হারিয়ে যাওয়ার আগে – ১০
১০
মা, বাবাকে একটা কল করে জানালে হতো না বিষয়টা?
শ্রেয়া খাবার পরে টেবিল পরিষ্কার করতে করতে বললো, না, থাক। তোর বাবা একটা প্রয়োজনে পুনে গেছে। তাকে নিশ্চিন্ত মনে কাজটা করতে দে। এসব কথা বলে বিভ্রান্ত করে লাভ নেই। এমনিতেই মানুষটা ইদানীং বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছে। চাপা স্বভাবের বলে ভিতরের কথা জানতেও পারি না। ঈশা একটু দ্বিধা জড়িত গলায় বললো, মা তুমি তো দিদিকে বারণ করতে পারতে, থানায় না যেতে। ইভানের দায়িত্ব কদিনের জন্য নিলো সেটাই তো বসের প্রতি, কোম্পানির প্রতি যথেষ্ট দায়িত্ব দেখানো হয়, তাই না?
এই রকম কনফিউসিং কেসে দিদির জড়ানোটা উচিত নয় মা। শ্রেয়া বেসিনে হাতটা ধুয়ে এসে বলল, তার মানে আমার সন্দেহই ঠিক। তোর মনেও যখন প্রশ্নটা এসেছে তখন পুরো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমিও শুনেছি সমুদ্র চৌধুরীর সঙ্গে যখন কথা বলে বিদিশা তখন কেমন যেন হাস্কি গলায় কথা বলে। ঠিক বুঝতে পারিনি। এখন ওনার স্ত্রী মারা যেতে বিদিশার তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা বোধহয় জালে জড়িয়েছে। বিদিশা বরাবরই বড্ড সফট রে। মুখে যতই কঠিন হোক, ভিতরে ও ভীষণ নরম। আমি তো মা, আমি ওকে চিনি।
নিশ্চয়ই ওর থেকে বছর পনেরোর বড় মানুষটার জালে জড়িয়েছে ও। এসব বড়লোকদের তো চরিত্রের ঠিক নেই রে। ঈশা মায়ের কথা শুনে বললো, মা আগেই কাউকে দোষারোপ না করে তুমি বরং দিদিভাই ফিরলে ওর সঙ্গে আলাদা বসে কথা বলো। আসলে আমার ভয় অন্য কারণে, একবার যদি কমপ্লেক্সে ওর নামে বদনাম রটে যায় তাহলে আমাদের এখানে বাস করা মুশকিল হয়ে যাবে। যতই দূর থেকে লোকে ভাবুক মহানগরের ব্যস্ততম জায়গার এই আকাশচুম্বী হাইরাইজের কানে তুলো ঠাসা থাকে, আদপে তা নয়। মুখরোচক খবর এদিক ওদিক করার জন্য এই কমপ্লেক্সেও কয়েকজন আছে। যারা দায়িত্ব নিয়ে বিকেলে ছেলেদের পার্কে খেলতে দিয়ে নিজেদের এই আলোচনায় মাতিয়ে রাখে। তাই কেউ কারোর খোঁজ রাখে না কথাটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়। হয়তো প্রয়োজনে তুমি কাউকে পাবে না, কিন্তু অপবাদ ঠিক আগুনের গতিতে ছড়িয়ে পড়বে ব্যস্ত ফ্ল্যাটের অন্দরমহলে। তাই তুমি দিদিভাই ফিরলেই একটু কথা বলো মা। ও যেন সমুদ্র চৌধুরীর সঙ্গে এ ব্যাপারে বেশি ইনভলভড না হয়।
শ্রেয়া চিন্তিত স্বরে বললো, দেখি ফিরুক। হ্যাঁ রে, ইভান কি জানে ওর মা আর নেই?
ইস, কতটুকু ছেলে মা হীন হলো বলতো। ছেলেটার চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কেমন একটা উদাস চাউনি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কিছু যেন খুঁজছে, কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। ঈশা শান্ত স্বরে বললো, খুব বাচ্চা তো নয় মা। ক্লাস সিক্সের স্টুডেন্ট। এখনকার বাচ্চারা এনাফ ম্যাচিওরড হয়। তাই আমার ধারণা ও কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে। আমাকে জিজ্ঞেস করছিলো, বাবা কি কল করেছিলো? মা কি ঠিক আছে? বেঁচে আছে মা?
