Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    খুনির রং – অনীশ দেব

    লেখক এক পাতা গল্প539 Mins Read0
    ⤶

    নীল রুমাল – প্রণব রায়

    বাড়িটা শহরের একটেরে— সীমানার বাইরেও বলা যায় ৷ হঠাৎ দেখলে একটা সাবেককেলে গির্জা বলে মনে হয় ৷ খুঁজে খুঁজে এই বাড়িটাতে নিশীথ তার স্টুডিও করেছে ৷

    শহরের কলরব-ব্যস্ততার থেকে দূরে, একান্তে বসে কাজ-কারবারের পক্ষে এই প্রাচীন নিরিবিলি বাড়িটা নাকি চমৎকার ৷ তাছাড়া আশেপাশে একটা জংলা আভাসও আছে ৷ বাড়িটার চারপাশ ঘিরে অনেকটা জমি— সাবু আর বড় বড় দেবদারু গাছে ভর্তি ৷ পিছন দিকে বড় গোছের একটা খালও আছে ৷ এককালে নাকি এই খালপথে বড় বড় ছিপ অন্ধকার রাত্রে নিঃশব্দ কুমিরের মতো ভেসে চলত শিকারের সন্ধানে ৷ শোনা যায়, তারা নাকি চট্টগ্রাম থেকে ছটকে-আসা জলদস্যুর দল ৷ কিন্তু সে বহু বছর আগেকার কথা ৷

    এখন হপ্তাহে একবার করে গঞ্জ-ফেরত ব্যবসায়ীদের নৌকো ছাড়া খালের জলে আর কিছু দেখা যায় না ৷

    নিশীথ কিন্তু এই পাণ্ডববর্জিত জায়গাতেই একটা স্টুডিও খুলে বসেছে ৷ নামকরা শিল্পী সে— তৈলচিত্র আর প্ল্যাস্টারের মূর্তি গড়ায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি আছে তার ৷ অদ্ভুত প্রকৃতির লোক এই নিশীথ ৷ তার বহু ছবি, বহু মূর্তি দেশ-বিদেশে প্রদর্শনীতে পুরস্কার লাভ করেছে, প্রচুর দামে বিক্রি হয়েছে ৷ শিল্প-রসিক বহু নরনারী তার শিল্পকে দেখেছে, তারিফ করেছে, কিন্তু শিল্পীকে বিশেষ কেউই দেখতে পায়নি ৷ কত অভিনন্দন-সভা থেকে আমন্ত্রণ এসেছে—নিশীথ সাড়া দেয়নি, কত অনুরাগীর আসরে উপস্থিত হওয়ার জন্যে অনুরোধ এসেছে— অসুস্থতার অজুহাতে সে উপস্থিত হয়নি ৷ এমনকী নিজের ছবি একখানা— তা-ও সে কোনোদিন আঁকেনি ৷

    নিশীথের এই আত্মগোপনের রহস্য আর কেউ না জানলেও একটি মানুষ জানত— সে ‘রোমাঞ্চ’র বিখ্যাত গোয়েন্দা প্রতুল লাহিড়ী ৷ পাঠক-পাঠিকারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই অপরাধের গন্ধ পেয়ে সচকিত হয়ে উঠেছেন ৷ কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে, নিশীথের আত্মগোপন-রহস্যের মধ্যে অপরাধের লেশমাত্র গন্ধ নেই ৷ আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে এই: নিশীথ লোকটা দেখতে অত্যন্ত কুৎসিত— শুধু কুৎসিত নয়, একেবারে হত-কুৎসিত ৷ মুখখানার গঠন অনেকটা ‘এপ ম্যান’ বা গরিলার মতন ৷ হাত দুটো অস্বাভাবিক দীর্ঘ এবং রোমশ ৷ সারা জীবন যে সুন্দরের পুজো করে আসছে, তার প্রতি সৌন্দর্য-দেবতার কেন যে এতখানি অকরুণ উপেক্ষা— তা বোধ করি ভগবানই জানেন ৷ কিন্তু নিজের কদাকার চেহারার জন্যে নিশীথের লজ্জা বেদনা অভিমানের অন্ত ছিল না ৷ তার শিল্পকলার নিদর্শন দেখে কত অনুরাগিণী নারী অনুরাগপত্র পাঠিয়ে তার দর্শন-প্রার্থিনী হয়েছে ৷ প্রথম প্রথমদু-একজনকে সে আসতেও লিখেছিল ৷ কিন্তু দেখা হলে কেউ-বা তাকে মনে করেছিল ভৃত্য, কেউ-বা আতঙ্কে চিৎকার করে পালিয়ে গিয়েছিল ৷ সেই থেকে নিশীথ লোকচক্ষুর অন্তরালে এই নির্জনবাস বেছে নিয়েছে ৷ সেই থেকেই বিখ্যাত শিল্পী নিশীথের আত্মগোপনের পালা শুরু ৷ প্রতুল তার বাল্যবন্ধু ৷ বন্ধুর জীবনের এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি তার অন্তরকে স্পর্শ করেছিল ৷ তাই এই নির্জনবাসের মধ্যে প্রতুলই নিশীথের একমাত্র অবসর-সঙ্গী ৷

    সেদিনও সন্ধ্যার পর প্রতুল এসেছিল স্টুডিওতে ৷ বাইরে শীতের রাত কুয়াশায় থমথম করছে ৷ মাঝে মাঝে ঝোড়ো বাতাসও দিচ্ছে ৷ দেবদারু-শাখাপুঞ্জের ভেতর দিয়ে তার অতৃপ্ত আত্মার আক্ষেপের মতো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ৷

    পাইপটা আর একবার ধরিয়ে প্রতুল বলল, হুঁ— কী বলছিলে, স্বপ্নের কথা! মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ যে স্বপ্ন দেখে, তার সঙ্গে অবচেতন মনের সংযোগ আছে ৷ কথাটা সোজা করে বলি! মানুষের গোপন ইচ্ছা, গোপন বাসনা অনেক সময় তার স্বপ্নের রূপ ধরে ওঠে ৷ যেমন ধরো, তুমি গায়ক নও, অথচ গান অত্যন্ত ভালোবাসো, গান গাইবার একটা গুপ্ত ইচ্ছাও আছে প্রবল ৷ তুমি কোনোদিন স্বপ্নে দেখতে পারো যে, বিরাট সভায় বসে গান গাইছ— লোকে তোমার অজস্র প্রশংসা করছে ৷ অবশ্য মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, সব জিনিসেরই ব্যাখ্যা আছে ৷

    থাক তোমার মনোবিজ্ঞানীদের কথা ৷ স্বপ্নের মাঝে এমন কিছুও ঘটে, বিজ্ঞান দিয়ে যার-ব্যাখ্যা চলে না, যা নিতান্ত অস্বাভাবিক ৷— একটা অসমাপ্ত নারীমূর্তি নিয়ে নিশীথ কাজ করছিল প্রতুলের দিকে পিছন ফিরে ৷ পিছন ফিরেই সে এই কথাগুলো বলল ৷

    প্রতুল মৃদু হাসল ৷

    গোয়েন্দাগিরি করতে করতে শেষ অবধি এই জেনেছি যে, অস্বাভাবিক বলে দুনিয়ায় কিছুই নেই ৷ লোকের মুখে-মুখে শুনে বা খবরের কাগজের রিপোর্টে পড়ে যে ঘটনাটা অস্বাভাবিক বলে মনে হয়, বিশেষ পরিবেশ বা অবস্থার মাঝে তাকে দেখলে নিতান্ত স্বাভাবিক বলেই মনে হয় ৷ কেননা, জীবনে ভালোটাও যেমন স্বাভাবিক, মন্দটাও ঠিক ততখানি স্বাভাবিক নিশীথ!

    কিন্তু স্বপ্ন?— নিশীথের হাতের কাজ হঠাৎ থেমে গেল ৷ স্বপ্ন তো ঘটনা নয়, স্বপ্ন জিনিসটাই অবাস্তব ৷ অবাস্তবের ব্যাখ্যা তুমি কী ক’রে করবে প্রতুল?

    আগে স্বপ্ন-কাহিনিটা শুনি, তারপর নাহয় চেষ্টা করা যাবে ব্যাখ্যা করবার ৷

    নিশীথ আবার কাজে হাত লাগিয়ে বলল, তুমি যুক্তি-তর্কবাগীশ মানুষ, তোমার কাছে আমার এই স্বপ্ন-কাহিনি হয়তো আষাঢ়ে গল্পের মতো মনে হবে ৷

    মন্দ কী!— সোফার হাতলের ওপর পা-দুটো তুলে দিয়ে, পাইপে আরাম করে একটা টান দিয়ে প্রতুল বলল, শীতের এই ঠান্ডা রাতে আষাঢ়ে গল্প জমবে ভালো ৷ আজকের মতো কাজ বন্ধ করে গল্প শুরু করে দাও!

    নিশীথ বলল, ভেবেছিলাম আমার স্বপ্নের কথা কোনোদিন কাউকে বলব না ৷ কারণ, এ কাহিনি যত মধুর তত ভয়ংকর ৷ সবচেয়ে সেরা মদ আর সবচেয়ে উগ্র বিষ একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে যা হয়, সে-স্বপ্নের কথা মনে পড়লে আমার অবস্থাও হয় ঠিক তেমনি ৷ সে যে কী অদ্ভুত অনুভূতি, তা তোমায় বোঝাতে পারব না প্রতুল ৷ আনন্দ যে এত যন্ত্রণাদায়ক হয়, আগে তা জানতাম না ৷ বলি শোনো প্রতুল ৷

    হাতের যন্ত্র ফেলে দিয়ে নিশীথ এতক্ষণে ধীরে ধীরে প্রতুলের দিকে মুখ ফেরাল ৷ এতক্ষণ যে ঝোলানো আলোটার নীচে নিশীথ কাজ করছিল, সেটা এখন তার পেছনে ৷ তার পরিবর্তে নিশীথের মুখে পড়েছে— প্রতুলের সামনে টেবিলের ওপর যে রিডিং-ল্যাম্প, তারই মৃদু আলো ৷ সে-আলোটা নিচু দিক থেকে মুখে পড়ায়, তার গরিলাকৃতি মুখখানা যেন সত্যিই পশুর মতো বীভৎস হয়ে উঠেছে ৷

    প্রতুল স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ৷ বাইরে শীতের ঝড়ো হাওয়ার আর্তনাদ একটা খোলা জানলা দিয়ে ঘরে আসছে ৷ দুলছে ঘরের ঝোলানো আলোটা, আর আলো-আঁধারির বিচিত্র ঢেউ খেলে যাচ্ছে দেওয়ালে-দেওয়ালে ৷

