Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেরী সাহেবের মুন্সী – প্রমথনাথ বিশী

    প্রমথনাথ বিশী এক পাতা গল্প546 Mins Read0

    ১.১১-১৫ কেরীর আবিষ্কার

    ১.১১ কেরীর আবিষ্কার

    চাকাওয়ালা একটা প্রকাণ্ড কাঠের খাঁচা দেশী আর ফিরিঙ্গি পুলিসে মিলে চৌরঙ্গী রোড বরাবর দক্ষিণদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, পিছনে চলেছে এক চুলি, সে মাঝে মাঝে ডুগ ভুগ করে ঢোলে বাড়ি দিচ্ছে আর সঙ্গে জুটে গিয়েছে নানা বয়সের একদল লোক, পথে যেমন সর্বত্র জুটে থাকে।

    কেরীরা আরও দেখল খাচার মধ্যে দশ-বারো বছর বয়সের একটি বালক উপবিষ্ট, জীর্ণ তার পোশক, মলিন তার চেহারা—কিন্তু মুখে বেশ সপ্রতিভ ভাব। তার মুখ দেখলে মনে হয়, তার জন্যেই এত আয়োজন হওয়ায় সে যেন বেশ একটু গৌরব বোধ করছে কৌতুক, কৌতূহল আর গৌরববোধ একসঙ্গে ফুটে উঠেছে তার মুখে চোখে।

    কেরী শুধাল, ব্যাপার কি?

    টমাস বলল, লোকটা আসামী, কোন অপরাধের জন্য ওকে দণ্ড দেওয়া হচ্ছে।

    এ কি রকম দণ্ড? আর ওর অপরাধটাই বা কি?

    রাম বসু বলল, হয়তো কিছু চুরি করেছে; হয়তো কোন সাহেবের ক্রীতদাস, পালিয়েছিল, এখন ধরা পড়ে দণ্ড ভোগ করছে।

    কেরী বলল, জানবার উপায় নেই কি? আমি বড় কৌতূহল অনুভব করছি।

    খুব জানা যায়, বলে রাম বসু ঢুলিকে ডাকল। সাহেব দেখে ঢুলি তাড়াতাড়ি এল আর লম্বা সেলাম করে দাঁড়াল।

    রাম বস বলল, সাহেব জানতে চাইছেন, ছেলেটার কি অপরাধ?

    ঢুলি সাহেবের উদ্দেশে রাম বসুকে বললে, হুজুর, ছোঁড়াটা মানি সাহেবের ‘সিলেভ’–

    রাম বসু বুঝিয়ে দিল—‘স্লেভ’, ক্রীতদাস।

    ঢুলি বলে চলল, মাতুনি সাহেব কুড়ি টাকা দিয়ে ওটাকে কিনেছিল। কিন্তু কুড়ি পয়সার কাজ করবার আগেই ছোঁড়া কদিন আগে পালিয়েছিল। ধরা পড়েছে কাল।

    এখন? সাহেবের হয়ে শুধায় রাম বসু।

    এখন যা দেখছেন তাই। তামাম শহর ঘোরানো হবে, তার পর ওর পিঠে পড়বে পঁচিশ ঘা চাবুক, তার পর ওকে আবার হাওলা করে দেওয়া হবে মানি সাহেবের সর্দার-খানসামার কাছে।

    তার পর?

    তার পর ব্যস, চুকে গেল।

    সমস্ত ব্যাপারটা শুনে কেরীর চোখ ছলছল করে এল। সে বলল, ব্রাদার টমাস, কি ভয়ানক অবস্থা!

    টমাস এ রকম অবস্থার সঙ্গে দীর্ঘকাল পরিচিত। সে বলল, এমন তো চলছে দীর্ঘকাল ধরে।

    আর একদিনও চলতে দেওয়া উচিত নয়।

    টমাস বলল, খ্রীষ্টধর্ম প্রচার হলেই এসব নৃশংসতা ক্রমে কমে আসবে।

    কিন্তু তার অনেক আগেই যে ওর পিঠে পড়বে পঁচিশ ঘা চাবুক।

    অবশ্যই পড়বে, ওরা সব ক্ষুদে শয়তান-বলল মিসেস কেরী।

    বল কি ডরোথি, ঐ কোমল পিঠে কড়া চাবুক পড়লে কি থাকবে?

    শয়তানি ছাড়া আর সবই থাকবে।

    তুমি বড় নিষ্ঠুর ডরোথি।

    তার কারণ সংসারে শয়তান অগণিত। যাই হক, এখন পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধর্মতত্ত্ব আলোচনার স্পৃহা আমার নেই, তাড়াতাড়ি ফিরে চল।

    কেরী বলল, না না, ছেলেটার একটা ব্যবস্থা না করে ফিরতে পারি না। আচ্ছা মিঃ মুন্সী, কেউ যদি কুড়ি টাকা দেয় তবে ওকে পেতে পারে না কি?

    টমাস, পার্বতী, রাম বসু সবাই দেশের রীতি জানত, একযোগে বলল, অবশ্যই পারে।

    তবে দেখ ছেলেটাকে পাওয়া যায় কিনা।

    ঢুলির সঙ্গে একজন পেটি পুলিস অফিসার ছিল, সমস্ত শুনে বলল, আপনি কুড়ি টাকা দিলে এখনই আপনি ছেলেটার possession পেতে পারেন।

    কিন্তু ওর মালিকের অনুমতি আবশ্যক হবে না কি?

    পুলিস অফিসার বলল, মার্টিন সাহেবের অনুমতি দেওয়াই আছে, তিনি ছেলেটাকে রাখতে চান না।

    ঢুলি সমর্থনে বলল, হুজুর, ছোঁড়া ভারি বজ্জাত। অমন কাজও করবেন না। ওর জ্বালায় আপনার হাড় একদিকে মাস একদিকে হবে।

    কেরী বিচলিত না হয়ে যখন টাকা বের করতে উদ্যত হল তখন মিসেস কেরী যুগপৎ বিস্ময়ে ক্রোধে বিরক্তিতে তর্জন করে উঠে বলল—তুমি কি সত্যি ওটাকে কিনছ নাকি?

    ডরোথি, ছেলেটাকে কিনছি বলা উচিত নয়, মানুষ সম্বন্ধে কেনাবেচা শব্দ প্রয়োগ করা খুষ্টানোচিত নয়, আমি ওর মুক্তির ব্যবস্থা করছি।

    বেশ তো, মুক্তি দাও, কিন্তু দয়া করে ঘরে নিয়ে যেও না।

    ঘরে না নিলে থাকবে কোথায়?

    কিন্তু কোন্ ঘরে নেবে ভেবে দেখেছ? তোমার নিজেরই তো ঘর নেই।

    আজ নেই কাল হবে।

    সে ঘরে ও ছেলেটা স্থান পেলে আমি সে ঘরে প্রবেশ করব না, এ তুমি নিশ্চয় জেনো।

    কেন বল তো?

    ও তো একটা আস্ত জানোয়ার। আমার জ্যাভেজকে খেয়ে ফেলতে ওর বাধা কি!

    আচ্ছা সেসব পরে বিচার করব—এই বলে কেরী পুলিস অফিসারটির হাতে কুভি টাকা দিল, পুলিস অফিসার একখানি রসিদ লিখে দিয়ে ছেলেটাকে ছেড়ে দেবার হুকুম দিল।

    খাঁচার দরজা খোলা পাওয়ামাত্র, এতক্ষণ এত কাণ্ডের মূলস্বরূপ সেই ছেলেটি একলক্ষে বাইরে এসে দাঁড়াল—এবং ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম, মাকু দিয়ে বাঁধলাম, একবার ভ্যা কয় তো বাপু’-বলে তারস্বরে বারকয়েক ভ্যা ভ্যা করে চিৎকার করল।

    তার ভাবভঙ্গী ও চীৎকারে জনতা হো হো করে হেসে উঠল।

    ছেলেটা বুঝে নিয়েছিল যে এখন সে হাত বদলিয়ে মাতুনি সাহেবের ‘সিলেভ’ থেকে এই নতুন সাহেবের ‘সিলেভ’-এ পরিণত হল। সে কেরীর সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে লম্বা এক সেলাম করে বলল, বান্দা হাজির হ্যায়, হুজুর, কুচ ফরমাইয়ে।

    তার পর কোন ফরমাশের অপেক্ষা না করেই আপন মনে গান ধরল–

    “কে মা রথ এলি?
    সর্বাঙ্গে পেরেক মারা চাকা ঘুর ঘুর ঘুরালি!
    তোর সামনে দুটো কেটো ঘোড়া,
    চুড়োর উপর মুখপোড়া,
    চাঁদ চামরে ঘণ্টা নাড়া, মধ্যে বনমালী।
    মা তোর চৌদিকে দেবতা আঁকা,
    লোকের টানে চলছে চাকা,
    আগে পাছে ছাতা পাখা, বেহদ্দ-ছেনালি।”

    হঠাৎ গানের মাঝখানে সে বলে উঠল, না, বসে বসে পা দুটো ধরে গিয়েছে, একটু খেলিয়ে নিই।

    এই বলে নাচতে শুরু করল। সুযোগ বুঝে ঢুলিও যোগ দিল, কাজেই নৃত্য গীত ও বাদ্য কিছুরই অভাব হল না। আর রথযাত্রার অভাবিত পরিণামে জনতাও খুশি হয়ে উঠে ‘বাঃ ভাই বেশ’, ‘ঘুরে ফিরে,’ ‘রসে বাজাও ভাই, ঢুলি,’ ‘বাহাদুর ছোকরা’ প্রভৃতি বাক্যে উৎসাহ প্রদান করতে লাগল।

    গান থামলে কেরী বলল, ছেলেটি খুব স্মার্ট।

    টমাস বলল, একবারে বাচ্চা ফলস্টাফ।

    মিসেস কেরী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল, কোনক্রমেই এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে না এই যেন তার প্রতিজ্ঞা।

    রাম বসু জিজ্ঞাসা করল-এই ছোঁড়া, তোর নাম কি?

    দাদা, তোমার চেহারা দেখে তোমাকে বুঝলাম বলে মনে হয়েছিল। নাম ধাম সব খুলে বললাম তবু বুঝতে পারলে না?

    কেমন?

