Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেরী সাহেবের মুন্সী – প্রমথনাথ বিশী

    প্রমথনাথ বিশী এক পাতা গল্প546 Mins Read0

    ৪.১১-১৫ পত্র পাঠ

    ৪.১১ পত্র পাঠ

    রেশমীর চিঠি নিয়ে জন সেই যে ঘরের মধ্যে ঢুকেছিল তার পর সন্ধ্যার আগে বের হয় নি। দুপুর বেজে গেল, জনের অন্তর্ধান অফিসের লোকজনের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল, কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ শুরু করল। তখন বৃদ্ধ কাদির আলী ভুলে-যাওয়া যৌবনের হাসিতে প শশুগুফ আলোড়িত করে বলল, তোমরা বেবাক বেআকৃষ্ণ।

    সে বলল যে, প্রিয়জনের চিঠি পেলে অমন মস্তানা দশা হয়েই থাকে। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করল নিজের দৃষ্টান্ত। যৌবনে সে যখন ‘জরু’র চিঠি পেত, সারারাত কাটিয়ে দিত চিঠিখানা বুকে ধরে; না খেত খানা, না যেত নিদ্রা।

    গঙ্গারাম নিরক্ষর, তার জরুও নিরক্ষর, তাই এমন ঘটনা তার অভিজ্ঞতার বহির্ভূত। সে ভাবল, বাল্যকালে লেখাপড়া শিখলে না জানি জীবনে আরও কত রস পেত। বড়লোকের জীবনে কত রস ভেবে তার বিস্ময় প্রায় চরমে পৌঁছল। কিন্তু সে বিস্ময় একেবারে চূড়া স্পর্শ করল যখন সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে এল জন, গঙ্গারাম সময়োচিত হাসি দিয়ে করল অভ্যর্থনা। অমনি জন সগর্জনে বলে উঠল, হাতা কাহে উ? সঙ্গে সঙ্গে ছুঁড়ল লক্ষ্যভ্রষ্ট এক লাথি।

    পলাতক গঙ্গারাম গিয়ে জানাল ব্যাপারটা কাদির আলীকে। কাদির দাডিতে হাত বুলিয়ে বলল, বেটা, এমন হয়েই থাকে, সাহেব এখন প্রেমে মস্তানা।

    গঙ্গারাম স্থির করল সাহেব মস্তানাই হক আর বাউরাই হক, কাছে না ঘেঁষাই বুদ্ধির কাজ।

    জন চিঠিখানা নিয়ে ঘরে ঢুকে একটানে ফেলল খুলে, এক নিমেষে ফেলল পড়ে; সংক্ষিপ্ত, সুতীক্ষ্ণ ভাষণ শাণিত ছুরিকার মত আমূল বিদ্ধ হয়ে গেল বুকে। সে শয্যা গ্রহণ করল-সন্ধ্যার আগে উঠল না।

    তার মনে হল পরিচিত সুবিন্যস্ত জগৎ যেন ভূমিকম্পে ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে, প্রবেশ ও বহির্গমনের পথ রুদ্ধ, ভূ-ভারে চাপা পড়েও কোনরকমে সে যেন বেঁচে রয়েছে।

    তার মনে হল, এই সেই রেশমী, এই তার চিঠি! তবে তো লিজার অনুমান মিথ্যা নয়! লিজা বহুবার তাকে সতর্ক করে দিয়েছে, বলেছে, নেটিভ মেয়ে কখনও আপন হয় না; বলেছে, প্রথম সুযোগেই সে পালাবে, একবার ছাড়া পেলেই স্বজনগণের মধ্যে গিয়ে উপস্থিত হবে।

    জন বলেছে, তা কেমন করে সম্ভব? বিয়ে যে হল—সে সম্বন্ধ ছিড়বে কি করে?

    লিজা বলেছে, ছোঃ, হিদেনদের আবার নীতিজ্ঞান! দেখ নি ওরা একসঙ্গে দশগও বিয়ে করে!

    অস্বীকার করতে পারে নি জন এসব যুক্তি। তখন বলেছে, অন্য হিদেন মেয়ে যেমনই হক রেশমী সে দলের নয়। অনেকদিন আছে ও পাদ্রীদের সঙ্গে, ওর মনটা সংস্কারমুক্ত হয়ে গিয়েছে।

    পাগলামি রাখ জন। হিদেনের মন কুকুরের লেজের মত, ছাড়া পেলেই বাঁকা হয়। তোমার রেশমী আর দশজনের মতই।

    জনের মনে হল, লিজার অনুমান বর্ণে বর্ণে সত্য। নতুবা জনের বাগদত্তা হয়ে কিভাবে সে ত্যাগ করে জনকে, কিভাবে নির্লজ্জের মত গ্রহণ করে মদনমোহনকে স্বামীরূপে। ইস্ আবার দেখ না, লিখেছে, এখন ঐ মদনমোহনই তার আশ্রয়, শান্তি, স্বামী। তার নীতিজ্ঞান কানে কানে বলে দিল, বাগদত্তার আবার পত্যন্তর হয় কি করে? মদনমোহন তার উপপতি! সে ভাবল, আজ মদনমোহন মরে তো বেশ হয়, রেশমীকে চিতায় পুড়ে মরতে হবে, এবারে আর রক্ষা করবার জন্যে কেরী থাকবে না। এইরকম কত কি অসম্ভব, অসংলগ্ন চিন্তা করতে লাগল সে। উদভ্রান্ত প্রেমিকের মস্তিষ্ক কুয়াশার জগৎ, সেখানে সমস্তই কিম্ভুত, অবাস্তব, অসম্ভব, সমস্তই কার্যকারণের সঙ্গতিশূন্য।

    অনেক কয়বার চিঠিখানা ছিঁড়ে ফেলবার জন্যে উদ্যত হয়েও সে হেঁড়ে নি। তার পরে সযত্নে রেখে দিল, ভাবল, থাক একখানা দলিল, আমার মত বিড়ম্বিত ব্যক্তিকে সতর্ক করে দেবার প্রয়োজন লাগবে। তার পরে সে বসে গেল রেশমীর চিঠির উত্তর লিখতে। অনেক কাগজ ছিঁড়ে, অনেক কাটাকুটি করে, মনের অনেক বিস্তারিত বিদ্বেষকে ঘনীভুত আকার দিয়ে, শাণিত ছুরির ফলার নিক্ষিপ্ত আলোকের ভাস্বরতা অর্পণ করে করে অবশেষে এক সময়ে সমাপ্ত হয় পত্র-রচনা।

    সে লিখল—

    “ডিয়ার লেডি,

    লিজার অনুমান মিথ্যা নয়, হিদেনদের নীতিজ্ঞান বলে কিছু নেই। যদি থাকত তাহলে তুমি আজ এমন করে একজনকে উপপতিরূপে বরণ করতে না। ভূতপূর্ব স্বামীর চিতায় তোমার পুড়ে মরাই উচিত ছিল। এবারে উপপতির সঙ্গে পুড়ে মরবার সাহস থেকে যেন বঞ্চিত না হও। আশা করি, এবারে আর তোমার মত ঘৃণ্য জীবকে কেউ বাঁচাবে না। কারণ তুমি একটি বাজারের বেশ্যা, আর তোমার উপপতি একটি আস্ত লম্পট। তোমার মত ডাকিনীর কুহক থেকে শেষ মুহূর্তে যে রক্ষা পেয়েছি, সেজন্য ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    –জন স্মিথ।”

    চিঠি লিখবার পরে মনের ভার খানিকটা হাল্কা হলে ঘুমিয়ে নিল সে ঘণ্টা দুই। তার পরে ভোরবেলায় গঙ্গারামকে চিঠি দিয়ে জন বলে দিল, জলদি দিয়ে এস—জবাব আনতে হবে না।

