হারিয়ে যাওয়ার আগে – ৮
৮
কি রে বিয়েবাড়ি থেকে অমন হাওয়া হয়ে গেলি কেন? আমি তো চারিদিকে খুঁজেও পেলাম না তোকে। এই ঈশা, এমন লাইট অফ করে এখুনি শুয়ে পড়লি যে! শ্রেয়া একনাগাড়ে কথাগুলো বলেই যাচ্ছে ঈশাকে। ঈশার মধ্যে কোনোরকম হেলদোল নেই। শেষে ঘরের লাইটটা জ্বেলে বুঝলো, ঈশা ড্রেসটা পর্যন্ত চেঞ্জ না করে শুয়ে আছে বিছানায়। এমনকি মাথার ফুলটা পর্যন্ত ঝরে পড়ছে বিছানায়। শ্রেয়া বললো, কি রে কিছু হয়েছে? দিদিভাই কিছু বলেছে তোকে?
ঈশা পাশ ফিরে বললো, কারোর কারোর স্বপ্ন দেখাও পাপ তাই না মা? কারোর কারোর জীবনে ভালোবাসা নামক বেইমান জিনিসটা কিছুতেই ধরা দেয় না তাই না মা? কাউকে আঁকড়ে ধরতে গেলেই দেখা যায় মুঠো শূন্য হয়ে গেছে। শ্রেয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ভালোবাসাকে জোর করে ধরে রাখার চেষ্টা করতে নেই। সে নিজেই ধরা দেবে তোর কাছে। শুধু অপেক্ষা করতে হয় সঠিক মুহূর্তের।
যা গিয়ে পোশাক পাল্টে নিয়ে শুয়ে পড়। ওহ, প্রান্তিককে জিজ্ঞেস করলাম তোকে দেখেছে কিনা, ছেলেটা করুণ মুখে বললো, ঈশা ওর বন্ধুদের সঙ্গে ছিল। এখানে একেবারে নতুন এসেছে, বোকার মত একা একাই ঘুরছিল দেখলাম। তুই একটু সঙ্গ দিতে পারতিস।
ঈশা ঠোঁটটা জোরে কামড়ে ধরে বলল, না মা তার সঙ্গী ছিল সন্ধে থেকেই। হয়তো সে চলে যাবার পরে একা ঘুরছিলো। শ্রেয়া বেশ বুঝতে পারছে মেয়ের কোথাও একটা আঘাত লেগেছে, তাই গলাটা করুণ শোনাচ্ছে। বেশি কথা না বাড়িয়ে বললো, ড্রেস চেঞ্জ করে নে, দিয়ে ঘুমিয়ে পড়।
মা বেরিয়ে যাবার পরে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকলো ঈশা। চেঞ্জ করে বিছানায় এসে দেখলো হোয়াটসঅ্যাপে দুটো মেসেজ ঢুকেছে। প্রান্তিক লিখেছে, বাড়িতে ফিরেছ? তোমার মা চিন্তা করছিলেন, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
ঈশা টাইপ করলো, অকারণ চিন্তা না করে ঘুমিয়ে পড়, আমি হয়তো তোমার আগেই ফিরেছি।
প্রান্তিক একটা স্মাইলি দিয়ে অফ হলো।
হোয়াটসঅ্যাপ ডিপিতে প্রান্তিককে একটু অন্যরকম লাগছে। অফিসের কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। পিছনে আরও চার-পাঁচজন দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে প্রান্তিকের গার্লফ্রেন্ডও রয়েছে। মেয়েটাকে বেশ মিষ্টি দেখতে। ছবিটা দেখতে দেখতেই গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল ঈশার, হয়তো ওর অজান্তেই। ঘুমিয়ে পড়লে হয়তো আজকের আচমকা পাওয়া আর হারিয়ে ফেলার স্মৃতিগুলো একটু হলেও আবছা হবে ওর দৃষ্টিপথে, তাই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো ঈশা।
চোখ বন্ধ করতেই দেখলো, সেই পনিটেল বাঁধা স্কুলড্রেস পরা মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
.
ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠলো ঈশা। মা ডাকছে, দরজায় নক করছে ঘনঘন।
ঈশা উঠতেই মা বললো, একটা খুব বাজে ঘটনা ঘটে গেছে কমপ্লেক্সে। নয়তলার সমুদ্র চৌধুরীর স্ত্রী গ্যাস ব্লাস্ট করে মারা গেছেন। পুলিশ এসেছে। বিদিশার বসের স্ত্রী রে। বিদিশা ছুটেছে একটু আগে। বোধহয় ভোরেই নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়েছিল, এক্সপায়ার করে গেছেন বলে ফিরিয়ে এনেছে। কেমন একটা ঘেঁটে যাচ্ছিল ঈশার সদ্য ঘুম ভাঙা মাথাটা। মা একনাগাড়ে বলেই চলেছে, আহা রে একটা সিক্সে পড়া বাচ্চা আছে। এই তো রে সামনের লনে বিকালে সাইকেল চালায় ছেলেটা। সবাই বলছে সুইসাইড, কেউ কেউ বলছে মার্ডার। ঈশা ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে দেখলো, পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অ্যাম্বুলেন্সও দাঁড়িয়ে। হাইরাইজের প্রচুর মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশা চেনে রচনাবৌদিকে। ভীষণ শাড়ির নেশা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ওর লাইভ প্রোগ্রাম দেখে ওর কাছ থেকে অনেক শাড়ি কিনেছিলো। মাস তিনেক হলো কোনো এক অজানা কারণে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে ভদ্রমহিলা। উপযাচক হয়ে কাস্টমার জোগাড় করতে ভালো লাগে না ঈশার, তাই দু-একবার সৌজন্যমূলক কথা বলতে গিয়ে দেখেছে রচনাবৌদি অদ্ভুত ভাবে অচেনার ভাব করে চলে গেছে। তাই প্রায় মাস দু-তিন হলো যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ। যদিও কাস্টমারের বাইরে আর কোনো রিলেশন ছিলো না ভদ্রমহিলার সঙ্গে, উনিই যে দিদির বসের স্ত্রী এটুকুই তথ্য ছিল ঈশার কাছে। রচনা সাজগোজ নিয়ে ভীষণ সচেতন ছিলো। ‘সন্ধ্যাতারা’ কমপ্লেক্সের পুজোর সময়েও ডিজাইনার দামি শাড়ি আর ডায়মন্ড জুয়েলারী দিয়ে নিজেকে যত্ন করে সাজাত মহিলা। দেখে তো মনে হতো না সুইসাইড করতে পারে! বেশ সুখী সুখী ভাবনাবিহীন চেহারা ছিলো মহিলার। ঈশা আর কিছু ভাবার আগেই দিদিভাই ঢুকলো রচনাবৌদির বাচ্চাটাকে নিয়ে। ঢুকেই বললো, ঈশা আজ ওকে টেক কেয়ার করবি তুই। দেখিস ওর যেন কোনো অযত্ন না হয়। খুব কাঁদছে ইভান, একটু সামলে রাখিস। আমি একটু স্যারের সঙ্গে থানায় যাবো।
ছেলেটার চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে, মুখটা পেলব। সেটাই স্বাভাবিক। আচমকা মায়ের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরে কোনো বাচ্চাই বিশ্বাস করতে পারবে না তার মা আর নেই। ইভান মুখ কাঁচুমাচু করে বসেছিলো। ঈশা নিজের পুরনো ইন্ডোর গেম নিয়ে সাজিয়ে বসেছিলো ইভানের সামনে। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে কেঁদে ফেলছিল ছেলেটা।