    তোমার সামনে দুটো কেটো ঘোড়া, মানে ঐ সেপাই দুটো। চূড়োর উপর মুখপোড়া–ঐ যে কোম্পানির নিশানটা, আর চাঁদ চামরে ঘণ্টা নাড়া মধ্যে বনমালী-বলে দেখিয়ে দিল নিজেকে।

    তা হলে তোর নাম বনমালী, কেমন?

    যতক্ষণ রথের উপর ছিলাম তাই ছিল, এখন যা খুশি বলে ডাক। কোম্পানির কাছে নালিশ করব না।

    বাড়ি কোথায়?

    এতক্ষণ ছিল ঐ রথের মধ্যে, তার আগে মাতুনি সাহেবের বাড়িতে, এখন পথের উপর—এর পরে বুঝি এই সাহেবের বাড়িতে হবে।

    তার মানে, তোর বাড়িঘর নেই?

    দাদা, এত যার বাড়িঘর, তার বাড়িঘর নেই? কি যে বল!

    কেরী তাদের কথোপকথন বুঝতে পারে নি, তাই রাম বসুকে শুধাল, কি বলছে?

    বলছে ওর নামও নেই, বাড়িঘরও নেই।

    কেরী বলল, ওর নাম দিলাম ফ্রাইডে, আজ তো ফ্রাইডে বটে, আজ ওকে পেলাম। আর বাড়ি? আমার বাড়িতে।

    কেরীর স্পষ্টোক্তি শুনে মিসেস কেরী স্পষ্টতর উক্তি প্রয়োগ করল, তাহলে ওকে নিয়েই থাক। আমি ঐ আস্ত জন্তুটার সঙ্গে থাকতে রাজী নই।

    কেরী-দম্পতির গৃহবিপ্লব শুরু হয় দেখে রাম বসু বলল—আচ্ছা সেজন্য আপনারা ভাববেন না, আমি ওকে আমার বাড়িতে রাখব।

    একটি জটিল সমস্যার এত সহজে সমাধান দেখে কেরী সকৃতজ্ঞ ভাবে বলল, মিঃ মুন্সী, তোমাকে ধন্যবাদ।

    রাম বসু বলল, বেলা অনেক হল, তাহলে আমি ওকে নিয়ে বাড়ি যাই। কি বল পার্বতীদা? তুমিও চল।

    পার্বতীচরণের বড় অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল, সে বলল, নিশ্চয়।

    তখন রাম বসু, পার্বতীচরণ ও ছোকরা—তিনজনে প্রস্থান করল। কেরী-দম্পতি চলল বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোডে স্মিথদের বাড়ির দিকে।

    .

    ১.১২ রামরাম বসুর সংসার

    রামরাম বসুর নিবাস ডিঙিভাঙা অঞ্চলে, পার্বতীচরণের নিবাস কলিঙ্গা বাজারের কাছে। তাদের প্রতিবেশী বললেই চলে।

    রাম বসুর জন্ম খুব সম্ভব ১৭৫৭ সালে। ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্রে’র ভূমিকায় সে লিখেছে-”আমি তাঁহারদিগের (প্রতাপাদিত্যের) স্বশ্রেণী, একই জাতি”, কাজেই তাকে বঙ্গজ কায়স্থ গণ্য করা যায়। “তাছাড়া প্রচলিত জীবনকাহিনীতে তার জন্মস্থান চুঁচুড়া ও শিক্ষাস্থল ২৪-পরগণার নিমতা গ্রাম বলে উল্লিখিত আছে।”

    বর্তমানে তার নিবাস কলকাতা শহরে। সেকালে ইংরেজের মুন্সীগিরি করে অনেকে ধন মান ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুর বোধ করি তার প্রকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত। তিনি অল্পবয়সে ওয়ারেন হেস্টিংসের মুন্সী হন, তারপর ক্লাইভের। এই দুই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা ধুরন্ধরের আনুকূল্যে ও নিজের বুদ্ধিবলে মুন্সী নবকৃষ্ণ শেষ পর্যন্ত মহারাজারূপে কলকাতা সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি পরিগণিত হয়েছিলেন।

    রাম বসুও অল্প বয়সে ইংরেজের মুলীগিরি লাভ করেছিল, কিন্তু জমিদারি পদবী তার ভাগ্যে ঘটে নি। ওসব বস্তুতে তার যে আগ্রহের অভাব ছিল এমন নয়, আসল কারণ সে যাদের মুন্সী হল, তারা কেউ রাজপুরুষ ছিল না, কাজেই রাম বসুরও রাজগী লাভ ঘটল না। মূল বনস্পতির উচ্চতার উপরেই পরগাছার উচ্চতা নির্ভর করে।

    রাম বসুর রাজগী লাভ ঘটে নি সত্য, কিন্তু অন্য রকম খ্যাতি ও অমরত্ব সে লাভ করে গিয়েছে এই কাহিনী তার প্রমাণ। বসুর ফারণী ও বাংলা ভাষায় বেশ দখল ছিল। ১৭৮৩ সালে টমাস নামে একজন মিশনারী এদেশে আসে। দেশের অবস্থা দেখে তার মনে হল, এদেশে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করা উচিত। তখন সে দেশে ফিরে যায় এবং ১৭৮৬ সালে এদেশে ঐ উদ্দেশ্য নিয়ে আসে। কি ধর্মপ্রচার করতে গিয়ে সে বুঝল, প্রধান অন্তরায় ভাষা। ওই সময় উইলিয়াম চেম্বার্স ছিল সুপ্রীম কোর্টের ফারসী দো ভাষী। চেম্বার্স রাম বসুর সঙ্গে টমাসের যোগাযোগ সাধন করে দিল—তখন ১৭৮৭ সাল। এই বহর থেকে রাম বসুর মৃত্যুর ১৮১৩ সাল পর্যন্ত সে কোন-না-কোন মিশনারীর সঙ্গে কাটিয়েছে। এবার বুঝতে পারা যাবে, দীর্ঘকাল সাহেবের মুলীগিরি করেও কেন বসুর ধন, মান ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ ঘটে নি। মিশনারীগণ ধনমানের সন্ধানে আসে নি, কাজেই তাদের সঙ্গীরও ও-বস্তু প্রাপ্তি ঘটে নি।

    এই সময় থেকে রাম বসুর ইতিহাস মিশনারীদের ইতিহাস, রাম বসুর পথ ও গতিবিধি মিশনারীদের পথ ও গতিবিধি—আর সে ইতিহাস রাম বসুর মৃত্যুতে অবসিত হল না, উত্তরপুরুষে গিয়ে বর্তাল।

    ১৭৮৭ সালে হিতাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে টমাস গেল মালদহে। সেখানে কোম্পানির রেশম কুঠির কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট জর্জ উডনী। তারও খ্রীষ্টধর্ম প্রচারে আগ্রহ। টমাস তার বাড়িতে থাকে, বসুর কাছে বাংলা ও ফারসী শেখে, অবসর সময়ে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করে ঘুরে বেড়ায়, রাম বসুকে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে হয়।

    রাম বসুর সান্নিধ্যে বাস করে টমাসের ধারণা হল, লোকটি কেবল বিদ্বান্ নয়, তার মনটাও যেন ক্রমে সত্যধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বসু কথায়-বার্তায় সদা-সর্বদা বাইবেলের উল্লেখ করে, খ্রীষ্ট-মহিমার গুণগান করে। টমাস ভাবল, আর একটু হলেই প্রথম খ্রীষ্টান করবার গৌরব সে লাভ করবে। বলা বাহুল্য, সে-গৌরব কাউকে লাভ করতে হয় নি, বসুজা পৈতৃক ধর্মের কোলেই দেহরক্ষা করেছিল। বসু মাঝে মাঝে বাংলা ভাষায় খ্রীষ্টীয় সংগীত রচনা করে টমাসের আশানল উস্কে দিত, কিন্তু এমনই তার স্বাভাবিক সংযমবোধ যে, আশানলকে কখনও চিতানল করে তোলে নি। পথভ্রষ্ট রাম বসু মিশনারীদের সঙ্গে না জুটে ওয়ারেন হেস্টিংস বা ক্লাইডের দলে ভিড়লে বাংলা দেশের অভিজাত সমাজ আর-একটা রাজা-মহারাজার পদবীগৌরব লাভ করত। কিন্তু প্রতিভা এমন শক্তি যে, পথভ্রষ্ট হলেও পথ কেটে নিতে ভোলে না, রাম বসুর প্রতিভাও পথ কেটে নিয়েছে–বাংলা গদ্য রচনারীতির পথ।

    ১৭৯২ সালে টমাস ইংল্যান্ডে ফিরে গেল কিন্তু একেবারে শূন্য হাতে গেল না, রাম বসু কৃত একটি খ্রীষ্ট-মহিমা-সংগীত হাতে করে গেল। আর সেই সংগীত, রাম বসুর খ্রীষ্টান হব-হব মনোভাব, তার অগাধ পাণ্ডিত্য, ব্রাহ্মণদিগকে তর্কযুদ্ধে ধরাশায়ী করতে তার অসাধারণ নৈপুণ্য প্রভৃতি ‘আশার ছলনা’য় সেখানকার একটি মিশনারী সম্প্রদায়কে এমন প্রলুব্ধ করে তুলল যে, তারা অচিরে পাত্রী উইলিয়াম কেরীকে সপরিবারে এদেশে পাঠাবার সঙ্কল্প করল। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী টমাস ও সপরিবার কেরী ১৭৯৩ সালের ১৩ই জুন দিনেমার জাহাজ ‘প্রিন্সেস মারিয়া’ যোগে যাত্রা করে ১১ই নভেম্বর তারিখে চাঁদপাল ঘাটে এসে নামল।

    জানবাজার রোড বরাবর পুবদিকে চলেছে রাম বসু, পার্বতী ও ছোকরাটি; হোকরাটি কয়েক ধাপ আগে, পিছনে পাশাপাশি বসুজা ও পার্বতী।

    পার্বতী ফিস ফিস করে বলল, বসুজা, নিয়ে তো চললে, তার পর?

    তার পর নিত্য যা হয় তাই হবে।

    কিন্তু ঐ ছেলেটার সম্মুখে?

    কার সম্মুখে না হচ্ছে, না হয় আর একটা লোক বেশি জানবে—এই তো?

    তাই বা কেন হবে? কেন নিতে গেলে ঐ ছেলেটার ভার?

