হারিয়ে যাওয়ার আগে – ১
১
অন্যমনস্ক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলো প্রান্তিক। আচমকা মনে হল কানের খুব কাছে কেউ একজন ফিসফিস করে কিছু বলছে। চমকে উঠে দেখলো একটা বছর চোদ্দোর ছেলে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের ঘড়ি জানান দিচ্ছে এখন রাত্রি একটা পাঁচ। যদিও পুজোর সময় মহানগরীতে মধ্যরাত বলে কিছু হয় না, সারারাত মানুষের ভিড় দেখা যায় রাস্তায়। তবুও কমপ্লেক্সের ছাদে এসময় কাউকে দেখবে এটা আশা করেনি প্রান্তিক। ছেলেটা আবার ফিসফিস করে বললো, তুমি এত রাতে পুজোর সময় এখানে কি করছো গো?
প্রান্তিক ভালো করে তাকিয়ে দেখলো ছেলেটার দিকে। বেশ অভিজাত চেহারা, পরনে দামি জিন্স আর টি শার্ট, হাতে স্মার্টওয়াচ, পায়ে স্নিকারস, হেয়ার কাটিংটাও বেশ স্টাইলিশ। প্রান্তিক ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো, তুমি এত সেজেগুজে ঠাকুর দেখতে না গিয়ে ছাদের অন্ধকারে কি করছো বলতো?
ছেলেটা নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, সৌগত চৌধুরী। আমার ডাক নাম ইভান। ক্লাস এইটের স্টুডেন্ট।
‘এইট’ শুনে ইমম্যাচিওর্ড ভাবার মত বোকা বোধহয় তুমি নও, তাই আমাকে বলতেই পারো এত রাতে কেন এসেছো ছাদে? কোনো বদ মতলব আছে নাকি?
প্রান্তিকের ভাবনায় ছেদ পড়ায় ও বিরক্ত হয়ে বললো, কেন ছাদটা কি তোমার একার নাকি, যে আর কেউ আসতে পারবে না? আমি ছাদের উপর থেকে পুজো দেখবো বলে এসেছি। ইভান ফিকফিক করে হেসে বললো, তোমায় না বলেছিলাম, আমায় ইমম্যাচিওর্ড ভেবো না। সেই ভুলটাই করলে! রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখেছো, লিলিপুট লাগছে লোকগুলোকে, এখান থেকে তুমি পুজো দেখতে এসেছিলে? হাউ ফানি ঢপ।
ইভানের দিকে তাকিয়ে প্রান্তিক ফিক করে হেসে বললো, বেশ, বুঝলাম আমি ঢপ দিচ্ছি, কিন্তু তুমি কি করতে এখানে এসেছিলে বলবে?
ইভান আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ওই যে ওই ইস্ট কর্নারের যে স্টারটা দেখছো, শি ইস মাই মম। আমি ডিসিশন নিলাম, আমি মমের কাছে চলে যাব। তাই ছাদে এসেছি, এখান থেকে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়বো আর মম আমায় কোলে তুলে নেবে, যেমন নিতো বছর দুয়েক আগে। জানো আমার মম একজন সিঙ্গার ছিল। দারুণ গান গাইতো। আমায় রোজ রাতে ঘুম পাড়িয়ে দিত গান গেয়ে। আমার বাবা প্রোমোটার। মা বছর দুয়েক আগে কিচেনে গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট করে মারা যায়। আমি তখন ঘুমিয়েছিলাম। সবাই ফিসফাস করছিলো, বাবা নাকি মাকে মেরে দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করিনি। বাবা আর মায়ের মধ্যে মাঝে মাঝে মধ্যরাত পর্যন্ত ঝগড়া হতো। মা বলতো, আগে বলো, বিদিশার সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক?
বাবা বলতো, শি ইস জাস্ট মাই গুড ফ্রেন্ড।
মা কাঁদত, রাগ করতো, পরের দিন সকালে আবার বাবার ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিতো। আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না। আমায় বাবা সময় দিতো না ঠিকই, কিন্তু কখনো মারধর করতো না। তারপর একদিন হঠাৎই মায়ের এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেলো। আমি আর বাবা দুজনেই রয়ে গেলাম ফ্ল্যাটে। প্রথম প্রথম রোজ আসতো বিদিশা আন্টি আমার দেখাশোনা করতে, আমার সঙ্গে গল্প করতে। আমি খুব ভালোবাসতাম আন্টিকে। তারপর বছরখানেক পরে বিদিশা আন্টির আসাও কমে গেলো। কণিকা নামের একজন মেড থাকতো আমাদের বাড়িতে। অল্পবয়সী, কিন্তু আমায় খুব যত্ন করে। একা একাই বড় হতে লাগলাম আমি। কিন্তু গত একমাস ধরে যা দেখছি তাতে আর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই নেই। বেশ বুঝতে পারছি, আমার মাকে কিছু প্রশ্ন করার দরকার হয়ে পড়েছে। আমায় জানতে হবে মা ঠিক কেন চলে গেলো? বাবা আর বিদিশা আন্টির কারণে, নাকি আমি মাসখানেক ধরে যেগুলো আবিষ্কার করলাম সেগুলোর কারণে? আমাকে মা ঠকিয়েছে এটা ভাবতেই পারছি না। তাই প্রশ্নটা করতেই হবে সামনাসামনি। আমি মমের কাছে যেতে চাই। দাদাভাই, ক্যান ইউ হেল্প মি প্লিজ?
প্রান্তিক নরম গলায় বলল, হেল্প? কিভাবে?
ইভান হেসে বললো, ভয় করছে নিচের দিকে তাকাতে! দুবার ট্রাই করেছি কিন্তু ভয় করছে। আমি পা ঝুলিয়ে বসছি, তুমি একবার ঠেলে দেবে? প্লিজ একবার ঠেলে দাও না দাদাভাই। আমি মমের কাছে যেতে চাই।
প্রান্তিক বললো, খুন করতে বলছো?
ইভান কাঁদতে কাঁদতেই বললো, আমি মায়ের কাছে যেতে চাই, প্লিজ হেল্প মি। কেউ জানতে পারবে না, আমি সুইসাইড নোট লিখেছি, পকেটে আছে। তোমার কোনো প্রবলেম হবে না।
প্রান্তিক একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললো, আমিও পুজো দেখতে এখানে আসিনি। মহানগরীর জমকালো পুজোটা এবারে আমার কাছে বড্ড ম্রিয়মাণ। আমিও এই হাইরাইজের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাই নিচের ভূমিতে।
দেখো ইভান, তোমার জীবনের এখনও অনেক বাকি। তুমি এখন বড্ড বাচ্চা। এখনই কেউ মরে না। আমি জীবনটাকে কাছ থেকে দেখেছি, বিতৃষ্ণা এসেছে আমার জীবনে, তাই আমি শেষ করতে চাই নিজেকে। যতই ভালো চাকরি করি, স্বাধীনভাবে একা থাকি, দুঃসহ হয়ে উঠেছে জীবনটা। কিন্তু এতটা উপর থেকে যতবার নিচের দিকে তাকাচ্ছি প্রচণ্ড ভয় করছে, তাই প্লিজ ইভান আমাকে তুমি একটু ঠেলে দাও, আমি মরতে চাই। কিছু না, জাস্ট পিঠে একটা ঠেলা দেবে তাহলেই কাজ শেষ। তারপর সোজা নীচে গিয়ে ঘরে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। সকালে যদি চেঁচামেচি হয় তখনও তুমি সামনে আসবে না। তোমার কাজ শেষ, সিম্পল। প্লিজ ইভান হেল্প মি। বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করার ক্ষমতা আমার আর নেই। তাই বলছি, এটুকু করে দাও এই দুর্গাপুজোর রাতে।
.
ইভান একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ওহ রিয়েলি? আমার থেকে তোমার জীবনটা বুঝি বেশি কষ্টকর? দেখো প্রান্তিকদা, তুমি যতটুকু বললে তাতে এটুকু বুঝলাম, তুমি একটা ভালো জব করো, নিজের ইচ্ছেয় এই ফ্ল্যাটে একা থাকো। এখন যদি একাকীত্ব তোমায় গ্রাস করতে আসে আর তুমি সুইসাইডের সিদ্ধান্ত নাও, তাহলে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমার প্রবলেমটা তোমার মত সাজানো নয়, রিয়েল প্রবলেম।
ইভান বোধহয় বয়েসের তুলনায় একটু বেশিই ম্যাচিওরড। প্রান্তিকের অন্তত তাই মনে হলো। বছর চোদ্দোর ছেলে যে এতটা পরিণত হয় ওর জানা ছিল না। হয়তো মা-বাবা ছাড়া একা থাকতে থাকতে এমন হয়ে গেছে।
.
প্রান্তিক বললো, সবটা শুনে যদি মনে হয়, আমার প্রব্লেমটা তোমার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে কিন্তু আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ো ইভান। ইভান বললো, আমার তো মনে হয় না আমার থেকে আর কারোর প্রবলেম বেশি জটিল হতে পারে। ওকে, তাহলে ডিল করি, যার প্রবলেম বেশি গভীর তাকে অন্যজন হেল্প করবে সুইসাইড করতে। বলো, রাজি?
প্রান্তিক আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, রাজি।
মধ্যরাতের নিস্তব্ধতায় দুই অসমবয়সী মানুষ ডুব দিলো অতীতের অভ্যন্তরে। ওদের দৃষ্টিপথে প্রকট হলো বছর দুয়েক আগের দিনগুলো।