হারিয়ে যাওয়ার আগে – ১৩
১৩
নিজের হাতটা প্রান্তিকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ঈশা বললো, পরিয়ে দাও।
প্রান্তিকের দেওয়া ছোট্ট বক্সটাতে ছিল একটা সোনার এনগেজমেন্ট রিং আর একটা চিঠি। সকালে ঈশা চিঠিটা খুলতে গিয়ে প্রথমেই দেখেছিলো সম্বোধনের জায়গায় বার দুই কাটা, অবশেষে প্রান্তিক লিখেছে,
আমার একলা আকাশের তারা,
প্রথম দর্শনে প্রেমে আমিও বিশ্বাসী ছিলাম না। কিন্তু আমার জানা হিসেব উল্টেপাল্টে গেল যেদিন প্রথম এই ফ্ল্যাটে তোমায় দেখলাম। বুঝতে পারলাম, ডেস্টিনি যাই হোক, আমাকে কিনতেই হবে এই ফ্ল্যাটটা। নাহলে ওই মুখটা আমি দেখতে পাবো না। একে ভালোবাসা বললে কি অন্যায় বলা হবে ঈশা? বেশ মেনে নিলাম তর্কের খাতিরে এটা ভালো লাগা। তারপর যেদিন তুমি সুপর্ণার বিয়েতে গেলে আমার সঙ্গে, আর বললে তোমার ক্রাশের সঙ্গে আমার দেখা করাবে সেই মুহূর্ত থেকে বিয়েবাড়ির আলো, কলিগদের মজা সব ফিকে হয়ে গেলো আমার কাছে। ভাবলাম, এটা হয়তো রিজেক্ট হবার ব্যর্থতা। মেনেই নিলাম না হয়। তারপর যখন জানলাম তোমার ক্রাশ আমি, তখন তারায় ভরা আকাশের বুকে খুঁজতে চেয়েছিলাম অরুন্ধতী, নীহারিকাদের মুখ, কিন্তু আমার গোটা দৃষ্টিপথ জুড়ে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিলে শুধু তুমি। যতবার প্রশ্ন করেছি আকাশকে ততবার সে আকাশগঙ্গা জুড়ে প্রকট করেছে তোমার থুতনির তিলটা, ঠোঁট কামড়ে ওই দুষ্টু হাসিটাকে। আর তোমার বাঙময় চোখ দুটোকে। আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি। মনের সঙ্গে সব দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে জয়ী হয়েছে আমার ভালোবাসা। তাই আজ আমি অকপটে বলতে পারি, আমি ভালোবাসি তোমায়। এই আংটিটা পাঠালাম, কারণ আমি বড্ড পজেসিভ লাভার, আমি চাই আমি সবসময় থাকি তোমার সঙ্গে। তোমার অনামিকায় নয় তর্জনীতেই থাকতে চাই। হ্যাঁ ঠিক ধরেছ, তোমার শাসনেই রেখো আমায়। তোমার অঙ্গুলিহেলনে পাল্টে ফেল আমার এলোমেলো স্বভাবগুলোকে, নিজের মত করে গুছিয়ে নিও ঈশা, প্লিজ কখনো মিথ্যে বোলো না আমায়। মিথ্যে কথাকে আমি বড্ড ভয় করি। মিথ্যে কথা নাড়িয়ে দেয় বিশ্বাসের ভীত। ওলটপালট করে দেয় ভালোবাসার সোপানগুলোকে। তাই আমার কাছে গোপন কোরো না কিছুই। আমি রোম্যান্টিক নই, নই আল্ট্রামর্ডান স্মার্ট, এখনো আমার মধ্যে বেঁচে আছে মধ্যবিত্তের জীবনবোধ। তোমাদের এই আভিজাত্যে মোড়া কমপ্লেক্সে জানি আমি একটু বেমানান।
হয়তো আমি তোমার মনের মত নই, শুধু একটাই কথা বলবো, তোমার বিনা অনুমতিতেই ভালোবাসতে পারি এক পৃথিবী। তুমি হাত না ছেড়ে দিলে, হাঁটতে পারি তেপান্তরের মাঠ। ভালোবাসি ঈশা, জানি না বোঝাতে পারলাম কিনা! তুমি সামনে এলে আমার কথারা শব্দ হারায়, তাই বলা হয় না কিছুই, সেজন্য লিখে পাঠালাম।
ইতি-
এই অর্বাচীন…যার কাছে ভালোবাসা আর ঈশা শব্দদুটো সমার্থক।
.
