Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ক্যামিল – পিয়ের লেমেইত

    পিয়ের লেমেইত এক পাতা গল্প325 Mins Read0

    প্ৰথম দিন – সকাল

    সকাল ১০টা

    জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য সামান্য একটা ঘটনাই যথেষ্ট। বিশেষ করে, সেই ঘটনা যদি আপনার জীবনকে পুরোপুরি অস্থিতিশীল করে তোলে। কয়েক মাস আগে ‘ইতিহাসের পট পরিবর্তন’ শিরোনামে একটা লেখায়, এমনটাই পড়েছিল ক্যামিল ভেরহোভেন। জীবনকে এলোমেলো করে দেয়া ঘটনা, আর দশটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার সাথে মেলানো যাবে না। শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত নেয়ে যাওয়ার মত ঘটনাতো সচরাচর ঘটে না। ঘটনার পরপরই আপনি বুঝতে পারবেন, এমন এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, যা থেকে ফেরার কোনো পথ থাকবে না।

    ধরা যাক, ‘পাম্প অ্যাকশন শটগান’ থেকে চলা তিনটা গুলি, আপনার প্রিয়তমার বুকে বিঁধেছে।

    ক্যামিলের ভাগ্যে এমন কিছুই লেখা আছে।

    হয়তো ক্যামিলের মত আপনিও, নিজের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেন। কিংবা একদিনে দুর্ভাগ্যের ষোলকলা পূর্ণ করতে পারেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ নেই। কেন না ভাগ্য এইসব মামুলি বিষয় নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায় না। বরং এই ভাগ্যই খুনির রূপ ধরে আপনাকে তাড়া করবে।

    ঠিক তখন প্রতিক্রিয়াঃবশত আপনি কী করবেন, সেটাই দেখবার বিষয়। আর এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

    কেন না আপনি তখন মানসিকভাবে এতোটাই বিপর্যস্ত থাকবেন, কী করবেন-আপনি তা নিজেই জানেন না। ধরা যাক, আপনার প্রিয়তমাকে গুলি করার আগে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়েছে। শটগানে গুলি ভরার দৃশ্য আপনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন।

    সম্ভবত এমন সময়ে, সত্যিকারের সাহসী মানুষ নিজেকে মেলে ধরে। যারা সবচেয়ে সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তেও, নিজের সেরা সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।

    যদি আপনি সাধারণ কোনো মানুষ হন, তাহলে হয়তো পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। আগে কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন না হলে, আপনার সিদ্ধান্ত ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ।

    একটা নির্দিষ্ট বয়স পার হওয়ার পর কিংবা ভয়ংকর কোনো ঘটনা যদি আপনার জীবনকে তছনছ করে থাকে, হয়তো ভাববেন আর কোনো কিছুই আপনাকে নাড়াতে পারবে না। ক্যামিলের ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে। তার প্রথম স্ত্রী খুন হয়েছিল। সেই দুঃসহ স্মৃতি কাটিয়ে উঠতে, বেশ কয়েক বছর লেগেছে তার। এমন অগ্নিপরীক্ষার পর আপনি ভাববেন. এর চেয়ে বেশি আর কী বা হতে পারে!

    এই চিন্তাটাই আপনাকে ফাঁদে ফেলবে।

    আপনি অসতর্ক হয়ে পড়লেন।

    আপনাকে অসতর্ক অবস্থায় পাওয়ার ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে ভাগ্যদেবী।

    …আর নিয়তির অমোঘ পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

    ***

    খোলার সাথে সাথে গ্যালারি মনিয়েরে প্রবেশ করলো অ্যানি ফরেস্টিয়ে দোকানে লোকজন নেই বললেই চলে। বাতাসে ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ। দোকানের মালিক বই আর গয়না গোছাতে ব্যস্ত।

    উনিশ শতকের শেষের দিকে তৈরি এই গ্যালারিতে প্রাচীন স্থাপত্যকলার ছাপ লক্ষণীয়। দোকানের একদিকে স্টেশনারি পণ্য, চামড়ার তৈরি জিনিসপত্র, অ্যান্টিকের উপস্থিতি। এছাড়াও কাচের তৈরি নানা ধরনের সৌখিন জিনিসও আছে। কাচের জিনিস যে অ্যানির ভালো লাগে না, তা নয়। তবে এই মুহূর্তে এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তার নেই।

    এখন তার দরকার কড়া এক কাপ ব্ল্যাক কফি।

    কেন না আজ সকালে, তাকে আরো কিছু সময় বিছানায় চাইছিল ক্যামিল। সকালে উঠার ব্যাপারে খুব একটা সুনাম নেই অ্যানির। কিন্তু আজ কেন জানি শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল না তার। তাই ক্যামিলের বাহুডোর থেকে মুক্ত হয়ে গোসলে গেল সে। অবশ্য ক্যামিলের উষ্ণ হাতের ছোঁয়া, তখনও অনুভব করছিল। কিন্তু ঘণ্টাখানেক আগে বানানো কফি এখনো রান্নাঘরে পড়ে আছে, তা ভুলে গেল। গোসল শেষে চুল মুছতে মুছতে যখন কফির কথা মনে পড়লো, ততোক্ষণে তা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।

    নতুন করে কফি বানানোর সময়ও নেই। এখনই বের হতে হবে তার, একদম খালি পেটে

    দশটা বাজার কিছুক্ষণ পর, গ্যালারি মনিয়েরে পৌঁছালো সে। মূল দরজার কাছেই একটা টেবিলে বসলো। আশেপাশের সবগুলো টেবিল খালি । কফি মেশিন এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার। যদিও কিছুক্ষণ পর পর সে ঘড়ি দেখছে। তার যে খুব তাড়া আছে, ব্যাপারটা এমন না। ওয়েটারকে তাগাদা দেয়াই মূল উদ্দেশ্য। এদিকে ওয়েটারেরও কিছু করার নেই, কেন না কফি মেশিন এখনো চালু হয়নি। তাই অ্যানিকে কথাবার্তায় ভুলিয়ে রাখতে চাইছে সে। লোকটা লম্বা, গায়ে বাড়তি মেদ নেই। তবে কথা একটু বেশি বলে। টেবিল মোছা শেষ করে অ্যানির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।

    ওয়েটার একটু বোকা হলেও তার পছন্দ ভালো। চল্লিশে পা দিলেও অ্যানির সৌন্দর্য এক ফোঁটাও কমেনি। কালো চুল, ফ্যাকাশে সবুজ চোখ আর মায়াকাড়া হাসি…অসাধারণ শারীরিক গঠন তাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তার কমনীয় ভঙ্গির ধীর পদক্ষেপ, সুগঠিত শরীর যে কোনো পুরুষের হৃদয়ে আলোড়ন তুলতে সক্ষম।

    অ্যানির কথা মনে পড়লে নিজেকে সামলাতে বেশ কষ্ট হয় ক্যামিলের । তার সম্পর্কে কী ভাবে অ্যানি, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায়। কিছুদিন আগেই পঞ্চাশের ঘর ছুয়েছে তার বয়স, মাথায় নেই কোনো চুল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, টেনেটুনে চার ফুট এগারো হবে সে। এগারো বছর বয়সি এক বাচ্চার উচ্চতার সমান। তার চেয়ে খুব বেশি না হলেও, প্রায় ছয় ইঞ্চি বেশি উঁচু হবে অ্যানি।

    ওয়েটারের এসব কর্মকাণ্ড দেখে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিলো অ্যানি। যার সারমর্ম হলো ‘দূর হও’। দ্রুত কফি শেষ করে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিলো সে। দরজার কাছে আসতেই ব্যাগে হাত ঢোকালো। স্যাঁতসেঁতে কিছু একটা অনুভব করছে। তার আঙুলে কলমের কালি লেগেছে।

    সত্যি বলতে, ক্যামিলের গল্প এই কলম থেকেই শুরু। কিংবা এতো দোকান থাকতে অ্যানির গ্যালারি মনিয়েরে যাওয়া থেকে। অথবা অন্য কোন সকালের পরিবর্তে এই সকাল থেকে। এতোগুলো কাকতালীয় ঘটনা যে মর্মান্তিক পরিণতিটার দিকে নিয়ে যাবে, তা সহ্য করার ক্ষমতা সবার থাকে না। অবশ্য কাকতালীয় ঘটনাকে একতরফা দোষ দিয়ে লাভ নেই। কেন না, এভাবেই ক্যামিলের সাথে প্রথম দেখা হয় অ্যানির।

    আঙুলে কালির পরিমাণ দেখে আর কী কী নষ্ট হলো, তা নিয়ে চিন্তিত বোধ করে অ্যানি। পরবর্তি কর্মপন্থা নিয়ে ভাবতে শুরু করে সে। সামনে একটা কাঠের স্ট্যান্ড দেখে সেখানে ব্যাগটা ঝুলিয়ে নেয়। এরপর ভেতরের জিনিসপত্র বের করতে থাকে।

    খুব একটা সন্তুষ্ট মনে হছে না তাকে। তবে যে ভয় পেয়েছিল তা নিতান্তই অমূলক। কোনো বিষয়ে ঘাবড়ে গেছে অ্যানি, পরিচিত মানুষজনের কাছে তা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার জীবনটাই এমন। কখনোই দামি জামাকাপড় গায়ে চড়ায়নি সে। এমনকি এই মুহূর্তেও তার পরনের জামাটা বেশ সাদামাটা। নিজের গাড়ি কিংবা বাড়ি কোনোটাই নেই। যা আয় করে, তার পুরোটাই দুই হাতে খরচ করে। এক পয়সা বেশি না, কমও না। অর্থকড়ি জমানোর অভ্যাস নেই। বাবা এক দোকানের সামান্য কর্মচারি ছিল। ব্যাংক থেকে দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার আগে দোকান থেকে মূল্যবান জিনিস চুরি করে পালিয়ে যায় সে। এরপর তার টিকিটাও দেখা যায়নি। অর্থের ব্যাপারে অ্যানির এতোটা উদাসিনতার পেছনে, কিছুটা হলেও এই ঘটনা দায়ি। শেষবার এই বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হয়েছিল অনেক আগে। একমাত্র মেয়ে আগাথাকে একা মানুষ করার সময়ে। কলমটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলো সে। টিস্যু দিয়ে মোবাইলটা মুছে তা জ্যাকেটের পকেটে রাখলো। ব্যাগের ভেতরে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেছে তার। ভেতরটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। সামনের বড় শপিংমল দেখে হয়তো সে নতুন ব্যাগ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিন্তু তা আর জানা সম্ভব নয়। এরপর যা ঘটতে যাচ্ছে, তা যে কোনো পরিকল্পনা নস্যাৎ করার জন্য যথেষ্ট ।

    ওই ওয়েটারের কথা মনে পড়তেই পুনরায় মনিয়ের গ্যালারিতে যাওযার ইচ্ছা দমে গেল তার। হুট করেই একটা পাবলিক টয়লেটের দিকে তার চোখ

    পড়লো। টয়লেটের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা দেখা যাচ্ছে। তীর চিহ্ন দিয়ে দিকটাও ঠিক করা আছে। আর ওইদিকেই তার গন্তব্য।

    এরপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটতে শুরু করলো।

    টয়লেটের দিকে ত্রিশ মিটার এগুনোর সাথে সাথে দু-জন লোকের সাথে মুখোমুখি হলো সে।

    তারা দামিয়ানির রাস্তা থেকে বেরিয়ে, গ্যালারি মনিয়েরের দিকে যাচ্ছিল।

    কিছুক্ষণ পর…শুনতে কিছুটা উদ্ভট শোনালেও এটাই সত্যি : যদি আর পাঁচ সেকেন্ড পরে ঢুকতো অ্যানি! ততোক্ষণে লোক দুজন বাঁদর টুপি দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলতো। পুরো ঘটনা প্রবাহ একদম বদলে যেতো।

    তার বদলে যা ঘটলো-তাদের সামনে অ্যানি আচমকা উপস্থিত হওয়ায় সবাই যেন জায়গায় জমে গেল।

    তাদের মুখভঙ্গি, অবস্থান আর বাঁদর টুপি কোনোকিছুই অ্যানির চোখ এড়ালো না।

    তাদের হাতে থাকা শটগান দেখে ঘাবড়ে গেল অ্যানি। কেন না নিরীহ কোনো মানুষের হাতে অস্ত্র থাকলে, তার চেহারায়ও একটা অদম্য ভাব চলে আসে।

    দুজনের মাঝে বেটে লোকটার ভেতর থেকে অদ্ভুত এক গোঙানি বেরিয়ে আসছে। লোকটার দিকে চোখ ফেরালো অ্যানি : হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। পাশের লোকটা লম্বা, চেহারায় করুণ ভাব ফুটে উঠেছে। এই দৃশ্যের পাত্র-পাত্রি তিনজনই বাকরুদ্ধ। সবাই অসতর্ক অবস্থায় একে অপরকে দেখছে। স্তদ্ধতা কাটিয়ে লোক দুজন বাঁদর টুপি দিয়ে মুখ ঢাকলো। লম্বা লোকটা রাইফেল এমনভাবে উঁচিয়ে ধরলো, যেন কোনো কাঠুরে গাছ কাটার জন্য কুড়াল তুলেছে। এরপরেই রাইফেলের বাঁট অ্যানির মুখ বরাবর নেমে এলো।

    নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে আঘাত হানলো লম্বা লোকটা।

    অ্যানির চিকবোন গুঁড়ো করে দিলো সে। মুখ দিলে বেরিয়ে এলো ঘোঁত ঘোঁত শব্দ, ঠিক যেমন টেনিস খেলোয়াড় প্রথমবার সার্ভ করার সময় করে থাকে।

    হাত দিয়ে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় কিছুটা পিছিয়ে গেল অ্যানি। কিন্তু ধরার মতো কিছুই পেল না। আঘাতের ফলে তার মনে হচ্ছে,

    কেউ যেন শরীর থেকে মাথা আলাদা করে দিয়েছে। প্রায় এক মিটার দূরে গিয়ে পড়লো সে। হাত দুটো দুইদিকে ছড়ানো।

    রাইফেলের বাঁটের আঘাতে তার চোয়াল থেকে কপাল পর্যন্ত থেঁতলে গিয়েছে। চিকবোন ভেঙে প্রায় দশ সেন্টিমিটারের এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। রক্তে রঞ্জিত সারা মুখ। বাইরে থেকে শব্দটা অনেকটা পাঞ্চব্যাগে বক্সারের ঘুসির মত শোনা গেল। কিন্তু অ্যানির কাছে তা পুরোপুরি আলাদা। মনে হচ্ছে সর্বশক্তি দিয়ে কেউ বড় হাতুড়ি চালিয়েছে তার মুখে

    বেটে লোকটা চিৎকার শুরু করলো। অ্যানির কানে মৃদু শব্দ আসছে। দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে।

    লম্বা লোকটা ধীরস্থিরভাবে সামনে এগিয়ে, অ্যানির মাথা বরাবর তাক করলো রাইফেল। এই দৃশ্য দেখে পাশের জনের চিৎকারের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। চোখ খুলতেও ভয় পাচ্ছে অ্যানি। শুধু হাত দিকে লোকটাকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলো সে।

    হুট করেই রাইফেল হাতে থাকা লোকটা থেমে গেল। গোলাগুলির শব্দ মানেই পুলিশ চলে আসবে আর পিছু লাগবে। পরবর্তি কর্মপন্থা ঠিক করতে কিছুটা সময় নিলো সে। উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে অ্যানির দিকে ঘুরলো। তার মুখ আর পেট বরাবর একের পর এক লাথি চালাতে লাগলো। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেও খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না সে। তার পেছনে একটা বন্ধ দরজা আর সামনে যম। ফাঁদে পড়ে গেছে। কোনোমতে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

    হুট করেই লোকটা থেমে গেল। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, আশানরূপ ফল পাচ্ছে না। তাই নিষ্ঠুরতার মাত্রা আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিলো সে। রাইফেলের বাঁট দিয়ে যত জোড়ে সম্ভব মারতে শুরু করলো এবার। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, শক্ত মাটিতে লম্বা খুঁটি পোতার পণ করে নেমেছে। নিজেকে রক্ষার চেষ্টায় মোচড় দিয়ে, নিজের রক্তের সাগরেই পিছলে গেল অ্যানি। দুই হাত দিয়ে ঘাড় আঁকড়ে ধরলো।

    প্রথম আঘাত তার মাথার পেছনে লাগে, পরেরটা তার হাতের আঙুলগুলো ভেঙে দেয়।

    সঙ্গির এমন কৌশল খুব একটা ভালো ঠেকলো না বেটে লোকটার কাছে, তাই সামনে এগিয়ে, নিজের সহচরকে বাঁধা দেয় সে। তাতে লম্বা লোকটার পরিকল্পনায় কোনো পরিবর্তন আসে না। আগের কাজে ফিরে যায় সে। ভারি মিলিটারি বুট দিয়ে অ্যানির মাথায় লাথি চালাতে থাকে। গোল হয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টায় ব্যর্থ হয় অ্যানি। তার শরীরের প্রায় পুরোটা জুড়ে লাথির ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

    ঠিক এমন সময়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে অ্যানি।

    সাময়িক আপদ মিটে যাওয়ায় দুজনের মুখে প্রশান্তির ছাপ দেখা গেল। কিন্তু অ্যানির নিথর শরীর তাদের বের হওয়ার পথ আটকে আছে। সময় নষ্ট না করে, হাত ধরে টেনে অ্যানিকে পেছনে নিয়ে এলো দুজন। টানাটানির সময় মাথায় বেশ কয়েকবার আঘাত পেল অ্যানি। তার ভাঙা হাত উদ্ভট ভঙ্গিতে মেঝেতে পড়ে রইলো। দেখে মনে হচ্ছে, মেঝেতে কেউ ম্যাডোনার ছবি এঁকে রেখেছে। যদি ক্যামিল দৃশ্যটা দেখতে পেতো তাহলে হয়তো ফারনান্ড পেলেজের আঁকা ‘দ্য ভিক্টিম’-এর সাথে অদ্ভুত সাদৃশ্য চোখে পড়তো তার।

    ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো। দুর্ভাগ্যের তো আর কিছু বাকি ছিল না কিন্তু লম্বা লোকটার মনে অন্য কিছু চলছে।

    এরপর মেয়েটার কী হবে? যদি জ্ঞান ফিরে পেয়ে চিৎকার শুরু করে? যদি দৌড়ে গ্যালারিতে চলে যায়? অথবা ইমারজেন্সি এক্সিট দিয়ে বেরিয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করে কিংবা টয়লেটে গিয়ে পুলিশকে ফোন করে?

    দরজার ফাঁকে পা দিয়ে তা আটকে যাওয়া থামালো লম্বা লোকটা । এরপর একটু ঝুঁকে, অ্যানির ডান গোড়ালি ধরে এমনভাবে টেনে টয়লেট থেকে বের করলো, যেন একটা বাচ্চা ছেলে তার খেলনা নিয়ে যাচ্ছে।

    অ্যানির সারা শরীর জুড়ে ক্ষত আর কালশিটে দাগ। টয়লেটের দরজায় বাড়ি খেলো তার ঘাড়। করিডোরের দেয়ালে আঘাত পেল কোমর। মাথাটা একদিকে বেকায়দাভাবে ঝুলে আছে। গ্যালারির বিভিন্ন জিনিসের সাথে একটু পর পরই বাড়ি খাচ্ছে শরীরের বিভিন্ন অংশ। একটা শতচ্ছিন্ন কাপড়ের টুকরায় পরিণত হয়েছে সে, যেন প্রাণহীন একটা পুতুল চলার পথে রক্তলাল চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। রক্ত যেমন দ্রুত জমাট বাঁধে তেমনি শুকিয়েও যায়।

    লম্বা লোকটার মনে হলো, মারা গেছে অ্যানি। তাই দ্বিতীয়বার না ভেবে পা ছেড়ে দিলো সে। এই মেয়ে আর কোনো কাজেই আসবে না তার। তাই পাম্প অ্যাকশন শটগান লোড করে নিলো। লোক দুইজন উঁচু গলায় কিছু বলতে বলতে দে ফসে জুয়েলার্সে ঢুকলো। দোকানটা কেবলই খুলেছে। দোকানে কর্মী বলতে দুইজন মহিলা ছাড়া কেউ নেই। অবশ্য এমন পরিস্থিতি দেখে তারা ভয়ে আধমরা। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে তাদের পেটে আর মুখে এলোপাথাড়ি ঘুসি শুরু হলো। চিৎকার, গোঙানি, চাপা কান্না আর কাচ ভাঙার শব্দে মুখরিত হলো গ্যালারি মনিয়ের।

    হয়তো মেঝেতে টেনে আনার ফলে কিংবা মাথার বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি খাওয়ার কারণে, কিছু সময়ের জন্য চেতনা ফিরে পেল অ্যানি। কিন্তু আশেপাশে কী ঘটছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।

    তার মস্তিষ্ক যেন ধুম্রজাল বুনছে। আশেপাশে কী হচ্ছে তা বোঝার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো সে। কিন্তু সবই বৃথা। মাথায় আঘাতের রেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। উপর্যুপরি আঘাতে সব অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে। পুরো শরীর জুড়ে অসহ্য ব্যথার কারণে একটুও নড়তে পারলো না।

    দোকানে মালিকের সাথে এক শিক্ষানবিস সহকারী মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। ষোড়শী মেয়েটা পাটকাঠির মত শুকনো, খোঁপা করে বাঁধা চুল কালো কাপড়ে ঢাকা মুখ আর অস্ত্র হাতে লোকগুলোকে দেখে ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেল। এদের হাতে সে জিম্মি, তা ভাবতেই তার হাত পা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। গোল্ডফিশের মত করে মুখটা একবার খুলছে আর বন্ধ করছে সে। মাথাটা কেমন ঘুরছে তার। কাউন্টারের এক কোণায় হাত রেখে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করলো। মেঝেতে পড়ে যাওয়ার আগে তার মুখে আঘাত হানলো শটগানের ব্যারেল। পরবর্তী বেশ কিছু সময় সে এভাবেই পড়ে থাকবে। হাত দিয়ে মাথাটা এমনভাবে ঢেকে রাখলো, যেন কিছুক্ষণ পরে পাথরের বৃষ্টি নামবে।