    সন্ধ্যাবেলায় শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে রেশমী আরতি দেখতে গেল না, টুশকি একাই গেল। কিন্তু অসুস্থতার কোন লক্ষণ ছিল না রেশমীর শরীরে বা মনে। আজ সারাটা দিন একটি সু-গীত সঙ্গীতের মত তার কেটে গিয়েছে। মাঝে মাঝে খোঁপায় হাত দিয়ে দেখেছে চিঠিখানা লুকোনো আছে কিনা; অদৃশ্য ফুলের গন্ধে বনতল যেমন আমোদিত হয়ে ওঠে, সমস্ত অন্তর তার আজ তেমনি পূর্ণ। বিকালবেলায় চুল আঁচড়াবার জন্যে আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সে চমকে উঠল, মুখে এ কি দিব্য কান্তি। চাঁদ পড়েছে মেঘে চাপা, তবু লাবণ্য টষ্টল করছে। সেই চাপা চাঁদের স্মরণে আজ শাড়িটি বিশেষ ভঙ্গীতে পরল, কপাল খয়েরের টিপটি আঁকল, তার পরে গোধূলির আলো-আঁধারিতে গঙ্গার পশ্চিম তীর যখন রসিয়ে তুলেছে, শুক্লা তৃতীয়ার চাঁদের ক্ষীণ ওষ্ঠাধর যখন আকাশের প্রান্তে কৌতুক-বর্ষণে উদ্যত, তখন প্রদীপটি জ্বেলে নিয়ে চিঠিখানা কোলের উপরে মেলে ধরল, মিলল কালো-পঙক্তির দুই চোখে আর তার সন্নত দুই চোখে। কি বহুপ্রতীক্ষিত মিলন চারি চক্ষুর!

    এক নজরে চিঠিখানা পড়ে নিয়ে সর্পদষ্টবৎ অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল রেশমী। ফুলের মালায় ছিল সাপ, এতক্ষণ যে ফুলের মালাকে সযত্ন প্রশ্রয়ে বহন করছিল সে খোপার নিভৃত আশ্রয়ে। কিন্তু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না রেশমীর, বার বার ফিরে ফিরে সে পাঠ করে; তার পরে কেমন যেন রোখ চড়ে যায় মাথায়, উচ্চস্বরে পাঠ করে চিঠিখানা; এতক্ষণ যা চোখে দেখছিল, এবারে শোনে তাই কানে; কোন কোন কথা আছে যা একটিমাত্র ইন্দ্রিয়ের সাক্ষ্যে বিশ্বাসযোগ্য হয় না—তাই একাধিক সাক্ষীর তলব পড়ে।

    ‘এমন করে একজনকে উপপতিরূপে বরণ করতে না।’….’এবারে উপপতির সঙ্গে পুড়ে মরবার সাহসে যেন বঞ্চিত না হও’…’তুমি বাজারের বেশ্যা’…ছত্রগুলো ছুরির ফলার মত আঘাত করে বুকে। আত্মঘাতপ্রয়াসীর যখন রোখ চড়ে যায় তখন যেমন সে বারংবার নিজেকে আঘাত করে উৎকট উল্লাস অনুভব করে, তেমনি অনুভূতি হতে লাগল ঐসব ছত্র পড়ে পড়ে রেশমীর-সে উপপতি গ্রহণ করেছে, সে যেন পুড়ে মরে, সে বাজারের বেশ্যা!

    তার চিন্তাশক্তি এককালে লোপ না পেলে কথাগুলোর সত্যাসত্য বিচার করে দেখত সে, হয়তো তখন বুঝতে পারত যে, এর মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি আছে, জনশ্রুতির হস্তক্ষেপ আহে। কিন্তু বিচারের শক্তি তার ছিল না। পূর্বাপরের সূত্র ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তার জীবনে, সে যেন অতর্কিতে অত্যুচ্চ শিখর থেকে অতলস্পর্শ খাদে নিক্ষিপ্ত হয়েছে—দুঃসহবেগে ক্রমাগতই পড়তে পড়তে চলেছে, এর চেয়ে অনেক শ্রেয় ভূপৃষ্ঠে সংঘাত ও মৃত্যু।

    কতক্ষণ সে এইভাবে মূঢ়ের মতন বসে ছিল জানে না, যখন সম্বিৎ পেল, শুনল টুশকির কণ্ঠস্বর। তাড়াতাড়ি চিঠিখানা আবার খুঁজল খোঁপার গুচ্ছে, ভাবল, পরীক্ষিতের মত তক্ষককে ধারণ করলাম মস্তকে, তার মতই যেন মুহূর্তে একমুঠি ভস্মমাত্র হয়ে অস্তিত্বের প্রান্তে মিলিয়ে যাই কোথাও একটুকু চিহ্ন যেন না থাকে যে রেশমী বলে কেউ কখনও কোথাও ছিল।

    .

    ৪.১২ যেমন কাঠ তেমনি কাঠুরে

    একদিন কলকাতার পুলিস সুপারিনটেন্ডেন্ট মিঃ পোকার মোতি রায়ের দেওয়ান রতন সরকারকে ডাকিয়ে বলল, সরকার, বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে, একটু সামলে চলতে হবে।

    রতন সরকার বলল, হুজুর, আমরা খুব সাবধানে চলছি, কেবল মেয়েগুলো বে আক্কেলে, চীৎকার করে পাড়া মাথায় করে।

    তাদের কাছে তুমি কি আশা কর? তাদের পাকড়াও করে নিয়ে যাবে, আর তারা চুপ করে থাকবে?

    রতন সরকার অপ্রস্তুত হওয়ার লোক নয়, জমিদারের নায়েবি করলে মানুষে যমকে ভয় করে না, বলল, তাই তো উচিত হুজুর। খামকা চীৎকার করে লজ্জার কথা প্রচার করে লাভ কি?

    স্পোকার বলল, সে কথা মিথ্যা নয়, তাছাড়া লোকের চীৎকারকে ভয় করা চলে, কিন্তু ইতিমধ্যে যে বড়লোক এসে জুটেছে।

    বড়লোকের হস্তক্ষেপ শুনে রতন সরকারও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, কে আবার এল এর মধ্যে?

    মাধব রায়-বলে স্পোকার।

    হুজুর, মাধব রায়ের কথা বিশ্বাস করবেন না, লোকটা ঘোর মিথ্যাবাদী।

    রতন সরকারের অভিযোগ এমনই সত্যভাষণে পূর্ণ যে, পুলিস সুপারিনটেন্ডেন্টের মুখেও হাসি ফুটল। সে বলল, অবশ্যই আমি তার কথা বিশ্বাস করি নি। কিন্তু মুশকিল কি জান, লোকটা আমার কাছে আসে নি, লাট কাউন্সিলের মেম্বারদের ধরেছে; জানিয়েছে যে, মোতি রায়ের দৌরাত্ম্যে পাড়ার মেয়েদের সম্প্ৰম গেল, পুলিস নিষ্ক্রিয়।

    স্পোকারকে উত্তেজিত করবার আশায় রতন সরকার বলল, এ যে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া।

    শুধু ঘোড়া ডিঙিয়ে নয় সরকার, ঘোড়র আস্তাবল সুদ্ধ ডিঙিয়ে। কিন্তু নিরুপায়। এবারে বন্ধ কর তোমাদের দৌরাত্ম্য, নইলে আমার সমূহ বিপদ।

    রতন সরকার দীর্ঘ সেলাম করে বলল, এই কথা? এখনই হুকুম দিয়ে দিচ্ছি।

    এই বলে চৌকি ছেড়ে উঠতেই পোকার কাছে গিয়ে মৃদুস্বরে বলল, একবারে সব থামিয়ে দিতে হবে না, কারণ আমি জানি যে, মোতি রায়ের সম্মান আহত হয়েছে, এখন মেয়েটাকে খুঁজে বার করে সকলের সামনে দেখাতে না পারলে তার গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে না, কিন্তু যা রয় সয়, তা-ই কর, বেশি জানাজানি না হয়।