চিঠিটা শেষ করে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলো ঈশা। এমন করে কেউ প্রোপোজ করতে পারে এটাই যেন অজানা ছিল ওর। ফিসফিস করে নিজের কানকেও বাঁচিয়ে বলেছিলো, তোমার হাত ধরে হাঁটবো মরুপ্রান্তর।
কি হলো? লজ্জা পাচ্ছ কেন, পরিয়ে দাও। এই জন্যই মাকে মিথ্যে বলে সন্ধেতে এলাম এখানে। তুমি না পজেসিভ লাভার? নিজে হাতে নিজের অধিকার কায়েম করো আমার আঙুলে! প্রান্তিক ঈশার তর্জনীতে রিংটা পরিয়ে দিয়ে বলেছিলো, তুমি শুধু আমার হলে।
ঈশা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, হলাম।
প্রান্তিক বললো, এবারে আর লজ্জা করবে না তো আমার কলিগদের সামনে দাঁড়াতে? আর সংকোচ হবে না তো আমার কিচেনে ঢুকতে? মনে হবে না তো নামহীন সম্পর্কের মধ্যে আছো?
ঈশা ঘাড় নেড়ে বললো, না, মনে হবে না। প্রান্তিক ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো, তাহলে কি মনে হবে?
ঈশা মুচকি হেসে বললো, সব থেকে কাছের মানুষটার সঙ্গে আছি।
প্রান্তিক গলাটা গম্ভীর করে বললো, তো ম্যাডামের এই ফ্ল্যাটে পার্মানেন্টলি কবে আসা হবে? মানে আমি কবে পাবো নিজের করে?
ঈশা ঠোঁটটা কামড়ে একটু সময় নিয়ে বললো, বছর দুয়েক পর। আমার বিজনেসটা দাঁড় করাবো, পড়াশোনা কমপ্লিট করবো, দিদির বিয়ে হবে তারপর বুঝলে?
অপেক্ষা করতে রাজি আছো তো?
প্রান্তিক বললো, না করে উপায়?
ঈশা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, এখন চললাম, মা বকবে। প্রান্তিককে ‘বাই’ বলেই ছুটলো ঈশা। ঠিক যেন দামাল ঝর্ণা।
প্রান্তিক দেখলো, সুপর্ণা মেসেজ করেছে। সুপর্ণাকে জানাতে হবে ঈশার সঙ্গে প্রেমের বিষয়টা। আফটার অল ওর জন্যই এটা সম্ভব হলো। ও যদি জোর না করতো তাহলে না আসতো এই ফ্ল্যাটে না দেখা হতো ঈশার সঙ্গে। তাই একটা বিগ থ্যাংকস তো প্রাপ্যই সুপর্ণার।
প্রান্তিক লেখার আগেই দেখলো, সুপর্ণা লিখেছে, কেমন আছিস রে? মাছগুলো আমায় খোঁজে নাকি?
প্রান্তিক বুঝলো সুপর্ণা মিস করছে ওর এই ফ্ল্যাটটাকে।
প্রান্তিক মজা করে লিখলো, আরে ওরা তো আমায় রোজই বলে, দিদি কি জামাইবাবুকে পেয়ে আমাদের ভুলে গেল? আমি বলি, নতুন বিয়ের পরে এমন একটু হয়। বেখেয়ালে, আনমনা..তাই না?
সুপর্ণা লিখলো, হয়তো হয়। তবে অনেকে আবার আত্মঅহংকারে আঘাত খেয়ে নিশ্চুপও হয়ে যায়। তখন সম্পর্কটা হয়ে যায় একটা অভ্যাস, আর এখান থেকে গুটিগুটি পায়ে পালিয়ে গিয়ে ভালোবাসা ধীরে ধীরে বাসা বাঁধে কোনো স্বপ্ন দেখা রঙিন চোখের তারায়। বাস্তবের সংঘাতে সে হাঁপিয়ে ওঠে। তাই চুপিচুপি পালিয়ে যায়। বুঝলি কিছু? বাকি বল, ঈশা কেমন আছে রে? আসে তোর কাছে?
প্রান্তিক বলতে যাচ্ছিল, ঈশা এখন শুধু আমার। কিন্তু কোথা থেকে যেন একমুঠো লজ্জা আর একরাশ সংকোচ এসে ভিড় করলো ওর জিভের ডগায়। তাই কোনোমতে বললো, হ্যাঁ আসে তো। রোজই গল্প হয়। তুমি কেমন আছো? কেমন লাগছে বিদেশ?
সুপর্ণা সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো, এখানে সব কিছু বড্ড সাজানো, কৃত্রিমতার কদর বেশি, অকৃত্রিম কিছুর কোনো চান্স নেই। প্রান্তিক হেসে বললো, বিয়ের পরে তুমি কেমন গম্ভীর হয়ে গেছো সুপর্ণা। অঙ্কিতা কিন্তু আগের মতই আছে।
সুপর্ণা লিখলো, অঙ্কিতা যে নিজেকে পরাধীন করতে চায়নি স্বেচ্ছায়, তাই ও বিয়ের পরেও গম্ভীর হবে না, বুঝলি প্রান্তিক। তুই তো পুরুষ মানুষ তাই তুই বুঝবি না রে, সব ছেড়ে চলে আসার পর অবজ্ঞার কষ্ট।
প্রান্তিকের মনে পড়ে গেলো, বিয়ের আসরে অঙ্কিতা বলেছিল, সুপর্ণার কিছু একটা হয়েছে। মুডটা কেমন অফ লাগছে। প্রান্তিক অঙ্কিতার কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাই মন খারাপ হয়তো। আজ সুপর্ণার মেসেজ পড়ে মনে হচ্ছে মেয়েদের বোধহয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় একটু বেশিই স্ট্রং। তাই অঙ্কিতা সেদিন সুপর্ণার নিখুঁত মেকআপের মধ্যেও ওর মন খারাপের খবরটা বুঝে গিয়েছিলো। সুপর্ণা কি খুশি নয়? কে জানে!
