বর্ণিতার আত্মপক্ষ সমর্থন
অন্যমনস্ক হয়ে বর্ণিতা বললো, বিশ্বাস করুন, প্রায় মাস আষ্টেক আগে আমার শেষ দেখা অব্যয়ের সঙ্গে। আমি জানতামই না অব্যয় মিসিং। মাসখানেক আগে শুনলাম ওর এক্সিবিশন হচ্ছে শহরের নামী একটা হলে। আমায় কোনো মেসেজ করেনি, কোনো কার্ড আসেনি নিমন্ত্রণের, তাই আমি অভিমান করেই উপযাচিত হয়ে যাইনি অব্যয়ের শোতে। লেডি পুলিশ অফিসার ভ্রুতে কোঁচ ফেলে বললেন, ওনার কলেজে গিয়ে শুনলাম আপনি নাকি মাঝে মাঝেই যেতেন ওনার সঙ্গে দেখা করতে। বর্ণিতা হাত জোড় করে বললো, দেখুন অফিসার মাঝে মাঝে বলতে ঠিক কি বলতে চেয়েছেন ওর কলিগরা আমি জানি না, তবে ওর অধ্যাপনা শুরু হবার পরে ওই কলেজে আমি হাতে গুনে চারবার গেছি গত আড়াই বছরে। তাও সম্পূর্ণ আচমকা গেছি। ও সেদিন কলেজে উপস্থিত থাকবে কিনা সেটাও কনফার্ম করিনি। ইচ্ছে হয়েছে ওকে দেখতে তাই চলে গেছি। কেউ যদি আপনাকে বলে থাকে অব্যয়ের সম্পর্কে আমি সব খুঁটিনাটি বলতে পারবো তাহলে সে ভুল বলেছে। অব্যয় চিরটাকাল ধরাছোঁয়ার বাইরে। ওর মনের মধ্যে প্রবেশ করার ক্ষমতা কারোর ছিল না অফিসার। আমাদের ব্যাচের সবথেকে ভালো ছেলে ও। প্রফেসররা ওকে দেখিয়ে বলতেন, দেখো ভবিষ্যতের যামিনী রায় বা পিকাসোকে সামনে থেকে দেখছো তোমরা। অব্যয় বরাবরই নিজের সম্পর্কে বেশি কিছু বলতো না। এমনকি দমদমের ঠিক কোন জায়গায় ওর বাড়ি ছিল তাও আমরা জানতাম না। কোনোদিন কাউকে নিজের বাড়িতে নিয়েও যায়নি ও। ওরা কয় ভাইবোন, বাড়িতে কে আছে এসব প্রশ্ন আমরাও কোনোদিন করিনি, ও স্বেচ্ছায় বলেনি।
একটু ভেবে বর্ণিতা বললো, আচ্ছা অফিসার, ওর বাড়ি থেকে থানায় কেউ রিপোর্ট লেখায়নি?
.
অফিসার ঘাড় নেড়ে বললেন, কলেজের কয়েকজন কলিগ এসে রিপোর্ট লিখিয়ে গেছেন। দমদমের ওই ফ্ল্যাটে আর উনি এখন থাকেন না। ওর বাবা-মা ওর দাদার কাছে দমদমে থাকেন। অব্যয় সাউথের দিকে কোথাও একটা ফ্ল্যাট কিনেছিল। সেখানে আজ অবধি ওর বাবা-মা কাউকেই নিয়ে যায়নি। তাই তারা সঠিক অ্যাড্রেস দিতে পারলো না। আপনি যেহেতু অব্যয়ের কলেজফ্রেন্ড তাই এসেছিলাম আপনি যদি কিছু জানেন!
বর্ণিতা চিন্তিত মুখে বললো, ওর একটা গ্রামের বাড়ি আছে। আমি ওকে দেখতাম ও একটা গ্রামের বাড়ির দৃশ্য আঁকত মাঝে মাঝেই। জিজ্ঞেস করলে বলতো, আমার গ্রামের বাড়ি। কোথায় তা তো বলতে পারবো না। আদৌ এখনও সে বাড়ি আছে কিনা জানি না। তবে গ্রাম আর ঘনসবুজ এই দুটোতে ওর আকর্ষণ ছিল মারাত্মক।
.
