Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেরী সাহেবের মুন্সী – প্রমথনাথ বিশী

    প্রমথনাথ বিশী এক পাতা গল্প546 Mins Read0

    ২.০১-৫ আগুনের ফুলকি

    দ্বিতীয় খণ্ড
    ২.০১ আগুনের ফুলকি

    বজরা ভেসে চলে, দুদিকের তীরে তীরে নূতন নূতন দৃশ্য উদঘাটিত হয়—সকাল বিকাল মধ্যাহ্ন। রাত্রি আসে আকাশের তারা আর পৃথিবীর দীপ সাজিয়ে; মাঠে মাঠে। বেজে ওঠে শিবাধ্বনি, কখনও বা বাঘের গর্জন।

    দুখানা বজরা ভাগীরথী বয়ে উজানে ভেসে চলে, সঙ্গে ছোট আর একখানা পানসি। বজরা দুখানার মধ্যে একখানা বড়, একখানা ছোট। বড়খানায় সপরিবারে কেরী। ছোটখানায় রাম বসু, পার্বতী ব্রাহ্মণ, জন দুই খানসামা, বাবুর্চি; ঘোট পানসিখানায় রসুই হয়, খাদ্য ও পানীয় জল থাকে। রাম বসু ও পার্বতীর রান্নার ব্যবস্থা স্বতন্ত্র; বজরার। এক কামরায় পার্বতীচরণ রাঁধে, দুজনে খায়। রাম বসুর হাতের অন্ন পার্বতী খাবে না। জর্জ উডনী খরচের কার্পণ্য করে নি, সপরিবার কেরীর সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য যথাসাধ্য করেছে; কৃতজ্ঞ কেরী বলে যথাসাধ্যের বেশি; সে বলে, এত করবার না ছিল প্রয়োজন, ছিল তার নিজের সাধ্য।

    সকাল বেলায় ব্রেকফাস্টের পবে রাম বসু আসে কেরীর বজরায়, সুসজ্জিত কামরায় দুজনে বসে বাইবেল তরজমার তোড়জোড় করে। বাইবেলের নিগুঢ় রহস্য কেরী কর্তৃক বিবৃত হয, মন দিয়ে শোনে রাম বসু। পাশের কামরায় অর্ধোম্মাদ কেরী-পত্নী আপন মনে বকে চলে; তার পবের কামরায় আয়া সুর করে ছড়া আউড়ে ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করে জ্যাভেজকে,-ফেলিক্স আর পিটাব ছাদের উপরে বসে থাকে, না হয় তাদের কৌতূহলের অন্ত, না হয় তাদের তৃপ্তি।

    কেরী বলে, মুন্সী, কাজ করবার এমন অবাধ ক্ষেত্র আমাদের দেশে নেই। সেখানে গদ্য পদ্য দুটোই সমৃদ্ধ, নৃতন কিছু করা কঠিন। তোমাদের দেশে সুযোগ প্রচুর।

    রাম বসু মনে মনে ভাবে, এ যদি সুযোগ হয়, তবে দুর্যোগ না জানি কি। প্রকাশ্যে বলে, ডাঃ কেরী, বাংলা সাহিত্যে গদ্য নেই বটে, তবে পদ্যের সমৃদ্ধি কম নয়।

    কেরী বলে, আপাতত প্রয়োজন আমাদের গদ্যে।

    কিন্তু না আছে বাংলা ভাষার অভিধান, না আছে ব্যাকরণ, গদ্য গড়ে উঠবে কি ভাবে?

    অসুবিধাটা কি? ব্যাকরণ লিখব, অভিধান সঙ্কলন করব, তার পরে এ দুয়ের সাহায্যে মুখের ভাষার উপরে বনিয়াদ খাড়া করে গদ্যের ইমারত গেঁথে তুলব। কঠিনটা কি? এই পথেই সব দেশের গদ্য তৈরি হয়ে উঠেছে।

    কাজের সুগমতা স্মরণ করে রাম বসু শিউরে ওঠে।

    কেরী বলে চলে, প্রথমে ইংরেজী আর ফারসী থেকে অনুবাদ করে গদ্যের আড় ভাঙতে হবে, তার পর আসবে মৌলিক রচনা।

    রাম বসু বলে, খুব ভাল হবে।

    হবেই তো, উৎসাহিত হয়ে বলে ওঠে কেরী, তার পরে হিন্দী ভাষায়, ওড়িয়া ভাষায় এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় গদ্য সৃষ্টি করবার ভার নেব—আর নিশ্চয় জোনো। প্রভুর আশীর্বাদে সাফল্যলাভ করব। কেন না তাঁর মহিমা তাঁর বাণী প্রচারের জন্যই তো এত পরিশ্রম, এত অধ্যবসায়।

    রাম বসু স্বীকার করে—অবশ্যই সাফল্যলাভ হবে, নতুবা তিনি এমন যোগাযোগ ঘটাতেন না।

    নিশ্চয়, নিশ্চয়, বলে কেরী বাইবেল খুলে বসে বলে, “সেন্ট ম্যাথিউ’ পরিচ্ছেদটি আজ তোমাকে বুঝিয়ে দিই।

    কেরী বোঝায়, অসীম তার উৎসাহ। খুব সম্ভব রাম বসু বোঝে, কেন না অগাধ তার নীরবতা।

    অবশেষে পরিশ্রান্ত কেরী শুধায়, মুন্সী, বুঝলে? রাম বসু বলে, ডাঃ কেরী, পাণ্ডিত্য ও প্রভুর কৃপা অসাধ্য সাধন করতে পারে, বুঝে উপায় কি?

    বেলা এগারোটা বাজে। বোটের জানালা দিয়ে গাঁয়ের ঘাট দেখা যায়। দেখা যায় আদুড় গায়ে মানাথী নরনারী, ছেলেরা জলে সাঁতার কাটছে, এক পাশে নৌকোর ভিড়।

    কেরীর মানসিক গতিবিধির অস্ফুট পদধ্বনি বাক্যে প্রকাশিত হয়—আহা, কবে এরা প্রভুর গোষ্ঠে এসে সমবেত হবে!

    রাম বসু মনে মনে বলে—তাহলে তোমাকে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকতে হবে, তার আগে নয়। পারবে কি?

    উইলিয়াম কেরী ও রামরাম বসুর মত ভিন্নপ্রকৃতির দুটি লোক কখনও কদাচিৎ মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। দুজন দুই জগতের, দুই যুগের লোক। ঘটনাচক্রের বিচিত্র আবর্তনে দুইজনে এসে একখণ্ড ভূমিতে পাশাপাশি উপস্থাপিত হয়েছে, মিল এইটুকু মাত্র—দুটি মনশ্চেতনার মধ্যে অনন্ত ব্যবধান।

    কেরী খ্ৰীষ্টীয় মধ্যযুগের অধিবাসী, কালভ্রষ্ট হয়ে অষ্টাদশ শতকে অবতীর্ণ। রাম বসু নূতন জগতের মানুষ, স্থানভ্রষ্ট হয়ে বাংলা দেশে আবির্ভূত। কেরীর বিশ্বাস, ধর্ম যাবতীয় সমস্যার সমাধানে সক্ষম। যে জাহাজের সে যাত্রী, তার নাম ধর্ম, তার কাঁটা কম্পাস নীতি, তার ধ্রুবতারা খ্ৰীষ্টীয় ভক্তি; যে দুর্নিরীক্ষ্য উপকূলের অভিমুখে জাহাজের গতি, তার নাম খ্রীষ্টীয় ভক্তিজগৎ।

    রাম বসুর বিশ্বাস, জ্ঞান, বিশুদ্ধ জ্ঞান, সব সমস্যার সমাধানে সক্ষম। তার জাহাজের নাম প্রত্যক্ষ জ্ঞান; নীতি, ধর্ম, বিবেকের পুরাতন কাঁটা-কম্পাস অতলে নিক্ষিপ্ত, ধ্রুবতারার উপরে নেই তার আস্থা, বন্দরের আকর্ষণ অনুভব করে না যাত্রীর দল—জ্ঞানের কি অন্ত আছে! ঐ সমুদ্রের ঢেউগুলো যেমন অসংখ্য, জ্ঞানের উর্মির সংখ্যা তার চেয়ে কম হবে কেন? সমুদ্রের প্রচণ্ড আঘাত, প্রভঞ্জনের কঠিন আলিঙ্গন, লক্ষ লক্ষ তরঙ্গের অট্ট-করতালি, জাহাজের ওঠাপড়ার ছন্দ তার সুপ্ত গুপ্ত ব্যক্তিত্বের ঝুটি ধরে নাড়া দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়-লবণাম্বুসিক্ত উদার আকাশের তলে জেগে উঠে, তার বিস্ময় কৌতুক কৌতূহল জিজ্ঞাসার আর অন্ত থাকে না।

