হারিয়ে যাওয়ার আগে – ৪
৪
ঈশা, ছেলেটা কিন্তু খুবই ভালো ছেলে রে। দেখেই বোঝা যায়। ঈশা বিবর্ণ মুখে বলেছিলো, জানি মা, প্রান্তিককে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই একটা কথা বুঝেছিলাম, ওর মধ্যে ‘র’ ব্যাপারটা এখনো আছে, পুরো পলিশড নয়। জানো মা, প্রান্তিক বলছিলো, আপনার মাকে দেখেই বোঝা যায়, মেয়েকে বড্ড বেশি আদর করে। আমি বললাম ছাই করে! শ্রেয়া মেয়েকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললো, তুই ছাড়া আর কে আছে রে দুনিয়ায়!
কেন দিদিভাই?
শ্রেয়া মনমরা গলায় বললো, সে আর থাকা কোথায় রে! মায়ের একটা কথাও সে শোনে? কি কাজ করে, কেন রাতে মাঝে মধ্যেই বাড়ি ফেরে না, ফিরলেও কেন কোনো উত্তর দেয় না কিছুই তো বুঝি না। বিদিশার সঙ্গে সম্পর্কটা দিনদিন বড্ড জটিল হয়ে যাচ্ছে রে। মনেই হয় না ও আমার মেয়ে। অথচ ছোটবেলায় তুই ছিলিস বড় দুষ্টু, আর বিদিশা ছিল আমার বাধ্য। তবে তুই ছিলিস মা হ্যাংলা আর বিদিশা ছোট থেকেই বাবা ন্যাউটা ছিলো। বাবা যতক্ষণ না কাজ থেকে ফিরছে ততক্ষণ পর্যন্ত ঠায় জেগে থাকতো। পাঁচ বছরের বড় দিদি হয়েও তোকে কত আগলাতো বলতো! মেয়েটা যেন গত একবছরে কেমন একটা বদলে গেলো। ঈশা বললো, মা দিদিভাই যবে থেকে জবটা জয়েন করলো তবে থেকেই কেমন যেন হয়ে গেল। ইদানীং আমার সঙ্গেও দায়সারা কথা বলে।
শ্রেয়া অন্যমনস্কভাবে বললো, কাউকে ভালো টালো বাসে, জানিস কিছু? ঈশা ঘাড় নেড়ে বললো, কিছুই জানি না। দিদিভাইয়ের ব্যাপারে আমি একেবারেই অজ্ঞ। কেমন যেন তল খুঁজে পাই না দিদিভাইয়ের গভীরতার। শ্রেয়া মানিপ্ল্যান্টটাতে সামান্য জল দিতে দিতে বললো, তোর বাবা মানুষটা চিরটাকালই চুপচাপ, বিদিশাও বোধহয় তোর বাবার স্বভাবটা পেয়েছে। ঈশা পাশবালিশটা জড়িয়ে ধরে বললো, আর আমি লাইক মাই মম।
শ্রেয়া নরম গলায় বললো, বড় হয়েছিস, একটা কথা বলি, যার সঙ্গেই বন্ধুত্ব করিস না কেন মানুষ চিনতে যেন ভুল করিস না। ভুল মানুষ হলে একটা জীবন কেটে যাবে আফশোস করতে করতে। তাই বলছি ঈশা, যাকে তাকে কাছের মানুষ ভেবো না। তবে একনজর দেখে প্রান্তিককে আমার বেশ ভালো মনে হয়েছে, তার মানে এই নয় প্রান্তিক বিশাল কিছু সার্টিফিকেট পেয়ে গেল। খুব বেশি মেলামেশার দরকার নেই।
মা গুরুগম্ভীর ভাবে কথাগুলো বলে চলে গেলো ঘর থেকে। ঈশা পাওয়ার ন্যাপের আশায় চোখ দুটো বন্ধ করলো।
দূরে একটা বেশ বড়সড় স্কুল দেখতে পাচ্ছে ঈশা। দুদিকে রেড রিবন বেঁধে একটা মেয়ে ছুটছে। সাদা শার্ট আর সাদা স্কার্ট, শুধু মাঝের কোমরের বেল্টটা রেড। মেয়েটা ছুটে স্কুলে ঢুকলো। গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা, মুখটা একটু কাঁচুমাচু করে। মেয়েটা ঢুকেই বললো, কি রে অনুভব, আজও তোর মনখারাপ?
অনুভব ম্লান মুখে বললো, বাবার সঙ্গে মার খুব ঝগড়া হয়েছে। বাবা বলেছে মাকে, আমার বিজনেস ডিলের জন্য তোমাকেও যেতে হবে মিটিংয়ে। মা বলেছে, নিজের স্ত্রীকে, নিজের সন্তানের মাকে যে মানুষ অন্যের হাতে তুলে দেয় তাকে নাকি স্বামী বলা যায় না।
জানিস ঈশা, আমাকে নিয়ে মা বোধহয় মামার বাড়ি চলে যাবে। ঈশা অনুভবের চোখ দুটো মুছে দিয়ে বলেছিলো, তাহলে আমার কি হবে! কে হবে আমার বন্ধু! আমি কার সঙ্গে টিফিন শেয়ার করবো? ক্লাস সেভেনের অনুভব বলেছিলো, তুই চিন্তা করিস না। আমি বড় হয়ে তোকেই বিয়ে করবো। আমি কখনো তোকে কষ্ট দেবো না ঈশা। আমি আমার বাবার মত হবো না। কাউকে তোর কাছে ঘেঁষতেই দেবো না। তুই আর আমি থাকবো একটা বড় বাড়িতে।
দুজনেই মনখারাপ ভুলে কালার পেন্সিল আর নতুন ধরনের ইরেজার নিয়ে মেতে উঠেছিলো। আবার টিফিন ভাগ করে খাওয়ার সময় ঈশা বলেছিলো, আগে কথা দে, তুই আমার ছেড়ে কোথাও যাবি না অনুভব? তারপর আমি তোর টিফিন খাবো। অনুভব ঈশার টিফিন বক্স থেকে সন্দেশটা তুলে নিয়ে বলেছিলো, বললাম তো তোকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।
পরের দিন মেয়েটা দৌড়ে ঢুকেছিলো স্কুলে। কিন্তু গেটের কাছে ওই ছেলেটা অপেক্ষারত ছিলো না। একসঙ্গে ক্লাসেও ঢোকেনি ওরা।
শুধু প্রিন্সিপ্যাল প্রেয়ার লাইনে এসে বলেছিলো, ক্লাস সেভেনের সেকশন এ-র অনুভব মিত্র কাল রাতে মারা গেছে, তাই তোমরা দুমিনিট তার জন্য নীরবতা পালন করে তারপর বাড়ি চলে যাও। আজ ক্লাস হবে না, আজ ছুটি।
ছোট্ট মেয়েটা স্থবির হয়ে গিয়েছিলো। অনুভব মারা গেছে? কি করে? অনুভব আর স্কুলে আসবে না? ও যে বলেছিলো, ঈশাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না! অনুভবের পাড়ার একটা ছেলে বলছিলো, কাল রাতে তো অনুভব আর ওর মা দুজনেই একসঙ্গে মরে গেছে, ঘুমের ওষুধ খেয়ে। আগে অনুভবকে ওর মা মেরে ফেলেছে, তারপর নিজেও মরেছে। কথাগুলো ঈশার কানে এসে পৌঁছাচ্ছিলো, কিন্তু বিমূঢ় হয়ে বসেছিলো ও। কোনো কথাতেই যেন কর্ণপাত করছিলো না। সবাই বাড়ি চলে এসেছিলো। ঈশা একাই বসেছিলো ওদের রোজ টিফিন শেয়ার করে খাওয়ার গাছতলাটাতে। শেষে গেটকিপার এসে বলেছিলো, তুই এখানে কি করছিস? তোর মা বাইরে দাঁড়িয়ে তোকে খুঁজছে, চল শিগগির।
ঈশা ভারী পা দুটোকে টেনে নিয়ে এসেছিলো স্কুল গেটের সামনে। মা বুঝেছিলো সবটা। রোজ টিফিন গোছানোর সময় মেয়ে যে একটা মিষ্টি, চারটে লুচি এক্সট্রা চায় সেটা মা জানতো, জানতো অনুভবের জন্যই ওগুলো নিয়ে আসে ঈশা। তাই আর কেউ না বুঝুক মা বুঝেছিলো, ঈশার পক্ষে এই স্কুলে পড়া আর সম্ভব নয়। স্মৃতি কিছুতেই ওর পিছু ছাড়বে না। ঘুমের মধ্যেই চমকে উঠতো ও। দিদিভাইকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদত। একটা বছর পড়াশোনা করতে পারেনি ঈশা। মা-ই দায়িত্ব নিয়ে অন্য একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলো ওকে। স্কুলে যেত, টিফিন খেত, পড়াশোনাও করতো ঈশা, শুধু সেই প্রাণচঞ্চল ঈশাটা যেন একটু একটু করে শুকিয়ে যেতে লাগলো। এমনকি কাজে ব্যস্ত সুফল অর্থাৎ ঈশার বাবারও চোখ এড়ায়নি মেয়ের এই পরিবর্তন। শ্রেয়া ঈশাকে একটা নামি আঁকার কোচিংয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলো। আঁকায় ঈশার ছোটবেলা থেকেই ন্যাক ছিলো। পাড়ার একটা স্কুলে আঁকা শিখত। নতুন স্কুলে শিখতে শুরু করেই ঈশার আগ্রহ ছিলো কবে ও ফুল-ফল বাদ দিয়ে মানুষের মুখ আঁকতে পারবে নিখুঁত করে। অনুভবের মুখটা মনে থাকতে থাকতে এঁকে ফেলতে চেয়েছিলো ও। যদি একেবারেই হারিয়ে ফেলে অনুভবকে, তখন কি হবে!
খাতার পর খাতা ও শুধু অনুভবকে এঁকেছিলো নিখুঁত করার জন্য। প্রায় বছরখানেকের অক্লান্ত চেষ্টায় ও আঁকতে পেরেছিলো অনুভবকে। একদম পারফেক্ট এঁকেছিলো। তারপর থেকে আর আঁকতে চেষ্টা করতো না অনুভবের ছবি। বরং একটা ডায়রিতে লিখে রাখতো নিজের মনের কথা, যেন অনুভবকেই বলতো ওর সবকিছু সিক্রেট। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল ঈশা। তবে এরপর কোনোদিন বেস্টফ্রেন্ড বলে ও ডাকেনি কাউকে। রণদীপ, বিজিত, সুজাতা, ঈশিতা এরা খুব কাছের বন্ধু ঠিকই কিন্তু বেস্টফ্রেন্ড নয়। অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে ওই বিশেষ শব্দটাকেও বিদায় দিয়েছে ঈশা নিজের জীবন থেকে। এখন শুধু ফ্রেন্ড শব্দটাকে রেখেছে, যাতে হারিয়ে যাওয়ার পর কষ্ট না হয়। আর্ট কলেজে পড়ার সময়েও বেশ কিছু ছেলের কাছ থেকে পেয়েছে প্রোপোজাল, কখনো সাড়া দেবার তাগিদ অনুভব করেনি। করেনি কারণ অনুভব ছিল ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই কাউকে ভালোবেসে ওঠাও হয়নি। ঈশা ধীরে ধীরে অনুভবকে ভুলতে চেষ্টা করেছে, যত ভুলতে চেষ্টা করেছে ততই অনুভব ওর গোটা স্মৃতি জুড়ে বসেছে। ওর ওই সহজ সরল হাসিটা দিনের পর দিন নির্ঘুম রেখেছে ঈশাকে। তারপর একদিন ঈশা উপলব্ধি করেছে অনুভবকে ভোলার চেষ্টা না করে ওর বন্ধুত্বকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে ওকে। থাকুক অনুভব ওর স্মৃতি জুড়ে, ভুলতে চেষ্টা করলে ও যেন আরও প্রকট হচ্ছিল ঈশার দৃষ্টিপটে। আস্তে আস্তে অনুভবের স্মৃতিতে ধুলোর আস্তরণ পড়েছে, ঈশার জীবন এগিয়েছে অন্য খাতে। এখন ঈশা হাসে, সকলের সঙ্গে মজা করে কিন্তু ভালোবাসা, বেস্টফ্রেন্ড শব্দগুলো থেকে নিজেকে ব্রাত্য করে রেখেছে স্বেচ্ছায়।
এসি ঘরেও নাকের ডগায় বিন্দু বিন্ধু ঘাম জমেছে ঈশার। সবুজ মাঠ দিয়ে ছুটছে ও। দূরে দাঁড়িয়ে আছে সাদা শার্ট আর ফুল প্যান্ট পরা ছেলেটা। প্রাণপণে ছুটছে ঈশা। ধরতেই হবে ছেলেটাকে, ছুটতে ছুটতে হাঁপাচ্ছে ও। ছেলেটার সামনে পৌঁছাতেই দেখলো ছেলেটা মুহূর্তে মিলিয়ে গেলো। ধড়ফড় করে উঠে পড়লো ঈশা। ঘামে ভিজে গেছে ওর টপটা, ঘাড়ের কাছেও অস্বস্তিকর ঘাম জমেছে। আজ বহুদিন পরে অনুভবকে দেখলো ও স্বপ্নে। ইদানীং অনুভব আর আসতো না ওর মধ্যরাতের স্বপ্নে, তছনছ করে দিতো না ওর একটুকরো দিবানিদ্রার বিলাসিতাকে। এখন ও শান্তিতে ঘুমাতে পারতো। আজ হঠাৎ কি এমন ঘটলো যে অনুভবকে দেখলো! মনে করার চেষ্টা করলো স্বপ্নের শেষ মুহূর্তটা। চমকে উঠলো একটু। অনুভবের মুখটা বদলে হয়ে যাচ্ছিল প্রান্তিকের মুখ। কাবার্ড খুলে সেই পুরনো ড্রয়িংয়ের ডায়রিটা বের করলো। দেখছিলো যেখানে পাতার পর পাতায় আঁকা আছে অনুভব। এই জন্যই প্রান্তিককে প্রথম দিন দেখেই কেমন যেন চেনা চেনা মনে হয়েছিলো ঈশার। অনুভবের মুখের সঙ্গে বেশ মিল আছে প্রান্তিকের। বিশেষ করে টিকাল নাক, আর ওই সরল হাসিটা দেখলে মনে হবে দুজনে যেন একই মানুষ। শুধু অনুভবের থুতনির নিচের কাটা দাগটা নেই প্রান্তিকের। কিন্তু প্রান্তিককে অনুভবের দাদা বলে চালানোই যায়। মুখের বেশ মিল আছে দুজনের।
বহুবছর পরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো ঈশা। ওই জন্যই কি এত বছর পরে প্রান্তিককে ওর ভালো লাগছে, ইচ্ছে করছে প্রান্তিকের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে? কারণটা কি শুধুই অনুভবের সঙ্গে মুখের মিল আছে বলে! কিন্তু তাহলে তো প্রান্তিকও হারিয়ে যাবে ওর জীবন থেকে, ঠিক যেভাবে অনুভব গিয়েছিলো। কথা দিয়েও কথা রাখেনি ও। ঠিক সেভাবেই কি প্রান্তিকও ….ডুকরে কেঁদে ফেললো ঈশা। ঠিক তখনই দেখলো প্রান্তিক মেসেজ করেছে, পাওয়ার ন্যাপ কি কমপ্লিট? একটা একান্ত অনুরোধ ছিলো আপনার কাছে, যদি রাখা সম্ভব হয় তবেই রাখবেন, না রাখতে পারলে রাগ করবো না কথা দিলাম। গেস্টহাউসে যাওয়ার আগে কি একবার আমার ফ্ল্যাটে আসা সম্ভব হবে? তাহলে একসঙ্গেই যেতাম আরকি।
ক্লান্ত, বিষণ্ণ মনটা যেন প্রাণ ফিরে পেলো। মুচকি হেসে ঈশা টাইপ করলো, আপনাকে বডিগার্ড করবো ভাবছি আজকে রাতে। জিম টিম করেন, তেমন কোনো বেয়াদপি দেখলে দেবেন তার নাক উড়িয়ে!
দুটো স্মাইলি পাঠিয়ে প্রান্তিক লিখলো, ব্রাহ্মণ মানুষ, চালকলা মেখে খাই তাকেও বক্সিং করিয়ে ছাড়বেন? অবশ্য যুদ্ধ যখন লাগে তখন শুনেছি ব্রাহ্মণরাও পুজোর ফুল ফেলে তলোয়ার ধরে।
যদি সাহস দেন একটা কথা বলি, আজ কি রঙের পোশাক পরবেন?
ঈশা লিখলো, গেস….
প্রান্তিক লিখলো, রেড ব্ল্যাকের কম্বিনেশন বোধহয়।
ঈশা বললো, জ্যোতিষ চর্চা করুন মশাই। সাইড ইনকাম জমে যাবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আসছি।
ঈশার ঠোঁটের কোণে জমা হলো অনেকটা লজ্জা আর একমুঠো খুশি। অনুভব হারিয়ে গিয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু প্রান্তিক হারাবে না, কিছুতেই না।
ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে বড় ওয়ার্ডরোবটা খুললো ঈশা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে বেছে বেছে বের করলো লাইট স্কাইব্লু পাঞ্জাবিটা। যেটার এক কোনে আঁকা আছে জোড়া বাঁশি, তার ওপরে মিনাকারী কাজ করেছে ঈশা। এটা ফিটিং করার কথা। পাঁচ দশ হাইটের জন্য পারফেক্ট এটা। যদি একান্ত ফিট না করে তবে তো প্রান্তিকের টিশার্ট না কি যেন আছেই। নিজের মনেই গুনগুন করতে করতে ঘর থেকে বেরোলো ঈশা।
দিদিভাই রেডি হয়ে বেরোচ্ছিলো কোথাও। ঈশা বললো, কি রে বিয়েবাড়ি যাবি না?
বিদিশা বিরক্তির স্বরে বললো, তোর মত সুখী আর কে আছে বল। সংসারের একটা দায়িত্বও তো নিতে হয় না, উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিস, বেড়া। আমাকে অন্তত তোর এই আদিখ্যেতার মধ্যে ঢোকাস না।
হন্তদন্ত হয়ে ঘড়ির বেল্টটা আটকাতে আটকাতে বেরিয়ে গেলো বিদিশা। দিদিভাইয়ের চলে যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলো ঈশা। পাল্টে গেল সবকিছু, বড্ড দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে এই বাড়ির আবহাওয়াটা। বিক্ষিপ্ত মনটা নিয়েই মায়ের ঘরের দিকে এগোলো ঈশা। মা শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছে দেখে ঈশা বললো, মা আমাদের বাড়িটা এমন কেন হয়ে যাচ্ছে? দিদিভাই কেন এত রুড বিহেভ করে আমার সঙ্গে? আমি তো আমার বিজনেস শুরুর সময় কারোর কাছ থেকে টাকা ধার চাইনি। ঠাম্মা যে টাকা রেখেছিলো আমার নামে, সেটা দিয়েই শুরু করেছি। তাছাড়া এই তো মাত্র দু-বছর স্টার্ট করেছি, একটু দাঁড়িয়ে গেলেই আমিও ফ্যামিলিতে টাকা কনট্রিবিউট করবো দেখো।
শ্রেয়া বইয়ের পাতা বন্ধ করে বললো, জানিস ঈশা, মনের মধ্যে কোনো বোঝা চেপে রেখে বাইরে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলে কোথাও না কোথাও একটা বিস্ফোরণ ঘটবেই। বিদিশারও হয়েছে তাই। গত একবছর ধরে ওর মনের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে চলছে মারাত্মক টানাপোড়েন, সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে এভাবে। ওকে তো চিনিস, জিজ্ঞেস করতে গেলে অপমানিত হওয়ার তীব্র আশঙ্কা আছে, তাই কোনোদিন ও নিজে বলবে সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম। তার আগে পর্যন্ত ওর এই দুর্ব্যবহারে কষ্ট না পেয়ে ইগনোর করার চেষ্টা করছি, তাতে সফল হয়েছি। ও ইদানীং আমায় আর কিছু বলে না। কারণ এই যে এখন বেরিয়ে গেল সেজেগুজে, আমি একবারও জানতে চাইনি কোথায় যাচ্ছিস, সুপর্ণার বিয়েতে যাবি কিনা, এই সব….জিজ্ঞাসা করিনি বলেই আমার ঘরের সামনে এসে বলে গেল, মা আসছি, ফিরতে রাত হবে।
তুইও আমার পদ্ধতি নে ঈশা। তোর বাবাকে বা বিদিশাকে জিজ্ঞেস করিস না, কোথায় যাচ্ছ? কখন ফিরবে?
বরং ওদের বেরোনো বা ঢোকার টাইমে পারলে সামনে থেকে সরে যাস, বা অন্য কাজে মন দিস। দেখিস কাজে লাগবে, অন্তত নিজের মনটুকু শান্তিতে থাকবে। অকারণ তাকে কেন যন্ত্রণা দিবি বল? শ্রেয়ার গলাটা একটু ধরে এলো দেখে মাকে জড়িয়ে ধরে ঈশা বললো, ইউ আর দ্য বেস্ট মম ইন দ্য হোল ওয়ার্ল্ড। সবকিছুর সমাধান আছে আমার মায়ের ঝুলিতে। এমনকি মনখারাপ ভালো হওয়ার মেডিসিনও। শ্রেয়া মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললো, যা রেডি হয়ে নে। আমি দত্তগিন্নিদের সঙ্গে যাব। তুই রিনিদের সঙ্গে যাবি তো?
.
ঈশা মুচকি হেসে বললো, তোমায় সাজিয়ে দিয়ে তারপর আমি বেরোবো। শ্রেয়া হেসে বললো, বিয়েটা তো সুপর্ণার রে, তোর বুড়ি মা সেজে কি করবে!
বিরক্তির গলায় ঈশা বললো, উফ মা, বুড়ি বুড়ি করবে না তো, তুমি অলটাইম এভারগ্রিন। আমি রেডি হচ্ছি, তুমিও রেডি হয়ে নাও, আমি টাচ আপ করে দেবো তোমায়।
ওয়াশরুমের বড় আয়নায় নিজেকে একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিলো ঈশা। আজ কি ওকে একটু বেশিই খুশি খুশি লাগছে? কিন্তু কেন? অন্যসময় তো দিদিভাই এভাবে কথা বললে ওর মুড অফ হয়ে যেত, আজ ইগনোর করতে পারলো কেন? কেউ ওর জন্য অপেক্ষা করছে এই অনুভূতিটাই কি ওকে প্রাণশক্তি যোগান দিচ্ছে? শাওয়ার ক্যাপটা মাথায় পরে নিয়ে শাওয়ারের ঠান্ডা জলের স্রোতের নিচে দাঁড়ালো ঈশা।
ঠান্ডা জলের স্রোত ধীরে ধীরে নামছে ওর চিবুক বেয়ে বুকে, নাভিতে। শিউরে উঠলো ওর বাইশের যৌবন। জলের রেখাগুলো যেন আলতো করে আদর করছে ওকে। নরম আদর, কোনো বন্য হিংস্রতা নেই, নেই আগ্রাসী চাহিদা, শুধু আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওর গোটা শরীরে। আবেশ জড়ানো গলায় যেন জিজ্ঞেস করছে, কেমন আছো ঈশা? শ্রান্ত মনের শান্তির প্রয়োজন, ধুয়ে দাও গ্লানি, শুরু করো নতুন করে।
ঈশা তাকিয়ে দেখল, শাওয়ার থেকে ক্রমাগত নতুন জলের ধারা নেমে এসে ধুয়ে মুছে দিতে চাইছে ওর বুকের এককোণে জমে থাকা ঘন অন্ধকারের মত দুর্বিষহ কষ্টটাকে। সুখের স্পর্শে চোখ বন্ধ করে নিলো ঈশা।