বাদশাহ আর ফরাসি ডাক্তার
বাদশাহ মুসাফির অন্যমনস্ক হয়ে বসেছিলেন নিজের রাজকীয় তাঁবুর ভিতরে। সামনে কয়েকজন চাটুকার বাদশাহের মনকে প্রসন্ন করার তাগিদে চটুল অঙ্গভঙ্গিমা প্রদর্শনে ব্যস্ত। যদিও অল্পবয়সী বাদশাহের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তাঁবুর সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নয়না নদীর ধারা। সেদিকে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছেন তিনি। বাদশাহ মিজানুর ছিলেন রুদ্রনগরের বীরপুরুষ। সামরিক বুদ্ধিতে, শক্তিতে তিনি ছিলেন অপরাজেয়। তার একমাত্র বংশধর হয়েও মুসাফির যুদ্ধে পারদর্শী নন। রাজ্যে কানাঘুষো চলে নতুন বাদশাহ কাব্যচর্চায় ব্যস্ত। রাজ্য পরিচালনায় নাকি তিনি অক্ষম। বাদশাহ মিজানুরের সুযোগ্য সন্তান তিনি নন। মিজানুরের তিন বেগমের বাকি সন্তানরা কন্যা। তাই সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে নামতে হয়নি মুসাফিরকে। ছোটি বেগম জাহানারার পুত্র মুসাফির পরিশ্রম না করেই রুদ্রনগরের সিংহাসনে আসীন হয়েছেন। বাদশাহ মিজানুরের আকস্মিক মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো গোটা রুদ্রনগর। রুদ্রনগরের বাতাস এমন প্রজাবৎসল বাদশাহের জন্য ক্রন্দনধ্বনিতে ভারী হয়ে উঠেছিলো। ঠিক তখনই মহামন্ত্রী সুজান খানের তত্ত্বাবধানে রুদ্রনগরের সিংহাসনে বসেন মুসাফির।
বাদশাহ মিজানুরকে যুদ্ধক্ষেত্রে বিষাক্ত তীরের আঘাতে হত্যা করা হয়। মিজানুরের যুদ্ধ জয় যখন নিশ্চিত, ঠিক তখনই বল্লভপুরের রাজা যুদ্ধনীতিকে বিকৃত করে জয়ী বাদশাহকে আঘাত করেন বিষাক্ত তীর দিয়ে। সেই বিষক্রিয়ার সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে প্রাণ ত্যাগ করেন বাদশাহ মিজানুর। পিতার ছত্রছায়ায় বাইশটা বসন্ত কাটানোর পরে মুসাফির বিস্মৃত হয়েছিলেন যে তিনি একজন শাহজাদা। তাঁকেও রাজ্যভার গ্রহণ করতে হবে। এমন গুরুদায়িত্ব আচমকাই তাঁর কাঁধে এসে পড়ায় তিনি কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। সুজান খানই তাঁর মধ্যে গত আট মাস ধরে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছেন। পিতার শত্রুকে নিধন করাটাই নাকি এই মুহূর্তে সবথেকে বড় সংকল্প হওয়া উচিত মুসাফিরের।
.
