হারিয়ে যাওয়ার আগে – ৯
৯
তুমি কি আমায় একটুও বিশ্বাস করো বিদিশা? বিলিভ মি আমি রচনাকে মারিনি। ঘটনাটা ঘটেছে ভোর চারটের সময়। আমি প্রায় মাস পাঁচেক ধরে অন্য রুমে থাকি। রচনা আর ইভান একসঙ্গে থাকে। আমি রাত পর্যন্ত কাজ করে ঘুমাচ্ছিলাম, গতকাল রাতেও অবশ্যই একই ভাবে একতরফা ঝগড়া করেই ঘুমাতে গিয়েছিল রচনা। আমি দেখলাম একনাগাড়ে আমাকে অপমান করে বেশ যত্ন নিয়ে নাইটক্রিম মাখলো ও। ড্রয়িংয়ে বসে একটা পেগ বানালো নিজের জন্য, ধীরে ধীরে টিভিতে খবর দেখতে দেখতে সেটা খেলো, তারপর ইভানকে স্টাডিরুম থেকে ডেকে নিয়ে ঘুমাতে গেল। ইদানীং প্রায়ই দেখি ড্রিংক করে। আমি কিছু বলি না। বললে শুনবে না, উল্টে তোমাকে ঘিরে কিছু বাজে মন্তব্য ছুটে আসবে। তারপর আমি নিজের ঘরে গিয়ে ল্যাপটপে কাজ করে প্রায় আড়াইটে নাগাদ ঘুমিয়েছি। ভোর চারটের সময় চিৎকার আর বীভৎস শব্দে ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিলো। ঘুমের ঘোরে বুঝতেও পারিনি আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে। মাঝে মাঝেই রাস্তা দিয়ে ট্রাক বোঝাই ইয়ং ছেলেরা ভলিবল ট্রফি জিতে ফেরার সময় বেশ চিৎকার করে, থালা বাজায়। মাঝে সাজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমে ভেবেছিলাম ওরকমই কিছু। তারপর আওয়াজটা প্রায় কানের কাছে হওয়াতে কোনোমতে উঠে দেখি, রচনার অর্ধদগ্ধ দেহটা পড়ে আছে কিচেনের মেঝেতে। গ্যাসের গন্ধ নেই, রান্নাঘরের একটা অংশ তখন জ্বলছে। আমি বাথরুম থেকে দু-বালতি জল নিয়ে গিয়ে ঢেলে দিতে আগুনটা নিভলো। গ্যাসের নব বন্ধ করলাম। কিন্তু একটা অদ্ভুত জিনিস জানো বিদিশা, গ্যাসের নিচের পাইপ ঠিক ছিল। গ্যাসের পাশে একটা সস্প্যান পড়েছিলো জল সমেত। আমার দৃঢ় ধারণা ভোরে উঠে রচনা লেবু দিয়ে গরম জল খেতে চেয়েছিলো। কোনোভাবে ওর গায়ের পোশাকে আগুন ধরে গিয়েছিলো। গ্যাস থেকে আগুন ছড়ালে অত সহজে আগুন নেভানো যেত না। আমি দেরি না করে গাড়িতে তুলেছিলাম রচনাকে, তোমাকেও তখনই ফোনটা করেছিলাম। তারপরের ঘটনা তোমার জানা।
বিদিশা স্থির গলায় বলল, আমি জানি তুমি রচনাকে মারনি। তুমি মানুষ মারতে পারো না। তুমি খুনি নও সমুদ্র। আমাকে পাওয়ার জন্য তুমি তোমার সন্তানের মাকে ডিভোর্স করতে পারোনি এই দেড় বছরেও, সেখানে তুমি যে খুন করবে না সেটা আমি জানি। আমাকে বিশ্বাস করানোর দরকার নেই। যা বলার পুলিশকে বলবে। সমস্যাটা কোথায় জানো? কোনো আই উইটনেস নেই।
তবে সমুদ্র, ভেঙে পড় না। এই সময় তোমায় স্টেডি থাকতে হবে।
সমুদ্র নরম ক্লান্ত গলায় বললো, ইভান কোথায় বিদিশা? রচনাকে ছাড়া ওকে কিভাবে মানুষ করবো আমি?
বিদিশা গম্ভীর গলায় বললো, ইভান আমার ফ্ল্যাটে আছে, বোনের, মায়ের দায়িত্বে। তুমি টেনশন করো না, ও ঠিক আছে, আমি বলেছি, মাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মা ঠিক হয়ে যাবে।
সমুদ্র বললো, না বিদিশা ও বোধহয় জানে ওর মা আর নেই। আমার দিকে কেমন একটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। ওর দৃষ্টিটা আমার জাস্ট সহ্য হচ্ছিল না। ও কি আমায় অপরাধী মনে করছে ওর মায়ের মৃত্যুর জন্য? তাহলে আমি কোথায় যাই বিদিশা? বিদিশা শান্ত গলায় বলল, আপাতত ইভানকে নিয়ে না ভেবে নিজেকে কি করে বাঁচাবে সেটা ভাবো প্লিজ। রচনা কোনো সুইসাইড নোট রেখে যায়নি তো? দেখেছো ঘরে?
