হারিয়ে যাওয়ার আগে – ২
২
শরতের আকাশে পেজা তুলোর মত মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে নিজের খেয়ালে। তিলোত্তমা সেজে উঠেছে পুজোর মেজাজে। আলোয় আলোয় ঢেকেছে রাস্তাঘাট। ঢাকের বাদ্যি আর নতুন পুরোনো গানের মিশ্রণে বাতাসেও আনন্দের সুর। যদিও এই হাইরাইজের বারো তলার ছাদে পুজোর রেশ এসে পৌঁছাতে পারেনি। এমনকি নিচের আলোর রেখাও উঠতে পারছে না এত উঁচুতে। নিচের দিকে তাকালে শুধুই মানুষের ঢল, যদিও এত উঁচু থেকে তাদের দেখতে গ্যালিভার ট্রাভেলসের ক্ষুদ্র মানুষদের মতই লাগছে। সামনেই ভূমিশ্রীর বিখ্যাত দুর্গা, তাই ‘সন্ধ্যাতারা’ কমপ্লেক্সের অনেক আগে থেকেই লাইন পড়েছে। সন্ধ্যাতারা কমপ্লেক্সের ‘বি’ ব্লকের সাততলার বাসিন্দা প্রান্তিক। প্রান্তিক ব্যানার্জী। মেট্রোরেলে কর্মরত। বয়েস আন্দাজ সাতাশ বছর।
সুঠাম জিম করা চেহারা, গোল্ডেন ব্রাউন কালারের চুল, টিকালো নাক, উজ্জ্বল শ্যাম গায়ের রং আর নিখুঁত ট্রিম করা দাড়ির দিকে তাকালে একনজরে বলা যেতেই পারে স্টাইলিশ। সব মিলিয়ে দেখতে মন্দ নয়। বিশেষ করে ওর স্মার্টনেস চোখে পড়ার মত। কথায় বিশেষ পারদর্শী নয় ও, তবে অপটু বলেও দুর্নাম নেই। সন্ধ্যাতারা হাইরাইজে ফ্ল্যাট কেনার মত বড়লোক প্রান্তিক নয়। এ হলো রীতিমত অভিজাতদের পাড়া। যারা উঁচুতে বসে একাকীত্ব উপভোগ করতে ভালোবাসে। প্রান্তিক শহরতলির ছেলে, নৈহাটিতে ওর পৈতৃক বাড়ি। মা, দাদা, বৌদি, ভাইপোর গোছানো সংসার। নৈহাটি থেকেই বছর দুয়েক জবটা কনটিনিউ করেছিল প্রান্তিক। তারপর পরিচয় হয়েছিল ওদেরই অফিসের সুপর্ণার সঙ্গে।
সুপর্ণা প্রান্তিকের থেকে বছর দুই-তিনেকের বড়, বেশ গোলগাল চেহারার হাসিখুশি মেয়ে। প্রান্তিককে বলেছিল, তুই কিছু কচি খোকা নয় যে আমায় সুপর্ণাদি বলে ডাকবি। শুধু সুপর্ণা বল। শোন সরকারি চাকরি করছিস বছর দুয়েক হলো, মাইনে-পত্তর তো খারাপ পাস না। তো মহানগীরর টপে বসে দুর্গাপুজোর আমেজ নিতে ইচ্ছে করে না তোর? কলকাতায় চাকরি করছিস আর মফঃস্বলে পড়ে থাকবি, এ কেমন কথা রে! সাউথে একটা ছোট দেখে ফ্ল্যাট কিনে ফেল দেখি। প্রান্তিক হেসে বলেছিল, তোমার কি মাথা খারাপ হলো সুপর্ণা? এসব অভিজাত কমপ্লেক্স মধ্যবিত্তদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। সারাটা জীবন ব্যাংকে চড়া ই.এম.আই দিতে দিতেই মাথার চুল সাদা হয়ে যাবে। যদি একান্তই কখনো ফ্ল্যাট নিই তবে দমদমের দিকে কিছু ছোট ফ্ল্যাট হচ্ছে, বিজ্ঞাপন দেখলাম, ওখানে বুক করতে পারি। কিন্তু সাউথে কোথাও কেনার ক্ষমতা আমার নেই।
.