শ্রেয়া বললো, হ্যাঁ রে বিদিশা ওর আত্মীয়স্বজন কেউ নেই? বিদিশা একটু জোরে শ্বাস নিয়ে বললো, রচনার বাবা-মা মারা গেছেন। এক দাদা বিদেশে থাকে। সে খবর পেয়েই কোনো একজন রিলেটিভের মাধ্যমে কেস ঠুকে দিয়েছে স্যারের নামে। এখন স্যার ইভানকে নিয়ে পড়েছেন বিপদে। ওকে কার কাছে রাখবেন বুঝতে পারছেন না। তাই আমি নিয়ে এলাম।
শ্রেয়া একটু নরম গলায় বলল, সে ভালো করেছিস। আমি ওকে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করি। তুইও ব্রেকফাস্ট করে বেরোবি। বিদিশা অন্যমনস্কভাবে বললো, এখন খাওয়ার সময় নেই মা। আমি আসছি, ইভানকে দেখো।
ঈশা দেখছিল, বিদিশা যেন একটু বেশিই চঞ্চল হয়ে পড়েছে। শুধু বসের স্ত্রীর মৃত্যুতে কেউ এতটা ভেঙে পড়ে না বোধহয়। প্রশ্নটা মনে আসতেই কয়েকদিন আগের দেখা একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে গেলো ঈশার।
বিদিশা বেশ রাত্রে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো ফিসফিস করে। দুটো কথা কানে এসেছিলো ঈশার, প্লিজ সমুদ্র এভাবে রিস্ক নিয়ে এখন কল করো না। কাল অফিসে গিয়ে কথা হবে।
ঈশা বাথরুমে যাওয়ার সময় শুনতে পেয়েছিলো কথাগুলো। একটু অবাক হয়ে ভেবেছিলো, দিদিভাই এত রাত্রে অফিসের বসের সঙ্গে কেন কথা বলছে, তাছাড়া টোনটাও কেমন অদ্ভুত ফিশি লেগেছিল। আজও রচনা মারা যাওয়ায় দিদিভাইয়ের অস্থিরতা মায়ের চোখ এড়িয়ে গেলেও ঈশার নজর এড়াতে পারেনি। অস্বস্তির কাঁটাটা মনের মধ্যে খচখচ করছে। মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করলো ও, যেন এই মৃত্যুর সঙ্গে দিদিভাইয়ের নাম কোনোভাবেই না জড়িয়ে যায় ভগবান। অন্যমনস্ক ঈশা দেখলো, ইভান ম্যাগিটা খেয়ে নিলো চেটেপুটে। ছেলেটার বোধহয় খুব ক্ষিদে পেয়েছিলো। খাওয়া শেষ হতেই বললো, মা কখন ফিরবে আন্টি? মা আমায় গান গেয়ে ঘুম পাড়ায় রোজ। আমার মা ভালো সিঙ্গার।
ঈশা বুঝতে পারলো মায়ের মৃত্যু সংবাদ এখনো ছেলেটার কানে পৌঁছায়নি, বা বুঝতে পারেনি ঠিক কতটা ক্ষতি হয়ে গেছে ওর।
ইভান ফিসফিস করে নিজের মনে বললো, কাল মা কাঁদছিলো, ঝগড়া করছিলো বাবার সঙ্গে। মা বলছিলো, আমি মরে গেলে বিদিশার সঙ্গে থাকতে পারবে তুমি।
বাবা বললো, আর কতবার বলবো, বিদিশা আমার এমপ্লয়ি, ভালো বন্ধু এই পর্যন্ত। দিনের পর দিন এক ইস্যু নিয়ে অশান্তি করো না।
ঈশা চমকে উঠলো ইভানের কথা শুনে। তার মানে ওর ভাবনা সত্যি। সমুদ্র চৌধুরীর সঙ্গে দিদিভাইয়ের একটা রিলেশন আছে। রচনা তার মানে যবে থেকে এটা আন্দাজ করেছে এবং জেনেছে ঈশা বিদিশার বোন, তবে থেকেই ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। ভয়ে হাতপা ঠান্ডা হয়ে গেলো ঈশার।
ফোনটা ভাইব্রেট করছে ঈশার। প্রান্তিকের ফোন। কাঁপা গলায় হ্যালো বলতেই প্রান্তিক বললো, ঈশা কমপ্লেক্সে কি হয়েছে জানো? গেটে অত পুলিশ কেন? অফিসে যেতে হবে তো, তাই জানতে চাইছি। ঈশা ঘটনাটা বলার পরে বললো, প্রান্তিক তোমার কোনো ভালো ল-ইয়ার জানা আছে গো? আমার এক ফ্রেন্ডের জন্য দরকার।