    কেরীর মুখ দিয়ে গতপ্রায় মধ্যযুগ প্রশ্ন করে, জীবনের উদ্দেশ্য কি? রাম বসুর মুখ দিয়ে নবীন জাগ্রত যুগ প্রশ্ন করে, এসব কেমন করে সৃষ্টি হল? মধ্যযুগ বলে, স্রষ্টার সঙ্গে জীবনের অভিপ্রায়কে মিলিয়ে নেব, নবীন যুগ বলে, সৃষ্টির রহস্য ভেদ করে স্রষ্টার স্থান অধিকার করব। মধ্যযুগের অদম্য সর, নবযুগের অনন্ত জিজ্ঞাসা।

    যদি কেউ শুধায়, এই ঘর-কুনো, প্রাচীন প্রথা ও বহু সংস্কারের দ্বারা জীর্ণ বাংলা। দেশে এমন মানুষ সম্ভব হল কেমন করে? কোথায় কোন্ দূর গায়ে লাগা আগুনের ফুলকি, বাতাসের কোন্ খেয়ালে এ পাড়ায় এসে পড়ে কে বলবে? প্রাচীন গ্রীসের চাপাপড়া জ্ঞানবিজ্ঞান হঠাৎ একদিন জ্বলে উঠেছিল নবীন ইউরোপে—তার ফুলিঙ্গের শিখায় জ্বলে উঠল একে একে ইতালী, ফ্রান্স, ইংলঙের মন। দাবানল ছড়িয়ে গেল পাশ্চাত্ত্য দেশে। তার পরে বাতাসের কোন খেয়ালে না জানি দু-একটা উড়ো ফুলকি এসে পড়ল বাংলা দেশের আম-কাঁঠাল-নারকেলের শান্ত পরিবেশে। একই জাহাজে চেপে গতপ্রায় মধ্যযুগ আর নবযুগ ভারতের বন্দরে এসে পদার্পণ করল। সেই দিব্য অনলের স্পর্শে জ্বলে উঠল রাম বসুর কল্পনা, মস্তিষ্ক, সমস্ত ব্যক্তিত্ব। নূতন যুগের নূতন মানুষের সূত্রপাত হয়ে গেল।

    এমন, এমন দুটি ভিন্ন প্রকৃতির লোক পাশাপাশি এল কোন্ বিধানে? কেবলই অদৃষ্টের খেয়াল? তা নয়। নৃতন ও পুরাতনের মিলন যে এক সীমান্তে, ছাড়াছাড়ি হতে হতেও একবার হাত মিলিয়ে নেয় তারা। ভিন্ন তাদের প্রকৃতি, বোধ করি সেই কারণেই পরস্পরের প্রতি এমন তাদের আকর্ষণ। সেকালে পাত্রীর দলের কৌতূহলের অন্ত ছিল না এই লোকটির প্রতি। ঘুরে ঘুরে তার কাছে টানত রাম বসুকে, তাড়িয়ে দিয়ে আবার ফিরিয়ে নিতে আসত অনুরোধ-উপরোধ করে। আবার রাম বসুও মনের মানুষ পেত। বিদেশী বিধর্মী বিভাষী বিচিত্র লোকগুলোর মধ্যে। ঐ তো বলেছি–তাদের মন ছিল এক সীমান্ত-ঘেঁষা।

    কেরী যখন খ্ৰীষ্টীয় শাস্ত্রকারদের রচনা পড়ে, বাম বসু তখন দি হোলি বাইবেল সম্মুখে রেখে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে ফিডিং-এর টম জোন্স। কেরীর পায়ের শব্দ শোনবামাত্র বাইবেল দিয়ে চাপা দেয় টম জোন্স। কতদিন ধরা পড়তে পড়তে এই উপায়ে রক্ষা পেয়ে গিয়েছে বাইবেলের উপর গিয়েছে বেড়ে ভক্তি।

    কেরী যখন কুসংস্কারে আকণ্ঠনিমগ্ন স্নানাথী জনতাকে জর্ডান নদীর জলে দীক্ষিত করবার স্বপ্ন দেখে, রাম বসু তখন নদীজলে আকণ্ঠনিমগ্ন স্নানাথিনীগণের রহস্যোদ্ধারে মনকে নিযুক্ত করে।

    সহসা কেরী বলে ওঠে, মুন্সী, আমার ইচ্ছা এদের মধ্যে আমি প্রভুর নাম প্রচার করি!

    সুখতন্দ্রা ভেঙে রাম বসু চমকে ওঠে, বলে, বেশ তো, সে খুব ভাল হবে। তবে তার ব্যবস্থা কর।

    রাম বসু বলে, আগামীকাল রবিবার আছে, সকাল বেলা এক গাঁয়ে নৌকো ভিড়িয়ে বক্তৃতা করবেন।

    উৎসাহিত কেরী বক্তব্য গুছিয়ে নেবার জন্যে মনোনিবেশ করে।

    পাশের কামরায় অর্ধোম্মাদ ডরোথি থেকে থেকে চীকার করে ওঠে—টাইগার! টাইগার!

    ঐ শব্দটা মাঝে মাঝে চীৎকার করে ওঠা তার এক বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    বজরা চলে, পালে বাতাস লাগে, দুই তীরের দৃশ্যবৈচিত্র্য অফুরন্ত সৌন্দর্যে একটানা অবারিত হয়ে যায়, পাশাপাশি গায়ে গায়ে উপবিষ্ট মধ্যযুগ ও নবীন-যুগ, ভক্তি ও জ্ঞান, ভিন্নমুখে চিন্তাসূত্র বয়ন করে। আর পাশের কামরা থেকে কেরীপত্নী ভীতচকিত চীৎকার করে করে ওঠে—টাইগার! টাইগার!

    .

    ২.০২ স্রোতের ফুল

    বজরা চলে। দিন ও রাত্রি তীরে তীরে বিচিত্র দৃশ্য উদঘাটিত করে। সমস্তই কেরীর চোখে নূতন, সমস্তই কেরীর কানে অভিনব।

    অতি প্রত্যুষে নদীব জল থেকে ওঠে কুয়াশার সূক্ষ্ম মলমল, দুই তীর কুয়াশার আড়ালে ঝাপসা, দেখা যায় অথচ বোঝা যায় না, এমন।

    কেরী শুধায়, মুন্সী, নদীতীরে অনেক মিন্সেকে স্থির হয়ে বসে থাকতে যেন দেখতে পাচ্ছি। কি করছে ওরা?

    সম্প্রতি ন্যাড়ার কাছে কেরী লোকমুখের ভাষায় পাঠ নিচ্ছে—‘মনুষ্যে’র বদলে ‘মিন্সে’ শব্দটা তার বড় পছন্দসই, শেখবার পরে যত্রতত্র ব্যবহার করবার দিকে তার ঝোক।

    রাম বসু এক মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে—ওরা? রিলিজ্যস পীপল! প্রেয়িং গড।

    ভেরি গুড, ভেরি গুড। প্রেয়ার ইজ হেলদি, বলে কেরী।

    আচ্ছা মুন্সী, ওরা দিনে ক-বার প্রেয়ার করে?

    যার যেমন প্রয়োজন, সাধারণত দিনে দু-তিন বারও করে, কিন্তু অন্তর্দ্বন্দ উপস্থিত হলে–

    বাধা দিয়ে কেবী বলে, অন্তর্দ্বন্দ্ব, মানে মানসিক সংগ্রাম, স্পিরিচুযাল স্ট্রা তার পরে বল

    রাম বসু বলে, তখন আট-দশ বার প্রেয়ার করে থাকে!

    পার্বতীর আর বসে থাকা সম্ভব হয় না, সে উঠে অন্য যায়।

    ভেরি গুড, ভেরি গুড। আমি দেখেছি কিনা প্রেয়ারের পরে দেহে মনে বেশ শান্তি পাওয়া যায়। কিন্তু ওদের কাছে জলপাত্র আছে বলে যেন মনে হচ্ছে। হোয়াট ফর?

