Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেরী সাহেবের মুন্সী – প্রমথনাথ বিশী

    প্রমথনাথ বিশী এক পাতা গল্প546 Mins Read0

    ৩.১৬-২০ ননদ-কাঁটা

    ৩.১৬ ননদ-কাঁটা

    পরদিন জন বিনা ভূমিকায় লিজাকে বলল, লিজা, আমি স্থির করেছি বিয়ে করব।

    লিজা এমন প্রস্তাবের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, তাই হঠাৎ উত্তর দিতে পারল না। তার নীরবতা খুঁচিয়ে উত্তর আদায় করবার আশায় আবার জন বলল, কি, উত্তর দিলে না যে? এবারে লিজাকে কথা বলতে হল, বলল, এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে।

    জন বলল, মুখে যাই বল না কেন, তোমার আনন্দ যে হয় নি তা মুখ দেখেই বুঝতে পারছি।

    লিজা বলল, আনন্দ না হওয়ার কারণ তো দেখছি না।

    সত্য বলতে কি, জনের প্রস্তাবে লিজা হকচকিয়ে গিয়েছিল। রোজ এলমারের সমাধিতে ঘাস গজাবার আগেই এমন প্রস্তাবের প্রত্যাশা করে নি সে জনের কাছে। সে মনে মনে ভাবলধন্যি এই পুরুষ জাতটা!

    জন বলল, আনন্দের কারণ থাক আর নাই থাক, আমি মনঃস্থির করে ফেলেছি।

    লিজা হেসে বলল, জন, শুধু সঙ্কল্পে তো বিয়ে হয় না, একটা পাত্রীও প্রয়োজন হয় বলে জানি।

    অবশ্যই একজন পাত্রী আছে।

    এবার কে সেই সৌভাগ্যবতী জানতে পারি কি?

    ‘এবার’ শব্দটার খোঁচা বিঁধল গিয়ে জনের মর্মে, সে নিতান্ত বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, এবারে ছাড়া আর কোনবার বিয়ের প্রস্তাব করেছি শুনতে পাই কি?

    লিজা অবশ্য ইচ্ছা করলে কেটি ও রোজ এলমারের নাম করতে পারত, কিন্তু সেদিক দিয়ে গেল না, বলল, কিছু মনে কর না জন, মনটা ভাল নয়, তাই হয়তো কি বলতে কি বলে ফেলেছি।

    জন বলল, আশা করি মন খারাপের কারণ আমার প্রস্তাবটা নয়?

    নিশ্চয়ই নয়। তার পরে বলল, কথা কাটাকাটি থাক, এবারে মেয়েটির নাম বল।

    লিজা ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি জন ও রেশমীর ঘনিষ্ঠতা।

    এবারে জনের উত্তর দেওয়ার পালা। বিয়ের প্রস্তাবটা সে ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলেছিল বটে, কিন্তু অত সহজে মেয়ের নামটা মুখে এল না তার। গতকাল সন্ধ্যাতেও রেশমীকে বিয়ে করবার ইচ্ছা তার মনে ছিল না, কিন্তু রেশমীর পলায়ন ও তার চিঠি প্রচণ্ড একটা রোখ জাগিয়ে দিয়েছিল তার মনে। বিশেষ রেশমী যে লিখেছিল ‘সংস্কার অন্তরায়’, তার স্বকৃত ভাষ্য করে নিয়েছিল জন; সে ধরে নিয়েছিল যে, কোন সৎঘরের মেয়ে বিয়ের আগে আত্মসমর্পণ করে না। রেশমীর চিঠিখানা পড়ে অনেকক্ষণ সে মাথায় হাত দিয়ে বসে ভেবেছিল, তার পরে মনে হয়েছিল, ভাল, রেশমী যদি তা-ই চায় তবে বিয়েই করব। জনের মত ভাবালু লোক নীতি বা সঙ্কল্পের দ্বারা চালিত হয় না, চলে ঝোকের মাথায়। সেই ঝোঁকটা থাকতে থাকতে তারা অসাধ্যসাধন করতে পারে, ঝোক চলে গেলেই তারা চরম অসহায়।

    জনকে নীরব দেখে লিজা হেসে বলল, কি জন, আগে বিয়ের সঙ্কল্প স্থির করে এখন বুঝি মেয়ের নাম ভাবতে বসলে? না জন, এমন ছেলেমানুষি ভাল নয়।

    ছেলেমানুষি দেখলে কোথায়? মেয়ে তো স্থির আছে।

    তবে নামটা বলে ফেল।

    কিন্তু নামটা এত সহজে আসতে চায় না জনের মুখে, তার মনে পড়ল রেশমীর চিঠি—’সংস্কার অন্তরায়।‘

    লিজা বলল, এস আমরা ভাগাভাগি করে নিই, তুমি সঙ্কল্প স্থির করেছ, আমি এখন মেয়ে স্থির করি।

    ধন্যবাদ লিজা, তোমাকে কষ্ট করতে হবে না, মেয়েটির নাম রেশমী।

    বজ্ৰচালিত হয়ে লিজা বলে উঠল, রেশমী! আর কোন কথা বের হল না তার মুখে।

    কি, চুপ করে রইলে যে?

    এ যদি পরিহাস না হয় তবে নিতান্ত মূঢ়তা!

    কেন, শুনতে পাই কি?

    সে যে নেটিভ।

    কেন, নেটিভ কি মানুষ নয়?

    ওসব তর্কের মধ্যে যেতে চাই নে জন, আমি বলছি এ অসম্ভব।

    কেন অসম্ভব? এই কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নকের কি নেটিভ পত্নী ছিল না?

    সে একশ বছর আগেকার কথা ছেড়ে দাও, তখন কজন শ্বেতাঙ্গ ছিল এ শহরে?

    তাই বলে বিয়েটা কি বিয়ে হয় নি?

    লিজা বলল, সেদিন কলকাতায় শ্বেতাঙ্গ সমাজ বলে কিছু ছিল না, সব কিছু চলত। আজকে তুমি নেটিভ বিয়ে করলে আমরা একঘরে হব।

    বিয়ের পরে আমার ঘরে কেউ না এলে আমি দুঃখিত হব না।

    কিন্তু আমাকেও যে ছাড়তে হবে এ ঘর।

    তোমাকে তো একদিন ছাড়তেই হবে, তুমি কি বিয়ে করবে না?

    লিজা বলল, ইচ্ছে ছিল করব, কিন্তু তোমাদের পুরুষদের ব্যবহার দেখে সে ইচ্ছা আর বড় নেই।

    আমার ব্যবহারে কি দোষ দেখলে শুনি?

    লিজা ইচ্ছে করলে রোজ এলামারের প্রসঙ্গ তুলতে পারত, কিন্তু আর আঘাত দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না জনকে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, জন, সব কথা ভেবে দেখ নি, ও যে বিধর্মী।

    কথাটা সত্যই ভেবে দেখে নি জন। কিন্তু হটবে কেন, বলল, ধর্মান্তর গ্রহণ করবে।

    কণ্ঠস্বর কোমল করে লিজা বলল, না না জন, এসব ছেলেমানুষি ছাড়।

    লিজার কণ্ঠে স্নেহের স্পর্শ পেয়ে জনও নরম হল, শুধাল, তবে কি করতে বল?

    আমি বলি রেশমীর প্রসঙ্গটাই ভুলে যাও, আর যদি নিতান্তই ভুলতে না চাও, তবে অনেক শ্বেতাঙ্গ যেমন নেটিভ মেয়ে রাখে, তেমনিভাবে ওকে রাখ না কেন!

    মুহূর্তে অগ্নিদীপ্তবৎ জ্বলে উঠে জন বলল, মুখ সামলে কথা বল লিজা, অপমান কর না আমাকে।

    এই বলে সে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হল। লিজারও প্রচণ্ড রাগ হল, বলল, কি, চললে কোথায়? আশা করি তোমার রেশমীকে নিয়ে একবারে গির্জায় চললে না?