    নইলে যে কেরীর গৃহবিপ্লব শুরু হয়।

    তোমারই বা কোন্ গৃহশান্তি? দেখ এখনও সময় আছে।

    ভায়া, আর সময় নেই, এখন আর ফিরিয়ে দিয়ে আসা চলে না। আর খুব বেশি অশান্তি দেখি তত নিয়ে গিয়ে টুশকির জিম্মা করে দেব।

    ঐ অতটুকু ছোঁড়াকে দেবে টুশকির বাড়িতে!

    আর কি উপায় আছে বল।

    টুশকি রাজী হবে তো?

    টুশকিকে তুমি জান না। এক রাত্রির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যারা ওর কাছে যায়, তাদের প্রতি ওর দারুণ ঘৃণা। এই নিরীহ ছোকরাকে পেয়ে ও বেঁচে যাবে।

    যায় ভালই। কিন্তু আমি প্রায়ই তোমার কথা ভাবি, কোন সুখে থাক ঘরে।

    ঘরে আর থাকি কই! পাদ্রীদের সঙ্গেই তো দীর্ঘকাল ঘুরে বেড়ালাম। আর যখন একেবারে অসহ্য বোধ হয়, টুশকির কাছে গিয়ে পড়ে থাকি।

    কি, একরাত্রির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে?

    না ভাই, অনেক রাত্রির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। ও আমার অবস্থা কতক বোঝে!

    তাহলে আমি এখন যাই, বলল পার্বতী।

    কাল সাহেবের ওখানে আসছ তো?

    না, দিনতিনেকের জন্য বাইরে যাচ্ছি, ফিরে এসে দেখা করব-বলে পার্বতী বিদায় নিল।

    তখন রাম বসু ছোকরাটাকে কাছে ডেকে বলল—হ্যাঁ রে, তোকে কি বলে ডাকব?

    সে বলল, ন্যাড়া বলেই ডেকো। মনে পড়ছে খুব ছেলেবেলায় যেন ঐ নাম ছিল।

    তার মানে? ছেলেবেলার কথা কি মনে নেই তোর?

    সে অনেক কথা, আর একদিন বলব। কিন্তু এত বেলায় তো নিয়ে চললে, গিন্নিমা রাগ করবে না তো?

    না রে না, সে রকম লোকই নয়।

    না হয়, ভালই। কিন্তু তোমাদের কথাবার্তা কিছু কিছু কানে ঢুকল যে!

    শুনেছিস নাকি? চল্, তবে এবার দেখবি।

    দু-চার মিনিট পরেই একধারে ডোবা অন্যধারে বাঁশঝাড় রেখে, মাঝখানের শুঁড়ি পথ ধরে দুজনে এসে দাঁড়াল হোগলাপাতায় ছাওয়া বাড়ির সামনে। রকে বসে খেলছিল চার-পাঁচ বছরের একটি বালক। সে চীৎকার করে উঠল-মা, বাবা এইছে।

    ভিতর থেকে উত্তেজিত কাংস্যকণ্ঠে উত্তর এল—এই যে আমিও এইছি, তৈরী হয়েই ছিনু।

    মুহূর্ত পরে খাটো মলিন শাড়ি পরা কৃশকায় এক রমণী বের হয়ে এল, হাতে তার এক মুড়ো ঝাঁটা।

    কিন্তু একটির বদলে দুটিকে দেখে অভ্যস্ত কার্যে বাধা পড়ল, কাঁসার বাটি খন খন আওয়াজ করে উঠল-একা রামে রক্ষা নাই, সুগ্রীব দোসর!’ আজ আবার সঙ্গে কারপরদাজ আনা হয়েছে! ভাবা হচ্ছে যে, আমি দুজনের সঙ্গে পেরে উঠব না। দেখবি তবে, দেখবি?

    এই বলে সে কোমরে কাপড় জড়াতে শুরু করল।

    রাম বসু তাকে শান্ত করবার অভিপ্রায়ে বলল, গিন্নি, আগে শোন ছেলেটা কে, তার পর রাগ কর।

    কাঁসার বাটি উগ্রতর রবে খন খুন করে উঠল-বটে বটে, আমি রাগ করেছি। আগে তো ময়লা সাফ করে নিই, রাগ করব তার পরে।

    তাকে খুশি করবার ইচ্ছা ন্যাড়া সাষ্টাঙ্গে প্রণত হয়ে বলল, গিন্নিমা, পেন্নাম হই।

    দূর, দূর! ছুঁস নে-বলে বসুপত্নী তিন হাত পিছিয়ে গেল। তার পর স্বামীর উদ্দেশে বলল, নিজে তো খিরিস্তানের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে জাতজন্ম খুইয়েছ, আবার সঙ্গে করে আনা হয়েছে একটা আস্ত খিরিস্তানকে।

    ভুল করছ গিন্নি, ও খিরিস্তান নয়।

    খিরিস্তান নয় তো কাটা-পোশাক গায়ে কেন?

    কাটা-পোশাক পরলেই কি খিরিস্তান হয়? দাড়ি থাকলেই কি মুসলমান হয়?

    এখন বসুর এক শ্যালকের দীর্ঘ শ্মশু ছিল। গিন্নি ভাবল, লক্ষাটা তারই প্রতি—

    তবে রে ড্যাকরা মিন্সে, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা—

    সম্মার্জনী স্বামীর উদ্দেশে নিক্ষিপ্ত হল।

    রাম বসু জানত, ঠিক কোটির পরে কি ঘটবে, স্বামী-স্ত্রীতে অনেকদিনের পরিচয় কিনা, সে চট করে মাথা নীচু করে নিয়ে অস্ত্রকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করল। ষ্টলক্ষ্য সম্মার্জনীকে লক্ষ্য করে ন্যাড়া হাততালি দিয়ে বলে উঠল—’বো-কাটা’–কিন্তু রাম বসু গীতো নিষ্কাম পুরুষের ন্যায় যেন কিছুই ঘটে নি এমনভাবে বলল, গিন্নি, বেলা অনেক হল, দুই ঘড়ি বাজে, খেতে দাও।

    খেতে দাও! এতবেলা অবধি যেখানে ছিলে সেখানে গিয়ে গেলো গে—এখানে কেন?

    এই বলে সদর্পে ঘরের ভিতরে গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।

    রাম বসু বলল—আস্তে গিন্নি আস্তে, দবজা ভেঙে গেলে চোর-হঁচড় ঢুকবে।

    ভিতর থেকে আওয়াজ এল-চোর-ছ্যাচড় ঢুকবে! কত সাত রাজার ধন মানিক এনে রেখেছ কিনা!

    রাম বসু গৃহিণী-চরিত্রের অন্ধিসন্ধি জানত, বুঝল, আজ এখানে ভাত জোটবার আশা নেই। ন্যাড়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে আঙিনার বাইরে এসে দাঁড়াল। বলল, চল।

    কোথায়?

    চল্‌ না! তোর বুঝি খুব খিদে পেয়েছে, মুখ শুকিয়ে গিয়েছে যে!

    ন্যাড়া অল্পবয়সে অনেক দেখেছে কিন্তু ঠিক এহেন দৃশ্য তার অভিজ্ঞতার বহির্ভূত। সে বলল, দাদা, আমাকে এনেই এত গোলমালে পড়লে। আমাকে বরঞ্চ ছেড়ে দাও।

    দূর বোকা, সে কি হয়, বিশেষ সাহেবের কাছ থেকে ভার নিয়েছি তোকে আশ্রয় দেব।

    ও কাজটি পারবে না। আমাকে এ পর্যন্ত কেউ আশ্রয় দিতে পারে নি, না বাপ মায়ে, না সাহেব-সুবোয়। তুমিও পারবে না, মাঝ থেকে তোমার হেনস্তা হবে!

    বসু কোন উত্তর দিল না দেখে ন্যাড়া শুধাল, তা এত বেলায় আবার চললে কার বাড়িতে?

    টুশকির বাড়িতে।

    সে কে হয় তোমার?

    কেউ হয় না।

    তবে বোধ হয় আশ্রয় মিলবে—ঐ যে বলে কিনা, আপন চেয়ে পর ভাল, পর চেয়ে বন ভাল।…তা সেখানেও আশ্রয় না মেলে কাছে তো সুন্দরবন রয়েছেই।

    চল।

    সে আবার কতদূর?

    মদনমোহনতলা।

    সে যে অনেক দূর!

    হাঁটতে পারবি না?

    অপ্রস্তুত হয়ে ন্যাড়া বলল, না না, এমনি বললাম, খুব হাঁটতে পারব, চল। তখন তারা মদনমোহনতলার দিকে হন হন করে হাঁটতে শুরু করল।

    .

    বসুপত্নী অন্নদা একটি মূর্তিমতী খাণ্ডারণী। যে সংসারে স্বামী-স্ত্রীতে মনের মিল, সে সংসারে পয়ার ছন্দ। ছত্রে ছত্রে মিলে গিয়ে সংসাররূপ মিত্রাক্ষর দিব্য শান্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, অগ্রসর হবার উদ্দীপনা অনুভব করে না। আর যে সংসারে স্বামী স্ত্রীতে মনের মিল নেই তা হচ্ছে গিয়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দ-ছত্র থেকে ছত্রান্তরে, যতি থেকে যত্যন্তরে, অতৃপ্তির আবেগে কেবলই এগিয়ে চলে, শান্তি না থাকায় কোথাও সমাপ্তির নিষেধ স্বীকার করতে হয় না। রাম বসুর লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ, সাহেব পাদ্রীর প্রতি ঔৎসুক্য, খ্রীষ্টীয় ধর্মে বিশ্বাস প্রভৃতির মূলে সাংসারিক অশান্তি। সাংসারিক শান্তির অভাবেই মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রেরণা।

    ১.১৩ টুশকি

    সন্ধ্যাবেলা টুশকি তসরের শাড়ি পরল, হাতে একজোড়া মন্দির নিল, ডাকল, ন্যাড়া, আয় আমার সঙ্গে।

    রাম বসু শুধাল, কোথায় চললে?

    কেন, জান না নাকি? মদনমোহনের আরতি দেখতে।

    ন্যাডাকে আবার কেন?

    ও এখানে একলা থেকে কি করবে? দেখে আসুক। তার পর একটু ভেবে বলল, সন্ধ্যাবেলায় দেবদেবী দেখলে মনটা ভাল থাকে। না রে ন্যাড়া?