    রতন সরকার সেইরূপ প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিল।

    মাঝখানের ঘটনা এখন প্রকাশ করে বলবার সময়। মাধব রায় মোতি রায়কে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নিরস্ত করতে না পেরে সোজাসুজি রাধাকান্ত দেবের কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। রাধাকান্ত দেব তখন নিতান্ত তরুণ যুবক। কিন্তু হলে কি হয়, শোভাবাজারের রাজপরিবারের ছেলে তো—ইংরেজ সরকারে তার অবারিত গতি, প্রচুর সম্মান।

    মাধব রায় বলল, হুজুর, আপনি মুখ তুলে না চাইলে তো হিন্দুসমাজ তলিয়ে যায়।

    রাধাকান্ত দেব আনুপূর্বিক জানতে চাইলে যা ঘটেছে, যা ঘটতে পারে এবং যা ঘটা অসম্ভব—সমস্ত একযোগে ঘটে গিয়েছে বলে নিবেদন করল মাধব রায়।

    রাধাকান্ত বললেন, তোমাদের পাড়ায় যে এমন পৈশাচিক কাও চলেছে, তা তো জানি নে। যাক, ভয় কর না, আমি কাউন্সিলের মেম্বারকে জানাচ্ছি।

    রাধাকান্ত দেবের নালিশ কাউন্সিলের মেম্বারের কানে পৌঁছল এবং তখন টনক নড়ল স্পোকারের। তার পরের ঘটনা হচ্ছে স্পোকার ও রতন সরকার সংবাদ।

    রতন সরকার ফিরে গিয়ে সব জানাল মোতি রায়কে। মোতি রায় খেদবৈরাগ্য মিশ্রিত স্বরে বলে উঠল, মাধবটা সংসারে টিকতে দিল না দেখছি।

    তার পর বলল, রতন, এখন তুমি যাও, একটু ভেবে দেখি।

    পরদিন মোতি রায় বলল, দেখ, ঐ চণ্ডী বক্সীকে খুঁজে বার করতে হবে। এরা কেউ সেই মেয়েটাকে চেনে না, বকশিশের লোভে যাকে-তাকে ধরে গোল বাধাচ্ছে। যাও, খুঁজে বার কর চণ্ডীকে।

    চণ্ডী কলকাতা ত্যাগ কবে নি। খোঁজাখুঁজির পরে তাকে পাওয়া গেল, মোতি রায়ের লোকজন তাকে হুজুরে হাজির করল।

    নিভৃতে চণ্ডীকে ডেকে মোতি রায় জানিয়ে দিল যে, তোমার কোন ভয় নেই, বৃথা তুমি পালিয়েছিলে।

    চণ্ডী জিভ কেটে বলল, পালাই নি হুজুর, সম্মুখে একটা যোগ পড়েছিল, তাই শব-সাধনার জন্যে শ্মশানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম, আমরা তিন-পুরুষের তারিক কিনা।

    বেশ বেশ, আমি তো এইরকম নির্ভয় লোককেই পছন্দ করি, বলে মোতি রায়।

    দেখ চণ্ডী, তোমাদের মেয়ে স্নেচ্ছের হাতে পড়ে থাকবে, এটা কি উচিত হচ্ছে?

    হুজুর, তারই প্রতিকার আশাতেই তো আমার শবসাধনা।

    তার পরে সে নিজের মনে বলে ওঠে, এবারে মরবে বেটা ম্লেচ্ছ!

    নিশ্চয় মরবে, বিশেষ তুমি যখন ক্রিয়া করেছ; কিন্তু সমস্ত ভার দৈবের উপর ছেড়ে দিলে তো চলে না, পুরুষকারের সাধনাও করতে হয়।

    হয় বই কি হুজুর, দুটি চক্র না হলে কি গাড়ি চলে?

    কী বলেছ চণ্ডী, গাড়ি চলতে দুটি চক্র চাই। আর মনে কর সে চক্র যদি রজত চক্র হয়, তবে গাড়ি কেমন চলে!

    এই পর্যন্ত বলে হঠাৎ গম্ভীরভাবে বলে ওঠে মোতি রায়, বক্সী, এখানে খামকা বসে থেকে কি করবে, কিছু টাকা রোজগার কর, মেয়েটাকে সনাক্ত করে দাও।

    একটু থেমে আবার শুরু করল, আর তা যদি না কর তবে মনে রেখ যে, আমিও শবসাধনায় বসতে জানি, জ্যান্ত মানুষের গর্দান স্বহস্তে কেটে শব প্রস্তুত করে নেওয়া আমার বিধান।

    পরমুহূর্তেই হাসিতে মুখখানা প্রসন্ন করে বলল, নাও নাও বক্সী, মেয়েটাকে সনাক্ত করে দাও, একটু আমোদ-আহ্লাদ করা যাক। বুঝতেই তো পারছ, একদিন তোমারও তো ছিল আমার মত বয়স।

    এই বলে হাঁক দিয়ে উঠল মোতি রায়, ওরে কে আছিস, ভাল হুঁকোয় করে অম্বুরী তামাক সেজে নিয়ে আয় বক্সীর জন্যে।

    কিন্তু হুজুর, মেয়েটা যদি এখানে না থাকে?

    এটা কি একটা কথা হল বক্সী? এখানে না থাকলে তুমি এখানে বসে আছ কোন্ আশায়?

    মুহূর্তে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, নবাবী আমলের কিরিচ দেখেছ বক্সী? এক কোপে হাতীর গর্দান নামিয়ে দেওয়া যায়। আমার তোষাখানাতে খান-অষ্টেক আছে। দেখবে?

    চণ্ডী বক্সী উত্তর দেয় না, কিন্তু তার ভাব-গতিকে স্বীকৃতি প্রকাশ পায় যে, এতদিনে তার জুড়ি মিলেছে। যেমন কাঠ তেমনি কাঠুরে। এ হেন যুগল যেখানে মিলিত হয়, সে স্থান সংসার-রসিকের তীর্থ।

    চণ্ডী সবিনয়ে বলে, হুজুর, আমার বাড়ির মেয়েকে আমি ধরিয়ে দেব, লোকে বলবে কি?

    নিশ্চয় নিশ্চয়। বলে প্রচুর সুগন্ধি ধূম উদগিরণ করে মোতি রায়। তার পর অনেকক্ষণ কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, যেন ওখানে সমাধান আছে এই জটিল সমস্যার। তার পর তাকিয়ার উপরে ভর দিয়ে দেহটাকে ঈষৎ উত্তোলন করে বলে, জানছে কে বক্সী, জানছে কে?

    একটু পরে বলে, তাহলে তুমি স্বীকার করলে! বেশ, বেশ। ওরে কে আছিস, বক্সীর নাহারের ব্যবস্থা করে দে। কি বল বক্সী, কোথায় আর যাবে এত বেলায়?

    তার পরেই মুখখানায় শাণিত গাম্ভীর্য এনে বলে, নবাবী আমলে একটি সুন্দর রীতি ছিল, আসামীকে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়ানো হত। কর্তাদের আমলে আমাদের বাড়িতেও সে রীতি দেখেছি। কোম্পানির আমলে সেসব সুন্দর প্রথা লোপ পেল। তবে এখনও গোটা দুই ডালকুত্তা আছে আমার। দেখবে নাকি বক্সী?

    মোতি রায়ের মেদ-মেদুর মুখমণ্ডলে যুগপৎ স্নিগ্ধ আভা ও খরবিদ্যুৎ কি চমৎকার মানায়, বিস্মিত হয়ে দেখছিল চণ্ডী। সে বুঝল, স্বীকার না করলে নিতান্ত ডালকুত্তার পেটে যদি বা না যেতে হয়, বেঘোরে গুম-খুন হতে কতক্ষণ! সে বলল, হুজুরের কথার অবাধ্য আমি নই, তবে জানাজানি না হয়। ছুঁড়িটার দেখা পেলে আমি দূর থেকে দেখিয়ে দেব-আপনার লোকজন ধরে নিয়ে যাবে-এইটুকু দয়া আমাকে করতে হবে।

    সে তো করতেই হবে। তুমি দেখিয়ে দিয়েই খালাস—তার পরে আমার লোকজন আছে।

    তবে এখন উঠি কর্তা।

    আহা উঠবে কোথায়? আমার বাড়িতে কি তোমার একটু স্থান হবে না?

