Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কে কথা কয় – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প311 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২১. সালেহার বুক থেকে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে

    সালেহার বুক থেকে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। রাত বারোটা দশ। হাবিবুর রহমান এত রাত পর্যন্ত জাগেন না। দশটা বাজতে না বাজতেই ঘুমিয়ে পড়েন। আজ জেগে বসে আছেন, তাঁর হাই উঠছে। তিনি হাই চেপে আছেন। সালেহা যদি দেখে তার এমন জটিল অবস্থাতেও একজন পাশে বসে হাই তুলছে তাহলে বিরাট ক্যাচাল বেঁধে যাবে। হাবিবুর রহমান তৌহিদার জন্য অপেক্ষা করছেন। তৌহিদা সরিষার তেলে রসুন দিয়ে চুলায় গরম করছে। রসুন-সরিষার তেল বুকে ডলা হবে। এতে যদি কিছু আরাম হয়। তৌহিদা এত দেরি করছে কেন কে জানে!

    তৌহিদা ওষুধপত্র ছাড়াই এখন স্বাভাবিক আছে। মানসিক অসুস্থতার একটি মাত্র লক্ষণ তার ভেতর আছে। মতিনকে সে তার স্বামী হিসেবে জানে। তাকে সেই ভাবেই দেখে। মতিন তাঁর সঙ্গে বাস করছে না, মেসবাড়িতে থাকছে, এই বিষয়টিও সে সহজভাবে নিয়েছে। বেচারা কী করবে? এই বাসায় থাকার জায়গা কোথায়! নিশু নামের মেয়েটা বিপদে পড়ে থাকতে এসেছে। ছোট বাসা, বাড়তি রুম নেই। নিশু রাতে তার সঙ্গে এক খাটে ঘুমায়। মতিন তো আর দুজনের মাঝখানে ঘুমুতে পারে না। তৌহিদাকে কিছুদিন কষ্ট করতেই হবে। সব মানুষকেই জীবনের শুরুতে কিছুদিন কষ্ট করতে হয়। কষ্ট করলে কেষ্ট মিলে। সে কিছুদিন কষ্ট করবে, তারপর মতিনের সঙ্গে বাস শুরু হবে। আলাদা সংসার। নয়-দশ বছর বয়সের একটা কাজের মেয়ে রাখবে। মেয়েটা ঘরের টুকটাক কাজ করবে। তৌহিদা রান্নাবান্না করবে। একবছর পার না হতেই সে বাবু নিয়ে নিবে। স্বামী-স্ত্রীর সংসার কোনো সংসার না। সংসারে বাবু থাকতে হয়।

    তৌহিদা তেলের বাটি নিয়ে সালেহার পাশে দাঁড়াতেই সালেহা কঠিন ধমক দিলেন, তেল আনতে এতক্ষণ লাগল? তেল এনেছে এক বালতি। আমি কি তেলে গোসল করব? জিনিস নষ্ট করতে গায়ে লাগে না!

    হাবিবুর রহমান বললেন, আহা, বাদ দাও তো। চুপ করে থাক, তেলটা মালিশ করে দিক।

    সালেহা বললেন, বাবারে বাবা! ছোট বৌ-এর উপর দ বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে। এতই যদি দরদ তাহলে আমার সামনে বসে আছ কেন? ছোট বৌকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাও। ঘরও তো খালি নাই যে কোনো ঘরে ঢুকবে। আরেক মাগি এসে চেপে বসেছে। এক কাজ কর, ঐ মাগিটাকেও বিয়ে করে ফেল। মাগিকে ডেকে আন, আমি সুপারিশ করব।

    তৌহিদা সালেহার ছোট বৌ বিষয়ক কথাবার্তা ঠিক বুঝতে পারে না। বুবু কেন তাকে ভাইজানের ছোট বৌ বলে খোঁটা দেয়? এটা ঠিক না। ভাই হলো ভাই। ভাইয়ের সম্মান নষ্ট হয় এই ধরনের কোনো কথা বলা ঠিক না। তৌহিদার উচিত প্রতিবাদ করা। সে করে না। অসুস্থ মানুষের কথা ধরতে হয় না। বুবুর। শরীর অতিরিক্ত খারাপ।