বর্ণিতা আকাশকুসুম ভাবছিল, তখনই অফিসার যেটা বললেন, সেটা শুনে আরেকটু হলেই ও জ্ঞান হারাত।
অফিসার লগ্নজিতা ভট্টাচার্য বললেন, আপনার বন্ধু উত্তর কলকাতার এক বেশ্যাপল্লীতে যেতেন। ঠিক পল্লী বলা ভুল হবে, উনি একজনেরই বাড়িতে যেতেন তার জীবিকা ছিল প্রস্টিটিউশন। যার ঘরে যেতেন সেই লাবণ্য বলে মেয়েটি খুন হয়েছে দিন চারেক আগে। আর ঠিক ওই দিন থেকেই মিস্টার অব্যয় বিশ্বাস কলেজে আসেন নি। অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার তাই বলে। আপনি জানেন ওনার ওই এক্সিবিশনে মোট আয় কত হয়েছিল? প্রায় ছয় লক্ষ টাকা। ওনার প্রতিটা ছবি চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। এত সাফল্যের পরে কোনো ব্যক্তি কেন নিরুদ্দেশ হতে পারেন? কলেজে কোনো ছুটির অ্যাপ্লিকেশন নেই। বাবা-মাও কোনো সন্ধান দিতে পারেননি। লাবণ্যর ঘরে একটা ব্যাগের মধ্যে প্রায় লাখ দুয়েক টাকার হার্ড ক্যাশ পাওয়া গেছে। সম্ভবত ওই টাকা লাবণ্যকে অব্যয়বাবুই দিয়েছিলেন। জানি না ওই টাকার লোভেই কেউ লাবণ্যকে খুন করেছে কিনা!
পুলিশ অফিসার যাওয়ার সময় বলে গেলেন, যদি আপনার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ করেন, তাহলে প্লিজ ইনফর্ম করবেন। লাবণ্যর খুনিকে ধরার জন্য অব্যয়বাবুকে আমাদের বিশেষ প্রয়োজন।
বর্ণিতার ফোনটা বেজে যাচ্ছে। বি বেঙ্গলির অফিস থেকে। ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ফোনের স্ক্রিনের দিকে। অব্যয় আর নারী শরীর পিপাসু? মেলাতে গিয়ে বড্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। ঘেঁটে যাচ্ছে হিসেব নিকেশ।
দৃষ্টিপটে ভেসে উঠছে অব্যয়ের সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার দৃশ্যটা।
.
সত্যি বলতে কি তোমার এই রংতুলির টানেই আমি ফিরে আসি। বর্ণিতা নিচের ঠোঁটটা কামড়ে কথাটা বললো অব্যয়কে। অব্যয় উদাস চোখে তাকিয়ে বললো, পারছি না, ঠিক মত ফুটিয়ে তুলতে পারছি না চোখের সামনে ভেসে থাকা দৃশ্যদের। কি বলতো বর্ণিতা, আর্ট কলেজে প্রফেসরি করে, সারাটা দিন ছাত্র-ছাত্রীদের শিখিয়ে নিজের জন্য আর সময় বাঁচে কই! তাই মাথায় ভেসে থাকা দৃশ্যপটগুলোকে আর ধরা হয়ে ওঠে না ক্যানভাসে। বর্ণিতা ফিক করে হেসে বললো, আমি তো সেই কবেই আর্ট কলেজ ছেড়েছি, তারপর মেকআপ আর্টিস্ট বনে গেলাম। ভেবেছিলাম ক্যানভাসে গোটা আকাশকে ধরবো, পারলাম কি? লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পথ হারালাম। বি বেঙ্গলির মেকআপ আর্টিস্ট বর্ণিতা দত্তগুপ্ত এতদিনে বুঝেছে, মাসের শেষে মোটা টাকা উপার্জন করাটাই শেষ কথা নয়, প্যাশন থাকা উচিত, তবেই স্বপ্নরা ধরা দেবে।
অব্যয় হাসতে হাসতে বললো, তাহলে শুরু করে দাও, হাতে তুলে নাও জল রং, ক্যানভাস ভরে উঠুক শরতের আকাশের মেঘপুঞ্জ দ্বারা। আর্ট গ্যালারিতে এক্সিবিশন হোক বর্ণিতা দত্তগুপ্তর। বর্ণিতা ভেজা গলায় বললো, লোভ দেখাচ্ছ? তাকিয়ে দেখো, তোমার কথাতে আমার রোমকূপরা পর্যন্ত শিহরিত হচ্ছে, আমার দৃষ্টিতে একটা উড়ন্ত স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবে তুমি অব্যয়।