    অকুতোভয় রাম বসু বলে, ও আর কিছুই নয়, অফারিং টু অলমাইটি।

    এবারে বিষণ্ণ কেরী বলে, ভেরি ব্যাড, ভেরি ব্যাড। ওটা কুসংস্কার। আমাদের দেশে প্রেয়ারের সময়ে জলপাত্রের প্রয়োজন হয় না।

    তা বটে, কিন্তু যে দেশে যেমন রীতি।

    আবার কেরী বলে, ভেরি ব্যাড, ভেরি ব্যাড। কেরী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভাবে, এরা বড়ই কুসংস্কারগ্রস্ত।

    পার্বতী ফিরে এসে ফিস ফিস স্বরে বলে-ও সব কি বললে ভায়া?

    রাম বসু জনাস্তিকে বলে—এ ছাড়া আর কি বলব? আসল কথা জানলে যে

    আমাদের দেশের লোককে অসভ্য ভাববে। সেটা কি খুব গৌরবের হবে?

    কেরী বলে, মুন্সী, আজ গায়ে বজরা ভেড়াবে—আমি মিন্সেগুলোর মধ্যে প্রভুর নাম প্রচার করব। কাল নামপ্রচার করে বেশ তৃপ্তি পেয়েছি, রাত্রে সুনিদ্রা হয়েছিল।

    বেশ তো, সামনেই একটা গ্রাম দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, নৌকো ভেড়ালেই হবে।

    নৌকা এগিয়ে চলে, মাঝিরা পাল গুটোবার আয়োজন করে—কেরী যাজকের পোশাক পরে প্রস্তুত হয়—তীর অদুরে। এমন সময় অভাবিত এক কাণ্ড ঘটল।

    তীরে কোলাহল উঠল-’গেল গেল, পালাল পালাল, ধর ধর!’

    নৌকার আরোহীরা চকিত হয়ে তাকিয়ে দেখে যে তীরে একটি ছোটখাটো জনতা; কিন্তু কে পালাল কাকে ধরতে হবে, সে রহস্য উদ্ধার করবার আগেই তারা দেখল নদীর জলে একটি মেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার দিয়ে নৌকার দিকে আসছে। সকলে বুঝল তাকে ধরবার উদ্দেশ্যেই কোলাহল। মেয়েটি নৌকার কাছে এসে পড়েছে এমন সময় খান দুই ডিঙি করে জনকয়েক লোক তাকে ধরবার জন্য এগোল। কিন্তু ডিঙি তাকে ধরবার আগেই মেয়েটি কেরীর বজরার কাছে এসে আর্তস্বরে বলে উঠল, বাঁচাও, বাঁচাও! ওরা পেলে আমায় পুড়িয়ে মারবে।

    পরমুহূর্তে কেরীকে লক্ষ্য করে মেয়েটি বলে উঠল–সাহেব, দোহাই তোমার, আমাকে রক্ষা কর!

    কেরীর ইঙ্গিতে রাম বসু মেয়েটিকে টেনে তুলে ফেলল নৌকায়।

    সকলে দেখলে, বিচিত্র তার বেশ, বিচিত্র তার সজ্জা, বিচিত্র তার রূপ। ভয়ে উদ্বেগে সে রূপ সহস্রগুণ উজ্জ্বল। প্রকৃত সৌন্দর্য দুঃখে সুন্দরতর হয়! ঝডের আকাশের চন্দ্রকলা মধুরতর।

    তার বেশভুষা দেখে রাম বসু বলে ওঠে, এ যে দেখছি বিয়ের সাজ! তুমি কি বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছ?

    রক্তিম ঠোঁটের ভঙ্গীতে গোলাপফুল ফুটিয়ে মেয়েটি বলে—বিয়ে কাল রাতে হয়েছে, আজ এনেছিল চিতায় পুড়িয়ে মারতে।

    হতবুদ্ধি রাম বসু শুধায়, বর হঠাৎ মারা গেল?

    হঠাৎ নয়, একটা মড়ার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছিল, এখন বলে কিনা ঐ মড়াটার সঙ্গে আমাকে পুড়ে মরতে হবে!

    বহু যুগের সংস্কার রাম বসুর মুখ দিয়ে কথা বলে ওঠে, চিতা থেকে পালাতে গেলে কেন?

    চিরন্তন জীবনাগ্রহ মেয়েটির মুখে কথা বলে ওঠে-আমার মরতে বড় ভয় করে।

    তার পরে একবার পিছন ফিরে দেখে কেরীর পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বসে ব্যাকুলতায় ভেঙে পড়ে বলে-সাহেব, রক্ষা কর-ওরা একবার ধরলে আর রক্ষা থাকবে না, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে।

    ডিঙির আরোহীদের মধ্যে কৃশকায় একটি লোককে দেখিয়ে বলে—ঐ চণ্ডীখুড়ো সব নষ্টের গোড়া। দোহাই সাহেব, ওর হাতে আমাকে ছেড়ে দিও না, দোহাই তোমার?

    সমস্ত ব্যাপার দেখে কেরীর বাকরোধ হয়ে গিয়েছিল, মেয়েটির আর্তব্যাকুলতায় এতক্ষণে তার ক্যুতি হল কেরী বলল, তুমি ডরো মৎ, ঐ মিলের হাতে তোমাকে আমি ছাড়ব না।

    সংসারে মুখের কথার উপরে মেয়েটির আর ভরসা ছিল না, সবলে সে কেরীর জান আঁকড়ে পড়ে রইল।

    এই রে! ম্লেচ্ছস্পর্শ-দোষ ঘটে গেল। এখন দেখছি চিতায় তোলবার আগে একটা অঙ্গ-প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে নিতে হবে। আর এক খরচার মধ্যে পড়া গেল দেখছি।

    বক্তা পূর্বকথিত চণ্ডীখুড়ো।

    ঐ শোনো সাহেব ওর কথা-কম্পমানা মেয়েটির উক্তি।

    চণ্ডীখুঁড়ো হাঁকল-কালামুখ আর পোড়াস নে, মেলেচ্ছর নৌকো থেকে নেমে আয় বলছি।

    মেয়েটি আরও জোরে কেরীর জানু আঁকড়ে ধরে।

    রাম বসু শুধায়—কি হয়েছে মশাই?

    কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পার নি মনে হচ্ছে! ন্যাকা নাকি? স্নেচ্ছের সঙ্গে থেকে তোমরাও অধঃপাতে গিয়েছ দেখছি।

    তার পরে গলার স্বর আর এক পর্দা চড়িয়ে চণ্ডীখুঁড়ো বলে—ভালয় ভালয় না দাও তো জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যাব, সঙ্গে লোকজন আছে দেখছ তো?

    রাম বসু বলে—একবার চেষ্টা করে দেখ না—ওর নাম কেরী সাহেব, বিলেত থেকে সবে আমদানি হয়েছে, কলকাতার চুনোগুলির ফিরিঙ্গ নয়।

    আমাকেও চেন না মনে হচ্ছে, আমি জোড়ামউ গায়ের চণ্ডী বক্সী, জীবনে অমন দু শ পাঁচ শ লোক খুন করেছি, তার উপরে না হয় আর একটা খুন হবে।

    বটে। একবার সাদা চামড়ায় আঁচড় কেটে দেখ না কি হয়। কোম্পানির তেলিঙ্গি ফৌজ এসে জোড়ামউ কচলে আমপিত্তি রস বের করে দিয়ে যাবে!

    তবে তাই হক। ওরে, বাজারে বাজা!