    আজও সেই স্বপ্নের কথা মনে হলে আমি যেন কীরকম হয়ে যাই প্রতুল ৷ কেমন একটা অস্থির আতঙ্ক আমায় যেন পাগল করে দেয় ৷ মনে হয়, সারাজীবন বুঝি এ-যন্ত্রণা ভোগ করে কাটাতে হবে ৷

    বলতে বলতে নিশীথ এগিয়ে এসে প্রতুলের সামনে বসল ৷ ধীরে ধীরে তার মুখের পাশব-ভাব বদলে গিয়ে প্রশান্ত হয়ে এল ৷ চোখ-দুটো আস্তে আস্তে এল বুজে ৷ হাত দুটো জোড় হয়ে বুকের কাছে উঠে এল ৷ নিশীথ বলতে লাগল, কিন্তু অসীম করুণা ভগবানের, আমার এ ভাব কয়েক মুহূর্তের বেশি থাকে না ৷ যখন মনে পড়ে যায়, স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই, তখনই নিশ্চিন্ত প্রশান্তিতে মন আবার সুস্থ হয়ে ওঠে ৷

    প্রতুলের পাইপটা নিভে গিয়েছিল ৷ কিন্তু তার স্থির দৃষ্টি তখনও নিশীথের মুখের ওপর ৷ ছাই ঝাড়বার জন্যে পাইপটা ঠুকতেই নিশীথ যেন ধ্যান থেকে জেগে উঠল ৷

    মৃদু গম্ভীর গলায় ধীরে ধীরে সে বলতে শুরু করল: ঠিক এক বছর আগেকার কথা ৷ তারিখটা ছিল আজকেরই মতন ১৩ ডিসেম্বর আর রাতটাও ছিল ঠিক এমনি ঝড়ো, কনকনে ৷ পরের দিনই একখানা পোর্ট্রেট সম্পূর্ণ তৈরি করবার কথা ছিল ৷ কেননা, সেখানা জাহাজে করে বিদেশে যাবে ৷ তাই স্টুডিওতে সারাদিন কাজ করে ছবিখানা যখন শেষ করলাম, তখন সন্ধে উৎরে গেছে ৷ সারাদিন একনাগারে চোদ্দো-পনেরো ঘণ্টা কাজ করে ক্লান্তিতে শরীর যেন ভেঙে পড়েছিল ৷ সেদিন তুমিও আসোনি প্রতুল ৷ খানিকক্ষণ গল্প করে কাটাবারও সময় ছিল না তখন ৷ ভাবলাম, আজ সকাল-সকাল বিশ্রাম নেব ৷ ক্লান্তিতে বাড়ি ফেরারও উৎসাহ ছিল না— যদিও বাড়ি আমার স্টুডিও থেকে আধ মাইল দূরে ৷ নেপালি চাকরটাকে এক কাপ কফি আর দু’টুকরো রুটি দিতে বলে রাত্তিরের মতো তাকে ছুটি দিয়ে দিলাম ৷ স্টুডিওর চাবি আমাকে দিয়ে সে তার ঘরে চলে গেল ৷ তুমি জানো, এ হলটার পশ্চিম দিকে যে ছোট ঘরখানা, সেখানে একখানা লোহার খাটে আমার বিছানা সবসময় পাতা থাকে— কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু বিশ্রাম নেবার জন্যে ৷ কফি আর রুটি খেয়ে কোনোরকমে বিছানায় গিয়ে শুয়ে রইলাম ৷ কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না, ঘুম ভেঙে গেল দেবদারুর শাখায় শাখায় ঝড়ো হাওয়া আর কাতরানির শব্দে ৷ বাইরে শীতের রাত ঘন কুয়াশায় ঠিক এমনি থমথম করছে ৷

    ঘুম ভেঙে যেতে ইচ্ছে হল, পোর্ট্রেটটাকে একবার ভালো করে দেখি, যদি আর এক-আধটুকু তুলির টান দরকার হয় ৷ আমার শোবার ঘরের মোটা পর্দা ঠেলে এই হলের মধ্যে এসে দাঁড়ালাম ৷ হলের ঝোলানো বাতিটা তখনও জ্বলছিল— বোধ হয় নিভিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম ৷ সেই আলোয় এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম— আলোর সামনে হলের মাঝখানে পোর্ট্রেটটা ইজেলের ওপর দাঁড় করানো ৷ আর তারই সামনে আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে ৷ ঘন নীল রঙের সিল্কের পোশাক তার পরনে ৷ শুধু অনাবৃত কাঁধ দুটি শঙ্খের মতো সাদা ৷ মসৃণ কালো চুলগুলি কাঁধ পেরিয়ে আর নীচে নামেনি ৷ বোঝা গেল, এদেশের মেয়ে নয়— বিদেশিনী ৷ পাশের সোফায় মেয়েদের একটা টুপি আর ফার-কোট পড়ে আছে ৷ জীবনে এতখানি আশ্চর্য আর আমি কখনও হইনি ৷ রাত তখন কত কে জানে! এত রাতে এই নির্জন স্টুডিওর মধ্যে অচেনা বিদেশিনী মেয়েটি এল কেমন করে? কেনই বা এল? একি স্বপ্ন, না সত্যি, না ভৌতিক ব্যাপার! আপনা থেকেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল— কে?

    মেয়েটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে ছবি দেখছিল ৷ আমার গলার আওয়াজে চমকিয়ে ফিরে তাকাল ৷ আশ্চর্য— ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেলাম ৷ মনে হল, পোর্ট্রেট থেকে জ্যান্ত হয়ে নেমে মেয়েটি যেন হলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ৷ আজ সাতদিন এই চেহারাই তো আমি রং আর তুলি দিয়ে এঁকেছি ৷ সেই সবুজাভ চোখের তারা, সেই ঈষৎ স্ফুরিত রক্তবর্ণ ওষ্ঠ, সেই পানের মতো মুখের গঠন— পোশাকটার সঙ্গে ছবিটাও হুবহু মিলে যাচ্ছে, পা পর্যন্ত ঝোলানো কাঁধকাটা গাঢ় নীল রঙের সিল্কের পোশাক— ছবি কি কখনও জীবন্ত হয়? না আমার দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে? মনে করে দেখলাম, না, অন্যদিনের মতো আমি তো আজ হুইস্কি খাইনি! তবে— তবে এ কী দেখছি?

    কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মেয়েটি কুণ্ঠিত স্বরে বললে, ক্ষমা করবেন ৷ আমি না বলে ছবিখানা দেখছিলুম ৷ যদিও আমার এই ছবিখানা আঁকবার ফরমাস আমিই দিয়েছি ৷ তবু— চিত্রকরের দেখা পেলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিতাম ৷

    তার প্রয়োজন হবে না ৷ ছবির মালিকের ছবি দেখবার নিশ্চয়ই অধিকার আছে ৷ — আমি জানালাম ৷

    মেয়েটির ঈষৎ স্ফুরিত ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কয়েকটি কুন্দদন্ত দেখা গেল ৷ বললে, অনেক ধন্যবাদ ৷

    আমি বললাম, আপনিই তাহলে বারবারা স্মিথ? নিজে এসে সিটিং না দিয়ে পোর্ট্রেট আঁকবার জন্যে ফোটোগ্রাফার পাঠিয়েছিলেন কেন জানতে পারি কি?

    আমি এক মার্চেন্ট অফিসে স্টেনোগ্রাফারের কাজ করি ৷ আসবার সময় পাই না ৷ কিন্তু আমার বরাবর ইচ্ছে ছিল এখানে আসবার, চিত্রকরের সঙ্গে দেখা করবার ৷— বারবারার দুই চোখে আগ্রহ ফুটে উঠল ৷

    বললাম, তার সময় কি এই? এই অন্ধকার ঝোড়ো শীতের রাত; আপনি একা শহরের বাইরে এতদূরে এলেন কী করে? কে-ই বা আপনাকে দরজা খুলে দিলে?

    বারবারা বললে, অনেক খুঁজে আমায় আসতে হয়েছে, এসে দেখলাম দরজা খোলাই আছে ৷ ভেতরে ঢুকে দু-তিনবার ডাকলাম, কোনো সাড়া পেলাম না ৷ তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছবিখানা দেখছিলাম— তখন আপনি এলেন ৷

    বারবারা কি সত্য কথা বলছে? এতরাত্রে স্টুডিওর দরজা খোলা ছিল? তাই হবে ৷ টেবিলের ওপর ওই তো চাবি পড়ে আছে ৷ বন্ধ করতে আমি নিশ্চয় ভুলে গেছলাম ৷

    বারবারা বলতে লাগল, কাল আমি সানফ্রান্সিসকো চলে যাব ৷ কাল হয়তো আসবার সময় হবে না, তাই এলাম আজকে ৷ রাত অবশ্য অনেক হয়েছে, তবু তো চিত্রকরের সঙ্গে দেখা করবার সুযোগ হারাইনি ৷ কোথায় চিত্রকর? একবার দেখা হবে না?— বারবারার সাগ্রহ কণ্ঠস্বর মধুর বাজনার মতন বেজে উঠল ৷ সে-কণ্ঠস্বরে ছিল উৎসুক আশা আর গভীর শ্রদ্ধা ৷

    চিত্রকরের সঙ্গে আজ দেখা হবে না? বারবারা আবার জিজ্ঞাসা করল ৷

    সংক্ষেপে বললাম, হবে ৷ আজ রাত্রেই দেখা হবে— আপনি চলে যাওযার আগেই ৷

    বারবারার সবুজাভ চোখের তারায় প্রত্যাশার আনন্দ ৷ ঊর্ধ্বমুখী ফুলের মতো আমার দিকে মুখ তুলে সে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় তিনি?

    বললাম, এই স্টুডিওতেই তিনি আছেন ৷

    বারবারা অধীর স্বরে বলল, এই স্টুডিওতেই আছেন? আমার ভাগ্য ভালো দেখছি! চলুন— আমাকে এখুনি তাঁর কাছে নিয়ে চলুন ৷

    বারবারা আমার দিকে এক পা এগিয়ে এল ৷

    বাধা দিয়ে বললাম, দাঁড়ান!

