার যথাসাধ্য সদ্ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছি।

    দুই শ্রেণীর নরনারীর চরিত্র আছে উপন্যাসখানায়, ঐতিহাসিক আর ইতিহাসের সম্ভাবনা-সঞ্জাত। কেরী, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, টমাস, রামমোহন, রাধাকান্ত দেব প্রভৃতি ঐতিহাসিক চরিত্র। রেশমী, টুশকি, ফুলকি, জন স্মিথ, লিজা, মোতি বায় প্রভৃতি ইতিহাসের সম্ভাবনা-সঞ্জাত অর্থাৎ এসব নরনারী তৎকালে এইরকমটি হত বলে বিশ্বাস। এখানে যেমন কিছু স্বাধীনতা আছে, তেমনি ভুলের সম্ভাবনাও বর্তমান। ভুল না করে স্বাধীনতার সুযোগ গ্রহণে লেখকের ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ক্ষমতা কতটা প্রকাশ পেয়েছে জানি না।

    পাত্রপাত্রীর উক্তিকে লেখকের মন্তব্য বলে গ্রহণ করা উচিত নয়। সে-সব উক্তি পাত্রপাত্রীর চরিত্রের সীমানার মধ্যেই সত্য, তাদের সত্যের সাধারণ রূপ বলে গ্রহণ করলে লেখকের প্রতি অবিচার করা হয়। বলা বাহুল্য, কোন ধর্ম কোন সম্প্রদায় বা কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিকে আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্য এ গ্রন্থের নয়। তার চেয়ে

    উচ্চতর আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে লেখক। একটা সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পর্বের কয়েকটি বিশেষ নরনারীর সুখদুঃখের লীলাকে অবলম্বন করে নির্বিশেষ মানবসমাজের সুখদুঃখের লীলাকে অঙ্কন লেখকের উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এমন দাবি করি না— কিন্তু উদ্দেশ্য ও ছাড়া আর কিছু নয়।

    আরও একটা কথা বুঝলাম বিষয়ে প্রবেশ করে আর কাহিনীটা লিখতে গিয়ে কলকাতা শহরের প্রাচীন অংশের প্রত্যেক পথঘাট, অট্টালিকা, উদ্যান, প্রত্যেক ইষ্টকখণ্ড বিচিত্র কাহিনীরসে অভিষিক্ত। এ শহরের একটি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আছে যা ভারতের প্রাচীন শহরগুলোর ব্যক্তিত্ব থেকে স্বতন্ত্র। ভারতের প্রাচীন ও নবীন যুগের সীমান্তে অবস্থিত এই শহর। এর অনেক ত্রুটি সত্ত্বেও না ভালবেসে পারা যায় না একে, কারণ এ আমার সমকালীন। সমকালীনতার দাবি এ শহরের সকলের প্রতি। ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’রও ঐ দাবি—তদধিক কোন ঐশ্বর্য এর আছে মনে হয় না। অলমিতি

    ৭ই মে, ১৯৫৮

    সেকালের পথঘাটের বর্তমান নামধাম

    বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড : পার্ক স্ট্রীট।

    এসপ্লানেড : বর্তমান ইডেন গার্ডেন।

    নঈ তলাও : পার্ক স্ট্রীট ও চৌরঙ্গীর মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের পুকুর।

    ঝাঁঝরি তলাও রোড :কিড স্ট্রীট।

    বিজিতলাও। : লোয়ার সারকুলার রোড ও চৌরঙ্গীর মোড়ের উত্তর-পশ্চিম কোণের পুকুর।

    জানবাজার রোড : সুরেন ব্যানার্জি রোড

    কসাইটোলা স্ট্রীট : বেন্টিঙ্ক স্ট্রীট।

    রোপওয়াক : মিশন রো।

    দি অ্যাভিনিউ : বহুবাজার স্ট্রীট।

    এসপ্লানেড রোড : গঙ্গার ধার চাঁদপাল ঘাট থেকে শুরু হয়ে সোজা পূর্বদিকে চৌরঙ্গী রোড পর্যন্ত; বর্তমান রাজভবনের দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিমমুখী দুটি প্রধান ফটক পার হয়ে এসপ্লানেড ঈস্ট ও চৌরঙ্গীর সংযোগস্থল পর্যন্ত।

    ট্যাঙ্ক স্কোয়ার : লালদিঘি।

    ওল্ড মিশন চার্চ : লালবাজার স্ট্রীট ও মিশন নোর মোড়ের দক্ষিণে অবস্থিত।

    সেন্ট জনস্ চার্চ : কাউন্সিল হাউস স্ট্রীট ও হেস্টিংস স্ত্রীটের মোড়ের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত।

    ওল্ড ফোর্ট : বর্তমান পূর্ব রেলওয়ের প্রধান কার্যালয়, কলকাতার কালেকটরেট ও জি পি ও-র উত্তর দিকের কিছু অংশ জুড়ে পুরাতন কেল্লা অবস্থিত ছিল।

    .

    কেরী সাহেবের মুন্সী
    প্রথম খণ্ড

    চাঁদপাল ঘাট

    চাঁদপাল ঘাট।

    ১৭৯৩ সালের ১১ই নভেম্বর।

    ও-পারের জনশূন্য বাবলাবনের দিগন্তে হেমন্তের সূর্য ডোববার মুখে।

    এতক্ষণ ঘাট প্রায় জনশূন্য ছিল, ক্রমে ক্রমে লোকজন জড়ো হতে লাগল, সেই সঙ্গে গাড়িঘোড়াও।

    বিলাতী জাহাজ এসে পৌঁছনো একটা মস্ত ঘটনা। আজ পৌঁছবে দিনেমার জাহাজ প্রিন্সেস মারিয়া।

    ক্রমবর্ধমান জনতার একান্তে নিমগাছের তলে দাঁড়িয়ে দুজন লোক। একজন লম্বা ছিপছিপে, দাড়ি-গোঁপ কামানো, কথা বলবার সময় কপালে অনেকগুলো রেখা জাগে; অপরজন বেঁটে, শক্ত নিরেট দেহ, ঘাড়ে-গর্দানে এক।

    লম্বা লোকটি বলল, পার্বতীভায়া, তোমাকে কেন চটি পায়ে আর নামাবলী গায়ে আসতে বলেছিলাম বুঝতে পারলে কি?

    না বসুজা, সত্যি কথা বলতে কি, পারি নি। তুমি বললে তাই এই বেশে এলাম। এ কি ঘাটে আসবার পোশাক! তার পর ভাবলাম, এসব বিষয়ে বসুজা আমার চেয়ে বেশি বোঝে, তাই আর আপত্তি করলাম না।

    ভালই করেছ। এই পাদ্রীগুলোর স্বভাব কি জান, যারা দূরে থাকে তাদের উপর বেশি টান। তুমি কোট-পালুন পর, খানা খাও, খ্রীষ্টান হও, দু দিন পরে আর হবে না। আর তা না করে যদি চটি চাদর নামাবলী শিখা বজায় রাখ, একটু অং বং করে দুটো সংস্কৃত মন্তর আওড়াও, তোমার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াবে।

    সে তো তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। চেম্বার্স সাহেবের মুন্সীগিরি করলে কত বছর, তার পর টমাস ডাক্তারের সঙ্গে ঘুরলে আরও কত বছর, কিন্তু না উঠল গায়ে কাটাপোশাক, না খেলে অখাদ্য কুখাদ্য। অথচ তোমার উপরই দেখি সবচেয়ে বেশি টান। কেন এমন হয় বলতে পার?

    এ সেই ওদের বাইবেলের নিষিদ্ধ ফলের গল্প আর কি। নিষিদ্ধ বলেই টানের অন্ত নেই। জাহাজঘাটায় পৌঁছবার বিলম্ব সয় না, টমাস সাহেবের চিঠির পর চিঠিমুন্সীজি, জাহাজঘাটে হাজির থাকবে।

    কিন্তু আবার এই বুড়ো পার্বতী ব্রাহ্মণুকে কেন?

    তোমার ব্রাহ্মণত্বেই যে তোমার দাম একটা ব্রাহ্মণকে খ্রীষ্টান করতে পারলে হাজারটা শূদ্রকে খ্রীষ্টান করবার ফল পাওয়া যায়।

    কিন্তু একটা শূদ্রকেই বা খ্রীষ্টান করতে পারল কই! আচ্ছা বসুজা, খ্রীষ্টান হবার জন্যে তোমার উপর চাপ দেয় না?

    দেয় না আবার!

    তবে?

    তবে আবার কি? টমাস সাহেবকে বলি, সাহেব, খ্রীষ্টান হয়ে খ্রীষ্টানধর্ম প্রচার করব এ আর বেশি কি। কিন্তু খ্রীষ্টান নই অথচ খ্রীষ্টানধর্ম প্রচার করছি এর প্রভাবটা একবার ভেবে দেখ। সাহেব বলল, ঠিক হ্যায়।

    তখন তুমি কি বললে?

    আমি কিছুই বললাম না, সাহেবকে ডোমতলার এক জুয়োর আড্ডায় নিয়ে গেলাম। পরদিন সর্বস্ব খুইয়ে সাহেব বলল, মুন্সীজি, জুয়োর আড্ডা নরক। আমি বলি, তা আর বলতে! তার পর সাহেব বলল, টাকাকড়ি হচ্ছে ‘ওয়েজেস অব সিন’। আমি বলি, সেইজন্যেই ওগুলো নরকে গিয়েছে। যা হক সাহেব, এখন তো বেশ হাল্কা হয়েছ, এবার স্বর্গে যাও।

    একেবারে মরতে বললে?