প্রান্তিক বললো, কলকাতায় এলে এখানে আসবে কিন্তু। দেখে যেও তোমার গোছানো ফ্ল্যাট আমি একই রকম রেখেছি কিনা।
সুপর্ণা বললো, ধুর পাগলা। তুই আমার ভাড়াটে নোস, ওটা আর আমার ফ্ল্যাট নেই, তোর হয়ে গেছে। তুই তোর ইচ্ছে মতন সাজিয়ে নিস। আর হয়তো আমার কোনোদিনই ফেরা হবে না কলকাতা। একমাত্র ফ্ল্যাটটা রেজিস্ট্রি করে দিতে যাবো তুই যখন ডাকবি। সুপর্ণার টাইপিং বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রান্তিকও খুঁজে পায়নি কোনো সান্ত্বনাবাক্য, তাই গুড নাইট আর ভালো থেকো লিখে কনভারসেশন শেষ করেছিল।
প্রান্তিকের প্রতিমাসের মাইনে থেকে একটা নির্দিষ্ট টাকা সুপর্ণার অ্যাকাউন্টে ঢুকে যায়। প্রান্তিক হিসেব করে দেখেছে, বছর দেড়েক লাগবে ফ্ল্যাটটা রেজিস্ট্রি করতে। ঈশা বলেছে অন্তত বছর দুয়েক লাগবে ওর সম্পূর্ণভাবে প্রান্তিকের হতে। ফ্ল্যাটের লোন কমপ্লিট হলেই ও চেষ্টা করবে লোন নিয়ে একটা চারচাকা কিনতে। ধুর, তিলোত্তমার রাস্তায় এই পলিউশনের মধ্যে ও ঈশাকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরতে পারবে না। ঈশার জন্য কি কি করতে হবে ভেবে মুচকি হেসে ফেললো প্রান্তিক। ঈশার মত একটা মিষ্টি পরীকে নিজের কাছে আনতে গেলে সবকিছু পরিবর্তন করতে হবে। ঈশার যেন কোনোভাবেই কোনো অসুবিধা না হয়। কলকাতায় ফ্ল্যাট কেনার পর দাদা, বৌদি আর মা প্রায় সম্পর্ক ত্যাগ করেছে ওর সঙ্গে। দাদা-বৌদির ইস্যুটা না হয় এক্সপেকটেড, কিন্তু মা! মায়ের এই পরিবর্তনে অবাক হয়েছে প্রান্তিক। ছেলের সৌভাগ্যে মা খুশি না হয়ে বরং বলেছে, নিজের মত যখন থাকতে চাও তখন আর আমরা কি করবো? আর ঢং করে এবাড়িতে এসে হাজিরা দেওয়ার দরকার নেই। প্রান্তিক জানে দাদার সংসারে ও আর টাকা দেয় না বলে ওদের রাগ। কিন্তু মায়ের হাফ খরচ তো ও দিতে চেয়েছিলো, মা বলেছে তার প্রয়োজন নেই। প্রান্তিক মাকে এই ফ্ল্যাটে এনে রাখতে চেয়েছিল, সে শর্তেও রাজি হয়নি মা। আস্তে আস্তে নৈহাটির বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কের রংটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। প্রান্তিকও আর সেভাবে টান অনুভব করে না ওই বাড়ি যাবার। বেশ বুঝতে পারে ও বাড়িতে পা রাখলেই সবাই কেমন এক্সট্রা গম্ভীর হয়ে যায়। যেন সুতোটা ছিঁড়ে দিতে চাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে ওরা। তাই আপাতত মাসে একবার নৈহাটি যাবে ঠিক করেছে ও। যদি সেটাতেও ওদের সমস্যা হয় তাহলে নাহয় যাওয়াই বন্ধ করে দেবে। বড্ড একলা হয়ে যেতে শুরু করেছিল প্রান্তিক, ভাগ্যিস ঈশা ছিল। নাহলে বন্ধুবান্ধব ওর বরাবরই কম। বরাবরই ও একটু ইন্ট্রোভার্ট। খুব পছন্দের মানুষ না হলে নিজের সব কথা বলতেই পারে না। এটা ওর একটা বদঅভ্যেস। আবার পছন্দ হয়ে গেলে সেই মানুষের কাছে ও ওর নিজের জীবনের খুঁটিনাটি মেলে ধরতে পারে অনায়াসেই।