অব্যয় আড়চোখে কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখলো, নিষ্ঠুরভাবে রক্তাত্ব করে রেখেছে নিজের প্রতিটা শাখা প্রশাখা। এতটা সৌন্দর্য পাওয়ার কোনো অধিকার নেই ওই পুজোর নৈবেদ্যতে অর্থহীন পুষ্পের। তবুও ওর জন্মদাত্রী ওকে দশহাতে সাজিয়েছেন, রাঙিয়ে দিয়েছেন প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত রং দিয়ে। চোখ ধাঁধানো রঙিন থেকে চোখ ফিরিয়ে অব্যয় বললো, ভাবো বর্ণিতা ভাবো, এসময় বোধহয় আর ফেরত পাবে না।
বর্ণিতা অন্যমনস্ক ভাবে বললো, হ্যাঁ ভাববো। আসলে যখন আঁকা ছেড়ে মেকআপ আর্টিস্ট হলাম তখন একটা চাকরি আর বেশ কিছু টাকার বড্ড প্রয়োজন ছিলো। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, ট্রিটমেন্টের জন্য অনেক খরচ হচ্ছিলো। এখন বাবা নেই, মা বাবার চাকরিটা জয়েন করেছে, সংসার বলতে আমি আর মা। বি বেঙ্গলির চাকরিটা করেও আবার আঁকিবুকি করার সময় পাচ্ছি। আউটডোর কলগুলো অ্যাটেন্ড না করলেই হলো। তাহলেই আবার ফিরবো সম্পূর্ণ সাদা জমিতে, যেখানের একচেটিয়া অধিকার শুধু আমার। রং নিয়ে খেলবো আবার।
অব্যয় বললো, এক্সিবিশনের শখ হয় না তোমার? মুচকি হেসে বর্ণিতা বললো, ওটা তো স্বপ্ন, আমরা সবাই দেখি। অব্যয় বললো, আমি সাধারণ এক্সিবিশনের স্বপ্ন দেখি না বর্ণিতা। আমি দেখি ইউনিক সব আঁকা। ব্যতিক্রমী সৃষ্টির ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ছবি বোদ্ধা মানুষরা। আমি নিজেই নিজের সৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে দোলাচলে দুলছি, কোনটা শ্রেষ্ঠ বিচারে অপারগ আমি। এমন একটা স্বপ্ন দেখি আমি। তারপর ঘুম থেকে উঠে যখনই ক্যানভাসে আঁকতে যাই সেই ব্যতিক্রমী ছবিদের তখনই তারা ক্রমশ দূরে সরে যায়, হাত বাড়িয়ে আপ্রাণ ধরতে চাই, ছবি আঁকা শেষ হলে দেখি সেই গতানুগতিক এঁকেছি, কান্না পায় জানো। কষ্টে বুজে আসে গলার কাছটা। বর্ণিতা বললো, অব্যয় আমি জানি তুমি প্রেমে পড়ো না কোনো মানবীর, তোমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা ছবির ওই এলোমেলো বা সাজানো রংগুলোই। তাই বলছি, কলেজ যেমন করছো করো সঙ্গে আঁকতে থাকো, এক পৃথিবী আঁকো।
এই কথাটার পরেও বর্ণিতা আশা করেছিলো অব্যয় হয়তো বলবে, রংতুলির কাছে দাসত্ব স্বীকার করেছি ঠিকই কিন্তু ভালোবাসি না বললে অন্যায় হবে। হয়তো বাসি। বর্ণিতা খুব আশা করেছিলো অব্যয় বলবে, যদি বলি তোমাকে বাসি তাহলেই বা কি! ভালোবাসলেও যে বাধা পড়তে পারবো না পার্থিব কোনো শরীরের সঙ্গে, সে কি তুমি জানো না বর্ণিতা? বর্ণিতার কল্পিত একটা শব্দও ব্যবহার করেনি সেদিন অব্যয়। শুধু বলেছিলো, প্রেমে আমিও পড়ি, বারবার পড়ি কিন্তু ওই যে রংতুলি বড়ই হিংসুটে তাই কাউকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয় না আমার। পাখিরা ঝাঁক বেঁধে ঘরে ফেরার সময়টুকু অব্যয়ের সঙ্গে কাটিয়ে ফিরে এসেছিল বর্ণিতা। তারপর আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো ও। অব্যয়ের সঙ্গে কথা হয়নি বহুদিন। হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে না অব্যয়। ফোন করলে মুড ঠিক থাকলে রিসিভ করে, না হলে নয়। তাই বর্ণিতার যেদিন খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে সেদিন ও চলেই যায় অব্যয়ের কলেজে, একেবারে আচমকা। অব্যয় আর বর্ণিতা একসঙ্গেই