    তা বইকি দিদি। সারাটা দিন অসুরগুলোর সঙ্গে কাটে যে। এ তবু ভাল, দিনের বোঝা দিনে নামে। সাহেবগুলোর সঙ্গে থেকে দেখলাম কিনা—ওরা সাতদিনের বোঝ নামায় একদিনে, রবিবারে।

    টুশকি হেসে বলল—সাতদিন বইতে পারে?

    ন্যাড়া বলল, তুমি আমি হলে কি পারতাম, ঘাড় ভেঙে যেত। ওরা যে অসুর। সাতদিনের বোঝা বইবার মত করেই ওদের দেহ তৈরি।

    ন্যাড়ার কথায় টুশকি হেসে উঠল। রেড়ির তেলের সেই স্তিমিত আলোতেও রাম বসুর চোখে পড়ল টুশকির নিটোল গালে দুটি টোল।

    বসুজার দৃষ্টি টুশকির চোখ এড়াল না, সে বলল, তুমি একা বসে থেকে কি করবে?

    রাম বসু বলল, বসে আর রইলাম কোথায়! অথৈ সাগরে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।

    দেখো ডুবে না যাও।

    ডোববার চেষ্টাই তো করছি।

    কেন, ডোববার এত শখ কেন?

    তলিয়ে দেখি পাতালপুরীর রাজকন্যে মেলে কি না।

    তবে তাই দেখ। আমি এখন চললাম। আয় ন্যাড়া। এই বলে ন্যাড়াকে সঙ্গে নিয়ে টুশকি প্রস্থান করল।

    ঘণ্টাখানেক পরে টুশকি ফিরে এল। টুশকি দেখল যে, প্রদীপের কাছে বসে বসুজা নিবিষ্ট মনে লিখছে, ওদের আগমন টের পেল না। টুশকিই প্রথম কথা কইল-কি কায়েৎ দাদা, কি লেখা হচ্ছে?

    ওঃ, তোমরা ফিরলে? কিছু না, একটা গীত রচনা করলাম।

    গীত! কি গীত? সেই পাতালপুরীর রূপবর্ণনা নাকি?

    না ভাই, ঠিক উল্টো। সাগর পার করবার জন্যে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা।

    কেন, পার হতে যাবে কেন? ডুবে মরবার শখ যে হয়েছিল!

    এখনও আছে। কিন্তু সাহেবের ইচ্ছা অন্যরকম।

    এর মধ্যে সাহেব আবার এল কোত্থেকে?

    খাস বিলেত থেকে, কেরী সাহেব। যার কথা ওবেলা বলেছি।

    সাহেবের ইচ্ছাটা কি?

    যীশু সম্বন্ধে একটা গীত লিখি।

    আর তুমি লিখে ফেললে? কোথাকার মেলেচ্ছ, তাদের দেবতার বিষয়ে অমনি গীত রচনা করলে! কায়েৎ দাদা, কিছুই তোমার অসাধ্য নয়!

    সাধ্য কি অসাধ্য শোন না একবার।

    দাঁড়াও কাপড়টা ছেড়ে আসি, অমনি ন্যাড়াকেও খেতে দিয়ে আসি, ছেলেটার ঘুম পেয়েছে।

    কিছুক্ষণ পরে টুশকি ফিরে এলে, বাতিটা কাঠি দিয়ে উস্কে দিয়ে রাম বসু সুর করে পড়তে শুরু করল

    “কে আর তারিতে পারে
    লর্ড জিজছ ক্রাইস্ট বিনা গো,
    পাতকসাগর ঘোর
    লর্ড জিজছ ক্রাইস্ট বিনা গো।
    সেই মহাশয়            ঈশ্বর তনয়
    পাপীর ত্রাণের হেতু।
    তারে যেই জন            করয়ে ভজন
    পার হবে ভবসেতু।
    এই পৃথিবীতে            নাহি কোন জন
    নিষ্পাপী ও কলেবর।
    জগতের ত্রাণকর্তা            সেই মহাশয়
    জিজছও নাম তাঁহার।
    ঈশ্বর আপনি            জন্মিল অবনী
    উদ্ধারিতে পাপী জন।
    যেই পাপী হয়            ভজয়ে তাঁহার
    সেই পাবে পরিত্রাণ।
    আকার নিকার            ধর্ম অবতার
    সেই জগতের নাথ।
    তাঁহার বিহনে            স্বর্গের ভুবনে
    গমন দুর্গম পথ।
    সে বদন বাণী            শুন সব প্রাণী
    যে কেহ তৃষিত হয়।
    যে নর আসিবে            শুদ্ধ বারি পাবে
    আমি দিব সে তাহায়।
    অতএব মন            কর রে ভজন
    তাঁহাকে জানিয়া সার।
    তাঁহার বিহনে            পাতকিতারণে
    কোন জন নাহি আর।”

    পড়া শেষ করে বসু জিজ্ঞাসা করল, কেমন লাগল?

    টুশকি মনে দিয়ে শুনছিল, বলল, খুব সুন্দর, শুনলে জ্ঞান হয়, কেবল ঐ জিজছ না কি বললে না, ঐটি ছাড়া।

    আরে ঐটিই তো আসল, আর কিছু না থাকলেও চলত। আমাদের ভক্ত বৈষ্ণব বাবাজীরা যেমন কৃষ্ণ-র ‘ক’ শুনলেই মৃছা যায়, পাদ্রীদেরও প্রায় সেই দশা।

    তোমার দশা দেখছি আরও খারাপ—ঐ নাম শুনে লম্বা গীত রচনা করে ফেললে, এর চেয়ে যে মূৰ্ছা হলে ভাল ছিল।

    এক এক সময়ে আমিও তাই ভাবি। কিন্তু মূৰ্ছা যাওয়ার উপায় কি? কেরী সাহেব দেখা হলেই গীতটার জন্যে তাগিদ দেয়।

    তাই বল, সেই তাগিদে লিখলে! তবু ভাল, আমি ভাবলাম, কি জানি, হয়তো বা এবারে জিজছ ভজবে।

    পাগলি! পাগলি! আমার কাছে কৃষ্ট আর খৃষ্ট দুই-ই সমান। আসলে আমি যার ভক্ত তার নাম শুনবে?

    না, সে পাপ নাম মুখে এনো না; তাছাড়া হাজারবার তো শুনেছি।

    এই বলে টুশকি হাসল, গালে দেখা দিল টোল।

    বসুজা বলল—ঐ কালিয়দহে যে ডুবে মরেছে তাকে টেনে তোলবার সাধ্য গোকুলের কেষ্ট কি ফিলিস্তানের খৃষ্ট—কারও নেই।

    কিন্তু ঐ হাসি দেখেই কি পেট ভরবে? খেতে হবে না?

    তারপর একটু থেমে বলল—পাদ্রীগুলোর সঙ্গে মিশে তোমার এইটুকু উন্নতি হয়েছে যে, আমার হাতে ভাত খাও, নইলে শুধু কেষ্টর সাধ্য ছিল না আমার ছোঁওয়া খাওয়ায়।

    তবে দেখ খৃষ্টের মহিমা!

    না না, কথা শোন কায়েৎ দাদা, হিন্দু দেবদেবীর সম্বন্ধে গীত লেখ।

    আরে পাগলি, হিন্দু দেবদেবী কি মাসিক কুড়ি টাকা বেতন দিতে পারবে?

    মাসিক কুড়ি টাকা বেতন পেলে কি তুমি হাঙর কুমিরের স্তব রচনা করতে পার?

    অবাক করলে। হাঙরের মুখে হাত ঢুকিয়ে বসে আছি, স্তব রচনা করা তো তুলনায় অনেক সহজ।

    পোষা হাঙর হলে সবাই পারে।

    হাঙর কুমির কখনও পোষ মানে? আসল কথা কি জান, হঠাৎ কখন বলে ফেলেছিলাম যে, জিজছ সম্বন্ধে গীত রচনা করেছি, তার পর থেকে দেখা হলেই কেরী সাহেব তাগিদ দেয়, কই মুন্সী, গীতটি কোথায়?

    আচ্ছা, সাহেব বুঝি খুব ধার্মিক?

    না হয়ে উপায় কি, যা খাণ্ডারণী ব্রাহ্মণী! তারপর টুশকির গাল দুটি একটু টিপে দিয়ে বলল, সবারই তো টুশকি নেই যে আশ্রয় দেবে; কাজেই জিজহের শরণ নিতে হয়।

    খুব ভাল লোক নিশ্চয়, নইলে সাতসমুদ্র পার হয়ে ধর্মপ্রচার করতে আসে। দেখতে ইচ্ছে হয়।

    দেখবে? আচ্ছা একদিন টমাস সাহেবকে আনব-টমাস, যার কাছে আগে চাকরি করতাম। কেরীকে পারব না।

    সাহেব এসব জায়গায় আসবে?

    আরে ওদের দেশে গুঁড়িবাড়ি, বেশ্যাবাড়ি, জুয়োর আচ্ছা, বারুদখানা, গির্জা সব পাশাপাশি একটা থেকে আর একটায় কেবল এক ধাপের ব্যবধান।

    তবে এনো একদিন কাছাকাছি সাহেব দেখি নি।

    খুব কাছাকাছি যাবার ইচ্ছা যেন!

    নাও এখন রঙ্গ রাখ। ঐ শোন, শোভাবাজারের রাজবাড়ির ঘড়িতে দশটা বাজল। এখন ওঠ, খাবে।

    আজ রাতে শোওয়াটাও এখানে।

    বেশ, তাই হবে। নাও এখন চল।

    রাম বসু কাগজখানি ভাঁজ করে চাপা দিয়ে রেখে উঠল রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে শুধাল, ন্যাড়া কোথায়?

    খেয়ে শুয়েছে ওঘরে।

    তার পর বলল, ছেলেটা বেশ।

    তবে তোমার কাছেই থাকুক।

    ওকে আবার কোথায় নিয়ে যাবে ভাবছ? এখানেই থাকবে—ওকে পেয়ে আমি বেঁচে গিয়েছি।

    টুশকি, যার কেউ নেই তুমি তার আশ্রয়, তুমি লক্ষ্মী।

    টুশকি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, যে তিন কুলে কালি দিয়েছে সে আবার লক্ষ্মী, সে আবার সরস্বতী! নাও ব’স।

    বসুজা খেতে বসলে টুশকি পরিবেষণ শুরু করল।

    .