প্রান্তিক একটু ভেবে বললো, আছে। আমাদের অফিসের দেবাশীষদার ভাই তো ক্রিমিনাল ল-ইয়ার। আচ্ছা একটু পরে আমি তোমায় ওর ফোননম্বরটা সেন্ড করছি।
ঈশার বুকটা কাঁপছে, বারবার মনে হচ্ছে খুব বড় একটা বিপদ আসতে চলেছে দিদিভাইয়ের ওপরে, মানে ওদের গোটা পরিবারটার ওপরে। তাই আগাম ল-ইয়ারের সঙ্গে কথা বলে রাখতে চায় ঈশা কাউকে না বলে।
ইভান ওর পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঈশা খুব ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখলো, প্রান্তিক গেটের মুখে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ, সিক্যুইরিটি দুজনের সঙ্গেই একটু হট টক হচ্ছে মনে হলো। বোধহয় কমপ্লেক্স সিল করে দিয়েছে। এই মুহূর্তে কেউ বেরোতে পারবে না। অন্তত বি ব্লক থেকে। যেহেতু এরই নয়তলায় ঘটেছে ঘটনাটা তাই। ঈশা দেখলো প্রান্তিক ফিরে আসছে গ্যারেজের দিকে। মুখে থমথমে রাগ। ঈশা ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো ইভান ঘুমাচ্ছে। পায়ে পায়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেলো।
প্রান্তিক ফ্ল্যাটে রয়েছে দেখেই বেলটা বাজাল ও।
দরজা খুলেই প্রান্তিক বিরক্তির স্বরে বললো, আরে কোন ফ্ল্যাটে কি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে তার দায় কি আমার? শুধু শুধু আমার একটা ক্যাজুয়াল লিভ কাটা গেলো। কোনো মানে হয়? এখন নাকি প্রমাণ হবে চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের কর্মকর্তার স্ত্রী সুইসাইড করেছে না এটা মার্ডার? তার জন্য সাফার করতে হচ্ছে আমাদের।
ঈশা কাঁপা গলায় বললো, প্রান্তিক আর কি শুনলে গো?
প্রান্তিক ঈশার দিকে এতক্ষণে তাকিয়ে দেখলো, মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ওর। ঠোঁট দুটো কাঁপছে তিরতির করে। গলার মধ্যে একরাশ ভয়ের অনুভূতি।
একটু অবাক হয়েই ও বললো, এই ঈশা তুমি কি ভয় পেয়ে গেছো? আরে কলকাতা শহরে প্রতিদিন কত মানুষ সুইসাইড করছে তোমার ধারণা আছে, এতে ভয়ের কি আছে? একটু ইনভেস্টিগেশন হবে, ওদের বাড়িতে কাল রাতে কোনো গন্ডগোল হয়েছিলো কিনা, বা সমুদ্রবাবুর কোনো অবৈধ্য রিলেশনের জের কিনা…এসব খুব সাধারণ, এনকোয়্যারির জন্যই কিছু ফরম্যালিটিস মানতে হবে সকালটা। বিকেল থেকে দেখবে এভরিথিং ইজ নরম্যাল। বাই দ্য ওয়ে তোমার ইউনিভার্সিটি নেই আজ?
ঈশার মুখটা ভয়ে আরেকটু নীল হয়ে গেলো। আতঙ্কগ্রস্ত গলায় বলল, একটু জল দাও তো।
প্রান্তিক কিচেন থেকে জলের বোতল এনে ওর সামনে রেখে বললো, অযথা ভয় না পেয়ে ক্রাশকে কল করে আড্ডা দাও বুঝলে?
দিদিভাইয়ের জন্য এমনিই টেনশন হচ্ছে ঈশার। তার মধ্যে প্রান্তিকের এরকম একটা কথাতে বিরক্তি উগলে দিয়ে বললো, তার মানে তোমায় কাল যে বক্সটা দিয়েছিলাম ওটা তুমি দেখনি, তাই তো?