    চণ্ডীখুড়োর হুকুমে অন্য ডিঙিখানায় যে-সব ঢুলী, ঢাকী, কাঁসরওয়ালা প্রভৃতি বাজনদার ছিল, তারা বাজনা শুরু করল, সঙ্গে ধরল গান–

    ‘যম জিনতে যায় রে চূড়া।
    যম জিনতে যায়,
    জপ তপ কিবা কর
    মরতে জানলে হয়।‘

    অমনি চণ্ডীখুড়ো আর জনকয়েক লোক মেয়েটিকে ছিনিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে বজরায় উঠবার উপক্রম করল। কেরী ঐ একবার মাত্র কথা বলেছিল, তার পরে নীরবে সব দেখছিল, এবারে বুঝল আর দেরি করা উচিত নয়, বাধা দেবার সময় উপস্থিত হয়েছে।

    সে হাত বাড়িয়ে নৌকার ভিতর থেকে বন্দুকটা টেনে নিয়ে গর্জন করে উঠল। মিন্সেরা, এখনও সতর্ক হও, আমি ধর্মযাজক কেরী, কিন্তু প্রয়োজন হলে বন্দুক ধারণ করতেও সমর্থ। অতএব শোন, যদি এই মুহূর্তে তোমরা আমার বজরা পরিত্যাগ না কর তবে আমি বন্দুক নিক্ষেপ করতে বাধ্য হব।

    কেরীর গর্জনে অবিলম্বে বাতি ফল ফলল। সকলে সুড় সুড় করে নিজ নিজ ডিঙিতে এসে উঠল।

    কেরী পুনরায় বন্দুক উচিয়ে গর্জন করে উঠল—তোমরা এখনই নৌকা নিয়ে ফিরে যাও, নতুবা আর এক মুহূর্ত পরেই আমি বন্দুক চালনা করতে বাধ্য হব।

    এবারেও অবিলম্বে বাঞ্ছিত ফল ফলল। নৌকার আরোহীদের মধ্যে একবার কানাকানি হল, তার পর নৌকার মুখ ফিরল তীরের দিকে। বাজনা অনেক আগেই থেমে গিয়েছিল।

    কিন্তু চণ্ডীখুড়ো ভাঙে তবু মচকায় না। সে একবার শেষ চেষ্টা করল, সাহেব, কোম্পানির দোহাই, নবকেষ্ট মুন্সীর দোহাই, আমাদের মেয়ে ফিরিয়ে দিয়ে যাও।

    কেরী নীরব প্রত্যুত্তরে বন্দুক উঁচিয়ে ধরল।

    রাম বসু চাপা গলায় পার্বতীকে বলল, প্রভুর নাম প্রচারই কর আর যাই কর, জঙ্গী রক্ত যাবে কোথায়? একটু আঁচড়ালেই মিলিটারি।

    পার্বতী বলল, সাহেবের আজকের মূর্তি থেকে মনে ভরসা পেলাম।

    কেন বল তো?

    বুঝলে না ভায়া, বিপদকালে প্রভুর নাম কোন কাজে আসে না; প্রমাণ পেলে হাতে হাতে, যেমনি বন্দুক তোলা সব মামলা ফয়সালা। তাই বলছিলাম সাহেব যে দরকার হলে বন্দুক ধরতে পারে তা জানা ছিল না, জেনে মনটায় জোর পেলাম।

    ক্রমশ দূরায়িত ডিঙি থেকে উচ্চকণ্ঠে চণ্ডীখুড়ো বলে উঠল—ভাবিস নে ছুঁড়ি তুই রক্ষা পেয়ে গেলি! আমি যদি জোডামউ গায়ের চণ্ডী বক্সী হই, তবে ভূ-ভারতের যেখানেই তুই পালিয়ে থাকিস না কেন, ঝুঁটি ধরে তোকে নিয়ে এসে চিতায় চড়াবই চড়াব! এখনও ধর্ম আছে রে, এখনও চন্দ্রসূর্য উঠছে, মা গঙ্গা মর্ত্যে আছেন, তাই জানিয়ে রাখছি, মেহের সাধ্য নেই তোকে বাঁচায়। আজকের মত রক্ষা পেলি বলেই চিরকালের মত রক্ষা পেলি তা ভাবিস নে রেশমী, তা ভাবিস নে!

    বজরার আরোহীরা জানতে পেল মেয়েটির নাম রেশমী।

    .

    ২.০৩ বারোয়ারীতলার বিচার

    জোড়ামউ গ্রামের বারোয়ারীতলায় বড় ভিড়। গ্রামস্থ প্রধান ও প্রবীণগণ সমবেত, অনেকক্ষণ বিচার-বিতর্কের পরে সভাস্থলে অবসাদের নীরবতা। সভাসান অনিশ্চিত। বাঙালীর সভা আপনি ভাঙে না, বজ্রপাত বা অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় আধিদৈবিক বা আধিভৌতিক দুর্ঘটনার আবশ্যক হয়।

    হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে চণ্ডী বক্সী লাফিয়ে উঠল, তারস্বরে শুরু করল—যা রয় সয় তাই কর তিনু চক্কোত্তি। এদিকে তো চালচুলো নেই, ওদিকে কথা শুনলে মনে হয় বেদব্যাস নেমে এলেন।

    তড়াক করে লাফিয়ে উঠল তিনু চক্কোত্তি, খুড়ো, চালচুলো নেই বলেই সাহসটা অন্তত আছে। তা ছাড়া বেদব্যাসেরই বা কোন্ চালচুলো ছিল?

    সে কথা তোমার জানা থাকবার কথা বটে, বেদব্যাসের বাপ কিনা।

    ইঙ্গিতটায় অনেকে হেসে উঠল, চক্কোত্তির জেলেনী অপবাদ দিল।

    মুখ সামলে কথা বল বক্সী। আর তাঁতিনীটা কোন্ কুলীন হল?

    তবে রে শালা! লাফিয়ে উঠল চণ্ডী বক্সী।

    শালা বলল, তোমরা সবাই শুনলে।

    কেউ কেউ বলল, খুব হয়েছে এখন থাম।

    থামব কেন? বেটা আমাকে শালা বলে কোন্ সুবাদে, একবার জিজ্ঞাসা কর না।

    কেউ জিজ্ঞাসা করল না দেখে তিনু বলে উঠল, বেটার বাপ জেলে ছিল কিনা।

    জেলেনী অপবাদের সমুচিত প্রত্যুত্তর হয়েছে মনে করে যখন সে স্বস্তি অনুভব করছে সেই মুহূর্তে বক্সী ব্যাঘুঝম্পে তার ঘাড়ে এসে পড়ল, যেন একখানা কাঠি আর একখানা কাঠির উপরে গিয়ে পড়ল। দুইজনেই সমান কৃশ, সমান দীর্ঘ এবং সমান হাঁপানির রুগী। সেইটুকুতেই রক্ষা, কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনে পরিশ্রান্ত হয়ে নিজ নিজ কোটে প্রত্যাবর্তন করে হাঁপাতে লাগল। ভগবান সুবিচারক, বাঘ সিংহ ভালুক প্রভৃতি

    পদকে বীরত্ব দিয়েছেন, কিন্তু বেশিক্ষণ পরিশ্রম করার শক্তি দেন নি। চণ্ডী বক্সী ও তিনু চক্কোত্তির মত বীরপুরুষের বক্ষেও হাঁপানি প্রতিষ্ঠিত করে বীরত্বের সীমা টেনে দিয়েছেন।

    এবারে উঠল জগৎ দাস, বাজারের বড় গোলদার, সাধুপুরুষ নির্যাট বলে তার খ্যাতি। লোকটার পেট গোল, মুখ গোল, চোখ গোল; সব গোলের প্রতিকার তার বাক্যে–শেষটা বড় সরল। সরল তলোয়ার ও সরল বাক্যকে লোকের বড় ভয়।

    জগৎ দাস বলল, দেখুন বক্সীমশাই আর চক্কোত্তিমশাই, সকালবেলাতে আমরা এখানে তামাশা দেখতে আসি নি। যদি কাজের কথা থাকে বলুন, না হলে আমরা উঠি।

    বক্সী দম ফিরে পেয়েছিল, সে বলে উঠল, আমি তো এতক্ষণ ধরে সেই কথাই বোঝাবার চেষ্টা করছি, মাঝে থেকে ঐ শালা–

    আমার জেলেনীর ভাই-বক্তা তিনু চক্কোত্তি।

    আবার আরম্ভ হল। তবে আমরা উঠি, বলে সঙ্গে সঙ্গে গাত্রোত্থান করল জগৎ দাস। তাকে উঠতে দেখে অনেকে উঠে পড়ল।

    সকালবেলাতেই কেবল জমবার মুখে এমন সরস আসরটি ভেঙে যায় দেখে ঘাড় বাঁকা পঞ্চানন বলে উঠল, কাজের কথা হক, বসুন দাসমশাই।

    কোন অজ্ঞাত বা অপ্রকাশ্য কারণে পঞ্চাননের ঘাড়টা বেঁকে গিয়েছে, তাই সে ঘাড বাঁকা পঞ্চানন নামে পরিচিত। পঞ্চানন জানে, কাজের কথা আপনি অকাজের কথায় পরিণত হয়, জোয়ার-ভাটা এক নদী-খাতেই খেলে।

    তবে তাই হক-বলে বক্সী পুনরায় শুরু করল-এই যে মেয়েটা শাস্ত্রের মাথায় পদাঘাত করে একটা স্নেচ্ছের সঙ্গে চলে গেল, তার কি হয়?