তার মানে ওর মনের মধ্যে কোথাও একটা সন্দেহ তৈরি হয়েইছে। বুঝলে মা, রচনা চৌধুরী যদি কোনো নোট রেখে যায় তাহলে সমুদ্র চৌধুরী তো ফাঁসবেই সঙ্গে দিদিভাইও। আমার এটাই ঘুরছে সেই থেকে মাথায়। দিদিভাইটা কেন যে এত ইমোশনাল!
শ্রেয়া মেয়ের মাথায় হালকা হাত বুলিয়ে বললো, তোরা দুই বোনেই ইমোশনাল। তাই আমার বিপদের শেষ নেই ।
হ্যাঁ রে ঈশা, রচনা কি সুইসাইড করলো, নাকি সমুদ্র ওকে মেরে দিলো!
ঈশা বললো, আঃ মা, প্লিজ। নেগেটিভ কথা বলো না তো। অ্যাক্সিডেন্টও হতে পারে। দিদিভাই থানা থেকে ফিরলে বিষয়টা ক্লিয়ার হবে। তবে প্রান্তিক বলছিলো, সিউকিউরিটি আর পুলিশ নাকি বলেছে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কাউকে কমপ্লেক্সের বাইরে যেতে দেবে না।
.
বেলটা বাজতেই ঈশা ছুটে গিয়ে দরজা খুলল। বিদিশা প্রায় টলতে টলতে ঢুকলো বাড়িতে। রক্তাক্ত দুটো চোখ, ভীষণ ক্লান্তিতে যেন জড়িয়ে আসতে চাইছে।
বিদিশা ঠোঁটটা নেড়ে কিছু বলার আগেই ঈশা বললো, দিদিভাই, ইভান লাঞ্চ করে ঘুমিয়ে গেছে। তুই লাঞ্চ করেছিস? বিদিশা ঘাড় নাড়তে ঈশা বললো, আমি বাথরুমে তোর টাওয়েল আর নাইটি রেখে এসেছি, তুই আগে ফ্রেস হয়ে নে। টেক এ ওয়ার্ম বাথ, দেখ ফ্রেস লাগবে। বিদিশা করুণ হেসে বললো, মা সেই ঈশা কত দায়িত্ববান হয়ে গেছে গো। আমি অকারণেই বকি ওকে।
বিদিশা ক্লান্ত পায়ে ঢুকলো বাথরুমে। ঈশা তাকিয়েছিলো ওর সব থেকে আপন মানুষটার দিকে। বড্ড বদলে গিয়েছিলো মানুষটা, আবার যেন আজ বহুদিন পরে দিদিভাইয়ের গলায় সেই পুরোনো সুরের অনুরণন শুনতে পেলো ঈশা। মনটা খুশিতে ভরে গেলো ওর। মনে মনে বললো, তুই আমায় অনেক বকিস দিদিভাই শুধু দূরে সরিয়ে দিস না। তোর থেকে দূরে সরে গেলে যে আমিও বাঁচবো না রে। বড্ড কষ্ট হয় তোর অমন নির্লিপ্ত ব্যবহারে।
বিদিশা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই বললো, ঈশা চল, ইভানের কাছে যেতে হবে। ওকে জানাতে হবে সত্যিটা।
ঈশা আমূল কেঁপে উঠে বললো, কিন্তু দিদিভাই এটা খুব শক্ত কাজ রে। তুই এটা ওর বাবার ওপরে ছেড়ে দিলেই ভালো করতিস। মানে আমি বলতে চাইছি ওর নিজের, কাছের কারোর কাছ থেকে এমন ভয়ঙ্কর খবরটা শুনলে ছেলেটা হয়তো তার বুকে মাথা রেখে কাঁদতেও পারবে। কিন্তু আমরা তো ওর কাছে ভীষণ নতুন। সেভাবে পরিচয়ও ছিল না। বরং আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের গাবলুটা দিনে তিনবার বেল বাজায় আমাদের দরজায়। মায়ের কাছে এসে এটা ওটা চেয়ে খায়। আমার সঙ্গে কম্পিউটার গেমের গল্প জোড়ে। তাই গাবলু অন্তত সেই ছোট থেকে আমাদের আপনভাবে। কিন্তু ইভান তো আজ ফার্স্ট টাইম আমাদের দেখলো। এমনিতেই ভীষণ রকমের আড়ষ্ট হয়েছিলো লাঞ্চের টাইমে। একেবারে চুপচাপ খেয়ে নিলো। আমি আর মা ওর স্কুলের গল্প, ফ্রেন্ডদের গল্প করার কত চেষ্টা করলাম। টুকটাক উত্তর দিলো, তারপর চুপ। বাড়িতে ঢোকার পরে তাও একটু প্রাণবন্ত ছিল জানিস, আমার সঙ্গে গেম খেলছিল, গল্প করছিল, যত সময় যাচ্ছিল ততই চুপ হয়ে যাচ্ছিল। আসলে কি বলতো একেবারে লোয়ারের বাচ্চাতো নয়, এখনকার ক্লাস সিক্সের ছেলেমেয়েরা অনেক ম্যাচিওর্ড হয় রে। তাই বলছি আমরা বলতে গেলে যদি হিতে বিপরীত হয়, তখন?