সমুদ্র বললো, সুইসাইড? তুমি ভাবছো ও সুইসাইড করেছে? অসম্ভব। তুমি জানো না বিদিশা ও নিজেকে কতটা ভালোবাসে, ও এটা করতেই পারে না। এটা অ্যাক্সিডেন্ট। দিনরাত রূপচর্চা করছে, গয়না কিনছে, জিমে যাচ্ছে, শাড়ি থেকে ওয়েস্টার্ন এসব নিয়েই তো আছে। চোখের নিচে ফাইন লাইন এলে যার মাথা খারাপ হয়ে যায়, সে নিজের মহামূল্যবান শরীরটা পুড়িয়ে ফেলবে? এটা আমি অন্তত বিশ্বাস করি না।
আমার যেটা মনে হয়, ও ওয়াকে যাবে বলে রেডি হচ্ছিল, তার আগে গরম জল খাবার জন্য রান্নাঘরে গিয়েছিল। সাধারণত ও বেশি ড্রিংক করে না, কাল একটু ডিস্টার্বড ছিল মনে হল, তাই একটু বেশিই খেয়েছিল বোধহয়। সেই হ্যাংওভার কাটাতেই লেবুজল খেতে গিয়েছিলো, তখনই বেখেয়ালে গায়ের চাদরটা হয়তো গ্যাসের বার্নারে পড়ে যায়। বেশিরভাগ সময় তো বাড়িতে সাটিনের নাইটি টাইপ পরে থাকে, তাই সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে গেছে আর সুযোগ পায়নি সেটা খুলে ফেলার।
বিদিশা একটু চুপ করে থেকে বললো, সেটা কতটা সত্যি পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলবে। তোমার মুখের কথা আমি বিশ্বাস করলেও পুলিশ করবে না। সবাই বিদিশা নয়, যে যেচে এসব সমস্যায় জড়াবে। সমুদ্র কাতর গলায় বললো, যদি আমার জেল হয়, ইভানকে একটু দেখো প্লিজ। আর শোনো, এই তিনটে আমার এটিএম কার্ড, পাসওয়ার্ডগুলো লিখে নাও। ইভানের যে কোনো দরকারে তুমি নিশ্চিন্তে টাকা তুলে খরচ করবে।
বিদিশা দেখছিলো সেই অফিসের মিটিংয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখা গম্ভীর মানুষটাকে। স্খলিত গলার স্বর, বিধস্ত চোখের দৃষ্টি, যেন বড্ড অচেনা এই মানুষটা।
দেখেই বুকের ভিতরটা গুমরে উঠলো ওর।
শান্ত গলায় বলল, তোমায় এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না। লিডারকে এমন ভেঙে পড়তে দেখলে সাধারণ সদস্যরা জোর পাবে কোথা থেকে? চিন্তা করো না, আমি সামলে নেবো। আজ অফিসে মেইল করে দিয়েছি, রাহুল সামলে নেবে মিটিংগুলো।
সমুদ্রকে বেশ কিছুক্ষণ জেরার পরে ছেড়ে দিলো অফিসার। তবে বলে দিলো, যেন কলকাতা ছেড়ে না যায় কোথাও এই মুহূর্তে। রচনার বডি পেতে পেতে আগামী কাল হয়ে যাবে জানিয়ে দিল থানা থেকেই। প্রায় বিধস্ত সমুদ্র কোনোমতে গাড়িতে উঠলো। বিদিশা ওর হাতটা ধরে বললো, এসব মিটে গেলে আমি সরে যাবো তোমার জীবন থেকে। এখন এই বিপদের মুহূর্তে ছেড়ে দিই কি করে?
সমুদ্র বিদিশার ঘাড়ে মাথা রাখতেই ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনতা জল। বিদিশা পরম যত্নে ওড়নার প্রান্ত দিয়ে মুছিয়ে দিলো জলটা। তারপর ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলো, কোনো একটা রেস্টুরেন্টে দাঁড়াবেন। নরম গলায় বলল, সমুদ্র ক্ষিদে পায়নি তোমার?