    সে দায় আমার। তুমি এখানেই থাকবে।

    এই বলে মোতি রায় খানসামার হাতে চণ্ডীর ভার অর্পণ করে।

    চণ্ডী বোঝে যে, আগে ছিল নজরবন্দী, এবারে সত্যকার বন্দী।

    তার পরে মোতি রায় রতনকে ডেকে হুকুম দেয়, দেখ মেয়েগুলোকে ধরে শহরের মধ্যে দিয়ে যেন টেনে নিয়ে যাওয়া না হয়, ওতেই চেঁচামেচি করে লোক জানাজানি হয়ে যায়। এবারে ধরেই ঘাটে নিয়ে গিয়ে নৌকায় তুলবে-আর সোজা নিয়ে যাবে কাশীপুরে। নদীর ধারেই বাগানবাড়িটা, জানাজানি হওয়ার ভয় থাকবে না।

    রতন সরকার বলে, সেইরকম হুকুম করে দেব হুজুর।

    আর বাড়িটা রঙ করা শেষ হয়েছে তো?

    রতন সরকার জানায়, হয়েছে।

    তবে আর কি, জলসার সব ব্যবস্থা ঠিক রেখ। মেয়েটা ধরা পড়লে…

    কথা শেষ করে না, প্রয়োজন হয় না। না বোঝবার কিছু নেই।

    তার পরে শুধায়, নিমন্ত্রণের তালিকা ঠিক করে রেখেছ?

    হাঁ হুজুর।

    দেখ, মাধব রায় যেন বাদ না পড়ে। দেখি তার মেম্বর স্বশুর কি করতে পারে!

    এই বলে মুখ থেকে আলবোলার নল সরিয়ে হো হো শলে হেসে ওঠে মোতি রায়। ভয় পেয়ে কার্নিসের পায়রাগুলো ঝাঁক বেঁধে আকাশে ওড়ে।

    .

    ৪.১৩ মুখোমুখি

    মানুষের আর সব সম্বল যখন ফুরিয়ে যায়, তখন হাতে থাকে চোখের জল। ওর আর অন্ত নেই, কোন দুঞ্জেয় চির-হিমানী-শিখরে ওর উৎস। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে সূর্য ওঠে রেশমীর, আবার চোখের জলের কুয়াশাতেই হয় তার অন্ত। চোখের জলের স্রোতে নিঃশব্দ প্রহরগুলো ভেসে চলে যায় রেশমীর জীবন থেকে। ঝরা শ্রাবণের পূর্ণিমার চাঁদের মত ও চোখের জলের বর্ষণ ঠেলে কোনরকমে এগোয়। এতদিনে ও বুঝতে পেরেছে সংসারে কাঁদবার অবসর অপ্রচুর নয়। গঙ্গায় ডুব দিয়ে কাঁদে, জলে জল মিশে যায়; ধোঁয়ার ছলনা করে কাঁদে, বাষ্পে বাষ্প মিশে যায়; আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কাঁদে, ছায়াতে কায়াতে বেশ মিশে যায়; বালিসে মুখ লুকিয়ে কাঁদে, বিছানায় জল মিশে যায়; কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে যখন কেঁদে ওঠে সে, ভাবে, ভগবান কি করলে, নিতান্ত হতভাগ্যকেও তুমি স্বপ্নসুখের বরাদ্দ করে থাকসেটুকুও কেড়ে নিলে আমার।

    এত চোখের জল তো লুকানো থাকে না। টুশকি শুধায়—কি হয়েছে বোন, কিসের এত দুঃখ, বল খুলে আমাকে।

    কি বলবে রেশমী? বলতে হলে আস্ত একখানা রামায়ণ বলতে হয়, ইচ্ছা হয় না রেশমীর, অথচ চোখের জলের একটা কারণ দর্শানো তো চাই।

    সে বলে, দিদি, বাড়ির কথা মনে পড়ছে।

    এটা অসঙ্গত কথা নয়।

    টুশকি বলে, নিতান্ত যাওয়ার ইচ্ছা হয় তো বল, দেখি সেথো-সঙ্গী পাওয়া যায় কিনা।

    রেশমী তো প্রকৃত তথ্য গোপন করেছে, তাই সেখো-সঙ্গীর জন্য আগ্রহ দেখায়।

    টুশকি বলে, আচ্ছা না হয় এখন না-ই গেলে, দেখি তোমার গায়ের দিকে কোন লোক যায় তো তার হাতে একখানা চিঠি পাঠিয়ে দাও।

    তাতেও বড় আগ্রহ প্রকাশ করে না রেশমী। দাবানলের হরিণী যেদিকে এগোেয় সেদিকেই আগুন।

    অবশ্য আত্মসমর্পণ না করে উপায়ও থাকে না। টুশকি বলে, শোন বোন, তোমার চেয়ে আমার বয়স বেশি, সংসারটা দেখলামও বেশি, দুঃখ এমন জিনিস যা ভাগ করে নিলে কমে, আর সুখ এমন জিনিস যা ভাগ করে নিলে বাড়ে।

    রেশমী বলে, দিদি, সুখের ভাগ নেবার লোকের অভাব হয় না, দুঃখের ভাগ নেবে

    টুশকি বলে, আরে পাগল, সংসারটা বড় অদ্ভুত জায়গা, দুঃখের ভাগ নেবার লোকেরও অভাব হয় না এখানে।

    তার পর একটু থেমে বলে, সে রকম লোক না গড়েই কি দুঃখ গড়েছেন বিধাতা!

    নেবে তুমি আমার দুঃখের ভাগ? শুধায় রেশমী।

    যদি দাও।

    কেন নিতে যাবে পরের দুঃখ?

    যদি চাও তো আমার দুঃখের ভাগও না হয় তোমাকে দেব।

    তার পর হেসে বলে, সংসারে দুঃখের অভাব কি বোন?

    তবে একটা গল্প শোন, বলে পুনরায় আরম্ভ করে টুশকি : সেবার গিয়েছিলাম সুন্দরবনে, তা সে আজ অনেক দিনের কথা হল, গাঁয়ের নাম ন’পাড়া, গাঁ আর বন পাশাপাশি, কোথায় গাঁয়ের শেষ আর কোথায় বনের শুরু বোঝবার উপায় নেই। আমি ভাবি, তা উপায় না থাকে না থাক, আমার তো ভালই হল, বন দেখতে এসেছি বন দেখি। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াই। তাই দেখে বুড়িমা—যে বাড়িতে গিয়েছি সেই বাড়ির কত্রী-বলল, মা, অমন কাজটি ক’র নি, অমন একা একা যেখানে সেখানে যেও নি।

    কেন মা? শুধাই আমি।

    এখানে যে প্রত্যেক ঝোপে-ঝাডে বাঘ।

    দিনের বেলাতেও?

    দিনের বেলাতেও বইকি। দিনের বেলায় বাঘগুলো যাবে কোথায়।

    তার পরে টুশকি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে, সংসারে প্রত্যেক ঝোপে-ঝাড়ে দুঃখ, জাগরণেও দুঃখ, ঘুমন্তেও দুঃখ। লোকে যখন বলে যে, ঘুমোলে দুঃখের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, তখন আমার বুড়িমার কথা মনে পড়ে-দিনের বেলায় বাঘগুলো যাবে কোথায়? ঘুমোলে দুঃখগুলো যাবে কোথায়? তখন তারা স্বপ্নে গুঁড়ি মেরে এসে নিঃশব্দে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে।

    হঠাৎ নিজের মনটাকে সবলে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগ্রত করে তুলে রেশমী বলে, শুনবে দিদি আমার সব কথা?

    টুশকি বললে, শুনব বইকি।

    শুনলে তাড়িয়ে দেবে না তো?

    বিস্মিত টুশকি বলে, তাড়াতে যাব কেন?