    উত্তর না দিয়ে জন হন হন করে বেরিয়ে চলে গেল।

    লিজা ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। কিন্তু শান্তি কোথায়, স্বস্তি কোথায়? ভূমিকম্প অন্তে গৃহস্থ সযত্নসজ্জিত গৃহে প্রবেশ করে যেমন চমকে ওঠে, দুদণ্ড আগের চিরপরিচিত গৃহে যেমন নিজেকে অপরিচিত বোধ করে, আপন গৃহকুটিরে যেমন পা ফেলতে ভয় পায়, তেমনি অবস্থা হল লিজার। তার চোখের সামনে দেওয়ালগুলোয় দুঃস্বপ্নের পাণ্ডুরতা, ছাদের কড়িকাঠগুলো অদৃষ্টের শাসনদণ্ডের মত উদ্যত, প্রকাণ্ড আয়নাখানায় নিষ্ঠুর পরিহাসের দীপ্তি, আসবাবপত্রের অতি মসৃণ কোমলতা জল্লাদের অতি-বিনয়ের মত মর্মান্তিক, এক মুহূর্ত আগের সুখবাস পরমুহূর্তে আশার সমাধিতে পরিণত। হঠাৎ চোখ। পড়ল দুখানা তৈলচিত্রের উপরে, তার পিতামাতার ছবি, অমনি বান ডাকল চোখে, সে বানের অন্ত নেই, স্মৃতির চির-নীহারপ দিচ্ছে অফুরান যোগান। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

    কিন্তু কেঁদে কর্তব্য সমাপ্ত করবার মেয়ে লিজা নয়। মাতার মৃত্যুর পরে সংসারের দায়িত্ব বহন করতে গিয়ে তৈরি হয়ে উঠেছে তার চরিত্র, তাতে থেকে সোনায় লোহায় সম ভাগে মিশে তাকে করে তুলেছে যেমন সুন্দর তেমনি সুদৃঢ়। চোখের জলের প্রথম বন্যা চলে গেলে সে উঠে বসে কর্তব্য স্থির করে ফেলল, মনে মনে বলল, এ ঘরে প্রবেশ করতে দেব না ঐ নেটিভ মেয়েটাকে! তখনই সে দুপুরবেলা একবার দেখা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে রেশমীর নামে একখানা চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলে চাকর দিয়ে। তার পর সে আবার প্রফুল্লমনে কাজে লেগে গেল।

    রেশমী চিঠি পড়ে বুঝল যে, একবারে ‘অদ্য যুদ্ধ ত্বয়া ময়া’! সে বুঝল যে, এর মূলে আছে নির্বোধ জনের কোন কাজ বা উক্তি, ভাবল এখন আর ফেরবার উপায় নেই, দেখতেই হবে চরম দাঁড়িটানা পর্যন্ত। চাকরকে বলে দিল যে, মেমসাহেবকে জানিও, আমি দুপুরবেলা নিশ্চয় যাব।

    ঘটনাগুলো সব সময়ে সমচালে চললে সংসার হয়তো সুখের হত, কিন্তু জীবনের নাটক এমন জমে উঠত কিনা সন্দেহ। ঘটনাগুলো নিয়মিতভাবে চলতে চলতে হঠাৎ মাঝে মাঝে রত্নাকর দস্যুর মত অতর্কিতে ঘাড়ে এসে পড়ে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়, জীবনের পূর্ব শৃখলা নষ্ট হয়ে যায়, জীবননাটক অপ্রত্যাশিত অঙ্ক পরিবর্তন করে। এখানেও তাই ঘটল। রেশমী, জন ও লিজার জীবন বেশ চলছিল, এবারে এল অঙ্ক পরিবর্তনের পালা।

    দুপুরবেলা, জন তখন আপিসে, রেশমী লিজার বাড়িতে এসে পৌঁছবামাত্র অতিবিনয়ের প্রচ্ছন্ন বিদ্রপে লিজা তার অভ্যর্থনা করল; আগেও করেছে, কিন্তু তাতে এমন ঘাতকের খড়ের চিক্কণ ভাস্বরতা ছিল না। রেশমী বুঝল, এই অতিভদ্রতা আসন্ন অভদ্রতার ভূমিকা ছাড়া আর কিছু নয়। সে প্রস্তুত হয়েই এসেছিল, এখন মনটাকে ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে আরও সচেতন করে নিল।

    লিজা বিনা ভূমিকায় বলল, এস রেশমী বিবি, বাড়িঘর সব বুঝে নাও, কেমন দেখছ সব?

    বুঝেও না বোঝবার ভান করে রেশমী বলল, তোমার কর্তৃত্বে কি কিছু খারাপ থাকতে পারে, সব চমৎকার!

    আর আমার কর্তৃত্বের কথা কেন তুলছ? এখন তো সব তোমার।

    রেশমী সরাসরি উত্তর না দিয়ে হাসল।

    রেশমীর প্রশান্ত অটলতায় লিজা হাড়ে হাড়ে চটে গেল। সে ভেবেছিল রেশমী রাগ করবে, রাগ করলে তার কাজ সহজ হত, ক্ষুরধার ব্যঙ্গ প্রয়োগের পথ অনায়াস। হয়ে আসত। সে ভাবল, কি মুশকিল, এ যে রাগে না। কিন্তু তাই বলে তো চুপ করে থাকা চলে না। তখন প্রকাও একটা ঝড়ের মত সে ভেঙে পড়ল রেশমীর ঘাড়ে।

    লিজা শুধাল, তা শুভ বিবাহটা হচ্ছে কবে? রেশমী বুঝল, সর্বনাশ! জন এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছে। নির্বোধ। ভাবল, বোকা সেজে শুনে নিই কতদূর কি গড়িয়েছে।

    মুখে কিছু প্রকাশ না করে বলল, বিবাহ! কার সঙ্গে?

    আহা, কচি খুকিটি আর কি, কিছুই জানে না! জনের সঙ্গে! নির্বোধ জনের সঙ্গে।

    রেশমী বুঝল, ‘সংস্কার অন্তরায়’-এর কি ভাষ্য জন করেছে। সে বলল, জন নির্বোধ হতে পারে, আশা করি মিথ্যাবাদী নয়, তার মুখেই সব শুনতে পাবে।

    কেন, তোমার হিন্দু-মুখে বাধছে বুঝি বিধর্মীকে বিয়ে করবার সংবাদটা?

    হিন্দু-মুখ আর খ্রীষ্টান-মুখের প্রভেদ আমার কাছে নেই মিস স্মিথ।

    ওঃ, দুই মুখ বুঝি এক হয়েছে! কতবার?

    মৃদু হেসে রেশমী বলল, অনেকবার।

    আর কতদূর গড়িয়েছে, শুনতে পাই কি?

    অনেকদূর। বিশদ বিবরণ মিঃ স্মিথের কাছে শুনে নিও।

    তাই বুঝি গড়াতে গড়াতে এখন বিয়ে পর্যন্ত এসে পৌঁছবার উপক্রম… শয়তানী!

    এই জন্যেই কি দুপুরবেলা ডেকে পাঠিয়েছিলে মিস স্মিথ?

    না, শুধু এইজন্যে নয়, আরও কিছু আছে। জান, লাট সাহেবকে বলে এ বিয়ে বন্ধ করে দিতে পারি?

    রেশমী শান্তভাবে বলল, যতদূর জানি তেমন কোন আইন নেই কোম্পানির।

    ওঃ, আইনও জানা আছে দেখছি! তবে নিশ্চয়ই জান যে হিন্দুর সঙ্গে খ্রীষ্টানের বিবাহ চলে না।

    কিন্তু এও জানি যে হিন্দুর খ্ৰীষ্টান হতে বাধা নেই।

    সত্যকার বিস্ময়ে লিজা বলল, তুমি খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করবে?

    খ্রীষ্টানের ঘর করতে চলেছি, খ্রীষ্টান না হলে চলবে কেন?

    লিজা বলল, শুনেছি তোমরা হিন্দুরা সব করতে, পার কিন্তু ধর্মত্যাগ করতে পার না!

    কিন্তু যা শোন নি তা শুনে রাখ, হিন্দু নারী পতির জন্য সবরকম ত্যাগ স্বীকার করতে পারে।

    লিজা বলল, দিতে পারবে তার জন্যে তোমার পৈতৃক ধর্ম জলাঞ্জলি?