বালক বয়েস থেকেই যুদ্ধবিরূপ মনোভাব নিয়ে বড় হয়েছেন মুসাফির। যুদ্ধ, মৃত্যু, হাহাকার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নির্জনে থাকতে পছন্দ করেন তিনি। আয়ুর্বেদ তাঁর বড় প্রিয় বিষয় ছিলো। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা নিয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছেন। হারেম মহলে বহুবার ঢুকেছেন চিকিৎসার জন্য। রোগী যখন তাঁর চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছে তখন বাদশাহ এসে বহুবার কাঁধে হাত রেখে বলতেন, বিদেশি ডাক্তার প্যাট্রিকের মতই সুদক্ষ চিকিৎসক হয়ে উঠছো। তুমি যদি সিংহাসনের অধিকারী না হতে তাহলে তোমায় শল্য চিকিৎসায় পারদর্শী করে তুলতাম।
প্যাট্রিক ছিলেন রুদ্রনগরের বিদেশি চিকিৎসক। জাতিতে ফরাসি হলেও বাংলাভাষার প্রতি ছিল অপরিসীম টান। উর্দু, বাংলা শেখার আগ্রহ থেকেই প্যাট্রিক রুদ্রনগরের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। একমাত্র প্যাট্রিকের হারেমে প্রবেশের অধিকার ছিলো। বেগমেরা তাঁর সোনালী চুল দেখেও তাঁর দিকে তির্যক চাহনিতে চাইতো না। বরং হারেমের অনেক বেগমকেই তিনি নানা স্ত্রী রোগের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন। বাদশাহের ভীষণ প্রিয় পাত্র ছিলেন চিকিৎসক প্যাট্রিক। মুসাফিরের থেকে বছর পাঁচেকের অগ্রজ প্যাট্রিকের সঙ্গে ক্রমে ক্রমে রীতিমত সখ্যতা তৈরি হয়েছিলো ওর। প্যাট্রিক আর মুসাফির রাত জেগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই মুখস্থ করতেন। কিন্তু আফশোস একটাই প্যাট্রিককে কোনোদিন তলোয়ার চালাতে হবে না। কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে না। কাউকে যুদ্ধক্ষেত্রে খুন করতে হবে না। প্যাট্রিক শুধু মানুষকে জীবনদায়ী ঔষধ দিয়ে বাঁচবে, আর মুসাফিরকে মানুষের প্রাণ নিতে হবে। হতাশ লাগে মুসাফিরের। কেন ও বাদশাহের প্রাসাদে জন্মালো, কেন ও চিকিৎসক হতে পারলো না! কেন ও শব্দের পরে শব্দ মিলিয়ে কাব্য রচনার সুযোগ পেলো না!
.
জাহাপনা, জঙ্গলের অভ্যন্তর দিয়ে পথ প্রস্তুত হয়েছে। বিষপুরের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এ পথ পৌঁছাবে বল্লভপুরের সীমানায়।
সচকিত হয়ে মুসাফির বললেন, খেয়াল রেখো বিষপুরের বাসিন্দাদের যেন সমস্যায় পড়তে না হয়। সাধারণ প্রজাদের যেন তকলিফ না হয়। সৈনিক মাথা নত করে জানালো, তারা নিরাপদেই আছে।
ডাক্তার প্যাট্রিক ফিসফিস করে বললেন, বাদশাহের কি একটু ফুরসৎ হবে? তাহলে নয়না নদীর ধারে পদচারণা করে চক্ষুযুগলকে আরাম দেওয়া যেতে পারে। এই জন্যই যুদ্ধক্ষেত্রে তেমন প্রয়োজন হবে না জেনেও মুসাফির প্যাট্রিককে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। জখম সৈনিকদের ক্ষত নিরাময় করা ছাড়াও মুসাফিরের অন্তর পড়তে পারেন প্যাট্রিক। তিনি ঠিক বুঝেছেন এই সৈন্যদের পদচারণা, তলোয়ারের ঝনঝন, কামানের আওয়াজ, গোপন পথ দিয়ে বক্রপথে আক্রমণের পরিকল্পনা….এসবে কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারছেন না মুসাফির। সারি সারি শিবিরের এত মানুষের মধ্যে একমাত্র একজন বিদেশিই বুঝতে পারেন মুসাফিরকে। না, তার মা জাহানারাও বোঝেন না তার পুত্রকে। বুঝলে আসার আগে বলতেন না, বাদশাহের হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে তবেই ফিরো মুসাফির।
না, বাদশাহের বেগম কখনো কৃষক ঘরণী হতে পারেন না। সন্তানের অন্তরের ব্যাকুলতা অনুভব করার মত যথেষ্ট সময় তাঁর থাকে না। কিন্তু এক ফরাসি ভিনদেশী ডাক্তার অনেক বেশি মনোযোগ দেন মুসাফিরের প্রতি। বাদশাহকে তৈলমর্দন করার জন্য নয়, মানুষটা সত্যিই ভালোবাসেন মুসাফিরকে। মুসাফির বা বাদশাহ মিজানুরের দরবারে কোনোদিন কিছু প্রার্থনা করেননি প্যাট্রিক। শুধুমাত্র তাঁর ডাক্তারির পারিশ্রমিকটুকু বুঝে নিয়েছেন। মুসাফির সিংহাসনে অধিষ্ঠান করার পরেও প্যাট্রিকের ব্যবহারের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেননি মুসাফির। একবার কৌতূহলবশে জানতে আগ্রহী হয়েছিলেন, বাদশাহের কাছে তুমি কি ইনাম চাও প্যাট্রিক? প্যাট্রিক হেসে বলেছিলেন, এ সিংহাসনের অধিকারীকে আজীবন যত্নে রাখতে চাই। এ সুযোগ থেকে যেন বঞ্চিত না হই কখনও। মুসাফির বুঝেছিলেন, চিরকুমার ফরাসি ডাক্তারের চাহিদা বড়ই কম। নিজের উপার্জনের অর্থেই চলে যায় একলা জীবন।
.