    হয়তো বাড়িতে রাখবার অযোগ্য মনে করবে।

    টুশকি মনে মনে হাসে। মনে মনে বলে, তুমি এইটুকু জীবনে এমন কি পাপ করেছ জানি না, কিন্তু আমার সব কথা শুনলে এখনই এ বাড়ি ছেড়ে না যাও তো কি বলেছি।

    টুশকিকে নিরুত্তর দেখে বলে, কি, তাড়িয়ে দেবে নাকি?

    শোন একবার কথা! মামলা না শুনেই রায়?

    রায় কি হবে তা বুঝতে পারছি, কিন্তু তবু বলব।

    যদি মনে খুঁত থাকে, না-ই বললে।

    দিদি, আর এত ভার একা বইতে পারি নে।

    বেশ, এস না তবে, ভাগ দাও। আমিও কিছু ভাগ দেব তোমাকে। তুমি কি ভাব দুঃখ একতরফা?

    রেশমী বলে, এতদিন বোনের মত মায়ের মত আশ্রয় দিলে আর তোমার কাছে সত্য গোপন করে বসে আছি, বড় দুঃখ হত। কতবার ভেবেছি, বলব সব কথা তোমাকে। তখনই ভয় হয়েছে, যদি সে সব কলঙ্কের কথা শুনে তাড়িয়ে দাও, যাব কোথায়?

    টুশকি বলে, আরে পাগলী, মানুষ কি দোষগুণ বিচার করে ভালবাসে? আগে ভালবেসে ফেলে তার পরে খুঁজে খুঁজে গুণ বের করে। ভালবাসা এমনই যে তাতে দোষকেও গুণ মনে হয়। দেখ নি মাঘের শিশিরে সূর্যের আলো পড়লে মুক্তো বলে মনে হয়!

    রেশমী বলে, আজ সন্ধ্যাবেলা খুলে বলব সব, তার পরে যা থাকে কপালে।

    বেশ তো, ভাগাভাগি করা যাবে দুঃখের, আমিও নেব দুঃখের ভার। দেখি কার দুঃখের ভার বেশি, কার কলঙ্কের রঙ বেশি গাঢ়।

    তখন দুজনে স্থির করে যে, রাত্রে শুনবে তারা পরস্পরের কথা।

    সন্ধ্যাবেলা মদনমোহনের আরতি দেখবার জন্যে টুশকি একাকী গেল। ইদানীং কয়েক দিন রেশমী যাওয়া বন্ধ করেছে, তাই টুশকি আর পীড়াপীড়ি করে না। আজকে রেশমীর মনটা অনেকটা হালকা, তবু সে গেল না। তার ইচ্ছা যে, দুজনে মুখোমুখি হওয়ার আগে মনটাকে গুছিয়ে প্রস্তুত করে নেবে। মনের মালখানায় সব ভূপাকারে অগোছালে পড়ে আছে—একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে না নিলে নিজেরই যে পথ করে চলা কঠিন, অপরে ঢুকবে কি উপায়ে?

    ভাবতে ভাবতে রেশমী ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন জাগল, দেখল বাতিটা কখন নিভে গিয়েছে, বুঝল রাত নিশ্চয় অনেক। ভাবল টুশকি নিয়মিত সময়ে নিশ্চয় ফিরেছে আর ঘুমের ঘোরে কখন হয়তো ওরা খেয়ে নিয়েছে, মনে না পড়বারই কথা। পাশে হাতড়িয়ে দেখল টুশকির বিছানা শূন্য। শূন্য? কোথায় গেল?

    রেশমী উঠে বাতি জ্বালল। দেখল যে, বাড়ির মধ্যে কোথাও টুশকি নেই দেখল রান্নাঘরে দুজনের ভাত ঢাকা পড়ে রয়েছে, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। সে বুঝল টুশকি ফেরে নি। এমন সময়ে মদনমোহনের বাড়িতে ডঙ্কা বেজে উঠল। রেশমী বুঝল যে, রাত শেষ প্রহর। নিঃশব্দ আকাশের তলে প্রদীপ হাতে মূঢ়ের মত সে দাঁড়িয়ে রইল। সে রাত্রে টুশকি ফিরল না।

    .

    ৪.১৪ রেশমী(?)-হরণ

    সেদিন বিকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, সন্ধ্যাবেলায় চেপে এল। টুশকি যখন মদনমোহনের বাড়িতে এসে পৌঁছল, দেখল আঙিনা জনশূন্য, নাট-মন্দিরের মধ্যে সামান্য কয়েকজন মাত্র লোক। আরতি শেষ হওয়াব আগে বৃষ্টিতে আবার জোর লাগল, বৃষ্টি কমবে আশায় অপেক্ষা করে রইল টুশকি। তখন মন্দির প্রায় জনশূন্য। অবশেষে বৃষ্টি কমে এল। রাত্রি অনেক হয়েছে, আর অপেক্ষা করা উচিত নয় মনে করে সে যেমন মদনমোহনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্ধকারের মধ্যে রাস্তায় নেমেছে, অমনি নিঃশব্দে তিন-চারজন লোক তার ঘাড়ের উপর এসে পড়ল। একজন একখানা গামছা দিয়ে তার মুখ বেঁধে ফেলল, আর জনদুই মিলে তাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাত্রা করল। মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত রহস্য পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে, বস্তুত রহস্যজনক কিছু ছিল না এতাদৃশ ব্যাপারে। টুশকি বুঝল, এরা মোতি রায়ের লোক, বুঝল সেই মেয়েটা মনে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে। গুণ্ডাদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা সে করল না, সাধ্য ছিল না—ইচ্ছাও বুঝি ছিল না; নীরবে বিনা আয়াসে সে আত্মসমর্পণ করল ভবিতব্যের কাছে। তাকে নিয়ে একখানা নৌকার উপরে তোলা হল, মুখ তখনও গামছায় বাঁধা, কিন্তু চোখ খো।লা, দেখতে বাধা ছিল না। সে দেখল যে আততায়ী তিনজন নৌকায় উঠল, চতুর্থ ব্যক্তি তীরে দাঁড়িয়ে রইল। জোয়ারের মুখে নৌকো ছুটে চলল উজানে। আকাশের অসীম অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে পড়ে রইল, মনে হল সৌরভী না জানি তার জন্যে কত রাত্রি পর্যন্ত জেগে অপেক্ষা করে থাকবে।

    অপস্রিয়মাণ চতুর্থ ব্যক্তি চণ্ডী বক্সী। মোতি রায়ের প্ররোচনায় ও শাসনে রেশমীকে দেখিয়ে দিতে সে সম্মত হয়েছিল। চণ্ডী জানত যে, রেশমী কলকাতাতেই আছে, আর সাহেব-পাড়াতে না গিয়ে এদিকেই কোথাও লুকিয়ে আছে। মদনমোহনের বাড়িতে তার দেখা পাওয়া যাবে বলে তার যে ধারণা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তা সত্য বলে প্রমাণিত হল। মোতি রায়ের লোকের সঙ্গে আজ দুদিন মদনমোহনের বাড়িতে সে এসেছে, সাক্ষাৎ পায় নি রেশমীর। আজকে বৃষ্টির মধ্যে সে এসেছিল, চণ্ডী জানত দৈবদুর্যোগ এসব কাজের পক্ষে প্রশস্ত। তবে তার একটুখানি ভুল হয়ে গেল, সে ভুল দিনের খর আলোতেও অনেকে করছে, আর এ তো রাতের অন্ধকার। টুশকিকে রেশমী বলে ভুল করেছিল। চণ্ডী বলেছিল যে, সে দূর থেকে মেয়েটাকে ইশারায় দেখিয়ে দেবে, সামনাসামনি উপস্থিত হতে পারবে না; হাজার হক, গায়ের মেয়ে তো বটে।

    রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে থেকে নাট-মন্দিরের আলো-আঁধারির মধ্যে টুশকিকে দেখে সে চমকে উঠল। এই তো রেশমী! তখন একবার ভাবল যে, দূর ছাই, না-ই ধরিয়ে দিলাম, ধরিয়ে দিলে মেয়েটার কি গতি হবে, সে বিষয়ে তার কোন প্রান্ত ধারণা ছিল না! তার পরে ভাবল, হুঁ, ওর জন্যে আবার এত চিন্তা কেন; ওকে বাঘে খেলেও খাবে, কুমীরে খেলেও খাবে। তা ছাড়া চিতা থেকে যে পালিয়েছে তার আবার সতীত্ব, তার আবার কুমারীত্ব। চণ্ডীর দৃঢ় প্রত্যয় হল যে, রেশমীর পক্ষে জনের শয্যায় আর মোতি রায়ের শয্যায় কোন প্রভেদ নেই। তবু মনের মধ্যে কেমন খচখচ করতে লাগল। তখনই মনে পড়ল, মোতি রায়ের সুরা-বিঘূর্ণিত চক্ষু আর শাসন। প্রাণের ভয় তুচ্ছ করে সৎ কাজ করতে যারা পারে, চণ্ডী বক্সী সে দলের নয়। রেশমীকে দূর থেকে দেখিয়ে দিয়ে সে আড়ালে গেল, তার পরে নির্বিঘ্নে সে নৌকায় নীত হলে অন্ধকারের মধ্যে সরে পড়ল।

    কিছুক্ষণ পরে নৌকা গিয়ে তীরে ভিডল। আততায়ীরা টেনে নামাল টুশকিকে, নিয়ে চলল সঙ্গে। দু-চার মিনিটের মধ্যেই তারা এসে পৌঁছল একটা বাগানবাড়িতে। টুশকি বুঝল, এই সেই বহুত মোতি রায়ের বাগানবাড়ি। কোন কথা এ পর্যন্ত সে বলে নি, নীরবে সব দেখছিল। তাকে নীচের তলায় দাঁড় করিয়ে একজন উঠে গেল দোতলায়। ফিরে এসে লোকটা ইঙ্গিত করল, সকলে মিলে নিয়ে চলল টুশকিকে দোতলায়। একটা বড় হলঘরের মধ্যে তাকে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে তারা সরে পড়ল।

    প্রদীপের তিমিত আলোতে সে দেখতে পেলে একখানা পালকের উপরে অর্ধশায়িত অবস্থায় পড়ে আছে মোতি রায়। মোতি রায়কে সে চিনত।

    মোতি রায় সুরা-বিজড়িত কণ্ঠে বলল, কি দাঁড়িয়ে রইলে কেন, ঐ চৌকিখানায় বস।

    টুশকি বসল না, যেমন ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে রইল।

    মোতি রায় তাকিয়া আশ্রয় করে একটু নড়েচড়ে উঠে বলল, বস রেশমী।

    এবারে টুশকি কথা বলল–এই প্রথমবলল, আমি রেশমী নই।

    গদগদ কণ্ঠে মোতি রায় বলল, রেশমী নও, পশমী তো?

    ওটাও আমার নাম নয়।

    আচ্ছা রেশমী না হও, পশমী না হও, সুতী তো?

    খুব একটা রসিকতা করা হল মনে করে হেসে উঠল মোতি রায়।

    শিউরে উঠে টুশকি ভাবল, কি বিকট হাসি, যেন নরকের দরজার শিকল খোলার ঝনঝন ধনি।

    তবে তোমার নাম কি?

    টুশকি।

    বাঃ, বেশ মিষ্টি নামটি তো! দাঁড়াও দেখি কি কি মিল পাওয়া যায় তোমার নামের সঙ্গে-টুশকি, খুস্কি, ঘুষকি…আজ মাথাটা বেশ খুলেছে, হরু ঠাকুর থাকলে খুশি হত। দেখি আর কিছু পাওয়া যায় কিনা। মুচকি? উঁহু, ওটা চলবে না।

    এতক্ষণ মোতি রায় নিজের মনেই বলে চলছিল, এবারে টুশকিকে লক্ষ্য করে বলল, বুঝতে পারছ না নিশ্চয়, ভাবছ লোকটা কি সব বাজে বকছে। তবে শোন, আমি হর ঠাকুরের কাছে গান-বাঁধা শিখছি। হরু ঠাকুর বলে যে, গান বাঁধতে হলে আগে হাতের কাছে মিলগুলো গুছিয়ে নিয়ে বসতে হয়। ঠাকুরের উপদেশ এমনি মনে ধরেছে যে, একটা শব্দ শুনলেই মিলগুলো আপনি মনে পড়ে যায়। টুশকি, খুস্কি, ঘুষকি—কিন্তু উঁহু-মুচকি চলবে না।

    তার পরে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, কেন চলবে না, একশ বার চলবে। হরু ঠাকুর আপত্তি করলে তার মাসোহারা বন্ধ করে দেব না! আলবৎ চলবে, বাপ বাপ বলে চলবে। শোন না, ইতিমধ্যেই কেমন একটা গান বেঁধে ফেলেছি–

    ঐ যে পাড়ার ঘুষকি,
    নামটি তাহার টুশকি,
    মাথা ভরা খুস্কি,
    হেসে চলে মুচকি।

    নিজেই নিজেকে উৎসাহিত করে বলে ওঠে, বাঃ বাঃ, বেড়ে হয়েছে! কাল ঠাকুরকে দিয়ে একটা সুর বসিয়ে নিতে হবে। কি বল?

    হঠাৎ টুশকিকে লক্ষ্য করে বলে, কি, বসলে না?

    এবারে টুশকি সাহস সঞ্চয় করে বলে, আপনি যে মেয়ের সন্ধান করছেন, আমি সে মেয়ে নই।

    সে মেয়ে নও? চালাকি ক’র না চন্দ্রবদনী। ঐ কথা শুনতে শুনতে এই কদিনে কান পচে গিয়েছে—আজকে আসল মানুষটিকে পাওয়া গিয়েছে।

    তার পর গুনগুন সুরে গেয়ে উঠল, ‘আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়নু পেখনু পিয়ামুখ চন্দা’! তার পরে বলল, নাঃ কেবলই মাঝরাত, তা হক, পিয়ামুখ-চন্দা তো মিথ্যা নয়।

    টুশকি স্থির কণ্ঠে বলল, আমি রেশমী নই, আমি মদনমোহনতলার টুশকি।

    গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে মোতি রায়, আলবৎ তুমি জোড়ামউ গাঁয়ের…

    স্মৃতির ক্ষীণ পর্দা নডে ওঠে টুশকির মনে।

    আলবৎ তুমি জোড়ামউ গাঁয়ের রেশমী, চণ্ডী বক্সী তোমায় সনাক্ত করেছে…

    স্মৃতির পর্দাখানা সবেগে আন্দোলিত হয় টুশকির মনে।

    আলবৎ তুমি জোড়ামউ গাঁয়ের রেশমী, চণ্ডী বক্সী করেছে তোমাকে সনাক্ত। আর এতেও যদি বিশ্বাস না হয়, মোক্ষদা বুডিকে দিয়েও সনাক্ত করিয়ে দিতে পারি। এবারে বিশ্বাস হল তো যে, ঠিক মানুষটি এতদিনে পেয়েছি?

    স্মৃতির পর্দাখানা আদ্যন্ত অপসারিত হয় টুশকির মনে।

    আরও শুনতে চাও? খ্রীষ্টানরা তোমাকে শ্রীরামপুরে নিয়ে গিয়েছিল, খ্রীষ্টান করে বিয়ে করবে বলে। আমার লোকের সঙ্গে চণ্ডী বক্সী গিয়ে তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসে। তার পরে গঙ্গার ঘাট থেকে সেই যে পালালে—আজ এতদিনে পেখনু পিযামুখচন্দা। কি, আদ্যন্ত ইতিহাস জানি কিনা—কি বল?