    আমার কণ্ঠস্বরে কী ছিল জানি না, বারবারা স্তব্ধ হয়ে থেমে গেল ৷

    বললাম, তার আগে একটা কথা আমার বলবার আছে ৷ আর্টিস্ট নিশীথ সেনের সঙ্গে আপনি দেখা করতে এসেছেন বটে, কিন্তু দেখা না করে ফিরে যাওয়াই ভালো ৷ যাবার সময় আপনার ছবিখানা আজই নিয়ে যেতে পারেন ৷

    বারবারা কয়েক মুহূর্ত আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে রইল ৷ তারপর বলতে লাগল, কেন একথা বলছেন? আর্টিস্ট নিশীথ সেনের সঙ্গে দেখা না করাটাই ভালো কেন? না-না-না, তা হতে পারে না, দেখা আমি করবই ৷ তাঁর সঙ্গে দেখা না করে আমার সানফ্রান্সিককো যাওয়া হতে পারে না!

    কেন বলুন তো? আপনার ছবিখানা কি মনোমতো হয়নি? কোনো ত্রুটি রয়ে গেছে?

    না-না, মোটেই তা নয় ৷ এমন চমৎকার পোর্ট্রেট আমি জীবনে কখনও দেখিনি ৷ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে, এ আমারই ছবি! আর্টিস্টকে আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই ৷

    বললাম, আপনার সে-কৃতজ্ঞতা আমি পৌঁছে দেব আর্টিস্টের কাছে ৷

    ধন্যবাদ ৷ কিন্তু আমি বড় আগ্রহ নিয়েই এসেছি ৷

    বেশ তো, আপনি ছবি ভালোবাসেন, এই স্টুডিওতে আর্টিস্টের আঁকা আরও ছবি রয়েছে ৷ এগুলো দেখে যান, আপনার আগ্রহ মিটতে পারে ৷

    অধীর স্বরে বারবারা বললে, শুধু সৃষ্টিই দেখে যাব? স্রষ্টাকে দেখে যাব না?

    স্রষ্টাকে দেখতে পাওয়া যায় না ৷ যেমন দেখতে পাওয়া যায় না বিধাতাকে ৷ রাত অনেক হল, আপনি ফিরে যান মিস স্মিথ ৷

    নিজের কণ্ঠস্বর আমার নিজের কানেই রূঢ় লাগল; বারবারার সবুজাভ চক্ষু ম্লান হয়ে এল ৷ ধীরে ধীরে শুভ্র হাত দুটি জোড় করে বুকের কাছে তুলে ধরল ৷ তার ডান হাতের মুঠির মধ্যে ছোট্ট একখানি নীল রুমাল— নীল পদ্মের একটি কুঁড়ির মতো ৷

    বারবারা বলতে লাগল, আপনি কে, তা জানি না ৷ যে-ই হোন, আপনাকে মিনতি করছি, চিত্রকরের সঙ্গে একবার দেখা করতে দিন ৷ আমি শপথ করছি, আমি তাঁর বেশি সময় নষ্ট করব না ৷ আপনি জানেন না, আমি আর্টিস্ট সেনের ছবির কতখানি অনুরাগিনী ৷ তাঁর আঁকা ছবি আমার কতখানি ভালো লাগে— তা বলে আমি বোঝাতে পারব না ৷ কলকাতা, প্যারিস, বার্লিন, রোম, পিকিং— পৃথিবীর যেখানে যেখানে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে, সব জায়গায় আমি ঘুরে এসেছি ৷ আর্টিস্ট সেন আমার কাছে দেবতা ৷ কত রাত্রে আমি তাঁর স্বপ্ন দেখি!

    বারবারার চোখ-মুখের ভাব আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ৷ কেননা, তার মুখের সামনে ছিল ঝোলানো আলোটা ৷ কিন্তু আমার মুখ তার দৃষ্টির সামনে অন্ধকার অস্পষ্ট ৷ আমি দাঁড়িয়েছিলাম ঝোলানো আলোটা পেছনে রেখে ৷— আমার এই আত্মগোপন যে ইচ্ছাকৃত— তা তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ প্রতুল!

    বারবারা তখনও মিনতির ভঙ্গিতে বলে চলেছে, দয়া করুন— আমাকে ফিরে যেতে বলবেন না— আর্টিস্ট সেনকে, আমার স্বপ্নের দেবতাকে একবার দেখেই আমি চলে যাব ৷ আমি শপথ করছি— ৷

    উত্তেজনায় বারবারার গাল দুটি রক্তাভ হয়ে উঠেছে ৷ ঘন নিশ্বাসে তার নাসারন্ধ্র, তার পীবর বক্ষ ফুলে ফুলে উঠছে ৷ বারবারা, সুন্দরী— সুতনু বারবারা বলছে, ‘আমি আর্টিস্ট সেনের অনুরাগিণী ৷ আমি তাঁর স্বপ্ন দেখি?’ মনে হল, আমি খুব দামি নেশা করেছি ৷ আর সেই নেশা আমার মাথার মধ্যে রিমঝিম করছে ৷

    তবুও কণ্ঠস্বর আরও রূঢ় করে বললাম, স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই স্মিথ ৷ তোমার স্বপ্নের দেবতার সঙ্গে আর্টিস্ট সেনের যদি কিছুমাত্র মিল না থাকে? যদি—যদি সে কুৎসিত হয়? যদি তার মুখের চেহারা হয় পশুর মতো, জানোয়ারের মতো কুৎসিত? তাহলে কি তুমি সহ্য করতে পারবে বারবারা? তার চেয়ে কাজ নেই দেখা করে ৷ তোমার সুন্দর স্বপ্ন, সুন্দর ধারণা নিয়ে ফিরে যাও ৷

    বারবারার মুখে-চোখে সন্দেহের ছায়া দেখা দিতে না দিতেই মিলিয়ে গেল ৷ পরম বিশ্বাসের সঙ্গে মৃদু হেসে বললে, ঈশ্বরের দোহাই, মিথ্যে দিয়ে আমায় ভোলাবার চেষ্টা করবেন না ৷ তারপর চারপাশের ছবিগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, যে মানুষ এমন অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে, সে কখনও কুৎসিত হয়? অসম্ভব! মুখের চেহারা তার সুন্দর হোক বা কুৎসিত হোক, আমার কাছে সে সৌন্দর্যের দেবতা হয়েই থাকবে! ঈশ্বরের দোহাই— আপনি বিশ্বাস করুন৷ রাত বোধ করি শেষ হয়ে এল, বলুন কোথায় আর্টিস্ট সেন?

    এইখানে— তোমার সামনে ৷

    যেন বহুদূর থেকে আমার গলার চাপা আওয়াজ ভেসে এল ৷ ধীরে ধীরে বারবারার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ৷ নীল রুমালখানি সমেত ডান হাতখানি মুখে চাপা দিয়ে সে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আমার দিকে ৷ তারপর আনন্দিত বিস্ময়ে বলে উঠল, তুমি-তুমি আর্টিস্ট সেন? আলোয় এসো— আমাকে দেখা দাও!

    আমার সামনে ছিল টেবিলের ওপর এই রিডিং-ল্যাম্প ৷ হাত বাড়িয়ে সেটা জ্বেলে দিলাম ৷

    শীতের ঝোড়ো হাওয়া দেবদারু-শাখায়-শাখায় সহসা চিৎকার করে উঠে স্তব্ধ হয়ে গেল ৷ সে-চিৎকার আসলে শীতের ঝোড়ো হাওয়ার নয়— সে-চিৎকার বারবারা স্মিথের! তাকিয়ে দেখি, তার পূর্বের ঈষৎ রক্তাভ কপোল যেন ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেছে ৷ দেহবল্লরী ঝড়ে দীপশিখার মতো কাঁপছে ৷ আর, আধো-নিমীলিত সবুজাভ চক্ষু দুটি আমারই মুখের পানে স্থির-নিবদ্ধ হয়ে ক্রমশ বিস্ফারিত হচ্ছে! অকস্মাৎ দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে উঠলে যেমন হয় ৷

    কয়েক মুহূর্ত মৃত্যুর মতো শীতল স্তব্ধতা ৷

    তারপর নীল রুমালখানি সমেত দুই হাতে চোখ ঢেকে বারবারা আতঙ্ক-বিহ্বল কণ্ঠে বলে উঠল, না-না-না, এ হতে পারে না— তুমি আর্টিস্ট সেন নও, কিছুতেই তুমি আর্টিস্ট হতে পারো না ৷ আর্টিস্ট যে, সে সৌন্দর্যের পূজারি— সে সুন্দরের প্রতিনিধি ৷ সে কখনও এমন হতে পারে না— এ আমি কী দেখলাম! কাকে দেখলাম ৷ কাকে দেখলাম!

    গলা দিয়ে আমার প্রত্যুত্তর বেরিয়ে এল, তুমি আর্টিস্ট সেনকে দেখেছ— তুমি যার অনুরাগিনী— তুমি যার স্বপ্ন দেখ, যে তোমার কাছে দেবতা…

    কিন্তু—কিন্তু এত কুৎসিত মানুষ হয়?— ধীরে ধীরে বারবারা চোখ থেকে হাত নামাল ৷ তার আঙুলগুলো ছোট ছোট প্রদীপের শিখার মতো তখনও কাঁপছে ৷

    বললাম, তার আগে বলো তো বারবারা, যে মানুষ এত সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে, তার দৈহিক আকৃতি যেমনই হোক না কেন, তাকে কি তুমি কুৎসিত বলবে? বলো— এ প্রশ্ন একটু আগে তুমিই করেছিলে— তুমিই এর জবাব দাও ৷

    কোনো জবাব এল না ৷ বারবারার পাণ্ডুর মুখখানি সন্ধ্যার পদ্মের মতো ধীরে ধীরে নত হল ৷

    কেমন যেন একটা চাপা আবেগ আমার মধ্যে দুরন্ত উচ্ছ্বাসে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল ৷ যে-কথা কোনোদিন কাউকে জানাইনি, যে-কথা গোপনে একদিন আমার তপ্ত যৌবনের রক্তের মধ্যে গুমরে বেড়াচ্ছিল, সেই কথা আজ ঝোড়ো শীত-রাত্রির অদ্ভুত অবাস্তব পরিবেশের মাঝে আমার মুখ দিয়ে অনর্গল জল-কল্লোলের মতো বেরিয়ে আসতে চাইল ৷ আমি বলতে লাগলাম, আমি জানি বারবারা, আমায় দেখে তুমি ভয় পেয়েছ— মনে মনে পেয়েছ প্রচণ্ড আঘাত ৷ কিন্তু আমি কি তোমাকে আগেই বলিনি যে, তুমি ফিরে যাও? বলি নি কি, আমায় দেখলে তোমার ধারণা, তোমার স্বপ্ন নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে? তবু কেন তুমি দেখতে চাইলে? কেন তোমার সুন্দর স্বপ্ন— সুন্দর ধারণা নিয়ে এমনিই ফিরে গেলে না? বারবার নিষেধ সত্বেও কেন তুমি আমাকে দেখতে চাইলে? কেন— কেন? শুধু বুকজোড়া ঘৃণা আর অবহেলা দিয়ে ফিরে যাবে বলে? কিন্তু কী আমার অপরাধ বলতে পারো বারবারা যে, তোমার মতো সুন্দরী মেয়েদের কাছে শুধু ঘৃণা আর উপেক্ষার পাত্র হয়ে থাকব? পশুর মতো আমার এই আকৃতির জন্যে আমি তো দায়ী নই? দায়ী সেই বিধাতা, যে নিষ্ঠুর খেয়ালের বশে আমাকে এমনি কদাকার করে গড়েছে— আমার ভিক্ষার অঞ্জলিতে যে কৃপণ বিধাতা রূপের একটি কণাও দান করেননি!