    কোন্ শাস্ত্রে আছে যে, একটা অনাথ মেয়েকে পুড়িয়ে মারতে হবে? শুধায় তিনু চক্কোত্তি।

    তোমার কোন্ শাস্ত্রটা পড়া আছে চক্কোত্তি? বলে চণ্ডী বক্সী।

    আমার না থাক তোমার তো আছে, তুমিই বল না।

    বক্সী জীবনে এমন পরীক্ষায় পড়ে নি, তবু সে মচকাবার পাত্র নয়, বলে, তুমি বামুনের এঁড়ে, তোমার কাছে বলে কি লাভ? বুঝতে পারবে?

    আহা-হা, আমি না বুঝি এঁদের কেউ কেউ তো বুঝবেন বলে চকোত্তি সভাস্থ জনতা দেখিয়ে দেয়।

    বক্সী সে দিক দিয়ে যায় না, বলে, নিশ্চয় আছে, বিধান নিয়েছি শিরোমণি মশায়ের কাছে।

    যদি কোন শাস্ত্রে অনাথা বালিকাকে পুড়িয়ে মারবার বিধান থাকে, তবে সেই শান্ত ভরে আমি ইয়ে করি—বলে লাফিয়ে উঠে বিশেষ একটা ভঙ্গী করতে উদ্যত হয় তিনু চক্কোত্তি।

    ঘাড়-বাঁকা পঞ্চানন চীৎকার করে ওঠে, শাস্ত্রের দোষে এখানে যেন ইয়ে করে বসবেন —এটা বারোয়ারীতলা, জাগ্রত দেবীর স্থান।

    লজ্জিত চক্কোত্তি আসন গ্রহণ করে।

    জগৎ দাস বলে, চক্কোত্তিমশায়, আপনি প্রাচীন ব্যক্তি তায় ব্রাহ্মণ বর্ণশ্রেষ্ঠ, আপনার বিবেচনা করে কথা বলা উচিত।

    বামনামির নিকুচি করি আমি, এবারে বসে বসেই বলে চক্কোত্তি, ঐ কেষ্ট কবরেজও তো বামুন।

    এর মধ্যে কেষ্ট কবরেজ আবার এল কোত্থেকে? শুধায় জগৎ দাস।

    ওঃ, তোমরা কিছুই জান না দেখি। তবে শোন। চণ্ডী বক্সী, তুমিও শোন, মিথ্যা বললে ধরিয়ে দিও।

    অতঃপর গলা পরিষ্কার করে নিয়ে চক্কোত্তি শুরু করে, ঐ তোমাদের চণ্ডী খুড়ো আজ ছ মাস কেষ্ট কবরেজের কাছে হাঁটাহাঁটি করছিল। কেন জান?-কবরেজ, তোমার হাতে তো অনেক রুগী, এমন একটার সন্ধান দাও যেটা দু-এক মাসের মধ্যেই টাসবে।

    কবরেজ শুধায়, হঠাৎ তেমন রুগীতে কি প্রয়োজন পড়ল?

    শেষে অনেক দরাদরি অনেক কচলাকচলির পরে আসল কথা প্রকাশ করে চণ্ডী বক্সী। রেশমীর সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে।

    তা রুগী কেন? শুধায় কবরেজ।

    যাতে বিয়ের পরে বেশি দিন না টেঁকে।

    সে কি কথা!

    দরদ দেখিয়ে চণ্ডী বলে, আহা মেয়েটার যে বিয়ে হয় না।

    তা ভাল বর খোঁজ না কেন?

    ভাল বর জুটবে কেন? আর তা ছাড়া খোঁজেই বা কে?

    শেষে কবরেজ মশায় কিছু আদায় করে সন্ধান দিলেন ঐ অম্বিকা রায়ের, তিনকাল গত বুড়ো, দেড় বছর ভুগছিল ক্ষয়কাশে।

    কখ্‌খনও ক্ষয়কাশ নয়, হাঁপানি, চীৎকার করে বলে চণ্ডী বক্সী। এতক্ষণ সে হতভম্ব হয়ে ভাবছিল, এত কথা চক্কোত্তি জানল কেমন করে?

    ঐ রকম হাঁপানি তোর হক, উত্তর দেয় তিনু।

    কিন্তু এতে বীমশায়ের লাভ কি? শুধায় জগৎ দাস।

    ওহো, তুমি কিছুই জান না দেখছি, আর জানবেই বা কেমন করে-থাক সের বাটখারা-দাঁড়িপাল্লা নিয়ে! যদি না জান তো শুনে নাও। মেয়েটা বিধবা হলে তাকে তোমাদের হিন্দুশাস্ত্রের দোহাই দিয়ে পুড়িয়ে মারতে পারলেই তার সম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পাবে। কি, ঠিক বলছি কিনা চণ্ডী বক্সী?

    তুমি খিরিস্তানের মত কথা বলছ।

    আরে বাবা, খিরিস্তান কাকে বলে এবারে দেখলে তো! গিয়েছিলে তো একবার, পালিয়ে এলে কেন লেজ গুটিয়ে? যাও না আবার।

    যাবই তো, আমি কি সহজে ছাড়ব? আর, এক বারে না হয় এক শ বার যাব।

    নিরানব্বই বার হাতে থেকে যাবে, এক বারেই কাজ ফরসা হবে।

    কৌতূহলী হয়ে কেউ কেউ শুধায়, সেটা আবার কেমন?

    গুলি মেরে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে। নিজের রসিকতায় নিজে হো হো করে হেসে ওঠে চক্কোত্তি। বলে, বাবাঃ, একেই বলে বাঘের উপর টাঘ। রাজকন্যা আর রাজত্ব দুই-ই একসঙ্গে পড়ল গিয়ে সাহেবের হাতে। দেখি এবারে বক্সীর কতদূর কি সাধ্য।

    বক্সী মনে মনে বড়ই অস্বস্তি অনুভব করছিল, কারণ কথাগুলোর কোনটাই মিথ্যা নয়। তবু এমন নীরব থাকলে অপকর্মের দায়িত্ব দ্বিগুণ ভারী হবে ভেবে বক্সী বলল, তোমার মত গজিলের কথার প্রতিবাদ করে আমি সময় নষ্ট করতে চাই নে।

    ও, তাই বুঝি এখন সময়ের সদ্ব্যবহার করছ পাড়ায় পাড়ায় জোট পাকিয়ে ওর দিদিমাকে একঘরে করবার চেষ্টায়!

    কে বলল?

    যে বলল সে ঐ আসছে।

    সকলে তাকিয়ে দেখল, মোক্ষদা বুড়ি ধীরে ধীরে আসছে। মোক্ষদা বৃদ্ধা বিধবা, রেশমীর মাতামহী।

    বারোয়ারীতলায় প্রবেশ করে মোক্ষদা ডুকরে কেঁদে উঠল, বাপ সকল, আমাকে একঘরে করে সমাজে ঠেলো না।

    তিনু চক্কোত্তি এতক্ষণ তার হয়েই মামলা লড়ছিল, কিন্তু এখন তার বড় রাগ হল। ভাবল, বুডি তো বড় স্বার্থপর, রেশমীর সর্বনাশের চেয়ে একঘরে হওয়ার ভয়টা হল তার বেশি!

    |||||||||| সে বলল, বুড়ি, একঘরে হলে তোমার দুঃখটা কি? তোমার ঘরে কেউ খাবে, এই তো? ভালই তো, তোমার ভাত বেঁচে যাবে।

    বুড়ি দ্বিগুণ ডুকরে উঠল, মরলে কেউ কাঁধ দেবে না।

    নাও, সব গেল, এখন মরার পরে কি হবে সেই দুশ্চিন্তায় বুড়ির ঘুম নেই!