    ভালবাসার পাত্রকে অদেয় কিছুই নেই। সংসারে এমন কিছু থাকতেই পারে না। যা ভালবাসার পাত্রের জন্যে অত্যাজ্য!

    ধর্মও?

    ধর্ম, ইহকাল, পরকাল, জীবন, যৌবন–সমস্ত।

    লিজা বুঝল, এ মেয়ে অসাধারণ; আরও বুঝল, এ পর্যন্ত জয় হল রেশমীর। তাতেই তার রাগ গেল বেড়ে। এতক্ষণ ভদ্রতার সীমার মধ্যেই কলহ চলছিল, এবারে বুঝি সে সীমা লঘিত হল।

    কি দিয়ে নির্বোধ জনকে ভোলালে শুনতে পাই কি?

    নিশ্চয়ই। রূপ দিয়ে মিস স্মিথ, রূপ দিয়ে—সগর্বে বলল রেশমী।

    এতখানি স্পষ্টবাদিতা আশা করে নি লিজা।

    লিজাকে নীরব দেখে রেশমী বলল, আর তাতে দোষটাই বা কি মিস স্মিথ? সব নারীই পুরুষকে ভোলাতে চায়, কেউ রূপ দিয়ে, কেউ ধনমান বংশমর্যাদা দিয়ে, আর কেউ বা শুধু বন্ধুত্ব আলাপ-আপ্যায়ন দিয়ে। কেউ পারে, কেউ পারে না।

    এই বলে কটাক্ষ নিক্ষেপ করল লিজার দিকে। মেরিডিথ ও রিংলারের সঙ্গে লিজার ব্যর্থ প্রণয়ের ইতিহাস সে শুনেছিল জনের কাছে।

    রেশমীর ইঙ্গিতে জ্বলে উঠে লিজা বলল, তুমি কি বাড়ি বয়ে আমাকে অপমান করতে এসেছ?

    তুমি ভুল করছ মিস স্মিথ, আমি স্বেচ্ছায় আসি নি, তুমি আমাকে আমন্ত্রণ করে এনেছ, আর এখন বুঝতে পারছি অপমান করবার জন্যেই এনেছ। এবারে আমি চললাম–

    বলে সে প্রস্থানের জন্য উদ্যত হল। লিজা বলল, এক মিনিট দাঁড়াও।

    তার পরে বলল, শোন রেশমী বিবি, আমার প্রাণ থাকতে এ বিবাহ আমি হতে দেব না।

    রেশমী ফিরে দাঁড়িয়ে উত্তর দিল, বেশ তো, চেষ্টা করে দেখ। কিন্তু মনে রেখো, নির্বোধকে নিবৃত্ত করা অত সহজ নয়–

    এই বলে ব্যঙ্গে, গর্বে, স্পর্ধায় পূর্ণ একটি কটাক্ষ নিক্ষেপ করে বেরিয়ে চলে গেল রেশমী।

    .

    ৩.১৭ কাঠে-কাঠে

    রেশমী চলে যাওয়া মাত্র লিজা গাড়ি করে বেরিয়ে পড়ল মেরিডিথের উদ্দেশ্যে। রেশমীর ইঙ্গিত রিংলার সম্বন্ধে সত্য হলেও মেরিডিথের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সত্য নয়। রিংলার অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিল, বন্ধ হয়েছিল তার আনাগোনা লিজার কাছে। রিংলারকে নিয়ে লিজার সঙ্গে মেরিডিথের মনোমালিন্য ঘটে, সে বন্ধ করে দিয়েছিল আনাগোনা লিজার বাড়িতে। কিন্তু আজ আর এই সামান্য বিষয় নিয়ে সঙ্কোচ করবার ইচ্ছা ছিল না লিজার, বিপদের সময়ে তাকেই বিশেষ করে মনে পড়ল, ভাবল, ভালই হল, এই উপলক্ষে তার সঙ্গে মিটমাট করে নেবে।

    গাড়ি গিয়ে পৌঁছল মেরিডিথের বাড়িতে, আর সৌভাগ্যক্রমে তখন সে বাড়িতে বিশ্রাম করছিল। লিজাকে দেখে আনন্দে বলে উঠল মেরিডিথ, এস এস লিজা, তুমি আসবে ভাবি নি।

    লিজা বলল, মেরিডিথ, বিষম সঙ্কটে পড়েছি, তাই আগে সংবাদ না দিয়েই আসতে বাধ্য হলাম।

    মেরিডিথ তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই তো, তোমার মুখ চোখ লাল হয়ে উঠেছে, ব্যাপার কি? ব’স, কি হয়েছে বল তো?

    লিজা কোনরকম ভূমিকা না করে শুরু করল, মূখ জন রেশমী বলে একটা নেটিভ মেয়েকে বিয়ে করবার সঙ্কন করেছে।

    বিস্মিত মেডিডিথ বলল-বল কি? আলাপ-পরিচয় ঘটল কোথায়?

    ঘটনাচক্রে এই কলকাতাতেই ঘটেছে, বিস্তারিত বিবরণ পরে শুনো, এখন বিয়েটা বন্ধ করবার উপায় স্থির কর।

    চিন্তিত মেরিডিথ বলল, জনকে অনুরোধ উপরোধ করা ছাড়া তো উপায় দেখি নে। তাকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করে দেখেছ কি?

    সে-সব হয়ে-বয়ে গিয়েছে, নির্বোধ একেবারে কেপে উঠেছে।

    তবে মেয়েটাকে ভয় দেখিয়ে বা প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিনিবৃত্ত কর।

    সে চেষ্টাও হয়েছে।

    কিছু ফল পেলে?

    ফল? মাই গড। মেয়েটা আস্ত শয়তানী।

    তবে উপায়?

    সেইজন্যেই তো তোমার শরণাপন্ন হয়েছি।

    মেরিডিথ শুধাল, মেয়েটি কি খ্রীষ্টান?

    না।

    খ্রীষ্টান না হলে হবে কি করে?

    মেয়েটা খ্রীষ্টান হবে স্থির করেছে। কোন রকমে সেটা বন্ধ করতে হবে।

    সে কেমন করে সম্ভব?

    অসম্ভব কেন? তোমার সঙ্গে তো পাত্রীদের পরিচয় আছে। কেউ যাতে ওকে দীক্ষা দেয় তার ব্যবস্থা কর।

    দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল মেরিডিথ, অসম্ভব লিজা, অসম্ভব।

    কেন, তোমার সঙ্গে কি পাদ্রীদের পরিচয় নেই?

    পরিচয় আছে বলেই অসম্ভব বলছি।

    খুলে বল, আমার মন বড় অস্থির।

    এই পাত্রীদের তো তুমি তো জান না, আমি জানি। তারা সমাজের হাজার হাজার টাকা খাচ্ছে অথচ এ পর্যন্ত একটা নেটিভকে দীক্ষিত করতে পারে নি, একবারে মনমরা হয়ে আছে। এখন কোন একটা নেটিভ দীক্ষিত হতে ইচ্ছা করেছে শুনলে সবাই নেচে উঠবে। নদীর জলধারা রোধ করা সম্ভব হলেও ওদের রোধ করা অসম্ভব।

    তুমি বড় বড় সাহেবদের ধরে ওদের উপরে চাপ দাও।

    বড় সাহেবদের উৎসাহ যেন কিছু কম।

    তবে কি কোন উপায় নেই?

    তাই তো মনে হয়। তা ছাড়া, বড় সাহেবদের প্রভাব খাটিয়ে কোম্পানির মুনুকে দীক্ষাদান বন্ধ করলেই যে দীক্ষা বন্ধ থাকবে এমন কি কথা!

    কেন?