    আরে না, না। ইশারায় গির্জায় যেতে বললাম। তা ছাড়া, ও যে মরলে স্বর্গে যাবে তা কে বলল?

    মনটি বড় সরল।

    শুধু সরল মনের জোরে সবাই যদি স্বর্গে যেতে পারত, তাহলে স্থানাভাবে সেখানে যে অন্ধকূপ হত্যার পালা হত।

    এবারে আবার কাকে সঙ্গে আনছে?

    শুনছি কেরী নামে এক পাদ্রীকে।

    একা রামে রক্ষা নাই, সুগ্রীব দোসর!

    শুধু সুগ্রীব নয়, সঙ্গে কুমার অঙ্গদ, তারা, নীল, নল, অনেকেই আছে।

    সপরিবারে? এ দেশেই থাকবে মনে হচ্ছে!

    শুধু থাকবে কেন, বাইবেল তর্জমা করবে, অন্ধকার দূর করবে, প্রভু যীশুর করুণা বৃষ্টি করবে।

    অমনি সঙ্গে কিছু রুপোর বৃষ্টি করবে!

    অবশ্যই করবে। চেম্বার্স সাহেবকে আমি একসময় বাইবেল তর্জমায় সাহায্য করতাম, সাহেব বেশ দরাজ হাতের লোক।

    বসুজা ভায়া, এবারে হুঁশিয়ার হও, এতদিনে খাস পাদ্রীর হাতে পড়বে। চেম্বার্স আদালতে দোভাষী, টমাস জাহাজী ডাক্তার, এ বেটা শুনেছি দীক্ষিত পাদ্রী।

    শুধু তাই? কেরী এক সময়ে জুতো সেলাই করত, এখন চণ্ডীপাঠ করে। না জানে এমন কাজ নেই। টমাস সাহেব খুলে লিখেছে কিনা।

    এমন সময়ে তাদের কানে গেল, কে যেন গুনগুন করে গান করছে–

    ‘কলকাত্তাকা বাবুলোক
    করে কাম বেহদ,
    দিনমে খাতা গঙ্গাপানি
    রাতমে খাতা মদ।’

    কে, অ্যাব্রাহাম নাকি?

    সেলাম বোস সাহেব, অ্যাব্রাহামই বটে।

    অ্যাব্রাহাম ও রামরাম বসু দুজনেই ডিঙাভাঙা অঞ্চলের অধিবাসী, পরস্পরকে বেশ চেনে। অ্যাব্রাহামের পিতামাতার কোন একজন কোন এক পুরুষে পর্তুগীজ ছিল, কিন্তু কয়েক পুরুষের ধোপে পিতৃমাতৃপরিচয়ের আজ আর কিছু অবশিষ্ট নেই, আছে শুধু ধমটি, পোশাকটি আর নামটি।

    প্রথম পরিচয়ে সে নিজের নাম বলে, ডন অ্যাব্রাহাম ডি লেসে। আর ইংরেজি নিয়ে কেউ যদি ঠাট্টা করে বলে, কেমন সাহেব তুমি! অ্যাব্রাহাম বলে, ইংরেজি কি আমার ভাষা? তার পর সগর্বে বলে, ডন অ্যাব্রাহাম ডি লেসেন্সের ভাষা পর্তুগীজ। আর প্রশ্ন করবার সুযোগ দেয় না, গুন-গুন স্বরে যে কোন একটা গান ধরে, এমন অনেক গানের পুঁজি তার।

    রাম বসু শুধাল, তার পর এখানে কি মনে করে?

    পার্বতীচরণ বলল, দেশের লোক আসছে দেখতে।

    অ্যাব্রাহাম রাগল না, হেসে উঠল, পার্বতীচরণের সঙ্গেও তার পরিচয় ছিল রাম বসুর সূত্রে; তার পরে বলল, দেশের লোক দেখতে ইচ্ছা হয়ই তো। কিন্তু সেজন্যে ঠিক আসি নি, এসেছি ব্যবসার জন্যে।

    পার্বতীচরণ শুধাল, তোমার আবার কিসের ব্যবসা?

    অ্যাব্রাহাম মুচকি হেসে বলল, কাঁচা চামড়ার ব্যবসা।

    দুজনে হো-হো করে হেসে উঠল। বলল, তা বেশ, তা বেশ।

    ব্যবসা চলছে কেমন?

    কই আর তেমন চলে! এই নতুন জাহাজ পৌঁছলে যা চলে কয়েকদিন।

    শুনলাম কোম্পানি জাহাজী গোরাদের জন্যে ‘সেইলরস হোম’ খুলেছে!

    তা গোটা দুই খুলেছে বটে।

    তবে তো তোমাদের ব্যবসার সদর দরজাটাই বন্ধ।

    কিন্তু খিড়কির দরজাটা? সেটা বন্ধ করে কার সাধ্য?

    কি রকম?

    আগে ডাঙায় নামলে খদ্দের যোগাড় হত, এখন জাহাজে থেকে করতে হয়, তফাৎ এই। খাটুনি বেড়েছে, ভয় বেড়েছে, তেমনি দরও বেড়েছে। অতিরিক্ত পয়সা দিয়ে মরে গোরা খালাসী, আমার মুনাফায় হাত দেয় কে!

    কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ের অন্ধিসন্ধি জানবার ঔৎসুক্য জানাল দুজনে।

    অ্যাব্রাহাম শুরু করল, তবে শুনুন। সেদিন এল ‘উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি জাহাজ। আগে হলে সরাসরি জাহাজে গিয়ে চড়তাম, কিন্তু এখন তা হবার উপায় নেই, পাস লাগে। কি করি? একখানা ডিঙি নিয়ে গেলাম জাহাজের কাছে। কাপেনকে সেলাম করে শুধালাম, হুজুর, জন টমসন বলে কোন যাত্রী এসেছে? কাপ্তেন বলল, না, ও নামে কোন যাত্রী নেই।

    তখন আপন মনেই যেন বললাম, তাই তো, বড় মুশকিল হল, এখন কি করি! তারপর আবার কাপ্তেনকে বললাম, একবার হুকুম হলে জাহাজে উঠে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখি কেউ জন টমসনের পাত্তা জানে কি না। এমন তো হতে পারে জাহাজ ছাড়বার আগে কেউ তাকে দেখেছে।

    উত্তর হল, বেশ তো, এসে খোঁজ কর না। দেখো জলে পড়ে যেও না যেন।

    অমনি তুড়ুক করে জাহাজে লাফিয়ে উঠে জাহাজী গোরাদের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। তার পর, রতনে রতন চেনে। ওদের বুঝিয়ে বললাম, ‘সেইলরস্ হোম’ এ কত তকলিফ, কত কড়া আইন, রাত নটার পরে বাইরে বেরুতে দেয় না। আর আমার ঠিকানায় যদি যাও, তবে যা চাও তাই পাবে, ধুম ফুর্তি—চার্জ নামমাত্র।

    সবাই একসঙ্গে বলে উঠল-তোমার ঠিকানা বল।

    ঠিকানা আবার কি! অ্যাব্রাহামের কুঠি, লালবাজার যা ফ্ল্যাগ স্ট্রীট, বললে কুকুরটা অবধি পথ দেখিয়ে দেবে। খদ্দের ঠিক করে নেমে এলাম।

    রামরাম বসু শুধাল, তার পর কি হল বল, ওরা গিয়েছিল তোমার কুঠিতে?

    সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আব্রাহাম বলে উঠল, ঐ যে জাহাজ দেখা দিয়েছে। চললাম হুজুর, বহুত বহুত সেলাম।

    এই বলে সে একখানা ডিঙির উদ্দেশে ছুটল।

    রামরাম বসু ও পার্বতী ব্রাহ্মণ দেখল, সত্যই ‘প্রিন্সেস মারিয়া’ মাঝগঙ্গায় নোঙর করেছে, এবারে পাল গুটোবার আয়োজন করছে, এতক্ষণ কথাবার্তায় মগ্ন ছিল বলে। কিছু দেখতে পায় নি।

    ঘাটের দিকে তাকিয়ে দেখল, ইতিমধ্যে সমস্ত স্থানটা তাঞ্জাম, পাল্কি, সেড্যানচেয়ার, ল্যান্ডো, বগি, ব্রাউনবেরি, ফিটন প্রভৃতি বিচিত্র যানবাহনে ভরে উঠেছে। অধিকাংশ গাড়িই খালি, সওয়ারী ধরতে এসেছে। অনেক সাহেব মেম এসেছে আত্মীয়স্বজনকে অভ্যর্থনা করতে। নানা ভাষার কৌতূহল-গুঞ্জনে ঘাটটা মুখর।

    রাম বসু ভাবছে, তাই তো, স্মিথ সাহেব এখনও এল না, ব্যাপারখানা কি?

    .

    ১.০২ চাঁদপাল ঘাটে

    হ্যালো, মুন্সী!