    মেঝেতে অ্যানির নিথর দেহটা পড়ে আছে। স্কার্টটা কোমরের সাথে লেপ্টে আছে তার, পা জুড়ে রক্তলাল ক্ষত। অ্যানির এই অবস্থা দেখে বেরিয়ে আসা চিৎকার কোনোমতে এক চাপা গোঙানিতে পরিণত করলো দোকানের মালিক। কিছু বলার চেষ্টা করলেও তা আর মুখ দিয়ে বের হলো না। লম্বা লোকটা দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আর খাটো লোকটা শটগানের ব্যারেল তাক করে এগিয়ে আসছে তার দিকে। কাছে এসেই তার পেট বরাবর আচমকা গুঁতো দিলো খাটো লোকটা। কোনোমতে বমি আটকাতে সক্ষম হলো দোকানের মালিক। খাটো লোকটার মুখ ফুটে কিছুই বলতে হলো না। আসলে এরপরে কিছু বলতেও হয়নি, দোকান মালিক ইতোমধ্যে রোবটের মত কাজ শুরু করে দিয়েছে। প্রথমেই অপটু হাতে অ্যালার্ম বন্ধ করে দিলো। চাবি খুঁজতে যেয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে সে। তখনি তার মনে পড়লো, চাবি পেছনের রুমে রাখা। এই ভেবে যেই না এক কদম এগুলো, সাথে সাথে অনুভব করলো তার নিচের অংশ ভিজে গেছে। কাঁপাকাঁপা হাতে চাবির গোছা নিয়ে ফিরলো সে। যদিও পরবর্তীতে সাক্ষী হিসেবে দেয়া বিবৃতিতে এই কথা চেপে যাবে। এই মুহূর্তে জিম্মি করা লোকটাকে সে শুধু বলছে, ‘দয়া করে আমাকে মারবেন না…’ তার এখন এমন অবস্থা যে, জীবনের ঘড়িতে মাত্র বিশ সেকেন্ড যোগ করার বিনিময়ে পুরো পৃথিবী বিকিয়ে দিতেও দ্বিতীয়বার ভাববে না। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে হাত দিয়ে মাথা ঢেকে মেঝেতে শুয়ে পড়লো সে, এরইসাথে শুরু হয় নিচু গলার প্রার্থনা।

    লোক দুজনের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে প্রার্থনা কোনো কাজে আসবে না। দোকানের মালিক প্রার্থনায় মগ্ন থাকার সময় বেশিরভাগ জিনিসপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেছে তারা।

    ডাকাতির পরিকল্পনা সুচারুভাবে করা হয়েছিল। চার মিনিটেরও কম সময়ে পুরো কাজ সম্পন্ন করাটা তারই প্রমাণ। দোকানে একদম সঠিক সময়েই ঢুকেছে তারা। এরপর একজন দরজায় পাহারা দিয়েছে, আরেকজন ক্যাবিনেট ওলটপালটের কাজে মত্ত ছিল। দোকানের ভেতরের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাবে ড্রয়ার, ক্যাবিনেট ঘেটে মূল্যবান যা পাচ্ছে তাই ব্যাগে তুলে নিচ্ছে একজন। আর বাইরের ক্যামেরায় দরজার একাংশ দৃশ্যমান। অ্যানির নিথর দেহও এই ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।

    এতো সতর্কতার সাথে তৈরি পরিকল্পনা-ঠিক এই সময় থেকেই ভজঘট পাকিয়ে যায়। ক্যামেরার ফুটেজে অ্যানির শরীর একটু নড়তে দেখা যায়, যদিও তা খুব সামান্য। প্রথম দেখায় নিজের চোখকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো না ক্যামিল। আরেকবার খেয়াল করতেই, সব সন্দেহ দূর হয়ে গেল তার। ধীরে ধীরে মাথাটা ডান থেকে বামদিকে ঘোরালো অ্যানি। এই ভঙ্গিমার সাথে ক্যামিল সুপরিচিত। বিশ্রামের সময় চেয়ারে গা এলিয়ে দিতো মেয়েটি, ঘাড় ধনুর মত বাঁকা করে ভার্টিব্রা এবং ‘স্টার্নোক্যাডোমাস্টয়েড পেশি বরাবর সঞ্চালিত করতো। এই পেশির ব্যাপারে অবশ্য জানা ছিল না ক্যামিলের। যদিও ভিডিওতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এখন আর সেই অবস্থা নেই অ্যানির। একদিকে কাত হয়ে পরে আছে সে। ডান পা উপরের দিকে বেকায়দায় উঠে আছে, হাঁটু প্রায় বুক স্পর্শ করেছে তার। বাম পা একদিকে ছড়ানো। স্কার্ট উপরে উঠে থাকার কারণে সাদা পেন্টিও দেখা যাচ্ছে। মুখ থেকে রক্তের ধারা নেমে গেছে নিচে।

    দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, বেধড়ক মারার পর কেউ ছুড়ে ফেলেছে তাকে।

    ডাকাতি শুরু হওয়ার পর দরজায় পাহারারত লোকটা বেশ কয়েকবার অ্যানির দিকে তাকালো। কোনো নড়াচড়া না দেখে সে অন্যদিকে মনোযোগ দিলো। তার জুতোর নিচে রক্তের ধারা গড়িয়ে আসছে, সেদিকেও খেয়াল করলো না সে।

    দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে, চারপাশে কী ঘটছে তা বোঝার চেষ্টা করলো অ্যানি। সি.সি ক্যামেরায় তার মুখটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে যন্ত্রণার ছাপ সুস্পষ্ট।

    ক্যামেরার ফুটেজে এই দৃশ্য দেখে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল ক্যামিল। হাত দুটো যেন অসাড় হয়ে গেছে তার। রিমোটের বাটন চাপতেও ভুলে গেছে সে। দুইবারের চেষ্টার ভিডিও থামাতে সফল হলো। কিন্তু এই অ্যানিকে চিনতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। সবসময় ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি আর চোখের সেই মায়াবী দ্যুতি-কিছুই নেই। রক্তমাখা মুখটা কেমন যেন বিকৃত হয়ে গেছে। চোখজুড়ে অসীম শূন্যতা।

    টেবিলে হাত রেখে কোনোমতে ভারসাম্য রক্ষা করলো ক্যামিল। লেন্স বরাবর সরাসরি তাকিয়ে আছে অ্যানি। মনে হচ্ছে ক্যামিলের দিকেই তাকিয়ে আছে। অ্যানির চোখদুটো কিছু বলতে চাইছে তাকে, তার কাছে সাহায্যের আকুতি জানাচ্ছে। গলায় কেমন যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে তার। কান্না আটকে রাখতে পারছে না সে।

    একবার আপনার ভালোবাসার মানুষের কথা ভাবুন, যাকে আপনি যে কোনো বিপদে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যখন চোখের সামনে কষ্ট পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখবেন তাকে, কিন্তু কিছুই করতে পারবেন না-ঠিক এমন মুহূর্তে প্রিয় মানুষটা চিৎকার করে সাহায্যের জন্য ডাকছে আপনাকে! তখন হয়তো ভাববেন, এই দৃশ্য দেখার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো ছিল। ।

    মনিটরের দিকে তাকিয়ে ঠিক এমন অনুভূতিই হচ্ছে ক্যামিলের। প্রিয় মানুষটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তেই কাছে থাকতে পারেনি সে। তীব্র অসহায়ত্ববোধ ঘিরে ধরলো তাকে। এখন আর কিছুই করার নেই। সবকিছু শেষ …

    এটা মেনে নেয়া যায় না। কোনোভাবেই যায় না।

    এই ফুটেজ আরো বেশ কয়েকবার দেখলো সে।

    অ্যানির ব্যবহারে মনে হচ্ছে, তার চারপাশে কিছুই নেই। যদি শটগানের ব্যারেল তার কপাল বরাবর তাক করে দাঁড়াতো লম্বা লোকটা, তাহলেও হয়তো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতো না সে। সকল পথ বন্ধ হয়ে গেলেও, বেঁচে থাকার জন্য মানুষ শেষ অবধি চেষ্টা করে যায়। কিন্তু মনিটরে এখন যা দেখা যাচ্ছে, তা যেন আত্মহত্যারই নামান্তর : দুই মিটারের কম দূরত্বে শটগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা লোকটা। কিছুক্ষণ আগেই পুরোপুরি বুঝিয়ে দিয়েছে, অ্যানির কপালে ফুটো করতে দ্বিতীয়বার ভাববে না সে। এমন সময়ে অ্যানি যা করতে যাচ্ছে, তার জায়গায় অন্য কেউ হলে স্বপ্নেও এমনটা করার সাহস পেতো না। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো সে। এর পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, ব্যাপারটা একবারও মাথায় আসলো না তার। এখান থেকে পালাতে চাইছে সে। তার সাহসের প্রশংসা করতে হয়। কিন্তু শটগান হাতে থাকা লোকের মুখোমুখি হতে সাহসের চেয়ে আরো বেশি কিছু প্রয়োজন।

    এরপর যা হওয়ার কথা, ঠিক তাই হবে। দুই বিপরীত শক্তি একে অপরের বিরুদ্ধে লড়বে। শেষপর্যন্ত টিকে থাকবে একজনই। এখানেও তাই ঘটবে। তবে, দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মাঝে শক্তির তারতম্য অনেক বেশি। একদিকে শটগান হাতে দাঁড়ানো একজন, যা শুরু থেকেই এগিয়ে রাখছে তাকে। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, শরীরের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে অ্যানি। হাতে ভর দিয়ে একটু উঠতে পারলেও, তা খুব অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। আবার চেষ্টা করে সে। দেখে মনে হচ্ছে, পুরো ঘটনা যেন স্লো মোশনে চলছে। শরীর যে ইতোমধ্যে বিদ্রোহ শুরু করেছে, অ্যানির মুখ ভঙ্গি দেখে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বুক ভরে অক্সিজেন নেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে সে। একটু অক্সিজেনের জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে তার। এমন অবস্থায়, আপনিও চাইবেন তার দিকে সাহায্যেও হাত বাড়িয়ে দিতে।

    ক্যামিল যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে, একটুও নড়বে না অ্যানি। প্রায় এক মিনিট পর, ঘুরে দাড়ালো পাহারাদার লোকটা। নড়াচড়ার ব্যাপারটা তার নজর এড়ায়নি। এদিকে অ্যানির অবস্থা এতোটাই খারাপ যে তিন মিটারও যেতে পারলো না, এরইমাঝে গুলির শব্দে কেঁপে উঠলো সে।

    কয়েক ঘন্টা পার হয়ে গেছে। এখনো মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে ক্যামিল। এখন যে পরিকল্পনাই করুক, কোনো লাভ নেই। দেরি হয়ে গেছে। অনেক দেরি হয়ে গেছে!