মুসাফির ইশারায় আমির ওমরাহদের ওনার পশ্চাৎ অনুসরণ করতে নিষেধ করে প্যাট্রিকের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন। মন্ত্রী সুজান খান জানতে পারলে নিষেধ করতেন। রুদ্রনগরের নতুন বাদশাহকে পরিচালিত করার ক্ষমতা একমাত্র সুজান খানেরই আছে। তিনি হয়তো বলতেন, তাঁবু ছেড়ে বাইরে না বেরিয়ে আসতে। শত্রুরা হয়তো টের পেয়ে গেছে বিষপুরের প্রান্তের এই তাঁবুর কথা। তাই বাদশাহকে একলা পেয়ে হত্যা করার এমন সুযোগ তারা কখনোই হারাবে না। সুজান খান হয়তো ঠিক, কিন্তু ওই তাঁবুর অভ্যন্তরে দুদিন ধরে বসে থাকতে থাকতে নিজেকে বড়ই অকর্মণ্য মনে হচ্ছে। তাই প্যাট্রিক সাহেবের প্রস্তাবের অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই নয়না নদী বরাবর হাঁটতে শুরু করেছেন মুসাফির।
প্যাট্রিক প্রায় অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, নয়না নদীতে স্নান সেরে তবেই বাড়ি ফিরবে দিবাকর। আপনার সাহিলকে বলুন তাড়াতাড়ি পা চালাতে। জঙ্গলের ওপাশে নয়নার জল বড়ই স্বচ্ছ। ওখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখাবো আপনাকে। আপনি কবি মানুষ, দু-কলম রচনা করবেন অমন সৌন্দর্য দেখে। সাহিল মুসাফিরের প্রিয় ঘোড়া। দুধ সাদা আরবি সাহিলকে বড্ড ভালোবাসেন বাদশাহ।
নয়না নদীর জলে পড়েছে অস্তগামী সূর্যের আভা। নদীর ধারে একটা পুরোনো অশ্বত্থ গাছে নিজেদের ঘোড়াগুলোকে বেঁধে নদীর অভিমুখে চললেন মুসাফির আর প্যাট্রিক। মুসাফিরের চোখে প্রকৃতি দেখার বিস্ময়। প্যাট্রিক ফিসফিস করে বললেন, বাদশাহ কান পাতুন, ঘুঙুরের শব্দ শোনা যায় যে। মুসাফির থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, কাঞ্চনী? এখানে? আমাদের হারেমে তো কাঞ্চনীদের থাকার বন্দোবস্ত আছে। মাসোহারার ব্যবস্থাও করে গেছেন স্বয়ং বাদশাহ মিজানুর। তাহলে কেন এখনও বিষপুরের কাঞ্চনীদের অন্যের মনোরঞ্জন করতে হচ্ছে?
কাঞ্চনীরা নেচে, গেয়ে সকলের মনোরঞ্জন করে বেড়াবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই তাদের উপার্জনের একমাত্র পন্থা। তাই বলে পাশেই রুদ্রনগর থাকতে তাদের এমন করুণ অবস্থা কেন?
ফরাসি ডাক্তার প্যাট্রিক একটু ইতস্তত করে বললেন,কাঞ্চনী তার প্রমাণ কি? কোনো নর্তকীও তো হতে পারে? মুসাফির ফাঁকা প্রান্তর কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে বলে উঠলেন, সাহেব, এ দেশে থাকলেই এদেশীয় হওয়া যায় না। এদেশের ভাষা শিখলেও সংস্কৃতি জানা সম্ভব নয়। কাঞ্চনী আসলে কারা জানো?