    গুড ইভনিং, মিঃ স্মিথ।

    স্মিথ বলল, তোমরা এসেছ ভালই হয়েছে, মিঃ চেম্বার্স তোমাদের ঘাটে উপস্থিত থাকতে বলেছিল। ডাঃ কেরী তোমাকে দেখবার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

    রাম বসু বলল, তোমাকে না দেখে আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।

    হ্যাঁ, আমার আর একটু আগে আসা উচিত ছিল।

    রাম বসু ইংরেজি পড়তে বলতে লিখতে শিখেছিল, যখন যেমন প্রয়োজন ইংরেজি বা বাংলা ব্যবহার করত। এখন ইংরেজিতেই কথা হল।

    মিঃ চেম্বার্স সুপ্রীম কোর্টের ফারসী দোভাষী, কলকাতায় সাহেব মহলে বিখ্যাত। লোকটা টমাসের বন্ধুও বটে, খ্রীষ্টধর্ম প্রচারেও তার অসীম আগ্রহ। স্মিথ ও কেরীর মধ্যে সে যোগাযোগ করে দিয়েছিল, স্থির হয়েছিল যে টমাস ও সপরিবার কেরী স্মিথের আতিথ্য গ্রহণ করবে।

    স্মিথ ধনী ব্যবসায়ী, বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোডে বাড়ি।

    স্মিথের আসতে বিলম্ব হবার সত্যই কারণ আছে। আজ তার শিকার করতে যাওয়ার কথা। এমন সময়ে তার পিতা জর্জ বলল, জন, শিকারে নাই গেলে, আমি সুস্থ বোধ করছি না, তুমি জাহাজঘাটে গিয়ে মান্য অতিথিদের নিয়ে এস।

    জন বলল, সে কি বাবা, শিকারে বেরুব, সব ঠিক, এমন সময়ে—

    বুড়ো জর্জ বলল, তাই তো, তাহলে আমাকেই যেতে হচ্ছে দেখছি।

    তখন জনের ভগ্নী লিজা বলল, যাও জন যাও, আখেয়ে ভাল হবে। কি ভালটা দেখলে?

    চোখ থাকলে তুমিও দেখতে পেতে। কলকাতায় অবিবাহিত যুবকদের গিঞ্জেয় যাওয়ার এত আগ্রহ কেন?

    কেন তুমিই বল।

    জান না? ভাবী বধু সংগ্রহ।

    সে আগ্রহ কি একতরফা?

    নিশ্চয়ই নয়, সেই জন্যেই তো আমি কখনও গিয়ে যেতে ভুলি নে।

    কিন্তু জাহাজঘাট তো গির্জে নয়।

    তার চেয়েও বেশি। অবিবাহিত যুবতী পাকড়াও করবার আশাতেই ওখানে ভিড় জমে।

    আমার সে রকম আগ্রহ নেই।

    তবে তোমার ভাগ্যে ‘খিদিরপুর অ্যাসাইলাম’-এ যাচাই করা লেখা আছে।

    এখন ‘খিদিরপুর অ্যাসাইলাম’-এর ভয়েই হক আর কর্তববুদ্ধিতেই হক জন শিকারে গেল না, জাহাজঘাটে এল। এই তার বিলম্বের আসল কারণ।

    রাম বসু বলল, মিঃ জন, এঁর সঙ্গে তোমার পরিচয় নেই, এতক্ষণ পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, এর নাম পার্বতী ব্রাহ্মণ, হিন্দুশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত ব্যক্তি, আমার বন্ধু, টমাস ও চেম্বার্সের সঙ্গে এঁর দীর্ঘকাল পরিচয়।

    বড় আনন্দের কথা। ঐ ডিঙিখানায় বোধ হয় ওরা আসছে!

    এই বলে স্মিথ অগ্রসর হল।

    রাম বসু ও পার্বতী দেখল—হ্যাঁ তারাই বটে, সন্দেহ নেই। টমাসকে বেশ চেনা যাচ্ছে বাকি সকলে সপরিবার কেরী হবে।

    ওহে পার্বতী ভায়া, এ যে একগুষ্টি!

    দেশে ভাত জোটে না।

    আহা, চট কেন? আমাদের ভাত অমনি খাবে না; যেমন আমাদের ভাত খাবে তেমনি আলো বিতরণ করবে।

    রামভায়া, তুমি কি সত্যিই ওদের পাত্ৰীভাবে বিশ্বাস কর?

    পাগল! রাম বসু কিছুতেই বিশ্বাস করে না, আবার কিছুতেই তার অবিশ্বাস নেই। সমস্ত সংস্কার গলে পান করে সে নীলকণ্ঠ হয়ে বসে আছে!

    নীলকণ্ঠ না বলে লালকণ্ঠ বলাই উচিত, সাধারণত ঐ বস্তুটার রঙ লাল হয়েই থাকে—বলে পার্বতীচরণ।

    বাপ রে, কি পেল্লায় টাক! কোথায় কপালের শেষ আর কোথায় টাকের শুরু ঠিক করে কোন শালা!

    না ভাই, আমার মনে হচ্ছে ওর কপালটা ঠেলতে ঠেলতে ব্রহ্মতালু অবধি উঠেছে। যাই বল, দরাজ-কপালে ব্যক্তি। হা, অদৃষ্ট পরীক্ষা করতে আসছে, দেখা যাবে কত বড় কপাল!

    বলা বাহুল্য, এ কপাল-প্রশস্তির লক্ষ্যস্থল স্বয়ং পাদ্রী কেরী। ডিঙিখানা খুব কাছে এসে পড়েছে।

    ঐ বেটীই বোধ হয় কেরীর স্ত্রী?

    একেবারে বুড়ী যে!

    পুষিয়ে নিয়েছে ঐ ছুকরিকে দিয়ে, খাসা দেখতে ভায়া!

    বোন নাকি?

    বোনই–তবে মনে হচ্ছে গৃহিণীর, নইলে এত যত্নে সাত সমুদ্র পারে নিয়ে আসে না।

    বোনই হক আর শালীই হক, স্মিথ দেরি করে এসেও ঠকবে না।

    রাম বসু বলল, দেখেছ আমার কথা সত্যি কি না? স্মিথের একবার আগ্রহ দেখ! নৌকায় লাফিয়ে উঠবে নাকি? দেখ দেখ, পড়েছে কাদায়!

    সত্যই ভাটার কাদায় স্মিথ খানিকটা লাঞ্ছিত হল।

    রামভায়া, চল এগিয়ে যাই।

    পাগল নাকি, ঐ সব হাঙ্গামার মধ্যে কখনও যেতে আছে! আগে শত ডাঙায় পা দিক, তখন গিয়ে সরফরাজি করা যাবে। তা ছাড়া, যারা দশ হাজার মাইল পার হয়ে এল—তারা এই দশ গজও পার হতে পারবে, আমাদের সাহায্যের দরকার হবে না।

    ইতিমধ্যে সাহেব বিবির দল শুকনো ডাঙায় এসে নামল। যাদের আত্মীয়স্বজন এসেছে, তারা বাড়ির গাড়িতে রওনা হয়ে গেল। যাদের কেউ নেই, তারা গাড়িতে উঠে বলল-Burra Poachkhanna!

    কোচম্যান ও পাক্কি-বাহকের দল শব্দটার সঙ্গে খুব পরিচিত, তারা জানে যে Burra Poachkhanna বললে বড় Hotel-এ নিয়ে যেতে হয়। কোন যুবতীকে অবিবাহিত অর্থাৎ বেওয়ারিশ মনে হওয়া মাত্র যুবকের দল তাকে হেঁকে ঘিরে ধরছে। একজন যুবক কেরীর ডিঙির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই স্মিথের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেখে ফিরে অন্যত্র গেল।

    পরিখাবেষ্টিত কলকাতায় শ্বেতাঙ্গসমাজ Ditchers নামে পরিচিত। Ditcher গণের আর কোন অভাব নেই—ঐ একটি অভাব ছাড়া। তারা চিরন্তন ‘নারী-মন্বন্তর’-এ অভিশপ্ত। শ্বেতাঙ্গিনীর অভাব শ্যামাঙ্গিনী দিয়ে মিটিয়ে নেওয়া সেকালে একটা অর্ধসামাজিক রীতি বলে স্বীকৃত হয়েছিল। নিজে থেকে অন্দরমহলের কথা না বললে কেউ সে প্রসঙ্গ তুলত না, সেটা ছিল নিষিদ্ধ ফলের জগৎ।

    .

    ১.০৩ ঘাট থেকে ঘরে

    স্মিথের বাড়ির দুখানা প্রকাণ্ড ব্রহাম গাড়ি বোঝাই হয়ে সবাই ঘাট থেকে ঘরে রওনা হল। সুমুখের গাড়িখানায় একাসনে কেরী ও কেরী-পত্নী, ক্রোড়ে সদ্যোজাত পুত্র জ্যাভেজ; অন্য আসনে রাম বসু ও টমাস। পিছনের গাড়িতে জন স্মিথ, কেরীর শ্যালিকা ক্যাথারিন প্ল্যাকেট, আর কেরীর দুই পুত্র ফেলিক্স ও পিটার; ফেলিক্স ও পিটার বালক। পার্বতীচরণ স্বগৃহে ফিরে গেল, বলে গেল আগামীকাল ভোরে গিয়ে দেখা করবে। রাম বসুও যেতে চেয়েছিল, কেরী হাড়ে নি। দশ হাজার মাইল সমুদ্র সন্তরণ করে এসে কাষ্ঠখণ্ড পেলে কে ছাড়তে চায়! টমাস চাঁদপাল ঘাটেই সকলের সঙ্গে কেরী ও কেরী-পত্নী ডরোথির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, এবারে গাড়িতে চেপে বসে আলাপ শুরু হল। আলাপ আলোচনা চলে মুখ্যত কেরী টমাস আর রাম বসুর মধ্যেই; ডরোথি নিতান্ত দু-একটি কথা ছাড়া বলে না; সে অপ্রসন্ন মুখে চুপ করে বসে রইল। তবে রক্ষা এই যে, সন্ধ্যার অন্ধকারে তার মুখের ভাব কেউ তখন দেখতে পেল না।

    গাড়ি চাঁদপাল ঘাট থেকে ডাইনে এপ্লানেড, বাঁয়ে কাউন্সিল হাউস ও গভর্নরের কুঠি রেখে এপ্লানেড রো ধরে সোজা পুব দিকে চলেছে। আগে পিছে চলেছে এমন অনেক গাড়ি, অনেক রকমের। প্রত্যেক গাড়ির আগে মশালচি ছুটছে মশালের আলোয় অন্ধকার ঘুচিয়ে, পিছনে হাঁকছে চোপদার ‘সামনেওয়ালা ভাগো’, ‘পিছনেওয়ালা হুঁশিয়ার’। মশালের আলোয় কোচম্যানের বড় বড় চাপরাশগুলো ঝকঝক করে উঠছে। এক সার মশাল ছুটছে পুব দিকে, আর এক সার মশাল ছুটেছে মাঠের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ দিকে। বিশ পঁচিশ পঞ্চাশখানা গাড়ির চাকার ঘড়ঘড়, শ দুই তিন মশালচি ও চোপদারের হুঁশিয়ারি আওয়াজ, অন্ধকার রাত্রি, অপরিচিত দেশ—সমস্ত মিলে নবাগন্তুকদের মনে কি ভাবের সৃষ্টি করল কে বলতে পারে!