    ১. ১৪ পাদ্রী ও মুন্সী

    পূর্বোক্ত ঘটনার পরে পাঁচ-সাত দিন অতিবাহিত। এ কয়দিন রাম বসু কেরীর সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারে নি। বসিরহাটে তার কিছু পৈতৃক জমি-জমা ছিল, হঠাৎ খবর পেয়ে সেখানে যেতে বাধ্য হয়েছিল। নতুবা নবাগত কেরীকে ছেড়ে দূরে থাকা তার স্বভাব নয়। পার্বতীকে সে বলল, ভায়া হে, একটি কথা মনে রেখ, দুধের ভাঁড় আর পাত্রী সাহেব এ দুটো বস্তুকে ছাড়া রাখতে নেই, যে পারবে এসে মুখ দেবে। কিন্তু এত সতর্কতা সত্ত্বেও মাঝখানে কদিনের জন্য পাত্রী সাহেবকে ছাড়া রাখতে সে বাধ্য হয়েছিল। ফিরে এসে দেখলে যে, না, দুধের ভাঁড় যেমন ছিল তেমনি আছে, কেউ মুখ দেয় নি।

    আজ দুপুরবেলা স্মিথদের বাড়ির বাগানে একটি আমগাছের ছায়ায় বসে কেরী, টমাস ও রাম বসুর মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। তখনকার দিনে দুপুরে কলকাতা শহরে রাতের নিযুতি নামত। দেশীয় সমাজের আদর্শে নবাগত বিদেশীগণও বাংলাদেশের নিদ্রাভরা দ্বিপ্রহরের কাছে নতিস্বীকার করেছিল। কাজেই স্মিথদের বাড়িতেও নিযুতি। কিন্তু কেরী আনকোরা নবাগক, তাই দিবানিদ্রায় অভ্যস্ত নয়, আর তার উৎসাহের ধাক্কাতে টমাস ও রাম বসুর ঘুমোবার উপায় ছিল না।

    শীতের মধ্যাহ্ন। অদূরশায়ী সুন্দরবনে উত্তরে হাওয়ার মরমর সরসর রব-একটা ঘুঘু অকারণে করুণ সুরে ডেকেই চলেছে।

    কেরী বলল, মিঃ মুন্সী, এই দিনটির জন্য আমি বাল্যকাল থেকে অপেক্ষা করে ছিলাম।

    রাম বসু বলল, ডাঃ কেরী, এসব লক্ষণ সাধারণত বাল্যকালেই দেখা দিয়ে থাকে। আমাদের শাস্ত্রে আছে যে, প্রহ্লাদ বাল্যকালেই ভক্তির লক্ষণ দেখিয়েছিল।

    তার উক্তির অনুমোদনে টমাস মাথা নাড়ল, ভাবটা এই যে, এসব কথা তার অজানা নয়।

    নিজের সমধর্মা একজনের উল্লেখে আহ্লাদিত কেরী ‘প্রহ্লাদ’ শব্দটা উচ্চারণ করতে চেষ্টা করল কিন্তু বার দুই ‘পেল্ল’ ‘প্রলা’ করেই ক্ষান্ত হল, বিজাতীয় শব্দটা তার জিহ্বার পক্ষে গুরুভার। টমাস তাকে সাহায্য করতে উদ্যত হল কিন্তু ততক্ষণে অসহায় কেরী প্রসঙ্গান্তরে পৌঁছেছে। কেরী বলল, বাল্যকালে পলাপিউরি গ্রামে একটি হিদেন বালককে দেখে প্রথম আমার মনে হিদেন সমাজে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করার বাসনা জাগ্রত হয়।

    বিস্মিত রাম বসু সাগ্রহে বলে উঠল, কি আশ্চর্য ডাঃ কেরী, আপনার জীবনবৃত্তান্তের প্রত্যেকটি ঘটনার সঙ্গে আমাদের শাস্ত্রের কেমন গাঁঠে গাঁঠে মিল! গৌতম বুদ্ধের মনেও প্রথমে একটি সন্ন্যাসীকে দেখে সংসার ত্যাগের ইচ্ছা জেগেছিল।

    এবারে বুদ্ধ নামোচ্চারণে কেরী সগর্বে উত্তীর্ণ হল, বললে, ইয়েস, বুঢ়া, তার কথা আমি পড়েছি।

    টমাস মাথা নাড়ল–ভাবটা, আমরা বিশ্বাস করেছি।

    তার পর কাপ্তেন কুকের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত পড়ে জানলাম, জগতে হিদেনের সংখ্যা অজস্র। তখন মনে হল, হায়, সত্যধর্মে দীক্ষিত না হয়ে মরলে এরা যে অনন্ত নরক ভোগ করতে বাধ্য হবে। তখনই স্থির করলাম, যাব হিদেনদের দেশে, সত্যনাম দিয়ে দুর করব তাদের নরকভোগ। এমন সময়ে-দেখ মুন্সী, করুণাময় ভগবানের কি দিব্য অভিপ্রায়-এমন সময়ে ব্রাদার টমাসের সঙ্গে পরিচয় ব্যাপটিস্টমণ্ডলীর এক সভায়।

    রাম বসু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে উঠল, যাক বাঁচলাম।

    টমাসের সঙ্গে কেরীর পরিচয়, কেরীর বাক্যসমাপ্তি, অথবা অনন্ত নরক ভোগের আশঙ্কা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা—ঠিক কোন্ অর্থটি প্রযোজ্য রাম বসুর উক্তি সম্বন্ধে সেটা ঠিক বোঝা না গেলেও টমাস ও কেরী শেষোক্ত অর্থেই রাম বসুর উক্তিকে গ্রহণ করল। আদর্শবাদিতা ও নির্বুদ্ধিতা নিকটতম প্রতিবেশী।

    রাম বসু বলল, সত্যধর্ম এদেশে প্রচার করতেই হবে, নইলে আমরা অনন্ত নরকে দগ্ধাব—কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে, প্রচারকার্যের কেন্দ্র কোথায় হবে, কলকাতায় না মফস্বলে?

    বলা বাহুল্য, রাম বসুর মনোগত অভিপ্রায় এই যে, প্রচারকার্যটা কলকাতাতেই চলুক, তা হলে সকল দিক রক্ষা পায়। কিন্তু কথাটা অত সহজে বলা চলে না, একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলাই রীতি। যে-মাছ নিশ্চিত বঁড়শি গিলেছে তাকেও খেলিয়ে তবে টেনে তুলতে হয়।

    টমাস বাংলা দেশের অনেক স্থানে ঘুরেছে, কাজেই তার বিশ্বাস, এ বিষয়ে সে একজন বিশেষজ্ঞ, তাই সে বলল, ব্রাদার কেরী, কলকাতায় ধর্মপ্রচার নিরর্থক। এখানে তবু কিছু প্রকৃত খ্রীষ্টান আছে, হিদেনগণ সদাসর্বদা খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীদের মুখ দেখছে, কাজেই তাদের অবস্থা একেবারে শোচনীয় নয়। কিন্তু এখানে বসে থাকলে আমাদের চলবে না, যেতে হবে বাংলা দেশের আলোকবর্জিত সেই সব অঞ্চলে যেখানে এখনও প্রভুর নাম প্রতিধ্বনিতেও বহন করে নিয়ে যায় নি। সেসব স্থান আমি দেখে এসেছি ডাঃ কেরী, ভয়ানক সেসব স্থানের অবস্থা। সেখানকার অধিবাসীরা দিবারাত্রি নরকানলে দগ্ধ হচ্ছে চল ব্রাদার, অবিলম্বে সেখানে যাই।

    রাম বসু দেখল যে, টমাসের বাগ্মিতা যেমন চার পা তুলে ছুটেছে, কি ঘটে বলা যায় না; হয়তো বা সপরিবারে কেরীকে লেজে বেঁধে নিয়ে এখনই দেবে ছুট আলোকবর্জিত সেই সব অঞ্চলে।

    তাই টমাসের ধাবমান বাকতুরঙ্গের গতিকে কতক পরিমাণে শ্লথ করবার উদ্দেশে রাম বসু বলল—কথা ঠিক, কিন্তু সেসব স্থান অতি দুর্গম, খাদ্যদ্রব্যের সেখানে অভাব, তার উপর আবার মারাত্মক ব্যাধি ও শ্বাপদের বড় উপদ্রব।

    টমাস বলল, মুন্সী ঠিক কথাই বলেছে, কিন্তু প্রকৃত খ্রীষ্টানের সেজন্য ভয় পেলে চলে না কারণ তার শক্তি অজেয়।

    এই বলে সে তন্ময়ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে অর্ধনিমীলিত নেত্রে করজোড়ে আবেগকম্পিত কণ্ঠে বলতে শুরু করল

    “প্রভু আমার পাথর, আমার কিল্লা, আমার পরিত্রাতা; প্রভু আমার তাগৎ, যাহাতে আমার বিশ্বাস, আমার বর্ম, আমার মুক্তির শৃঙ্গ, আমার উচ্চ মিনার।”

    কেরী ও টমাস সমস্বরে বলে উঠল, আমেন।

    রাম বসু ভাবল, কি আপদ! আমি থাকতে টমাস করবে রঙ্গমঞ্চ অধিকার! দেখা যাক কে কত বড় অভিনেতা!

    এবারে সে প্রকাশ্যে বলল, ভাল কথা, মিঃ টমাসের স্তোত্র আবৃত্তি শুনে মনে পড়ল যে, আমিও প্রভুর বিষয়ে একটা গীত লিখেছিলাম।

    কই, সঙ্গে এনেছ নাকি? বলে লাফিয়ে উঠল টমাস।

    কেরী স্থিরভাবে অথচ আগ্রহের সঙ্গে শুধায়, সঙ্গে আছে?