    কলকাতার আশেপাশে অনেক পর্তুগীজ, ডাচ, দিনেমার উপনিবেশ আছে সেখানে তো পাত্রীর অভাব নেই; তারাও সমান উৎসাহী। সেখানে গিয়ে দীক্ষা নিলে বন্ধ করবে কি উপায়ে? ইংরেজ কর্তৃপক্ষের অনুরোধ সেখানে খাটবে না।

    অন্তত কলকাতায় দীক্ষা বন্ধ কর-বাধা পেয়ে যদি জনের সঙ্কল্প টলে।

    লিজার করুণ অনুরোধে মেরিডিথ সেই চেষ্টা করতে প্রতিশ্রুত হল, বলল, আচ্ছা লিজা, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব, কলকাতায় যাতে মেয়েটার দীক্ষা না হয়। কিন্তু কত দূর কি করে উঠতে পারব, জানি নে।

    .

    যখন লিজা ও মেরিডিথে এইসব পরামর্শ চলছিল, রেশমী তখন কি করছিল?

    লিজার বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্বপ্নচালিতের মত রেশমী ফিরে এল বাড়িতে, হেঁটে এল কি ছুটে এল, কি শনাপথে সাঁতরে এল মনে পড়ে না তার। ঘরের মধ্যে পৌঁছে সম্বিৎ ফিরে পেল সে।

    সে বুঝল, তার ‘সংস্কার অন্তরায়’-এর কি মারাত্মক ভাষ্য করেছে নির্বোধ জন। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, জনের উপরে তার একটুও রাগ হল না, বরঞ্চ একরকম মায়া অনুভব করল সে। নির্বোধের প্রতি বুদ্ধিমতীর মায়া। জন ও রেশমীর মাঝখানে লিজা এসে পড়ে এমন প্রচণ্ড অপমান না করলে খুব সম্ভব বিবাহের প্রস্তাবটাকে পাশ কাটিয়ে যেত সে, কিন্তু এখন আর সে ইচ্ছা বা উপায় ছিল না তার। কতকটা জনের প্রতি আন্তরিক টান, কতকটা লিজার প্রতি দুর্জয় রাগ তার সঙ্কলকে পাথরে গেঁথে তুলল, সে স্থির করল যেমন করেই হক জনকে বিয়ে করে ঐ বাড়ির গৃহিণী হয়ে বসবে সে, তখন লিজাকে হতে হবে তার আত্রাপালনকারিণী, নয় তাকে ও-বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে; দেখা যাবে কার প্রতাপ বেশি, বোনের না পত্নীর! নিছক প্রেমের টানে যা সম্ভব না হতেও পারত, প্রতিশোধ গ্রহণের আকাঙ্ক্ষায় তা হয়ে উঠল দুর্বার। দুর্জয় সঙ্কল্প গ্রহণ করল সে, জনকে বিবাহ করবেই সে, পৃথিবী থাক আর রসাতলে যাক। বিবাহ সঙ্কলিতা নারীর গ্রাস থেকে মুক্তি পৃথিবীতে সবচেয়ে অসম্ভব আশা।

    কিন্তু তখনই তার মনে পড়ল, জনটা যে নির্বোধ, হঠাৎ সে না পিছিয়ে যায়। তার মনে হল, লিজা হয়তো কেঁদেকেটে পড়বে, অমনি শান্তশিষ্ট পোষমানা ভাইটি বলবে, তবে থাক গে, আর কাউকে বিয়ে করলেই চলবে। এইরুপ চিকা মাত্রে মনে তার ভয়ের সঞ্চার হল। সর্বনাশ, এমন ঘটলে—আর এমনটা ঘটা মোটেই অসম্ভব নয়-মৃত্যু ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না তার সম্মুখে। সে স্থির করল, জনের ভার নিজ হাতে গ্রহণ করবে, বিয়ের পর যখন সমস্ত ভারই নিতে হবে তখন না হয় দুদিন আগেই তা গ্রহণ করল। লিজার প্রভাবে জনের সঙ্কল্প যাতে বিচলিত না হতে পারে, সেই উপায় আবিষ্কার করতে হবে তাকে। তখনই জনের উদ্দেশে একখানা চিঠি লিখে বাড়ির এক হোকরাকে কিছু পয়সা কবুল করে পাঠিয়ে দিল জনের অফিসেজন যেন বাড়ি ফেরবার আগে তার সঙ্গে অবশ্য অবশ্য সাক্ষাৎ করে, চৌরঙ্গী-বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোডের মোড়ের নঈতলাও-এর পুব-দক্ষিণ কোণে।

    .

    ৩.১৮ রেশমীর ‘হ্যাঁ’

    অফিস ছুটি হওয়া মাত্র ছুটতে ছুটতে এল জন, নঈতলাও-এর কাছে গাড়ি থেকে নেমে কোচম্যানকে বলে দিল, তুমি গাড়ি নিয়ে এখন বাড়ি যাও, আমি বেড়িয়ে ফিরব, বলে দিও বিলম্ব হবে।

    তার পরে সে দিঘিটার ধারে রেশমীকে খুঁজতে শুরু করল। রেশমী স্পষ্ট লিখেছিল যে পুব-দক্ষিণ কোণে থাকবে। জনের সে কথা মনে ছিল না, সে দিঘিটার তিন দিক খুঁজে তাকে দেখতে না পেয়ে বিস্মিত চিন্তিত হয়ে উঠল, তবে সে কি আসে নি, না কোন দুঃখে দিঘিতেই ডুবে মরল! এই সব কথা ভাবতে ভাবতে যখন পুব-দক্ষিণ দিকে এসে পড়েছে তখন দেখল একটা তেঁতুল গাছের আড়ালে একজন কে যেন বসে আছে। রেশমী, তুমি! বলে সে ছুটে গেল কাছে। রেশমীই বটে।

    রেশমী, রেশমী, ডিয়ারি!

    কিন্তু রেশমী নড়ল না, সাড়া দিল না, যেমন চুপ করে মুখ গুঁজে বসে ছিল তেমনি বসে রইল।

    জন তাকে ধরে তুলতে গেল, রেশমী বাধা দিয়ে সরে গেল।

    জন বুঝতে পারে না কি হয়েছে, ভাল করে ঠাহর করে দেখে বিস্ময়ে বলে উঠল–রেশমী, কাঁদছ কেন? এই তো আমি এসেছি, আমার কি কোন অপরাধ হয়েছে?

    তবু রেশমী নীরব।

    অনেকক্ষণ সাধাসাধির পরে, অনেক কাল্পনিক দোষ স্বীকার করবার পরে রেশমী জনের দিকে মুখ তুলে চাইল, কালো চোখ দুটি আষাঢ়ের নব মেঘভারে ঈষৎ আনত।

    কি হয়েছে রেশমী, বল!

    এবারে রেশমী কথা বলল, কিন্তু কিছুতেই জনকে কাছে ঘেঁষতে দিল না।

    রেশমী, কি দোষ করেছি খুলে বল।

    তুমি কি আমাকে অপমান করবার জন্যে তোমার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলে?

    তোমাকে অপমান! আমার বাড়িতে! কি বলছ, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না! খুলে বল, দয়া করে খুলে বল।

    রেশমী তার বিচলিত অবস্থা দেখে বুঝল যে এবারে সে যা বলবে সমস্ত বিশ্বাস করবে জন, বোনের বিরুদ্ধে নালিশ করলেও অগ্রাহ্য করতে পারবে না। তখন দুপুরবেলাকার সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিক বিবৃত করল। রেশমী নিতান্ত বুদ্ধিমতী, তাই তথ্যের এদিক-ওদিক না করে, কেবল সুর ও স্বপ্নের হেরফের করে তথ্যের গুরুত্ব দিল বাড়িয়ে।

    সমস্ত শুনে জন বলল, এ সব কিছুই আমার অভিপ্রেত নয়, লিজার অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে।

    রেশমী বলল, চমৎকার বিচার। অন্যায় হয়েছে! যাও, এখন লিজাকে ক্ষমা করে বাড়িতে গিয়ে ঢোক, আমার সঙ্গে তোমার সম্বন্ধ এখানেই শেষ।

    এ কি কথা রেশমী, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন শূন্য।

    তোমার জীবন শূন্য হলে আমি কি করব?

    তুমি কি করবে? তুমি আমার গৃহিণী হয়ে আমার জীবন পূর্ণ করবে! কি বল রেশমী, হবে তো?