বিদিশা একটু চিন্তা করে বললো, তুই যেটা বলছিস একেবারে পারফেক্ট বলছিস। কিন্তু সমস্যাটা কি বলতো, ওর ইঁচড়ে পক্ক মামাটা সমুদ্রর নামে কেস ফাইল করিয়েছে কাউকে দিয়ে, ওই দূর থেকেই। সে এসে পৌঁছানোর আগেই ইভানকে একটু বুঝিয়ে বলতে হবে। বাবা-ছেলের তেমন বন্ডিং নেই রে। বাবা দিনরাত টাকার পিছনে ছুটছে, বেশিরভাগ দিনই ছেলে ঘুমিয়ে পড়ার পরে ফিরতো সমুদ্র। ওই হয়তো স্কুল বাসে মাঝে মধ্যে পৌঁছে দেওয়া বা রেয়ার একটা ছুটির দিনে ছেলের সঙ্গে একটু টাইম স্পেন্ড করা ছাড়া সময় কোথায় সমুদ্রর!
ঈশা লক্ষ্য করলো, দিদিভাই সমুদ্র চৌধুরী বা স্যার অথবা বস কিছুই ব্যবহার করল না। শুধু সমুদ্র বলেই সম্বোধন করছে।
বিদিশা বললো, তাছাড়া এ ব্যাপারে আমি সমুদ্রকে একেবারেই ভরসা করি না। হয়তো এমন ভাবে রচনার চলে যাওয়াটা ব্যাখ্যা করলো যে ছেলেটা ট্রমা কাটিয়ে উঠতেই পারলো না। আসলে ইভানের সব কিছু দেখাশোনা করতো রচনা নিজেই। তাই মা’র চলে যাওয়াটা যে কতটা কষ্টের হবে ইভানের পক্ষে সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি। না রে ঈশা, এই খবরটা একটু অন্যরকমভাবে আমাকেই দিতে হবে ইভানকে।
ঈশা একটু অন্যমনস্কভাবে বললো, সব মিটে গেলে সমুদ্রবাবুর আরেকটা বিয়ে করা উচিত, অন্তত ইভানের কথা ভেবে। আর ভদ্রলোকের বয়েস কত হবে, এই বছর চল্লিশ- বিয়াল্লিশের বেশি তো নয়। এখন তো ছেলেরা এমনিতেই থার্টি ফাইভের পরে বিয়ে করছে, তাই না?