    তৌহিদা হাতে তেল মাখিয়ে বিছানার দিকে ঝুঁকে এলো। সালেহা ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিয়ে তীব্র গলায় বললেন, তুই তেলের বাটি নিয়ে বিদায় হ। তোর স্বামীর … (মুদ্রণযোগ্য না) তেল মাখিয়ে দে।

    হাবিবুর রহমান তৌহিদার দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করলেন সে যেন চলে যায়। তৌহিদা তাই করল। সালেহা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি বসে আছ কেন? ছোট বৌ-এর কাছে যাও। ছোট বৌ-এর সঙ্গে লটরপটর কর। নিজের বৌ, বাইরের কেউ তো না।

    হাবিবুর রহমান হতাশ গলায় বললেন, নোংরা কথাগুলি না বললে হয় না?

    সালেহা বললেন, তুমি নোংরা কাজ করতে পারবে, আমি নোংরা কথা বলতে পারব না?

    হাবিবুর রহমান দুঃখিত গলায় বললেন, তুমি খুব ভালো করে জানো নোংরা কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি অতীতে কোনোদিন কোনো নোংরা কাজ করি নি, ভবিষ্যতেও করব না।

    সালেহা সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় বড় করে বললেন, ওরে বাবারে, এত বড় মহা মানব আমার সামনে বসে আছে। তুমি কষ্ট করে তোমার বাম পা-টা এগিয়ে দাও। আমি তোমার শ্রী চরণ চেটে দেই।

    হাবিবুর রহমান কিছু বললেন না। তিনি এখন অনেক স্বস্তি বোধ করছেন, কারণ সালেহার বুক থেকে ঘড়ঘড় আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। ঝামেলাটা সেরে গেছে। তাঁর মন বলছে কিছুক্ষণের মধ্যেই সালেহা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। তিনিও ঘুমাতে পারবেন। এক ঘুমে রাত কাবার করে দেবেন। হাবিবুর রহমান স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, বুকের ব্যথাটা কি কমেছে?

    সালেহা বললেন, কমলে তোমার কী?

    একগ্লাস পানি খাও। পানি খেয়ে ঘুমাবার চেষ্টা কর।

    পানি তুমি খাও] একগ্লাস না, এক বালতি খাও। পানি খেয়ে শরীর ঠাণ্ডা কর। তৌহিদাকে দেখে তোমার শরীর গরম হয়ে গেছে। শরীর ঠাণ্ডা করা দরকার।

    হাবিবুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সালেহা এরকম ছিল না। রোগে শশাকে সে বদলে যাচ্ছে। রোগটা যে কী তাও ধরা যাচ্ছে না। যে রোগ ধরা যায় সে রোগের চিকিৎসা হয়। রোগই ধরা যায় না, চিকিৎসা কী হবে? একটা সন্তান যদি তার পেটে আসত সব ঠিক হয়ে যেত। সেই চেষ্টাও কম করা হয় নি। চেষ্টা যে এখন বন্ধ হয়ে গেছে তাও না গোপনে গোপনে চলছে। তিনি নবীনগরের এক পীর সাহেবের কাছে গিয়েছিলেন। পীর সাহেব তাকে একটা দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন। চিল্লায় বসে এই দোয়া পড়তে হবে। সাতদিনের চিল্লা। এই সাতদিনে গায়ে তেল মাখা যাবে না, মাংস খাওয়া যাবে না। সময় সুযোগ হচ্ছে না বলে চিল্লায় যাওয়া যাচ্ছে না।

    হাবিবুর রহমান খাট থেকে নামলেন। সালেহা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, যাও কোথায়?