সমুদ্র ঘাড় নেড়ে বললো, মনে ছিল না এতক্ষণ, তুমি বললে বলে মনে পড়লো।
বিদিশা নিজের পার্স থেকে সমুদ্রর এটিএম কার্ড তিনটে ফেরত দিয়ে বললো, যদি কখনো দরকার হয়, চেয়ে নেব। আপাতত আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে টাকা নামক অহংকারী বস্তুটাকে প্রবেশ করার অধিকার দিতে চাইছি না আমি। ও থাকুক ওর দাম্ভিকতা নিয়ে, আমি থাকি বিপদে তোমার পাশে। এটুকুই মনের তৃপ্তি আমার সমুদ্র। নাহলে রচনা তো কবেই আমায় কেপ্ট বলে ভূষিত করে গেছে। আফসোস কি জানো, রচনাকে বোঝানো হলো না, ওর সংসার ভাঙতে আমি আসিনি। আমিও ভুল করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওর ঘরের মানুষটাকে। কিন্তু তাকে নিয়ে সংসার গড়ার কথা আমি ভাবিনি। রচনা আমায় খুব খারাপ ভেবেই চলে গেলো সমুদ্র, ওকে বোঝানো হলো না, অর্থের বাইরেও বন্ধুত্ব হয়। ওকে জানানো হলো না, ওর স্বামী ওকে ডিভোর্স দিয়ে অন্যের সঙ্গে সংসার করতে চায়নি। ওকে জানানো হলো না, ওর স্বামী এখনো অবধি আমার কুমারীত্ব নষ্ট করেনি। কত কি বলা বাকি থেকে গেলো সমুদ্র!
কে জানে রচনা আমার কারণে চলে গেলো কিনা! যদি তাই হয় ইভানের সামনে দাঁড়াবো কি করে! কথাগুলো বলতে বলতেই ঘাড়ের কাছে একটা ঘন নিঃশ্বাসের আওয়াজ পেলো বিদিশা। তাকিয়ে দেখলো, ওর কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সমুদ্র। বড্ড ক্লান্ত লাগছে ওকে। কতদিন নির্ঘুম আছে কে জানে মানুষটা! বাড়িতে রচনার বাক্যবানে বিদ্ধ হয়ে যখনই ওর কাছে একটু আশ্রয় খুঁজতে এসেছে, তখনই বিদিশাও তিনহাত সরে গিয়ে বলেছে, আমি তোমার কেউ নই, চলে যাও। মানুষটা করুণ চোখে তাকিয়ে ধীরে ধীরে সরে গেছে।
এই কয়েকমাস তো একটু দূরেই ছিল সমুদ্র। বড্ড নির্লিপ্ত যেন। গতকাল সন্ধেতেই একটু অবাধ্য হয়ে এসেছিলো বিদিশার সামনে। ওর হাতের মুঠোতে দিতে চেয়েছিলো ভিজে গোলাপের পাপড়ি, সেটুকুও নেয়নি বিদিশা। ফিরিয়ে দিয়েছে, আঘাত করেছে নির্মমভাবে। সমুদ্র শুধু অস্ফুটে বলেছিলো, আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাস, সে তুমি যতই দূরে সরিয়ে রাখো না আমায়! বিদিশা জানে জোর করে দূরে সরে গেলেও ওরা একে অপরকে চেনে, ভীষণভাবে চেনে। দুজনের ওয়েভলেংথ বড্ড ম্যাচ করে যে। তাই তো যে সময়ে বিদিশার সব থেকে দূরত্ব বজায় রাখার কথা সেই সময়েই ও ছুটে এসেছে সমুদ্রের পাশে। হয়তো এই নিয়ে সকলের মনেই একটা প্রশ্ন উঠবে, সমুদ্র চৌধুরী শুধুই কি বিদিশার বস? নাকি আরও একটু…
বিদিশার সঙ্গে সমুদ্রের অবৈধ সম্পর্কের জেরেই রচনা এমন করলো না তো? এই অতি কমন প্রশ্নগুলো যে কমপ্লেক্সে উঠবে সেটা বুঝেও বিদিশা একা ছাড়তে পারেনি বিধস্ত মানুষটাকে। হ্যাঁ, সমুদ্র ঠিকই বোঝে, বিদিশা ওকে ভালোবাসে, নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়েছে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। বিদিশা খুব নরম গলায় ডাকলো, সমুদ্র… সমুদ্র….
ধড়ফড় করে উঠে সমুদ্র বললো, বিশ্বাস করো সবাই, আমি মারিনি রচনাকে।
বিদিশা ওকে শান্ত করে বললো, নামো, চলো আমরা খেয়ে নেবো। বাধ্য ছেলের মত বিদিশাকে যেন আঁকড়ে ধরেছে সমুদ্র। ওর কথাতে টুকটুক করে গিয়ে বসল রেস্টুরেন্টে।