    কিছুক্ষণ পরে গাড়ি মোড় ঘুরে চৌরঙ্গী রোডে পড়ে দক্ষিণ মুখে চলতে শুরু করল। ঠিক সেই সময়ে ডান দিকের মাঠ-ভরা জঙ্গল থেকে শেয়ালের দল প্রথম প্রহর ঘোষণা করল। হুয়া হুয়া, হুক্কা হুয়া, ক্যাথুয়া ক্যাহুয়া—দূর থেকে দূরান্তরে ছুটে চলে গেল তরঙ্গের পরে তরঙ্গ তুলে।

    চকিত কেরী-পত্নী স্বামীকে শুধাল, ও কিসের আওয়াজ?

    কেরী বলল, শেয়ালের।

    শেয়াল? তুমি কি বলতে চাও সত্যিকার শেয়াল? তুমি নিশ্চিত জান ওগুলো নেকড়ে নয়?

    কেরী হেসে বলল, অত্যন্ত নিশ্চিত। কেরী-পত্নীকে নিশ্চিন্ত করবার উদ্দেশ্যে টমাস বলল, ওগুলো খুব নিরীহ জানোয়ার। কত দেখতে পাবে বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোডে।

    হোয়াট, কোথায়?

    টমাস বলল, যেখানে আমরা তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি, বেরিয়াল গ্রাউন্ড—

    তার বাক্য সমাপ্ত হবার আগেই ডরোথি চাপা তর্জন করে উঠল, বলল, বিল, তোমার মনে শেষে এই ছিল? বিদেশে এনে আমাকে বেরিয়াল গ্রাউন্ডে নিয়ে চলেছ?

    ডিয়ার, তুমি ব্রাদার টমাসের বাক্য পুরোপুরি না শুনে ভয় পাচ্ছ—বেরিয়াল গ্রাউণ্ড নয়, বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোড, একটা রাস্তার নাম!

    টমাস বলল, সেখানে বহু ধনী লোকের বাস, অবশ্য কাছেই একটা বেরিয়াল গ্রাউন্ড আছে বটে।

    তাই বল, তারা সব শয়তানের প্রতিবেশী—এই বলে ডরোথি নিতান্ত অপ্রসন্ন মুখে শালখানা গায়ের উপর টেনে নিয়ে চুপ করে রইল।

    পত্নীর ব্যবহারে লজ্জিত কেরী কথার মোড় ঘোরাবার আশায় রাম বসুকে জিজ্ঞাসা করল, মিঃ মুন্সী, এই মশালগুলো বুঝি পথ আলো করবার জন্যেই?

    ঠিক ধরেছ ডাঃ কেরী।

    জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঐ যে ওদিকে মশাল চলেছে—এটা কোন দিক?

    ওটা দক্ষিণ দিক।

    আমরা কোন্ দিকে যাচ্ছি?

    আমরাও দক্ষিণ দিকে চলেছি। এ দুটো রাস্তা প্রায় সমান্তরাল, মাঝখানে মস্ত একটা মাঠ আর জঙ্গল।

    ও রাস্তাটা গিয়েছে কোন্ পাড়ায়?

    ও রাস্তায় প্রথমে পড়ে খিদিরপুর, তার পরে আছে গার্ডেনরীচ, সেটা ঠিক গঙ্গার ধারে-আর ভিতরের দিকে আছে আলিপুর।

    আর এ রাস্তাটা?

    ভবানীপুর, রসা পাগলা হয়ে গিয়েছে কালীঘাট।

    ক-লি-গট! মজার নাম। সেখানে কি আছে?

    কালীমাতার মন্দির। জাগ্রত-মানে ‘অল-পাওয়ারফুল’ গডেস।

    রাম বসু পাদ্রীদের একমাত্র ভরসাস্থল। তার মুখে কালীর প্রশংসা কেরীর ভাল লাগল না, বলল, মিঃ মুন্সী, তোমাদের দেশ বড় পৌত্তলিক।

    রাম বসু বলল, সাহেব, তোমরা এসেছ আর ভাবনা নেই।

    টমাস সোৎসাহে বলল, ঠিক কথা। তার পর কেরীর উদ্দেশে বলল, কেমন, আমি বলেছিলাম না?

    কেরী বলল, তা বটে। মিঃ মুন্সী, ব্রাদার টমাসের মুখে তোমার সব কথা আমি শুনেছি, আমি জানি যে আত্মীয়স্বজনের ভয়েই তুমি সত্যধর্ম গ্রহণে নিরস্ত আছে।

    সে কথা আর বলতে! এবারে দেখ না সাহেব, তুমি ঝাড়ে-বংশে এসেছ, এবারে আমিও ঝাড়ে-বংশে গিয়ে গিঞ্জেয় উঠব।

    মনে মনে বলল, মা কালী, কিছু মনে কর না। অসুরগুলোর কাছে এ রকম বলতে হয়, তুমিও তো মা অসুরবধের সময় সরলপন্থা অবলম্বন কর নি। যাই হক মা, অপরাধ নিও না, আগামী অমাবস্যায় গিয়ে ভাল পরে পুজো দিয়ে আসব।

    কি ভাবছ মুন্সী?

    প্রভু যীশুর সম্বন্ধে একটা গীত রচনা করেছিলাম, সেটা মনে করবার চেষ্টা করছি।

    সত্যি?

    এসব বিষয়ে কি মিথ্যা বলা সম্ভব?

    কই, কি গীত?

    কাছে নেই, যত শীঘ্র সম্ভব এনে দেখাব।

    মিঃ মূলী, তোমাকে না হলে আমার চলবেই না। আজ থেকেই তোমাকে আমার মুন্সী নিযুক্ত করলাম, এখন মাসিক কুড়ি টাকার বেশি দেবার আমার সাধ্য নেই।

    রাম বসু বলল, সাহেব, ধর্মকার্যে টাকা তুচ্ছ।

    এ তো হিদেনের মত কথা নয়।

    সাহেব, কি আর বলব, আমি ইতিমধ্যেই আধা-খ্রীষ্টান হয়ে গিয়েছি।

    টমাস বলল, তুমি এ দেশে খ্রীষ্টান-ধর্মের ভোরের পাখী।

    রাম বসু মনে মনে বলল-কি, কুঁকড়ো নাকি?

    তিনজনের মধ্যে কথাবার্তা বাংলা ভাষাতেই চলছিল। কেরী বিলাত থেকে আসবার সময় জাহাজে টমাসের কাছে বাংলা পড়তে লিখতে ও বলতে শিখেছিল। তবু এখনও তার মুখের আড় ভাঙে নি, কথাগুলো বেঁকেচুরে যায়, ঠিক শব্দটি ভাবের মুখে আসে না। কুয়াশার মধ্যে যেমন মানুষ দেখা যায় অথচ চেনা যায় না, কেরীর মুখের বাংলা ভাষার চেহারা অনেকটা তেমনি। তবে রাম বসু দীর্ঘকাল সাহেবের মুখের বাংলার সঙ্গে পরিচিত, কেরীর বাংলা বুঝতে তার কষ্ট হল না। টমাস বাংলা পড়তে লিখতে ও বলতে বেশ পারে, প্রায় শিক্ষিত বাঙালীর মতই। কিন্তু সাধারণের পক্ষে কেরীর বাংলা এখন অবোধ্য।

    দ্বিতীয় গাড়ির আরোহীদের মধ্যে নিতান্ত বালক ও শিশু বাদে প্রাপ্তবয়স্ক জন স্মিথ ও ক্যাথারিন প্ল্যাকেট। তাদের মধ্যে যে আলাপ চলছিল তা চিত্তাকর্ষক হলেও যে ধর্মসংক্রান্ত নয়, তদ্বিষয়ে একটি তথ্যই যথেষ্ট। মিঃ স্মিথ ও মিস প্ল্যাকেট এখন পরস্পরের কাছে জন ও কেটি। এ-জাতীয় পরিবর্তন এত দ্রুত সচরাচর ঘটে না সত্য, কিন্তু যেখানে ভিড় বেশি, আসন অল্প, সেখানে সাধারণ নিয়ম খাটে না। অনেক সময়েই অশোভন ব্যস্ততায় চেয়ারে রুমাল বেঁধে আপন স্বত্ব চিহ্নিত করে রাখতে হয়।

    কেটি বলছিল, জন, তোমাদের রাস্তার নামটি খুব রোমান্টিক বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড়!