    তুমি তো বাবা নাস্তিক, তোমার ধর্মও নেই পরকালও নেই, কিন্তু বাবা আমরা। যে ভগবান মানি।

    তবে এখানে কেন? ভগবানের কাছে গিয়ে কাঁদ।

    তাই তো কাঁদছিলাম বাবা। বলছিলাম, ঠাকুর, পোড়ারমুখীর কপালে যা ছিল তা হল, এখন আমার যেন অগতি না হয়।

    বেশ তো কাঁদছিলে, তবে আবার এদিকে গতি হল কেন?

    বাবা, একঘরে তো ভগবানে করে না, মানুষে করে—

    বাধা দিয়ে চক্কোত্তি বলল—মানুষে করে না, অমানুষে করে।

    তার পরে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, নাঃ, আমার সহ্য হচ্ছে না, তোমরা জাহামে যাও, আমি চললাম–

    এই বলে সে হন হন করে প্রস্থান করল।

    তিনু চক্রবর্তী গাঁয়ের একটি সমস্যা। তার বিষয়সম্পত্তি, শ্রীপুত্র, বাড়িঘর, স্বাস্থ্য, বিদ্যা কিছু নেই, কিন্তু বোধ করি সেই কারণেই সবচেয়ে বেশি করে আছে অদম্য সাহস ও অপ্রিয় সত্যভাষণের তেজ। বিষয়-সম্পত্তি প্রভৃতি যার আছে তাকে আয়ত্তে রাখা সহজ, কিন্তু অকিঞ্চনের শক্তিরোধের কি উপায়? সেইজন্য ঐ নিঃস্ব লোকটা সমস্ত গ্রামের চিরস্থায়ী শিরঃপীড়ারূপে বিদ্যমান। কিন্তু এক্ষেত্রে চক্রবর্তী ভ্রান্ত। যে সমাজে বিচারের চেয়ে আচারের, ধর্মের চেয়ে অনুষ্ঠানের, ইহকালের চেয়ে পরকালের গুরুত্ব বেশি, সেখানে একঘরে হওয়ার ভয় দুর্বিষহ, আর মৃত্যুর পরে মৃতদেহটার অগতি-আশঙ্কা একেবারেই অসহ্য। যে সমাজে যাবতীয় দুস্কৃতি কপালের উপরে চাপিয়ে নিজেকে দায়মুক অনুভব করবার পথ প্রশস্ত, সেখানে রেশমীর বাস্তব সর্বনাশের তুলনায় তার দিদিমার কাল্পনিক সামাজিক বাধা যে গুরুতর হবে এ তো নিতান্ত সহজবোধ্য ব্যাপার। কাজেই মোক্ষদা বুড়ির দৃষ্টিতে তিন চক্রবর্তী নাস্তিক ও অধার্মিক। চণ্ডী বজীর কাছে নতিস্বীকার করে সে বলল-তোরা যা বলবে বাবা, তাই করব।

    চণ্ডী সগর্বে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলে তো, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে কি না।

    যে দেশ ধর্মের কল নাড়াবার ভার বাতাসের উপর অর্পণ করে নিশ্চিত থাকে, সে দেশের দুঃখের অন্ত থাকে না।

    অবশেষে অনেক বিতর্ক ও বিতভার পরে মোদার কাছ থেকে বারোয়ারী কালীমাতার ভোগের জন্য একুশটি সিক্কা টাকা ও সওয়া মণ চাল নিয়ে তার উপর থেকে সামাজিক দণ্ড প্রত্যাহার করা স্থির হল এবং আরও অনেক সলা-পরামর্শের পর সিদ্ধান্ত হল যে কলকাতায় গিয়ে জাত-কাছারির কর্তা মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুরকে ধরাও করা আবশ্যক। কোম্পানির উপরে তাঁর প্রভূত প্রভাব। তিনি ইচ্ছা করলে অবশ্যই সাহেবের কবল থেকে রেশমীকে উদ্ধার করার উপায় করে দিতে পারেন।

    চণ্ডী বক্সী অবিলম্বে কলকাতা যাত্রার উদ্যোগ শুরু করে দিল।

    .

    ২.০৪ রেশমী সুত্র

    রেশমীর সম্বিৎ ফিরে পেতে পুরো তিনটি দিন লেগে গেল। চতুর্থ দিনে খানিকটা গরম দুধ পান করে সে আবার শুয়ে পড়ল। ছিরুর মা বলল-ও-রকমভাবে না খেয়ে থাকলে যে মরে যাবে, নাও এই সন্দেশ দুটো ধাও। কিন্তু কোন সাড়া দিল না রেশমী। ছিরুর মা জ্যাভেজের আয়া।

    তন্দ্রায় ঘুমে স্বপ্নে কেটেছে এই কয়দিন রেশমীর। যতক্ষণ পর্যন্ত চণ্ডী বক্সী দলবল নিয়ে শাসাচ্ছিল-সে প্রাণপণ-বলে কেরীর হাটু আঁকড়ে পড়েছিল, নিজের শেষবিন্দু শক্তিকে চাবকে জাগিয়ে রেখেছিল। চণ্ডীর দল অপসারিত হতেই তারও শক্তি নিঃশেষিত হয়ে গেল, ছিন্নমূল লতার মত নিঃশব্দে নেতিয়ে পড়ে গেল কেরীর দুই পায়ের মাঝখানে নৌকার পাটাতনের উপর। রাম বসু ডেকে আনল হিরুর মাকে। তখন দুজনে ধরাধরি করে নিয়ে চলল তাকে হিরুর মার কামরায়। সেই যে শুল, ঘুমে তন্ত্রায় স্বপ্নে কেটে গেল তিন দিন তিন রাত, না গেল মুখে এক বিন্দু জল, না গেল পেটে এক দানা অন্ন।

    মেয়েটিকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হিরুর মার ঘরে, মিসেস কেরী একবার উঁকি মেরে শুধাল, ওর কি হয়েছে? বাঘে ধরেছে নাকি?

    ফেলিক্স বলল, না, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। মিসেস কেরী তাঁর বাক্য সমাপ্ত করে দিয়ে বলল, বাঘের আক্রমণেই। দেখছ না ওর গা লাল হয়ে গিয়েছে।

    ভেজা চেলি লেপটে রয়েছে ওর গায়ে।

    দুধটুকু পান করে শুয়ে পড়ল, কিন্তু আর ঘুম এল না। ঘুমেরও একটা সীমা আছে। দেহে নূতন করে বলের সঞ্চার অনুভব করল সে। বল কমতে কমতে শেষ সীমায় পৌঁছে আবার বোধ করি আপনিই বাড়তি মুখে রওনা হয়, অমাবস্যার চন্দ্রের শুক্লা তিথিতে সঞ্চারের মত। নতুবা রেশমীর নতুন করে বল অনুভব করবার কি কারণ থাকতে পারে। বলের সঙ্গে এল আশা, আশার সঙ্গে আবার বাঁচবার ইচ্ছা। সে ভেবেছিল, এখন মরলেই বাঁচি। এবার ভাবতে শুরু করল, আবার বাঁচি না কেন! ভাবল, মরবই যদি তবে চিতা থেকে পালাতে গেলাম কেন? চিতার স্মরণে সর্বাঙ্গে শিউরে উঠল। চেষ্টা করল মনটাকে সেদিক থেকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু তা আর সম্ভব হল না। একে একে মর্মান্তিক দৃশ্যগুলো ভেসে উঠতে লাগল তার মনশ্চক্ষে। একে একে কিন্তু ঠিক পরম্পরা রক্ষা করে নয়। গত অষ্টপ্রহরের অগুনতি দৃশ্য হরিলুটের বাতাসার মত ছিটকে পড়ছে, পূর্বাপর ঠিক থাকছে না।