ঈশা লক্ষ্য করলো, দিদিভাই একটু যেন সংকুচিত হয়ে বলল, এসব কথা এখন থাক। আগে প্রমান হোক এটা অ্যাক্সিডেন্ট, সুইসাইড বা মার্ডার নয়, তারপর তো সমুদ্র ভাববে অন্য কিছু নিয়ে। এখন চল ঈশা, ইভানের সঙ্গে কথা বলি। ঈশা বললো, দাঁড়া ফ্রিজে চকলেট আছে, আমার এক কাস্টমার সেদিন পাঠিয়েছিল। ওটা নিয়ে যাই ইভানের জন্য।
বিদিশা হেসে বললো, বড্ড বড় হয়ে গেলি তুই ঈশা। কত বুদ্ধি হয়েছে তোর। সেই আমার ছোট্ট বোনটা। রাত্রে টয়লেট করতে গেলেও আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো বাথরুমের সামনে। সেই মেয়েটা এখন রীতিমত পরিণত বুদ্ধির অধিকারিণী। ঈশা বললো, সমুদ্রবাবু কোথায় রে দিদিভাই? বিদিশা অন্যমনস্কভাবে বললো, নিজের ফ্ল্যাটেই গেলো। আমি বলেছিলাম, এখানে আসতে, শুনলো না। বললো, ইভানের দায়িত্ব নিয়েছ তুমি, আমারটা আমাকেই সামলাতে দাও।
চকলেটটা হাতে নিয়ে বিদিশা ঢুকলো ইভানের ঘরে।
ইভান সিলিঙের দিকে তাকিয়ে আছে নিস্পলক। চোখের কোনে ভিজে জলের রেখা। বিদিশা গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বললো, ইভান, তোমাকে ঈশা আন্টি খেলতে নিয়েছিলো তো, নাকি তোমার সঙ্গে খেলে নি? আমায় বলো দেখি, আমি তাহলে ঈশাকে খুব বকে দেব। ইভান ধড়ফড় করে উঠে বসে বললো, আন্টি, মা কেমন আছে? বাবা কোথায়?
বিদিশা ইভানের হাতে চকলেটটা দিয়ে বললো, এটা খাও ইভান। জানো ইভান, আমরা না কেউ এই পৃথিবীর মাটিতে জন্মাতাম না যদি ভগবান আমাদের না পাঠাতো স্বর্গ থেকে। ভগবান আমাদের স্বর্গ থেকে পাঠালেন তাই আমরা পৃথিবীর মাটিতে এসে পৌঁছালাম। আমাদের আসল ঘর তো স্বর্গে। যদিও ভগবান কখনো কোনো খারাপ মানুষকে আর পৃথিবী থেকে স্বর্গে নিয়ে যান না। আসলে ওটা তো হেভেন, তাই ওখানে কোনো পচা লোকের আর ঢোকা বারণ থাকে। একমাত্র গড যাকে ভীষণ ভালোবাসেন তাকেই নিয়ে যান হেভেনে। ওখানে চারিদিকে সুন্দর ফুলবাগান, ধূপের গন্ধ, সবুজ মাঠ, ঝর্ণা, পাহাড় সে যেন ঠিক ছবির মত জায়গা। ইভান একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, সুইজারল্যান্ডের মত? আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন আমরা গিয়েছিলাম সুইজারল্যান্ড। একেবারে ক্যালেন্ডারের ছবির মত জানো আন্টি। মা আর আমি অনেক ছবি তুলেছিলাম। ল্যাপটপে আছে সব, আমি তোমায় দেখাবো। ঈশা দেখছিলো ইভানের চোখ দুটো একটু উদাসীন হলো। হয়তো হলিডের সুন্দর স্মৃতির কথা মনে পড়ছে ওর। বাবা মায়ের সঙ্গে থাকার একটুকরো মুহূর্তকে স্মরণ করে ওর ঠোঁটের কোণে ফুটেছে খুশি আর বিষণ্ণতা মেশানো হাসির রেশ। বিদিশা ওকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বললো, হ্যাঁ ইভান ঠিক ক্যালেন্ডারের ছবির মত সুন্দর জায়গা হলো হেভেন। তো ভগবান কি করে জানো? সে শুধু তার পছন্দের মানুষকে তার কাছে ওই দারুণ সুন্দর স্বর্গপুরীতে ডেকে নেয়। ইভান চোখ বড় বড় করে বললো, ওখানে তো পলিউশন নেই, কোনো ডিজিজ নেই তাই না? ওখানে শুধু খাও দাও আর আনন্দ করো।
বিদিশা বললো, ইভান তুমি তো দেখছি সব জানো, ভীষণ ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। তো গড হঠাৎ আমাদের এই সন্ধ্যাতারা হাইরাজের মাথার ওপর দিয়ে আকাশপথে যেতে যেতে দেখছিলেন, এখানে সব চেয়ে সুন্দর, খুব মিষ্টি মানুষটা কে আছে! যদি কেউ থাকে তাহলে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে স্বর্গপুরীতে। ইভান অবাক হয়ে বলল, গড কি রাত্রে বেরোয়?