    বলতে বলতে নিষ্ফল অভিমানের তপ্ত অশ্রুধারা কখন যে আমার গালের ওপর দিয়ে গড়িয়ে এসেছে, আমি তা টের পাইনি ৷ বারবারা সহসা মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কাঁদছেন?

    বারবারার আতঙ্ক-পাণ্ডুর মুখ সহানুভূতিতে কোমল হয়ে এল ৷ লক্ষ করলাম, পুরুষের অশ্রু নারীর অন্তর আজও স্পর্শ করে ৷ বারবারা থেমে থেমে কোমল গলায় বলতে লাগল, আমি-আমি ক্ষমা চাইছি ৷ তোমাকে দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম সত্যি, কিন্তু বিশ্বাস করো, ঘৃণা আমি তোমাকে করিনি ৷ যে শ্রদ্ধা, যে অনুরাগ নিয়ে আমি এসেছিলাম, এখনও আমি তা হারাইনি ৷

    কিন্তু সে-শ্রদ্ধা, যে-অনুরাগ কার প্রতি?— প্রশ্ন করলাম?

    তোমার প্রতি— ঈশ্বরের দোহাই বলছি—

    চুপ করো! ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে মিথ্যে কথা বোলো না বারবারা ৷— আগ্নেয়গিরির মুখ দিয়ে যেমন করে লাভাস্রোত বেরিয়ে আসে, তেমনি করে আমার এতদিনের রুদ্ধ জ্বালামুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, আমি জানি— আমি জানি বারবারা, তোমার অনুরাগ, তোমার শ্রদ্ধা আমার জন্যে নয়— আর্টিস্ট সেনের জন্যে, যে তোমার পোর্ট্রেট এঁকেছে, দেশ-বিদেশের প্রদর্শনীতে যে বহু পুরস্কার পেয়েছে ৷ তারই জন্যে তোমার মতো সুন্দরীর অনুরাগ— তারই জন্যে শীতের এই দুর্যোগ-রাত্রেও তোমার অভিসার! তাই নয় কি? আমি বুঝতে পেরেছি বারবারা, আর্টিস্ট সেনকে না দেখেই তুমি ভালোবেসেছ ৷ আর এ-ও তুমি জেনে রাখো, ঠিক এই কারণেই আর্টিস্ট সেনকে আমি হিংসা করি— আমি তাকে ঘৃণা করি— ভয়ানক ঘৃণা করি ৷ আর্টিস্ট সেন আমার শত্রু— পরম শত্রু ৷ আমাকে সে চিরদিন বঞ্চিত করেছে— সুন্দরী নারীর সঙ্গ থেকে, যৌবনের কামনা থেকে, বহু অনুরাগিনীর ভালোবাসার থেকে ৷ যা আমার হতে পারত, তা হরণ করে নিয়েছে ওই আর্টিস্ট সেন! আর্টিস্ট সেন যদি দ্বিতীয় কোনো পুরুষ হত বারবারা, আমি শপথ করে বলছি, আজ এই মুহূর্তে তাকে আমি দুই হাত দিয়ে গলা টিপে খুন করে ফেলতাম!

    আতঙ্কিত বারবারা অস্ফুট আওয়াজ করে এক পা পিছিয়ে গেল ৷ আর সেই সময় হু-হু শব্দে শীতের ঝোড়ো হাওয়া খোলা জানলা-পথে ঢুকে এল ঘরের মধ্যে ৷ দুলতে লাগল ঝোলানো বাতিটা, সজীব হয়ে উঠল হলের দেওয়ালে-দেওয়ালে বিচিত্র সব ছায়ামূর্তি—আমাদেরই দীর্ঘ ছায়ামূর্তি ৷

    আতঙ্ক বিবশা বারবারা বলতে লাগল, একী বলছ তুমি?… আমি আর শুনতে পারছি না! রাত শেষ হয়ে এল, কাল ভোরে আমার জাহাজ ছাড়বে— আমায় যেতে দাও— আমি যাই—

    ত্রস্ত ব্যাকুল হাতে বারবারা তার টুপি আর ফার-কোট তুলে নিল ৷ তারপর ‘শুভ্ররাত্রি’ বলে দরজার দিকে এগোল৷

    দাঁড়াও! —আমার গলা দিয়ে যেন একটা চিৎকার বেরিয়ে এল ৷

    যন্ত্রচালিতের মতন বারবারা ফিরে দাঁড়াল ৷

    টেবিলের ওপর থেকে দরজার চাবিটা তুলে নিলাম ৷ তারপর তাকে পার হয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বললাম, রাত্রি আজ শুভ নয় বারবারা— তোমার পক্ষে নয়, আমার পক্ষেও নয় ৷

    বারবারা যেন কান্নায় ভেঙে পড়ল,— না, না, ওকথা বোলো না ৷ তারপর কম্পিত হাত কপালে-বুকে ঠেকিয়ে ক্রশ-চিহ্ন আঁকতে আঁকতে বললে, আমি যাই—আমি যাই—

    দরজায় পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে দুই পাশে দুই হাত প্রসারিত করে বললাম, কোথায় যাবে? যাওয়া আজ তোমার হবে না বারবারা ৷

    বিস্ফারিত দুই চোখে তাকিয়ে বারবারা বলে উঠল, হবে না! সানফ্রান্সিসকোর জাহাজ জেটিতে অপেক্ষা করছে যে!

    তুমি না গেলেও সে-জাহাজ ঠিক সময়ে ছাড়বে— আর ঠিক সময়েই সানফ্রান্সিসকোয় পৌঁছে যাবে ৷ বৃথা চিন্তিত হোয়ো না বারবারা ৷

    অকস্মাৎ উৎকট একটা চাপা হাসি আমার গলা দিয়ে যেন ফেটে বেরিয়ে এল ৷ সে-হাসি হলের খিলানে খিলানে ধাক্কা খেয়ে, ঝড়ের গোঙানির সঙ্গে মিশে ঘরময় ঘুরপাক খেতে লাগল ৷ সেই বিশ্রী ভয়াবহ আওয়াজ সহ্য করতে না পেরে বারবারা দুই হাতে কান চেপে ধরল ৷ তারপর ভীত কাতর স্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল, ঈশ্বরের দোহাই, চুপ করো— তুমি চুপ করো ৷ যেতে দাও— আমায় যেতে দাও— তোমার কাছে ভিক্ষে চাইছি—

    নীল রুমাল সমেত হাত দুটি জোড় করে বারবারা আমার মুখের পানে তাকিয়ে রইল ৷

    আমি তার দিকে এক-পা এগিয়ে এলাম ৷ বললাম, ভিক্ষা পেতে হলে আগে ভিক্ষা দিতে হয় বারবারা ৷ আমিও কাঙালের মতো তোমার মুখের পানে তাকিয়ে আছি, তোমার ভালোবাসার প্রসাদে কখন আমার অঞ্জলি তুমি ভরে দেবে, সেই আশায় ৷

    কেন তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ না?—বারবারা সঘন নিশ্বাসে যেন হাঁপিয়ে উঠল ৷— আর্টিস্ট সেনকে আমি মনে মনে যা দিয়েছি, সে কি তোমারই উদ্দেশে দেওয়া নয়?

    না—না—না, সে তুমি আমাকে দাওনি বারবারা ৷ সে তুমি দিয়েছ তোমার স্বপ্নের সুন্দরকে—আমার মতো কুৎসিত পুরুষকে নয় ৷ কিন্তু কুৎসিত হলেও আমিও কি পুরুষ নই—যে পুরুষ যুগে যুগে সুন্দরী নারীকে আপন অন্তরের সিংহাসনে রানির মতো নিরুপমা করে বসিয়ে রেখেছে? আমারও জীবনে কি সেই সাধ, সেই আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে না বারবারা? আমারও কি ভালোবাসবার আর ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা নেই মনে করো? কুৎসিত পশুও ভালোবাসতে পারে, আর কুৎসিত মানুষ পারে না?

    সঘন নিশ্বাসের সঙ্গে বারবারা শুধু এই কথাই বলতে লাগল, যেতে দাও—আমাকে যেতে দাও—

    তার মুখের পানে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, প্রাণপণ চেষ্টায় সে উগরে-ওঠা ঘৃণাকে দমন করতে চাইছে—যাতে আমি টের না পাই ৷ তবু সেই ঘৃণা—কুৎসিতের প্রতি তিক্ত ঘৃণা তার সবুজাভ চোখের তারায়, মুখের প্রত্যেকটি পেশিকুঞ্চন থেকে কালো বিষের মতো ঝরে পড়ছে ৷ চকিতে নিজের চেহারাটা যেন অদৃশ্য আর্শিতে দেখতে পেলাম ৷ দেখতে পেলাম গরিলার মতো মুখাকৃতি, থ্যাবড়া নাক আর বিশ্রী পুরু ঠোঁট ৷ অকস্মাৎ মনে হল, একটি বারবারা যেন শত শত সুন্দরী বারবারা হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তিক্ত ঘৃণাভরে উপেক্ষার হাসি হাসছে ৷ আর দেখতে দেখতে তাদের সেই সমবেত কণ্ঠের তীক্ষ্ণ খলখল অট্টহাসি, তিক্ত ঘৃণার কুটিল ভ্রুভঙ্গি, তিক্ত বিষের ক্রিয়ার মতো আমার সর্বাঙ্গে আগুনের জ্বালা ধরিয়ে দিল ৷

    আমি বলতে লাগলাম—আমার নিজের কানেই আমার আওয়াজ অজগরের হিসহিস শব্দের মতো শোনাতে লাগল : শোনো বারবারা, রাত আর অল্পই বাকি আছে, তবু আজ রাত্রে তোমার যাওয়া হতে পারে না! যেতে যদি হয়, আমার পাওনা মিটিয়ে দিয়ে যেতে হবে ৷

    বারবারা তার ফার-কোটের পকেট থেকে একটা নোট-কেস বার করলে ৷

    বাধা দিয়ে বললাম, থামো! আজ রাতে তোমার কাছে আমার যা পাওনা, তা টাকা দিয়ে মিটিয়ে দেওয়া যায় না ৷ পাওনা মেটাতে হলে তোমায় নিজেকে দিতে হবে ৷

    এবার দলিতা সাপিনীর মতো মাথা উঁচু করে বারবারা বলে উঠল, কী বলছ তুমি?