    স্বাভাবিক চিন্তাধারা আর কাজ করছে না অ্যানির। বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই সবকিছু করছে। কোনো যুক্তির ধার ধারছে না সে। ভিডিওতে তা খুব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে থাকা শটগানে মোটেও ভীত মনে হচ্ছে না তাকে। বরং মনে হচ্ছে, নেশায় আচ্ছন্ন এক নারী, এখনই মেঝে থেকে তার হ্যান্ডব্যাগ তুলে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। যেন শটগান নয়. ঘোর লাগা অবস্থাটাই তার ফিরে যাওয়ার পথে একমাত্র বাঁধা।

    পরবর্তি ঘটনাপ্রবাহ খুব দ্রুতই সম্পন্ন হয়। অসহনীয় ব্যথা স্বত্ত্বেও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো অ্যানি। কোনোমতে দাঁড়াতে সফল হলো সে। স্কার্টটা এখনো কোমরের দিকে উঠে আছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দৌড়ানো শুরু করলো সে।

    ঠিক এই মুহূর্ত থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরবর্তি ঘটনাগুলো কিছু ভুল আর দুর্ঘটনার সমষ্টি বৈ কিছু না। এমন নাটকীয় ঘটনা প্রবাহে, স্বয়ং ঈশ্বরও যেন বিচলিত হয়ে বাকি অংশ পাত্র-পাত্রীর হাতেই ছেড়ে দেন। আর অদক্ষ হাতেই তার ঘটনার করুণ সমাপ্তি ঘটে।

    নিজের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই অ্যানির। ভারসাম্য রক্ষা করতেও বেগ পেতে হচ্ছে তার। পালানোর সময় কোনো কিছু না ভাবেই দৌড় দিয়েছিল সে। সত্যি বলতে, এখন ভুল পথে এগুচ্ছে সে। যদি হাতটা সামনের দিকে বাড়ায়, তাহলে তা লম্বা লোকটার কাঁধ ছুয়ে যাবে। আর যদি লোকটা ঘুরে দাঁড়ায় তাহলে…

    কী করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। দ্বিধান্বিত অবস্থায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সে। এখনো যে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটাই বিস্ময়কর ব্যাপার। জামার একাংশ দিয়ে রক্তমাখা মুখটা মুছে নিলো। তার ঘাড় কাত করা দেখে মনে হচ্ছে, কিছু শোনার চেষ্টা করছে। আর এক কদম ফেলতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না…হুট করেই দৌড়ানোর চেষ্টা করলো অ্যানি। এই অংশ দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতো পারলো না ক্যামিল। তার সাহসের শেষ স্তম্ভটাও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।

    প্রবৃত্তির বশে অ্যানি যা করেছে, তাত্ত্বিকভাবে কোনো ভুল নেই তাতে। কিন্তু বাস্তবতা বরাবরই ভিন্ন কথা বলে। রক্তের পুকুরে বারবার পিছলে যাচ্ছে সে। দেখে মনে হচ্ছে স্কেটিং করছে। কার্টুনে এইসব দেখতে মন্দ লাগে না কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, এই মুহূর্তে নিজের রক্তে পিছলে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে সে। দৌড়ানোর সার্বিক চেষ্টা চালালেও কোনো লাভ হলো না। বেশ কয়েকবার বেকায়দাভাবে পড়ার ফলে ব্যথার তীব্রতা আরো বেড়ে গেছে তার। দেখে মনে হচ্ছে স্লো মোশনে দৌড়াচ্ছে সে। হৃদয়বিদারক এক দৃশ্য।

    আশেপাশে কী ঘটছে, তা বুঝে উঠতে কিছু সময় লাগলো লম্বা লোকটার। লোকটার ওপর প্রায় পড়ে যাবার উপক্রম হলো অ্যানির, এমন সময়ে মেঝের দেখা পেল সে। ভারসাম্য ফিরে পেতেই, আবার একদিকে কাত হয়ে গেল, যেন কোনো স্প্রিংয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে সে।

    এই কাত হওয়াটাই, তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো, কারণ তা ছিল ভুল দিকে।

    শিকার পালানোর চেষ্টা করছে, তা বুঝে উঠতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো লম্বা লোকটার। বুঝতে পারার সাথে সাথে গুলি চালালো সে।

    এই অংশটুকু বারবার টেনে দেখলো ক্যামিল। একটা বিষয় নিশ্চিত, খুনি কিছুটা বিষ্মিত। শটগানটা নিতম্বের কাছাকাছি ধরে আছে সে। সাধারণত বন্দুকধারী যখন আশেপাশের চার কিংবা পাঁচ মিটার ব্যাসার্ধের কোনো কিছুতে আঘাত হানতে চায়, তখন তা নিতম্বের কাছাকাছি রাখে। হয়তো চিন্তা করার সময়ই পায়নি, কিংবা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল। এটা অবশ্য অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটে। নিতান্ত সাধারণ একজন মানুষের হাতে একটা শটগান দিয়ে যদি তা যথেচ্ছ ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে নিজেকে ওস্তাদ ভাবতে শুরু করে দেয় সেই লোক। হয়তো সবকিছু মিলেই এমনটা ঘটেছে।

    কিন্তু অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছে ক্যামিল। ব্যারেলটা উঁচুতে ছিল, বেশ উঁচুতে। গুলিটা হয়তো প্রতিক্রিয়ার বশবর্তী হয়েই চালিয়েছে লোকটা লক্ষ্য স্থির করার কোনো প্রয়োজনীয়তাই বোধ করেনি সে।

    চোখে কিছুই দেখছে না অ্যানি। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে চলার পথেই, টুকরো কাচের বৃষ্টি নেমে আসে তার উপর। এই শব্দে তার কানে তালা লেগে যায়। সবকিছুর মূলে ওই বুলেট, যা উপরে থাকা কাচের এক প্রতিকৃতিতে গিয়ে লেগেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিষ্ঠুর শোনালেও, ওই কাচের প্রতিকৃতিতেও শিকারের দৃশ্য খোদাই করা। ঘেউ ঘেউ করতে থাকা একদল হাউন্ড একটা হরিণকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে সুদর্শন দুই অশ্বারোহী। হাউন্ডগুলোর জিভ দিয়ে লালা ঝরছে, বিকট দাঁতগুলোও বের হয়ে এসেছে। শিকার ইতোমধ্যে হাল ছেড়ে দিয়েছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, গ্যালারি মনিয়েরের এই প্রতিকৃতিটা দুটো বিশ্বযুদ্ধেও বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। শেষমেশ, তা মামুলি এক ডাকাতের গুলিতে ধ্বংস হলো…কিছু জিনিস মেনে নেয়া সত্যিই কষ্টকর।

    পুরো গ্যালারি কেঁপে উঠলো। জানালা, মেঝে, আসবাব…যে যেভাবে পারলো নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করলো।

    “আমি দলা পাকিয়ে শুয়ে ছিলাম,” পরবর্তিতে অঙ্গভঙ্গি নকল করে, ক্যামিলকে জানাবে একজন অ্যান্টিক ডিলার।

    লোকটার বয়স চৌত্রিশ বছর। তার উদ্ধত গোঁফ যেন শেষপ্রান্তে গিয়ে বিলীন হয়ে গেছে। বড় নাকের নিচে এমন গোঁফ কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে। ডান চোখটা প্রায় বন্ধ হয়ে আছে তার। দেখতে অনেকটা জত্তোর আঁকা ছবি, ‘আইডোল্যাট্রি’তে হেলমেট পরিহিত লোকটার মত লাগছে। গুলির শব্দের রেশ এখনো কাটেনি তার। এই ঘটনায় বেশ হতবিহ্বল মনে হলো তাকে।

    “দেখুন, প্রথমে আমার মনে হলো কোনো সন্ত্রাসী আক্রমণ। পরক্ষণেই মাথায় এলো, না এটা হতেই পারেই না। গ্যালারিতে, সন্ত্রাসীরা কেন আক্রমণ করবে? সেরকম কিছু তো নেই এখানে। তাছাড়া…”

    যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করে এই ধরনের লোক। কোন কাজটা আগে করা দরকার, তা নির্ধারণ করতে কোনো ভুল হয় না এদের। ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগে, নিজে ঠিক আছে কি না তা ভালোমতো দেখে নেয় একবার।

    “অবশ্য তেমন কোনো আঘাত লাগেনি আমার!” এই বলে নখ দিয়ে সামনের দাঁত ঘষতে শুরু করলো সে।

    গ্যালারিটার প্রস্থের চেয়ে উচ্চতা বেশি। প্রায় পঞ্চাশ মিটার জুড়ে সারিবদ্ধভাবে স্থাপিত অনেকগুলো দোকান। এরকম আবদ্ধ জায়গায় বিস্ফোরণের মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশিই অনুভূত হয়।

    গুলির শব্দ আর কাচের টুকরো অ্যানিকে থামিয়ে দিলো। হাত উঁচু করে মাথা ঢেকে থুতনি বুকের কাছাকাছি নিয়ে আসলো সে। কাঁপতে থাকা শরীরের কাছে আরেকবার হার মানতে হলো তার। পা পিছলে পড়ে গেল সে। কিন্তু একটা গুলি আর কাচের টুকরো, অ্যানির মত কাউকে থামানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আবার উঠে দাঁড়ালো সে।

    লম্বা লোকটা প্রথমবার লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হলেও, আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে সে। এবার, সময় নিয়ে লক্ষ্য স্থির করলো। সিসিটিভি ফুটেজে, শটগান লোড করে ব্যারেলের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল তাকে। ভিডিওর রেজুলেশন আরেকটু ভালো হলে ট্রিগারে শক্ত করে চেপে বসা তার আঙুলও বোঝা যেতো।

    হুট করে কালো দস্তানা পরিহিত একটা হাত দেখা গেল। গুলি করার ঠিক আগে, তাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো খাটো লোকটা।

    কাছে থাকা বইয়ের দোকানের জানালা যেন বিস্ফোরিত হলো। ডিনার প্লেটের সমান আর ব্লেডের মত ধারালো কাচের টুকরো ছড়িয়ে পড়লো টাইলসের মেঝেতে।

    “বইয়ের দোকানের পেছনে ছোট একটা অফিসে ছিলাম আমি…”

    পেশায় ব্যবসায়ী মহিলার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। আকৃতিতে একটু খাটো, গোলগাল মুখে মেকআপের কোনো কমতি নেই। সপ্তাহে দুইবার বিউটিশিয়ানের সাথে দেখা করতে হয় তার, মুখ দেখে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ব্রেসলেট, নেকলেস, চেইন, ব্রোচ, কোনো কিছুই পরতে বাকি রাখেনি (ডাকাতির সময় এই জিনিসগুলো যে যায়নি, সেটাই অবাক করার বিষয়)। সিগারেট আর মদের সাথে তার যে গলায় গলায় ভাব, তা বুঝতে আর বাকি রইলো না ক্যামিলের। ডাকাতির পর বেশ কয়েক ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে। অধৈর্য হয়ে উঠছে ক্যামিল। সবকিছু জানতে হবে তার।

    “আমি দৌড়ে বেরিয়ে এলাম…” দোকানের বাইরের দিকে আঙুল তাক করলো ব্যবসায়ী মহিলা। এই বলে একটু বিরতি নিলো সে। আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ায় বেশ খুশি মনে হচ্ছে তাকে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইছে সে। কিন্তু ক্যামিল ভেরহোভেন যেখানে উপস্থিত, সেখানে তা সম্ভব নয়।

    “তাড়াতাড়ি কথা শেষ করুন,” চিৎকার করে বলল ক্যামিল।

    এমন ব্যবহার একজন পুলিশ অফিসারের শোভা পায় না, মনে মনে বলল ব্যবসায়ী মহিলা। তার মনে হলো, লোকটার উচ্চতাই এর জন্য দায়ি। এটা এমন এক ব্যাপার, যা আপনাকে কর্কশ আর রিবক্তিকর করে তোলে। মনে মনে এইসব ভাবলো সে। গুলি চলার পরপর উঠে দাঁড়ানোর জন্য অ্যানির নিরন্তর চেষ্টার ছবি এখনো তার চোখে ভাসছে।