    কিন্তু ও গৃহ কি আমার! সেখানে যা অপমান আজ সহ্য করতে হয়েছে!

    বিয়ের পরে তোমার অধিকার জন্মাবে ও গৃহে, তখন সাধ্য কি লিজার যে তোমাকে অপমান করে!

    কিন্তু লিজা বলেছে কিছুতেই এ বিয়ে সে হতে দেবে না।

    তুমি রাজী থাকলে ঠেকাবে কে?

    বুদ্ধিমতী রেশমী বুঝে নিয়েছিল যে লিজার চক্রান্তে কলকাতায় দীক্ষা গ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত হবে। তাই সে গোড়া থেকে শুরু করল–

    আমি যে দীক্ষা গ্রহণ করতে চাই, লিজা তা বিশ্বাস করে না।

    সে তো তুমিই ভাল জান।

    জানিই তো। তোমাকে অদেয় আমার কিছু নেই। প্রাণ মন জীবন যৌবন মায় পৈতৃক ধর্ম সব তোমার পায়ে সমর্পণ করেছি।

    তার ত্যাগস্বীকারে অভিভূত হয়ে জন তাকে কাছে টেনে নেয়। রেশমী বাধা দেয় না, বোঝে এবারে জনকে একটু স্পর্শরসে তাতিয়ে তোলা আবশ্যক।

    জন বলে, তোমার ত্যাগের তুলনায় কি দিলাম তোমাকে আমি রেশমী!

    তুমি তোমাকে দিলে, তার চেয়ে বেশি কাম্য আমার আর কি থাকতে পারে!

    পরস্পরের অভাবিত ত্যাগস্বীকারের আনন্দে দুজনে কিছুক্ষণ অভিভূত হয়ে বসে থাকে, তার পর জন শুরু করে—আমি কালকেই ব্যবস্থা করব যাতে তুমি দীক্ষাগ্রহণ করতে পার।

    সে সম্ভব নয় জন।

    বিস্মিত জন বলে, কেন সম্ভব নয়?

    কলকাতায় দীক্ষা নিতে গেলে বাধা উপস্থিত হবে, লিজা আর-পাঁচজনের সাহায্যে বাধা দেবে নিশ্চয়।

    ভুলে যেও না এ কোম্পানির রাজত্ব।

    সেইজন্যেই তো ভয়।

    কেন?

    কেন কি? কোম্পানির বড় সাহেবরা রুখে দাঁড়ালে পাত্রীরা পিছিয়ে যাবে।

    বল কি! কিন্তু তারা রুখে দাঁড়াবে কেন?

    কিছু মনে কর না জন, লিজাকে তুমি চেন না, তার অসাধ্য কিছু নয়।

    না না, রেশমী, লিজার সাধ্য কি এমন করতে পারে!

    পারুক না পারুক একটা অপ্রীতিকর ঘটনা তো ঘটবে।

    তাহলে কি করবে বল?

    চল না আমরা দুজনে কোথাও পালিয়ে যাই, সেখানে গিয়ে আমি দীক্ষা নেব।

    লিজার অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণে রেশমী বদ্ধপরিকর; সে স্থির করেছে পৈতৃক ধর্ম পরিত্যাগ করবে, কিন্তু এমনভাবে করবে যাতে লিজাকে অপমানের চুড়ান্ত করতে পারে। সে ভাবে, দেখা যাক লিজার বুদ্ধি বেশি কি আমার বুদ্ধি বেশি!

    জনকে নীরব দেখে শুধায়, কি বল?

    জন বলে, আমি ভাবছি তেমনি নিরাপদ স্থান কোথায় আছে!

    রেশমী মনে মনে স্থির করে রেখেছিল, বলল, কেন, শ্রীরামপুরে পাত্রীরা আছে, সেটা কোম্পানীর রাজত্ব নয়, সেখানে গেলে সমস্ত নির্বিঘ্নে হতে পারবে!

    চমৎকার আইডিয়া। সত্যি রেশমী, তোমার কি বুদ্ধি!

    তার পরে বলে, কাল সকালেই সেখানে চিঠি লিখে লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি, তার পর পরশু দুজনে রওনা হয়ে যাব। কি বল?

    রেশমী বলে, কিন্তু এই দু রাতের মধ্যে তোমার মত বদলে যাবে!

    কেন বল তো?

    লিজা এসে যেমনি দুটো মিষ্টি কথা বলবে, একটু চোখের জল ফেলবে, অমনি ভাই বলবে, পড়ে মরুক গে রেশমী! সে তো নেটিভ মেয়ে বই নয়। আমি তার চেয়ে ডলি কি পলি মলি কাউকে বিয়ে করব—লিজা, তুমি ব্যবস্থা করে দাও!

    তীব্র ব্যঙ্গে জনের পৌরুষ সচেতন হয়ে ওঠে। বলে, আমি শপথ করছি—

    বাধা দিয়ে রেশমী বলে, থাক, আর শপথে কাজ নেই।

    তবে কি করব?

    পারবে?

    বলে দেখ।

    এ দুটো রাত তুমি বাড়িতে না-ই গেলে, তোমার অফিসে তো দিব্যি থাকবার ব্যবস্থা আছে, সেখানে এ দুটো রাত কাটাও না কেন!

    তোমার যদি তাই ইচ্ছা তবে সেই রকমই হবে।

    কিন্তু বাড়িতে একটা খবর দিতে হবে তো?

    সে বরঞ্চ অফিসে গিয়ে পাঠিয়ে দেব।

    বিস্ময়ে জন বলে ওঠে, তুমি যাবে আমার সঙ্গে অফিসে?

    শুধু যাব না, থাকব দু রাত তোমার কাছে ওখানে।

    আনন্দে জন বলে কাটাবে দু রাত আমার সঙ্গে?

    যার সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে যাচ্ছি তার সঙ্গে অতিরিক্ত দুটো রাত কাটাতে পারব না?

    কিন্তু বিয়ের আগে? তুমি তো জান রেশমী, আমি কত দুর্বল।

    তুমিও তো জান জন, আমি কত শক্ত। এই বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ওঠ জন, আর দেরি নয়।

    দুজনে অফিসের তেতলায় এসে পৌঁছায়। তার পরে রেশমীর পরামর্শে জন লিজাকে চিঠি লিখে জানাল, বন্ধুদের সঙ্গে সে সুন্দরবনে চলল শিকারে, ফিরতে দু-চার দিন বিলম্ব হবে। আর একখানা চিঠি সে লিখল ডাঃ কেরীকে, তাতে খোলাখুলি রেশমীর খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের আকাক্ষা জানাল, জানাল যে ধর্মান্তরের পরে জন তাকে বিবাহ করবে, আরও জানাল পরশু দিন কোন সময়ে তারা দুজনে পৌঁছবে শ্রীরামপুরে। স্থির হয়ে থাকল যে ভোরবেলাতে একজন আরদালি চিঠিখানা নিয়ে শ্রীরামপুরে রওনা হয়ে যাবে।

    .