    জন বলছিল, আর কাছেই আছে প্রকাণ্ড সুনড্রীবন। কাল বিকেলে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব।

    কেটি বার দুই জিভ দিয়ে ‘সুনড্রী’ শব্দটি নেড়েচেড়ে দেখলেনা হল আয়ত্ত শব্দটি, হল আয়ত্ত অর্থ। সে শুধাল, জন, সুনড্ৰীবন কি বন, কখনও তো শুনি নি?

    ওর অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘ফরেস্ট অব বিউটিফুল উইমেন’। ও বন এ দেশ ছাড়া নেই।

    কৃত্রিম বিস্ময়ের সঙ্গে কেটি বলল, বল কি, এ দেশ ছাড়া নেই? তাই বুঝি তুমি এ দেশ ছাড়তে চাও না? সর্বনাশ! এখন কি আর স্বদেশের কাউকে তোমার মনে ধরবে?

    দেখা যাক। সত্যি কাল যাবে তো?

    সত্যি নিয়ে গেলে সত্যি যাব।

    তার পর কেটি আপন মনে গুনগুন করে গান শুরু করল–

    Under the Greenwood tree
    Who loves to lie with me…

    সে বিষয়ে কি তোমার সন্দেহ আছে, কেটি?

    এমন সময়ে অদূরে একসঙ্গে কতকগুলো বন্দুকের আওয়াজ হল। কেটি শুধাল, ও কি!

    বন্দুকের আওয়াজ, নেটিভ পাড়ায় ডাকাত তাড়াচ্ছে।

    ডাকাতও আছে নাকি? তবে তো শেরউড ফরেস্ট হয়ে উঠল!

    উঠলই তো। এমন কি, রবিনহুড ও মেড মারিয়ানেরও অভাব হবে না।

    মিসেস কেরী শুধাল, ডাঃ টমাস, ও কিসের শব্দ?

    টমাস বুঝেছিল যে ডাকাত বললে মিসেস কেরী এখনই হাউমাউ করে উঠবে, তাই সে বলল, ও কিছু নয়। নেটিভ পাডায় উৎসব হচ্ছে, তারই ঘটা।

    গাড়ি মোড় বেঁকে বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোডে ঢুকল এবং কিছুক্ষণ পরেই জর্জ স্মিথের ফটকওয়ালা বাড়ির প্রকাণ্ড হাতার মধ্যে প্রবেশ কবল।

    জর্জ স্মিথ মান্য অতিথিদের অভ্যর্থনার আয়োজনের ত্রুটি করে নি। রোশনাই এর ব্যবস্থা হয়েছে দরাজ হাতে। বাড়ির গাড়িবারান্দার কাছে দুদিকে সারিবদ্ধ শতাধিক দাসদাসী। খানসামা, সরকার, খিদমতগার, সর্দারবেয়ারা, বাবুর্চি, আবদার, আয়া, দারোযান, সহিস, মালী, মেথর, মেথরানী, ভিস্তি, চাপরাসী, ধোবি, দরজি, চোপদার, হুঁকাবদার প্রভৃতি ধোপদুরস্ত পোশাকে সসম্ভ্রমে দণ্ডায়মান। বারান্দার উপরে বৃদ্ধ জর্জ স্মিথ ও কন্যা মিস এলিজাবেথ স্মিথ। জর্জ স্মিথ বিপত্নীক।

    গাড়ি থামবামাত্র শতাধিক দাসদাসী আভৃমি নত হয়ে সেলাম করল। জর্জ কেরীকে হাত ধরে নামাল, এলিজাবেথ মিসেস কেরীকে নামাল। দ্বিতীয় গাড়ির আরোহীরা নামলে সকলে মিলে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল।

    রামরাম বসু কলকাতার শ্বেতাঙ্গসমাজের রীতিনীতির সঙ্গে পরিচিত। সে জানে তার মত লোকের অধিকার ঘাট থেকে ঘর পর্যন্ত, ঘরের মধ্যে নয়। সে কেরীকে বলল, ডাঃ কেরী, আমি এখন চললাম, কাল সকালে আসব।

    কেরী বলল, মিঃ মুন্সী, অবশ্য আসবে।

    অতিথির নিমন্ত্রিত ব্যক্তির প্রতি ভদ্রতা করা উচিত মনে করে জর্জ বলল, মিঃ মুন্সী, অবশ্য আসবে। এরা কাল সকালে যখন নগর-ভ্রমণে বেরোবে তখন তোমাকে সঙ্গে থাকতে হবে। এ নগৰ সম্বন্ধে তোমার মত ওয়াকিবহাল আমরা নই।

    রাম বসু উভয়কে সেলাম করে প্রস্থান করল।

    .

    ‘সাপার’ শেষ করে শুতে যাওয়ার আগে জনকে একান্তে পেয়ে এলিজাবেথ বলল কি জন, ঘাটে না গেলে ঠকতে মনে হচ্ছে!

    জন বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে।

    দেখলে তো, শিকার কেবল বনেই মেলে না!

    না, নদীতেও মেলে।

    এটি কি? গোল্ড ফিশ না মারমেড?

    ও দুয়ের কিছুই নয়। এটি হচ্ছে মেড মারিয়ান।

    ইতিমধ্যে নামকরণও হয়ে গিয়েছে—ইউ লাকি ডগ!

    দুই ভাইবোন হেসে উঠল।

    যৌবনে হাসির ঢেউ অকারণে আসে, অযাচিতভাবে আসে, বার্ধক্যে এক-আধটা ঢেউ-এরও দেখা মেলে না কেন? যৌবন বহির্মুখী, বার্ধক্য অন্তর্মুখী-তাই কি?

    .

    ১.০৪ ওটা কি সত্যকার বাঘ?

    অনেক রাতে ঠেলা খেয়ে কেরী সাহেব জেগে উঠল, দেখল যে পত্নী পাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে।

    কেরী শুধাল, ডরোথি, কি হয়েছে?

    ডরোথি নীরব, দেহ ভয়ে কম্পমান।

    হঠাৎ অসুখ-বিসুখ হয়েছে আশঙ্কায় কেরী উঠে দাঁড়িয়ে পত্নীকে চৌকির উপরে বসাল, জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে বল তো?

    কি হয়েছে! শুনতে পাচ্ছ না?—এতক্ষণে ডরোথির বাকস্ফূর্তি হল।

    কি শুনব?

    ঐ যে বাইরে গর্জন, কি যে ডাকছে।

    এবারে কেরী সত্যই শুনতে পেল, বাইরে কোন একটা জন্তুর গর্জন।

    ভীত ডরোথি ফিস ফিস স্বরে শুধাল, ওটা কি ডাকে?

    কেরী বলল, বাঘের ডাক তো স্বকর্ণে কখনও শুনি নি, তবু যতদূর বুঝতে পারছি বাঘের ডাক বলেই মনে হচ্ছে, জলে দেশ কিনা।

    ওটা কি সত্যিকার বাঘ? শুধাল মৃতপ্রায় পত্নী।

    কেরী হেসে বলল, ডিয়ার, সত্যি বাঘ ছাড়া এত রাতে আর কি ডাকবে!

    যদি আক্রমণ করে?

    সামনে পেলে আক্রমণ করে বই কি।

    কি সর্বনাশ! তাতে আবার জানালাগুলো সব খোলা!

    এই বলে ডরোথি গরাদহীন বড় বড় খোলা জানালাগুলোর দিকে তাকাল।

    বাঘ লোকালয়ে কখনও আসে না।

    কেমন করে জানলে? তুমি কি বাঘ দেখেছ কখনও? তবে? আমি বই-এ পড়েছি যে, বাঘ পশুর মধ্যে সবচেয়ে হিংস্র। তার হাতে পড়লে আর নিস্তার নেই।

    কিন্তু তার হাতে পড়বে কেন?

    পড়তে বাধাই বা কি? যেখানে ঘরের পাশে বন, বনের মধ্যে বাঘ! বন তো ঘরের পাশে নয়।

    অবশ্যই পাশে। কেটি বলছিল যে, পাশেই প্রকাণ্ড বন, কাল সেখানে বেড়াতে যাবে!

    ডরোথি, তুমি মিছে ভয় পাচ্ছ, তেমন বাঘের ভয় হলে এখানে মানুষ থাকতে পারত না। নাও, তুমি এখন ঘুমোও।

    পাশের ঘরে ছেলেরা ঘুমোচ্ছ, তাদের একবার দেখে আসি-বলল ডরোথি।

    যাও, কিন্তু জাগিও না।

    পাশের ঘরটিতে ফেলিক্স, পিটার, জ্যাভেজ ও ক্যাথারিনের শয়নের ব্যবস্থা হয়েছিল। ডরোথি সেই ঘরের দিকে গেল।

    এক মুহূর্ত পরে উধ্বশ্বাসে ফিরে এল ডরোথি।

    সর্বনাশ বিল, সর্বনাশ!

    আবার কি হল? বলল উদ্বিগ্ন কেরী।

    ঘরের মধ্যে প্রকাণ্ড একটা ভ্যাম্পায়ার।

    ভ্যাম্পায়ার! অবিশ্বাস ও পরিহাসের মাঝামাঝি স্বরে বলল কেরী। ভ্যাম্পায়ার বলে কোন প্রাণী নেই। তা ছাড়া ও ঘরটা অন্ধকার, কি দেখতে কি দেখেছ!