    বারান্দায় যাই। একটা সিগারেট খাব।

    সিগারেট খাবে না-কি ছোট বৌ-এর সঙ্গে ঘষাঘষি করবে? কোথাও যেতে পারবে না। যেখানে বসে ছিলে সেখানে বসে থাক।

    হাবিবুর রহমান বাধ্য ছেলের মতো খাটে উঠে বসতে বসতে বললেন, সালেহা, আমি সাতদিনের জন্যে ঢাকার বাইরে যাব।

    সালেহা বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললেন, কেন?

    একটা জরুরি কাজ আছে।

    কাজটা কী?

    কাজটা কী তোমাকে বলা যাবে না। শুধু তোমাকে না, কাউকেই বলা যাবে। বললে কাজটা হবে না।

    হলে না হবে। কী কাজ বলো।

    সাতদিনের জন্যে চিল্লায় বসব।

    চিল্লা কী?

    মসজিদে বসে এক মনে আল্লাহপাককে ডাকব।

    উনাকে ডাকাডাকি করে বিরক্ত করার দরকার কী?

    চিল্লায় বসে উনার কাছে কিছু চাইলে উনি দেন। সন্তান চাব। দেখি উনার দয়া হয় কি-না।

    সালেহা কঠিন কোনো কথা বলতে গিয়েও বললেন না। নিজেকে সামলে নিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন, যাও, সিগারেট খেয়ে আস।

    হাবিবুর রহমান বললেন, থাক শুয়ে পড়ি।

    হাবিবুর রহমান বাতি নিভালেন। বিছানায় শুতে এলেন। সালেহা নিজের মনে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, আমার যদি একটা মেয়ে হতো এমন নাম রাখতাম যে নাম কেউ কোনোদিন রাখে না।

    কী নাম?

    আচার।

    মেয়ের নাম রাখবে আচার?

    হুঁ।

    ঘর অন্ধকার। সালেহা হাসতে শুরু করেছেন। শব্দ করেই হাসছেন। আচার নামটা তিনি এই মুহূর্তেই ঠিক করেছেন। নামটা তার খুবই মনে ধরেছে। তার ইচ্ছা করছে তৌহিদাকে ডেকে আচার নামটা নিয়ে আলোচনা করতে। রাত এমন কিছু বেশি হয় নি। ইচ্ছা করলেই তৌহিদাকে ডাকা যায়। নিশু নামের মাগিটাকেও ডাকা যায়। সে আবার বিরাট জ্ঞানী। আচার নামটা কি এত বড় জ্ঞানীর পছন্দ হবে? সালেহা স্বামীর গায়ে ধাক্কা দিলেন। হাবিবুর রহমান ঘুম। ঘুম গলায় বললেন, কী?

    তোমার ছোট বৌকে ডাক দিয়ে আন। তার সঙ্গে আমার কথা আছে।

    আচ্ছা।

    আচ্ছা কী? যাও।

    হাবিবুর রহমান হু বলে শব্দ করে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। সালেহা চেষ্টা করেও স্বামীর ঘুম ভাঙাতে পারলেন না।

     

    নিশু ঘুমুচ্ছিল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিল। ভয়ঙ্কর স্বপ্ন। তার গা ঘেঁষে কুকুরের মতো চেহারার কুৎসিত একটা জন্তু বসে আছে। জন্তুটার হাত মানুষের হাতের মতো। তবে হাতে অনেকগুলি করে সরু সরু আঙুল। জন্তুটা ত হাতভর্তি আঙুল দিয়ে নিশুর গা হাতাপিতা করছে। ভয়ে আতঙ্কে নিশু ধড়মড় করে জেগে উঠে দেখে ঘরে বাতি জ্বলছে। তার পাশে তৌহিদা বসে আছে। তৌহিদা তার গায়ে কী যেন মাখাচ্ছে। এই মহিলার মাথার ঠিক নেই, সে কী করছে কে জানে। নিশু হতভম্ব গলায় বলল, কী হচ্ছে?