    ঠিকই বলছি ৷—বাধা দিয়ে তাকে থামিয়ে বললাম, মিথ্যে হলেও আজ তোমাকে বলে যেতে হবে, তুমি আমারই অনুরাগিনী ৷ থাক তোমার স্বপ্নের আর্টিস্ট সেন তোমার অনুরাগ-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা নিয়ে, ওসব ভালো ভালো জিনিসের ওপর আর লোভ করব না বারবারা ৷ শুধু জেনে রাখো, আজ রাতে আমি আর্টিস্ট নই, আমি গুণী নই, আমি শুধু পুরুষ—চিরন্তন পুরুষ—আমার প্রেম, আমার পৌরুষকে তুমি অস্বীকার করে যেতে পারবে না ৷

    পঙ্গুর মতো বারবারা আস্তে আস্তে সোফার ওপর বসে পড়ল ৷

    সেই দিকে তাকিয়ে কেমন একটা অস্থির উল্লাসে আমি বলে যেতে লাগলাম, সারাজীবন বঞ্চিত থাকার পর ভাগ্য আজ তোমাকে এনে দিয়েছে বারবারা ৷ এ সুযোগ আমি ছাড়ব না! আমার জীবনে এ সুযোগ হয়তো এই প্রথম—হয়তো এই শেষ ৷

    পাথরের মতো ভাবলেশহীন চোখে বারবারা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল ৷ চোখে পলক পড়ছে না, দেহ স্থির ৷ যেন মৃতদেহ কথা কইছে, এমনি করে শুধু ঠোঁট নেড়ে বারবারা হঠাৎ বলে উঠল, ভাগ্য যদি আমায় এনে দিয়ে থাকে, তবে আজ ভাগ্য-পরীক্ষা করো ৷

    ভাগ্য-পরীক্ষা ৷

    হ্যাঁ, যদি তোমার জিৎ হয়, তোমার প্রাপ্য তুমি পাবে ৷

    জিজ্ঞাসা করলাম, আর যদি আমি হারি?

    জবাব এল, ভাগ্যকে দোষ দিয়ে আমার পথ থেকে চিরদিনের মতো তুমি সরে যাবে ৷—রাজি আছ ভাগ্য-পরীক্ষায়?

    এক মুহূর্ত চুপ করে রইলাম ৷ ভাগ্যের জুয়াখেলায় কী হবে আমার? হার না জিৎ? … হার না জিৎ? … হার না জিৎ? কেমন যেন একটা নেশা আমায় পেয়ে বসল ৷ যদি জিৎ হয়, তবে আমার পুরস্কার ওই সুন্দরী — বারবারা—সুতনু, সুমধ্যমা, সুদীপ্তযৌবনা ৷ আমার নিঃসঙ্গ জীবনের, আমার বঞ্চিত জীবনের—

    কিন্তু ভাগ্যের পাশাখেলায় মন্দভাগ্য পাণ্ডবদের মতো যদি আমার হার হয়? না, না, হার হবে কেন? হার হবে না—আমার হার হতে পারে না ৷ … বারবার আমার মনে হতে লাগল, আমার জিৎ হবেই—আমার জিৎ হবেই! আবার মনটা দুলে উঠল—যদি জিৎ না হয়, যদি শেষ পর্যন্ত হেরে যাই? বারবারার পথ থেকে চিরদিনের মতো আমাকে সরে যেতে হবে? মুহূর্তে শরীরের সমস্ত রক্তস্রোত যেন ঊর্ধ্বমুখী হয়ে গেল ৷ মধুর সুধার পাত্র মুখের কাছে এগিয়ে ধরে ভাগ্য আবার তা কেড়ে নেবে? না, তা হতে পারে না ৷ কেড়ে নিতে আমি দেব না ৷ বারবার আমার মন, আমার যৌবনের সমগ্র চেতনা যেন লক্ষ করতাল বাজিয়ে বলতে লাগল, এ খেলায় জিৎ আমার হবেই ৷ ক্রমশ সেই নেশাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে আমার শিরা-স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ৷

    রুদ্ধ নিশ্বাসে বলে উঠলাম, রাজি আছি—আমি রাজি আছি ৷

    বারবারার সবুজাভ চোখের তারা দুটি হীরার টুকরোর মতো ঝকঝক করে উঠল ৷ দেখতে দেখতে তার আইভরির মতো পাণ্ডুর মুখ রক্তোচ্ছ্বাসে রাঙা হয়ে উঠল ৷ কতকটা স্বগতোক্তির মতোই সে বলে উঠল, রাজি আছো! বেশ, তাহলে শুরু হোক আমাদের ভাগ্যপরীক্ষা ৷ তাস আছে?

    আছে ৷

    আনো ৷

    এক মুহূর্ত চিন্তা করে স্টুডিয়োর দরজায় চাবি দিলাম ৷ তারপর পাশের ছোট ঘর থেকে তাস আনতে গেলাম ৷ তুমি তো জানো প্রতুল, অবসর যাপনের জন্যে একজোড়া তাস আমার স্টুডিয়োতে এনে রেখেছি ৷ কতদিন সন্ধ্যায় তুমি আসোনি, একা একা পেশেন্স খেলে কাটিয়েছি ৷

    পাইপ মুখে বসে বসে প্রতুল এতক্ষণ নিঃশব্দে স্বপ্ন-কাহিনি শুনে যাচ্ছিল ৷ ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় মুখখানা তার অস্পষ্ট হয়ে গেছে ৷ সেই ধূম্রজালের আড়াল থেকে আওয়াজ ভেসে এল, হুঁ, তারপর?

    নিশীথ আবার শুরু করলে:

    তারপর এই টেবিলের মুখোমুখি বসলাম দুজনে ৷ শুরু হল ভাগ্যের জুয়াখেলা ৷ তাসগুলো বারবারা উল্টো করে আমার সামনে বিছিয়ে দিল ৷ তারপর নিজের একখানা টেনে নিয়ে আমাকে বললে, নাও ৷

    টেনে নিলাম একখানা তাস—রুইতনের সাহেব ৷ বারবারা তার হাতের তাসখানা দেখাল—ইস্কাবনের নওলা ৷ বললে, তুমি ‘ডিল’ করো ৷

    জিজ্ঞাসা করলাম, ক’দান খেলতে চাও?

    বারবারা বললে, তিন দানই যথেষ্ট ৷

    প্রথমবার আমি ‘ডিল’ করলাম ৷ একখানা করে তিনবার ৷ বারবারা তার তাসগুলি টেবিলের ওপর চিত করে মেলে ধরল ৷ হরতন আর চিড়েতনের টেক্কা, আর রুইতনের বিবি ৷

    এবার আমার পালা ৷ উপুড় করা তিনখানা তাস তুলতে গিয়ে আমার আঙুলগুলো একবার কেঁপে উঠল ৷ এ তিনখানা তাসের উল্টো পিঠে আমার ভাগ্যের কী ফলাফল লেখা আছে, কে জানে!

    এক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইলাম ৷

    বারবারা বললে, তোমার তাস দেখাও ৷

    আঙুলে যেন জোর করে শক্তি এনে আমার তাস তিনখানা উল্টে দিলাম ৷ ইস্কাবনের আট-নয়-দশ!

    উল্লাসে চিৎকার করে উঠলাম, দান আমার!

    বারবারার মুখ আবার বিবর্ণ হয়ে এল ৷ অস্বাভাবিক শান্ত গলায় সে শুধু বললে, দ্বিতীয় দানের তাস দাও ৷

    বাহান্নখানা তাস ভেঁজে দ্বিতীয়বার তাস দিলাম ৷ বারবারা এবার তার তাস তিনখানা স্পর্শ করে বিড় বিড় করে কী যেন বললে ৷ তারপর ধীরে, অতি ধীরে একখানা করে তাস উল্টে ধরল ৷ তিনখানা বিবি—ইস্কাবন, রুইতন আর হরতন ৷ তারপর আমার দিকে তাকাল ৷

    এক নিমেষে আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল ৷ বললাম, ভাগ্য এবার তোমার প্রতি কৃপা করেছে দেখছি ৷ বিবির ট্রায়ো তুলেছ ৷ কিন্তু আমিও যদি সাহেবের ট্রায়ো তুলি?

    বটে! তোমার ভাগ্য আরও ভালো বলব ৷—বারবারার ওষ্ঠ প্রান্তে সুতীক্ষ্ণ একটু হাসি দেখা দিল ৷ সে কি তিক্ত ব্যঙ্গ?

    আমার তাস তিনখানা তুলে সশব্দে টেবিলের ওপর মেলে ধরলাম ৷ না, সাহেবের ট্রায়ো নয় ৷ সাহেব মাত্র একখানা, বাকি দু’খানা পাঁচ আর চার ৷ এবারের দান আমার নয়—বারবারার ৷

    সমস্ত তাসগুলো কুড়োতে কুড়োতে অত্যন্ত শান্ত গলায় বারবারা বললে, তোমার জন্যে আমি দুঃখিত, সেন ৷

    মাথার ভেতরটা আমার দপ দপ করে উঠল ৷ উত্তপ্ত রূঢ় গলায় বললাম, চুপ করো! আমার জন্য দুঃখিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই তোমার ৷

    বারবারার ওষ্ঠপ্রান্তে সেই সুতীক্ষ্ণ হাসি আবার ঝিলিক দিয়ে উঠল ৷ তাসগুলো ভাঁজতে ভাঁজতে আরও শান্ত গলায় সে শুধু বললে, এবার শেষ বাজির খেলা ৷

    সহসা লক্ষ মৌমাছির একটানা গুঞ্জনের মতো কথাগুলো আমার মাথার মধ্যে ক্রমাগত বাজতে লাগল: ‘শেষ বাজির খেলা!’ ‘শেষ বাজির খেলা!’ শেষ বাজি কার? আমার না বারবারার? শরীরের সমস্ত রক্ত উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে উঠতে লাগল ৷

    এক, দুই, তিন—বারবারার তাস দেওয়া হয়ে গেল ৷ আগের মতোই সে তাসগুলি স্পর্শ করে মুদিত চক্ষে বিড় বিড় করে কী যেন বললে ৷ তারপর তাস তিনখানা উল্টে দিল ৷ সেই দিকে তাকিয়ে আমার চোখ দুটো পাথরের মূর্তির চোখের মতো পলকহীন হয়ে গেল ৷ বারবারা যে দান তুলেছে, তার চেয়ে বড় দান আর হয় না ৷ তুলেছে তিনখানা টেক্কা—ইস্কাবন, হরতন, আর চিড়েতনের ৷

    এক মুহূর্তের জন্য আমার হৃৎস্পন্দন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল ৷ শেষ পর্যন্ত এই হল? শেষ বাজির খেলায় ভাগ্য আমাকেই ছলনা করল?

    তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতো বারবারার শান্ত-কঠিন কণ্ঠস্বর আমার কানে এসে বিঁধল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, শেষ বাজি আমারই ৷

    অন্ধ আক্রোশে আমার তাসগুলো তুলে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলতে যাচ্ছিলাম ৷ কিন্তু একী!— আমার বরফের মতো ঠান্ডা থেমে-যাওয়া হৃৎপিণ্ড হঠাৎ যেন তপ্ত রক্তস্রোতে ফের খরবেগে চলতে শুরু করল ৷

    সেই শাণিত ব্যঙ্গের হাসি হেসে বারবারা বলে উঠল, তোমার তাসগুলো অনর্থক দেখে লাভ কী, সেন? তিনখানা টেক্কার চেয়ে বড় দান আর হয় না—আশা করি, তা তোমার জানা আছে ৷ ভাগ্যের এই ঠাট্টাটুকু সহজভাবে নিতে চেষ্টা করো, সেন ৷

    ফার-কোট আর টুপি নিয়ে বারবারা উঠতে যাচ্ছিল ৷ বললাম, বসো ৷ ভাগ্য আমাকে ঠাট্টা করেনি, করেছে তোমাকে ৷

    বারবারা জিজ্ঞাসু চোখ তুলে তাকাল ৷ আমার হাতের তাসগুলো গুনে দেখলাম ৷ এক, দুই, তিন, চার ৷

    এবারে হাসবার পালা আমার ৷ বললাম, শেষ বাজির খেলাটা আসলে খেলাই হয়নি ৷ উত্তেজনায় তাস তোমার দিতে ভুল হয়েছে বারবারা ৷ তিনখানার বদলে আমাকে চারখানা দিয়ে ফেলেছ ৷ সুতরাং এবারের খেলা নাকচ ৷—তারপর আমার কুৎসিত মুখে বীভৎস হাসি ফুটিয়ে থেমে থেমে বললাম, ভাগ্যের এই ঠাট্টাটুকু সহজভাবেই নিতে চেষ্টা করো সুন্দরী বারবারা!

    বারবারার মুখ দেখতে দেখতে সাদা হয়ে গেল ৷ প্রবল চেষ্টায় নিজেকে সামলে নিয়ে সে শুধু বললে, বেশ, আবার নতুন করে খেলা শুরু হোক ৷

    ঝড়ে যেমন দেবদারুর কচি শাখা কাঁপে, তেমনি কম্পিত হাত বাড়িয়ে বারবারা তাসগুলো কুড়িয়ে নিতে গেল ৷ কিন্তু তার আগেই আমার কালো কর্কশ মুঠির মধ্যে তার হাতখানা ধরে ফেলে বললাম, না, আর খেলা হবে না ৷

    বারবারার মুখ-চোখ, সমস্ত দেহ পলকের মধ্যে আড়ষ্ট হয়ে উঠল ৷ কঠিন কণ্ঠে সে বললে, শেষ খেলা খেলতেই হবে সেন, নইলে ভাগ্যের সঙ্গে বোঝাপড়া হবে না ৷

    বললাম, তার আগে আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করো বারবারা ৷

    হাত ছাড়ো—তাস দিতে দাও—

    না ৷

    হাত ছেড়ে দাও বলছি—

    না—না—না!

    ঘরের ভেতর পুরুষ ও নারীর এই চিরন্তন দ্বন্দ্বের মাঝখানে বাইরের ঝড়ের বেগ কখন যে বেড়ে উঠেছিল, খেয়াল করিনি ৷ হঠাৎ হু-হু করে ক্ষুব্ধ আত্মার আক্ষেপের মতো শীতল দমকা হাওয়ার ঝলক খোলা জানলা-পথে এসে টেবিলের ওপর থেকে তাসগুলোকে এক ফুঁয়ে ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে গেল ৷ প্রবলভাবে দুলতে লাগল ঝোলানো বাতিটা, আর বিচিত্র ঢেউয়ে প্রকাণ্ড হলটা যেন প্রেতরাজ্যের গুহার রূপ ধারণ করল ৷

    সঘন নিশ্বাসে বারবারার পীবর বক্ষ, দুই নাসারন্ধ্র ফুলে ফুলে উঠছে ৷ চোখের তারায় শিহরিত আতঙ্ক আর তিক্ত ঘৃণায় মেশানো অদ্ভুত দৃষ্টি ৷ আর আমার মনে হতে লাগল, কোনো এক তীব্র উত্তেজক ওষুধের প্রতিক্রিয়ার ফলে আমার প্রত্যেকটি অণু-পরমাণু যেন ক্রমশ বদলে যাচ্ছে ৷ ডাঃ জেকিল যেন মিঃ হাইডে পরিণত হচ্ছে ৷

    কী চাও তুমি?—দম নিয়ে বারবারা জিজ্ঞাসা করল ৷

    কালো কর্কশ মুঠির মধ্যে ধরা সুন্দর মসৃণ হাতখানা আকর্ষণ করতেই, টেবিল পার হয়ে আচমকা বারবারা আমার বুকের ওপর এসে পড়ল—একরাশ পপি ফুলের স্তবকের মতো ৷ তেমনি সুরভিত, তেমনি মদির, তেমনি মোহময় ৷ ললিতযৌবনা নারীদেহের চক্ষে, অধরে, মোহময় রূপে আর মায়াময় স্পর্শে চিরকালের যে বিচিত্র ইন্দ্রজাল, তার নেশায় আমার বন্য বর্বর যৌবন মাতাল হয়ে উঠল ৷ আর সেই নেশা আকণ্ঠ পান করে মিঃ হাইড অপরূপযৌবনা বারবারার কানে কানে বলতে লাগল, কী চাই? তুমি কি জানো না বারবারা, তোমার কাছে আমি কী চাই? চাই তোমার এতটুকু ভালোবাসা, করুণা আর কোমল দৃষ্টি—পরিণামে যদি তোমার রূপের আগুনে লোভী পতঙ্গের মতো আমি নিঃশেষে পুড়ে ছাই হয়ে যাই, তবুও—

    বারবারার সবুজাভ চোখের তারায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠল ৷ প্রবল বিতৃষ্ণায় তার মুখের পেশিগুলো কুঁচকে গেছে ৷ হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে সে বলে উঠল, তোমার কি নরকের ভয় নেই?

    বিশ্রী বীভৎস একটা হাসির আওয়াজ আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল ৷ বললাম, তুমি যদি নরক হও বারবারা, তবে সে আমার স্বর্গের চেয়েও—

    কথা আমার শেষ হল না ৷ তার আগেই আমার মুখময় থুতু ছিটিয়ে এক ঝটকায় নিজেকে টেনে নিয়ে বারবারা দূরে সরে গেল ৷

    তারপর—

    তারপর শুরু হল শিকারি আর শিকারে দ্বন্দ্বের খেলা ৷ এধার থেকে ওধার, এ- কোণ থেকে ও-কোণ ৷ কেবলই ধরতে চাওয়া—আর এড়িয়ে যাওয়া ৷ একজনের আক্রমণ, আর একজনের আত্মরক্ষা ৷ উল্টে গেল সোফা, ভেঙে পড়ল টেবিল, টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল কত মূর্তি আর ছবি ৷ একটা চীনে ফুলদানীর টুকরো লেগে রক্তাক্ত হল আমার কপাল, আর নখের আঘাতে বারবারার ছিঁড়ল নীল বক্ষবাস ৷ কনকনে শীতের রাত্রেও কপালে দেখা দিয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সঘন নিশ্বাসে দম যেন প্রতি মুহূর্তে ফুরিয়ে আসছে ৷ শিকারি আর শিকারের এ খেলা যেন কোনোদিনও আর শেষ হবে না!

    ঝড়ের বেগ ক্রমশ বাড়ছে ৷ বিপুল আক্ষেপে দেবদারুর শাখাগুলি যেন বুক চাপড়ে উঠছে ৷ ঝোলানো বাতিটা বিষম দোলায় এবার বুঝি ছিঁড়ে পড়বে ৷

    বিপর্যস্ত পরিশ্রান্ত বারবারা তখন হলের ডান দিকের কোণে একটা ভাঙা মূর্তি ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ ডান হাতে সেই নীল রুমালখানি দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে, বাঁ-হাতে ছিন্ন বক্ষবাস ধরা ৷ যেন ঝড়ে ছিন্নপাখা একটি শ্বেত-কপোতী ত্রস্ত হয়ে ঘরের কোনায় আশ্রয় নিয়েছে ৷ পুঞ্জ পুঞ্জ রূপ যেন মহাকালের অত্যাচার সহ্য করেও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷

    ক্লান্ত করুণ ভঙ্গিতে বারবারা দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা মূর্তিটার পাশে ৷ দেখে মনে হল, এই প্রাচীন গির্জার মধ্যে কোনো তপস্বিনী শেষ প্রার্থনার মতো তার শেষ মোমের বাতিটি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে!