    রাগে দুঃখে জ্বলে উঠে পত্নী বলল, কি দেখতে কি দেখেছি। স্পষ্ট দেখেছি মস্ত পাখাওয়ালা কিস্তৃত পাখী ছেলেদের ঠিক মাথার উপরে নড়ছে।

    বল কি! এবারে কেরীর স্বরে বিশ্বাসের আভাস লেগেছে।

    চল নিজের চোখে দেখবে।

    দাঁড়াও,-এই বলে টেবিলের উপরে রক্ষিত মোমবাতিটা নিয়ে পাশের ঘরের দিকে রওনা হল কেরী, পিছনে ডরোথি। ঘরটার দরজার কাছে গিয়েই কেরী হো হো করে হেসে উঠল, বলল, ঐ দেখ, তোমার ভ্যাম্পায়ার আলোর জাদুতে কাঠের পায়। পরিণত হয়ে গিয়েছে!

    ভুল ভাঙতে ডরোথির বিলম্ব হল না। যদিচ ‘পাঙ্খা’ পদার্থটির সঙ্গে কেবল আজই সন্ধ্যায় তার পরিচয়, তবু ও বস্তৃটা যে পাখা ছাড়া আর কিছু নয়, অনিদ্রা পাখা পুলারের টানে নড়ছে, এ সত্য তাকেও স্বীকার করতে হল। তখন তার এতক্ষণের উপটীয়মান সমস্ত ক্রোধ এসে পড়ল স্বামীর উপর।

    ব্রহ্মাস্ত্রের সঙ্গে স্ত্রীজাতির ক্রোধের তফাৎ ঐখানে। নিক্ষিপ্ত ব্ৰহ্মাস্ত্র স্বর্গ মর্ত্য রসাতল খুঁজে লক্ষ্য না পেলে, ফিরে এসে আঘাত করে অস্ত্রীকে, আর স্ত্রীজাতির লক্ষ্যভ্রষ্ট ক্রোধ এসে পড়ে স্বামীর ঘাড়ে। কিন্তু সত্যই তফাৎ আছে কি? স্বামী-স্ত্রী যে অভিন্ন সত্তা। অভিন্ন সত্তা বটে, কিন্তু ভিন্নমুখ, পত্নী চন্দ্রের চিরোজ্জ্বল মুখ, স্বামীর মুখটা চিরন্তন নিষ্প্রভ।

    ডরোথি শয্যায় এসে বসে পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধের বাষ্প প্রভূত অশুতে ঝরতে শুরু হল–

    আমার এমনই কপাল যে তোমার মত লোকের হাতে পড়েছিলাম, নইলে এমন দেশে কেউ আসে যেখানে ঘরের পাশে বাঘ ডাকে আর ঘরের মধ্যে ভ্যাম্পায়ার উড়ে বেড়ায়!

    কিন্তু ডিয়ার, স্বচক্ষে তো দেখলে ওটা ভ্যাম্পায়ার নয়, ‘পাঙ্খা’!

    কিন্তু ধর যদি ভ্যাম্পায়ার হত?

    ভ্যাম্পায়ার বলে কিছু নেই।

    আমি বলছি অবশ্যই আছে। অপরিচিত দেশের সব রহস্য কি তুমি জান? আর তাছাড়া যে দেশে বাঘের ডাকে ঘুম ভেঙে যায়, সে দেশে জানপ্রাণ কতক্ষণ নিরাপদ? আচ্ছা, ভ্যাম্পায়ার না থাকুক, বাঘ তো আছে!

    কে অস্বীকার করছে?

    পারলে করতে, বলতে যে শেয়াল ডাকছে।

    সে কথা মিথ্যা নয়, শেয়াল আর বাঘ কাছাকাছি থাকে।

    তবে?

    যেন ঐ ‘তবে’ বলাতে ডরোথির জয় হল, যেন তর্কটার ওখানে চূড়ান্ত হয়ে গেল। তাই সে এবারে প্রসঙ্গ উল্টে বলল—আগামী মেলেই ছেলেদের আর কেটিকে নিয়ে আমি দেশে চলে যাব, এ হিদেনের দেশে এক দঙ থাকব না।

    কিন্তু ডিয়ার, ভুলে গেলে কেন যে হিদেনদের সত্যধর্মে দীক্ষিত করবার উদ্দেশ্যেই আমরা এখানে এসেছি!

    ‘আমরা’ নয়, বল ‘আমি’ এসেছি। তুমি সত্যধর্মে দীক্ষা দাও, আমরা ফিরে যাব।

    আগে আপত্তি করলে না হয় না আসতাম, কিন্তু এখন তো।

    কেরীর বাক্য শেষ হবার আগেই ডরোথি চীৎকার করে উঠল—একশ বার আপত্তি করেছিলাম। তখন আমাকে হাত করতে না পেরে ফেলিক্স, পিটার আর কেটিকে হাত করে নিয়েই তো আসতে বাধ্য করলে।

    কেরী মৃদু হেসে বলল, এখন যদি তারা যেতে রাজী না হয় তবে কি করবে?

    আমি একাই যাব জ্যাভেজকে নিয়ে। যাক ওরা বাঘের পেটে।

    এই বলে আবার সে চোখের ধারা ছেড়ে দিল, কাদতে লাগল ফুপিয়ে ফুপিয়ে।

    কেরী বুঝল এমন আর কিছুক্ষণ চললে ডরোথির হিস্টিরিয়া রোগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে, আর হিস্টিরিয়ার আক্রমণ একবার শুরু হয়ে গেলে বাড়িসুদ্ধ সবাইকে তুলবে অস্থির করে। নূতন জায়গায় প্রথম রাতেই সেটা হবে লজ্জার চরম।

    তখন সে নরম হয়ে বলল, ডরোথি ডিয়ার, এখন ঘুমোও, ফেরবার কথা ভেবে দেখব। তুমি যা বললে তার মধ্যে অনেক সার কথা, ভাববার কথা আছে।

    স্নেহময় বাক্যে ডরোথির মন অনেকটা নরম হল। ঝড় থামল কিন্তু ঝড়ের দোলা থামতে চায় না। সে শুয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল এবং কখন একসময় নিজের অজ্ঞাতসারে ঘুমিয়ে পড়ল।

    কেরী পত্নীকে, ভাল ভাবেই চিনত, জানত যে তার চিন্তায় ও কাজে দৃঢ়তা বলে কিছু নেই, সমস্ত বিষয়েই শেষ পর্যন্ত সে স্বামীর উপর নির্ভরশীল। তবে মাঝে মাঝে ঝোঁকের মাথায় ও হিস্টিরিয়ার প্রকোপে এক-একটা সঙ্কট সৃষ্টি করে বসা ডরোথির স্বভাব, কোন রকমে সেটা কাটিয়ে দিতে পারলেই আবার সে এসে পড়ে স্বামীর মুঠোর মধ্যে। কেরী বুঝল দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার অস্বাভাবিক জীবনের প্রতিক্রিয়ায় আজ রাত্রে দেখা দিয়েছিল এইরকম একটা সঙ্কট—তবে সেটা বড় রকম অনর্থ ঘটাবার আগেই গেল কেটে। পত্নীর কাছে তর্কের বেলায় হেরে কাজের বেলায় জেতে যে স্বামী তাকেই বলি বুদ্ধিমান।

    .

    ১.০৫ কলিকাতা দর্শন

    ব্রেকফাস্টের পর সকলে ড্রইংরুমে অপেক্ষা করছে এমন সময় রামরাম বসু ও পার্বতী ব্রাহ্মণ এসে পৌঁছল।

    কেরী বলল, মিঃ মুন্সী, তোমাদের জন্যেই আমরা অপেক্ষা করছিলাম, চল শহর দেখতে বের হব।

    রামরাম বসু বলল, চলুন, আমরা তৈরি।

    গাড়িবারান্দায় দুখানা বুহাম অপেক্ষা করছিল। প্রথমখানায় উঠল কেরী, কেরী পত্নী, ডাঃ টমাস, রামরাম বসু ও পার্বতী ব্রাহ্মণ। দ্বিতীয়খানায় উঠল মিস প্ল্যাকেট, মিস স্মিথ, ফেলিক্স কেরী ও জন স্মিথ। পিটার ও জ্যাভেজ বাড়িতেই রইল।

    প্রথমে এলিজাবেথ যেতে চায় নি, কিন্তু ক্যাথারিন কিছুতে ছাড়ল না, অগত্যা সে রাজী হল।

    কেটি বলল, যাবে না কেন? তুমি সঙ্গে থাকলে বেশ কথাবার্তা বলা যাবে।

    লিজা বলল, তাতে জন বোধ হয় খুশি হবে না, কি বল জন?

    জন বলল, সে কি কথা! তিনজন না হলে কি আলাপ জমে?

    লিজা বলল, আলাপ নানা রকমের।

    যেমন?

    এই ধর, প্রেমালাপ!

    ইউ নটি গার্ল!

    কথাটা কেটি শুনতে পায় নি, শুধাল, মিঃ স্মিথ কি বলছে?

    পাছে এলিজাবেথ একটা অদ্ভুত কিছু বলে বসে তাই জন তাড়াতাড়ি বলে উঠল না, এমন কিছু নয়। ও কেন যাবে না তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম।

    এলিজাবেথ বলল, জন, তুমি যখন বলছ যাচ্ছি, কিন্তু ‘ফ্লাই ইন দি অয়েন্টমেন্ট’ না হয়ে থাকি।

    সে দেখা যাবে, এখন চল তো।

    গাড়ি দুখানা ফটক থেকে বেরিয়ে বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড ধরে চৌরঙ্গীর দিকে চলল। যে শহরে জীবনের শ্রেষ্ঠ একচল্লিশ বৎসর কাটবে সেই কলকাতা তার বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব নিয়ে কেরীর চোখে হেমন্তপ্রভাতের স্নিগ্ধ আলোয় এই প্রথম উদ্ভাসিত হল।

    বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোডের দুদিকে প্রকাণ্ড হাতাওয়ালা বড় বড় সব বাড়ি, অধিকাংশ বাড়িই একতলা, তবে বাড়ির সংখ্যা বেশি নয়, বড়জোর দশ-বারোটা হবে।

    চৌরঙ্গী রোডে গাড়ি পৌঁছতেই মিসেস কেরী সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল—ও কি, ঐ লোকটা অমন করে রাস্তার উপর গড়াচ্ছে কেন?