    তৌহিদা বলল, আপনার শরীরে তেল মাখাই।

    কেন?

    তৌহিদা সহজ গলায় বলল, বুবুর জন্যে তেল গরম করেছিলাম। বুবু তেল মাখবে না। তেল খামাখা নষ্ট হবে।

    নিশু বলল, তেল নষ্ট হলে হবে। আমি গায়ে তেল মাখব না।

    একটু দিয়ে দেই, আরাম লাগবে।

    আমার আরামের দরকার নেই।

    চুলে বিলি দিয়ে দেই?

    চুলে বিলি দিতে হবে না। কয়টা বাজে?

    একটা পাঁচ।

    এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ কেন? তুমি ঘুমাও।

    তৌহিদা বলল, আমার ঘুমাতে ভালো লাগে না। জেগে থাকতে ভালো লাগে। জেগে থাকার মজা আছে। ঘুমের মধ্যে কোনো মজা নেই।

    কী মজা?

    জেগে থাকলে ভালো ভালো চিন্তা করা যায়। ঘুমের সময় নিজের মতো চিন্তা করা যায় না।

    ভালো ভালো চিন্তাটা কী?

    তৌহিদা লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, আমি চিন্তা করি–বিয়ে করেছি, কিন্তু স্বামীর সঙ্গে থাকতে পারি না। এখন আমার দিন যায় কষ্টে। এই দিন থাকবে না। আমরা আলাদা বাসা ভাড়া করব। একটা কাজের মেয়ে রাখব। সে আমার বাবুর দেখাশোনা করবে। এখন আমার অনেক কষ্ট। তবে কষ্ট করলে কেষ্ট মিলে। ঠিক না আপা?

    নিশু হাই তুলতে তুলতে বলল, ঠিক।

    তৌহিদা বলল, কেষ্ট জিনিসটা কী আপা?

    নিশু বলল, কেষ্ট হলো কৃষ্ণ। কষ্ট করলে কৃষ্ণকে পাওয়া যায়। অর্থাৎ আনন্দ পাওয়া যায়। কৃষ্ণ কে তুমি জানো না?

    তৌহিদা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। নিশু বলল, রাতে ঘুমাতে যাবার আগে তোমার ঘুমের ওষুধ খাওয়ার কথা না?

    তৌহিদা বলল, হ্যাঁ, দুটা করে নীল রঙের ট্যাবলেট। ঘুমের ওষুধ।

    আজ খেয়েছ?

    না।

    গতকাল খেয়েছিলে?

    না।

    গত পরশু?

    এখন থেকে ওষুধ থেমে ঘুমাবে। আমি নিজের হাতে তোমাকে ওষুধ খাওয়াব। যাও ওষুধ নিয়ে আস।

    আচ্ছা।

    তিনটা ট্যাবলেট আনবে। আমি একটা খাব। আমার ভালো ঘুম দরকার।

     

    রাতে একবার ঘুম ভাঙলে নিশুর আর ঘুম আসে না। নীল রঙের ঘুমের ওষুধ খাবার জন্যেই হয়তো সে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছে। আরামের কোনো ঘুম না। কষ্টের ঘুম। ঘুমের মধ্যে সে দৌড়াচ্ছে। পুরনো ঢাকার চিপা গলির ভেতর। ছুটছে। গলি জনশূন্য। কয়েকটা কুকুর শুধু ঘোরাফেরা করছে। কুকুরগুলি সাইজে অনেক বড়। রঙ মিশমিশে কালো। অনেক রাত। নিশু ছুটছে, নিশুর পেছনে পেছনে কালো গাউন পরা উকিল দৌড়াচ্ছে। উকিলটা মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে মিস নিশু, আমার কথা শুনুন। কাস্টমারদের কাছ থেকে আপনি কত করে নেন, এটা আমার জানা দরকার। কারণ আপনার স্বামী বিষয়টা জানতে চাচ্ছে।