    ৩.১৯ ভাঙা পা ও ভাঙা মন

    কেরীর মুখে জনের পত্রের মর্ম শুনে রাম বসুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, ঘরে এসে শুয়ে পড়ল সে। এতদিনে সে বুঝল, যে আগুন নিয়ে খেলা শুরু করেছিল, ঐ আগুনের খেলার দক্ষতায় এতকাল ধরে সে দর্শককে তাক লাগিয়ে দিয়েছে; নীরব নৈপুণ্যে যেন বলেছে, দেখ জ্বলন্ত পাবক, অথচ কোথাও স্পর্শ করে নি আমাকে; আজ হঠাৎ সে আবিষ্কার করল কখন অজ্ঞাতসারে আগুনের ফুলকি গিয়ে পড়েছে ঘরের চালে, সব দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠবার মুখে। পাদ্রীদের সঙ্গ তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল সত্য, কিন্তু সে তো তাদের ধর্মপ্রাণতার জন্যে নয়। পাদ্রীদের সাহচর্যে পেত সে পাশ্চাত্ত্য জানবিজ্ঞানের, পাশ্চাত্তের উদার সংস্কৃতির আভাস-ঐটুকুই তার কাম্য, তাদের ধর্মোৎসাহ কখনও তাকে বিচলিত করে নি। সেইজন্যেই দীর্ঘকাল তাদের সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও কখনও সে ধর্মান্তর গ্রহণ করবার জন্য সত্যকার উৎসাহ বোধ করে নি। সত্য কথা বলতে কি, জ্ঞানে যেমন তার উৎসাহ, ধর্মবিষয়ে তেমনি তার উদাসীনতা। হিন্দুধর্ম ও খ্রীষ্টধর্ম দুয়ের সম্বন্ধেই তার সমান ধারণা—ওগুলো যেন অপরিহার্য আপদ। ওগুলো হচ্ছে রসাল আমের নীরস আঁঠি। মাঝে মাঝে সে বলেছে বটে যে শীঘ্রই ধর্মান্তর গ্রহণ করবে। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে কেরীকে বলেছিল এবারে ধর্মান্তর গ্রহণ করার পক্ষে শেষ অন্তরায় দূর হল। এখন একদিন সুপ্রভাতে “খ্রীষ্টের খোঁয়াড়ে” এসে ঢুকবে। এইভাবে দীর্ঘকাল তাদের আশা জইয়ে রেখেছিল। কেন? পাদ্রীদের আন্তরিকতা আকর্ষণই একমাত্র উদ্দেশ্য। কেন? তাহলে তাদের কাছে থেকে পাশ্চাত্ত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের তাপ অনুভব করতে বাধ্য হবে না। পাদ্রীরা যুগপৎ বহন করে এনেছিল মধ্যযুগ ও নবযুগের বাণীনবযুগের বাণীকে গ্রহণ করবার আশাতেই সহ্য করত সে মধ্যযুগের বাণীকে। কিন্তু মধ্যযুগ যে এমনভাবে প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে ভাবতে পারে নি সে।

    রেশমীকে ভালবেসেছিল রাম বসু। সে প্রেম একটু ভিন্ন জাতের। রেশমীর কাছে প্রত্যাখ্যানের পর সে ভালবাসা যেমন চতুৰ্গণ প্রবল হয়েছিল তেমনি কায়িক সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এ যেন চাঁদের প্রতি মানুষের টান। এখন হঠাৎ সংবাদ এল সেই চাঁদে গ্রহণ শুরু হবে, একসঙ্গে রাহু ও কেতুর গ্রাস, জনের ও খ্রীষ্টধর্মের। চাঁদ যাবে চিরকালের জন্যে নিভে, তার ভুবন হবে চিরকালের জনন অন্ধকার। কি করে বাঁচবে সে? এইসব দুরপনেয় চিন্তাজালে যখন সে জড়িয়ে পড়ে ক্লান্ত, তখন প্রচণ্ড উল্লাসে টমাস ছুটতে ছুটতে এসে চীৎকার করে উঠল : মুন্সী, সুসংবাদ শুনেছ? মরুভূমির পথিকের সম্মুখে দয়াময় বিধাতা স্বর্গীয় খাদ্য নিক্ষেপ করেছে, সুন্দরী রেশমী আসছে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করবার উদ্দেশে।—কি মুন্সী, তোমাকে বিমর্ষ দেখছি কেন?

    শরীরটা বড় ভাল নেই ডাঃ টমাস।

    বল কি, নাড়ীটা দেখি।

    জোর করে তার হাতে টেনে নিয়ে নাড়ী পরীক্ষা করে বলে, কই, এমন কিছু তো নয়।

    রাম বসুকে স্বীকার করতে হয় যে সত্যই এমন কিছু নয়।

    তবে আর কি, ওঠ, উৎসবের আয়োজন করা যাক। কি বল?

    রাম বসু নীরস ভাবে বলে, কিছু করতে হয় বই কি।

    বিস্মিত টমাস বলে, কিছু! এমন উপলক কি আর জুটবে? একে তো প্রথম ধর্মান্তর, তাতে আবার রেশমীর মত সুন্দরী মহিলা। আমি ভেবেছিলাম ঐ ফকিরের মত গোঁয়ার চাষাটাকে দিয়েই বুঝি ধর্মান্তরের অভিযান শুরু হবে। এখন ভাবছি বেটা পালিয়েছে ভালই হয়েছে।

    রাম বসু মনে মনে হাসে, হাসবার সঙ্গত কারণও আছে।

    ফকিরকে রাম বসুই গোপনে ভাগিয়ে দিয়েছিল, বলেছিল, তুই কেন এখানে মরতে এলি?

    ফকির বলেছিল, সাহেব বলেছে খিরিস্তান হলে ভাল খেতে পরতে পারবি।

    কিন্তু সে কদিনের জন্যে?

    কেন? ব্যাকুলভাবে শুধায় ফকির।

    তবে শোন। কঙ্কালীতলার পীঠস্থান মনে আছে?

    আছে বই কি, চৈত সংক্রান্তির মেলায় কতবার গিয়েছি!

    কঙ্কালীতলার মা জাগ্রত জানিস?

    খুব জানি। কতবার মানত করেছি, কোনদিন ফলে নি!

    কেন ফলে নি এখন বোঝ! তোর মনে যে পাপ!

    পাপ কোথায় দেখলে কায়েৎ মশাই?

    এই যে খিরিস্তান হতে যাচ্ছিস। তবে শোন, কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখেছি, কঙ্কালী মা বলছেন, ফকরে খিরিস্থান হয়েছে কি তাকে আস্ত গিলে খাব!

    সাহেব ঠেকাতে পারবে না?

    সাহেবের বাবার সাধ্য নেই ঠেকায়।

    তবে কি করব মশাই?

    যা এখনই পালিয়ে চলে যা, গিয়ে কঙ্কালীতলায় ভাল করে একটা পূজা দে গে। আর কখনও এমুখো হোস নি।

    এই বলে তখনই সে ফকিরকে পথখরচা যুগিয়ে দিয়ে রওনা করে দেয়।

    পরদিন ভোরবেলা “খ্রীষ্টের খোঁয়াড়ে প্রবেশেছু মেষ”-কে পলায়িত দেখে টমাস বিমর্ষ হয়ে পড়ে।

    টমাস শুধায়, কি মুন্সী, নীরব কেন?

    ভাবছি, রেশমীও যদি ফকিরদের পন্থা অনুসরণ করে তখন তো কৃষ্ণদাস আছেই।

    নিরুৎসাহিত টমাস বলে, তা আছে বটে, কিন্তু দুয়ে অনেক প্রভেদ।

    হাঁ, একজন পুরুষ আর একজন স্ত্রীলোক।

    শুধু স্ত্রীলোক? অপূর্ব সুন্দরী!

    তাতে তোমার কি লাভ? সঙ্গে তো মালিক আসছে!

    টমাস সংক্ষেপে বলে, মিঃ স্মিথকে আমি পছন্দ করি নে।

    আমিও করি নে। আচ্ছা ডাঃ টমাস, প্রথম ধর্মান্তরের ফল তুমিই কেন ভোগ কর না। জনকে তাড়িয়ে দিয়ে রেশমীকে তুমি বিয়ে কর না কেন?

    বলা বাহুল্য এটা রাম বসুর মনের কথা নয়। সে চায় জনে টমাসে একটা গোলমাল পাকিয়ে উঠে রেশমীর ধর্মান্তর-গ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত হক।

    কৃতজ্ঞ হয়ে টমাস বলে, মুন্সী, তুমি সত্যই আমার বন্ধু, কিন্তু তা হওয়ার নয়।

    কেন, আমি যতদূর জানি রেশমী তোমার প্রতি বিরূপ নয়।

    সে কথা তো আমিও জানি। আমাকে দেখলেই সে লজ্জায় পালিয়ে বেড়ায়।

    তবে কেন না হবে?

    দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে টমাস বলে, মিঃ স্মিথ জানিয়েছে যে বিয়ের পরে ভারী রকম দান করবে আমাদের মিশনে।

    টমাস ও রাম বসু দুজনেই বুঝল এর পরে আর যুক্তি নেই।

    সময়োচিত কিছু বলা কর্তব্য মনে করে রাম বসু বলল, তাই তো! তবে উপায়?