    “জানালায় গিয়ে ধাক্কা খায় মেয়েটা। মেঝেতে পড়তে না পড়তেই, আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো! (মহিলার কণ্ঠে বিস্ময়ে ছাপ স্পষ্ট।) শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল ওর। আর, এদিক ওদিক হাত পা ছুঁড়ছিল। বারবার পিছলে যাওয়ার কারণে দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছিল মেয়েটার। আমি আসলে বলে বোঝাতে পারছি না…”

    সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, লোক দু-জন কিছু সময়ের জন্য নড়াচড়া একদম বন্ধ করে দিয়েছে। খাটো লোকটা মেঝেতে ব্যাগগুলো নামিয়ে রাখলো। এরপর, তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো, এখনই মারামারি শুরু করবে সঙ্গীর সাথে। কালো কাপড়ে ঢাকা মুখের ঠোঁট দেখে বোঝা যাচ্ছে, সঙ্গীর উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলছে সে।

    লম্বা লোকটা শটগান নামিয়ে রাখলো। কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না সে। অ্যানি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে আর টলতে টলতে বাইরের দিকে এগুচ্ছে। সেদিকেই তাকিয়ে আছে লম্বা লোকটা। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। সতর্ক সংকেত বেজে উঠলো তার মাথায়। ইতোমধ্যেই, পরিকল্পনার চেয়েও বেশি সময় পার হয়ে গিয়েছে।

    সিদ্ধান্ত নেয়া শেষ। খাটো লোকটা ব্যাগগুলো নিজের কাঁধে তুলে, অবশিষ্ট একটা সঙ্গীর দিকে ছুঁড়ে দেয়। এরপরেই পালিয়ে যায় দু-জন। মনিটরেও আর দেখা যায় না তাদের। কয়েক সেকেন্ড পর লম্বা লোকটা ফিরে আসে। পালানোর সময় যে হ্যান্ডব্যাগটা ফেলে গিয়েছিল অ্যানি, তা তুলে নেয় সে। আবার মনিটর থেকে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। লোক দু-জন টয়লেটের পাশ দিয়ে বের হয়ে মূল রাস্তায় ওঠে। যেখানে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল আরেকজন।

    ***

    অ্যানি কোথায় আছে তা নিজেও বুঝতে পারছে না। একবার মেঝেতে পড়ে, আবার উঠে দাঁড়ায়। শেষমেশ নরক থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসতে সক্ষম হলো সে।

    “পুরো শরীরে রক্ত নিয়ে হাঁটছিল সে। দেখতে একদম জোম্বির মত লাগছিল তাকে…” বিশ বছর বয়সি দক্ষিণ আমেরিকান মেয়ে এমনটাই জানালো। তার কালো চুল আর তামাটে বর্ণ বিশেষভাবে নজর কাড়ে। পাশেই একটা সেলুনে কাজ করে সে। তখন কফির জন্য বাইরে এসেছিল।

    “আমাদের কফি মেশিনটা নষ্ট। তাই কফির দরকার হলে বাইরে থেকেই আনতে হয়,” কারন ব্যাখ্যা করলো সেলুনের ম্যানেজার জ্যানিন গুনট। সরাসরি ক্যামিলের দিকে তাকিয়ে আছে সে। দেখতে অনেকটা পাড়ার সর্দারনীর মত লাগছে তাকে। মনে হচ্ছে একই রকম দায়িত্ববোধ সম্পন্নও সে; রাস্তায় দাঁড়ানো লোকের সাথে তার কোনো মেয়ে কথা বলার সময়, চোখ কান খোলা রাখছে সে। নষ্ট কফি মেশিনের কারণে মেয়েটা বাইরে গিয়েছিল। তাতে কিছু যায় আসে না ক্যামিলের। তবুও বিষয়টা মাথায় রাখলো সে।

    ট্রে’তে করে পাঁচ কাপ কফি নিয়ে আসছিল মেয়েটা। গ্যালারি মনিয়েরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গুলির শব্দে কিছুটা অবাক হয় সে। একইসাথে ভয় পেয়ে জোরে হাঁটতে শুরু করে। এমন সময়ে গ্যালারির দিক থেকে ছুটে আসা রক্ত মাখা এক অবয়বের সাথে ধাক্কা লাগে তার। সাথে সাথেই হাতে থাকা ট্রে, কফির কাপ, পিরিচ, পানির বোতল শূন্যে ভাসে। আর, মেয়েটার গায়ে থাকা সেলুনের নির্ধারিত পোশাকে কফির দাগ লেগে যায়। গুলির শব্দ, কফি আনতে দেরি হওয়া, সবকিছু না হয় সামাল দিতে পারবে সে। কিন্তু সেলুনের পোশাক অনেক দামি।

    একটু উঁচু কণ্ঠেই কথাগুলো বলল ম্যানেজার। নিজের ক্ষতির পরিমাণ বোঝাতে চাইছে ক্যামিলকে। “সমস্যা নেই। ব্যাপারটা আমি দেখবো,” জানিয়ে দিলো ক্যামিল। এরপরেও ম্যানেজার জানতে চাইলো, পরিস্কার করার খরচ কে দেবে, এর ভর্তুকি সরকারের বহন করা উচিত। “বললাম তো আমি দেখবো,” রেগে গিয়ে বলল ক্যামিল।

    “এতোকিছুর পরেও থামেনি মেয়েটা,” জোর দিয়ে বলল ম্যানেজার, যেন কোনো মোটরসাইকেল সাথে সংঘর্ষ হয়েছিল।

    এরপর সে এমনভাবে বলা শুরু করলো, যেন তার সাথেই ঘটনাটা ঘটেছে। ভাবখানা এমন, যেন এখানে কথা বলাটা তার মৌলিক অধিকার। শক্ত করে তার হাত ধরলো ক্যামিল। ক্যামিলের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। দেখে মনে হচ্ছে, সামনে পড়ে থাকা কুকুরের গু পর্যবেক্ষণ করছে।

    “ম্যাডাম, আমার সাথে ঢঙের প্যাচাল পারবেন না,” রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে ক্যামিল।

    নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না ম্যানেজার। বামনটা এভাবে কথা বলছে তার সাথে! ভেরহোভেন তাকিয়ে আছে তার দিকে। হুট করেই, অস্বস্তিকর নিরবতা নেমে এলো দুজনের মাঝে। এদিকে, প্রত্যক্ষদর্শী মেয়েটা নিজের চাকরি নিয়ে উদ্বিগ্ন।

    “সে গোঙাচ্ছিল…” ক্যামিলের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বলল মেয়েটা

    কথাটা শোনার সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়ালো ক্যামিল। “কী বলতে চাইছো? গোঙাচ্ছিল মানে?” জানতে চাইলো সে।

    “থেমে থেমে কাঁদছিলেন উনি, যেন কাঁদতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। অনেকটা…আমি আসলে বুঝতে পারছি না কীভাবে বোঝাবো আপনাকে।”

    “চেষ্টা করো,” বলল ম্যানেজার। পুলিশের সামনে নিজের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে চাইছে সে। কেউই জানে না, কখন কী কাজে লেগে যায়। “কী হলো, চেষ্টা করো। ভদ্রলোককে বলো ভালোমতো কীভাবে কাঁদছিল। জোর দিয়ে বলল সে।

    মেয়েটা তাকিয়ে রইলো, চোখের পাতা কাঁপছে তার। বুঝতে পারছে না, কী করতে বলা হয়েছে তাকে। তাই কান্নার বর্ণনা বাদ দিয়ে তা নকল করে দেখানোর চেষ্টা করলো সে। গোঙানি আর চাপা কান্নার শব্দ করলো বেশ কয়েকবার। এতে করে তার মুখ একেকবার একেক রকম আকৃতি পাচ্ছে। শেষমেশ চোখ বন্ধ করে যে শব্দ করলো, তাতে মনে হলো কিছুক্ষনের মাঝেই স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করবে সে।

    রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তারা তিনজন। পরিচ্ছন্নতাকর্মি তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে অতি উৎসাহী লোকজনও জড়ো হয়ে গিয়েছে। রক্তের সরু ধারা এখনো নর্দমার দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্রাকৃতির এক পুলিশ অফিসার, কারো নজর এড়াচ্ছে না। তার বিপরীতে দাঁড়ানো এক তরুণী; চেহারায় হলদেটে ভাব, মুখ দিয়ে অশ্লীল শব্দ করছে। অবশ্য, অন্য পাশে দাঁড়ানো সর্দারনিকে এমন অশ্লীল শব্দে বেশ খুশি মনে হচ্ছে। নিজের আশেপাশে এমনটা কেউই আশা করে না। নিজ নিজ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সবই খেয়াল করছে অন্যান্য দোকানদার। গুলির শব্দে চমকে গেছে সবাই। পুরো রাস্তা জুড়ে হয়বরল অবস্থা তৈরি হয়েছে।

    একের পর এক প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলছে ক্যামিল। সবার বক্তব্য মিলিয়ে পুরো ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে সে।

    পুরোপুরি বিধ্বস্ত অবস্থায় গ্যালারি মনিয়ের থেকে বেরিয়ে জর্জ-ফ্যানড্রিন সড়কে উঠলো অ্যানি। কয়েক মিটার এগুতেই ধাক্কা খায় সেলুনের ওই মেয়েটার সাথে। তবুও না থেমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগুতে থাকে সে। এর মাঝে বেশ কয়েকবার ভারসাম্য হারানোর উপক্রম হয় তার। তখন পার্কিংয়ে থাকা গাড়িতে হাত রেখে ভারসাম্য রক্ষা করে সে। কয়েকটা গাড়ির ছাদে, তার রক্তমাখা হাতের ছাপও পাওয়া গেছে। সেই মুহূর্তে রাস্তায় থাকা মানুষজনের ভাষ্যমতে, ওই নারীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত রক্তে রঞ্জিত ছিল, যেন সাক্ষাত রক্তচোষা। টলতে থাকা শরীর নিয়েও এক মুহূর্তের জন্য থামেনি সে, মদ্যপের ন্যায় গোঙাচ্ছিল। মানুষজন সরে গিয়ে জায়গা করে দিচ্ছিল তাকে। একজন অবশ্য সাহস করে এগিয়ে জানতে চেয়েছিল, “ম্যাডাম, কোনো সাহায্য লাগবে?”, কিন্তু এতো রক্ত আর সহ্য করতে পারেনি লোকটা।

    “এতো রক্ত দেখে সত্যিই অনেক ভয় পেয়েছিলাম…বুঝতে পারছিলাম না কী করবো।”

    লোকটা এখনো সেই দৃশ্য ভুলতে পারেনি, তার চোখ মুখের অভিব্যক্তি দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে। চোখটা কেমন যেন পিটপিট করছে সে। ক্যামিলের ধারণা লোকটার চোখে ছানি পড়েছে, মৃত্যুর আগে তার বাবারও এমন হয়েছিল। একটা বাক্য শেষ করে দীর্ঘ বিরতি নেয় লোকটা।

    “ম্যাডাম,” বলে আবারও ডাক দিলো সে। কিন্তু অ্যানিকে থামানোর সাহস হয়নি তার। অ্যানি যেন ঘুমের ঘোরে হাঁটছিল; তাই কিছু না করে, টলতে থাকা অ্যানির পথের দিকে চেয়ে রইলো সে।