    রাম বসু এই কদিনের মধ্যেই কেরী ও টমাসের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য লক্ষ্য করেছে। বসুজার মতে কেরী ও টমাস দুজনেই ভক্ত, কিন্তু দুয়ের ভক্তির প্রকৃতিতে প্রভেদ আছে। কেরী ভক্তির খোয়া ক্ষীর, অটল অচল। আর টমাস ভক্তির পাতক্ষীর, ঢেলে দেবামাত্র নীচের দিকে প্রবাহিত হয়ে যায়। কত নীচে যায়, তার সাক্ষী স্বয়ং রাম বসু, জুয়ার আজ্ঞা পর্যন্ত যেতে দেখেছে, এবারে দেখবে বেশ্যাবাড়িতেও ভক্তিপ্রবাহের ঢেউ গিয়ে ধাক্কা মারে কি না।

    বসু বলল, সে গীত কি কাগজে লেখা আছে, লেখা আছে এই এখানে-বলে দেখিয়ে দিল নিজের হৃদয়টা।

    উৎসাহের আধিক্যে টমাস লাফিয়ে এক ধাপ কাছে এল রাম বসুর—ভাবটা, একবার হৃদয়ের মধ্যে উঁকি মেরে দেখবে কোন্ অক্ষরে গীতটি লিখিত—স্বর্ণাক্ষরে না রক্তাক্ষরে।

    হঠাৎ সংযত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মুদ্রিত নেত্রে যুক্তকরে যথাযোগ্য আবেগকম্পিত কণ্ঠে রাম বসু পূর্বোল্লিখিত গীতটি রামায়ণপাঠের ভঙ্গীতে ও সুরে আবৃত্তি শুরু করে দিল।

    ক্রমে তার দেহে স্বেদ অশ্র কম্প পুলক প্রভৃতি সাত্ত্বিক লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করল, আর ঝড়ের নাবিক যেমন আশাভরা আগ্রহে চাপমান যন্ত্রটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, তেমনিভাবে কেরী ও টমাস রাম বসুর মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে রইল। টমাস ভাবল, আহা, আমার কবে এমন তন্ময় অবস্থা হবে; কেরী ভাবল, এ লোকটা সত্যধর্ম গ্রহণ করলে অনেক কাজ হয়।

    কবিতা আবৃত্তি শেষ করে বসু বসল, তখনও তার ভক্তির ঘোর কাটে নি, তাই নির্বাক হয়ে রইল, আর গড়াতে লাগল তার চোখের কোণে জল।

    কেরী শুধাল, মুন্সীজী, তুমি কেন সত্যধর্ম গ্রহণে বিলম্ব করছ?

    মুন্সী কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, নসিব, পাদ্রী সাহেব, নসিব! কতবার রাত্রে স্বপ্ন দেখেছি প্রভু যীশুখ্রীষ্ট এসে আদেশ করছেন-ওরে আমার মেষশিশু, আমার পালে এসে ভর্তি হ।

    তবে কেন বিলম্ব?

    সেই সঙ্গে তিনি অন্য একটি আদেশও যে করেছেন, কালীঘাটের ঐ পৌত্তলিক মন্দিরের পাশে আমার শ্রীগির্জা গড়ে তোল—সেখানে হবে তোর দীক্ষা।

    কেরী ও টমাস ঠিক এমন একটি কঠিন আদেশের জন্য প্রস্তুত ছিল না, তবু বিশ্বাস করে উপায় নেই, কারণ একে শ্রীমুখের স্বপ্নাদেশ, দ্বিতীয়ত আদিষ্ট ব্যক্তির চোখের কোণে এখনও যে জলের রেখা।

    তা ছাড়া, মুন্সী বলে, আমার ধর্মান্ধ পৌত্তলিক আত্মীয়স্বজনের অত্যাচার।

    তোমাকে মারপিঠ করে নাকি?

    করে না আবার! এই দেখ—বলে পিঠে একটা ক্ষতচিহ্ন দেখায় বসু।

    কিছুদিন আগে ফোড়া হয়েছিল, তারই দাগ।

    কেরী বলে, তুমি নালিশ কর না কেন?

    কি বলছেন পাদ্রীসাহেব! আমার প্রভু কি তাঁর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন? আমি সেই দিব্য মেষপালকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কেবল বলি—পিতা ওদের ক্ষমা কর, ওরা জানে না ওরা কি করেছে।

    নিজেদের হঠকারিতায় কেরী ও টমাস অনুতপ্ত হয়ে বলে, পিতা, আমাদের ক্ষমা কর।

    তার পর কেরী শুধাল, এখন তাহলে কর্তব্য কি?

    টমাস বলে, কর্তব্য তো প্রভু কর্তৃক নির্দিষ্ট, অন্যরূপ করবার সাধ্য কি আমাদের।

    তবে সেই কথাই ঠিক—কলকাতা শহরেই কেন্দ্র করব ধর্মপ্রচারের, আর একটু স্থির হয়ে বসতে পারলেই মুন্সীর কাছে ফারসী ও বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করব।

    বসু বলে-বাসস্থানের কথাটাও আমি ভেবে দেখেছি। শহরেই মানিকতলা বলে একটা পাড়া আছে। সেখানে নীলু দত্ত নামে আছে আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু। লোকটা ঘোরতর পৌত্তলিকতাবিরোধী, তার উপর আবার আমার মতই প্রায়ই প্রভুর কাছে স্বপ্নাদেশ পেয়ে থাকে। সেদিন আপনার জন্য বাড়ি ঠিক করবার উদ্দেশে তার কাছে গিয়ে শুনলাম যে, সে রাত্রিবেলাতে স্বপ্ন দেখেছে প্রভু যেন বলছেন, ওরে বাছা, মাঠের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছি আমার এক অবোধ মেষ-শিশু, শীগগির তাকে খুঁজে বাড়িতে নিয়ে আয়। এই স্বপ্নাদেশের অর্থ সে খুঁজে পাচ্ছিল না, এমন সময় আমি আপনার জন্য বাড়ির প্রসঙ্গ তুললাম, অমনি সে বলে উঠল—এই তো পাওয়া গেছে স্বপ্নের অর্থ। তবে পাদ্রী কেরী সাহেবই হচ্ছে সেই হারানো মেষ-শিশু! অবশ্য নিয়ে আসতে হবে তাকে আমার ঘরে।

    তখন নীলু বলল–বলে চলে রাম বসু-মানিকতলায় আমার একটি বাড়ি আছে, সেটিতে নিয়ে এসে রাখ ডাঃ কেরীকে।

    ভাড়া?

    সর্বনাশ! প্রভু যাকে আদেশ দিয়ে পাঠিয়েছেন, তার কাছ থেকে নেব ভড়া!–এই বলে সে কাটস হিজ টাং–কি না, জিভ কাটে।

    কেরী আঁতকে উঠে বলে কাটস হিজ টাং–! কেন? অ্যাঙ অল ফর নথিং!

    টমাস বুঝিয়ে দেয় বাংলা ইডিয়মের অর্থ, বলে, ওর মধ্যে কাটাকাটি রক্তপাত কিছুই নেই।

    কেরী আশ্বস্ত হয়, বলে—তবে সেই কথাই ভাল, একদিন ভক্ত নীলুকে নিয়ে এস, বাড়ির ব্যাপারটা শীঘ্র স্থির করে ফেলা যাক—কারণ তোমাদের যখন সকলের ইচ্ছা টমাস মনে করিয়ে দেয়—আর প্রভুরও যখন আদেশ–

    কেরী বাক্য শেষ করে কলকাতা শহরেই ধর্মপ্রচারের কেন্দ্র স্থাপন করা যাক।

    রাম বসু বলে ওঠে, প্রভু, তোমার কৃপায় এখানে নতুন জেরুজালেম প্রতিষ্ঠিত হবে।

    মনে মনে বলে, মা কালী, তোমার আশীর্বাদে ওদের খ্রীষ্ট আর খৃষ্টানির নিকুচি করে ছাড়ব! তুমি একটু সবুর করে দেখ না মা, কি হেনস্তা ওদের করে ছাড়ি।

    কলকাতায় প্রচারকেন্দ্র করবার আরও কত সুবিধা যখন সে বোঝাতে উদ্যত হবে, তখন হঠাৎ ফেলিক্স ছুটে এসে বলল, বাবা, শীগগির এস, মা মূৰ্ছা গিয়েছে।

    মূর্ছা গিয়েছে! তিনজনে চমকে উঠে দাঁড়ায়।

    কেরী ও টমাস ব্যস্তসমস্ত হয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে।

    রাম বসু ভিতরে গেল না, বাগানের মধ্যেই পায়চারি করতে করতে মনে মনে বলতে লাগল, মা, বেটীর মূৰ্ছা আর ভাঙিও না মা, ঐ বেটীই যত ‘কু’-এর গোড়া, ওরই টানে কেরীর মন কলকাতা ছাড়বার জন্যে উসখুস করছে। দোহাই মা, মৃছা পর্যন্ত যখন নিয়েছ, আর একটু টেনে নিয়ে যাও, সকল ল্যাঠা সমূলে চুকে যাক।

    এমনি কত কি বলতে বলতে সে একাকী পায়চারি করতে লাগল।

    .

    ১.১৫ কেটির কি হল?

    কেরী ও টমাস ঘরে ঢুকে দেখল যে, ডরোথি কৌচের উপর মৃর্ভূিত হয়ে পড়ে আছে, লিজা তার নাকের কাছে ধরে রয়েছে স্মেলিং সল্ট-এর শিশি, আয়া প্রকাণ্ড একখানা পাখা দিয়ে মাথায় বাতাস করছে। আর জন অদূরে চেয়ারের উপর মাথায় হাত দিয়ে বিষণ্ণ মুখে উপবিষ্ট। বুড়ো জর্জ স্মিথ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, কেরীকে দেখবামাত্র দৌড়ে এসে বলল, ডাঃ কেরী, আমি নিতান্ত দুঃখিত যে এমন অঘটন ঘটল।

    কেরী বলল, আপনি দুঃখিত হবেন না, ডরোথির মাঝে মাঝে এমন হয়ে থাকে, এখনই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কেটিকে দেখছি না কেন? তার উচিত ছিল এসে সেবা করা, সে জানে এ রকম সময়ে কি করতে হয়।

    কেটির নাম শুনে জন উঠে নীরবে কক্ষ পরিত্যাগ করে বেরিয়ে গেল। জর্জ স্মিথ বলল, তারই জন্যে এ বিপদটি ঘটেছে। আপনি পাশের ঘরে আসুন, সব বলছি।

    বিস্মিত কেরী ও টমাস জর্জকে অনুসরণ করে পাশের ঘরে গেল। কেরী বলল আমি খুব বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন, কি হয়েছে খুলে বলুন।

    কেটি ও জন চাঁদপাল ঘাটেই পরস্পরকে আপনার বলে চিহ্নিত করে নিয়েছিল আর তার পর থেকে দিবারাত্রির অনেকটা সময় একত্র যাপন করত। ঘাট থেকে ঘরে আসবার পথে জন প্রতিশতি দিয়েছিল যে, কেটিকে নিয়ে সুন্দরবনে বেড়াতে যাবে আর সুন্দরী গাছের বনের অনুবাদ করে জন তাকে শুনিয়েছিল যে ফরেস্ট অব বিউটিফুল উইমেন’। জন প্রতিশ্রুতি ভোলে নি। প্রত্যহ সকালে ব্রেকফাস্টের পরে দুজনে ঘোড়ায় চেপে বনের ভিতরে ঢুকে পড়ত, ফিরত সন্ধ্যার আগে, সঙ্গে নিত ডিনারের জন্য কিছু খাদ্য আর আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক।

    লিজা বলত, কি জন, বনটা কেমন লাগছে? জন বলত, প্রায় ইডেন উদ্যানের মত। কৃত্রিম বিস্ময়ে লিজা বলে উঠল, কি সর্বনাশ।

    সর্বনাশ কেন?