সুপর্ণা হেসে বলেছিলো, ধুর! ইচ্ছেটাকে বড় করতে হয় বুঝলি? যদি তুই চৌরঙ্গীতে ভাবিস তবে ঢাকুরিয়ায় পাবি। যদি দমদম ভাবিস তাহলে নৈহাটিতেই থাকবি, বুঝলি কিছু? কাল বিকেলে ঢাকুরিয়ায় ‘সন্ধ্যাতারা’ কমপ্লেক্সে আমার ফ্ল্যাটে চলে আয়, তোকে কলকাতা দেখাবো।
সুপর্ণার কথা মত প্রান্তিক এসে হাজির হয়েছিলো সুপর্ণার ফ্ল্যাটে। মাত্র আটশ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট, কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর ভাবে সাজানো। দেখে মনে হচ্ছে কত বড়। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সন্ধের মহানগরীকে দেখে আপ্লুত হয়েছিল প্রান্তিক। এভাবে তো দেখা হয়নি কখনো। আলোয় আলোয় সেজে আছে তিলোত্তমা। অত্যন্ত ব্যস্ত সে, কাউকে গুরুত্ব দেবার কোনো দায় যেন তার নেই। বরং ভাবটা এমন যেন তোমরা দেখে মুগ্ধ হও আমার ব্যক্তিত্ব, ব্যস্ততা, সৌন্দর্য কিন্তু আমি ফিরেও দেখবো না তোমাদের। তোমরা বারবার আকর্ষিত হবে আমার রূপে, ছুটে ছুটে আসবে আমার দুয়ারে কিন্তু আমি চলবো বহতা নদীর মতই। তোমরা মিশে থাকবে জনসমুদ্রে, আলাদা করে চিনবো না তোমাদের। শুধু বলবো, তোমরা সবাই এই মহানগরীর বাসিন্দা অথবা অতিথি মাত্র, আমিই সত্য। প্রান্তিক মনে মনে বলেছিল, অহংকারী তিলোত্তমা, তবুও তোমার বুকে এলে লাখো লাখো প্রাণের স্পন্দন অনুভব করতে পারি।
সুপর্ণা বলেছিলো, দেখ প্রান্তিক এখন সবে চতুর্থী তাতেও মানুষের ঢল দেখেছিস? ওপর থেকে দেখে নিজেকে রাজা রাজা মনে হচ্ছে না? তুই এদের সকলের মাথায় বসে আছিস কিন্তু। আর আমাদের মেট্রোর অফিসে কি হয়? আমরা বসে থাকি পাতালে আর লোকেরা আমাদের মাথার ওপর দিয়ে হেঁটে যায়। ধুর, বাঁচবি যখন সম্রাটের ফিলিংস নিয়ে বাঁচবি, অন্তত নিজের কাছে। তাই বলছি, তুই এখানে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেল।
প্রান্তিক স্বপ্ন থেকে আছড়ে পড়েছিলো বাস্তবের মাটিতে।
এই ‘সন্ধ্যাতারা’ হাইরাইজে ফ্ল্যাট কিনবে প্রান্তিক? পাগলেও এমন স্বপ্ন দেখতে ভয় পাবে, আর ও তো সুস্থ মানুষ। ওর বয়েসী ছেলের চোখে স্বপ্ন একটু বেশিই থাকে, তাই বলে এমন দুঃস্বপ্ন কখনোই নয়।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই সুপর্ণার ফ্ল্যাটে বেল বেজেছিলো।
দরজা খুলতেই একটি বছর বাইশের অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে ড্রয়িংয়ে এসে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, এটা কে সুপর্ণাদি? তোমার ভাই?
সুপর্ণা বলেছিল, হ্যাঁ রে, ভাই প্লাস কলিগ।
মেয়েটা ঝর্ণার মত হেসে বলেছিল, অনেকটা গ্রিক ভাস্কর্যের মত দেখতে তোমার কলিগকে, কিন্তু এমন আনসোশ্যাল কেন? হাই, হ্যালো কিছুই কেন বললো না?
কিছু কিছু সৌন্দর্য তৈরিই হয় মানুষের চোখ ঝলসে দেবার জন্য। এই মেয়েটিও তাই। মেয়েটির উপস্থিতি বাকি সব কিছুকে ফিকে করে দিতে বাধ্য। মেয়েটি নিজেই সপ্রতিভভাবে এগিয়ে এসে বলেছিলো, ঈশা রায়। মাস্টার্সের ফাইনাল ইয়ার, বিষয়- ফাইন আর্টস। পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার।
ঈশার দিকে তখনও হাঁ করে তাকিয়ে বসেছিলো প্রান্তিক। মনে হচ্ছিল পলকের জন্য চোখ সরালেই বোধহয় একটা মূল্যবান মুহূর্ত মিস হয়ে যাবার সম্ভবনা রয়েছে। তাই এই অমূল্য সময়টুকুকে নষ্ট না করে দেখে নিতে চাইছিলো ঈশার থুতনির ভাঁজের বিউটি স্পটের ঔদ্ধত্যকে।
সুপর্ণা বললো, ওর নাম প্রান্তিক ব্যানার্জী, ও মেট্রো রেলের ইঞ্জিনিয়ার, পাশ করেই জব পেয়েছে, বছর দুয়েক হলো আমার সঙ্গে জব করছে। ব্রিলিয়ান্ট এন্ড সোবার বুঝলি?
ঈশা খিলখিল করে উচ্ছল ঝর্ণার মত হেসে বলেছিলো, তোমায় কি অ্যাসিসটেন্ট নিয়োগ করেছে নাকি? তুমিই ওর বায়োডাটা দিচ্ছ?
প্রান্তিক সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলেছিলো, আমার নৈহাটিতে বাড়ি। নাম তো শুনাহি হোগা। প্রান্তিক।
ঈশা হেসে বলেছিলো, শুনিনি আপনার নাম।
প্রান্তিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিলো, সেটা আপনার ফল্ট, আমার নয়। যেমন আপনার নাম আমি অনেক শুনেছি।
ঈশা চমকে উঠে বলেছিলো, কোথায় শুনেছেন?
প্রান্তিক গম্ভীরভাবে বলেছিল, কবিতায়-গল্পে বহুবার শুনেছি। ঈশা হেসে বলেছিলো, না আপনাকে যতটা আনসোশ্যাল লাগে ততটা আপনি নন।
সুপর্ণা বলেছিল, তোদের পরিচয় পর্ব কি মিটেছে? তাহলে কাজের কথাতে আসি, তুই বল ঈশা আমার লেহেঙ্গাটা কেমন করতে চাইছিস? কোনো স্কেচ এনেছিস?
ঈশা দুটো ক্যাটালগ সেন্টার টেবিলে রেখে বলেছিলো, এই যে দেখো। এগুলো সব আমার ডিজাইন করা, এর মধ্যে যদি কোনটা পছন্দ হয় দেখো, নাহলে তোমার কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া আমার দায়িত্ব। কেমন নিতে চাও শুধু বলো?
প্রান্তিক অবাক হয়ে বলেছিল, সুপর্ণা তুমি হঠাৎ ডিজাইনার ডেকে লেহেঙ্গা কেন বানাচ্ছ, বিয়ে করছো নাকি?
সুপর্ণা ফিক করে হেসে বললো, ইয়েস। অঘ্রানের প্রথমেই আমার বিয়ে। শোন, পাত্র বিদেশে থাকে বুঝলি! আমি বিয়ের পরে সোজা চলে যাবো জার্মানি।
প্রান্তিক ছটফট করে বলেছিল, আর তোমার জব?