প্যাট্রিক কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রইলেন মুসাফিরের দিকে।
কাঞ্চনীরা আসলে দিল্লির মুঘল দরবারের নর্তকী। নাচিয়েরা সব কাঞ্চনবর্ণা, তাই কাঞ্চনী। শুধু কাঞ্চনবর্ণ হলেই হবে না, হতে হবে অপরূপ রূপসী। তা হলেই মিলবে কাঞ্চনী দলে নাম লেখানোর ছাড়পত্র। এক সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী, কাঞ্চনীরা এমন ঝলমলে আর জমকালো পোশাক পরত, দেখে মনে হত যেন রক্তমাংসের নারী নয়, এরা সব বেহেশতের হুরি।
প্যাট্রিক বললেন, আমারও আপনাদের সভায় দু-একবার এই কাঞ্চনীদের নৃত্য দেখার সুযোগ হয়েছে। তখন দেখেছি এরা অপরূপা হন।
মুসাফির উদাসীন গলায় বললেন, সম্ভবত আকবরের আমল থেকেই দিল্লির খানদানি মহলে এদের রমরমা। প্রতি বুধবারে তাঁরা হাজির হতেন আম-খাসে, সম্রাটকে সেলাম জানাতে। এই রেওয়াজ অনেক দিনের পুরোনো। হয়তো আকবরই চালু করেছিলেন এই নিয়ম। তবে কাঞ্চনীরা ঠিক দরবারের বাঁধা নাচিয়ে নন। দরবারের বাইরেও নাচের আসর বসানোর অনুমতি ছিল এঁদের। যত্রতত্র নয়, শুধু খানদানি মহলে। এইভাবেই কাঞ্চনী প্রথা ছড়িয়ে পড়লো সারা দেশে।
আসর বসতো আমির-ওমরাহ-মনসবদারদের বাড়িতে। কাঞ্চনীরা না থাকলে শহরের রইসদের বাড়ির বিয়ে কিংবা উৎসবের জৌলুস যেন ফিকে হয়ে যেত। কাঞ্চনীরা নৃত্য করলেও এদের যথেষ্ট সম্মান দেওয়া হতো। অবশ্য এর কারণও ছিল। এই খাতিরদারির কারণটা উল্লেখ করে গিয়েছেন এক ফরাসি পর্যটক। তোমাদের দেশের লোক। নাম, ফ্রাঁসোয়া বের্নিয়ে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, কাঞ্চনবালাদের ‘দেহের গড়ন ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমন নরম ও কোমল যে নৃত্যের প্রতিটি ভঙ্গিমা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে যেন লীলায়িত হয়ে ওঠে। তাল ও মাত্রাজ্ঞানও চমৎকার। কণ্ঠের মিষ্টতাও অতুলনীয়।’ মুঘল দরবার চিরকালই গান-বাজনার সমঝদার। এমন কলাপ্রেমীদের দরবারে কাঞ্চনীদের মতো শিল্পীদের কদর তো হবেই। তবে প্যাট্রিক আরেকটা কথা, কাঞ্চনী হওয়া কিন্তু সহজ ছিল না। কারণ কাঞ্চনী দলের আইন-কানুন ছিল বড্ড কড়া। কাঞ্চনী হওয়ার প্রথম শর্ত, গেরস্থ ঘরের মেয়ে হতে হবে। ভদ্রঘরের, তবে সম্পন্ন নয় কেউই। সাধ করে কি আর কেউ কাঞ্চনী হয়! আর হ্যাঁ, একবার কাঞ্চনী হলে তার আর সংসার পাতার উপায় নেই। কাঞ্চনীরা চিরকুমারী।
.
একে ভদ্র পরিবারের, তারপরে চিরকুমারী, নাচিয়ে-গাইয়ে মহলে তাই খাতির ছিলো কাঞ্চনীদের। অবশ্য হারেমের নাচিয়ে-গাইয়েরা তাঁদের একটু অবজ্ঞার চোখেই দেখতো। কারণ, এরা যে ‘বাজারু আওরত’। অস্পৃশ্য। দশ জনের দিল বহলায়। হারেমে তবায়েফদের কোনো ঠাঁই নেই। হারেমের নাচিয়ে-গাইয়েরা শুধু জানে বাদশাহকে। তাঁদের রূপ-যৌবন-শিল্পকলা, সবকিছুর ওপর অধিকার আছে মাত্র একজন পুরুষের। তিনি বাদশাহ। বেগমদের মনও তাঁরা বহলায় বই কী, কিন্তু পুরুষ ওই একজনই। হাজার পুরুষের মনোরঞ্জন করে যারা, বেগমখানা তাঁদের ঠাঁই দিতে নারাজ। তুমি তো এ বিষয়ে যথেষ্ট অবগত তাই না প্যাট্রিক?