প্রান্তিক অন্যমনস্ক ভাবে বললো, না দেখিনি। সন্ধ্যাতারায় যেদিন প্রথম এসেছিলাম সুপর্ণার সঙ্গে সেদিন ভাবিনি এত টাকা ই.এম.আই দিয়ে এখুনি ফ্ল্যাট কিনবো। সুপর্ণাকে না বলে দিতেই যাচ্ছিলাম, ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম ওর এই লোভনীয় অফার। ঠিক তখনই বিস্মিত হয়েছিলাম তাকে দেখে, না শুধু অসাধারণ সুন্দরী বলে নয়, বরং অজান্তেই আমার স্বপ্নচারিণীকে সম্মুখে দেখে অবাক লেগেছিলো। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এখানেই ফ্ল্যাটটা আমায় নিতে হবে। তখনও জানতাম না সে এনগেজড কিনা, তার অন্য কোনো রিলেশন আছে কিনা, শুধু বুঝেছিলাম এর উপস্থিতি আমায় আনন্দ দেবে। এটাকেই বোধহয় ভালোলাগা বলে তাই না? যদিও বন্ধুরা বলে আমি নাকি প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপারে বড্ড আনপর। তবুও এটুকু আমার মনই জানান দিয়েছিল আমায়। বুঝেছিলাম এর নাম ভালোলাগা। কিন্তু সপ্তাহখানেক পরে সেই একজনের অনুপস্থিতি যখন আমায় অস্থির করলো তখন বুঝলাম আর ভালোলাগায় সীমাবদ্ধ নেই, আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। যখন জানতে পারলাম সে এনগেজড নয় তখন আশার পারদটা বাড়তে শুরু করলো। অসহ্যরকম সুন্দর সন্ধ্যায় জানতে পারলাম, তার প্রেমিক না থাক ক্রাশ আছে। আগে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার আঘাতটা সামলাই তারপর নাহয় দেখবো তোমার ক্রাশের ছবি। তাই আর ফ্রেমটা খুলিনি।
আর ঈশা, পাঞ্জাবির প্রাইসটা বলো প্লিজ। আমি দিয়ে দিতে চাই। অকারণ ঋণী হতে চাই না।
ঈশা নিজেই টের পায়নি কখন তার দুটো গাল বেয়ে নোনতা জলের ধারারা চিবুক ছুঁতে চাইছে! সম্বিৎ ফিরে পেল প্রান্তিকের ছোঁয়ায়। প্রান্তিক হাত দিয়ে ওর দুটো গাল মুছিয়ে দিয়ে বললো, তারপর সারারাত অনেক ভাবলাম বুঝলে ঈশা। ভেবে আবিষ্কার করলাম, তুমি ছাড়া এই হাইরাইজে পড়ে থাকার তেমন কোনো উদ্দেশ্য আমার নেই। সুতরাং বন্ধুত্বটুকু থাকুক, থাকুক একতরফা ভালোবাসাটাও। চিন্তা করো না, আমি তোমায় এমন কোনো অ্যাকওয়ার্ড পজিশনে ফেলব না যে তোমার বন্ধুত্বটুকু রাখতে অসুবিধা হবে।
ঈশা কান্নাভেজা গলায় বলল, তাহলে অফিসের ওই মেয়েটা কে, যে তোমার সঙ্গে অত হাসছিল?
