মধুবালার বিপদ
চিত্তহরণের গৃহে সংবাদ এসেছে। সংবাদপ্রেরক স্বয়ং শশাঙ্ক নারায়ণ রায়চৌধুরীর খাস লোক। শশাঙ্ক নারায়ণ পত্র পাঠিয়েছেন। চিত্তহরণ যেন আজ সন্ধেতে তার কন্যাকে প্রস্তুত করে রাখে। জমিদার বাড়ির ফিটন গাড়ি সন্ধে ছয়টা নাগাদ পৌঁছাবে চিত্তহরণের গৃহে।
পত্রটা হাতে নিয়েই দাওয়ায় স্থবিরের ন্যায় বসে রইলেন চিত্তহরণ। মধুবালার সংগীত ভেসে আসছে নীলকণ্ঠের গর্ভগৃহ থেকে। বিষাদ ঘনিয়ে এসেছে তার কণ্ঠে। হয়তো বিবাহ সংবাদই দায়ী এজন্য।
ঠিক যেদিন থেকে মধুবালা নিজের বিবাহ সংবাদ পেয়েছে সেদিন থেকেই পিতার সঙ্গে তার বাক্যালাপ কমেছে। মন্দিরের গর্ভগৃহেই সময় কাটাচ্ছে বেশি। আনমনে উদাসীন হয়ে যেন কিছু ভেবে চলেছে।
দুই ভ্রুর মাঝে একরাশ দুশ্চিন্তা যেন স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে মধুবালার। কন্যার এমন বিষাদরূপ দেখে অন্তরে রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে চিত্তহরণের।
চিত্তহরণ বুকে পাথর চাপা দিয়ে পরাজিত পায়ে এগিয়ে গেলেন গর্ভগৃহের দিকে।
নীলকণ্ঠের সম্মুখে জ্বলছে ঘিয়ের প্রদীপ। দিনের প্রথম সূর্যের আলোকরশ্মিও প্রবেশ করে না গর্ভগৃহে। তাই পিতলের প্রদীপ জ্বলে দিনরাত।
সাদা গরদের শাড়িতে দেবীমূর্তির মত পবিত্র লাগছে মধুবালাকে। ঠিক যেন মোম দিয়ে গড়া। নীলকণ্ঠের সম্মুখে দু-হাত জোড় করে সে গাইছে…
.
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।।
ঝম্পি ঘন গর্জন্তি সন্ততি
ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া।
কান্ত পাহুন কাম দারুণ
সঘনে খর শর হন্তিয়া।।
কুলিশ শত শত পাত-মোদিত
ময়ুর নাচত মাতিয়া।
মত্ত দাদুরি ডাকে ডাহুকী
ফাটি যাওত ছাতিয়া।।
.
সাধারণত নীলকণ্ঠের সম্মুখে ভক্তিগীতিই পরিবেশন করে মধুবালা। আজ হঠাৎ বিদ্যাপতির শ্লোক শুনেই চিত্তহরণ বেশ বুঝতে পারলেন মধুবালার অন্তর অত্যন্ত চঞ্চল হয়েছে।
তার ডাকে ফিরে তাকালো মধুবালা। চিবুক বেয়ে জলের ধারা।
চিত্তহরণ যেন আজ নীলকণ্ঠের মতোই প্রস্তর মূর্তিতে পরিণত হয়েছেন। নির্দেশের সুরে বললেন, আমি ভবানীরানীকে খবর পাঠিয়েছি। সে তোমাকে সুসজ্জিত করে দেবে। আজ জমিদার বাড়ি থেকে তোমায় দেখতে আসবে। তুমি মনকে প্রস্তুত করো।
দৃঢ় পায়ে উঠে দাঁড়ালো মধুবালা। স্থির কণ্ঠে বললো, আমি প্রস্তুত পিতা।
রানীমাসি কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে উপস্থিত। মধুবালার চুলে কবরী বেঁধে তাতে ফুলের মালা জড়িয়ে দিলো। কপালে কুমকুমের টিপ, গলায় মায়ের রেখে যাওয়া সোনার বেলফুল হার, কানে কানবালা। ঘরের ছোট আরশিটাতেই নিজেকে একবার দেখে নিলো ও। চোখের কোনে কাজল এঁকে দিলো রানীমাসি। তারপর বললো, মুখপুড়ি তোর ভাগ্য দেখে ঈর্ষা হয় রে। হতচ্ছাড়ি জমিদার গিন্নি হবি। বিষপুরের মাথায় বসবি।
মধুবালা এতক্ষণ নির্জীবের মতোই শুধু রানীমাসির নির্দেশ মেনে চলেছে। এই প্রথম ঠোঁট ফাঁক করে বললো, আমার সৌভাগ্যটা তুমি নেবে রানীমাসি! এ সৌভাগ্য বড় ভারী। এত বোঝা বইতে পারি না যে।
ভবানীরানী বললো, বাল্যবিধবা হলে বুঝতিস এ কথা নেহাত রসিকতা বলে মেনে নিতে কত কষ্ট হতো।
মা মরা অভাগী তুই, তোর এমন জমিদার বাড়িতে বিয়ে হবে এ যে আকাশকুসুম কল্পনা রে।
নীলকণ্ঠ তোকে সেই সুযোগ দিয়েছেন হতভাগী। দিবারাত্র তাঁকে ধ্যান করছিস যে।
মধুবালার মুখের রেখায় আনন্দের কোনো অভিব্যক্তি দেখতে পেলো না রানীমাসি। বরং দেখলো মধুবালা একটা চুনি পাথরের আংটির দিকে একমনে তাকিয়ে আছে।
.
পালকি থেকে নামলেন স্বয়ং শশাঙ্ক নারায়ণ রায়চৌধুরী। সঙ্গে রয়েছে ওনার দুই পুত্র। নায়েব ও লেঠেল। সুশান্ত নারায়ণ রায়চৌধুরীর মুখে ইতস্ততার চিহ্ন সুস্পষ্ট। ঘরের অন্ধকার জানালা দিয়ে সেটা দেখতে পেলো মধুবালা।
ঘোমটাটা একটু নামিয়ে দিয়ে ওকে ওদের সম্মুখে নিয়ে গেলো রানীমাসী।
চিত্তহরণ ভয়ে আর দুশ্চিন্তায় তটস্থ হয়ে রয়েছেন।
শশাঙ্ক নারায়ণ বললেন, কি হে চিত্তহরণ ভয়ে এমন মুখটা পাণ্ডুর করে রেখেছো কেন হে!
সম্পর্কে তো তুমি এখন আমার আত্মীয় হতে চলেছো। এখন কি এমন সহায়সম্বলহীন দরিদ্র ব্রাহ্মণের মুখ করে থাকলে চলে!
চিত্তহরণের দুজন প্রতিবেশী নিজে থেকেই উপস্থিত ছিলো। তারাই জলযোগের ব্যবস্থা করলো।
চিত্তহরণের কন্যাকে প্রদীপের আলোয় ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন শশাঙ্ক নারায়ণ। নেহাত নিজের বয়েস হয়েছে তাই। নাহলে এমন কন্যার স্বামী হওয়া গর্বের। নিজের অবাধ্য মনকে শাসন করলেন উনি। হবু পুত্রবধূকে নিয়ে এমন কল্পনা করাও অন্যায়। কিন্তু এমন পদ্মফুলের মত অবয়ব তিনি বড়ই কম দেখেছেন। সুশান্ত এর মর্ম কি বুঝবে? কোনোদিন তো পরিষ্কার করে বলতেও পারবে না, তুমি বড়ই সুন্দর।
শশাঙ্ক নারায়ণ বললেন, চিত্তহরণ তোমার কন্যাটিকে আমার বড় পছন্দ হয়েছে। ভারী সুলক্ষণা। এবারে কোষ্ঠী মেলানোর দায়িত্বটি তোমার। সুশান্তের জন্মবৃত্তান্ত চিত্তহরণের হাতে সমর্পণ করে বললেন, সনাতন পণ্ডিতকে খবর দিয়েছি, সে এখুনি এসে উপস্থিত হবে। কোষ্ঠী মিলিয়ে দেখে নেবে পাত্র-পাত্রী রাজযোটক কিনা!
কথা শেষ হওয়ামাত্র সনাতন পণ্ডিত হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন। জমিদার মহাশয়ের কাছ থেকে ক্ষমা ভিক্ষে করলেন তার বিলম্বের কারণে।
দুজনের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে বসলেন বিচারে।
.
প্রদীপের ঘৃত কমে এসেছিল, তাতে পুনরায় ঘি ঢেলে দিলো রানীমাসী। ঘরের সকলে শান্ত, চুপ। সকলের চোখ সনাতন পণ্ডিতের দিকে। তিনি কি বলেন সেই শোনার অপেক্ষায়।
আচমকাই প্রায় চিৎকার করে উঠলেন সনাতন পণ্ডিত। বললেন, এ অসম্ভব।
এ মেয়ের সঙ্গে সুশান্ত নারায়ণের বিবাহ হতে পারে না। এ কন্যার বিবাহ কোনো বিধর্মীর সঙ্গে হবে। চিত্তহরণ তুমি ধর্ম খোয়াবে শেষে!
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রাঘাত হলো। শুধু কেউ দেখতে পেলো না, অন্ধকারে ঘোমটার ভিতরের একটা বিষণ্ণ মুখে হাসি ফুটলো এক চিলতে। ধীর পায়ে সে উপস্থিত হলো নীলকণ্ঠের সম্মুখে। প্রণাম করে বললো, রক্ষা করো। আমি যেন তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে না পড়ি। আমি যে তার বাগদত্তা। এ কথা আর কেউ না জানুক নীলকণ্ঠ তুমি তো জানো! আমি শুধু ওনাকেই স্বপ্নে দেখি।
পায়ের ঘুঙুর দুটো পরে নিয়ে পরিস্থিতি ভুলে গর্ভগৃহের মধ্যেই নাচতে শুরু করলো মধুবালা।
যেন নীলকণ্ঠকে খুশি করতেই হবে। আপ্রাণ প্রচেষ্টা।
মত্ত হয়ে নেচে চলেছে মধুবালা। দিগ্বদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নাচছে মধুবালা।
.
পিতার চিৎকারে থমকে গেলো ওর ঘুঙুরের শব্দ।
রাগে ঠকঠক করে কাঁপছেন চিত্তহরণ। পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন শশাঙ্ক নারায়ণ রায়চৌধুরী। শশাঙ্ক নারায়ণ বললেন, চিত্তহরণ তোমার কন্যার তো জন্মই হয়েছে হারেমের কাঞ্চনী হবার অভিপ্রায়ে। একে আমি আমার গৃহবধূ করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, এ আমার ভারী অন্যায়। নৃত্য-গীতে এমন পারদর্শী মেয়ে কুলবধূ হিসাবে শোভা পায় না। একে রুদ্রনগরের সৈন্যরা নিয়ে যেতে এসেছে। পাঠিয়ে দাও হে। কাঞ্চনী হয়ে বাদশাহের মন জয় করুক। চলো হে সুশান্ত। সুলক্ষণা কন্যার সন্ধানে যেতে হবে। শশাঙ্ক নারায়ণ রায়চৌধুরীর পুত্রবধূ কোনো কাঞ্চনী হতে পারে না।
মধুবালা তখনও বিষয়টা মগজস্থ করে উঠতে পারেনি। চিত্তহরণ স্খলিত পায়ে মন্দিরের ভিতরেই বসে পড়লেন। কান্না ভেজা গলায় বললেন, তুমি নৃত্যে এমন পারদর্শী কবে হয়ে উঠলে মধুবালা! রুদ্রনগরের বাদশাহ মুসাফির তোমায় চিনলেন কি করে! কি করে তিনি জানালেন তুমি নৃত্য,গীতে পারদর্শী!
মধুবালা বললো, আমি জানতাম না বাবা, উনিই রুদ্রনগরের বাদশাহ। একদিন দুজন ভিনদেশী আমার গানের আওয়াজে এসে পৌঁছেছিলেন এখানে।
ওর কথা শেষ হবার আগেই দরজায় ভারী কড়াঘাত পড়লো। বাইরে থেকে ভেসে এলো অপরিচিতের কণ্ঠস্বর। আমরা মধুবালাকে নিতে এসেছি, ছেড়ে দিন ওকে। বাদশাহের হুকুম আজ রাতের মধ্যেই বিষপুরের জঙ্গল পরিত্যাগ করতে হবে।
চিত্তহরণ ভীত কণ্ঠে বললো, মধুবালা রুদ্রনগরের বাদশাহের সৈনিকরা তোমায় নিয়ে যেতে এসেছে। আমার ক্ষমতা নেই রক্ষা করার। আমি ধর্মচ্যুত হবার আগে তুমি আমার গৃহ পরিত্যাগ করো। বিধর্মীরা যেন কোনোভাবেই এই গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে না পারে।
মধুবালা বুঝলো, প্রবল প্রবঞ্চনা হয়েছে তার সঙ্গে।
ফরাসি চিকিৎসক তার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করেছে। সে আসলে বাদশাহের দূত মাত্র। বাদশাহের সম্মুখে নিজেকে উৎকৃষ্ট প্রমাণ করার হেতু তাকে বাজি রেখেছে। মধুবালাকে তুলে দেওয়া হবে বাদশাহের কাছে। তার ভোরের স্বপ্ন তার মানে সঠিক ছিলো। এই বিদেশি চিকিৎসকই ঘোড়ায় চাপিয়ে তাকে নিয়ে গিয়ে তুলে দেবে বাদশাহের জিম্মায় উপঢৌকন হিসাবে। বাদশাহ হাকিমকে পুরস্কৃত করবেন। হয়তো রাজবৈদ্য পদে নিযুক্ত করবেন।
.
মধুবালা নীলকণ্ঠকে প্রণাম করে, পিতার চরণে হাত রেখে বললো, আমার ভাগ্যলিখনকে মিথ্যা করার ইচ্ছা আমার নেই। তাই আমি চললাম। কঠিন পায়ে এগিয়ে গেলো মধুবালা। তার সর্বাঙ্গ ঘর্মাক্ত। দ্রুত নৃত্যের গতির কারণেই নিঃশ্বাস দ্রুতগামী হলো। ঘামে ভেজা শাড়ির মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠছে তার অবাধ যৌবন। মন্দিরের দরজা খুলে বেরোতেই চোখে পড়লো, তলোয়ার উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে চারজন সৈনিক। মধুবালা বেরোতেই তাকে পালকিতে বসার নির্দেশ দিল একজন সৈনিক। মুখ থেকে খসে গেছে ঘোমটার কাপড়। মশালের আলোয় একজন সৈনিক বললো, জন্নতের পরী। অন্যমনস্ক মধুবালা সচকিত হয়ে টেনে নিলো ঘোমটা।
.
না, ধারে কাছে সেই বিশ্বাসী নীল চোখদুটো নেই। মশালের আলোর সঙ্গে ‘হুম না হুম না’ করে এগিয়ে চলেছে মধুবালার পালকি। জঙ্গলে ঝিঁঝিঁর আওয়াজ আর মাঝে মাঝে শেয়াল অথবা বুনো হাতির ডাক ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না ও।
সেই সোনালী চুল, নীল চোখের রাজকুমার তবে তাকে এভাবে প্রবঞ্চনা করলো! এই ভাবনার থেকেই মধুবালার চোখের তরল জমাট বাঁধছে, উষ্ণ হচ্ছে তপ্ত মরুভূমির মত।
দুজন ফিসফিস করে বললো, বাদশাহের ছোটি বেগম নাকি হারেমের মুক্তিদাতা হয়েছে। তাহলে হারেমের দাসীবাঁদীদেরও মুক্তি দেবে নিশ্চয়ই। রাতের অন্ধকারে হাবাসীগুলোকে লুকিয়ে গর্দানের মায়া ত্যাগ করে হারেমে ঢোকা বহুত খতরনাক।
আরেকজন সৈনিক বললো, তাহলে কি হারেমের দাসীরা নিকাহ করতে পারবে?
সৈনিক দুজন হেসে বললো, রুকসানা বেগমের সিলমোহরে ছাপ লাগবে তবে হারেমের দুয়ার পেরোনো যাবে।
.
কে এই রুকসানা বেগম, কি তার পরিচয়, হারেমে ঠিক কি হয় এসব কিছুই জানে না মধুবালা।
কোথায় চলেছে ও সেটাও ওর অজানা। ওকে কেন সবাই কাঞ্চনী বলে সম্বোধন করছে সেটাও ওর বোধগম্য হলো না। ওর চোখের পাতায় কাঁপছে সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া মুখটা। যে বলেছিল, তুমিই আমার বাগদত্তা, যুদ্ধ শেষে তোমার কাছে ফিরবো। তাকে এত বড় প্রবঞ্চক ভাবতে বুকটা কেঁপে উঠছে, সমস্ত দ্রুতগামী রক্তকণিকারা বিক্ষিপ্ত গতিতে ছোটাছুটি করছে দেহের অভ্যন্তরে। নিজেকে জোর করে স্থির অবিচল রাখার চেষ্টা করছে। কানে বাজছে সনাতন পণ্ডিতের ভবিষ্যৎ বাণী, বিধর্মীর সঙ্গে বিবাহযোগ আছে এ কন্যার। তবে কি বাদশাহ ওকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করবেন? তিনিও তো বিধর্মী!