আর্ট কলেজে পড়েছে। ফাইন আর্টস নিয়ে। কলেজে পড়ার সময় থেকেই অব্যয়কে ভালোবাসতো বর্ণিতা। অব্যয় মজা করে বলতো, বর্ণিতা তোমার চোখের দৃষ্টিতে যে আকুতি দেখি সেটা নিশ্চয়ই সত্যি নয়! তোমার কথার সুরে যে কথা হারানোর আবেগ দেখি সেটাও নিশ্চয়ই সত্যি নয়! যদি এগুলো মিথ্যে হয় তাহলে আমি তোমার বন্ধু হলাম। আর যদি এগুলো মিথ্যে না হয়ে চরম সত্যি হয় তাহলে আমি তোমার প্রেমিক হতে অপারগ। ঘাবড়ে গিয়েছিলো বর্ণিতা, এমন স্পষ্ট কথার তীব্র আঘাতে। তবুও সামলে নিয়ে বলেছিলো, বন্ধু হলে বুঝি প্রেমিক হওয়া মানা? অব্যয় সবুজ ঘাসের ওপরে এলোমেলো পা ফেলে বলেছিলো, বন্ধুত্বের দায়িত্বটুকু হয়তো নিতে পারবে এই অর্বাচীন কিন্তু প্রেমিকের দায়িত্ব, বাঁধন এসব আমার সাধ্যের বাইরে।
সেদিন থেকেই অব্যয় ওর বন্ধু হয়েছিলো। আর বর্ণিতার একতরফা প্রেমের সঙ্গী। যে প্রেমের একমাত্র ভরসা সংযম আর অপেক্ষা। যদি কখনো অব্যয় ভালোবেসে ফেলে বর্ণিতাকে তার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলো ও। কলেজের তিনটে বছরে একবারও বর্ণিতা উচ্চারণ করেনি ও ভালোবাসে অব্যয়কে। অব্যয় তো করবে না এমনই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলো। এখন অব্যয় আর্ট কলেজের প্রফেসর, বর্ণিতা মেকআপ আর্টিস্ট, কেটে গেছে কলেজের সেই উদ্দীপনা তবুও অব্যয় নামটাকে খুব সংগোপনে রেখে দিয়েছে বর্ণিতা। যখন খুব মন খারাপ করে, দিশাহারা লাগে একঘেয়ে জীবনে, তখন ও গিয়ে দাঁড়ায় অব্যয় নামক বন্ধুটির সামনে। রঙের আঁচড়ে বর্ণিতাকে আবার উজ্জীবিত করে দেয় ও। আঁচল ভরে সেই উজ্জীবনী নিয়ে ফিরে আসে বর্ণিতা। মা শত বলা সত্ত্বেও বিয়ে করেনি বর্ণিতা। না, কারোর প্রতীক্ষায় আর থাকে না ও, শুধু অন্য কাউকে মেনে নিতে পারবে না বলেই হয়তো বিবাহ নামক জটিল বন্ধন থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে।
.
মা টেবিলে খাবার সাজাতে সাজাতে বললো, ফোনটা রিসিভ কেন করছিস না বলবি? পুলিশ অফিসার বাড়িতে এলো কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার অধিকার বোধহয় আমার আছে বর্ণি! বর্ণিতা গাঢ় গলায় বললো, মা মুখোশের আড়ালের মানুষটাকে আমরা কেন দেখতে পাই না সাদা চোখে? যে মানুষটাকে এতদিন পর্যন্ত একরকম জেনে এলাম হঠাৎ যদি দেখো সে মানুষটা বদলে গেছে বা এমনিই ছিল তুমি চিনতে পারো নি তখন কেমন লাগবে মা? কমলিনী মেয়ের হেঁয়ালিপূর্ণ কথার উত্তর না দিয়েই বললো, তুই যদি মনে করিস চাকরি ছেড়ে দিয়ে আঁকাটাকে নিয়ে থাকবি আমার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু।
বর্ণিতা অন্যমনস্ক ভাবে বললো, কে জানে কেন রংতুলির প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে গেল গত এক ঘণ্টায়। মানুষটা তার মানে মানবীর প্রেমে পড়েছিলো, প্রেমে না শরীরের প্রেমে? আমি তো অপেক্ষা করেছিলাম, না দেবার মত তো কিছুই ছিল না তাকে, শুধু একবার মুখ ফুটে বলার অপেক্ষায় ছিলাম আমি।
কমলিনী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, তুই কি কাউকে ভালোবাসতিস? ওই জন্যই বিয়ে করবি না ডিক্লিয়ার করেছিলি? তার কি কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে? আমায় বলবি কিছু?