প্রান্তিক হেসে বললো, ওটা তো অঙ্কিতা পাগলী। ওর স্টেডি বয়ফ্রেন্ড আছে, তবুও ও আমাদের অফিসের প্রাণশক্তি। সকলের বন্ধু। পঞ্চান্নর ব্যানার্জীদা থেকে শুরু করে বিয়াল্লিশের দেবাশীষদা, আবার আমার মত সমবয়সীরাও ওর বন্ধু। অঙ্কিতারা সামনের সপ্তাহেই আসবে আমার ফ্ল্যাটে। তোমার সঙ্গে সকলের আলাপ করিয়ে দেবো। তখন দেখবে, একটা মানুষ কি লেভেলের বকবক করতে পারে। প্রান্তিক জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, যদি তুমি পরিচয় করতে চাও তবেই।
ঈশা ফুঁপিয়ে বললো, কাল যে বক্সটা দিলাম ওটা এখুনি খুলে দেখো প্লিজ। আমি চললাম, পরে কথা বলবো। দেখার পরে মেসেজ করো, কেমন দেখলে আমার ক্রাশকে। ঈশা বেরিয়ে যেতে প্রান্তিক পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করলো একটা পিঙ্ক টাইপের পাতলা সোনালী কাজ করা বক্স। ঠিক ছোট্ট ফটোফ্রেমের মত দেখতে। হৃৎপিণ্ডের ভিতরের উত্তাল শব্দটুকুও কানে আসছে সমানে। হাতটা অল্প কেঁপে উঠলো প্রান্তিকের।
বক্সটা খুলতেই থমকে গেল প্রান্তিক। এমন সুন্দর কারুকার্য করা ফটোফ্রেমের মত দেখতে জিনিসটা একটা ছোট্ট মিরর! দুটো সাইডেই মিরর। ঠোঁটের কোণে যে হাসিটা ফুটলো প্রান্তিকের সেটার প্রতিচ্ছবি উঠলো ঈশার দেওয়া আয়নাটাতে। ইস, কাল সারারাত নির্ঘুম থেকে কষ্ট পেয়েছে প্রান্তিক। তখনই যদি বক্সটা খুলে দেখে নিতো তাহলে ঈশাকেও কষ্ট দিতে হত না। বন্ধুরা ঠিকই বলে, তোর দ্বারা মেয়েদের চোখের ভাষা বোঝা অন্তত সম্ভব নয়। মেয়েদের নয়, মাত্র একটা মেয়ের চাউনি বুঝতে চেয়েছিল ও। সেটাও ব্যর্থ। ঈশার উচিত প্রান্তিককে জাস্ট রিজেক্ট করে দেওয়া এই অপরাধে। নিজের মনেই হেসে চলেছে প্রান্তিক। আনন্দটুকুকে কৃপণের মত নিজের সঙ্গে এনজয় করছে ও, এর একফোঁটা ভাগও কাউকে দেবে না ও। এমনকি ঈশাকেও নয়। তাই এখনও মেসেজটা করেনি প্রান্তিক ঈশাকে। ক্যাজুয়াল লিভটা যাওয়ার জন্য মেজাজ খাপ্পা হয়েছিল প্রান্তিকের। ঈশা যেন মুহূর্তে সেই বিরক্তি, ক্ষোভ, সবটুকুকে নিয়ে চলে গেল ওর কাছ থেকে। এখন প্রান্তিকের মন কানায় কানায় পূর্ণ বসন্তের লজ্জা জড়ানো নরম বাতাসে।
সন্ধ্যাতারা হাইরাজের সাততলায় বসে নিচের জনবহুল মহানগরীর দিকে তাকিয়ে দেখল প্রান্তিক। মানুষগুলো ছুটছে নিজের নিজের কর্মস্থলের দিকে। মুখগুলো যদিও পরিষ্কার নয় সেভাবে তবুও প্রান্তিক বলে দিতে পারে, এই মুহূর্তে ওর মত সুখী আর কেউ নেই। একেই বোধহয় বলে প্রাপ্তি, নাকি স্বপ্নপূরণ! যা ইচ্ছে নামকরণ করুক বাংলা অভিধান, শুধু ও জানে এ অনুভূতি ওর একান্ত নিজের।
অনেকক্ষণ ঈশার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা খুলে বসেছিলো প্রান্তিক। একটা ছোট্ট মেসেজ করা উচিত। কি লিখবে কিছুতেই বুঝতে পারছে না ও। কি লেখা উচিত? ভালোবাসি….ধুর, হচ্ছে না। এভাবে মেসেজের মাধ্যমে ও এই আনন্দটা কিছুতেই ব্যক্ত করতে পারবে না। তাও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল প্রান্তিক।
ঈশা তোমায় পেতে নির্বাসনে যেতে পারি।
তোমার জন্য হাঁটতে পারি এক পৃথিবী।
ধুত্তোর বড্ড কাব্যিক হয়ে যাচ্ছে। ওর মত কাঠখোট্টা ইঞ্জিনিয়ারের মুখে কবিতা শুনে হয়তো ঈশা জ্ঞান হারাবে। তাহলে…না এভাবে নয়। একটু সময় চাই প্রান্তিকের।