প্যাট্রিক হেসে বললেন, সে আর বলতে বাদশাহ! আপনাদের বেগমখানায় যখন প্রথম প্রবেশ করি তখন একখানা কালো কাপড় জড়িয়ে আমায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। যাতে কোনোদিকে নজর না দিতে পারি। তখন আমার বয়েস আরও কম। ভয়ে জিভ অবধি শুকিয়ে গিয়েছিলো। আপনার পিতার মুখেই শুনলাম বেগমখানার একজন বেগম অসুস্থ। বেগমখানায় তো সাধারণত অন্য পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমি অবশ্য তখন এত বিশদে জানতাম না।
মুসাফির বললেন, হ্যাঁ হারেমে বেগানা পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। হারেম-কন্যারা পর্দানশিন কিনা! বেগমখানার অন্দরের সাফাখানা বা বিমারখানার ভার তাই মহিলা ডাক্তারদের ওপর। এছাড়াও আছে মেয়ে ‘জারাহ’ বা শল্য চিকিৎসকরাও। তবে রোগীর অবস্থা যখন জারাহদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, তখন বাধ্য হয়েই পুরুষ হাকিমদের ডেকে পাঠাতে হয় বেগমখানায়। তুমি খুব দ্রুত বেগমদের বা বাদশাহের বিশ্বাস অর্জন করে নিয়েছিলে।
প্যাট্রিক হেসে বললেন, এতটাও সহজ ছিল না প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা। আমি তখনও এদেশের রীতিনীতির সঙ্গে পরিচিত হইনি। সবে বিদেশে ডাক্তারি পাশ করে এদেশে পাড়ি জমিয়েছিলাম। এসেই পড়েছিলাম আপনার পিতার আনুকূল্যে। তাই হয়তো আমায় অসুবিধার সমুখীন হতে হয়নি।
বেগমখানায় প্রথম পা রাখলাম আমি সেদিন। সফেদ চাদরে ঢাকা বেগম শুয়েছিলেন পালঙ্কে। আমি পালঙ্কের সামনে গিয়ে বসতেই একটা চুড়ি কঙ্কন পরা হাত বেরিয়ে এলো চাদরের ভিতর থেকে। হাত ধরে নাড়ি দেখতে গিয়ে মালুম হলো, এ হাত কোনো মহিলার নয়। এ হাত তলোয়ার চালানো দক্ষ সেনার হাত। তবুও ভয়ে কিছু না বলেই তার নাড়ি খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। পিছনে দাঁড়িয়ে দুজন হাবসি খোজা (বলপূর্বক নপুংসক বানিয়ে হারেমের পাহারায় রাখা হতো যে পুরুষ প্রহরীদের)। হাতে তলোয়ার নিয়ে উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার ঠিক পিছনে। এমন সময় বাদশাহ মিজানুর ঢাকা সরিয়ে উঠে বসে বললেন, আপনি পাশ করে গেছেন বিদেশি হাকিম। আমার বেগমেরা আপনার কাছে সুরক্ষিত। নিশ্চিন্তে আপনি আসবেন এই বেগমখানায় চিকিৎসার কারণে। সুস্থ করে তুলবেন আমার হারেমের সুন্দরীদের। আমি আজও জানি না কেন ঠিক কি কারণে সেদিন বাদশাহ আমায় পাশ মার্ক দিয়েছিলেন।
মুসাফির হেসে বললেন, বাদশাহের মর্জি বোঝা আমার কম্ম ছিলো না কোনোদিনই। ঔরসজাত হয়েও তার স্বভাব আমার মধ্যে তেমন পরিলক্ষিত হয়নি বলেই রুদ্রনগরে অনেকেরই ক্ষোভ। আমি তাঁর মত ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী নই। পারদর্শী নই যুদ্ধবিদ্যায়। এমন বাদশাহকে তারা সিংহাসনের অধিকার দিতে নারাজ ছিলো। নেহাত উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসনের অধিকার আমার তাই বসাতে বাধ্য হলো রাজ্যবাসী।
নয়না নদীর জলে টুপ করে ডুবে গেলো সূর্যটা। ওরা নিজেরাও খেয়াল করেনি কখন জঙ্গলের পথে পথে এগিয়ে এসেছে কিছুটা।
ঘুঙুরের শব্দটা আরও তীব্র হয়ে শোনা যাচ্ছে। প্যাট্রিক এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। মুসাফির বললেন, নর্তকী এই কাছে পিঠেই আছে। কিন্তু এই জঙ্গলের মধ্যে কোনো রইস আদমির বাসভবন তো দেখতে পাচ্ছি না ডাক্তার। তাহলে নাচ-গান করছে কে?