    কয়েকদিন থেকে কানাঘুষায় সে শুনছিল যে, তার বিয়ে আসন্ন। কিন্তু তা যে এত আসন্ন তা কি জানত! সেদিন সন্ধ্যাবেলায় বুঝল আজ রাতেই বিয়ে! ঢোল-সানাইয়ের বাজনা মাঝে মাঝে এখনও যেন কানে এসে বাজছে। চেলি-চন্দনে সেজে হাতে দুগাছা বুলি পরে রওনা হল সে বিবাহমণ্ডপের দিকে। ঐ চণ্ডী-খুড়োরই যেন আগ্রহ বেশি। ঐ কি বর! শরীর যেন বৃকাঠ। মাথাভরা টাক, চোখ ঢুকে গিয়েছে গর্তের মধ্যে, মুখে একটাও দাঁত নেই! কে যেন চাপা গলায় বলল, অমন সুন্দর মেয়েটাকে দিল ভাসিয়ে। চণ্ডীখুড়ো ভারী গলায় হাঁকল, ওরে, বাজা বাজা, লগ্ন হয়েছে।…বন্দুকের শব্দ কেন? তবে কি বিয়েতে বোম ফাটাবার ব্যবস্থাও ছিল? বাসরঘরেই উঠল বরের শ্বাস। কবরেজ ডাক, ওরে কবরেজ নিয়ে আয়! কে একজন বলে ওঠে—এ বর আমদানি তো কবরেজের কৃপাতেই হয়েছে, আবার তাকে কেন? চণ্ডীখুড়ো তাড়া দেয়, তোমরা এখন যাও দেখি, গোল ক’র না।…নাঃ, শেষ হয়ে গেল! সর্বনাশ হল হুঁডিটার। কেষ্ট কবরেজ ধন্বন্তরি বটে, বিয়ে শেষ হবার আগেই বরের শেষ হল। তার পর কি হল ওর ভাল মনে পড়ে না। সব কেমন জট পাকিয়ে যায়। ঢাক-ঢোলের আওয়াজের মধ্যে সবাই ওকে কোথায় নিয়ে চলে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা, বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাকে এমনি অসাড় করে রেখেছিল যে, এতটুকু ঔৎসুক্য ছিল না তার মনে। সবাই বলল, চল; সে চলল। যখন সংজ্ঞা হল দেখল সম্মুখে চিতা সাজানো, উপরে শায়িত একটা মৃতদেহ। লোকটা কে? ওর সঙ্গে কি তার সম্বন্ধ? ঠিক বটে–এতক্ষণে মনে পড়ে—ঐ লোকটার সঙ্গেই তো তার বিয়ে হয়েছিল। কবে? কাল রাত্রে না পূর্বজন্মে–কিছু মনে পড়ে না। সবাই ওকে স্নান করতে নিয়ে যাচ্ছে কেন? তবে কি? বোধ করি তবে তাই। পাড়ার বিন্দু বামনীকে চিতায় উঠতে স্বচক্ষে ও দেখেছে। ওঃ, সে কি কষ্ট মেয়েটার! যতবার লাফিয়ে পড়তে যায়, সবাই মিলে হরিধ্বনির মধ্যে বাঁশ দিয়ে চেপে ধরে।…না না, ও মরতে পারবে না। আর এমন নির্মম মৃত্যুই যদি তার কপালে শেষ পর্যন্ত অবধারিত ছিল, তবে কেন ও বেঁচে রইল? ওর বাপ, মা, অন্য দুই ভাইবোনের মত নৌকাডুবি হয়ে কেন মরল না? না, কিছুতেই না কিছুতেই না। মরতে ওর বড় ভয়। সে দেখল অবাধ সুযোগরূপে সম্মুখে নদী প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। পূর্বাপর চিন্তামাত্র না করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রথমটা কেউ নজর দেয় নি, শেষে রব উঠল—গেল গেল, ডুবল ডুবল! না না, ডোবা নয়—পালাল রে পালাল। আন নৌকা আন ডিঙি! পিছনে দাঁড়ের ছপ ছপ শব্দ। সম্মুখে কার ঐ বজরা? বাঁচাও বাঁচাও, পুড়িয়ে মারল আমাকে, শীগগির বাঁচাও!

    কে একজন হাত বাড়িয়ে টেনে তোলে। রেশমী জড়িয়ে ধরে কার একজনের হাঁটু। এতক্ষণ এমন বিচিত্র কাজ করবার শক্তি কে যোগাল ওকে। যতক্ষণ বিপদের আশঙ্কা ছিল-শক্ত ছিল ও। আশঙ্কা দূর হতেই মুর্ভূিত হয়ে পড়ল।

    রেশমী, রেশমী, ওঠ, কিছু খাও।

    এই তো দুধ খেলাম।

    ওমা, সে তো কালকে খেয়েছ!

    তবে কি এর মধ্যে একটা দিন চলে গেল?

    বে না! দিন কি কখনও মুখ চেয়ে বসে থাকে?

    কি খাব?

    ভাত।

    সাহেবের বজরায় খাব না।

    ওমা, সাহেবের বজরায় কে খেতে বলছে, সঙ্গে যে হিন্দুর বজরা আছে।

    তুমি সেখানে খাও?

    তবে কি খিরিস্তানের বজরায় খেয়ে খিরিস্তান হব।

    তবে আমাকে সেখানে নিয়ে চল। কিন্তু তোমাকে কি বলে ডাকব?

    সবাই যা বলে ডাকে—ছিরুর মা।

    রাম বসুদের বজরায় এসে চার দিন পরে রেশমী অন্ন গ্রহণ করল।

    .

    ২.০৫ ন্যাড়া দি গ্রেট

    প্রতিদিন বিকালে ন্যাড়ার কাছে কেরী লোকমুখের ভাষায় পাঠ গ্রহণ করে, সকালবেলা যেমন শেখে ফারসী ও সংস্কৃত রাম বসুর কাছে।

    রাম বসুকে কেরী বলে, মুন্সী, বাংলা গদ্য গড়ে তুলতে হবে লোকে যেসব শব্দ সদাসর্বদা ব্যবহার করে তার উপরে।

    রাম বসু বলে—তাই করুন না কেন? আমি তো সাহিত্যের ভাষায় কথা বলি নে।

    তোমার ভাষায় ফারসী শব্দের আধিক্য, সংস্কৃত শব্দও কম নয়। লোকমুখের ভাষা অবিকৃত ন্যাড়ার মুখে। ও আমাকে খুব সাহায্য করছে। ওর নাম দিয়েছি ন্যাড়া দি গ্রেট।

    কিন্তু ও যে একেবারে অশিক্ষিত।

    আমার বাইবেলের তর্জমাও যে হবে অশিক্ষিত লোকের জন্য। দেখ, সেদিন ন্যাড়া দি গ্রেট আমাকে শিখিয়েছে ‘মিন্সে’ শব্দটা। শব্দটার খুব তাকত।

    ওটা নিতান্ত গ্রাম্য শব্দ।

    অধিকাংশ লোকই যে গ্রাম্য। দেখ মুন্সী, মনুষ্য বল, পুরুষ বল, লোকজন বল মিন্সের মত কোনটাই এক্সপ্রেসিভ নয়। মিন্সে শব্দটা উচ্চারণ করবামাত্র আস্ত একটা মানুষ সম্মুখে এসে দাঁড়ায়।

    রাম বসু বোঝে যে, যে-কারণেই হক, সাহেবের কাঁধে এখন গ্রাম্য ভাষার পেত্নী ভর করেছে, প্রতিবাদ করা বৃথা, প্রতিবাদ করলেও পেত্নী সহসা নামবে না, কাজেই এখন পেত্নীর সমর্থন করাই বুদ্ধির কাজ। সে বলে—আপনি যা বলেছেন। গ্রাম্য শব্দের তাকতই আলাদা।

    তবে! বলে একখানি কাগজ টেনে বের করে কেরী।

    দেখ, ন্যাড়া দি গ্রেট আরও কতকগুলো চমৎকার শব্দ আমাকে যুগিয়ে গিয়েছে।

    এই বলে সে পাঠ করে-কাহিল, ঠাকুরঝি, খানকী, মাগী, বেটা, ফলানা!

    তার পরে বলে ওঠে—‘ফলানা’—এমন চমৎকার শব্দ না আছে ইংরেজী ভাষায়, আছে তোমার সংস্কৃত ভাষায়। ‘অমুক ব্যক্তি’ বা ‘দ্যাট ম্যান’ ‘ফলানা’র কাছে—মদের কাছে জলের মত স্বাদুতাহীন।

    তার পরে উৎসাহিত হয়ে উঠে বলে, এর পরে যখন আমি প্রভুর নাম প্রচার করব, সমবেত জনতাকে সম্বোধন করব, হে মাগী, মিন্সে ও অন্যান্য ফলানাগণ! কেমন হবে?