ঈশা বললো, হ্যাঁ ন্যাচরালি রাত্রেই বেরোয়। যাতে আমরা কেউ বায়না না করতে পারি। আমরা তো ভগবানকে দেখলেই সবাই হাত তুলে বলবো, আমাকেও নিয়ে চলো তোমার সঙ্গে, প্লিজ গড। তখন তো ভগবান পড়বে বিপদে। স্বর্গে তো পৃথিবীর মত এত জায়গা নেই, সেখানে শুধু ভালো মনের মানুষদেরই নিয়ে যায়। এই যেমন ধরো যারা খুব সুন্দর গান গাইতে পারে তাদের। আমিও তো কাল রাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখলাম, গড একটা রথে চেপে ঘুরছে আমাদের কমপ্লেক্সের চারিদিকে। আমি কত ডাকলাম, প্লিজ আমায় একবার নিয়ে চলো, সে শুনলোই না। বললো তুমি গান গাইতে পারো না, তাই তোমায় নিয়ে যাবো না।
ইভান বললো, তুমি দেখলে গডকে? ইস, আমি দেখতে পেলাম না।
বিদিশা বললো, হ্যাঁ তো, গড সব ফ্ল্যাটের জানালায় উঁকি দিয়ে দেখতে দেখতে একজনকে পছন্দ করে ফেললো। ভাবলো, এই মিষ্টি মানুষটাকেই নিয়ে যাওয়া উচিত স্বর্গপুরীর মত সুন্দর জায়গায়। তাই তাকে নিয়ে চলে গেলো। ইভান কৌতূহলী হয়ে বলল, কাকে নিয়ে গেলো আন্টি?
বিদিশার গলাটা একটু কেঁপে উঠলো যেন, ইভানের চোখের দিকে থেকে চোখ সরিয়ে বললো, তোমার মাকে। রচনা চৌধুরীকেই গডের খুব পছন্দ হয়ে গেল। তাই তাকে আজ ভোরে নিয়ে চলে গেলো তার কাছে। ইভান একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে বললো, কবে ফিরিয়ে দেবে? আমি তো মাকে ছাড়া থাকতে পারি না আন্টি!
ঈশার চোখ দুটো অবাধ্য হয়ে উঠেছে, ইভানের সামনে কিছুতেই কাঁদবে না বলেই সমানে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে আটকে রেখেছে চোখের জলটাকে। ঈশা এত বড় মেয়ে হয়েও ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে মাকে দেখতে না পেলে মাথা খারাপ হয়ে যায়, কথায় কথায় মাকে ডেকে ডেকে পাগল করে দেয়, সেখানে এইটুকু ছেলে থাকবে কি করে মাকে ছাড়া! ভেবেই কান্না পাচ্ছে ওর।
বিদিশা খুব শান্ত গলায় বলল, দেবে তো। তুমি আরেকটু বড় হয়ে গেলেই ফিরিয়ে দেবে তোমার মাকে। এই কদিন তোমাকে খুব ভালো ছেলে হয়ে থাকতে হবে, খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে, তবেই গড আবার তোমার মাকে ফিরিয়ে দেবে। ইভান চোখটা ছলছল করে বললো, কিন্তু আমার তো মন খারাপ করছে মায়ের জন্য।
বিদিশা বললো, ওমা, মন খারাপ কেন করছে? মা তো সব চেয়ে মিষ্টি বলে গড তার সুন্দর দেশে মাকে ঘুরতে নিয়ে গেছে। ইভান বললো, আমায় কেন নিয়ে গেলো না, আমিও তো মায়ের পাশেই ছিলাম। তাহলে?