    এমন সময়ে হুট করেই ঘুরে দাঁড়ায় অ্যানি।

    এর কারন একমাত্র অ্যানিই জানে। আর কেউ না। কেন না এরপরেই উল্টো ঘুরে, ড্যামিয়ানি সড়কের দিকে হাঁটতে শুরু করলো সে। দুই-তিন সেকেন্ড পর দেখা গেল, অ্যানির বিপরীত দিক থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে ডাকাতদের গাড়ি।

    শিকারকে আরেকবার হাতের কাছে পেয়ে. শটগান হাতে নেয়ার লোভ সামলাতে পারলো না লম্বা লোকটা। এর আগে দু-বার গুলি চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে সে। অ্যানির কাছাকাছি আসতেই, গাড়ির জানালা নিচে নেমে গেল। শটগানের ব্যারেল ঠিক অ্যানির বরাবর তাক্ করা। এরপর, সবকিছু খুব দ্রুত ঘটলো। শর্টগানের ব্যারেল চোখে পড়লেও, এক ফোঁটাও নড়তে পারেনি অ্যানি।

    “সে গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল…” জানালো লোকটা, “আসলে কীভাবে যে বলবো আমি…মনে হচ্ছিল সে যেন এমনটাই আশা করছে।”

    সে যা বলছে, তা বুঝেই বলছে। তার কথার মর্মার্থ ক্যামিলও ধরতে পেরেছে। বৃদ্ধ লোকটা আসলে বোঝাতে চাইছে, রাজ্যের ক্লান্তি ভর করেছিল অ্যানির মাঝে। এতোকিছুর পর আর পারছিল না সে। তাই, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। এই বিষয়টায় যেন সবাই একমত। অ্যানি, খুনি, বৃদ্ধ লোক, ভাগ্য—সবাই।

    এমনকি সেলুনে কাজ করা সেই তরুণীও : “জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসা বন্দুকের ব্যারেল আমার নজর এড়ায়নি। আর রক্তমাখা ওই নারীও দেখেছিল। দুজনের কেউই চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কিন্তু একদম বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। বুঝতে পারছেন?”

    দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্যামিল। সবার বিবৃতি নেয়া হয়ে গেছে। শুধু ওই গাড়ির চালকের নেয়া বাকি। তবে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে ক্যামিল একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। গ্যালারির ভেতরে ঘটে যাওয়া হাঙ্গামা সম্পর্কে কিছুই জানতো না ড্রাইভার। বাইরে বসে হয়তো গুলির শব্দ শুনেছিল সে। তবে পরিকল্পনার চেয়ে বেশি সময় লাগছে, এটা তার বোঝার কথা। হয়তো ধৈর্যহারা হয়ে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়েছে সে। ভয় পেয়ে হয়তো চলে যাওয়ার কথাও ভাবছিল, তখনি লোক দুইজন চলে আসে। একজন আরেকজনকে ঠেলে গাড়িতে উঠে পড়ে। “কাউকে কি খুন করেছে এরা? করলেও কতজন?” মনে মনে ভাবলো সে। এসব ভাবনায় সময় নষ্ট না করে গাড়ি চালানো শুরু করে সে। দুইশ মিটার পার না হতেই ট্রাফিক সিগন্যালের কারণে গতি কমাতে হয় তার। তখনি, রক্তমাখা এক তরুণীকে দেখে। হয়তো এমন সময়ে খুনি গাড়ির গতি কমানোর কথা বলে তাকে। কে জানে, শিকারের আনন্দে হয়তো চিৎকার দিয়ে উঠেছিল খুনি। এই শেষ সুযোগ, এবার আর হাতছাড়া করা যাবে না। স্বয়ং ভাগ্যদেবী যেন চাচ্ছে, তার হাতেই মেয়েটার ইহলীলা সাঙ্গ হোক। তাই কাঁধের কাছাকাছি শটগানটা তুলে লক্ষ্যস্থির করে নেয় সে। এই অবস্থা দেখে চালকের মনে হয়, হত্যাকাণ্ডে সহায়তার কারণে হয়তো তাকেও অভিযুক্ত করা হবে। গ্যালারির ভেতরে যা ঘটেছে, তাতে জড়িত না থাকলেও কোনো লাভ নেই। ডাকাতির ঘটনা বাজে দিকে মোড় নিচ্ছে। এমনটা আশা করেনি সে…

    “কর্কশ শব্দ করে গাড়িটা থেমে যায়,” জানালো সেলুনে কাজ করা তরুণী। “ওই যে ব্রেক করলে টায়ারের যে আর্তনাদ শোনা যায়। অনেকটা তেমন…”

    রাস্তায় টায়ারের ছাপ থাকার কারণে গাড়ি শনাক্তকরণের কাজটা খুব একটা কঠিন হবে না। পরবর্তিতে জানা যায়, পোরশে নিয়ে পালিয়েছিল ডাকাত দল।

    লম্বা লোকটাসহ গাড়ির সবাই তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। খুনির বুলেটের আঘাতে গাড়ির দরজা আর জানালা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আশেপাশের সবাই রাস্তায় শুয়ে পড়ে। শুধুমাত্র বৃদ্ধ লোকটা নড়াচড়ার সময় পায় না। সাথে সাথে অ্যাক্সিলেটরে পা দাবায় চালক, আরেকবার টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা যায়। তখনি লুটিয়ে পড়ে অ্যানি।

    ফুটপাতে পড়ে আছে অ্যানি। এক হাত নর্দমার কাছে বেকায়দাভাবে ঝুলছে। আর, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক গাড়ির নিচে রয়েছে এক পা।

    “মেয়েটা জ্বলজ্বল করছিল,” বলল বৃদ্ধ লোকটা। অবশ্য ভুল বলেনি সে। কেন না উইন্ডস্ক্রিনের চুরমার হয়ে যাওয়া কাচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অ্যানির শরীরে।

    .

    সকাল ১০ টা ৪০

    তুর্কি ভ্রাতৃদ্বয় খুশি না।

    মোটেও খুশি না।

    দশাসই আকৃতির লোকটার চোখে মুখে রাগের ভাব সুস্পষ্ট। এমন অবস্থাতেই গাড়ি চালাচ্ছে সে। স্টিয়ারিং হুইল শক্ত করে চেপে ধরায়, তার আঙুলের গিঁট স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। চোখ কটমট করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মনের ভাব গোপন করা তার স্বভাবের মাঝে পড়ে না। অথবা এটা তার সংস্কৃতির অংশও হতে পারে।

    ছোট ভাইটা চঞ্চল প্রকৃতির, সারাক্ষণ ছটফট করছে। তার কৃষ্ণকায় চেহারায় পাশবিকতার ছাপ স্পষ্ট। অপমানজনক কথা একদমই সহ্য করতে পারে না সে। বাতাসে হাত চালিয়ে কী কী যেন বলছে। স্প্যানিশ হওয়ার কারণে কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি। তবে আন্দাজ করতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। আমাদের ভাড়া করা হয়েছিল ঝামেলাবিহীন একটা ডাকাতির জন্য, কোনো বন্দুকযুদ্ধের জন্য নয়। এই বলে হাত দুটো আরো ছড়িয়ে দিলো সে। যদি তোমাকে না থামাতাম, তাহলে? গাড়ির মাঝে অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো। বড় ভাইয়ের উদ্দেশ্যে করা প্রশ্নের জবাব না পেয়ে, আরো রেগে গেল সে। ভাইয়ের দিকে তুড়ি মেরে বলল : জুয়েলারি দোকান লুট করার কথা ছিল আমাদের, খুন না!

    যেমনটা বলছিলাম, পরিস্থিতি একটু গরম হয়ে উঠেছিল। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। রেগে গেলে সবকিছু একদম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতো।

    সবকিছু পরিকল্পনামতো হয়নি। তবে যা দরকার ছিল তা পাওয়া গেছে। এতেই আমি খুশি। ব্যাগ দুটোও জায়গামত আছে। কিছুদিন চলার মত সঞ্চয় হয়ে গিয়েছে। তবে, আরো বড় পরিকল্পনা আছে আমার। আরো অনেক ব্যাগ আসা বাকি। তুর্কি ভ্রাতৃদ্বয় ব্যাগের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কথা শুনে মনে হচ্ছে দুজনে মিলে নতুন কোনো পরিকল্পনা আঁটছে। ওরা এমনভাবে কথা বলছে, যেন আমি অস্তিত্ত্বহীন। হয়তো নিজেদের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে আলাপ করছে। ভাগ বাটোয়ারা…ভাবতেই হাসি পাচ্ছে আমার। কিছুক্ষণ পরপর ছোটভাইটা আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কিছু একটা বলে। দুই একটা গালি ছাড়া কিছুই আমার বোধগম্য হলো না। ভাইয়েরা মিলে এই দেশে এসেছে এখনো চব্বিশ ঘণ্টাও পার হয়নি। এর মাঝে স্থানীয় গালিও শিখে ফেলেছে। কে জানে, ওদের ভাষাজ্ঞান হয়তো বেশ ভালো। অবশ্য এতে আমার কিছু আসে যায় না। এখন খুব ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। ওরা যাই বলছে, আমি মাথা নেড়ে মেনে নিচ্ছি।

    অনেকটুকু রাস্তা পার হয়ে এলাম। গাড়ি থেমে গেছে। তবে, দুই ভাইয়ের তর্ক এখনো থামেনি। এদের দম আছে মানতে হবে। গাড়ি জুড়ে গুমোট বাতাস। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। ছোট ভাইটা একই প্রশ্ন বারবার করছে আর জবাব চাইছে। একটু পর কেমন একটা উদ্ভট অঙ্গভঙ্গি করলো সে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, এমন আশ্বাস দিয়ে চুপ করে রইলাম । একদমই মিথ্যা বলিনি আমি।

    এরইমাঝে গাড়ি থেকে নেমে এলো ড্রাইভার। গ্যারেজের তালা খুলতে পারছে না সে। বেশ কয়েকবার চাবি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে চেষ্টা করলেও, তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। চিন্তিত ভঙ্গিতে গাড়ির কাছে ফিরলো সে। তার মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরছে-সকালে যখন তালা লাগালাম, তখন তো ঠিকঠাকই কাজ করছিল। এই কানাগলিতে আমাদের কেউ খুঁজতে আসবে না। কিন্তু তাই বলে অনন্তকাল তো আর এখানে বসে থাকতে পারি না।

    তালা না খোলা, দুর্ভাগ্যের অংশ বলেই মেনে নিলো তুর্কি ভাইয়েরা। একটার পর একটা চলতেই থাকবে। ইতোমধ্যে, ছোট ভাইটা রাগে ফেটে যাচ্ছে। কোনো কিছুই পরিকল্পনা মত হচ্ছে না বলে সে প্রতারিত বোধ করছে। ‘শালা একটা ফ্রেঞ্চ ঠগ’, উত্তেজিত কণ্ঠের প্রলাপের মাঝে এইটুকু শুধু বোঝা গেল। কিছু না বোঝার ভান করে বসে থাকাটাই উত্তম মনে হলো আমার কাছে। চেহারায় এমন একটা ভাব আনলাম, যেন তালা না খোলার ব্যাপারে আমিও বেশ অবাক। চিন্তিত এবং বিভ্রান্ত হওয়ার ভঙ্গি করে, গাড়ি থেকে নেমে এলাম।