    উপায় তিনিই করবেন যিনি কৃষ্ণদাসকে জুটিয়ে দিয়েছেন, আবার যিনি রেশমীকে জোটাতে যাচ্ছেন।

    তা বটে, তা বটে, বলে রাম বসু, আবার দেখ তিনি শুধু কৃষ্ণদাসকে জুটিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হন নি, তার ঠ্যাঙ ভেঙে দিয়ে তোমার কাজের পথ কেমন সুগম করে দিয়েছেন।

    এ দুয়ে যোগাযোগের কথা তো ভেবে দেখি নি। বুঝিয়ে দাও দেখি। রাম বসু আরম্ভ করে।

    এ তো অত্যন্ত সহজ বিষয় ডাঃ টমাস, এখনই বুঝিয়ে দিচ্ছি। ফকির পালিয়ে গেল কেন?

    টমাস বলে, কেউ তার কান ভারী করে থাকবে।

    সেটা অসম্ভব নয়, বলে রাম বসু, কিন্তু পালাল পা দুখানার সাহায্যে। এখন বোঝ পা ভাঙা হলে নিশ্চয় চলে যেতে পারত না।

    সে কথা সত্য।

    এখন দেখ কৃষ্ণদাস ছুতোর পা ভেঙে পড়ে আছে, তাই না তুমি তাকে নিরাপদে ধর্মতত্ত্ব শোনাবার সুযোগ পেয়েছ।

    কিন্তু হাত ভাঙলেও সে সুযোগ পেতাম।

    ভাঙা হাত নিয়ে সে-ও পালাবার সুযোগ পেত। এখন পা ভেঙেছে বলেই লোকটা অচল।

    তা বটে।

    তবে কি এটাকে ভগবানের বিশেষ দয়া বলে মনে করা চলে না?

    কিন্তু তার কথাটাও একবার ভেবে দেখ, লোকটা কষ্ট পাচ্ছে।

    আর সে ফকিরের মত পালিয়ে গেলে তুমি যে কষ্ট পেতে!

    খুব কষ্ট পেতাম মুন্সী, বিশ বছর এদেশে ধর্মপ্রচার করছি অথচ একটা নেটিভকে খ্রীষ্টান করবার সুযোগ পেলাম না।

    এতদিন পরে গোড়ায় কোপ মেরে বিধাতা সেই সুযোগ এনে দিয়েছেন।

    গোড়ার কোপটা কি?

    কৃষ্ণদাসের ভাঙা পা।

    টমাস বলে, কিন্তু লোকে কি বলবে জান, আমি ভাঙা পায়ের সুযোগ নিলাম।

    হয় ভাঙা মন নয় ভাঙা পা-একটা কিছু না ভাঙলে কেউ ধর্মান্তর-গ্রহণ করবার জন্যে ব্যাকুল হয় না।

    ভাঙা মন বলতে কি বোঝায় মুন্সী?

    সেটা শুধিও রেশমীকে, ভাঙা মনের ব্যথা নিয়ে আসছে সে।

    ঘুরে ফিরে আবার দুজনে রেশমীর প্রসঙ্গে এসে পড়ে।

    টমাস শুধায়, রেশমীর মন ভাঙল কিসের আঘাতে?

    খুব সম্ভব মিঃ স্মিথের প্রেমের আঘাতে।

    জনের নাম শোনবামাত্র টমাস চাপা তর্জন করে ওঠে, আই ডোন্ট লাইক দি ফেলো! আমি ওকে পছন্দ করি নে!

    আর পছন্দ না করে উপায় কি? ও যে মোটা দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে!

    বেশ তো, টাকা দিক, রেশমী খ্রীষ্টান হক, কিন্তু ঐ রাস্কেলটাকে বিয়ে করতে যাবে কেন?

    ভুলে যাচ্ছ ডাঃ টমাস, টাকার প্রতিশ্রুতি বিয়ের জন্যে, খ্রীষ্টান করবার জন্যে নয়।

    এমন দায়বদ্ধভাবে খ্রীষ্টান করা অনুচিত।

    মুন্সী হেসে বলে, ডাঃ টমাস, দায়ে না পড়লে কেউ কখনও অন্য ধর্ম গ্রহণ করে না।

    তা হক, আমি রেশমীর জন্যে অন্য বরের চেষ্টা করব।

    রাম বসু বাহ্যত অত্যন্ত নিস্পৃহভাবে বলে, দেখ, যদি পাও।

    বলা বাহুল্য জনের উপরে সেও হাড়ে-হাড়ে চটে গিয়েছিল অথচ করবার কিছু ছিল না। একে তো রেশমীর নিতান্ত একয়ে স্বভাব, তার উপরে জন খেতাঙ্গ। এখন সে ভাবল কাঁটা দিয়ে যদি কাঁটা উদ্ধার হয় মন্দ কি? টমাস যদি গোলমাল বাধিয়ে দিতে পারে, তবে হয়তো শেষ পর্যন্ত রেশমীর ধর্মান্তর-গ্রহণও বন্ধ হতে পারে। স্পষ্টত কিছু বলা উচিত মনে করল না, এসব কথা কেরীর কানে যাওয়া অবিধেয়। তাই সে নিস্পৃহ ভাব ধারণ করল।

    দুজনে যখন এইভাবে চলতে চলতে একটা কানাগলির মাথায় এসে উপস্থিত হয়েছে, এমন সময় ফেলিক্স উল্লাসে চীৎকার করতে করতে ভিতরে ঢুকল-ডাঃ টমাস, মুন্সী, তোমরা এখানে চুপ করে কি করছ? চল চল, গঙ্গার ঘাটে চল!

    কি হল সেখানে? শুধায় দুজনে।

    মিঃ স্মিথ আর রেশমী এসে পৌঁছেছে। প্রকাণ্ড বজরা, নিশান উড়ছে, ডঙ্কা বাজছে সবাই গিয়েছে, এস এস।

    বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে, যেমন ছুটে এসেছিল তেমনি ছুটে বেরিয়ে গেল।

    চল ডাঃ টমাস, Predigal son-কে অভ্যর্থনা করি গিয়ে।

    তার পর বলল, এবারে আর শূন্য হাতে ফেরে নি, বিদেশিনী Ruth-কেও সঙ্গে এনেছে।

    অপ্রসন্ন টমাস ও কৌতূহলী রাম বসু ধীরপদে গঙ্গার দিকে এগোয়।

    .

    ৩.২০ মোতি রায়

    মোতি রায় সেকালের কলকাতার একজন দুর্ধর্ষ বাবু। তিনু রায় কাশীবাবু প্রভৃতি যে কজন বিখ্যাত বাবু ছিল, মোতি রায় তাদের অন্যতম। তার বাড়িঘর, জমিদারি, সিন্দুকভরা কোম্পানির কাগজ আর আকবরী মোহর, আট-দশখানা ব্রহাম ফিটন ব্রাউনবেরি গাড়ি, খান-পাঁচসাত পালকি, বাগানবাড়ি, দশ-বারোজন রক্ষিতা, তিনটি পরিবার-অন্যান্য বাবুদের ঈর্ষার ও অনুকরণের স্থল। বাগবাজারে গঙ্গার ধারে যেখানে এক সময়ে পেরিন সাহেবের বাগানবাড়ি ছিল, তার কাছে একটা মহল্লা জুড়ে মোতি রায়ের বাড়ি, কাছারি ও আস্তাবল। বর্গির হাঙ্গামার ভয়ে হুগলি জেলা থেকে মোতি রায়ের পূর্বপুরুষ কলকাতায় আসে। তার পরে তার যোগাযোগ ঘটে কোম্পানির সাহেবদের সঙ্গে। ১৭৫৬ সালে সিরাজদ্দৌলার তাড়া খেয়ে কোম্পানির সাহেবরা যখন ফলতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়, তখন মোতি রায়ের পিতামহ রাম রায় সেখানে রসদ ও টাকা যুগিয়ে কোম্পানির প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। তার পরে ক্লাইভ যখন পলাশী যাত্রা করে, রাম রায়। শতকরা বারো টাকা সুদে প্রচুর টাকা ধার দেয় কোম্পানিকে। পলাশীর যুদ্ধে কোম্পানির শাসন কায়েম হলে রাম রায়ের সৌভাগ্যের দরজা খুলে গিয়ে অচিরকালের মধ্যে সে কলকাতা-সমাজের মাথা হয়ে ওঠে। নবকৃষ্ণ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, গোবিন্দ মিত্রের ঠিক নীচের থাকেই হল তার স্থান। বর্তমানে দুই পুরুষের অর্জিত বিত্ত ও প্রতাপ লাভ করে মোতি রায় দুর্ধর্ষ বাবুগিরিতে সমর্পিতপ্রাণ।