    সেই ইডেন উদ্যান, সেই আদম ও ইভ, এখন বাকিটুকু না মিলে যায়!

    কি আর বাকি থাকল?

    সর্পরূপী শয়তান।

    বাঃ, তা না থাকলে আর মজা কিসের?

    বল কি, মজা? আদম আর ইভকে যে ইডেন উদ্যান পরিত্যাগ করে পৃথিবীতে আসতে হয়েছিল!

    সেই জন্যেই তো পৃথিবীতে তোমার মত সুন্দরী ভগ্নী পাওয়া গেল।

    ‘সুন্দরী ভগ্নী’ কথাটা সত্য, কিন্তু সেটা কেবল মিসেস কেরীর ভগ্নী সম্বন্ধেই প্রযোজ্য, অন্তত এক্ষেত্রে—বলে এলিজাবেথ।

    কৃত্রিম কোপে তর্জন করে জন বলল, লিজা, তুমি বড় মুখরা। কিন্তু আমিও মুক নই, তবে এখন সময় অল্প, আমি চললাম, কেটি বাইরে অপেক্ষা করছে।

    কেটির অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে লিজার বুকে দীর্ঘশ্বাস ফুলে ফুলে উঠল, কিন্তু সহোদরের সৌভাগ্য বলে তা পুঞ্জীভূতরূপে বাইরে না এসে মনের মধ্যেই যেত বিলীন হয়ে; সে বলত, যাও, কিন্তু সাবধানে যাতায়াত কর।

    ভয়টা কিসের? শয়তানরূপী সাপের?

    শুধু সাপটাই বা কি কম ভয়ঙ্কর?

    এইসব হাস্যপরিহাসের সময়ে কেউ জানত না যে, লিজার ঠাট্টা মর্মান্তিক বাস্তব রূপ গ্রহণ করবে। সুন্দরবন ইডেন উদ্যান না হতে পারে-তাই বলে এখানে শয়তানরূপী সর্গ থাকবে না এমন কোন কথা নেই।

    জন ও কেটি বনের মধ্যে দূর-দূরান্তে চলে যায়—বড় বড় গাছ, কালো কালো ছায়া, সরু সঁড়িপথ—দুজনের ঘোড়া যথেচ্ছ চলে; ওরা পথ দেখে না, গল্পে তন্ময় হয়ে থাকে। ভ্রমণ যেখানে উপলক্ষ্য, লক্ষ্য স্থির রাখবার সেখানে কি প্রয়োজন? যখন বেলা বাড়ে, খিদে পায়, ঘোড়া বেঁধে রেখে দুজনে ঘাসের উপর বসে, এক পাত্র থেকে খাদ্য ভাগ করে নিয়ে খায়, একটু বিশ্রাম করে, সারাদিন বনে বনে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসে।

    লিজা শুধায়—জন, তোমাদের ক্লান্তি বোধ হয় না?

    ক্লান্তি বলে একটা শব্দ অভিধানে থাকলেও প্রেমিকের অভিজ্ঞতায় একবারেই নেই। তাই ঐ শব্দটা শুনে জন চমকে উঠল যেন শব্দটা প্রথম শুনল, কিছু বলতে হয় তাই বলল, কই না তো!

    একদিন জন ও কেটি উপস্থিত হল দুর্গাপুর বলে ছোট এক গ্রামে। সেখানে পরিচয় ঘটল মশিয়ে দুবোয়া বলে এক ফরাসী ভদ্রলোকের সঙ্গে। লোকটা সভ্যতার প্রান্তে বনের মধ্যে অনেককাল বাসা বেঁধেছে। সুন্দরবনের মোম, মধু, হরিণের চামড়া প্রভৃতি পণ্য কেনে, শহরে চালান দেয়—ঐ তার ব্যবসা।

    দুবোয়া তাদের দুজনকে সাদরে অভ্যর্থনা করল, দুপুরবেলা ডিনারে ভুরিভোজন করাল আর পুনরায় আসবে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিল তাদের কাছে। দুবোয়া অবিবাহিত।

    জনের সাংসারিক ভূয়োদর্শিতা যথোচিত হলে এমন লোকের বাড়িতে কেটিকে নিয়ে দ্বিতীয়বার পদার্পণ করত না। কিন্তু জন অভিজ্ঞতায় কিশোর, বয়সে তরুণ, প্রেমে যুবক, তাই অন্ধ। তার বোঝা উচিত ছিল দুবোয়া-ও তার মতই নারীদুর্ভিক্ষ-জগতের মানুষ; দিব্যদৃষ্টি থাকলে বুঝতে বিলম্ব হত না যে, ইংরেজ যুবকের জন্য মাঝবয়সী ফরাসীর আকস্মিক আকর্ষণের কারণ তৃতীয় কোন বস্তুতে নিহিত, সেটি দুর্ভিক্ষের অন্নপিণ্ড। আর ‘বুভুক্ষিতঃ কিং ন করোতি পাপম।’

    এমন পর পর তিনদিন দুবোয়ার আতিথ্য গ্রহণ চলল। জন অবশ্য প্রসঙ্গত লিজাকে দুবোয়ার আতিথ্যের কথা জানিয়েছিল, কিন্তু সেটা এমনি অবান্তরভাবে বলেছিল যে, বিষয়ের গুরুত্ব লিজার মনে ওঠে নি। তাছাড়া, কেটিকে প্রশ্ন করেও কিছু জানতে পারে নি, জন যদিবা দু-চার কথা বলল, কেটি ও প্রসঙ্গে একেবারেই নীরব। তাই লিজা মনের মধ্যে দুবোয়া-প্রসঙ্গকে মোটেই আমল দেয় নি।

    চতুর্থদিন দুপুরবেলা দুবোয়ার গৃহে ডিনার যথাবিধি সমাপ্ত হল, পাশের ঘরে কেটি গেল বিশ্রাম করতে, জন ও দুবোয়া ড্রইংরুমে বসে পান ও গল্পগুজব করতে থাকল। তার পর বিকেলবেলা ফেরবার সময় হলে জন বলল, মশিয়ে দুবোয়া, এবারে কেটিকে খবর দাও, এখনই বেরুতে হবে, আর বিলম্ব হলে ফিরতে অন্ধকার হয়ে যাবে, আজ চাঁদ উঠবে অনেক রাতে।

    দুবোয়া বলল, তুমি অপেক্ষা কর, আমি খবর পাঠাচ্ছি–

    এই বলে সে ভিতরে গেল, জন গেল বাইরে যেখানে ঘোড়া দুটি অপেক্ষা করছিল।

    কিছুক্ষণ পরে দুবোয়া একাকী বেরিয়ে এল।

    জন শুধাল, কেটি কোথায়?

    দুবোয়া বলল, মিস প্ল্যাকেট বলে পাঠাল যে, সে তোমার সঙ্গে যাবে না, এখানেই থাকবে।

    বিস্মিত জন বললে, মশিয়ে দুবোয়া, এ পরিহাস আদৌ সময়োচিত নয়।

    দুবোয়া বলল, এটা সময়োচিত, এবং আদৌ পরিহাস নয়।

    তার মানে?

    সর্পবৎ মসৃণ, শয়তানবৎ স্মিতমুখ দুবোয়া বলল—তার মানে মিস প্ল্যাকেট স্থির করেছে যে আমার ঘরণী হয়ে আমাকে কৃতার্থ করবে।

    জন গর্জন করে উঠল—মিথ্যা কথা! তুমি তাকে গুম করেছ, আমি ভিতরে যাব।

    সে ভিতরে প্রবেশ করতে উদ্যত হলে দুবোয়া দ্বার রোধ করে দাঁড়াল, বলল, নিতান্ত দুঃখিত, যে, অতিথিকে বাধা দিতে হল।

    নিরুপায় জন বলে উঠল, মশিয়ে দুবোয়া, আই ডিমাণ্ড স্যাটিসফ্যাকশন।

    ওর অলঙ্কারচ্যুত অর্থ–জন দুবোয়ার সঙ্গে দুএল লড়তে চায়।

    দুবোয়া মৃদু হেসে বলল, আবার দুঃখিত মিঃ জন, আমি তোমাকে কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ করতে পারলাম না।

    কেন, শুনতে পারি কি?

    অবশ্যই, মশিয়ে ভলতেয়ার বলেছেন, ডুএল ছেলেমানুষী ব্যাপার।

    তোমার মশিয়ে ভলতেয়ার চুলোয় যাক।

    কেউ কেউ সন্দেহ করে যে, তার চেয়েও অনেক বেশি তপ্ত জায়গায় মশিয়ে ভলতেয়ার গিয়েছে।

    এত উত্তেজনার মধ্যেও দুবোয়ার মৃদু হাসিটি অবিকল থাকে, লোপ পায় না। ঐ হাসি দেখে জনের গা আরও বেশি জ্বালা করে, সে বলে ওঠে, তুমি কাপুরুষ।

    আবার মশিয়ে ভলতেয়ারের কথার উত্তর দিতে হল, ষোল টাকা মাইনের সেপাইগুলোকে যদি সেকেন্দার শা মনে করে বীরপুরুষ ভাব তবে স্বীকার করছি যে আমি সত্যি সে দলের নই।

    তুমি সেই দলের যারা মরতে ভয় পায়।

    ও-কথাটাও মিথ্যা নয়। মিস প্ল্যাকেটের সৌন্দর্য ও প্রেমের স্বাদ গ্রহণ না করে আমি, মরতে কেন, স্বর্গে যেতেই রাজী নই।

    ব্যঙ্গের সুরে জন শুধাল, এটাও কি তোমার মশিয়ে ভলতেয়ারের কথা?