    উকিলটা যখন থমকে দাঁড়ায় তখন নিশুও থমকে দাঁড়ায়। তাকে বাধ্য হয়ে দাঁড়াতে হয়, কারণ দৌড়াতে দৌড়াতে সে ক্লান্ত। তার পা ভেঙে আসে। সে বিশ্রাম নেবার জন্যে দাঁড়ায়। উকিলটার কথা বাধ্য হয়ে শুনতে হয়। তার কথার জবাব দেয়া অর্থহীন। এটা জেনেও সে জবাব দেয়।

    হ্যালো মিস নিশু–হ্যালো!

    কী চান?

    আপনার স্বামীর মোবাইল নাম্বারটা বলুন তো?

    আমি বিয়ে করি নি। আমার স্বামী নেই।

    তাহলে মতিন সাহেবের নাম্বারটা দিন।

    ওর নাম্বার আমার জানা নেই।

    আপনি সত্যি বলার শপথ নিয়েছেন। এখন মিথ্যা বলতে পারেন না। মিথ্যা বললে আপনাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।

    কী শাস্তি?

    ঐ তিনজনকে লেলিয়ে দেয়া হবে।

    কোন তিনজন?

    যারা আপনাকে রেপ করেছে। রেপ—ধর্ষণ। রেডি হয়ে যান। যাচ্ছে, ওরা যাচ্ছে। যাচ্ছে। গেট সেট রেডি, ওয়ান, টু, থি …

    নিশু আবার দৌড়াতে শুরু করেছে। নিশুর পেছনে ঐ তিনজনও দৌড়াচ্ছে। নিশু চেষ্টা করছে জেগে উঠার। তার ঘুম ভাঙছে না। কী কষ্ট! কী কষ্ট! নিশু ঘুমের ঘোরে ডাকলো, মতিন, বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও। মতিন! মতিন!

     

    রাত দুটা বাজে। মতিন জেগে আছে। তার টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে। সে চিঠি লিখতে বসেছে।

    কঠিন গাধা!

    হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো।

    অনেক দিন পর তোকে লিখতে বসেছি। শুরুতে কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো করে নিলাম। হ্যালো হ্যালো করার সুবিধা হচ্ছে–হ্যালো মানে কথা বলা। তোর কি মনে হচ্ছে আমি তোর সঙ্গে কথা বলছি?

    ভুলে যাবার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, মানুষ ভয় পায় কেন? মানুষ আনন্দ পায় কেন?

    বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা চাচ্ছি না। অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। এই বিষয়ে এখন গবেষণা চলছে।

    তারপর বল, তোর হাতির বাচ্চা কেমন আছে? হাতির আরেক নাম যে জলপশু এটা জানিস? হাতি একমাত্র প্রাণী যে জানে মাটির নিচে কোথায় মিষ্টি-পানি আছে। আফ্রিকানদের বিশ্বাস হাতি ইচ্ছা করলে আকাশ থেকে বৃষ্টি নামাতে পারে। হাতি বিষয়ে আরেকটা কথা একটা হাতি আট মাইল দূরের আরেকটা হাতির সঙ্গে Ultrasound-এর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারে।

    হাতি সম্পর্কে এত কথা বলছি কেন? কারণ নদ্দিউ নতিম সাহেব ঠিক করেছেন হারিয়ে যাওয়া একটি হাতির বাচ্চা নিয়ে গল্প লিখবেন। গল্পটা বাচ্চাদের জন্যে। গল্পের নাম ইরকু। ইরকু হলো হাতির বাচ্চাটার নাম। গল্প লিখতে হবে এইজন্যেই পড়াশোনা।