    চমৎকার হবে।

    রাম বসু মুখে বলে বটে—চমৎকার হবে, কিন্তু মনে মনে ভাবে, আমার কুড়ি টাকা মাইনের চাকরি খতম হবে। সমবেত জনতা তোমাকে দশা পাইয়ে ছাড়বে, দ্বিতীয়বার আর নামপ্রচার করবার সুযোগ দেবে না।

    দেখ মুন্সী, আমি স্থির করেছি ন্যাড়ার কাছে গ্রাম্য শব্দ সংগ্রহ করব, আর তোমার কাছে শিখব বাংলা গদ্য রচনার কৌশল। আর কিয়দ্র অগ্রসর হলে লোকমুখের ভাষায় গ্রন্থ রচনা করব। আর এক-আধখানা গ্রন্থ রচনা করে কলম দুরস্ত হলে বাইবেলের তর্জমা শুরু করব।

    এ অতি উত্তম প্রস্তাব। কোন বিষয় অবলম্বন করে লিখবেন কিছু স্থির করেছেন কি?

    বিষয় আপনি এসে জুটেছে।

    ভাসমান নৌকার উপরে কোথা থেকে বিষয় এসে জুটল—ভেবে পায় না রাম বসু।

    কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবার আবশ্যক হয় না, কেরী আরম্ভ করলন্যাড়া মুখে মুখে ওর জীবনকাহিনী বলে যায়, আমি টুকে রাখি। বিস্ময়কর ওর জীবন! যেন একখানি রোমান্স, তুমি কিছু শুনেছ কি?

    আমি এখনও শুধাবার অবকাশ পাই নি।

    এক সময়ে বিস্তারিত শুনে নিও-এখন একটু আভাস দিচ্ছি। এই বলে কেরী ন্যাড়ার জীবনকাহিনীর একটা ছক বর্ণনা করে যায়।

    ন্যাড়া বলে অতিশয় শৈশবে বাপ মা আর এক বোনের সঙ্গে গঙ্গাসাগরে তীর্থ করতে গিয়েছিল। ফেরবার পথে খেজরীর কাছে বোম্বেটেরা ওদের নৌকা লুট করে নেয়। ওর ধারণা ওর বাপ মা নিহত হয়েছে, বোনের খবর তার পরে পায় নি, খুব সম্ভব সেও নিহত হয়েছে। ও যে কেমন করে ব্যাঙেল গির্জার ক্যাথলিক পাদ্রীদের হাতে এসে পড়ল তা বলতে পারে না।

    ক্যাথলিক পাত্রী! রাম বসু আতঙ্কে শিউরে ওঠে।

    মুন্সী, আতঙ্কিত হয়ে উঠলে কেন?

    আতঙ্কিত হব না? ক্যাথলিক সম্প্রদায় যে প্রভুর সত্যধর্মের দুশমন!

    ঠিক কথা, ঠিক কথা। বলে আনন্দে কেরী রাম বসুর করমর্দন করে।

    রাম বসু মনে মনে হাসে।

    তোমার প্রভুকে তুমি যত জান আমার কুড়ি টাকার প্রভুকে তার চেয়ে বেশি জানি আমি। কোন্ কথায় তার মন ও টাকার থলি কতখানি বিস্ফারিত হবে তা আমার চেয়ে কেউ বেশি জানে না।

    কেরী বলে ওঠে, তোমার মত গুণী লোকের কুড়ি টাকা বেতন অত্যন্ত লজ্জার কথা, এবারে মদনবাটিতে গিয়ে আরও পাঁচ তা বাড়িয়ে দেব।

    প্রস্তাবটা কানে ঢোকে নি এমনভাবে রাম বসু বলে-ন্যাড়ার জীবনকথা বলুন।

    দুশমনদের কাছে পাঁচ-সাত বছর ও থাকে। সেই সময়ে দু-চার কথা ইংরেজী শেখে। একদিন যখন নদীর ধারে ও খেলছিল, ছেলে-ধরার দল ভুলিয়ে নৌকায় তুলে নিয়ে আসে কলকাতায়। সেখানে প্রসিদ্ধ হারমনিক ট্যাভানের মালিকের কাছে ওকে দশ টাকায় বিক্রি করে। ও বাসন-কোসন পরিষ্কার করত, ফাই-ফরমাশ খাটত, আর অবসর সময়ে লালদিঘির একটা বড় তেঁতুল গাছের তলায় লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেত। শেষে হারমনিক ট্যাভার্ন উঠে গেলে বাসন-কোসন আসবাবপত্রের সঙ্গে ও বিক্রি হয়ে যায়। মার্টিন সাহেব কিনে নেয় ওকে বিশ টাকায়।

    এবারে থেমে কেরী শুধায়, কেমন, বিস্ময়কর নয়?

    বিস্ময়কর, কিন্তু এমন অভিনব কিছু নয়, এমন আকছার ঘটছে! দুঃখের কথা বলব কি ডাঃ কেরী, চুরি-করা ছেলেয় কলকাতার সাহেব-সুবোদের চাকর-বাকরের মহল আর চুরি-করা মেয়ের কলকাতার গণিকাপাড়া ভর্তি হয়ে গেল!

    রাম বসু চুপ করে থাকে, হয়তো সাধারণভাবে কলকাতার বেশ্যাপল্লীর কথা মনে পড়ে, হয়তো বা বিশেষভাবে টুশকির কথা মনে পড়ে।

    তার পরে আবার বলে—এই যে মেয়েটা এসে পড়ল, শেষ পর্যন্ত তারই বা গতি কোন্ মহলে হবে কে বলতে পারে!

    কে, রেশমী? কেরী বলে, ওকে এদিক-ওদিক যেতে দেব না। ওর সঙ্গে কাল আমার কথা হয়ে গিয়েছে। ও বলে কিছুতেই ওর সমাজে ফিরবে না।

    তা আমি জানি, ফিরে গেলে ওর মৃত্যু অবধারিত।

    কেরী বলে, ওর নিজ নামে কিছু বিষয় আছে, ওর মৃত্যু না হওয়া অবধি উত্তরাধিকারিগণ নিশ্চিত হতে পারছে না।

    কেরী বলে চলে রেশমী বলছিল যে, আমার কাছে থাকলে ওকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে কেউ সাহস করবে না। মুন্সী, আমি স্থির করেছি, ওকে ইংরেজী শেখাব, আর কখনও স্বেচ্ছায় যদি সত্যধর্ম গ্রহণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে তবে ওকে খ্রীষ্টীয়মণ্ডলী ভুক্ত করে নেব।

    প্রস্তাবটা বসুর ভাল লাগে না। মুখে বলে-মন্দ কি!

    মিসেস কেরী মেয়েটিকে খুব পছন্দ করেছেন—ওর সঙ্গে গল্পগাছা করেন আর তাতে অনেকটা প্রকৃতিস্থ থাকেন। কিন্তু সবচেয়ে জমেছে ন্যাড়ার সঙ্গে ভাব, দুজন দুজনকে পেলে আর ছাড়তে চায় না, সমবয়স্ক কিনা।

    রাম বসু বলে, তা আমি লক্ষ্য করেছি। দুটিতে বজরার ছাদে বসে সারাদিন গল্প করছে। বেশ দেখায়, যেন দুই ভাইবোন।

    এমন সময়ে হঠাৎ মাঝিদের কোলাহল শুনে রাম বসু জিজ্ঞাসা করল—কি মাঝি, ব্যাপার কি?

    মাঝিদের একজন বলল, ঐ ছিপ নৌকাখানার গতিক ভাল নয়।

    রাম বসু তাকিয়ে দেখল, দূরে একখানা ছিপ।

    কি মনে হয়?

    বোম্বেটেদের নৌকা বলে মনে লাগে।

    বোম্বেটেদের নৌকা!

    সকলে একসঙ্গে চকিত হয়ে ওঠে।

    কি সর্বনাশ!

    পাল তুলে দাও, পাল তুলে দাও!

    ওরে ওঠ ওঠ, সকলে মিলে হাত লাগা।

    রাম বসু বলে উঠল, সমুখে রাত্রি, পিছনে বোম্বেটে, আজ বড় বিপদ।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচার-ইয়ারী কথা – প্রমথ চৌধুরী
    Next Article উইংস অব ফায়ার – এ পি জে আবদুল কালাম
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025
    Our Picks

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025

    ব্রাইডা – পাওলো কোয়েলহো

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.