    দেখতে দেখতে আমার মধ্যে সেই তীব্র উত্তেজক মাদকতার প্রভাব ফুরিয়ে আসতে লাগল ৷ শুরু হয়ে গেল তার উল্টো প্রতিক্রিয়া ৷ মরে গেল বর্বরযৌবন পশুপ্রবৃত্তি হাইড, আবার বেঁচে উঠল আর্টিস্ট সেন—সুন্দরের উপাসক, শিল্পী! ভুলে গেলাম সব ৷ ভুলে গেলাম এতক্ষণের দ্বন্দ্ব, কিছুক্ষণ আগেকার সেই নরকের আবহাওয়া ৷ আমার নির্নিমেষ চোখের সম্মুখ থেকে ক্রমশ মুছে গেল পৃথিবীর যা কিছু কুৎসিত, যা কিছু অসুন্দর— জেগে রইল শুধু হলের কোণে ভাঙা মূর্তির পাশে পরিশ্রান্ত বিপর্যস্ত রূপসি বারবারার অপূর্ব করুণ ভঙ্গিমা, ক্যানভাস আর রং-তুলি ৷ পাগলের মতো একখানা নতুন ক্যানভাস ইজেলের ওপর টাঙিয়ে ক্ষিপ্র হস্তে স্কেচ করতে করতে আমি বলে উঠলাম, ঈশ্বরের দোহাই বারবারা, নোড়ো না—যতক্ষণ না আমার আঁকা শেষ হয়, ঠিক অমনি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকো ৷ আজ আমি যে ছবি আঁকব, সেই হবে আমার শিল্পীজীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ৷ এ সুযোগ আমাকে দাও বারবারা ৷ ঈশ্বরের দোহাই, তুমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো ৷

    ক্ষিপ্রবেগে হাত চলতে লাগল আমার ৷ জীবনে এত দ্রুত আমি আর আঁকিনি ৷ প্রত্যেকটি রেখার অপূর্ব ব্যঞ্জনা ফুটে উঠতে লাগল ৷ শিল্পী নিশীথ সেনের এই শ্রেষ্ঠ কীর্তি হয়তো অমর হয়ে থাকবে জগতে ৷

    রাত শেষ হয়ে আসছে ৷ ঝড়ের বেগ এসেছে কমে ৷ স্কেচ সম্পূর্ণ হতে এখনও আর একটু বাকি ৷ বললাম, আর একটু—আর একটু সময় দাও বারবারা ৷ ভোরের আগেই ছবি আমার শেষ হয়ে যাবে ৷

    ক্যানভাস থেকে চোখ তুলে তাকাতেই—কোথায়? কোথায় বারবারা? ভাঙা মূর্তি] পাশ থেকে কোথায় হারিয়ে গেল তার সেই অপরূপ মূর্তি?

    বিভ্রান্ত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই ঝলমলে নীল রেশমি গাউনটা চোখে পড়ল ৷ উত্তর দিকের খোলা জানলা টপকে বারবারা তখন পালাবার চেষ্টা করছে ৷ চিৎকার করে বললাম, যেও না বারবারা—আর একটু সময় আমাকে দাও ৷ বিশ্বাস করো, আর কোনো ভয় নেই তোমার ৷ কাজ আমার সামান্যই বাকি, তারপর নিজের হাতে আমি দরজা খুলে দোব৷ সানফ্রান্সিসকোর জাহাজ ছাড়তে এখনও সময় আছে বারবারা—যেও না তুমি—

    বারবারা তখন পালাবার জন্যে জানলার ওপর উঠে পড়েছে ৷ হাতের তুলি ফেলে দিয়ে পাগলের মতো ছুটে যেতে যেতে ডাকলাম, ঈশ্বরের দোহাই বারবারা, তোমার দোহাই, চলে যেও না—আমার শ্রেষ্ঠ কীর্তি এভাবে নষ্ট হতে দিও না—

    তার কাছে পৌঁছবার আগেই বারবারা লাফিয়ে পড়ল বাইরের বাগানে ৷

    .

    আবার ডাকলাম, যেও না বারবারা—

    জানলার বাইরে কুয়াশা আর অন্ধকারে মাখামাখি ৷ তারই মধ্যে শুধু শোনা গেল পলাতকার পায়ের আওয়াজ ৷

    মাথার মধ্যে আমার আগুন জ্বলে উঠল ৷ পলকের মধ্যে কী ঘটে গেল জানি না ৷ পায়ের কাছে পড়েছিল একটা ভাঙা কাফ্রীর মুণ্ড—নিরেট, কালো পাথরের তৈরি ৷ চকিতে সেই ভারী মুণ্ডটা কুড়িয়ে অন্ধকারে পায়ের আওয়াজ লক্ষ্য করে ছুড়ে দিলাম—

    হু-হু উত্তরে হাওয়া চিৎকার করে একবার ককিয়ে উঠেই চুপ করে গেল ৷

    সে কি হাওয়ার শব্দ, না বারবারার শেষ আর্তনাদ?

    ছোট ঘর থেকে টর্চটা এনে জানলা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়লাম ৷ টর্চের আলোয় কিছুদূরে বাগানের ভিজে মাটির ওপর নীল গাউনটা ঝলমলিয়ে উঠল ৷ পা দুটো যেন সীসের মতো ভারী হয়ে উঠল ৷ সেই ভারী পা-দুটো টেনে টেনে টলতে টলতে কাছে গিয়ে দেখলাম, মাথার খুলির পেছন দিকটা গুঁড়িয়ে গেছে ৷ রক্তে আর কাদায় মিশে একাকার!

    খুন! … খুন করেছি আমি!

    হঠাৎ প্রচণ্ড একটা শীতের প্রবাহ আমার হাড় পর্যন্ত আড়ষ্ট করে দিল ৷ হাত-পা সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগল ঠকঠক করে, আর সেই জমাট করা ঠান্ডায় মস্তিষ্কটাও যেন অবশ হয়ে এল ৷ তারপর ধীরে— অতি ধীরে যেন আমার চেতনা একটু একটু করে ফিরে আসতে লাগল ৷ মনে হল, এখুনি ভোর হয়ে যাবে, বাগানের ধার দিয়ে দিনের লোক-চলাচল শুরু হবে, খবর যাবে পুলিশ-স্টেশনে, আসবে পুলিশ, খুনের চার্জে নিয়ে যাবে আমাকে ৷ তারপর খবরের কাগজে বড় বড় হরফে ছাপা হবে: আর্টিস্ট নিশীথ সেন খুনি!

    তারপর বিচার … জেলখানার সেল … তারপর একদিন ভোররাত্রে ফাঁসির দড়ি …

    বিদ্যুতে শক খাওয়ার মতো আমার শিরা-স্নায়ুগুলো ঝন ঝন করে উঠল ৷ আমার আদিম চেতনা আমাকে বলে দিল, নিজেকে বাঁচাও— আগে নিজেকে বাঁচাও—যত শিগগির পারো!

    পা দিয়ে ঘষে ভিজে মাটিতে রক্তের দাগগুলো নিশ্চিহ্ন করে দিলাম ৷ তারপর ফার- কোটটা এনে বারবারার মৃতদেহকে ঢেকে তুলে নিলাম কাঁধে ৷

    তখন ভোর হয়ে আসছে ৷ তবু ঘন কুয়াশার চারদিক ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট ৷ ঠাওর করে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কেউ কোথাও নেই ৷ সামনে খালের ধারে ল্যাম্প- পোস্টটার নীচে কনস্টেবলটাও নেই ৷ কে থাকবে এই ঝোড়ো শীতের ভোররাত্রে?

    নিশ্চিন্ত আশ্বাসে বাগানের ফটক খুলে বেরিয়ে পড়লাম ৷ আস্তে আস্তে গিয়ে দাঁড়ালাম খালের ওই কাঠের সাঁকোটার ওপর ৷ নীচের দিকে তাকালাম—কালো জলস্রোত অন্ধকার মৃত্যুর মতো বয়ে চলেছে ৷ দম-দেওয়া যন্ত্রের মতো আমার হাত দুটো কাঁধের বোঝাটিকে নামিয়ে একবার খালের ওপরে শূন্যে তুলে ধরল—

    তারপর শুধু ঝপ করে একটা শব্দ ৷ মুহূর্তের জন্যে অশান্ত হয়ে উঠল তরল মৃত্যুস্রোত ৷ তারপর আবার স্তব্ধতা ৷

    এতক্ষণে বোধ হয় সানফ্রান্সিসকোর জাহাজ ছাড়বার শেষ ঘণ্টা বাজছে!

    সেই কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে জনহীন সাঁকোর ওপর কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম, তা জানি না ৷ আর আমার কিছুই মনে নেই প্রতুল ৷ এইখানে এসে আমার স্মৃতি গেছে হারিয়ে ৷

    পরদিন যখন ঘুম ভাঙল, তখন অনেক বেলা ৷ মাথা অসহ্য ভারী, দারুণ পিপাসায় গলা উঠেছে শুকিয়ে ৷ গতরাত্রের ঘটনাটা মনে পড়তেই মাথার ভেতরটা গোলমাল হয়ে গেল ৷ তাড়াতাড়ি হলের মধ্যে গিয়ে দেখি, না, সব ঠিকই আছে, কোথাও এতটুকু বিশৃঙ্খলা নেই ৷ বুঝতে পারলাম, দুঃস্বপ্ন দেখেছি—নিছক একটা দুঃস্বপ্ন! নিমেষে দেহ-মন সুস্থ হয়ে উঠল ৷ মাথাটাও হালকা হয়ে গেল ৷ বেরিয়ে এলাম বাগানে ৷ প্রশান্ত দিন, উজ্জ্বল রোদ দেবদারু শাখায় শাখায় ঝলমল করছে ৷ গতরাত্রির দুঃস্বপ্নটা ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম ৷ ভুলে গিয়েও ছিলাম, কিন্তু আজ ১৩ ডিসেম্বর, এক বছর পরে সেই স্বপ্ন-কাহিনি আবার নতুন করে মনে পড়ল ৷

    কাহিনি বলা শেষ করে নিশীথ থামল ৷ পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাল একটা ৷

    পাইপের আগুনটা নিভে গিয়েছিল ৷ তবু সেই নিভন্ত পাইপ মুখে প্রতুল বড় সোফাটায় হেলান দিয়ে পূর্ণাবয়ব ছবির মতো স্থির হয়ে বসেছিল ৷ কপালে অল্প একটু কুঞ্চন-রেখা ছাড়া তার সারা মুখে চাঞ্চল্যের আর কোনো চিহ্ন নেই ৷ এতক্ষণে পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, তোমার স্বপ্ন-দেখার পরের দিন বারবারা স্মিথ তার ছবিখানা ডেলিভারি নিতে আসেনি?