    পেঙ্গুইনের বইগুলি পেয়েছি। বই হাতে নিয়ে লজ্জা লজ্জা লাগল। প্রথম সন্তান হবার পর বাবা যেমন লজ্জা পান সেরকম লজ্জা। মায়েরা মোটেই লজ্জা পায় না। তারা অহষ্কার করে বাচ্চা সবাইকে দেখিয়ে বেড়ায়। বাবা বেচারা লজ্জায় মুখ নিচু করে থাকে। পিতৃসুলভ লজ্জায় এখন পর্যন্ত বইটা কাউকে দেখাই নি। নিশুকেও না।

    নিশুর অবশ্যি বই দেখার মতো মানসিক অবস্থা নেই। সে তার মামলা নিয়েই বিপর্যস্ত। মামলার অবস্থা অবশ্যি ভালো। অপরাধীদের ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। জীবনের শেষ মুহূর্ত তাদের স্কুলে কাটাতে হবে। মন্দ কী? ঝুলন্ত মৃত্যু।

    মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না। একধরনের ক্লান্তি আমাকে গ্রাস করছে। ক্লান্তি বিষয়ে নদ্দিউ নতিমের একটা কবিতা–

    ক্লান্তি ও ক্লান্ত
    শান্তি ও শান্ত।
    ক্লান্ত ও ক্লান্তি
    শান্ত ও শান্তি।
    এইখানেই Stop
    Drag and Mop
    Drag and Mop।

    তোর কাছে আবোলতাবোল মনে হচ্ছে? কবিতাটা আবোলতাবোেল না। ভেতরে অর্থ আছে। তুই কি ভেতরের অর্থ খুঁজে বের করতে পারবি? পারলে তোর জন্যে পুরস্কার, না পারলে তিরস্কার।

    কি পারবি?

    জানি পারবি না। কারণ এতক্ষণ তোর সঙ্গে ফাজলামি করেছি। ছড়াটা অর্থহীন। ননসেন্স রাইমেও কিছু সেন্স থাকে। এখানে কিছুই নেই। আবোলতাবোল লিখেছি। চিঠিটাও আবোলতাবোল। চিঠিতে লিখেছি নিশুর মামলার অবস্থা ভালো। তা কিন্তু না। মামলার অবস্থা খারাপ। খুবই খারাপ। আসামিপক্ষের উকিল যেভাবে এগুচ্ছে তাতে মনে হয় নিশুই দোষী। গৃহস্থ পল্লীতে বাস করে মাদক এবং দেহব্যবসা চালাচ্ছিল। সুশীল নাগরিকদের স্বার্থে তাকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া প্রয়োজন। সে একা না, আমিও মক্ষীরানীর দালাল হিসেবে জেলে চলে যাব। আমার জন্যে ভালোই হবে। জেল জীবনের অভিজ্ঞতাটা দরকার। আচ্ছা, তুই কি মানুষের বন্দিদশা নিয়ে কখনো ভেবেছিস?

    মানব শিশু শুরুতে থাকে মায়ের পেটে। এখানেই সে অতি ক্ষুদ্র কারাগারে বন্দি। সেই কারাগার কঠিন কারাগার আলো নেই বাতাস নেই। এই ভয়ঙ্কর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সে আসে পৃথিবী নামক কারাগারে। এই কারাগারটা আগের চেয়ে ভালো। আলো বাতাস আছে। অনেক বড়। পৃথিবী নামক কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সে যাবে অন্য এক কারাগারে। (লজিক তাই বলে) সেই কারাগারটা হবে পৃথিবীর চেয়েও অনেক বড়। অনেক সুন্দর। সেই কারাগারের পরেও কি কোনো কারাগার আছে?