    টুশকির মনের মধ্যে আর একখানা সন্দেহের পর্দা নড়ে ওঠে। ঐ যে মেয়েটি অকস্মাৎ একদিন তার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে নিয়েছিল, নাম বলেছে সৌরভী, বলেছে ডাকাতের হাত থেকে পালিয়ে এসেছে—তবে সেই সৌরভীই কি রেশমী? জোড়ামউ গাঁয়ের রেশমী? মোক্ষদা বুড়ি, চণ্ডী বক্সী, জোড়ামউ গ্রাম—নামগুলি স্মৃতির স্বর্ণময় ঘন্টা বাজাতে থাকে তার মনে। তবে তো সৌরভী তার আপন বোন। তখনই মনে পড়ে দু-জনার চেহারার সাদৃশ্য। রাধারানী চেহারার মিল দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল, মেয়েটি কে হয় মা তোমার? ওরা নিজেরাও আয়নায় পাশাপাশি দুখানা মুখ দেখে কতবার চমকে উঠেছে। ঐ সৌরভীই তাহলে রেশমী, তার বোন! তার মনের মধ্যে স্মৃতির বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে, দিগন্তের পর দিগন্ত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আসন্ন বিপদকে ছাপিয়ে যায় পূর্বস্মৃতির গুরুভার। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, চৌকিখানায় বসে পড়ে।

    মোতি রায় বলে ওঠে, এই তো চাই। আগে দণ্ডায়মান, তার পরে উপবেশন, সবশেষে শয্যাগ্রহণ। সে হাত বাড়িয়ে টুশকির আঁচল ধরে আকর্ষণ করে, টুশকি বাধা দেয় না।

    টুশকি পালঙ্কে উঠতে উঠতে ভাবে কতজনকেই তো কতদিন দেহদান করতে সে বাধ্য হয়েছে, আজ না হয় নির্দোষ বোনকে রক্ষা করবার জন্যে দেহদান করল, ক্ষতি কি। হয়তো সব অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হবে আজ। সে শুয়ে পড়ে। বাতি নিভে যায়।

    .

    ৪.১৫ প্রভাতচিন্তা

    শেষ রাতে টুশকি জেগে ওঠে। দেখে—বিছানা শূন্য, দরজা খোলা, ঘর অন্ধকার। কোথায় আছে মনে পড়ে না তার। খোলা জানালা দিয়ে শরতের ভোর-রাতের শীতল বাতাস, অস্ফুট স্বচ্ছতা তাকে সম্বিৎ দেয়। মনে পড়ে ক্রমে ক্রমে রাতের অভিজ্ঞতা, কাপড় সামলে নিয়ে সে উঠে বসে।

    প্রথমে মনে হল পালিয়ে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তখনই স্মরণ হল মোতি রায়ের সতর্ক নিষেধ, পালাতে চেষ্টা কর না, মারা পড়বে। পাহারা তো আছেই, বাড়ির মধ্যে আছে দুটো ডালকুত্তা। তারা রেশমী পশমী বুঝবে না, ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলবে। ক্রমে অনেক কথা মনে পড়ে তার। নেশার ঝোকের মধ্যেও মোত রায় মর্যাদার কথা ভোলে নি; বলেছিল, রেশমী, তুমি পালিয়ে যাওয়ায় আমার জ্ঞাতি-ভাই-লোকটা বরাবর আমার শরটিয়ে বেড়াচ্ছিল যে, সাহেবরা তোমাকে লুটে নিয়ে গিয়েছে। এর পরে আমার মানসম থাকে কেমন করে? তোমাকে খুঁজে বার করবার জন্যে বিস্তর খরচা করেছি, ঢালাও হুকুম দিয়েছি—যত টাকা লাগে নাও, রেশমীকে খুঁজে বার কর।

    টুশকি নীরবে সব শুনে গিয়েছে।

    মোতি রায় বলে চলে, আজ তোমাকে পাওয়া গেল। আগামী কাল এখানে মস্ত মাইফেলের আসর বসবে। শহরের গণ্যমান্য লোক সকলকে নিমন্ত্রণ করব, আমার সেই জ্ঞাতি-ভাইটিও বাদ যাবে না। নাচ গান বাজনা কিছু বাদ পড়বে না, নিকি বাইজিকে বায়না দিয়ে রেখেছি একশ মোহর, নূতন চালান বিলিতি মদে নীচের তলার একটা ঘর ভর্তি, আতসবাজিরও ব্যবস্থা আছে। সবই আছে, কেবল ছিল তোমার অভাব—এবারে সে অভাবটাও পূর্ণ হল, বুঝলে?

    টুশকি চুপ করে শোনে।

    একবার সকলে এসে দেখে যাক যে, বাঘের মুখের শিকার ছিনিয়ে নিলেও নেওয়া যায়, কিন্তু মোতি রায়ের মেয়েমানুষেকে ছিনিয়ে নেয় এমন কার সাধ্য! বুঝলে তো, বড়লোকের মান-মর্যাদা রক্ষা করা কত কঠিন। তা পরদিন ইচ্ছা করলে তুমি চলে যেও জোড়ামউ, চণ্ডী আর মোক্ষদা বুড়ি তো কাছেই রইল।

    এমন কত কথা মাতালটা বলে যায়। নিরুত্তরে শোনে টুশকি, উত্তর দেয় না। কেবল এইটুকু বোঝে নিদারুণ ভবিতব্যের শেষ ধাপ পর্যন্ত না গিয়ে তার নিস্তার নেই।

    এখন শেষরাতে জেগে উঠে মনে পড়ে সেই সব কথা—আর মনে পড়ে পূবস্মৃতির ছিন্ন টুকরোগুলো। সেগুলোকে গুছিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে বিছানা ছেড়ে খোলা জানালার কাছে এসে বসে।

    শরৎতের প্রদোষান্ধকারে প্রায়ফুট শিউলিফুলের গন্ধে স্মৃতির মলমল অবারিত হয়ে যায়, মাতৃঅঞ্চলের মত তার প্রান্ত এসে স্পর্শ করে টুশকির গায়ে। সারা গা ওঠে কাঁটা দিয়ে। মোতি রায়ের মুখে রেশমীর যে পরিচয় পেয়েছে, তাতে এখন সে নিঃসন্দেহ যে, সৌরভীই রেশমী, আর তারা দুইজনে সহোদরা। চাপাপড়া অতীতের ঢাকনা খুলে। যায় তার মনে। বাল্যকালে বাড়ির বাগানে শিউলিফুল কুড়োতে যেত সে, পিছন পিছন চলত খলিত-পদে শিশু রেশমী। মা পিছন থেকে নিষেধ করত-ওরে এত ভোরে ঘাসের মধ্যে যাস নি, নিওর লেগে অসুখ করবে। কে কার কথা শোনে। অচল ফুলে ভরে উঠলে রেশমীকে ভাগ দিতে হত, নইলে সে কিছুতেই ছাড়ত না। বারান্দার উপরে ছোট্ট ভাইটি হামা দিত, ফুল দেখলেই খিল খিল করে হেসে তার উপরে এসে পড়ত। আরে রাখ রাখু—রেশমী, ওকে টেনে সরিয়ে নে, এ যে পূজোর ফুল।

    দূর থেকে মা হাসত। বলত, টুনি খুব ধার্মিক হবে, ঠাকুর বলে এত টান।

    আজকের ভোরের শেফালির গন্ধ কেন কে জানে-টান দিল মনের কোন্ নিভৃতে, সেদিনের স্মৃতি অবারিত হয়ে পড়ল। গন্ধে গন্ধে এ কি নিগুঢ় যোগাযোগ!