    চণ্ডী বক্সীর সঙ্গে সেকালের কলকাতার যাবতীয় বিত্তশালী ও বাবুর পরিচয় ছিল। এবারে কলকাতায় এসে চণ্ডী মোতি রায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করল! কিন্তু তার আগে বাজার থেকে কিছু ভাল ঘি, মানকচু, খেজুরগুড় প্রভৃতি সংগ্রহ করে নিল।

    মৃত্যুঞ্জয় বলল, দাদা, একটা বড়লোককে কি এইসব ভেট দেওয়া চলে?

    চণ্ডী বললে, যে দেবতা যে ফুলে তুষ্ট। ওদের কি টাকা-পয়সা দিয়ে সন্তুষ্ট করবার সাধ্য আছে? গ্রামজাত এইসব দ্রব্য পেলে কলকাতার লোকে খুশি হয়।

    তার পর সেগুলো নিজের বাড়িতে তৈরী বলে মোতি রায়ের পায়ের কাছে রেখে বশংবদ হাসি হেসে হাতজোড় করে দাঁড়াল।

    কি খবর চণ্ডী?

    সময়োচিত কিছু ভূমিকা করে সমস্ত বিষয় নিবেদন করল চণ্ডী।

    হঠাৎ মোতি রায়ের চাপা-পড়া হিন্দু প্রাণ জাগ্রত হয়ে উঠল, বলল, কি সর্বনাশ! মেয়েটা শেষে খ্রীষ্টানের হাতে পড়ল? এমনভাবে চললে হিন্দুধর্ম আর কদিন থাকবে?

    সেইজন্যেই তো হুজুরের কাছে এসেছি।

    দেখা যাক কতদূর কি করা যায়। মেয়েটা কোথায় কার কাছে আছে খোঁজ নাও।

    চণ্ডী ও মৃত্যুঞ্জয় সাহেবপাড়ায় ঘুরে ঘুরে রেশমীর সন্ধান করে। সে নিশ্চয় জানে, এহেন অমূল্য বস্তু লুকিয়ে রাখার পক্ষে দেশী পাড়া যথেষ্ট নিরাপদ নয়। সাহেবপাড়ার চাপরাশী, আরদালি, সরকার, খানসামার দল হয়ে উঠল তার আরাধনার পাত্র।

    ওদিকে মোদা বুড়ি বলে, বাবা চণ্ডী, মা কালী দর্শন তো হল, এবারে ফিরে চল।

    চণ্ডী আসল কথা ভাঙে না, কি জানি কি রকম প্রতিক্রিয়া ঘটে। বলে, আর দুটো দিন সবুর কর মাসি, তার পরেই রওনা হব।

    একদিন ভুলক্রমে মৃত্যুঞ্জয় বলে ফেলেছিল যে, তারা রেশমীর সন্ধান করছে; শুনে বুড়ি ক্ষেপে উঠে বলল, ঐ জাতখেয়ানো হতভাগীর নাম আমার কাছে কর না, ও মরেছে।

    তার পরে লুকিয়ে লুকিয়ে সারারাত কাঁদল মোদা।

    দিন-পনেরো সাহেবপাড়ায় গবেষণা করে চণ্ডী রেশমীর সাকুল্য সংবাদ সংগ্রহ করে ফেলল, আর তখনই গিয়ে উপস্থিত হল মোতি রায়ের বাড়িতে। মোতি রায় তখন ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে বুলবুলির লড়াই দেখছিল। চণ্ডীকে ইশারায় অপেক্ষা করতে আদেশ করল।

    তামাশা শেষ হলে মোতি রায় শুধাল, কিছু খবর পেলে?

    চণ্ডী কাঁদ-কাঁদ স্বরে বলল, হুজুর, আপনার অনুমান যথার্থ, হিন্দুধর্ম এবারে রসাতলে গেল।

    কেন, কি হয়েছে বল তো?

    হুজুর, মেয়েটা কেবল সাহেবের ঘরে থেকেই সন্তুষ্ট নয়, একটা সাহেব তাকে বিয়ে করতে চায়। তাই দুজনে পালিয়ে শ্রীরামপুরে পাদ্রীদের কাছে গিয়েছে, খ্রীষ্টান হয়ে সাহেবকে বিয়ে করবে।

    কি সর্বনাশ। বলে বসে পড়ে মোতি রায়।

    এখন উপায়?

    উপায় হুজুর, বলে চণ্ডী।

    শোন চণ্ডী, আমার ছিপ নৌকোখানা নিয়ে তোমরা শ্রীপুরে যাও, যেমন করে পার মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিয়ে এস।

    শেষে গোলমাল বাধবে না তো হুজুর?

    সঙ্গে চার-পাঁচজন পাইক বরকন্দাজ দেব।

    সে তো দেবেনই হুজুর, সে গোলমালের কথা বলছি না। তবে সাহেবের মুখ থেকে ছিনিয়ে আনলে কোম্পানি না রাগ করে।

    মোতি রায় বলে, শ্রীরামপুরের পাত্রীদের সঙ্গে কোম্পানির বনিবনাও নেই। ওরা ওখানে স্থান পায় নি বলেই শ্রীরামপুরে যেতে বাধ্য হয়েছে। না, কোন গোলমাল হবে না।

    চণ্ডী পাদপূরণ করে বলে, আর হলে তো হুজুর আছেনই।

    হাঁ,আমি আছি। তোমরা এখনই রওনা হয়ে যাও, আমি সব হুকুম করে দিচ্ছি।

    তার পরে চীকে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করে, মেয়েটাকে নিয়ে কি করবে ভাবছ?

    হুজুর, শাস্ত্রে আছে, চিতা থেকে যে পালিয়েছে তাকে চিতায় সমর্পণ করতে হয়।

    মোতি রায় বলে, শাস্ত্রে যা খুশি থাকে থাকুক, মেয়েটাকে আমাকে দিতে হবে।

    তার পরে একটু থেমে বলে, তোমার কথা শুনে মনে হয়েছে, মেয়েটা খুবসুরত।

    তার পরে আবার একটু থেমে বলে, চণ্ডী, শাস্ত্রের মর্যাদা রাখবার জন্যে কেউ এত কষ্ট স্বীকার করে না। তোমার উদ্দেশ্য তুমি জান, আমার উদ্দেশ্যে তোমাকে বললাম। আমার কাশীপুরের বাগানবাড়িটা খালি পড়ে আছে, মেয়েটা সেখানে দিব্যি থাকবে।

    হুজুরের কথার উপরে কি কথা বলতে পারি–তাই হবে।

    তার পর মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, কি বল মিত্যুঞ্জয়, মেয়েটার একটা হিল্লে হয়ে গেল।

    কলকাতার বাবুসমাজের সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয়ের হালে পরিচয়, সে কি বলবে ভেবে পেল না।

    মোতি রায় বলে, যাও চণ্ডী, মেয়েটাকে নিয়ে এসে একেবারে বাগবাজারের ঘাটে নামাবে।

    চণ্ডীরা পরদিন ভোরে ছিপযোগে শ্রীরামপুরে রওনা হয়ে যায়, সঙ্গে মোক্ষদা বুড়িকে নিতে ভোলে না; বলে, চল মাসি, এবারে বাড়ি ফেরা যাক।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচার-ইয়ারী কথা – প্রমথ চৌধুরী
    Next Article উইংস অব ফায়ার – এ পি জে আবদুল কালাম
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025
    Our Picks

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.