    মসবার্গ ৫০০ এর ম্যাগাজিনে সাত রাউন্ড গুলি ধরে। হায়েনার মত চিৎকার আর হই-হলা না করে, বলদগুলোর উচিত ছিল কত রাউন্ড খরচ করেছে তার হিসাব রাখা। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা বুঝতে পারবে তালার ব্যাপারে কিছু না জানলেও অন্তত যোগ বিয়োগটা শেখা উচিত ছিল তাদের। গাড়ি থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। আস্তে করে ড্রাইভারকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে বললাম, “দেখি, আমাকে দাও, চেষ্টা করে দেখি।” ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে, বাকি কাজের প্রস্তুতি সারলাম। ড্রাইভারের বুক বরবার চালানোর জন্য পর্যাপ্ত গুলি আমার আছে। তাই দেরি না করে ৭০মি.মি একটা শেল তার বুকে ঠুকে দিলাম। এবার ছোট ভাইটার পালা। দেরি না করে উইনশিল্ডের মাঝ দিয়েই গুলি চালালাম। থকথকে মগজ বেরিয়ে আসা দেখে অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এলো আমার মনে। কাচে রক্ত লেগে থাকার কারণে বাইরে থেকে পুরোটা দেখতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই কাছে গিয়ে দেখলাম, মাথাটা একদম টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গলা আর বাকি শরীরের বাকি অংশ মৃদু দুলছে। গলা কেটে ফেলার পর মুরগি ছটফট করে। তুর্কিরাও অনেকটা এমন।

    এখন আর দেরি করা যাবে না। ব্যাগ দুটো হাতে নিয়ে, সঠিক চাবি দিয়ে তালা খুলে ফেললাম। বড় ভাইকে টেনে গ্যারেজে ঢুকালাম। গাড়ির ভেতরে দুই টুকরা হয়ে পড়ে আছে আরেক ভাই। গ্যারেজেই ঠাই পাবে গাড়িটা। শাটার নামিয়ে গ্যারেজে তালা লাগাতেই সব খতম।

    এখন গলির শেষ মাথায় চলে যাওয়া বাকি। সেখানে গিয়েই একটা গাড়ি ভাড়া করতে হবে। সত্যি বলতে এখনো কাজ শেষ হয়নি। বলতে পারেন, এতো কেবল শুরু। হিসাব চুকানোর সময় এসে গেছে। মোবাইল বের করে একটা নাম্বার টিপতে হবে, যা বোমাটাকে সক্রিয় করবে। প্রায় চল্লিশ মিটার দূরে, গাড়িতে থেকেও শক ওয়েভ টের পেলাম আমি। বাহ্! একদম মনের মত একটা বিস্ফোরণ। তুর্কি ভ্রাতৃদ্বয়ের জন্য এটা স্বর্গের টিকেট। আশা করি ওখানে গিয়ে অনেক কুমারী নারীকে গর্ভবতী করতে পারবে। ওয়ার্কশপগুলোর ওপরের দিকটা বুনকা বুনকা কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। স্থায়ীয় সরকার অবশ্য উন্নয়ন কাজের জন্য এমনিতেও জায়গাটা চিহ্নিত করে রেখেছিল। আমি শুধু তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি। ডাকাত হয়েও নিজের নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকা যায়। ত্রিশ সেকেন্ডের মাঝে ফায়ার ব্রিগেড চলে আসবে। অপচয় করার মত সময় এখন নেই।

    জুয়েলারির ব্যাগ গাঁ দু নঁহ-এর লকারে লুকিয়ে রাখতে হবে। আর চাবিটা ম্যাজেন্টা এভিনিউয়ের লেটার বক্সে।

    ডাকাতির মালামাল নিতে একজনকে পাঠাবে আমার সহকর্মী

    শেষমেশ পরিস্থিতি বুঝে বাকি কাজ করতে হবে। জ্ঞানীগুণীরা বলে, খুনিরা সবসবময় অপরাধস্থলে ফিরে আসে। আমি আবার ঐতিহ্যকে সম্মান দিতে কার্পণ্য করি না।

    .

    সকাল ১১ টা ৪৫

    আরম্যান্ডের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যাওয়ার ঠিক দুই ঘণ্টা আগে ক্যামিলের কাছে একটা ফোন আসে। অ্যানি ফরেস্টিয়ে নামে কাউকে চেনে কি না জানতে চায়। কন্টাক্ট লিস্টে প্রথম আর ডায়াল লিস্টে শেষ নাম্বারটা তার। কলটা পেয়ে মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল এক স্রোত নেমে গেল ক্যামিলের : এভাবেই কারো মৃত্যু সংবাদ আসে।

    কিন্তু অ্যানি মারা যায়নি। “কেউ বেধড়ক পিটিয়েছে তাকে। কিছুক্ষণ আগে হসপিটালে নেয়া হয়েছে।” মহিলার কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পারলো ক্যামিল, অ্যানির অবস্থা ভালো না।

    সত্যি বলতে, অ্যানির অবস্থা বেশ খারাপ। কথা বলার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। তদন্তকারী অফিসার এসে ঘুরে গেছে। রোগির সাথে দেখা করার জন্য দায়িত্বরত নার্সের সাথে বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হলো ক্যামিলের। শেষমেশ অল্প সময়ের জন্য অনুমতি পেল সে।

    দরজা খুলে কিছু সময়ের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেল ক্যামিল। নিজের প্রিয় মানুষের এমন করুণ দশা, সে সহ্য করতে পারছে না।

    প্রথমেই, ব্যান্ডেজে মোড়ানো মাথার দিকে চোখ পড়লো তার। অ্যানিকে দেখে মনে হচ্ছে তার ওপর দিয়ে কোনো ট্রাক চলে গেছে। মুখের ডান পাশে ফুলে থাকার কারণে চোখদুটো ঢেকে গেছে, মনে হচ্ছে কোটর থেকে তুলে ফেলা হয়েছে। বাম পাশে প্রায় দশ ইঞ্চির গভীর ক্ষত। সেলাই করা জায়গাগুলো লাল হয়ে ফুলে আছে। ঠোঁটটাও বাজেভাবে কেটে গেছে। চোখের পাতা নীল হয়ে ফুলে আছে। নাকটা ভেঙে এমন অবস্থা, স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুণ বেশি ফোলা দেখাচ্ছে। মুখটা হালকা খোলা থাকার কারণে মাড়ি থেকে পড়া রক্তও ক্যামিলের চোখ এড়ায়নি। বালিশে লালা গড়িয়ে পড়ছে। একদম বয়স্ক মহিলার মত লাগছে অ্যানিকে। ভেঙে যাওয়া আঙুল আর ব্যান্ড্যে করা হাত বিছানার উপর পড়ে আছে। ডান হাতের গভীর ক্ষত, যা সদ্যই সেলাই করা হয়েছে-স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

    ক্যামিলের উপস্থিতি টের পেয়ে, হাত বাড়িয়ে দিলো অ্যানি। পানিতে টলমল করে উঠলো তার চোখ। বন্ধ করে আবারো চোখ খুলল সে। চোখ দুটো যেন কাচের তৈরি, অনুভূতিহীন। তার অপূর্ব সবুজ আইরিশও যেন বর্ণহীন হয়ে গেছে আজ।

    মাথাটা একদিকে কাত হয়ে গেল তার। কণ্ঠস্বর কেমন যেন ফেসেেস। জিহ্বা ভারি হয়ে আছে। অবচেতনভাবে কামড় লাগতেই অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় কেঁদে উঠছে সে। ঠোঁটে আঘাত লাগার কারণে, স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারছে না অ্যানি।

    “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে…”

    ক্যামিলের মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। অ্যানি কথা বলতে চাইলেও, তাকে থামার ইশারা করলো ক্যামিল। অ্যানির কপালে যে হাত বুলিয়ে দেবে, সেই সাহসও হলো না তার। হুট করে অ্যানিকে বেশ ভীত আর উত্তেজিত মনে হলো। কিছু করতে চাইছে ক্যামিল, কিন্তু কী করবে? নার্সকে ডাকবে? চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো অ্যানির, জরুরি কিছু বলছে চাইছে।

    “…ধওও ‘…’ ঘাত…’ রে…”

    হুট করে যা হয়ে গেছে, তার ঘোর এখনো কাটাতে পারেনি সে। সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাড়া করছে তাকে।

    নিচু হয়ে আরো মনোযোগ দিয়ে শুনলো ক্যামিল। বোঝার ভান করছে সে, মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। অ্যানির কথা শুনে মনে হচ্ছে, তার মুখ ভর্তি গরম স্যুপ। ভাঙা ভাঙা কয়েকটা অক্ষর বুঝতে পারছে ক্যামিল। মনোযোগ বাড়িয়ে দেবার ফল হাতেনাতে পেল সে। কয়েকমিনিট পর অক্ষর থেকে শব্দ আন্দাজ করতে সক্ষম হলো। ভাবতেই অবাক লাগে, মানুষ কত দ্রুত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

    “ধরলো,” শুনতে পেল ক্যামিল, “আঘাত… জোরে।”

    চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে অ্যানি, চোখেমুখে ভয়ের ছাপ সুস্পষ্ট। যেন ওই লোকটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এখনই বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করবে তাকে। আলতো করে কাঁধে হাত রাখলো ক্যামিল। শিউরে উঠলো অ্যানি। প্রেমিকার কান্নার শব্দ, প্রেমিকের হৃদয় আরো ব্যথিত করে তুলল।

    “ক্যামিল…” ডাকলো সে।

    একদম নড়তে পারছে না অ্যানি। কথা বলার সময়, হাত দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করে সে। বেশিরভাগ সময়ই ব্যর্থ হয়। তখন তার মুখটা দেখতে ফাটা তরমুজের মত লাগে।

    “…করতে যাচ্ছে…?”

    ক্যামিলের মনে হলো, সে এটাই শুনেছে। আবারো কান্না শুরু করলো অ্যানি। তার কান্না এখন আর কোনো বাঁধ মানছে না। উথলে ওঠা চোখের জল, তার চিবুক বেয়ে নামছে, মুখটা বিস্ময়ে ভরপুর।

    “এখনো জানি না আমরা…” নিচুস্বরে বলল ক্যামিল। “এখন বিশ্রাম করো। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে…”

    কিন্তু, অ্যানি অন্যকিছু ভাবছে। এরপর, মুখটা এমনটাভাবে ঘোরালো যেন সে লজ্জিত। তার কথা এখন প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। ক্যামিলের মনে হলো, সে বলতে চাইছে “এভাবে না…” কেউ তাকে এই অবস্থায় দেখুক তা সে চাইছে না। পেছনে বালিশ রেখে, হেলান দিয়ে বসলো অ্যানি। তার ঘাড়ে হাত রাখলো ক্যামিল। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না অ্যানি, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার কারণে, একটু পরপর তার শরীর কেঁপে উঠছে।

    “আমি থাকবো তোমার পাশে?”