    সকলে দেখল সত্যই একটা লোক একবার রাস্তার উপর সটান উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ছে আবার উঠে দাঁড়িয়ে কি যেন বিড় বিড় করে বলছে, তার পর আবার আগের মতই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে সুমুখে হাত বাড়িয়ে পথের উপর দাগ কাটছে।

    কেরী-পত্নী বলল, লোকটা বোধ হয় পাগল, গায়ে তো বস্ত্র নেই দেখছি।

    রামরাম বসু বলল, না মিসেস কেরী, লোকটা মোটেই পাগল নয়। ও চলেছে কালীঘাটের মন্দিরে। কোন কারণে এইভাবে কালীমন্দিরে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল, এখন সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে।

    ও কত দূর থেকে আসছে?

    ওর গ্রাম থেকে, হয়তো বিশ-ত্রিশ মাইল হবে, হয়তো আরও বেশি হবে।

    এ যদি পাগলামি না হয়, তবে পাগলামি আর কি?

    পার্বতী বলল, আমরা ওর আচরণকে ধর্ম বলে মনে করি।

    মিসেস কেরী অপ্রসন্ন মুখে বলল, ঘোর কুসংস্কার!

    পাদ্রী টমাস বলল, এবারে ডাঃ কেরী এসে পৌঁছেছে, এখন ওসব দূর হয়ে যাবে।

    কেরী প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে শুধাল, ঐ দিঘিটার নাম কি?

    বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড ও চৌরঙ্গী রোডের মোড়ে একটা বড় দিঘি সবাই দেখল।

    টমাস বলল, ওটার এখনও কোন নামকরণ হয় নি, সবে দু বছর তৈরি হয়েছে, সবাই এখনও নিউ ট্যাঙ্ক বা নঈ তলাও বলে। কি বল বসু?

    রাম বসু বলল, হাঁ, ঐ নামেই চলছে। আর ঐ যে ছোট রাস্তাটা ডান হাতে বেরিয়ে গিয়েছে ওটার নাম ঝাঝরিতলাও রোড।

    কেরী বার-দুই উচ্চারণ করল, ‘তলাও’, ‘তলাও’! বলল, আচ্ছা তলাও মানে কি?

    তলাও মানে ট্যাঙ্ক, বলল একসঙ্গে পার্বতীচরণ, রাম বসু ও টমাস।

    ঐ রাস্তাটার উপরে ঝাঁঝরি বা ল্যাটিওয়ার্ক ঘেরা একটা তলাও আছে, তাই থেকে রাস্তাটার নাম হয়েছে ঝাঝরিতলাও বোড়।

    কেরী বলল, রাস্তার পশ্চিমে আগাগোড়া জঙ্গল দেখছি।

    রাম বসু বলল, ঐ জঙ্গলের মাঝে মাঝে আছে বড় বড় সব জলা, আর তার চারদিকে নলখাগড়ার বন।

    টমাস বলল, এখন তো জঙ্গল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, দশ বছর আগে যা দেখেছি।

    এর চেয়েও বেশি ছিল নাকি?

    বেশি? ওয়ারেন হেস্টিংস ওখানে হাতী নিয়ে বাঘ শিকারে আসত।

    ‘বাঘ’ শব্দে মিসেস কেরী কান খাড়া করল।

    কেরী দেখল, সমূহ বিপদ। সে বুঝেছিল বাঘ জটার চেয়ে বাঘ শব্দটা কম মারাত্মক হবে না মিসেস কেরীর কাছে। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আশায় শুধাল, এখানে নিশ্চয়ই নয়?

    টমাস বলল, না, ঠিক এখানে নয়, আর একটু দক্ষিণে, বির্জিতলাও বলে সে জায়গাটাকে।

    রাম বসু তো কেরীর রাত্রির অভিজ্ঞতা জানে না, পাছে বাঘের আশঙ্কায় ঘাটতি পড়ে দেশের গৌরব কমে, তাই বলল, অতদিনের কথায় কাজ কি, এই সেদিন আমরা দিনের বেলায় খিদিরপুরে নালার কাছে বাঘের মুখে পড়েছিলাম কেমন না, পার্বতী দাদা?

    বাঘ বলে বাঘ! সারা অঙ্গে কালো কালো ডোরা কাটা। মনে পড়লে এখনও গা শিউরে ওঠে—এই বলে পার্বতী একবার নড়ে-চড়ে বসল।

    কেরী ভাবল, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যাগম ঘটে।

    মিসেস কেরী স্বামীর দিকে তাকিয়ে ধিক্কারের সুরে বলল—ভাল দেশে এনেছ।

    এমন সময় একটা হাতী দেখে কেরী ভাবল, যাক, হাতীতে আজ রক্ষা করল বাঘের হাত থেকে।

    কেরী বলল, ঐ দেখ।

    সকলে দেখতে পেল গজেন্দ্রগমনে প্রকাণ্ড এক হাতী চলেছে, কাঁধের উপরে তার মাহুত, আর পিছনে জন দুই-তিন বর্শাধারী পাইক।

    কিন্তু কেরী আজ এত সহজে রক্ষা পাবে না।

    মিসেস কেরী উদ্বিগ্নভাবে বলল, বাঘ শিকারে চলেছে বুঝি?

    টমাস ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছিল, তাই বলল, না না, এদিকে বাঘ কোথায়? আর দু-চারটে থাকলেও তারা মানুষ খায় না।

    কেন, সবাই বাইবেল পড়েছে বুঝি?–পত্নীর এবম্বিধ অখ্রীষ্টানোচিত উক্তিতে মর্মাহত কেরী প্রমাদ গুনল।

    রামরাম বসু মনে মনে বলল—বাঘগুলো এখনও বাইবেল পড়ে নি তাই রক্ষা!

    রাস্তার দু পাশে বরাবব কাঁচা নালা, মাঝে মাঝে যেখানে বেশি জল জমেছিল সেখানে এখনও জল শুকোয় নি। জলে অনেকদিনের অনেকরকম আবর্জনা পচে দুর্গন্ধ উঠছে; যেখানে আবর্জনার স্তূপ বেশি সেখানে কুকুরে শালিখে কাকে টানাটানি শুরু করেছে। এমন সময়ে উৎকট পচা গন্ধে সকলে সচকিত হয়ে উঠল। কিন্তু অধিক সন্ধান করতে হল না—একটা মৃত অধভুক্ত নরদেহ আড়াআড়ি ভাবে রাস্তার উপরে শায়িত, গোটা চার-পাঁচ বীভৎস শকুনি মাংস ছিঁড়ছে। গাড়ির চাকার শব্দে তারা উড়ে নালার ওপারে। গিয়ে বসল। এতক্ষণ গোটা দুই কুকুর শকুনের পাখাশাপটের ভয়ে কাছে ঘেঁষতে পারছিল না, সুযোগ বুঝে এবারে তারা মৃতদেহের উপরে গিয়ে পড়ল। ওদিকে স্বত্ব যায় দেখে শকুনিগুলো পাখা ঝাপটে কর্কশ ধ্বনি শুরু করে দিল।

    বাঘের আশঙ্কায় কেরী-পত্নী ভয় পেয়েছিল মাত্র, কিন্তু এ দৃশ্যে তার এমন জুগুপ্সা উপজাত হল যে, নাকে চোখে রুমাল চাপা দিয়ে গাড়ির পিঠদানিতে মুখ খুঁজল, কেবল মাঝে মাঝে বলতে লাগল—মাই গড! এ যে নরক, এ যে নরক!

    সঙ্কীর্ণ কাঁচাপথ, তাতে অসমান। বর্ষার কাদা চক্রচিহ্নে শতধা-বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, এতদিনে তা শুকিয়েছে বটে, কিন্তু এখনও বন্ধুরতা লোপ পায় নি, তার উপরে ঘটেছে ধুলোর প্রাদুর্ভাব। রোদ বাড়বার সঙ্গে যানবাহনের চলাচল বাড়ল, উড়ল পাঁশুটে রঙের ধুলো। চিত্রবিচিত্র করা পালকি চলেছে বেহারাদের কিছুত সুরের তালে তালে; ফিটন, বুহাম, ল্যাভো, বগি, ব্রাউনবেরি চলেছে ঘোড়ার ক্ষুরে ক্ষুরে প্রচুর ধুলো উড়িয়ে; কখনও বা টাটুঘোড়ায় স্বল্পবেশ আরোহী, বাঁক কাঁধে চলেছে গাঁয়ের লোক, প্রকাণ্ড গোলপাতার ছাতা মাথায় পথিক, আর গাড়ি একটু থামবামাত্র এসে জোটে ভিক্ষুকের দল, ছেলে-বুড়ো, স্ত্রীলোক। কেরী ও কেরী-পত্নীর চোখে সবই নূতন। কেরী ভাবে, এই তো সত্যধর্ম প্রচারের উপযুক্ত স্থান; কেরী-পত্নী ভাবে, একগুঁয়ে স্বামীর হাতে পড়ে সভ্যজগতের বাইরে এসেছি, পাশেই সেই ভয়াবহ স্থান নরক!