    প্রত্যেক কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিই তাঁর উক্তির প্রতিধ্বনি করছে, করছে না কেবল প্রেমমুগ্ধ, ছেলেমানুষ ও জনবুল।

    তোমা ভলতেয়ারকে পাঠিয়ে দেব শয়তানের কাছে।

    তার প্রয়োজন হবে না মিঃ স্মিথ, মশিয়ে নিজেই শয়তানকে পাঠিয়ে দিয়েছে তোমার কাছে।

    কই?

    তোমার সম্মুখে সশরীরে উপস্থিত এই দীন ভৃত্য দুবোয়া-ফরাসী প্রথায় কায়দা মাফিক ‘বাউ’ করল।

    আচ্ছা, আজ চললাম, কিন্তু এবারে ফিরে আসব সসৈন্যে, নিয়ে যাব মিস প্ল্যাকেটকে।

    সেটুকু কষ্ট স্বীকার করবার আবশ্যক হবে না, শীগগির তোমাদের সঙ্গে গিয়ে আমরা দেখা করব-মশিয়ে ও মাদাম দুবোয়া।

    তুমি জাহান্নমে যাও।

    মিঃ স্মিথ, তুমি আমার অতিথি, তা ছাড়া তোমার কৃপাতেই মিস প্ল্যাকেটকে পেলাম। তোমাকে অভিশাপ দিতে চাই না, কাজেই শুভকামনা জানাচ্ছি—মিস প্ল্যাকেট হীন স্বর্গে গিয়ে তুমি যেন নিরাপদে পৌঁছতে পার।

    জন বুঝল আর কথা-কাটাকাটি বাহুল্য, সে ঘোড়ায় চড়ে রওনা হয়ে গেল।

    দুবোয়া চীৎকার করে বলল, আর একটা ঘোড়া পড়ে রইল যে!

    ওটা দিয়ে গেলাম, মিস প্ল্যাকেটের dowry–ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারতে মারতে মুখ ফিরিয়ে বলল জন।

    ফরাসীসুলভ মুদ্রাদোষে দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে দুবোয়া বলে উঠল—Tre bein!

    জন বাড়ি ফিরে সমস্ত ঘটনা বলল। জর্জ বলল, এ যে লজ্জার একশেষ।

    লিজা বলল, কেটি নিতান্ত ছেলেমানুষ নয়, ভিতরে ভিতরে তার ইচ্ছা না থাকলে এমনটি ঘটতে পারে না।

    মিসেস কেরী কিছুই বলল না, নরম একটি কৌচ বেছে নিয়ে মূৰ্হিত হয়ে পড়ল।

    তখন ডাক পড়ল কেরী ও টমাসের।

    পাশের ঘরে গিয়ে জর্জ কেরীকে আনুপূর্বিক সব বলল।

    কেরী সব কথা শুনে বলল, কেটির এভাবে একাধিক দিন অপরিচিত ব্যক্তির বাড়িতে যাওয়া উচিত হয় নি।

    জর্জ বলল, কেটির চেয়ে বেশি দোষ জনের, সে কেন কেটিকে নিয়ে এমনভাবে আত্মীয়তা করতে গেল?

    সেজন্য দণ্ডও সে পাচ্ছে।

    দোষের তুলনায় দণ্ড কিছুই নয়।

    এমন সময় লিজা এসে খবর দিল যে, মিসেস কেরীর মূৰ্ছাভঙ্গ হয়েছে, তোমাদের ডাকছে।

    কেরী ও জর্জ মিসেস কেরীর কাছে গিয়ে উপস্থিত হল।

    স্বামীকে দেখে সখেদে সে বলে উঠল, কি দেশেই না এনেছ! কেটিকে হরণ করেছে, এবারে আমাকে হরণ করবার পালা।

    কিন্তু স্বামীর মুখেচোখে সমর্থন বা আশঙ্কার ছাপ না দেখে বলে উঠল, পাষাণের হাতে পড়েছি।

    তার পর বলল, মাথাটা আবার কেমন করছে। লিজা ডার্লিং, আমার স্মেলিং সল্টের শিশিটা নাকের কাছে ধর তো।

    বলে একটা বালিস জুৎ করে নিয়ে মিসেস কেরী পুনরায় মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল।

    মিসেস কেরীর অপহৃত হওয়ার আশঙ্কায় এত দুঃখের মধ্যে টমাসের হাসি পেল। সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে উপস্থিত হল রাম বসুর কাছে। তাকে সব খবর দিল, দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, মুন্সী, কিছুক্ষণ আগে আমাদের উক্তিটির সঙ্গে তোমাদের পৌরাণিক ঘটনার সাদৃশ্য দেখাচ্ছিলে, কেটি হরণের অনুরূপ তোমাদের পুরাণে কিছু আছে কি?

    আছে বই কি। রুক্মিণীহরণ!

    সেটা আবার কি?

    আর একদিন বুঝিয়ে বলব।

    আর মিসেস কেরীর আশঙ্কা?

    ও বেটী তো যমের অরুচি, মানে death’s dislike, ওকে হরণ করবে কার এমন বুকের পাটা!

    তার কথায় টমাস হেসে উঠল। রাম বসু বলল, তাহলে আজ যাই।

    টমাস চাপা গলায় বলল, সেই যে কোথায় নিয়ে যাবে বলেছিলে সে কথাটা ভুলো না।

    রাম বসু বলল, ডাঃ টমাস, তোমাকে তো যেখানে-সেখানে নিয়ে যেতে পারি না। নিকি বাইজী নামে লখনউ নগরের এক ডানসিং গার্ল-এর আসবার কথা আছে, সে এসে পৌঁছলে তোমাকে অবশ্যই নিয়ে যাব।

    কিন্তু কথাটা যেন ডাঃ কেরীর কানে না ওঠে।

    আরে রাম! এ বস কাজে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয় তা কি আমি জানি নে?

    রাম বসু বিদায় হয়ে গেলে টমাস আবার ভিতরে গেল।

    সে রাত্রে জন কিছুই আহার করল না, কেটির সংবাদ দেওয়া ছাড়া অন্য কথাও বলে নি, অভুক্ত অবস্থাতেই সে শয়ন করল।

    লিজা শুয়ে শুয়ে মনটাকে বিশ্লেষণ করছিল। কেটির সংবাদে অবশ্যই সে দুঃখিত হয়েছিল, কারণ এ ক-দিনে কেটির সঙ্গে তার সৌহার্দ্য জন্মেছে। কিন্তু এখন মনটাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখল যে, সেখানে অমিশ্র দুঃখ নেই। জলের নীচে পদ্মের হোট্ট কুঁড়িটির মুখটি যেমন এতটুকু দেখা যায়, তেমনি তার মনের মধ্যেও যেন কেমন একটি আনন্দের প্রকটপ্রায় অস্তিত্ব। সে ভাবল, ব্যাপার কি? কেটির সঙ্গে জনের বিয়ে হলে সে খুশি হত সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন বুঝল সেইটুকুই তো সব নয়। তবে কি এই অনুভূতির মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে ঈর্ষা ছিল? কেন? কেন নয়! কোথাকার কোন্ কেটি উড়ে এসে এই বাড়িঘর, পিতার স্নেহ, ভ্রাতার প্রেম দখল করে বসবে-আর সে নিফল উকার মত অসার্থকতার স্তপে গিয়ে পড়ে আবর্জনার রাশি বাড়াবে। না, এমন আদৌ সম্ভব নয়। সে ভাবল, বেশ হয়েছে, এমনটি হওয়াই উচিত ছিল। সে সিদ্ধান্ত করল কেটি বড় সহজ মেয়ে নয়, হয়তো ভাল মেয়েও নয়, নতুবা অমনি দুদিনের সাক্ষাতেই একটা বাউণ্ডুলে ফরাসীর সঙ্গে জুটে পড়ত না। তার মনে হল, খুব ফাঁড়া কেটে গেল জনের। ঐ মেয়েটাকে বিয়ে করলে জনের দুঃখের এবং শেষ পর্যন্ত লানার অবধি থাকত না। লিজা যখন জনের সম্ভাবিত মুক্তির আনন্দে নিজেকে জনকে ও আত্মীয়স্বজনকে অভিনন্দিত করছিল তখন বিনিদ্র জন নিজেকে পৃথিবীর হতভাগ্যতম ব্যক্তি বলে মনে করে বালিসে মুখ গুঁজে পড়ে ছিল।

    এমন সময় বৃদ্ধ জর্জ মোমবাতির আলো হাতে তার ঘরে প্রবেশ করল, স্নিগ্ধ কঠে বলল, জন, কালকেই আমি নিজেই পুলিস নিয়ে যাব কেটিকে উদ্ধার করে আনতে, তুমি নিশ্চিন্ত থাক।

    যথাসাধ্য নিজেকে দৃঢ় করে জন বলল, না বাবা, ও রকম কিছু করতে যেও না। তাতে আমার দুঃখ বাড়বে বই কমবে না।…আর তাছাড়া আমি একটুও দুঃখিত হই নি।

    এই বলে পিতাকে সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশে মুখে হাসি ফোঁটাতে চেষ্টা করল, কিন্তু এই প্রচেষ্টার উদ্যমে এতক্ষণের নিরুদ্ধ অশু হঠাৎ বাঁধ ভেঙে নির্বারিত ধারায় নেমে এল তার দুই গাল বেয়ে।

    বৃদ্ধ জর্জ এক ফুঁ-এ আলো নিভিয়ে দিয়ে প্রস্থান করল। পুত্রের অশু দর্শনে ভূয়োদশী পিতার মন হাল্কা হয়ে গেল। পুরুষ বিধাতার সৃষ্টি, নারী শয়তানের। পুরুষ ও নারীকে অবলম্বন করে সংসারে আজও দেবদানবের যুদ্ধ সক্রিয়।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচার-ইয়ারী কথা – প্রমথ চৌধুরী
    Next Article উইংস অব ফায়ার – এ পি জে আবদুল কালাম
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025
    Our Picks

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.