    ভালো লাগছে না। কিছুই ভালো লাগছে না। দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করছে। নির্জন কোনো দ্বীপে। যেখানে আমি ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। অন্যের সমস্যা নিয়ে এখন আর ভাবতে ইচ্ছা করছে না। আমি এমন একটা জগতে চলে যেতে চাচ্ছি যেখানে… আচ্ছা থাক এসব। নিজের সমস্যা অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দেবার মানে হয় না।

    চিঠি শেষ করার আগে আমার একটা দুঃস্বপ্নের কথা তোকে বলি। এই দুঃস্বপ্নটা বেশ কয়েকবার দেখেছি। আরো মনে হয় দেখব।

    দুঃস্বপ্নটা এরকম–ছায়াঘেরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আমি যাচ্ছি। যতই যাচ্ছি ততই ছায়ার অংশ বাড়ছে। গাছপালা ঘন হচ্ছে। এক পর্যায়ে শোনা গেল প্রবল কোলাহল! যেন ভয়ঙ্কর কিছু হচ্ছে। ভয়ে আমি উল্টো দিকে দৌড়াচ্ছি। যে দিকে যাচ্ছি সেদিকেই জঙ্গল ঘন হচ্ছে। একসময় দেখা যায় আমি আগের মতো দৌড়াতে পারছি না। পা বেঁধে বেঁধে যাচ্ছে। পায়ের নিচের মাটি জলজ শ্যাওলায় ঢাকা। আমি দৌড়াচ্ছি চোরাবালির উপর দিয়ে, এই সত্যটা একসময় টের পেয়ে আমি ভয়ে ও আতঙ্কে থমকে দাঁড়াই। আর তখনই আমার পা ডেবে যেতে থাকে। আমি চিৎকার করে ডাকি কেউ কি আছে আশেপাশে? আমাকে বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও।

    বেশিরভাগ সময় স্বপ্নের এই পর্যায়ে আমার ঘুম ভেঙে যায়। যখন ভাঙে না তখন স্বপ্নটা নতুন একদিকে মোড় নেয়। আমি অপরূপ রূপবতী এক তরুণীকে আসতে দেখি। সে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। খুব কাছে না। আমি হাত বাড়ালে তাকে ছুঁতে পারি না, এমন দূরত্বে। তরুণী আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, আপনার কী হয়েছে?

    আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছি। আমাকে বাঁচান।

    তরুণী হাসতে হাসতে বলে, চোরাবালির ইংরেজি কী?

    আমি বলি, কুইক স্যান্ড।

    জাপানি ভাষায় চোরাবালিকে কী বলে বলতে পারলে আপনাকে বাঁচাব।

    জাপানি ভাষায় কী বলে জানি না।

    তাহলে তো আপনার খুবই ব্যাড লাক। রুশ ভাষায় কী বলে বললেও হবে। জানেন?

    আমি হতাশ গলায় বলি, না।

    তরুণী হাসতে থাকে, আমি ডুবে যেতে থাকি। এই হলো স্বপ্ন।

    তুই কি জানিস জাপানি কিংবা রুশ ভাষায় চোরাবালিকে কী বলে? জানলে আমাকে অতি দ্রুত জানাবি। যাতে পরের বার যখন এই স্বপ্ন দেখব তখন যেন তরুণীকে চোরাবালির জাপানি কিংবা রুশ পরিভাষা বলে উদ্ধার পেতে পারি।

    ভালো কথা, এই তরুণী কিন্তু আমার পরিচিত। উনার নাম মুনা। উনি কমলের মা। আমি আমার জীবনে এই মহিলার মতো রূপবতী কোনো মহিলা দেখি নি। কিছুক্ষণ মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকলে একধরনের ঘোর তৈরি হয়। ঈশ্বরগুপ্তের কবিতার মতো বলতে ইচ্ছা করে–

    কে বলে শারদ শশী সে মুখের তুলা
    পদনখে পড়ে আছে তার কতগুলা।

    তুই একবার বলেছিলি আমি কখনো কোনো মেয়ের প্রেমে পড়তে পারব না। আমার ভেতর সেই জিনিস নেই। এখন দেখলি তো ঘটনা কী?

    আজ আর না। তুই ভালো থাকিস। তোর হস্তীশাবক ভালো থাকুক। পৃথিবীর সর্বপ্রাণী ভালো থাকুক।

    নদ্দিউ নতিম

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleজলপদ্ম – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article কালো যাদুকর – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }