হারিয়ে যাওয়ার আগে – ৬
৬
ডোর বেলটা বাজছে, রেডি হয়ে সোফায় বসে ছিল প্রান্তিক। এত দিন ও জানতো না অপেক্ষারা এত মিষ্টি হয়। বরং অফিসে বা বন্ধুমহলে কারোর জন্য ওয়েট করতে হলে ও অধৈর্য্য হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে পর্যন্ত গেছে। আজ যেন ঘড়ির কাঁটা দুটো ইচ্ছে করেই ওর ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। কাঁটা দুটোর যেন কিছুতেই চলার ইচ্ছে নেই। খুনসুটি করতে করতে একটু একটু করে এগিয়ে চলছে ওরা। সময় যেন আর কাটে না। প্রায় একঘণ্টা আগে রেডি হয়েছে ও। একটা মুভির অর্ধেক দেখা হয়ে গেল বসে বসে, তবুও বিরক্তি আসছে না মনে। ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকানোতেও যেন শিহরণ আছে। কেউ একজন স্পেশাল আসছে ওর ফ্ল্যাটে, এই অনুভূতিটাই ওর সব বিরক্তি কাটিয়ে ওকে ভালোলাগার আবেশে জড়িয়ে নিচ্ছিল। প্রান্তিক বুঝতে পারছিলো ঈশার জন্য ও অপেক্ষা করতে পারে এক যুগ। ডোর বেলটা বাজতেই ছুটে গিয়ে দরজা খুলল প্রান্তিক। রেড আর ব্ল্যাকের কম্বিনেশনে অদ্ভুত সুন্দর একটা লেহেঙ্গা আর তার সঙ্গে ম্যাচিং একটা রেডিস বটুয়া ব্যাগ হাতে নিয়ে ঢুকলো ঈশা। সোফার ওপরে আরেকটা বড়সড় শপিং ব্যাগ রেখে বললো, ধুর, ভাল্লাগে না।
প্রান্তিক দেখলো, ঈশার সুন্দর মুখটা জুড়ে একটা উষ্ণ বিরক্তি খেলা করছে।
কপালের স্টোনের টিপটা টিউবের আলোয় ঝকমক করে উঠলো। প্রান্তিককে প্রায় নির্দেশের সুরে বললো, প্যাকেটটা খুলে দেখুন, যদি পছন্দ হয়, তো পরুন।
প্রান্তিক একটু আলগা হেসে বললো, তা মহারানীর মুড ডাউন কেন? আসলে এমন মিষ্টি পরীর মত লাগছে, অথচ ঠোঁটে হাসি মিসিং তাই বললাম।
ঈশা ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো, ইররেস্পন্সবল পাবলিক আমি একেবারে পছন্দ করি না। আপনি জানেন, কি হয়েছে? যাক জেনেই বা কি আর করবেন এখন! ঠোঁটের হাসি মিসিং দেখছেন আর আমার সাজের মধ্যেও একটা জিনিস মিসিং আছে সেটা বুঝতে পারছেন কি?
প্রান্তিক ঈশার পারমিশন নিয়েই ওকে অপলক দেখতে শুরু করলো। ঈশা বিরক্ত হয়ে বললো, জানি বলতে পারবেন না। অমন হাঁ করে তাকিয়ে থেকেও খুঁজে পাবেন না।
প্রান্তিক উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ওয়েট, এক মিনিট, আমি আসছি। ফ্রিজের মধ্যে থেকে রাংতায় জড়ানো গোটা পাঁচেক রেড জারবেরা ফুল এনে ঈশার সামনে ধরে বললো, এটা মিসিং।
ঈশা প্রায় লাফিয়ে উঠে বললো, মাই গড! আপনি কি করে বুঝলেন? জানেন আমি অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম জারবেরা, লাস্ট মোমেন্টে ওরা ক্যানসেল করলো। আপনি কোথায় পেলেন?
প্রান্তিক মুচকি হেসে বললো, বিয়ে বাড়ি থেকে চুরি করে আনলাম। ম্যানেজমেন্টকে পটিয়ে নিয়ে এসেছি। বেসিক্যালি অনেকগুলো কালার ছিলো, আমি কনফিউশনে ছিলাম, তাই জানতে চেয়েছিলাম আপনি কি রঙের ড্রেস পরবেন, মোটামুটি আন্দাজ করেছিলাম, রেড অথবা পিঙ্ক পরবেন কিছু। সুপর্ণার সামনে সেদিন বলেছিলেন মনে হলো। রেড পেয়ে এগুলো তুলে এনেছি। যদি লটারিটা লেগে যায়, এই আরকি।
ঈশা প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বললো, ফ্রেন্ড?
প্রান্তিক ঘাড় নেড়ে বললো, অফকোর্স ফ্রেন্ড হতে রাজি। কিন্তু একটা ছোট্ট শর্ত আছে, প্লিজ কল মি তুমি।
ঈশা হাঁপ ছেড়ে বললো, বাঁচালে, বারবার মনে হচ্ছিল কিন্ডারগার্ডেনের টিচারের সঙ্গে কথা বলছি, আপনি, আজ্ঞে… এবার থেকে অনলি তুমি।
আচ্ছা প্রান্তিক তোমার ড্রেসিংটেবিল আছে? আমি ফুলগুলো লাগাবো চুলে, আরেকটা কাঁচি চাই।
প্রান্তিক হেসে বললো, আয়না নেই, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো নিজেকে দেখতে পাবে। ঈশা হেসে নিজের ব্যাগ থেকে ক্লিপ আর কি সব বের করে চলে গেল বেডরুমে।
প্রান্তিক পাশের রুমে ঢুকে ঈশার আনা পাঞ্জাবিটা ট্রাই করলো। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো নিজেকে। প্রিন্স কোর্টের ডিজাইনে পাঞ্জাবিটাতে ওকে একটু অন্যরকম লাগছে। দুর্দান্ত ফিটিংস হয়েছে, এতটা ও আশা করেনি। মেয়েটার ড্রেস কনসেপ্ট নিয়ে কোনো কথা হবে না। এবার থেকে শপিংয়ে গেলে ঈশাকে বগলদাবা করে নিয়ে যেতে হবে। ঈশার পছন্দ প্রান্তিক নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারবে, সেটা পাঞ্জাবি আর ধুতি সেপের প্যান্টটা পরেই টের পেল।
ঈশা এ ঘরে ঢুকেই বললো, প্লিজ হেল্প মি। ঠিক বাঁদিক চেপে চুলের মধ্যে ডান্ডিটা ঢুকিয়ে আটকে দাও ফুল দুটো। প্রান্তিকের নাকে এসে ঝাপটা দিলো ঈশার গায়ের লেডিস পারফিউমের গন্ধটা। ঈশা এখন প্রান্তিকের বুকের একেবারে কাছে। ব্লাউজের উন্মুক্ত পিঠে একটা সরু ফিতে বাঁধা, চুলটা কার্ল করে তোলা হয়েছে ঘাড়ের ওপরে। ঘাড়ের কাছে কিছু নরম চুল অবাধ্যের মত লুটোপুটি খাচ্ছে। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড দ্রুতগামী হয়েছে প্রান্তিকের, হাতটা কাঁপছে, ঈশা ওর এতটা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে ভুলভাল ইচ্ছেরা মাথা তুলতে চাইছে। প্রান্তিকের খুব ইচ্ছে করছে ঈশাকে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কানে কানে ফিসফিস করে বলতে, ভালোবাসি, বিশ্বাস করো, ভালোবাসি তোমায়।
প্রান্তিক কোনোমতে নিজেকে সম্বরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে বললো, আমি কি পারবো? যদি চুলটা নষ্ট করে ফেলি? ঈশা ঠোঁটটা বেঁকিয়ে চিবুকের তিলটাকে যেন একটু বকে দিয়ে বললো, নিশ্চয়ই পারবে। যে বিয়ে বাড়ি থেকে আমার জন্য জারবেরা চুরি করে আনতে পারে, সে চুলে আটকেও দিতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস। বাই দ্য ওয়ে, ভবিষ্যতে আর পাঞ্জাবি পরার দরকার নেই। প্রান্তিক একটু অবাক হয়েই বললো, কেন ভালো লাগছে না? চেঞ্জ করে নেব?
ঈশা আড়চোখে তাকিয়ে বললো, একটু বেশিই ভালো লাগছে, তাই বারণ করলাম। এসব ড্রেস পরার দরকার নেই, তোমার ঐ টিশার্টই বেস্ট।
অদ্ভুত একটা ভালোলাগার আবেশ এসে জড়িয়ে ধরলো প্রান্তিককে। কখনো ভাবেনি কেউ ওকে এভাবেও বলতে পারে। ওর প্রতিও যে কেউ পজেসিভ হতে পারে এটা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না প্রান্তিক। নিজের কান আর চোখের ওপরে এই মুহূর্তে ভরসা হারাচ্ছে যেন। যা দেখছে ঠিক দেখছে তো? যা শুনছে ঠিক শুনছে তো।
ঈশার চুলের মধ্যে ওর আঙুলগুলো খেলা করছে।
ক্লিপ, রেড জারবেরা আর ঈশার হালকা ব্রাউনিস হেয়ারে আপাতত মগ্ন হয়ে আছে প্রান্তিক। অনেক কসরতের পরে অবশেষে ও সাকসেসফুল হলো জীবনের প্রথম করা অনভিজ্ঞ কাজে। ঈশার চুল না ঘেঁটে ফুল দুটো আটকে দিতে সমর্থ হয়েছে প্রান্তিক।
ঈশা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দুবার আয়নায় দেখে নিয়ে বললো, পারফেক্ট। চলো ট্যাক্সি ধরতে হবে তো।
প্রান্তিক বললো, উবের ডাকি একটা। এমন একজন রূপকথার রাজকন্যার জন্য ময়ূরপঙ্খী ঘোড়ার দরকার ছিল, নিদেন পক্ষে একটা মার্সিডিজ। কিন্তু এই অর্বাচীনের তো শুধু একটা বাইক সম্বল। তাতে করে নিয়ে যেতে পারি না জলপরীকে। অগত্যা উবেরই ভরসা। খুব তাড়াতাড়ি একটা চারচাকা কিনতে হবে আমায়, নাহলে সম্মানহানির সমূহ আশঙ্কা।
ঈশা একটু ভেবে নিয়ে বললো, বাইক মন্দ কি? চলো আজ তোমার বাইকে চেপেই বিয়ে বাড়ি যাবো। প্রান্তিক ইতস্তত করে বললো, এমন একটা দামি ড্রেস পরে, এমন সেজে বাইকে করে গেলে সাজগোজ ঘেঁটে যেতে পারে, আজ উবেরেই চলো।
ঈশা জেদি মেয়ের মত বললো, যাক এলোমেলো হয়ে সাজগোজ, আজ ভারী মনটা উড়ুক হাওয়ায় হালকা পালকের মত, হোক না বেহিসেবি, হিসেব কষা সাবধানী হৃদয়টা। খুব কি ক্ষতি হবে প্রান্তিক?
প্রান্তিক ঈশার চেরি রেড লিপস্টিকের দিকে তাকিয়ে বললো, আদেশ অগ্রাহ্য করবো এমন সাহস কোথায়? চলো, উড়িয়ে নিয়ে যাই আজ তোমায়, ভেবে নিও আমার পালসার আজ ময়ূরপঙ্খী ঘোড়া। ঈশা বটুয়াটা হাতে নিয়ে বললো, আমি কমপ্লেক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুমি এসো তাড়াতাড়ি।
প্রান্তিক ফ্ল্যাটে চাবি দিয়ে লিফটের দিকে পা বাড়ালো। বর্ষার মাতলার মত ভেসে চলছে ও। কূল কোথায় খুঁজে দেখার বিন্দু বিসর্গ ইচ্ছেও ওর এই মুহূর্তে নেই। বারবার মনে হচ্ছে, পাল ছাড়া, হাল ভাঙা নৌকার মতই ভেসে যাক প্রান্তিক ঈশার হাত ধরে। দেখাই যাক না ওকে কোথায় নিয়ে যায় ওই রূপকথার রাজকন্যা। পাতালপুরীর অন্দরমহলে, নাকি সোনার কাঠি রূপোর কাঠির দেশে! যেখানেই নিয়ে যাক, প্রান্তিক ঈশার চোখেই নিজের সর্বনাশ দেখতে চায়। ও আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো, তারায় ভরা ঝকঝকে আকাশ। কোথাও কোনো কালিমা নেই, ঠিক যেন ঈশার হাসি ঝলমলে মুখ। প্রান্তিক এখনও ভাবতেই পারছে না ওরই বাইকে বসে, ওকে স্পর্শ করে ঈশা যাবে সুপর্ণার বিয়েতে। পাঞ্জাবির বাঁ দিকে বুকে একবার হাত বুলিয়ে নিলো প্রান্তিক, এই বাঁশিদুটো ঈশার নিজের হাতে আঁকা, ভেবেই হৃৎপিন্ডটা যেন লাফিয়ে উঠলো একটু। কখনো কারোর প্রেমে পড়েনি প্রান্তিক। তাই এই অচেনা অনুভূতি ওর কাছে ভীষণ রকমের অজানা। তবে সিক্সথ সেন্স বলছে, এর নামই প্রেম। শুধু ভালোলাগা নয়, সাময়িক উত্তেজনাও নয়, প্রান্তিক বেশ বুঝতে পারছে ও ঈশাকে ভালোবেসে ফেলেছে। ঈশা হয়তো ওকে ভালো বন্ধুর আসনে বসিয়েছে কিন্তু প্রান্তিক ঈশাকে শুধু বন্ধু ভাবতে নারাজ। ঈশা যদি শুধু বন্ধুই হতো তাহলে ওকে দেখলেই প্রান্তিকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের উপস্থিতি অথবা হৃৎপিণ্ডের রক্তরা দ্রুতগামী হয়ে ইঙ্গিত দিতো না যে, সামওয়ান স্পেশাল….
প্রকৃত প্রেম, ভালোবাসা ঠিক কি জানা নেই প্রান্তিকের, তবে ও এটুকু বুঝেছে ঈশা সামনে থাকলে একরাশ রজনীগন্ধা আড়াল থেকে গন্ধ ছড়ায়। ঈশা আড়াল হলেই মনখারাপি বাতাস এসে ঢেকে দেয় প্রান্তিকের অবুঝ মনটাকে। তাই প্রান্তিক ঈশাকে শুধু বন্ধু মানতে নারাজ।
বাইকের পিছনে বসেই প্রান্তিকের কাঁধটা ধরে ঈশা বললো, কিছু মনে করো না। আমি বাইকে চাপতে খুব একটা অভ্যস্ত নই, তাই ধরে বসলাম। আর লেহেঙ্গার সিল্কটাও বেশ স্লিপারি, অগত্যা…
প্রান্তিকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো, তোমার এই আলগা স্পর্শটুকুর জন্য পাড়ি দিতে পারি হিমালয়ের শেষ প্রান্তে।
সামলে নিয়ে বললো, তা একটু মনে করছি বৈকি। এমন সুন্দরী একজন মেয়ে আমার বাইকে, আমার কাঁধে হাত রেখে চলছে, ফিলিং প্রাইম মিনিস্টার।
ঈশা প্রান্তিকের পিঠে নরম করে কিল মেরে বললো, শুধু লেগপুলিং, তাই না?
ঈশা বললো, বললে না তো আমার সাজগোজ কেমন হয়েছে, আমাকে কেমন লাগছে?
প্রান্তিক বাইকে একটু স্পিড তুলে বললো, বিয়ে বাড়িতে যদি কাউকে ইম্প্রেস করার থাকে সে অলরেডি ধরাশায়ী হয়ে যাবে, এটুকু নিশ্চিত।
ঈশা জোরে জোরে হেসে বললো, ইম্প্রেসড হবে বলছো? কে জানে, আমার তো মনে হয় তার তেমন একটা অনুভূতি নেই আমায় নিয়ে। কেমন যেন উদাসীন টাইপ।
প্রান্তিক ফাঁকা রাস্তায় হর্ন দিয়ে বললো, এমন পাষাণ হৃদয়ের তো বাঁচার অধিকারই নেই এই পৃথিবীতে। তার নরকে স্থান হবে দেখো।
ঈশা হেসে বললো, ইস, নরকে কেন স্থান হবে, সে ভালো থাকুক। প্রান্তিক অচমকা বললো, তবে যে বললে তুমি এনগেজড নও? ঈশা বললো, নই তো। ক্রাশ আর স্টেডি লাভ দুটোর মধ্যে পার্থক্য বোঝো তো, নাকি সেটাও বোঝো না? প্রান্তিক নিজেকে সংযত রাখার জন্যই বললো, বুঝলাম। তো ক্রাশটা কে শুনি?
ঈশা ওর কাঁধে আরেকটু চাপ দিয়ে বললো, যাকে দেখে প্রেম নামক অদ্ভুত অনুভূতি জাগ্রত হয় মনে, তাকে ক্রাশ বলে। আর ক্রাশ যখন ভালোবাসতে শুরু করে তখন বলে স্টেডি লাভ।
প্রান্তিক বিরক্ত হয়ে বললো, আমি কি দর্শনের ছাত্র নাকি? যে তুমি ক্রাশ আর স্টেডিলাভের পার্থক্য বোঝাতে শুরু করেছ?
ঈশা হেসে বললো, তাহলে জানতে কি চাও? আমার ক্রাশ কে? সেটা এখুনি বলা যাবে না।
প্রান্তিক আর কোনো কথা না বলে গাড়ির স্পিড বাড়ালো। ঈশা ওকে চেপে ধরে বললো, আমার মাথায় হেলমেট নেই, বেশি স্পিড দেখলে পুলিশ ধরবে, তখন বিয়ে বাড়ির বদলে থানায় যেতে হবে। তাই আমার ক্রাশকে দেখার লোভে এত তাড়াতাড়ি গাড়ি চালানোর দরকার নেই, ধীরে ধীরে চলো। পালিয়ে তো আর কেউ যাচ্ছে না।
প্রান্তিকের মনে হলো, গোটা সন্ধের সব উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে গেছে। ঈশার হাতটা এখনও ওর কাঁধের ওপরে। ওই ছুঁয়ে থাকায় আর সেই শিহরন নেই যেন। ঈশা অন্য কাউকে ভালোবাসে এই উপলব্ধিটুকুই সজোরে আঘাত করলো স্বপ্নদেখা চোখ দুটোকে। গাড়ির স্পিড কমিয়ে বিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড় করালো প্রান্তিক। তাকিয়ে দেখলো, সাইডেই পার্কিং রয়েছে। প্রান্তিক হেলমেটটা খুলে বলল, তুমি ভিতরে যাও, আমি বাইকটা রেখে আসছি।
ঈশা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললো। লেহেঙ্গার ওড়না ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
প্রান্তিক বাইকটাকে রেখে, তার সঙ্গে হেলমেটটা বেঁধে দিয়ে বেরিয়ে এসেও দেখলো, ঈশা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
প্রান্তিক পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, দাঁড়াও ফুলটা একটু হেলে গেছে, ঠিক করে দিই, সম্ভবত বাইকের হাওয়া লেগে। ঈশার মাথার ফুলদুটো নির্লিপ্তভাবে ঠিক করে, প্রান্তিক বললো, চলো ভিতরে চলো, নাকি কারোর জন্য ওয়েট করছিলে? ঈশা বললো, তোমার জন্য। চুলটা হেলমেট পড়ে ঘেঁটে ফেলেছো তো, শেষে আমার ডিজাইন করা পাঞ্জাবির নাম ডোবাবে দেখছি। একবার ব্রাশ করে নাও। একটা ছোট্ট চিরুনি ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে ঈশা হাসলো ফিক করে। চিরুনিটাতে এখনো ঈশার চুলের গন্ধ লেগে। একটু বোধহয় আনমনা হয়ে গিয়েছিলো প্রান্তিক। ঈশা বললো, সন্ধেতে তো বেশ চার্মিং লাগছিলো তোমায়, এখন কি কলিগের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে মূর্ছা যাচ্ছ নাকি? মুখে স্মাইল কই? নাকি জলপরীর সঙ্গ আর ভালো লাগছে না? প্রান্তিক কিছু বলার জন্য ছটফট করে উঠলো। বলতে ইচ্ছে করছিল, তোমার তাতে কি? তুমি ভিতরে যাও, নিজের সৌন্দর্য দেখাও ক্রাশকে, দেখো সে নিশ্চয়ই কুপোকাত হবে। ক্রাশ তো মানুষই, ভগবান তো নয়। বিশ্বামিত্র মুনির মাথা টলবে তোমায় এখন দেখলে, আর ক্রাশ তো নেহাতই মনুষ্য চরিত্র।
এত কথা মনে আসা সত্ত্বেও রাগটাকে চুপচাপ হজম করে প্রান্তিক বললো, তখন হাসি পাচ্ছিলো, এখন পাচ্ছে না। আমি কোনদিন পাড়ার ক্লাবেও নাটক করিনি, তাই অভিনয়টা ঠিক পারি না। আবার যদি হাসি পায়, তাহলে নিশ্চয়ই হাসবো। ঈশা বললো, কোই বাত নেহি, তোমাকে অ্যাংরি ম্যান লুকেও বেশ হ্যান্ডু লাগছে। চলো, চলো, বিয়েটা বোধহয় হয়েই গেলো। এতো শর্ট কার্ট বিয়ে, তাই রাতভর মন্ত্র পড়বে না বুঝলে? আমি বাবা, সকাল থেকে উপোস করে, অনেক মন্ত্র পড়ে বিয়ে করবো, নাহলে যদি সে ভেগে যায়। ঈশা নিজেই বকবক করছে আর হাসছে। প্রান্তিক নিশ্চুপ, মনের মধ্যে ঝড় চলছে। এখুনি হয়তো কোন ছেলেকে দেখিয়ে ঈশা বলবে, ওই দেখো আমার ক্রাশ। হয়তো ওর হাতটা টেনে তার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলবে, এই দেখো আমার ফ্রেন্ড প্রান্তিক। উফ, আর ভাবতে ভালো লাগছে না প্রান্তিকের। কদিন ধরে ওর যত্নে গাঁথা মালাটা থেকে শুকনো শুকনো একটা গন্ধ আসছে যেন। মনমরা প্রান্তিক ঢুকে গেলো বিয়ে বাড়ির রোশনাইয়ের মধ্যে। দূর থেকেই দেখতে পেলো স্ন্যাকস সেকশনে ওদের অফিসের মোটামুটি অনেকেই এসেছে। ব্যানার্জীদা, দেবাশীষ, দেবব্রত, অঙ্কিতা, স্বাগতা সবাই ওকে দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে ডাকছিলো। নিজের চেনা পরিবেশের মানুষগুলোকে দেখতে পেয়ে ও যেন একটু শান্তি পেলো। ঈশা ‘সন্ধ্যাতারা’ কমপ্লেক্সের বেশ কিছু মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে লিপস্টিক বাঁচিয়ে ফুচকা খাচ্ছিলো। আড়চোখে একবার দেখলো প্রান্তিক, ধারে কাছে কোনো ছেলেকে দেখতে পেলো না। তবে একটু দূরেই দেখলো, বেশ হ্যান্ডসাম একটা ছেলে দূর থেকেই ঈশার ওপরে নজর রাখছে। কে জানে, হয়তো ওই ঈশার ক্রাশ!
দেবাশীষ বললো, কি গুরু একদিন সন্ধ্যাতারায় তোমার ফ্ল্যাটে চায়ের নিমন্ত্রনটা করো? অতো উঁচু থেকে কলকাতাকে কেমন লাগে আমরাও একবার দেখি।
ব্যানার্জীদা চন্দননগরের বাসিন্দা, খুব খোলামেলা মনের মানুষ। হাসতে হাসতেই গরম কফিতে চুমুক দিয়ে বললো, আমি না হয় সকলের জন্য জলভরা নিয়ে যাবো। অঙ্কিতা উত্তেজিত হয়ে বললো, আমি চিকেন প্যাটিস নিয়ে যাবো, আর স্বাগতা নিয়ে আসবে শিঙারা, কি স্বাগতা আনবি তো? স্বাগতা একটু শান্তশিষ্ট স্বভাবের। নিচু গলায় বলল, নিশ্চয়ই। দেবাশীষদা বললো, আরে তোমরা যদি সব ব্যবস্থা করে ফেল তাহলে আমাদের প্রান্তিকবাবু কি খাওয়াবে? ডিনার করাবে নাকি? তবে তাই হোক। চায়ের দায়িত্ব আমাদের, আর ডিনার প্রান্তিকের। এরা এতদিন ধরে জড়িয়ে রয়েছে প্রান্তিকের সঙ্গে তাই ফ্ল্যাট কেনার পরে এদের একদিন খাওয়াবে এমন প্ল্যান অবশ্য প্রান্তিকও করেছিলো। আজ এরা নিজেরাই আব্দার করে বসলো যখন তখন প্রান্তিক বললো, বেশ ডেট ঠিক করে জানাও আমায়। সুপর্ণার জন্য অঙ্কিতার একটু মনখারাপ, দুজনেই পাশাপাশি টেবিলে বসে হা হা হি হি করতো সারাক্ষণ। কারণে অকারণে হাসিই ছিলো ওদের দুজনের পরিচয়। ব্যানার্জীদা, দেবাশীষদা, প্রশান্তদা এরা লেগপুলিংও করতো এদের। সুপর্ণার বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়ে ব্যানার্জীদা বলেছিলো, জার্মানিতে আরেকটা ছেলে দেখো সুপর্ণা, অঙ্কিতাকে এদেশে একা ফেলে রেখে যেও না। এই মেয়ে না হেসে হেসে রামগরুড়ের ছানা হয়ে যাবে তোমার বিরহে। ইদানীং অঙ্কিতা আর স্বাগতাকে প্রায়ই ক্যান্টিনে একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে। যদিও অঙ্কিতা বলছে, স্বাগতা ইজ নট মাই টাইপ। তবুও একা বকবক করার থেকে একটা শ্রোতা জোটানো বেশি প্রয়োজনীয় বলেই হয়তো একটু নির্বিবাদী, শান্ত স্বাগতা এখন অঙ্কিতার সঙ্গী হয়েছে।
অঙ্কিতা বরাবরই ছটফটে টাইপের। দেবাশীষদাকে টপকে প্রান্তিকের সামনে এসে একটা ফিস বল ওর মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, তারপর, এত সাজগোজ কিসের বস? বিয়ে বাড়িতে মেয়ে পটালে নাকি গুরু। অঙ্কিতার একটাই সুবিধে, ও সকলের সঙ্গেই ভীষণ রকমের ফ্র্যাঙ্ক। যাকে যা খুশি বলে দিতে পারে। প্রান্তিকরা অবশ্য ওকে একেবারেই সিরিয়াসলি নেয় না। দেবাশীষদা তো রীতিমত বলে, আমি শুধু ভাবি রূপমের ধৈর্য্যের কথা, ছেলেটাকে নোবেল দেওয়া উচিত। রূপম হলো অঙ্কিতার স্টেডি বয়ফ্রেন্ড। খুব তাড়াতাড়ি হয়তো বিয়েও করবে। অঙ্কিতা কলার তুলে বলে, রূপমের ফরটিন ফাদার্সের সৌভাগ্য এমন একটা কোহিনূর হিরে পেয়ে গেল এই বাজারে। মোট কথা অঙ্কিতা আর সুপর্নাই ওদের ডিপার্টমেন্টটাকে মাতিয়ে রাখতো।
প্রান্তিক হেসে বললো, কি মনে হয়, আমার এই পার্সোনালিটিতে মেয়ে পটবে? না বস, কেউ পটেনি। অঙ্কিতা আড়চোখে স্বাগতার দিকে তাকিয়ে বলল, স্বাগতা তো এতক্ষণ তোমাকেই দেখছিলো মনে হলো। আমিও দেখছিলাম অবশ্য, কিন্তু নজর মে থোড়া ফারাক হ্যায়।
বুঝলে প্রান্তিক, আজ এই ড্রেসে তোমাকে কিন্তু বেশ অন্যরকম লাগছে, ইউ আর লুকিং ফেবুলাস। দেখো এটা বেশ স্ট্যান্ডার্ড বিয়ে বাড়ি, এখানে যদি কাউকে ম্যানেজ করতে পারো তো ভালো, নাহলে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের ভরসায় দিন গোনো। প্রান্তিক হেসে বললো, বুঝলাম, বিনাপয়সার জ্ঞানদাত্রী….চলো বিয়ের আসরে যাই, দেখি সুপর্ণার কি হলো!
দেবাশীষদা প্রান্তিকের কথাটাতে সায় দিয়ে বলল, চলো চলো, খেতে পেলে এরা আর কিছু চায় না। আরে সুপর্ণাকে গিফটটাও তো দিতে হবে। ওরা জনা দশেক অফিস স্টাফ মিলে সুপর্ণার জন্য একটা সোনার লকেট উইথ টার্সেল কিনেছে, এই দশজনের মধ্যে প্রান্তিকও আছে। অঙ্কিতা নিজের ব্যাগ থেকে গয়নার বক্সটা বের করে বললো, ব্যানার্জীদা আপনি সকলের বড়, আপনি এটা দিয়ে ওকে আশীর্বাদ করুন। ছাদনাতলা নামটা নেহাত এখনো চালু আছে তাই, নাহলে এর অত্যাধুনিক ডেকোরেশনের চোটে একে ফিল্মের নাহোক সিরিয়ালের সেট বলে চালানোই যায়। ফুলের ছাউনি আর লাইটের মেলায় দুর্ধর্ষ করে সেজে উঠেছে সুপর্ণার বিবাহক্ষেত্র।
ওরা সবাই মিলেই এগোলো সেদিকে। বিয়ে শুরু হয়ে গেছে।
অঙ্কিতা প্রান্তিকের কানে কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, সুপর্ণার কিছু একটা হয়েছে, তুমি কিছু জানো? ওকে ভীষণ অন্যরকম লাগছে। প্রান্তিক তেমন গুরুত্ব না দিয়েই বললো, বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, নিজের জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছে, হয়তো তাই জন্যই..
অঙ্কিতা দৃঢ় স্বরে বললো, নো নেভার, আমি ওকে চিনি। ওর চোখের আড়ালের কষ্টটা অন্য কেউ না দেখতে পেলেও লাইনার আর কাজলের আড়াল থেকেও আমার কাছে সেটা স্পষ্ট। প্রান্তিক কিছু বলার আগেই সুপর্ণা কলিগদের দেখে বিয়ের আসর থেকেই হাত নেড়ে বললো, ব্যানার্জীদা, অঙ্কিতা আজ কিন্তু আমাকে ছাড়াই তোদের এনজয় করতে হবে। প্রান্তিক, ওদের একটু অ্যাটেন্ড কর প্লিজ। প্রান্তিক ঘাড় নেড়ে বললো, ডোন্ট ওয়ারি, এভরিথিং ইজ পারফেক্ট। তুমি নিশ্চিন্তে বিয়ে করো। সুপর্ণার ঠোঁটে একটা ক্লান্ত হাসি। সেই ক্যান্টিনের চূড়ান্ত আড্ডা দেওয়া সুপর্ণাটা ভীষণভাবে মিসিং। অঙ্কিতা কি তবে ঠিকই বলছে, কিছু একটা হয়েছে সুপর্ণার!
এদিক ওদিক তাকিয়েও ঈশাকে আর দেখতে পেলো না প্রান্তিক। কে জানে কোথায় গেল? বোধহয় লনের ওদিকে আছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যর্থ হয়েই বিয়ে দেখতে লাগলো সুপর্ণার। হঠাৎই অনুভব করলো কেউ একজন হাতটা ধরে টানছে। পিছন ফিরতেই দেখলো, ঈশার হাতের মধ্যে ওর ডান হাতের তালু বন্ধ হয়ে আছে। ইশারায় ডাকলো ঈশা প্রান্তিককে। ঈশার পিছন পিছন একটু তফাতে হাঁটছে প্রান্তিক। মনে মনে প্রমাদ গুনলো ও। নিশ্চয়ই আলাপ করাতে নিয়ে যাচ্ছে ক্রাশের সঙ্গে। অঘ্রানের নরম শীতেও ঘাম জমেছে প্রান্তিকের কপালে। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণাটা বুকের বাম দিকে অনুভব করলো প্রান্তিক। একটা অদ্ভুত চিনচিনে কষ্ট হচ্ছে ওর। ঈশা লনের অন্য প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে বেশ কিছু ওর বয়েসী ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ওর মধ্যেই কি আছে ঈশার পছন্দের মানুষটি? প্রান্তিক একটু জোরেই বললো, ঈশা, শোনো একটিবার, ওখানে কেন নিয়ে যাচ্ছ আমায়? আমি তো ওদের চিনি না, ওরা তোমার ফ্রেন্ড, আমি কি করবো গিয়ে?
ঈশা থমকে দাঁড়িয়ে বললো, চিনে নেবে। এরা আমার ফ্রেন্ড ঠিকই কিন্তু এরা সবাই সন্ধ্যাতারার বাসিন্দা। তুমিও এখন আমার ফ্রেন্ড, তাই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি তোমার সঙ্গে, এসো। প্রান্তিক বলতে চাইছিলো, প্লিজ ঈশা আমার স্বপ্ন দেখা চোখ দুটোকে আলোর সন্ধান দিতে না পারো অন্ধত্ব দিও না, সহ্য করতে পারবো না। বলা হলো না কিছুই। শুধু পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো ঈশার নির্দেশিত পথে।
ঈশার বন্ধুরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক দু-হাত দূরে দাঁড়িয়ে প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে ঈশা আচমকা জিজ্ঞেস করলো, ওই ব্লু শাড়ির মেয়েটা কে? তোমার কলিগ এটা আমি জানি, বাকিটা বলো!
প্রান্তিকের তো প্রথমটা বেশ ধোঁয়াশা লাগলো, ব্লু শাড়ির মেয়ে, সেটা আবার কে? অঙ্কিতা, স্বাগতা না গোপা— কে পরেছে ব্লু শাড়ি, সেটা মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা করলো ও। হতাশ হয়ে বলল, কে পরেছে ব্লু শাড়ি?
ঈশা রেগে গিয়ে বললো, যার সঙ্গে কানেকানে ফিসফিস করছিলে তুমি, তার কথা বললাম। আর একদম বলোনা ওর শাড়ির রং তুমি নোটিশ করনি! এতক্ষণ তো ওর দিকেই তাকিয়েছিলে হাঁ করে।
প্রান্তিক ততক্ষণে বুঝে গেছে অঙ্কিতাকে নির্দেশ করছে ঈশা। ও কিছু বলার আগেই ঈশা বললো, ব্লু জারবেরা খুঁজে পেলে না বিয়ে বাড়িতে? লাগিয়ে দিতে পারতে ওর খোঁপায়, এনিওয়ে তোমার পছন্দ বেশ সুন্দর।
ঈশার শেষ কথাটা এসে তীরের মত বিঁধলো প্রান্তিকের বুকের বাঁদিকে। জীবনে এই প্রথমবার ও কারোর জন্য ফুল নিয়ে গিয়েছিল এবং সেটা তার চুলে আটকে দিয়েছে। তার টাটকা স্মৃতি এখনো ওর মনে রামধনুর রং ছড়াচ্ছিলো, আকস্মিক এমন আঘাতে সাতটা রং মিশে গিয়ে ঘনধূসরে পরিণত হলো। ঠোঁটটা কেঁপে উঠলো প্রান্তিকের কিন্তু কিছুই বলা হল না ঈশাকে। ঈশা কি ওকে প্লেবয় ভেবেছে নাকি! সকলের সঙ্গেই এক ব্যবহার করে যাবে। নিশ্চুপ হয়ে ছিল প্রান্তিক। ঈশা আবারও বললো, ভেবেছিলাম আজ আমার ক্রাশের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব, সে আর হলো কই? বরং তুমিই তোমার স্টেডি গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও।
নাকি সে ভীষণ পজেসিভ, আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে জানলে রাগ করবে?
প্রান্তিকের গলার কাছে একটা অদ্ভুত কষ্ট দলা পাকাচ্ছে। ঈশার রূঢ় কথাগুলো এসে সজোরে ধাক্কা দিচ্ছে হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠে। আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ও হয়তো কেঁদে ফেলবে চিৎকার করে।
খুব সাবধানে প্রান্তিক বললো, ঠিকই বলেছো, সে খুব পজেসিভ। হয়ে গেছে তোমার সব কথা বলা? তাহলে আমি এখন যাই?
ঈশা একটু থেমে বললো, বেশ আমার সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে না, তুমি বরং আমার ক্রাশকে দেখে যাও।
প্রান্তিক বললো, সে না হয় অন্যদিন দেখবো, আজ থাক।
তোমার বন্ধুরা তোমার জন্য ওয়েট করছে, যাও এনজয় করো।
ঈশা প্রান্তিকের হাতে হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট বক্স টাইপের কিছু ধরিয়ে দিয়ে বললো, দেখে নিও, ওর মধ্যে ছবিটা আছে। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি ঈশা। প্রান্তিকও ফিরে এসেছে ডিনার টেবিলে। বাফেতে থরে থরে খাবার সাজানো থাকলেও খাওয়ার ইচ্ছেটা চলে গিয়েছিলো ওর। দুপুরে যেমন ঈশার বকুনি শুনে খাচ্ছিলো, রাতেও হয়তো তেমনি আশা করে রেখেছিলো ও। তাই এসব খাবার এখন বিস্বাদ লাগছে প্রান্তিকের জিভে। কলিগরা খেয়েদেয়ে ফিরে যাচ্ছে দেখে প্রান্তিকেরও মনে হলো আর কেন বসে থাকবে এই বিয়েবাড়িতে সব অপরিচিতদের মধ্যে! হ্যাঁ সবাই অপরিচিত। ঈশাও…
উঠে বেরিয়ে আসার আগেই ঈশার মা এসে বললো, ঈশাকে দেখেছো প্রান্তিক? ফোন করছি ধরছে না, তাকে দেখতেও পাচ্ছি না, তুমি খাওয়াদাওয়া করেছ তো বাবা?
এই সামান্য কেয়ারিং কথাটাতেই চোখ ছাপিয়ে জল এসে যাচ্ছিলো প্রান্তিকের। কষ্টটাকে বুকের মধ্যে ঠেলে দিয়ে প্রান্তিক বললো, হ্যাঁ আন্টি খেয়েছি আমি। ঈশাকে দেখলাম বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরছে।
ঈশার মা একটু চিন্তিত স্বরে বললো, বেশিক্ষণ না দেখলে চিন্তা হয়, যা মুডি মেয়ে, কখন যে কি ভাবছে তার তল খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। এই হাসছে তো এই গোমড়া হয়ে যায়, ভয়ে থাকি ওকে নিয়ে। প্রান্তিক হেসে এগিয়ে এলো গেটের দিকে। মনে মনে বললো, তা বটে, বড্ড মুডি। আসার সময় তার মনে হল উবেরে নয় বাইকে চেপে, প্রান্তিককে স্পর্শ করে ওর মধ্যে একটা নরম আশা জাগানো দরকার, তাই সেটাই করলো। এখন মনে হলো, প্রান্তিককে প্লেবয় আখ্যা দেওয়া নিতান্ত প্রয়োজন তাই বললো। আবার তার মনে হলো, নিজের ক্রাশের ছবি প্রান্তিককে দেখানো দরকার তাই বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। পাঞ্জাবীর পকেটে বক্সটা খোঁচা দিচ্ছে। খুলে দেখার প্রয়োজন নেই প্রান্তিকের, তাই দেখেনি।
বাইকে স্টার্ট দিলো ও। এখন কারোর চুল বা ড্রেস খারাপ হয়ে যাবার দায়িত্ব নেই ওর, কাঁধে নেই কারোর নরম হাতের স্পর্শ, তাই রাতের ফাঁকা রাস্তায় বেশ স্পিডেই বাইক চালিয়ে দিলো প্রান্তিক। খুব তাড়াতাড়ি ফিরতে চায় ফ্ল্যাটে। ঢুকতে চায় একাকীত্বের নির্বাসনে। তবেই একটু শান্তি পাবে ও। পিছনে পড়ে রইলো স্বপ্নীল বিয়েবাড়ি, স্বপ্ন স্বপ্ন ঈশা। বেশ জোরেই চিৎকার করে বললো প্রান্তিক….এই জন্যই তো আমার একলা থাকার আয়োজন।