ঈশা বললো, এ বাবা সেটা কি করে হবে? তাহলে তোমার স্কুল, কোচিং, ক্যারাটে, ড্রয়িং এসব কি করে হবে? সব ক্লাস বাঙ্ক হয়ে যাবে! বন্ধুরা সেভেনে উঠে যাবে আর তুমি সিক্সেই থেকে যাবে। ইভান ঘাড় নেড়ে বললো, সেটা অবশ্য ঠিক। তার মানে মার যেহেতু পড়াশনা কমপ্লিট হয়ে গেছে, মা যেহেতু গান করতে পারে, মাকে দেখতেও সব থেকে মিষ্টি তাই মাকেই নিয়ে গেছে তাই না আন্টি?
বিদিশা বললো, হ্যাঁ সেটাই তো। তবে ইভান এই ছোট্ট সিক্রেটটা শুধু তুমি, আমি আর এই ঈশা আন্টি জানবো, অন্য কেউ কিন্তু জানে না। স্কুলে, কমপ্লেক্সের বন্ধুরা সবাই কিন্তু তোমায় বলবে, তোর মা তো মরে গেছে। আর ফিরবে না। তোর মা পুড়ে গিয়ে মারা গেছে…
এসব ভুলভাল কথা সবাই বলবে, কিন্তু আসল সিক্রেটটা তো তুমি জানো, তাই ওদের কথাতে কিছু মনে করো না। সবাই তো তোমার মত এত ব্রিলিয়ান্ট নয়, তারা হয়তো স্বর্গপুরী কেমন হয়, সেখানে কে কে থাকে এসব জানেই না। সুতরাং বুঝতেই পারছো বোকারা কি বললো, সেটার কোনো দাম নেই। তাই তুমি আমি আর ঈশা আন্টি এই তিনজনেই কিন্তু জানলাম আসল কথাটা। ইভান একটু থমকে গিয়ে বললো, আর বাবা? বাবা জানে? বাবার সঙ্গে তো মায়ের রোজ ঝগড়া হতো, বাবা বলতো আর পারছি না রচনা, এবারে রেহাই দাও। তুমি তো যা চাও আমি দিয়ে দিই, এবারে ছেড়ে দাও আমায়!
বিদিশা আন্টি, তুমি বুঝি বাবার বন্ধু? বাবা বলতো, বিদিশা আমার বন্ধু রচনা, আর কিছু নয়। মা রেগে গিয়ে বলতো, টাকা বেশি থাকলে এমন বন্ধুরা আসে বৈকি।
বিদিশা আর ঈশা চোখ চাওয়াচাওয়ি করলো। বিদিশা সামলে নিয়ে বললো, ওসব বড়দের ঝগড়া ইভান, ওসব তোমায় মনে রাখতে নেই। বাবা তোমায় খুব ভালোবাসে। তোমার বাবা হয়তো তোমায় সময় বেশি দিতে পারে না, কিন্তু খুব ভালোবাসে তোমায়। আমায় কত বলে তোমার কথা। ইভান দারুণ আঁকে, ইভান খুব ভালো ছেলে, সব কথা শোনে, এত সব প্রশংসা করে তোমার বাবা তোমার নামে। ইভানের চোখ দুটো চকচক করে উঠলো, ও বললো সত্যি? বাবা আমার প্রশংসা করে আন্টি?
বিদিশা ঘাড় নেড়ে বললো, খুব করে। বাবাও জানে তোমার মাকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই তো বাবার মন খারাপ হলেও চুপ করে আছে। ইভান বললো, আমি তো আছি। আমি বাবার মন খারাপ ভালো করে দেব। মা ফিরে দেখবে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।
ইভানের দু-চোখ দিয়ে আবার জল গড়িয়ে পড়লো, ফিসফিস করে বললো, মা আমি মিস করছি তোমায়, তাড়াতাড়ি স্বর্গপুরী ঘুরে ফিরে এসো আমার কাছে। প্লিজ মা, তাড়াতাড়ি ট্যুরটা শেষ করো।
বিদিশা পাশের ঘরে গিয়ে সমুদ্রকে ফোন করে বললো, ইভানের তোমায় দরকার এখন। আমি ওকে বলেছি ওর মাকে গড স্বর্গে নিয়ে গেছে, তুমিও ওটাই বলো। আর ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর একাকীত্বটাকে একটু কমানোর চেষ্টা করো সমুদ্র। ইভান বড্ড ভালো ছেলে।
সমুদ্র ধীর গলায় বললো, আমি আসছি ওকে নিতে।