    টুনি তার আসল নাম, জীবনস্রোত নূতন খাতে এসে পড়লে নামটা বদলে নেয়, করে টুশকি, কেবল আদ্যক্ষরটুকু মাতৃ-আশীর্বাদী নির্মাল্যের মত মাথায় খুঁজে রাখে।

    নূতন জীবন আরম্ভ করবার পর মায়ের ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করে কাঁদত সে, মেয়ে আমার ধার্মিক হবে, ঠাকুর বলে এত টান! আজ আবার বুক ফেটে কান্না এল, দুই চোখ গেল ভেসে। দুর আজ যে হঠাৎ নিকটে এসে পড়েছে।

    সেদিনটার কথা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে টুশকির, যেন এই সেদিন মাত্র ঘটেছে। কত আগে—তবু কত কাছে। সময়ের বাঁধা মাপে কি মানুষের মন চলে।

    শীতের শেষরাত্রে গঙ্গাসাগরে স্নানের জন্য নৌকা করে রওনা হয়েছিল তারা–বাপ মা, টুনি আর ছোটভাই নাড়। রেশমীকে কিছুতেই দিদিমা ছাড়ল না; বলল, ঐ রোগা মেয়ে পথেই মারা পড়বে। টুশকির বাপের বাড়ি আর মামার বাড়ি এক গ্রামেই। সঙ্গে গায়ের আরও কয়েকজন লোক ছিল। টুশকি এতদিন এসব কথা ভাবতে চায় নি, মনের অতীতের দরজাটা জোর করে বন্ধ করে রেখেছিল। আজ স্মৃতির উত্তরে হাওয়ায় হঠাৎ দরজা খুলে গিয়ে হু-হু করে বেরিয়ে আসছে চাপা ঘটনার প্রবাহ। গঙ্গাসাগরে স্নান করে ফেরবার পথে সন্ধ্যাবেলা নৌকা তোলপাড়। সবাই একসঙ্গে জেগে উঠে ভাবল, এ কি, হঠাৎ বান এল নাকি? বান নয়, বোম্বেটে। তার পর দু-চার মুহূর্তের মধ্যে কোথা দিয়ে যে কি হয়ে গেল, অন্ধকারের মধ্যে বুঝতে পারা গেল না। হাত-পা-মুখ-বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল সে বোম্বেটের নৌকার এক কোণে। দুদিন বাদে কলকাতার কলিঙ্গাবাজারে একটা লোকের বাড়িতে তার স্থান হল। শুনল এখানেই নাকি তাকে থাকতে হবে। সেই লোকটা-উঃ কি বিষম কালো আর মোটা বলে দিল, পালাবার চেষ্টা ক’র না—কেটে দু টুকরো করে ফেলব। তার আগে সে কলকাতাও দেখে নি, কলিজাবাজারের নামও শোনে নি। কি হল তার বাপ-মায়ের, কি হল নাড়র জানতে পেল না। বোম্বেটেদের চাপা কথাবার্তা থেকে মনে হয়েছিল তারা সবই ডুবে মারা গিয়েছে, গায়ের যে তিনজন লোক সঙ্গে ছিল তারাও মারা পড়েছিল বাধা দিতে গিয়ে। সেদিনের কথা মনে পড়ে চোখ জলে ভেসে যায়, যেমন সেদিন চোখ ভেসে যেতে জলে। চোখের জলের উপরে কালের চিহ্ন পড়ে কি?

    তার পরে তার আরম্ভ হল দুঃখের জীবন, দুঃখের আর লজ্জার। লোকটা তাকে বিক্রী করে দিল চিৎপুরে এক বাবুর কাছে। বাবুটি তাকে তৈরি করে দিয়েছিল এই বাড়িটা, দিয়েছিল কিছু টাকা আর এই টুশকি নামটা। টুনি চাপা পড়ে গেল টুশকির তলায়। ভালই হল। টুনি তো মরেছে। কিছুদিন পরে বাবুটি মারা গেল। তখন টুশকি হল স্বাধীন। ইচ্ছা করলে জোডামউ গায়ে ফিরে যেতে পারত, কিন্তু সে ইচ্ছাকে প্রশয় দিল না সে। মৃত টুনির আর পুনর্জীবন লাভ সম্ভব নয়। এমন সময় পরিচয় হল রাম বসুর সঙ্গে বসু হল তার কায়েৎ দা। কলকাতায় এসে এই প্রথম স্নেহের স্বাদ পেল, মেহের মিশ্রণ। ঘটেছিল বলেই তাদের যৌন সম্পর্কটা বিকৃত হয়ে ওঠে নি। মেয়েরা স্নেহ-ভালবাসা অবশ্যই চায়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি চায় এমন লোক যার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারে তেমন পুরুষকে অদেয় কিছু থাকে না নারীর। তার পরে সৌরভীর ছদ্মবেশে এল রেশমী, তার বোন। সে ভাবে তাদের ভাইবোন সকলেরই কি এক দুঃখের ভাগ্য!

    আবার দ্বিগুণ বেগে কান্না চেপে আসে। জলে গাল ভেসে গিয়ে কাপড় ভিজে যায়। কিন্তু যে দুঃখ স্তম্ভিত হয়ে আছে মনের মধ্যে, তার তুলনায় এ কতটুকু। হিমালয়ের সব তুষার গললে কি এক ছটাক জমিও জেগে থাকত!

    তার মনে পড়ে—অদৃষ্টের কি নিদারুণ পরিহাস! আজ সন্ধ্যাতেই সৌরভী তার পরিচয় দেবে বলেছিল, সে-ও স্থির করেছিল নিজের পরিচয় দেবে। আর দু ঘন্টা সময় পেলেই দুই বোন মুখোমুখি হত ভিন্ন পরিবেশে। আর এখন? আর কি সে ফিরে যেতে পারবে ঘরে? মোতি রায়ের শাসন যেমন দুর্লঙ্ঘ্য, বাসনা তেমনি দুর্জয়।

    শিউলির গন্ধ প্রবলতর হয়ে উঠেছে। সে ভাবে, ফুটেছে এতক্ষণে সব ফুলগুলো। তাকিয়ে দেখে, তাই তো, আলোতে গিয়েছে আকাশ ভরে। ভোরের আলোর সম্মুখে সে লজ্জায় এতটুকু হয়ে যায়। সে ভাবে যে, এর চেয়ে রাত্রির অন্ধকার ভাল ছিল। রাত্রিটা মোতি রায়ের কামনা দিয়ে তৈরি সত্যি, কিন্তু সে মজাকে ঢেকে দেবার জন্যে অন্ধকারেরও তো অভাব হয় না। হঠাৎ মনে পড়ে সৌরভীর কথা–না জানি কি করতে সে এতক্ষণ!

    .

    বিনিদ্র রেশমীর চোখের উপরে দিনের আলো ফুটে ওঠে। সে ভাবে, কাকে জিজ্ঞাসা করবে, কোথায় সন্ধান করবে টুশকি-দির।

    বেলা আটটা নাগাদ আসে রাধারানী।

    তার শুকনো মুখ দেখে রাধারানী শুধায়, কাল রাতে ঘুমোও নি দিদিমণি?

    না।

    অসুখবিসুখ হয়েছিল?

    টুশকি-দি আরতি দেখতে গিয়েছিল, এখনও ফেরে নি।

    বল কি! ভয়ে বিস্ময়ে বলে রাধারানী।

    কোথায় গেল বলতে পারিস?

    রাধারানী কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে, কপাল পুড়লে যেখানে যায়, বোধ করি সেখানেই।

    গম্ভীরভাবে শুধায় রেশমী, তার মানে?

    আরও খুলে বলতে হবে নাকি? বোধ করি মোতি রায়ের লোকের হাতে পড়েছে।

    অবিশ্বাস করবার কিছু নেই। রেশমী বোঝে যে, এতদিন যে আগুনে পাড়াপড়শীর ঘর পুড়ছিল, এবারে তার ফুলকি এসে পড়েছে নিজেদের ঘরে। সে একদণ্ড নিশ্চল গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার পরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়।

    ওকি, কোথায় চললে? শুধায় রাধারানী।

    উত্তর না দিয়ে, পিছনে ফিরে না তাকিয়ে, অবিচলিত পায়ে রেশমী চলতে থাকে উত্তর দিকে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচার-ইয়ারী কথা – প্রমথ চৌধুরী
    Next Article উইংস অব ফায়ার – এ পি জে আবদুল কালাম
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025
    Our Picks

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.