    নিশীথ বললে, না ৷ আর সবচেয়ে আশ্চর্য, এই দীর্ঘ এক বছরের মধ্যে বারবারা স্মিথ কোনোদিনই ছবিখানা নিতে আসেনি ৷

    হুঁ, না আসাই স্বাভাবিক ৷—পাইপ ঠুকে পোড়া তামাকটা ফেলে দিতে দিতে প্রতুল বললে, ঠিক এক বছর আগে খবরের কাগজে একটা রিপোর্ট বেরিয়েছিল: বারবারা স্মিথ নামে সানফ্রান্সিসকোর একটি মেয়ে ১৩ ডিসেম্বর রাত্রে পার্ক স্ট্রিটে তার ফ্ল্যাট থেকে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছে ৷ পুলিশ বহু চেষ্টাতেও তার কোনো সন্ধান পায়নি ৷ তোমার স্বপ্ন-কাহিনির সঙ্গে এই ঘটনাটার অদ্ভুত যোগাযোগ রয়েছে, না নিশীথ? খবরটা তুমিও নিশচয় পড়েছিলে?

    এক মুহূর্ত প্রতুলের মুখের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে নিশীথ জবাব দিলে, না, আমি পড়িনি প্রতুল ৷—তারপর হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে ভারী ওভারকোটটা গায়ে দিয়ে বললে, যাকগে ও-কথা ৷ রাত অনেক হল, ঝড় আজকে আর থামবে বলে মনে হয় না ৷ চলো, যাওয়া যাক ৷

    প্রতুলের ওভারকোটটা গায়েই ছিল, টুপিটা মাথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, চলো ৷

    হলের আলো নিভিয়ে দুজনে বাইরে এল ৷ স্টুডিয়োর দরজা বন্ধ করার জন্যে নিশীথ পকেট থেকে চাবি বার করতেই প্রতুল বললে, একটু দাঁড়াও, তামাকের পাউচটা টেবিলের ওপর ফেলে এসেছি ৷

    ওভারকোটের কলার তুলে দিয়ে নিশীথ বললে, নিয়ে এসো ৷ বেশি দেরি কোরো না কিন্তু ৷ আজ মারাত্মক শীত পড়েছে হে, ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি!

    প্রতুল একা হলের মধ্যে ঢুকে বাতি জ্বাললে ৷ তারপর টেবিলের ওপর থেকে পাউচটা নিয়ে পকেটে পুরলো ৷ ফিরে আসতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল, উত্তরের জানলাটা খোলা ৷ কী অন্যমনস্ক এই নিশীথ, বন্ধ করতে ভুলে গেছে! কিংবা এমনও হতে পারে যে, তার দুঃস্বপ্নের মধ্যে বারবারা স্মিথ এই জানলা দিয়ে পালাতে গিয়ে খুন হয়েছিল বলে নিশীথ এদিকটায় বড়-একটা আসে না ৷ জানলাটায় গরাদ নেই, বন্ধ করে যাওয়াই ভালো ৷ নইলে সারারাত ঝোড়ো হাওয়া আসবে, চোর আসাও বিচিত্র নয় ৷

    প্রতুল জানলার কাছে এগিয়ে গেল ৷ কিন্তু কপাট দুটো বন্ধ করতে গিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে গেল ৷ জানলার ছিটকিনির হুকে কী যেন একটা বস্তু আটকে রয়েছে না? সেটা তুলে প্রতুল আলোয় ভালো করে দেখল ৷ দেখতে দেখতে তার প্রশস্ত কপালে আবার সেই কুঞ্চন-রেখা দেখা দিল ৷ জীবনে এতখানি আশ্চর্য বোধ হয় আর সে কখনও হয়নি! এতখানি আঘাতও সে কমই পেয়েছে জীবনে ৷

    উত্তরের জানলাটা আর বন্ধ করা হল না ৷ ছিটকিনি-খোলা কপাটদুটো ঝড়ে বুক-চাপড়ানির মতো আছড়ে আছড়ে পড়ছে, সেদিকে প্রতুলের খেয়াল নেই ৷

    কী হে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার দুঃস্বপ্নের ব্যাখ্যা ভাবছ নাকি? আর আমি বেচারি এদিকে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার দাখিল!—দরজা ঠেলে ঢুকে নিশীথ বললে ৷

    চকিতে প্রতুল হাতের বস্তুটা পকেটে পুরে ফেললে ৷ তারপর ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, তাই বটে!

    অসহিষ্ণু কণ্ঠে নিশীথ বললে, সে-কথা আর একদিন শোনা যাবে ৷ আজকে চলো—

    প্রতুল এগিয়ে গিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়াল ৷ তীক্ষ্ণ-গভীর দুই চোখের দৃষ্টি নিশীথের মুখের ওপর ফেলে শান্ত গলায় শুধু বললে, না, আজই শুনে যাও ৷

    আরও অসহিষ্ণু কণ্ঠে নিশীথ বলে উঠল, কাল শুনব’খন ৷

    না, আজই শোনো ৷

    প্রতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিশীথের গলা কেমন যেন দুর্বল হয়ে এল ৷ শুধু বললে, বলো—

    বারবারা স্মিথকে তুমি সত্যিই খু-ন ক-রে-ছ নিশীথ!

    অন্ধকারে সাপ দেখার মতো চমকে উঠল নিশীথ ৷ পরক্ষণেই তার গলা দিয়ে বিশ্রী বীভৎস এক অট্টহাসি রোল বেরিয়ে এসে ঘরের খিলানে খিলানে ধাক্কা খেয়ে ঘুরে ঘুরে ফিরতে লাগল ৷ তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললে, সাবাস ডিটেকটিভ! বলিহারি তোমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা!

    শান্ত-কঠিন স্বরে প্রতুল বললে, মিথ্যে স্বপ্ন দিয়ে সত্য ঘটনাকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা কোরো না নিশীথ ৷ আমি জানি, এক বছর আগে ১৩ ডিসেম্বরের রাত্রে বারবারা স্মিথ তোমার এই স্টুডিয়োতে এসেছিল, আর তুমিই তাকে খুন করেছ ৷

    বটে! … প্রমাণ?

    প্রতুল নিঃশব্দে কোটের পকেট থেকে সেই বস্তুটা বের করে নিশীথের সামনে ধরলে ৷ জিনিসটা আর কিছুই নয়, নীল সিল্কের একটা রুমালের ছিন্ন অংশ ৷ এক বছরের রোদে-জলে নীল রং অনেকখানি বিবর্ণ হয়ে গেছে ৷ এক কোণে পুরোনো রক্তের মতো কালচে লাল সুতো দিয়ে বোনা একটি অক্ষর—B.

    প্রতুল বললে, উত্তরের জানলা টপকে পালাতে গিয়ে বারবারার হাতের নীল রুমাল ছিটকিনির হুকে আটকে যায়, সে-রাত্রে তুমি তা লক্ষ করোনি নিশীথ ৷ কিন্তু কে জানত, তারই ছিন্ন অংশ আজ এক বছর আগেকার এক হত্যা-রহস্যের সূত্র ধরিয়ে দেবে ৷

    নীল রুমালটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিশীথের গরিলাকৃতি মুখখানা রক্তহীন হয়ে গেল ৷ নিচেকার পুরু ঠোঁট ঝুলে পড়ল কদাকারভাবে ৷ তারপর দেখতে দেখতে তার চোখে এল বন্য হিংস্রতা ৷ রোমশ দুই বাহু বাড়িয়ে ক্রুদ্ধ গরিলার মতো সে নিমেষে প্রতুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল, কিন্তু তার আগেই প্রতুলের অপর হাতে দেখা দিয়েছে তার নিত্যসঙ্গী পিস্তল ৷

    এক পা-ও এগিয়ো না নিশীথ!

    ক্রুদ্ধ জানোয়ারের মতোই নিশীথ একটা চাপা গর্জন ক’রে উঠল ৷

    পিস্তলটা তার দিকে উঁচু করে ধরে প্রতুল শান্ত বেদনাহত কণ্ঠে বলতে লাগল, তোমার আমার বন্ধুত্ব আজ আঠারো বছরের ৷ দিনে দিনে এই বন্ধুতা নিবিড় অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে ৷ তবু, খুনি যে, তাকে বন্ধুতার খাতিরে আমি ছেড়ে দিতে পারব না নিশীথ ৷— হাত তোলো! চলো—

    দুই হাত তুলে পিছন ফিরে নিশীথ আস্তে আস্তে দরজা দিয়ে বেরোলে ৷ প্রতুলের পিস্তলের নলটা তার পিঠ রইল ছুঁয়ে ৷

    পিছন ফিরেই নিশীথ বললে, স্টুডিয়োর দরজা চাবি বন্ধ করে দিও প্রতুল ৷

    মুখ ফিরে চাবি বন্ধ করতে দু’সেকেন্ডের বেশি লাগেনি, কিন্তু তারই মধ্যে কুয়াশা আর অন্ধকারে ভারী জুতোর আওয়াজ পেয়ে প্রতুল চিৎকার করে উঠল, পালি না নিশীথ—পালাবার চেষ্টা কোরো না! নিশীথ—নিশীথ—

    ভারী জুতোর আওয়াজ ক্রমশ খালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ৷ উদ্যত পিস্তল হাতে আওয়াজ লক্ষ্য করে প্রতুল ছুটল৷

    পালিয়ো না নিশীথ—নিশীথ—

    ভারী জুতোর আওয়াজ কাঠের সাঁকোর ওপর গিয়ে পৌঁছেছে ৷ সাঁকোর ওপর কালো ওভারকোট মোড়া আবছা মূর্তি লক্ষ্য করে প্রতুলের পিস্তল গর্জে উঠল, দুম … দুম …

    আবছা কালো মূর্তিটা একবার সাঁকোর রেলিঙের ধারে স্থির হয়ে দাঁড়াল ৷ তারপর শুধু ঝপ করে একটা শব্দ হল মাত্র ৷

    প্রতুল ততক্ষণে সাঁকোর ওপরে গিয়ে পৌঁছেছে ৷ নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল, তরল কালো মৃত্যুস্রোত মুহূর্তের জন্যে অশান্ত হয়ে উঠে আবার শান্তবেগে বয়ে চলেছে—ঠিক যেমন হয়েছিল এক বছর আগে এই ১৩ ডিসেম্বরের রাত্রে ৷

    সাঁকোর ওপর প্রতুল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ৷ তার এক হাতে পিস্তল, অপর হাতে আর্টিস্ট নিশীথ সেনের স্টুডিয়োর দরজার চাবি ৷

    সে-দরজা হয়তো আর কোনোদিনই খুলবে না!

    ⤶
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপিশাচ দেবতা – অনীশ দাস অপু
    Next Article বাড়িটায় কেউ যেয়ো না – অনীশ দেব

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }