প্যাট্রিক ও বিষপুরের জঙ্গল
দুশ্চিন্তায় রাত্রে নির্ঘুম আছেন প্যাট্রিক। মুসাফির সমস্ত ব্যবস্থার মধ্যেও মনে রেখেছেন মধুবালাকে। তাকে পদ্মমহলের কাঞ্চনী বানাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যুদ্ধ শেষের উল্লাস উপভোগ করতে চান মধুবালার নৃত্যগীতের মাধ্যমে। প্যাট্রিক এত বছর মুসাফিরকে কাছ থেকে দেখে এটুকু চিনেছেন যে একবার যখন তাঁর অন্তরে মধুবালার নাম খোদাই হয়ে গেছে তখন এ নাম এত সহজে মুছবে না। তাঁবুর মধ্যে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছেন না প্যাট্রিক। মুসাফির বলেছিলেন, মধুবালাকে আমায় উপহার হিসেবে দাও প্যাট্রিক। কিন্তু প্যাট্রিক সেভাবে সাড়া দেননি। হয়তো মধুবালাকে অন্য উপায়ে অপহরণ করবেন মুসাফির। তার থেকে বরং নিজেই গিয়ে মধুবালাকে ওর গৃহ থেকে সসম্মানে নিয়ে আসাটা বাঞ্চনীয় ছিলো।
কিন্তু তারপর! মধুবালা তো নিশ্চিন্তে প্যাট্রিকের হাত ধরে চলে আসবে গৃহ ত্যাগ করে। একবার গৃহত্যাগী হলে সে মেয়েকে আর গৃহে রাখার প্রথা নেই এখানে। আর মুসাফিরের দরবারে মধুবালাকে সমর্পণ করলে মধুবালার দৃষ্টির ভর্ৎসনা বয়ে বেড়াতে হবে প্যাট্রিককে আজীবন।
জঙ্গলের শ্বাপদ প্রাণীর ভয়েও আজ ভীত নন প্যাট্রিক। তার জীবনটা যেন এক অমোঘ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। সমস্ত তাঁবুতে তাঁবুতে মানুষ নিদ্রারত। একমাত্র বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন প্যাট্রিক। জঙ্গলের মধ্যে পায়ে চলা পথটিতে পদচারণা করে চলেছেন অস্থিরভাবে। বারংবার ভাসছে মধুবালার মুখাবয়ব। বিশ্বাস, প্রতিশ্রুতি মিশ্রিত চাহনি ছিল ওর দৃষ্টিতে।
.
দূরে কতগুলো মশালের আলো দেখে সজাগ হলেন প্যাট্রিক। রুদ্রনগরের কোনো গোপন শত্রু নয় তো! রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে মশাল হাতে এগিয়ে আসছে রুদ্রনগরের শিবিরের দিকে। যুদ্ধক্লান্ত সৈনিকদের ওপরে আচমকা আঘাত হানাটাই হয়তো একমাত্র উদ্দেশ্য। বল্লভপুরের হিতৈষীও হতে পারে, হয়তো বন্দি হয়নি সকলে। তারাই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে উদ্যত হয়েছে। প্যাট্রিক কোমরবন্ধনী থেকে তলোয়ারটা উন্মুক্ত করলেন। একটা ঝাঁকড়া গাছের পিছনে দাঁড়ালেন নিজেকে লুকিয়ে নিয়ে।
মশালের আলোটা কাছে আসতেই বুঝতে পারলেন, পালকি বাহকের সামনে রয়েছে চারজন সেনা। পাগড়িতে রুদ্রনগরের তকমা লাগানো। প্যাট্রিক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবলেন, এত রাত্রে পালকি করে রুকসানা বেগম কোথায় গিয়েছিলেন! রুকসানা বেগম নাকি অন্য কেউ? কোনো গোপন শত্রু পালকিতে আশ্রয় নেয়নি তো। মুসাফিরের ওপরে বল্লভপুরের আচমকা আক্রমণ গোটা রুদ্রনগরবাসীকে সচেতন করে তুলেছে। প্যাট্রিক আর লুকিয়ে না থেকে সতর্ক হলেন। পালকিবাহকদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে পথ আটক করে জিজ্ঞেস করলেন, কে আছে পালকিতে? নামাও পালকি। প্যাট্রিকের কোমরবন্ধনীর হীরকখণ্ডই প্রমাণ করে তিনি রুদ্রনগরের সম্ভ্রান্ত পদে আসীন। তাই সৈন্যরাও আর দ্বিরুক্তি না করে পালকি নামানোর নির্দেশ দিল।
একজন সৈনিক বললো, বিষপুরের কাঞ্চনী যাচ্ছে এই পালকিতে। বাদশাহের নির্দেশে।
প্যাট্রিক কিছু বলার আগেই পালকির যাত্রী প্রায় স্বচ্ছ পর্দাটা সরিয়ে দিলো। এ গলা তার ভীষণ পরিচিত। এর সম্মুখে নিজের ঘোমটা উন্মোচন করতেও ভীত নয় মধুবালা। মশালের আলোয় প্যাট্রিক দেখলো, পরণে জমকালো বেনারসী শাড়ি, এক গা গহনা পরে বসে আছে মধুবালা। তার চোখে শ্লেষ, ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি। স্থির কণ্ঠে বললো, আমার দেখা স্বপ্ন তবে সত্যি হলো ভিনদেশী? এই নিন, এ অঙ্গুরীয়র অধিকার আর আমার নেই। নিজের আঙুল থেকে আংটিটি পরিত্যাগ করে প্যাট্রিকের হাতে দিয়ে বললো, বাদশাহের কাছ থেকে সঠিক ইনাম নেবেন ভিনদেশী। আমাকে সওদা করার উপহারস্বরূপ বড় ইনাম পাবেন আপনি।
প্যাট্রিক কাতর স্বরে বললেন, এ তোমার সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা মধুবালা। মধুবালা ওর কথা শোনার জন্য অপেক্ষা না করেই বললো, আমায় নিয়ে চলুন সৈনিক আপনাদের বাদশাহের কাছে।
.
উদ্ভ্রান্তের মত পালকির পিছনে পিছনে কিছুটা ছুটলেন প্যাট্রিক। তারপর জঙ্গলের রূঢ় মাটিতে লুটিয়ে পরলেন। পরিশ্রান্ত লাগছিলো। জীবনের সবকটা দুয়ার যেন কেউ সজোরে বন্ধ করে দিয়েছে ওঁর সম্মুখে। ওঁর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ করার কোনো ঔষধ আজ আর জানা নেই। এই মুহূর্তে যেন দমবন্ধ হয়ে মারা যান উনি। এমন কামনাই করছেন প্যাট্রিক। মধুবালার ওই ভর্ৎসনার দৃষ্টি দেখার পরে বেঁচে থাকার আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে অবশিষ্ট নেই ওঁর।
পোশাকটা ধুলোয় বিবর্ণ হয়ে গেছে। অবশ পা দুটোকে কোনোক্রমে টেনে নিয়ে চললেন নিজের তাঁবুর দিকে। কাল প্রাতে রুকসানা বেগমের কাছে গিয়ে দরবার করবেন প্যাট্রিক। মধুবালাকে কিছুতেই কাঞ্চনী পেশায় নিয়োজিত হতে দেবেন না প্যাট্রিক। তাতে যদি প্যাট্রিককে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে বাদশাহ সেটাও শ্রেয়।
বাকি প্রহর অস্থির হয়ে তাঁবুর মধ্যেই কাটিয়ে দিলেন প্যাট্রিক।
ভোর হতেই বাদশাহের নির্দেশ পৌঁছালো প্রতিটি তাঁবুতে। সকলকে প্রস্তুত হয়ে নিতে। এখনই রওয়ানা দেবে রুদ্রনগরের অভিমুখে।
গোটা সেনাবাহিনীর মধ্যে উদ্ভ্রান্তের মত দৃষ্টিপাত করেও মধুবালাকে খুঁজে পেলেন না প্যাট্রিক। হাতির ওপরে ছাউনিওয়ালা হাওদাতে রয়েছেন রুকসানা বেগম। বেশ কয়েকটা পালকিও চলেছে। তার কোনটার মধ্যে যে মধুবালা আছে সেটা বুঝতে অক্ষম হলেন প্যাট্রিক।
নিজের প্রিয় অশ্বের কাঁধে হাত রেখে প্যাট্রিক বললেন, ফিনাস তুই কি আমায় খুঁজে দিতে পারবি তাকে, যাকে আমি উদ্ধার করতে চাই এই জটিলতা থেকে!
.
যুদ্ধজয়ের আনন্দে আত্মহারা এখন রুদ্রনগরবাসী। সিংহদুয়ারে পুষ্পবৃষ্টি করে বরণ করে নিলো বাদশাহ মুসাফিরকে। মুসাফির অপদার্থ বাদশাহ থেকে বীরের তকমা পরিধান করতে ব্যস্ত। তাঁকে সুস্থ দেখে রাজ্যবাসী বড়ই প্রীত। সকলের মনেই আলোর রোশনাই। একমাত্র অন্ধকার বিরাজ করছে প্যাট্রিকের হৃদয়ে। অশান্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছেন তিনি।
বাদশাহ আর রুকসানা বেগম প্রবেশ করলেন তাঁদের প্রিয় পদ্মমহলে। জাহানারা পুত্রকে আশীর্বাদ করলেন। রুকসানাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন তার পুত্রের জীবনরক্ষা করার জন্য।
হারেমের নিয়ম বদলাতে চলেছে শুনে খুব একটা প্রীত না হলেও মুসাফিরের আদেশের বিরুদ্ধাচারণ করলেন না কেউই। জাহানারা বা সুজান খান সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, রুদ্রনগরের ছোটি বেগম অসম্ভব ক্ষমতাশালী। তাই তাঁকে অমান্য করার সাহস এই মুহূর্তে রুদ্রনগরের কারোরই নেই।
হারেমের নতুন কি কি নিয়ম কায়েম হয় তা দেখার অপেক্ষায় আছে কয়েকশো বেগম থেকে বাঁদী।
.
আগামীকাল বাদশাহ মুসাফির দরবারে বসবেন, শুনবেন রাজ্যবাসীর অভাব অভিযোগের কথা। বাদশাহ মিজানুরও প্রত্যহ সভায় দরবার বসাতেন। তাতে প্রজারা তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা সরাসরি বলতে পারতো বাদশাহের সম্মুখে। এই কারণেই হয়তো মিজানুর ছিলেন রুদ্রনগরের জীবন্ত আল্লাহ।
মুসাফিরও পিতার পথ অবলম্বন করতে চলেছেন দেখে খুশি হলেন রুকসানা। বললেন, আজ নিশিতে আমার কক্ষে আপনার নিমন্ত্রণ বাদশাহ। মুসাফির আপ্লুত কণ্ঠে বলেছেন, আজ আমিও তোমাকে একটা উপহার দিতে চাই বেগম। নৃতগীতে সে মোহিত করে দেবে তোমার কঠিন হৃদয়। রুকসানা স্মিত হেসে বলেছেন, সে কাঞ্চনী কি রুকসানার দীপ্তিকে ম্রিয়মাণ করে তুলতে সক্ষম হুজুর?
মুসাফির বেগমকে খুশি করার হেতু বলেছেন, একজন সামান্য কাঞ্চনীর সঙ্গে আমি রুদ্রনগরের ছোটি বেগমের তুলনা করবো এমন দুঃসাহস যেন আল্লাহ আমায় না দেন। তুমি মশালের মত উজ্জ্বল। চন্দ্রালোকের মত গর্বিত। মুক্ত বিহঙ্গের মত বাধাহীন। উন্মুক্ত আকাশের ন্যায় উদার…তোমার বিকল্প নেই বেগম। রুকসানা নিজেও বিশ্বাস করেন এটা। তাঁর মত সুন্দরী এ দেশে দ্বিতীয় নেই। তাই বাদশাহের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করলেন।
রুকসানা বেগম গোসল করে বেরোলেন, তার দেহ থেকে সুগন্ধির সুবাস। সিক্ত কেশরাশিতে ধূপের গন্ধ দিয়ে পরিচর্যা করলেন এক দাসী। সর্বাঙ্গে কেশরের সুবাস। মুক্তের গহনা পরিধান করতে প্রস্তুত হলেন তিনি। আজ পদ্মমহলে বসবে কাঞ্চনীর আসর। বাদশাহ নাকি বিষপুরের নীলকণ্ঠ মন্দির থেকে এই কাঞ্চনীকে নিয়ে এসেছেন শুধুমাত্র রুকসানা বেগমের মনোরঞ্জনের জন্য। ধবলগড়েতেও মাঝে মধ্যেই বসতো বাইজিদের নাচের আসর। পর পর তিনরাত চলতো নৃত্যগীত। চিকের আড়াল থেকে বেগমরা সে নৃত্য দেখতো। কাঞ্চনীরাও আসতো ধবলগড়ে নাচ দেখাতে। তাদের দেখতে বেশ সম্ভ্রান্ত হতো। রুকসানা কয়েকবার ওদের নৃত্যকলা দেখেছে।
.
নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে আবক্ষ বেলজিয়াম আরশির সম্মুখে দাঁড়ালেন রুকসানা। আরশির দিকে তাকিয়ে সম্মোহিতের গলায় বললেন, পুরুষের দৃষ্টি কেন অন্য দিকে ধায়!
একজন দাসী এসে সংবাদ দিলো, হুজুর নাচঘরে অপেক্ষা করছেন।
রুকসানা এগিয়ে গেলেন নাচঘরের দিকে। আজ নাচঘরে অন্য কোনো দর্শক থাকবে না। শুধু মুসাফির আর রুকসানা দুজনে উপভোগ করবেন এই নৃত্যগীত। অন্য পারিষদরা যখন উপস্থিত থাকে তখন অবশ্য রুকসানা থাকেন না। সেটাই নিয়ম। বেগম হলেও পরপুরুষের সম্মুখে বসে নৃত্য উপভোগ করা গর্হিত অন্যায়। তাই আজ মুসাফির এই বিশেষ ব্যবস্থা করেছেন ছোটি বেগমের জন্য।
হারেমে অবশ্য প্রায়শই কাঞ্চনীদের যাতায়াত চলতে থাকে। হারেমের বেগমদের খুশি করতে তারা প্রায়শই আসে তাদের নৃত্যগীতের পশরা সাজিয়ে।
আজ সবকিছুই অন্যরকম। পদ্মমহলের খোলা বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন রুকসানা, আজ চাঁদটাও যেন বড্ড উজ্জ্বল। যে কোনো নিয়ম ভাঙার খেলায় রুকসানার বড়ই প্রীতি। এ খেলা তাঁর ছোট থেকেই বড় পছন্দের। এত দিনের অচলায়তন ভেঙে ফেলার মধ্যে লুকিয়ে থাকে জয়ের বার্তা। ওই জয়ের খুশিটা রুকসানাকে আনন্দ দেয়।
নাচঘরে প্রবেশ করলেন রুকসানা। বাদশাহ অপলক চেয়ে বললেন, একি অসম্ভব! স্বয়ং চন্দ্র কি আজ আমার কক্ষে অবতীর্ণ হলো? আমি বিস্মিত!
বেগম তোমার কণ্ঠের মুক্তহারের এত স্পর্ধা কিভাবে হয় যে সে তোমায় জড়িয়ে থাকে!
কথাটা শেষ হবার আগেই রুকসানা গলা থেকে মুক্তহারটা এক টানে ছিঁড়ে দিলেন। মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো মহামূল্যবান মুক্তগুলো। হেসে বললেন, হুজুরের সম্মুখে এ স্পর্ধা আমিও বরদাস্ত করবো না। রুকসানাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে গেলেন মুসাফির। সুরার পাত্র ভরে উঠলো রঙিন সুরায়। রুকসানা বললেন, বাদশাহের কাঞ্চনী কোথায়! নিরুদ্দেশ হলো নাকি!
মুসাফির বললেন, বেগমের রূপের আগুনে সেওকি তবে জ্বলে পুড়ে গেলো!
একজন বাঁদী হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সংবাদ দিলো, বেগম সাহেবা কাঞ্চনী ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে অবচেতন হয়ে। হাতে মুখে লেগে আছে জহর। বাদশাহ লাফিয়ে উঠলেন, বিষ? কাঞ্চনী বিষ পান করেছে! এ যে ভয়ঙ্কর ঘটনা। বিষপুরের মন্দিরের পূজারীর কন্যা মেয়েটি। রুদ্রনগরের মহলের মধ্যে আত্মহত্যা করলে বিষপুরের মানুষ আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে বেগম। প্রজারা সদ্য আমাকে আল্লাহর আসনে বসিয়েছেন। বল্লভপুর জয় আমাকে সে সম্মান দিয়েছে বেগম। কিন্তু এখন যদি বিষপুরের হিন্দু ব্রাহ্মণ কন্যার মৃত্যু হয় পদ্মমহলে তাহলে বড়ই দুশ্চিন্তার বিষয়।
রুকসানা বিরক্ত হয়ে বললেন, কেন বাদশাহ, কেন আপনি একজন ব্রাহ্মণ কন্যাকে জোরপূর্বক কাঞ্চনী হতে বাধ্য করছিলেন? এ দেশে কি কাঞ্চনীদের অভাব আছে? প্রজা বিদ্রোহ দমন করা সহজ কর্ম নয়।
মুসাফির বললেন, রুদ্রনগরের গুমঘরে গায়েব করে দিতে হবে বেগম। এ সংবাদ বাইরে বেরোতে দিলে হবে না। রুকসানা আদেশের সুরে বললেন, প্যাট্রিক হাকিমকে খবর দিন বাদশাহ। আগে তার প্রাণ বাঁচানোর প্রচেষ্টা করা হোক।
মুসাফির রক্ষীকে আদেশ দিলেন প্যাট্রিককে ডেকে আনতে। মুসাফির নিজেও একজন চিকিৎসক। তাই রুকসানার নির্দেশে মধুবালার প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করলেন বাদশাহ স্বয়ং।
প্যাট্রিক এসে প্রবেশ করলেন পদ্মমহলে। অবিন্যস্ত চুল, উদ্ভ্রান্তের মত দৃষ্টি দেখে মুসাফির চিন্তান্বিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, চিকিৎসক তুমি কি শারীরিকভাবে অসুস্থ? কথা না বলে প্যাট্রিক নিজের কোলের মধ্যে তুলে নিলেন মধুবালাকে। ওর পরনে কাঞ্চনীর পোশাক। পায়ে ঘুঙুর। কপালে টিকলি। চোখ দুটি বন্ধ রয়েছে। বুকে মাথা দিয়ে শুনলেন প্যাট্রিক, খুবই ক্ষীণভাবে পড়ছে মধুবালার শ্বাস-প্রশ্বাস।
নিজের ঔষধের সামগ্রী থেকে সঠিক ঔষধ নির্বাচন করে মধুবালার মুখে দেওয়া হলো কোনোক্রমে। পর্দার আড়াল পেরিয়ে রুকসানা বললেন, হাকিম আপনি বলুন সংকট কাটতে কতক্ষণ লাগবে? আমি চাই না এই মুহূর্তে হুজুরের বদনাম ছড়িয়ে পড়ুক বিষপুর এলাকায়।
প্যাট্রিক স্থির কণ্ঠে বললেন, আজ আমি হুজুর এবং বেগম সাহেবার নিকট একটা আর্জি নিয়ে এসেছি। যদি মঞ্জুর হয় তো সম্মানিত হবো। যদি মঞ্জুর না হয় তাহলে হুজুর যেন আমার মুন্ডু ছেদ করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
রুকসানা চমকে উঠলেন। প্যাট্রিকের সঙ্গে মুসাফিরের দোস্তির কথা রুদ্রনগরের সকলেরই অবগত। মুসাফিরের আপনজন হিসাবেই পরিচিত প্যাট্রিক। তারপরেও কি এমন গর্হিত অপরাধ যে বাদশাহ তার মুন্ডু ছেদন করতে উদ্যত হতে পারেন!
মুসাফির বললেন, নির্ভয়ে বলো প্যাট্রিক।
প্যাট্রিক তখন মানসিক চাপে বিধস্ত। তাঁর প্রেমিকা মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তিনি প্রতিশ্রুতিভঙ্গের দায়ে দণ্ডিত হয়েছেন মধুবালার কাছে।
অসংলগ্ন কথাগুলোকে আপ্রাণ চেষ্টায় সাজিয়ে নিয়ে প্যাট্রিক বললেন, হুজুর আপনার পিতা আমায় রাজবৈদ্যের পদে আসীন করতে চেয়েছিলেন। আপনি সেদিন উপস্থিত ছিলেন রাজ দরবারে। আমি সেই পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেছিলাম। কথা দিয়েছিলাম রুদ্রনগরের বফাদার থাকবো। আপনার পিতা জানিয়েছিলেন সে পুরস্কারের ভাগীদার আমি। তাই রাজবৈদ্য না হলেও আমি যে কোনো সময়ে সেই পুরস্কারের দাবি জানাতে পারি। সেটা মঞ্জুর করবেন উনি।
রুকসানা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন, হাকিম সাহেব এটা কি সঠিক সময় পুরস্কারের দাবি জানানোর?
প্যাট্রিক বললেন, বেগম সাহেবা গোস্তাকি মাফ করবেন। এটাই সঠিক সময় এ পুরস্কারের দাবি জানানোর।
মুসাফির বললেন, জানতে চাই কি সেই পুরস্কার? রাজবৈদ্য পদে বর্তমানে আসীন হতে চাও প্যাট্রিক? তবে তা মঞ্জুর হলো।
প্যাট্রিক মাথা নিচু করে কম্পিত কণ্ঠে বললেন, আমি মধুবালাকে চাই হুজুর। আমি ওকে বিবাহ করতে চাই। মুসাফির কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর হাসতে শুরু করলেন। বললেন, শেষ পর্যন্ত এক কাঞ্চনীর প্রেমে মজলে হাকিম? তোমার দেশের লোকজন তো রসিকতা করবে হাকিম।
রুকসানা বেগম বললেন, আমি এখন হারেমের মালকিন। তাই এ প্রার্থনা শুধু আমিই মঞ্জুর করার ক্ষমতা রাখি।
প্রথম দর্শনেই এই ফরাসি চিকিৎসককে ভালো লেগেছিলো রুকসানার। এ যেন একটু অন্যরকম মানুষ। এর দৃষ্টিতে সর্বদা সম্ভ্রম রয়েছে।
প্যাট্রিক বেগমের সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসে বললেন, আমায় মধুবালাকে উপহার হিসেবে দান করুন বেগম সাহেবা। আমি আপনার আজীবনের বফাদার হলাম।
রুকসানা বললেন, এমন প্রেমিক যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বাদশাহ। কাঞ্চনীর ভাগ্যকেও এই মুহূর্তে ঈর্ষা করছেন রুদ্রনগরের ছোটি বেগম সাহেবা।
হাকিম সাহেব, আজ থেকে এ কাঞ্চনীর ওপরে অধিকার শুধুমাত্র আপনার।
মধুবালা চক্ষু উন্মোচন করলো। অনুভব করলো সে তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির কোলে শুয়ে আছে।
বিষক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছে প্যাট্রিকের ঔষধ।
মধুবালা তার পাপড়ির মত ঠোঁটদুটো উন্মোচন করে বললো, আমায় বাঁচালেন কেন ভিনদেশী? আমি অন্য কোনো পুরুষের মনোরঞ্জন করতে অক্ষম। আমায় মৃত্যু দিন।
বাদশাহ বললেন, আজ থেকে তুমি হাকিমের সম্পত্তি। এই প্রথম কোনো কাঞ্চনী রুদ্রনগরের হারেম থেকে মুক্তি পেলো। নজিরবিহীন ঘটনা ঘটলো এই রুদ্রনগরের প্রাসাদে।
রুকসানা বললেন, হারেমের সব বেগম এবং বাদীকে জিজ্ঞাসা করা হবে তারা হারেমে থাকতে ইচ্ছুক কি না। যদি তারা স্বেচ্ছায় থেকে যায় তাহলে থাকবে। আর যারা বন্দি থাকতে চায় না, আমি তাদের মুক্ত করে দেব বাদশাহ। এটাই রুকসানা বেগমের মর্জি। বাদশাহ বললেন, হারেমের মালকিন তুমি রুকসানা। তাই তোমার মর্জিই রুদ্রনগরের ইচ্ছে।
মধুবালাকে নিজের কোলে তুলে পদ্মমহল পরিত্যাগ করলেন প্যাট্রিক। নিজের বিশাল বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুললেন মধুবালাকে।
মধুবালা লজ্জিত হয়ে বললো, আমায় ক্ষমা করুন ভিনদেশী কুমার। আমি আপনার সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেছিলাম।
চুম্বনে চুম্বনে মধুবালাকে সিক্ত করতে করতে প্যাট্রিক বললেন, তুমি কাঞ্চনী নও, আমার ঘরণী।
.
রাতের অন্ধকারে একটা সফেদ আরবি ঘোড়া থামলো বিষপুরের নীলকণ্ঠের মন্দিরের সম্মুখে। দুটো ছায়া মূর্তি গোপন পথ দিয়ে প্রবেশ করলো মন্দিরের গর্ভগৃহে।
ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। সামনে ধ্যানগম্ভীর হয়ে বসে আছেন চিত্তহরণ পণ্ডিত। তাকে সমাজচ্যুত করেননি জমিদার। তবে তার কন্যার এই গর্ভগৃহে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন তিনি।
বিস্মিত হয়ে দেখলেন, তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে মধুবালা ও ফারসি হাকিম।
মধুবালা বললো, পিতা, সনাতন পণ্ডিতের গণনা নির্ভুল হলো। আমি ওই ভিনদেশীকে বিবাহ করতে আগ্রহী। উনিই আমায় কাঞ্চনী দশা থেকে মুক্ত করেছেন। আমায় কাঞ্চনী হতে দেননি। গৃহিণী করে রাখবেন উনি।
.
চিত্তহরণ সমাজের বিধিনিষেধ ভুলে কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। নীলকণ্ঠের সম্মুখে নিজে দাঁড়িয়ে বিবাহ দিলেন ভিনদেশী চিকিৎসকের সঙ্গে নিজ কন্যার।
আর মধুবালাকে নির্দেশ দিলেন আর যেন কোনোদিন সে প্রবেশ না করে নীলকণ্ঠের গর্ভগৃহে।
মধুবালার চোখে জল। নীলকণ্ঠ তাকে এভাবে পরিত্যাগ করলেন ভেবেই বুকটা মুচড়ে উঠলো।
প্যাট্রিক মধুবালাকে আশ্বস্ত করে বললেন, আমার বাড়িতে একটা গৃহে অবস্থান করবেন তোমার নীলকণ্ঠ। আমি আগামীকাল শিল্পীকে নির্দেশ দেব বিষপুরের নীলকণ্ঠের মূর্তি গড়ে দিতে। তুমি প্রত্যহ ভোরে তোমার সঙ্গীতের মূর্ছনায় জাগ্রত করবে সে প্রস্তর মূর্তিকে।
মধুবালা খুশিতে ঝলমল করে উঠলো। নীলকণ্ঠকে প্রণাম করে বললো, আমার স্বপ্নে দেখা সেই ভিনদেশী রাজপুত্রকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকলাম ঈশ্বর। আমি আপনার আজীবনের সেবাদাসী রইলাম।
.
রাতের অন্ধকারেই সেই সফেদ ঘোড়াটা বিষপুর পরিত্যাগ করলো।
পরিণতি পেলো প্যাট্রিক ও মধুবালার প্রেমকাহিনী। শুরু হলো তাদের নবজীবন।
.
তথ্যসূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকার মুঘল হারেমে ফরাসি প্রেমিক নিবন্ধ।