সুপর্ণা বললো, সেটাও ওখানে করবো। আরে ইঞ্জিনিয়ারদের চিন্তা কি রে, যেখানে যাবে ঠিক জুটিয়ে নেবে। সৌজন্য আর আমি সেই কলেজবেলার বন্ধু।
প্রেম সেই তবে থেকেই। তুই তো জানিস আমি জামশেদপুরের মেয়ে। আমার বাবা নেই, মা দাদার কাছে থাকে। দাদার সঙ্গে কোনোদিনই বনিবনা হয় না আমার। তাই জামশেদপুরের বাড়ি বা প্রপার্টির ভাগ ছেড়ে দিয়েছি দাদাকে। সেজন্য দাদা আমায় একটা মোটা অ্যামাউন্ট দিয়েছিলো। সেই থেকেই এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিলাম। পুরোটা ক্যাশে নয়, কিছু লোন ছিলো। যখন ফ্ল্যাটটা কিনেছিলাম তখন সৌজন্য আর আমার ভাবনা ছিলো কলকাতাতেই সেটেলড হবো। তারপর হঠাৎ সৌজন্যর অফিস থেকে একটা লোভনীয় সুযোগ এলো জার্মানিতে। বছর তিনেক হলো ও জার্মানিতে সেটেল্ড।
এখানে ফিরবে না বোঝাই যাচ্ছে। তাই আমিও ভালোবাসার টানে ওখানেই সেটেল্ড হতে চাই।
আমার জবের ব্যবস্থাও সৌজন্য করে ফেলেছে। শুধু বিয়েটা বাকি আছে এই যা। ফরম্যালি বিয়ে করে উড়ে যাবো কলকাতা ছেড়ে।
বিশ্বাস কর প্রান্তিক, কলকাতার এই ‘সন্ধ্যাতারা’ কমপ্লেক্সে থেকে মহানগরীকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তাই ছাড়তেও ইচ্ছে করছে না, আবার সৌজন্যকে ছাড়ারও কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাই ভেবে দেখলাম, এই ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দেবো। এমনিতেই কলকাতায় সৌজন্য আর আমার নামে একটা জয়েন্ট ফ্ল্যাট ও কিনেই রেখেছে। ওটাতেই একদিনও থাকা হয়নি। তারপর আবার এটা রেখে দিয়ে লাভ নেই। বড্ড শখ করে কিনেছিলাম জানিস প্রান্তিক, নিজের টাকায়। সাজিয়েওছিলাম প্রাণ ভরে। তাই কোনো ব্রোকারের হাতে দিতে চাই না। যদি কখনো কলকাতায় আসি যেন একটা সন্ধে কাটাতে পারি এখানে ব্যালকনিটাতে। তাই তোকে বলছিলাম, তুই কিনবি প্রান্তিক?
প্রান্তিক একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, কিন্তু সুপর্ণা এর তো অনেক দাম, আমি কিভাবে….
সুপর্ণা ছলছল চোখে বলেছিলো, ধীরে ধীরে ই.এম.আই-এ কেন। প্রতি মাসে আমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিবি। ফার্নিচারের দাম আমি কিছু ধরছি না। ফ্ল্যাটের দামটা শুনেও চমকে গিয়েছিলো প্রান্তিক। এত কম? সুপর্ণা বলেছিলো, ফ্ল্যাটটা আমি বুক করেছিলাম প্রায় বছর ছয়েক আগে। তখন এই দামই ছিল। তখন সদ্য উঠছে এই সন্ধ্যাতারা। ছয় বছরে এর দাম দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু এটা আমার সন্তানের মত, তাই একে চড়া দামে বেচতে পারবো না। শুধু দেখিস যেন যত্নে থাকে ও। অ্যাকুয়ারিয়মের মাছগুলো যেন মরে না যায়, ব্যালকনির এরিকাপামটা যেন শুকিয়ে না যায়, এটুকু খেয়াল রাখিস।
প্রান্তিক রাজি হবে কিনা ভাবছিলো, ঠিক তখনই ঈশা হাততালি দিয়ে বলেছিল, বাহ, দারুণ হবে। সুপর্ণাদি চলে যাবে শুনে মনখারাপ হয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলাম এই হাইরাইজের মাত্র হাতে গোনা তিনটে ফ্ল্যাটে আমার অবাধ বিচরণ, তার একটা বন্ধ হয়ে যাবে। প্রান্তিক এলে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হলে আমি লুকিয়ে থাকতে পারবো এখানে। এতদিন যেমন থেকেছি।
প্রান্তিক ঈশার চোখের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলো, এমন মৃগনয়নার জন্যই বারবার যুদ্ধ হয়েছে পৃথিবীর বুকে, ট্রয়ের যুদ্ধ থেকে কুরুক্ষেত্র সব ক্ষেত্রেই বোধহয় ইন্সপিরেশন ছিল ঈশার মত কেউ। বীরেরা যুদ্ধে প্রাণ দিতে পেরেছে আর ও এই ফ্ল্যাটটা কিনতে পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে, পারতেই হবে।
সুপর্ণা কিচেনে ঢুকলো ওদের জন্য স্ন্যাকস আর চা আনতে।
প্রান্তিক একটু মজার সুরেই বললো, ফ্ল্যাটটা যেদিন কিনবো বলে এগ্রিমেন্ট করবো সেদিন কিন্তু আপনাকেও প্রেজেন্ট থাকতে হবে।
ঈশা নিখুঁত প্লাক করা ভ্রু দুটো একটু উপরে তুলে বললো, আমি কেন প্রেজেন্ট থাকবো? ফ্ল্যাট তো কিনবেন আপনি, আর সাইন তো করবে সুপর্ণাদি, আমি কি করবো?
আরেকটা এগ্রিমেন্টে সাইন করতে হবে যে। এই ফ্ল্যাটে আমি শিফট করার পর রেগুলার আপনাকে হাজিরা দিতে হবে। বুঝতেই পারছেন, আমি এখানে একেবারেই একা, সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশ, তাই গাইড করার দায়িত্ব যদি লিখিত ভাবে আপনি নেন তবেই কিনতে পারি। নচেৎ ক্যানসেল করবো।
ঈশা পার্পেল কালারের নেলপলিশ পরা আঙুলটা থুতনির তিলে ঠেকিয়ে কিঞ্চিৎ ভেবে বললো, কম্প্যানি দেওয়ার জন্য চার্জ লাগবে যে। সেটা দিতে রাজি থাকলে আমিও এগ্রিমেন্টে সাইন করতে রাজি।
প্রান্তিক বলেছিল, ফিজটা কি পার্থিব না অপার্থিব?
ঈশা মুচকি হেসে বলেছিলো, সেটা এখুনি বলা যাবে না, যখন দরকার হবে চেয়ে নেবো।
প্রান্তিক ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, তার মানে আমায় দিয়ে সাদা কাগজে সাইন করিয়ে নেওয়া হচ্ছে তাই তো?
ঈশা আড়চোখে তাকিয়ে বলেছিলো, বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছে বুঝি আমায়?
প্রান্তিক গভীর গলায় বলছিলো, বিশ্বাস না করতে পারলে আমারই লোকসান, তাই ধৃতরাষ্ট্র হয়ে বিশ্বাস করলাম।
সুপর্ণা চা আর স্ন্যাকস নিয়ে এসে বসেছিলো, একটু যেন অন্যমনস্ক। বোধহয় কলকাতা ছেড়ে, জবটা ছেড়ে চলে যাবার কষ্টটুকুকে সহ্য করছিলো নীরবে।
প্রান্তিক বলেছিলো, সুপর্ণা তোমার এই ফ্ল্যাটটা আমি কিনতে রাজি, তবে শর্ত একটাই, কলকাতা ফিরলে যুগলে এই ফ্ল্যাটে উঠতে হবে। এবং আমার আতিথেয়তায় থাকতে হবে দুটো দিন অন্তত।
সুপর্ণা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেছিলো, তুই কিনবি? তাহলে আর চিন্তা রইলো না আমার। তোকে এই দু-বছর দেখে এটুকু বুঝেছি, তুই সম্পর্কের মানে বুঝিস। যত্ন করতে জানিস সেন্টিমেন্টকে। জানি তুই একটু একলা থাকতে পছন্দ করিস, তাই এই ফ্ল্যাট তোকে সেই নিরিবিলিও দেবে। তাহলে পেপার রেডি করি?
প্রান্তিক বলেছিলো, আপাতত তোমায় আমি লাখ দশেক হার্ড ক্যাশ দিতে পারবো। চেক লিখে দেব, বাকিটা মান্থলি তোমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেবো।
সুপর্ণা বললো, তুই পজেশন কবে নিতে চাস? প্রান্তিক হেসে বলেছিলো, যেদিন তুমি দিতে চাও!
সুপর্ণা একটু ভেবে বলেছিলো, নেক্সট মাসে দিয়ে দেবো তাহলে।
পরের মাসে প্রান্তিক পজেশন পেয়েছিলো সন্ধ্যাতারার বি ব্লকের সাততলার এই ফ্ল্যাটটার। মা এসে গৃহপ্রবেশের ছোট্ট একটা পুজো করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো। বাড়ির বাকিরা একটু বিরক্তই হয়েছিলো হঠাৎ এভাবে কলকাতায় শিফট করার সিদ্ধান্তে, তবে সামনে বিশেষ কিছু বলেনি। প্রান্তিক মাকে বলেছিলো, আমি সপ্তাহে সপ্তাহে যাবো তোমার কাছে, তোমায় সংসার খরচও দিয়ে আসবো। মা হেসে বলেছিলো, ওসব থাক, তুই ভালো থাকিস। বাড়ির ছেলে বাইরে শিফট করার কথা উঠলেই গোটা বাড়ির মানুষজন আচমকা তাকে পর করে দেয়, প্রান্তিকের বেলাতেও তার অন্যথা হয়নি। তবুও সন্ধ্যাতারা হাইরাইজের সাততলার ফ্ল্যাটটা বারবার ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো, তাই কিছুটা স্বার্থপরের মতই ও নৈহাটির বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলো ফ্ল্যাটে। সুপর্ণার যত্নে সাজানো ফ্ল্যাটে কোনো আসবাবই কিনতে হয়নি ওকে। শুধু ওয়ার্ডরোব খুলে নিজের জামাপ্যান্ট আর প্রয়োজনীয় জিনিসটুকু গুছিয়ে রেখেছিলো। প্রান্তিক ভেবেই নিয়েছিলো ফ্ল্যাটের টাকাটা শোধ করতে পারলে তারপর এসব আসবাবের দামও ধীরে ধীরে মিটিয়ে দেবে। খুব কম করে লাখ পাঁচেক টাকার ফার্নিচার আছে সুপর্ণার ঘরে। যেদিন থেকে প্রান্তিক এই ফ্ল্যাটে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলো সেদিন থেকেই বাড়ির সকলের সঙ্গে তৈরি হচ্ছিলো একটা অলিখিত দূরত্ব। কিন্তু এই হাইরাইজের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের আলো ঝলমলে মহানগরীকে দেখতে দেখতে একটা নেশায় পেয়ে বসেছিলো ওকে। অফিস থেকে ফিরে এককাপ চা নিয়ে ব্যালকনিতে বসাটা ওর রোজকার রুটিন ছিল। একাকীত্বের নীরবতাকে বড্ড ভালোবাসে প্রান্তিক। সুপর্ণা ঠিকই বলেছিল, রাজার মত বাঁচবি। সত্যিই প্রান্তিকের নিজেকে রাজা মহারাজাই মনে হতো। বড্ড মায়া পড়ে গিয়েছিল নিজের ছোট ফ্ল্যাটটার প্রতি। মাত্র মাস পাঁচেক আগে সুপর্ণার ধার শোধ করে ফ্ল্যাটটা রেজিস্ট্রি করিয়েছে প্রান্তিক ব্যানার্জীর নামে। যেটা একদিন স্বপ্ন ছিল সেটা সত্যি হয়েছে ওর জীবনে। কলকাতার অভিজাত পাড়ায় একটা নিজস্ব ফ্ল্যাট। দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিলো অবশ্যই একটা গাড়ি, সেটাও কিনতে সক্ষম হয়েছে। তাই যে কেউ প্রান্তিককে এখন সুখী-সফল পুরুষ বলতেই পারে। দেখতে দেখতে এই ফ্ল্যাটে কাটিয়েও দিলো দুটো বছর।