    ঐ সুন্দর বাড়িটা কার? শুধায় কেরী।

    মিঃ লিসে নামে একজন ইংরেজের, আসাম থেকে হাতী আর কমলালেবু চালান দিয়ে বিস্তর টাকা করেছে লোকটা, বলে রামরাম বসু।

    চৌরঙ্গী রোডের পুবদিক বরাবর বড় বড় হাতাওয়ালা বাড়ি, পশ্চিমদিকের মাঠে জলা-জঙ্গল আর নলখাগড়ার বন।

    এ রাস্তাটা কোন দিকে গেল?

    নেটিভ পল্লীর ভিতর দিয়ে শহরের পুবদিকে জলা পর্যন্ত গিয়েছে।

    কি নাম রাস্তাটার?

    জানবাজার রোড, ফেরবার সময় আমরা এই পথেই ফিরব।

    প্রশ্নোত্তর চলে কেবী ও টমাসের মধ্যে।

    গাড়ি আর একটু এগোতেই হঠাৎ টমাস বলে ওঠে, এই কোচম্যান, রোখো রোখো।

    গাড়ি থামে।

    টমাস বলে, ডাঃ কেরী, এই চৌমাথার ভূগোল তোমাকে বুঝিয়ে দিই, আশা করি চিত্তাকর্ষক হবে।

    এই বলে টমাস শুরু করে-চৌরঙ্গী রোডের এখানে শেষ, এবারে ঐ শুরু হল কসাইটোলা স্ট্রীট। এ রাস্তাটাকে কলকাতার চীপসাইড বলা যেতে পারে। ইওরোপীয়, আর্মেনিয়ান, চীনা আর নেটিভদের যত-সব নামকরা বড় বড় দোকান কলকাতার চীপসাইড এই কসাইটোলাতে। খাট-চৌকি-পালঙ থেকে পোশাক-আশাক খাদ্যখানা সব মিলবে এখানে। মিসেস কেরী, তুমি যেন এ রাস্তাটার নাম ভুলো না। কলকাতায় ঘর করতে হলে Daintic Davie’-র দোকানে আসতেই হবে। আর কিছু নয়, শুধু একখানা ফর্দ রেখে গেলেই দু ঘণ্টার মধ্যে সব জিনিস তোমার কুঠিতে পৌঁছিয়ে দেবে।

    মিসেস কেরী বিরক্তির সঙ্গে বলল, আমি চৌরঙ্গীর নরক পার হয়ে Daintie Davie কেন, স্বর্গেও যেতে রাজী নই।

    তবে তোমার সরকারকে অর্থাৎ নেটিভ স্টুয়ার্ডকে হুকুম করলেই এনে দেবে। কিন্তু সত্য কথা কি জান, নিজে আনাই ভাল।

    কেন?

    ওরা টাকার উপর দু আনা দস্তুরি চাপিয়ে বিল করে।

    তার মানে, চোর?

    মিসেস কেরী, চোরের দাবী এত বেশি নয়, ওরা ডাকাত!

    আর এদের উদ্ধার করবার জন্যেই এসেছে ডাঃ কেরী–বলে রুষ্ট মিসেস কেরী।

    ডরোথি, ওদেরই তো আলোর বেশি প্রয়োজন।

    তার আগে ওরা তোমার নিজের ঘর অন্ধকার করে ছাড়বে।

    কি করে ডিয়ার?

    তোমার তেল চুরি করে।

    যখন কেরী, কেরী-পত্নী ও টমাসের মধ্যে এইসব কথাবার্তা হচ্ছিল, রামরাম বসু ও পার্বতী মনে মনে অস্বস্তি অনুভব করছিল, ভাবছিল ওরা আমাদের কোন দলের অন্তর্গত ভাবে, চোর না ডাকাত?

    টমাস বলল, আর এই যে রাস্তাটা পুবদিকে গিয়েছে এটার নাম ধর্মতলা। এ রাস্তাটা গিয়েছে দেশী পাড়ায়, অবশ্য কিছু কিছু গরিব ফিরিঙ্গিও বাস করে এদিকে।

    কেরী বলল হাঁ, পাড়াটাকে নিতান্ত দীন বলেই মনে হচ্ছে।

    মাঝখান দিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা, দুদিকে আম কাঁঠাল তেঁতুল বনের মধ্যে গোলপাতার কুঁড়েঘর, কোথাও বা আগাছায় ভরা জলা জমি, আবার কোথাও বা দু-চারখানি পাকা বাড়ি।

    মিসেস কেরী বলে উঠল, ওদিকটায় আমি যেতে রাজী নই।

    না না, ওদিকে যাব কেন, আমরা যাব পশ্চিমদিকে। এই কোচম্যান, চল এসপ্ল্যানেড রো বরাবর—হুকুম করে টমাস।

    গাড়ি এসপ্লানেড রো ধরে চলে।

    টমাস বলে, কাল রাতে আমরা এই পথ দিয়ে এসেছিলাম।

    একটু পরে আবার টমাস আরম্ভ করে—এবারে আমরা ওন্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীটে এসে পড়েছি। এই রাস্তাটা দক্ষিণদিক বরাবর খিদিরপুর, গার্ডেনরীচ, আলিপুর পর্যন্ত চলে গিয়েছে।

    তার পর বিশেষভাবে মিসেস কেরীকে লক্ষ্য করে বলে, একদিন ওদিকে তোমাকে নিয়ে যাব। খুব সুন্দর আর রুচিসঙ্গত সব বাড়িঘর। এদিকটা দেখে তোমার যে অরুচি হয়েছে তার প্রতিকার আছে ঐদিকে।

    এমন সময় কেরী বলল, ডরোথি, ঐ প্রকাণ্ড জানোয়ারটা কি বলতে পার?

    ডরোথি বলল, কেমন করে জানব, আগে কখনও দেখি নি!

    ওটা উট।

    উট!

    ডরোথি অবাক!

    ওর পিছনে ওটা কি?

    এবারে টমাস বলল, গাড়ি। এ দেশে উটের গাড়ি চলে। অনেক জায়গায় ও ছাড়া অন্য যানবাহন নেই।

    ডরোথির বিস্ময় আরও বাড়ে। তার মনে উটের সঙ্গে সাহারার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গিয়েছে! এহেন স্থানে সেই উট! পিছনে আবার একটা মস্ত উঁচু গাড়ি জোতা। বিস্ময়ে সে যখন হতবুদ্ধি ও নিস্তব্ধ এমন সময় হঠাৎ চমকে উঠল—

    ওগুলো কি? ওগুলো কি পাখী?

    গোটাকয়েক হাড়গিলে কোথা থেকে উড়ে এসে মোড়ের মাথায় বড় বাড়িটার আলসের উপর বসল।

    মিসেস কেরী শুধায়—প্রকাণ্ড পাখী! ঈগল নাকি?

    না, ওগুলোকে বলে হাড়গিলে, Bone-swallower!

    কোথায় থাকে?

    রামরাম বসু বলল, মাঠের মাঝে যেসব বড় বড় জলা আছে সেখানে ওদের বাস।

    এত বড় বাড়িটা খালি পড়ে আছে কেন?–সেই বাড়িটা দেখিয়ে শুধায় কেরী।

    ডাঃ কেরী, এত বড় বাড়িতে থাকবে কে? বিশেষ ভিতরটা ভেঙেচুরে গিয়েছে!

    নিশ্চয় খুব শৌখিন লোক থাকত?

    তোমার অনুমান মিথ্যা নয়, এক সময়ে ওয়ারেন হেস্টিংস বাস করত এখানে। এই যে সামনেই পাশাপাশি গভর্নরের কুঠি আর কাউন্সিল হাউস।

    এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়।

    সেটাই তো এখানকার ইংরেজ সমাজের অভিযোগ। তারা বলে, এর চেয়ে বড় বাড়ি অনেক সওদাগরের আছে।

    টমাস বলে চলে-মিসেস কেরী, ঐ যে দূরে চাঁদপাল ঘাট, আর ঐ গঙ্গা–হিন্দুদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র নদী।

    মিসেস কেরী অস্পষ্টভাবে কি বলল বোঝা গেল না; ভালই হল, কারণ খুব সম্ভব সে-কথা উপস্থিত দুইজন হিন্দুর রুচিকর বোধ হত না।

    টমাস বলছে—এবারে আমরা কাউন্সিল হাউস স্ট্রীট ধরে উত্তরমুখে ঘুরেছি—আর চলেছি কলকাতার সবচেয়ে পুরনো, ঐতিহাসিক ঘটনাপূর্ণ অংশে। ডাঃ কেরী, এখানকার প্রত্যেক ইষ্টকখও বিচিত্র ইতিহাসের দ্বারা চিহ্নিত। ঐ যে সুপ্রীম কোর্ট, নেটিভরা বলে কি বলে মুন্সীজি?

    বড় আদালত।

    ঠিক ঠিক। বরা আদালত, অনুবৃত্তি করে টমাস।

    ডাঃ কেরী, মিসেস কেরী, এবারে আমাদের নামতে হবে, সুমুখেই সেন্ট জনস চার্চ, কলকাতার সবচেয়ে বড় গির্জা, এই সেদিনমাত্র তৈরি হয়েছে। ঐ যে গায়ে তারিখটা

    স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে—‘১৭৮৭ অ্যানো ডমিনি’।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচার-ইয়ারী কথা – প্রমথ চৌধুরী
    Next Article উইংস অব ফায়ার – এ পি জে আবদুল কালাম
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Our Picks

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    দ্য জাহির – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025

    ভুলবে সে গান যদি – প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.