বর্ণিতা নির্লিপ্ত ভাবে বললো, ঠিক জানি না মা। তবে আমার কলেজের বন্ধু এখন লেকচারার, চারদিন ধরে মিসিং তাই পুলিশ ইনভেস্টিগেট করছে ওর পরিচিতদের কাছে গিয়ে। জাস্ট রুটিন ইনভেস্টিগেশন মা, নাথিং সিরিয়াস। তুমি অফিস যাও, আমি আজ ফার্স্ট হাফে ছুটি নিয়ে নেবো।
কমলিনী একটু থমকে বললো, কষ্ট পাস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। জীবনটাতে অনেকগুলো বাঁক থাকে। কোনো বাঁকে একমুঠো যন্ত্রণা তোকে রক্তাত্ব করবে আবার কোনো বাঁকে একরাশ আনন্দ তোকে সুখী করবে, তাই সবটুকুকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিবি বুঝলি!
মা বেরিয়ে গেলো অফিস। একলা বাড়িতে বসে বসে বর্ণিতা ভাবছিল, বাবা বেঁচে থাকতে মা এতটা প্র্যাকটিক্যাল ছিলো না। তখন বরং বইপত্র পড়তো, সংসার সামলাতো, পুরোনো দিনের সিনেমা দেখে কাঁদতেও দেখেছে বর্ণিতা। বাবার মৃত্যুটাই বোধহয় মায়ের আবেগময় জীবনের ভীতটাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। সে তো বাবার মৃত্যু বর্ণিতাকেও বদলে দিয়েছে। ডক্টর যখন বলেছিলেন বাবার প্যানক্রিয়াসে ক্যানসার তখন টলে উঠেছিলো বর্ণিতার রামধনু রঙের দুনিয়াটা। সবে ফাইন আর্টসে মাস্টার্স করবে ভেবে ও তখন পরবর্তী জীবন নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। ওর নিজস্ব ছবির এক্সিবিশন হচ্ছে, মানুষজন ছবিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই ওর অধরা স্বপ্নটা ক্যালাইডোস্কোপের মধ্যে থাকা কাঁচের টুকরোগুলোর মত ছড়িয়ে পড়েছিলো মেঝে ময়।
ডক্টর শুনিয়েছিলেন, অপারেশন করতে প্রচুর টাকা লাগবে। বাবার ব্যাংকে জমানোর স্বভাব কোনোদিনই তেমন ছিল না। খরুচে মানুষ। তবুও ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে শুরু হয়েছিলো ট্রিটমেন্ট। বিজ্ঞাপন দেখে চাকরি খুঁজতে শুরু করেছিলো বর্ণিতা। তখনই বি বেঙ্গলি চ্যানেলের মেকআপ আর্টিস্টের বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়েছিলো, স্যালারিও মন্দ নয়। রঙের কাজ ও ভালোই পারবে, বাকি রইল মানুষকে সৌন্দর্য প্রদান করা, সাদা খাতাকে যে তুলির আঁচড়ে রঙিন করতে পারে সে একটা মানুষের মুখাবয়বকে সুন্দর করে তুলতে পারবে না, তাই হয় নাকি? কনফিডেন্স নিয়েই গিয়েছিলো ইন্টারভিউ দিতে।
.
ফোনটা রিসিভ করেই বর্ণিতা বললো, বল রক্তিম, বহুদিন পরে তুই ফোন করলি, কি খবর বল তোদের? তুই আর আমাদের পেঁচিরানী আছিস কোথায় এখন? রুবির কাছে ফ্ল্যাট নিয়েছিস?
বর্ণিতাকে থামিয়ে দিয়ে রক্তিম বললো, পুলিশ গিয়েছিলো তোর কাছে? আমার কাছে এসেছিলো। আরে আমাদের অব্যয় নাকি মিসিং! অব্যয়ের এক্সিবিশনে গেলাম এই তো সেদিন। আমি আর গুঞ্জা দুজনেই গিয়েছিলাম। আমাদের বন্ধুদের ব্যাচের অনেকের সঙ্গে দেখাও হলো। বেশ খুশি ছিল অব্যয়। গুঞ্জা তো ওর আঁকা একটা ছবিও কিনলো সেদিন অনেকগুলো টাকা দিয়ে। অব্যয় অবশ্য কলেজফ্রেন্ড বলে একটু কমই নিলো। সেদিনও তো বুঝতে পারিনি ও ডিস্টার্বড আছে, এভাবে কোথাও পালিয়ে যেতে পারে! বর্ণিতা মনে মনে বললো, কলেজের সব বন্ধুকেই মোটামুটি ইনভাইট করেছিল অব্যয়, শুধু ওকে বাদ দিয়ে। বাকি সব বন্ধুদের বর্ণিতা তুই বলে সম্বোধন করলেও অব্যয়কে তুমিই বলতো। অব্যয়কে অন্যদের পংক্তিতে বসাতে মন চাইতো না ওর। অব্যয়ও বোধহয় ওর তুমি শুনেই বর্ণিতাকে তুই বলে ডাকেনি কখনো।
একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল বর্ণিতা। রক্তিম বললো, কি রে উত্তর দিচ্ছিস না কেন? তুই এখন চ্যানেলের অফিসে আছিস, না বাড়িতে? বর্ণিতা হালছাড়া গলায় বললো, না রে আজ আর অফিসে যাওয়া হলো না। একটু আগেই এস আই লগ্নজিতা ভট্টাচার্য এসেছিলেন। একপ্রস্থ জেরা করে গেলেন। রক্তিম উত্তেজিত হয়ে বললো, তোর কাছেও গিয়েছিল তাই না? গুঞ্জা ঠিকই বলেছে বর্ণিতার কাছেও নিশ্চয়ই যাবে। এই শোন না, আমারও আজ স্কুলে যাওয়া হলো না, গুঞ্জাও বুটিকে যায়নি, তুই একবার চলে আয় না আমাদের ফ্ল্যাটে। কুণাল আর স্বর্ণদীপও আসছে। অব্যয়ের বিষয়টা নিয়ে কথা বলার জন্যই, আসবি?
.
বর্ণিতা বিরক্তির গলায় বলতে যাচ্ছিলো, অব্যয় ওর জীবনের ফার্স্ট এক্সিবিশনে আমাকে ডাকেনি, ডেকেছিল তোদের, তাই তোরাই আলোচনা কর। কথাটা বলার আগেই গুঞ্জার গলা শোনা গেল, হ্যাঁ বর্ণিতা আমাদের সকলের থেকে ওকে চেনে বেশি, তাই ও ভালো বলতে পারবে অব্যয় এখন কেমন মেন্টাল কন্ডিশনে ছিলো। কথাটা শোনার পরেই বর্ণিতার মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন হলো। ওর অবাধ্য মন আবার ভাবতে শুরু করলো, ঠিকই তো, ওর মত করে অব্যয়কে আর কেই বা চিনবে। অব্যয়ের নিঃশ্বাস নেওয়ার ধরনে ও বুঝতে পারতো ওর মুড কেমন আছে। বর্ণিতার মত করে যে কেউ অব্যয়কে ভালোবাসবে না সেটা বোধহয় অব্যয় নিজেও জানতো। গুঞ্জার মুখে কথাটা শুনে আবার একটা নরম ভালোলাগায় ভরে উঠল মনটা। বন্ধুরা এখনও ভাবে, বর্ণিতা আর অব্যয় হয়তো অনেকগুলো বসন্ত পেরিয়ে এসেও আবার শুরু করবে নতুন করে। এই আলটুসী ‘হয়তো’ শব্দটা ঘিরেই বেঁচে আছে বর্ণিতা, ওর একতরফা ভালোবাসাকে সঙ্গী করে।
রক্তিম রিপিট করলো, আসবি? তাহলে আমি আমাদের নতুন ফ্ল্যাটের অ্যাড্রেসটা টেক্সট করছি তোকে। বর্ণিতা ভাবনার মধ্যে নিমজ্জিত থেকেই বললো, হ্যাঁ আসছি।