    কোনো জবাব এলো না। কী করবে বুঝতে না পেরে, পাশেই বসে রইলো ক্যামিল। অনেকক্ষণ পর কিছু একটার দিকে ইঙ্গিত করে মাথা নাড়লো অ্যানি। যদিও তার ইশারার কারণ বোঝা গেল না। সবকিছু মুহূর্তের মাঝেই কেমন ওলটপালট হয়ে যায়। কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ। তখন চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

    অ্যানি ঘুমিয়ে গেছে কি না তা বলা অসম্ভব। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সে। নড়াচড়া করছে না বললেই চলে।

    এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।

    অ্যানির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্যামিল। প্রেমিকার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে সে। এই শব্দ তার চেয়ে ভালো কেউ চেনে না। ঘুমন্ত অ্যানির দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকার অভ্যাস আছে তার। সম্পর্কের শুরুর দিকে মাঝরাতে জেগে উঠতো সে, শুধুমাত্র অ্যানির স্কেচ করার জন্য। তার ধারণা প্রেয়সীর চেহারার মাধুর্য দিনের বেলায় ঠিক ফুটে ওঠে না। একশোর উপরে ড্রয়িং আর অগণিত ঘণ্টা পার করেছে সে, শুধুমাত্র অ্যানির ঠোঁটের পবিত্রতা ফুটিয়ে তোলার জন্য। বারবার ব্যর্থ হওয়ায়, অ্যানির প্রতি তার মুগ্ধতা আরো বেড়ে গেছে। কী এক অপার্থিব সৌন্দর্য! তার মতো এতো দক্ষ লোকও পেন্সিলের আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে পারছে না। যেখানে অন্য কারো হুবহু প্রতিকৃতি তৈরি করতে কয়েক মিনিটের বেশি লাগে না তার। ওই চেহারায় কিছু একটা আছে, যা বারবার দেখা সত্ত্বেও মন ভরে না। মায়াবি এক মোহ বারবার কাছে টেনে নেয়। কিন্তু, ব্যান্ডেজে মোড়ানো অবস্থায় সামনে যে শুয়ে আছে, তার চেহারায় আর যাই হোক, সেই মোহ নেই। অবশিষ্ট আছে কুৎসিত এক অবয়ব। যাকে চিনতে বেশ কষ্ট হচ্ছে ক্যামিলের।

    প্রতিটা মিনিট পার হচ্ছে আর ক্যামিলের মাঝে প্রজ্জ্বলিত আগুনের তীব্রতাও যেন সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

    একটু পর পর জেগে উঠছে আর অবাক দৃষ্টিতে চারিদিকে কী যেন দেখছে অ্যানি। এই দৃষ্টিভঙ্গি খুব পরিচিত মনে হলো ক্যামিলের। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে, আরম্যান্ডের চোখেও ছিল এমন গভীর বিষাদের ছায়া। ভাগ্যের নির্মম পরিণতি কোথায় এনে ফেলেছে তাকে। দৃষ্টি জুড়ে অবিশ্বাস আর অবিচারের ছায়া।

    মনের মাঝে ঝড় চলছে ক্যামিলের। এমন সময়ে নার্স এসে জানালো, তার সময় শেষ। নার্সের দাঁড়ানোর ভঙ্গিমার মনে হলো, ক্যামিল না যাওয়া পর্যন্ত একচুলও নড়বে না সে। নেইম-ট্যাগ থেকে নার্সের নাম জেনে নিলো ক্যামিল : ‘ফ্লোরেন্স’। আরো কিছুক্ষণ থেকে অ্যানির পুরো কথা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। এদিকে অ্যানিরও বিশ্রাম দরকার। তাই বেরিয়ে গেল ক্যামিল।

    চব্বিশ ঘণ্টা পার হওয়ার পর, ঘটনা বুঝতে শুরু করবে ক্যামিল।

    এই সময়ের মাঝে, পুরো পৃথিবী তন্নতন্ন করে ফেলার ক্ষমতা আছে কম্যান্ড্যান্ট ক্যামিল ভেরহোভেনের।

    খুব কম তথ্য সহকারে হাসপাতাল থেকে বের হলো সে। অ্যানির সাথে কথা বলে কিছু জেনেছে, আর কিছ জানে ওই ফোন কলের মাধ্যমে। সত্যি বলতে, এর বাইরে কেউই কিছু জানে না। তাই পুরো ঘটনা সময়ানুক্রমে সাজানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্রমাণ বলতে রয়েছে অ্যানির বিকৃত মুখের প্রতিচ্ছবি। যন্ত্রণাদায়ক এক ছবি, যা বারবার তার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে, যা ভেতরে থাকা আগুন উসকে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।

    হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার আগেই, রাগের পারদ একদম চূড়ায় উঠে আছে তার।

    সবকিছু জানতে চায় সে। এখনই জানতে চায়। সবার আগে জানতে চায়। সে চায়….

    এমনিতে ক্যামিল প্রতিশোধপরায়ণ নয়। তবে বেশ কয়েকবার সুযোগ সে পেয়েছে। কিন্তু তার প্রথম স্ত্রীর হত্যাকারী ফিলিপ বুসন এখনো জীবিত। কারাগারের মধ্যে তার যে চেনাজানা লোক আছে, তাতে খুব সহজেই দুই এক ঘা দিতেই পারতো খুনিকে।

    অ্যানির সাথে যা ঘটেছে, এর জন্যে প্রতিশোধের নেশা জেগে উঠেনি তার মাঝে। বরং, এই ঘটনা যেন তার নিজের জীবনকে সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে। কিছু করতে হবে, এখন আর বসে থাকা চলবে না তার। আইরিনের মৃত্যুর পর তার জীবন টিকে আছে শুধুমাত্র অ্যানির জন্যে।

    অন্য কারো কাছে এইসব কথা অতি আবেগপূর্ণ প্রলাপ মনে হলেও, এর মর্মার্থ একদমই আলাদা। নিজের প্রিয় মানুষের মৃত্যুর জন্য, এখনো নিজেকে দায়ি মনে করে ক্যামিল। ভালোবাসা মানুষকে বদলে দেয়।

    তার চোখে আবারো ভেসে উঠছে, অ্যানির ক্ষত-বিক্ষত মুখ।

    মৃত অ্যানির মুখটা কেমন হবে, তাও কল্পনা করে ফেলল সে। ভাবনা চিন্তা লাগামহীন হয়ে পড়েছে তার।

    অ্যানিকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে কেউ। কে কিংবা কেন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে তার।

    তার মনে হচ্ছে, এমনটা আগেও ঘটেছিল। আর এই ভাবনাই তার ভয়কে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আইরিন খুন হওয়ার পর…পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। বুসনের মূল লক্ষ্যই ছিল আইরিনকে হত্যা করা। কিন্তু, অ্যানি শুধুমাত্র ভুল সময়ে ভুল লোকের হাতে পড়েছে। কিন্তু ক্যামিলের চিন্তার জট কিছুতেই খুলছে না।

    হাত পা গুটিয়ে বসে থাকাও সম্ভব না তার পক্ষে।

    কিছু না কিছু তো করতেই হবে।

    সত্যি বলতে, ফোন পাওয়ার পর থেকেই অবচেতনভাবে নিজের সহজাত প্রবৃত্তিবশত কাজ শুরু করে দিয়েছে ক্যামিল। এক নারী পুলিশ অফিসার ফোন করে জানিয়েছিল, আট নাম্বার বিভাগে এক সশস্ত্র ডাকাতির সময় ‘কোন্দলে’ জড়িয়ে পড়ে অ্যানি। মারাত্মক আঘাত পেয়ে এখন স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি আছে। ‘কোন্দল’ শব্দটা ক্যামিলের খুব প্রিয়। পুলিশে কর্মরত সবারই বেশ পছন্দের শব্দ। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে নির্মম প্রহার পর্যন্ত, যে কোনো কিছুই বোঝানো যায় এই শব্দ দিয়ে। যার যেটা ভাবতে মন চায়, ভেবে নেবে। এতে করে চিন্তার স্বাধীনতাও রক্ষিত হয়।

    “কী ধরনের কোন্দল?”

    ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। হয়তো কোনো রিপোর্ট দেখে বলছিল। ক্যামিলের সন্দেহ হলো ঘটনার ব্যাপারে পুরোপুরি অবগত নয় ওই অফিসার ।

    “সশস্ত্র ডাকাতির সময় গোলাগুলি হয়েছে। ম্যাডাম ফরেস্টিয়ের গায়ে কোনো গুলি লাগেনি। তবে কোন্দলের সময় আঘাত পেয়েছেন। এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।”

    গোলাগুলি হয়েছে? অ্যানি আহত? ডাকাতির সময়? ঠিক হিসেব মিলছে না। কল্পনাতেও তো এমন ভাবতে পারে না ক্যামিল। অ্যানির সাথে ডাকাতির কী সম্পর্ক থাকতে পারে…

    লাইনে থাকা নারী অফিসার জানালো, অ্যানিকে যখন উদ্ধার করা হয় তখন তার সাথে ব্যাগ কিংবা পরিচয়সূচক কিছু ছিল না। পাশে পড়ে থাকা মোবাইল থেকে নাম আর ঠিকানা জানা গেছে।

    “বাসার নাম্বারে ফোন করেছিলাম। কিন্তু কেউ ধরেনি।”

    তাই অ্যানির ডায়াল লিস্টে সর্বশেষ যে নাম্বার ছিল তাতে কল দিয়েছে তারা-ক্যামিলের নাম্বার।

    প্রাথমিক কাজের জন্য ক্যামিলের নাম জানতে চাইলো ওই পুলিশ অফিসার।

    “ভেরোনা?” জিজ্ঞেস করলো সে।

    “ভেরহোভেন,” শুধরে দিলো ক্যামিল।

    কিছুক্ষণ নীরব থেকে বানান জানতে চায় নারী অফিসার।

    ক্যামিলের মাথায় হুট করেই একটা চিন্তা ঢুকলো।

    ভেরহোভেন মোটেও পরিচিত নাম নয়। পুলিশ বাহিনীতে তো আর কম। তবে, ক্যামিল ওই ধরনের পুলিশ অফিসার না যে লোকে তাকে সহজে ভুলে যাবে। শুধু যে ক্ষুদ্রাকৃতিই তাকে আলাদা করেছে তা নয়। সবাই তার খ্যাতি আর ইতিহাস সম্পর্কে অবগত। প্রিয়তম স্ত্রী আইরিনের ঘটনাও কারো অজানা নয়। আর অ্যালেক্স প্রিভস্টের কেস তো আলাদা করে চিনিয়েছে তাকে। বেশ কয়েকটা গুরুত্বপুর্ণ কেসের জন্য টিভি ক্যামেরার সামনে আসতে হয়েছে তার। আর পৈতৃকসূত্রে পাওয়া টাক তো বরাবরই ক্যামেরাম্যানদের বিশেষ নজর কেড়েছে। কিন্তু এই অফিসার যে পুলিশের বিখ্যাত কম্যান্ড্যান্টের নাম শোনেনি, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তাই বানান জানতে চাইছে সে।

    “ফেরোভেন, তাই না?”

    “হ্যাঁ, তাই। ফেরোভেন।” সায় জানালো ক্যামিল। সাথে বানানও বলে দিলো।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিসাশন – পিয়া সরকার
    Next Article অ্যালেক্স – পিয়ের লেমেইত

    Related Articles

    পিয়ের লেমেইত

    আইরিন – পিয়ের লেমেইত

    September 13, 2025
    পিয়ের লেমেইত

    অ্যালেক্স – পিয়ের লেমেইত

    September 13, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }