লগ্নজিতার জেরা
তারপর বলুন মিস্টার ঘোষাল, এই লাবণ্য নামের মেয়েটি যেদিন খুন হলো আপনি সেদিন কোথায় ছিলেন? বছর পঞ্চাশের বেশ নাদুসনুদুস সুখী চেহারার শুভদীপ ঘোষাল বললেন, লাবণ্যের বেডরুমে যে ছিলাম না সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। অ্যালিবাই আমার আছে। আরেকটা কথা বলুন তো, আপনি পুলিশ অফিসার নাকি গোয়েন্দা? লগ্নজিতা গম্ভীরভাবে বললো, তাতে আপনার সমস্যাটা কোথায়? একমাত্র প্রাইভেট ডিটেকটিভরাই বুঝি কেসের অন্তিম অবধি যায়? পুলিশ অফিসারদের তাড়া থাকে ফাইল বন্ধ করে দেবার? এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন। আমি একজন পুলিশ অফিসার কিন্তু এই কেসের শেষটা আমি দেখেই ছাড়ব। এবারে বলুন, আপনি তখন কোথায় ছিলেন? আর লাবণ্য এই ফ্ল্যাটে কতদিন ধরে বাস করছে, কে কে আসতো সেখানে? শুভদীপ একটু বিরক্ত মুখে বললো, দেখুন অফিসার, এই যে পাঁচতলা বাড়িটা দেখছেন এটা ঠিক ফ্ল্যাট নয় বুঝলেন। এটা আসলে আমার জেঠুর বাড়ি ছিলো। উত্তর কলকাতায় ফ্ল্যাট কালচার একটু কম ছিলো। আমি প্রোমোটারির ব্যবসা করি। ভেবেছিলাম জেঠুর বাড়িটাকে ফ্ল্যাট বানাবো। কিন্তু জেঠু মারা যাবার পরে জেঠিমার হঠাৎ করেই পুরোনো স্মৃতি মাথা চাগার দিয়ে উঠলো। ওহ তার আগে বলে নিই, আমার জেঠু নিঃসন্তান ছিলেন। লগ্নজিতা বুঝলো, ঘোষালের টু দ্য পয়েন্ট উত্তর দিতে সমস্যা আছে। শর্ট কোশ্চেনের উত্তরেও ইনি চারপাতার মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ লিখে বাড়ি ফিরতেন। অগত্যা ধৈর্য বড্ড জরুরি। তাই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো লগ্নজিতা। ঘোষাল বলতে শুরু করলো, জেঠু আমাকেই বাড়িটার অধিকার দিয়ে গিয়েছিলেন, আমার বড়দা বা ছোটভাইকে নয়। কারণ জেঠুর জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব কাজ আমি করে দিতাম। জেঠু মারা যাবার পরে ভেবেছিলাম পাঁচতলা বাড়িটা ভেঙে আধুনিক ফ্ল্যাট তুলবো, চড়া দামে বেচবো। কিন্তু ওই যে বললাম, জেঠিমা রানীবালার আচমকা পুরোনো সব স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। তাই জেঠিমা বললেন, শুভ, তুই বাপু বাড়িটাকে ভেঙে ফেলিস না আমি বেঁচে থাকতে। আমি এই একতলায় থাকবো, বাকি চারটে তলা তুই ভাড়া দিয়ে দে। লগ্নজিতা বললো, নিঃসন্তান দম্পতি পাঁচতলা বাড়ি নিয়ে কি করছিলেন? নাকি আপনারা সকলেই এই বাড়িতে থাকতেন?
জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে ঘোষাল বললো, একেবারেই নয়। আমাদের বাড়ি আলাদা। ওই তো পাশের গলি দিয়ে গেলেই আপনি আমাদের বাড়ি পাবেন। আসলে জেঠু ওকালতি করতেন। ভালো পসার ছিলো। একটা তলা জুড়ে ছিল জেঠুর অফিস, একটা তলা জুড়ে ছিল লাইব্রেরি। আর নিচের তলায় ছিল অন্তত গোটা দশেক বিভিন্ন জাতের কুকুর। জেঠু আর জেঠিমা থাকতেন তিনতলায়। বাকি বেশিরভাগ সময় তালাবন্ধ পড়ে থাকতো।
লগ্নজিতা বললো, প্রতিটা তলায় কটা করে ঘর ছিলো? বাড়ির ডিজাইনটা তো একেবারে আধুনিক বাড়ির মত। ঘোষাল হেসে বললো, জেঠু ভালো ইঞ্জিনিয়ার ডেকে বাড়ির ডিজাইন করিয়েছিলেন, তাই ভিতরে ঠিক এখনকার ফ্ল্যাটের মত তিনটে করে ঘর, ড্রয়িংরুম, বারান্দা, রান্নাঘর, বাথরুম। তবে সাইজগুলো এখনকার মত পায়রার খোপ নয়, বড় বড় ঘর মশাই। একজন দাঁড়ানোর মত শৌখিন ব্যালকনি নয়, রীতিমত বেতের চেয়ার টেবিল পেতে সন্ধের চা খাওয়ার মত বড় বারান্দা বুঝলেন? সত্যি বলতে কি একেকটা তলাতে অন্তত তিনটে করে ফ্ল্যাট হতো। কি আর করবো বলুন, সাবেক বাড়ির ছেলে, গুরুজনদের সম্মান করি অর্থের থেকেও বেশি তাই আর বুলডোজার এলো না বাড়ি ভাঙতে। একপ্রস্থ রং করে ভাড়ার নোটিশ ঝোলালাম। সেও হয়ে গেলো বছর পাঁচেক আগেকার কথা। আমার কাছে বাড়ি ভাড়া নিতে এসেছিলো এক অল্পবয়সী ছেলে, নাম রাজেশ ঘটি। প্রাইভেট কোম্পানিতে নাকি চাকরি করে। রাজেশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল একটা রোগা রোগা শ্যামলা গড়নের মেয়ে। তার দিকে চোখ পড়ার মত কিছু নয়। আমি ভোটার কার্ড দেখে ভাড়া দিলাম। তিনতলাটা ভাড়া নিলো। জেঠিমা আর জেঠিমার সব সময়ের দুটো কাজের লোক গোপাল আর সাবিত্রী রইলো একতলায়। ভাড়ার টাকা আমার হাতেই দিতো। জেঠিমা ও টাকায় হাত দিতো না। জেঠু যা ব্যাংকে রেখে গেছেন তাতে জেঠিমার ফেলে ছড়িয়ে খেয়েও জমে যায়।
চারতলায় ভাড়া নিলো এক চিত্রশিল্পী। সে পাগলা লোক। অর্ধেক সময় থাকে, অর্ধেক সময় কোথায় কোথায় জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। রাধারমণ মুখুজ্জে লোকটার নাম। সে নাকি স্টুডিও করবে এখানে।
আমি মাসের মাস ভাড়া পেয়ে যেতাম। লগ্নজিতা বললো, আর দোতলায়? এক ঢোক জল খেয়ে নিয়ে ঘোষাল বললো, কো-অপারেটিভ ব্যাংক। আর পাঁচতলায় গোটা চারেক কলেজের ছেলে আছে। বহুদিন পাঁচতলাটা ফাঁকাই পড়েছিল। এই বছর দুয়েক হলো ছেলে চারটে এসে ভাড়া নিয়েছে। লগ্নজিতা অধৈর্য হয়ে বললো, তো লাবণ্য কবে এসেছিলো?
ঘোষাল অবাক গলায় বললো, এই দেখ, বললাম তো তিনতলায় ছিলো। রাজেশ ঘটির বউ।
লগ্নজিতার ইনফরমার বলেছিলো, মেয়েটা নাকি প্রস্টিটিউট। এখন শুনছে সে রাজেশ বলে কারোর একজনের বউ! সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সামনের দোকানের ছেলেটা অব্যয়ের ছবি দেখে বলেছে, এই লোকটি লাবণ্যের কাছে আসতো। বর্ণিতা বা অব্যয়ের অন্য কোনো বন্ধু অবশ্য কথাটা বিশ্বাস করেনি। তাদের মতে অব্যয় এমন কোনো নিষিদ্ধ জায়গায় যেতেই পারে না। এদিকে লগ্নজিতার ইনফরমার আজ অবধি কোনো ভুল খবর দেয়নি। তবে কি এই প্রথম ইকবাল ভুল করলো? তবে কি অব্যয় মিসিং-এর সঙ্গে লাবণ্য খুনের কোনো সম্পর্ক নেই? কিন্তু লাবণ্যর বাড়িতে কে কে আসতো তার লিস্টে তো অব্যয়ের নাম দিয়েছে ইকবাল।
ঘোষাল বললো, আরে ওই নচ্ছারটাই তো যত নষ্টের গোড়া। বছর খানেক বেশ ভালোই থাকলো। লাবণ্যর সঙ্গে আমার জেঠিমার বড় ভাব হয়েও গেলো। মাঝে মাঝেই এটা ওটা রেঁধে দিয়ে যেত জেঠিমাকে। অবসর সময়ে গল্প করতো। হঠাৎই বছর খানেক পরে ওই নচ্ছার রাজেশটা বেপাত্তা হয়ে গেলো। আমি ভাড়া পাচ্ছিলাম না দেখে লাবণ্যকে বললাম উঠে যেতে। তখন দু-হাত দিয়ে তাকে আগলে ধরলো আমার জেঠিমা। বললো, কিছুতেই না। লাবণ্যকে এভাবে তাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। ওকে বেশ কিছুদিন সময় দিতে হবে। অগত্যা আমি আর নাক গলালাম না। সত্যি বলতে কি পাঁচ কাজের মানুষ। ওই পাঁচ হাজার, দশ হাজার টাকার জন্য কি হত্যে দিয়ে পড়ে থাকবো বলুন তো? মাস পাঁচেক পরে লাবণ্য এসে আমার হাতে ভাড়ার টাকা দিয়ে গেলো। বলে গেলো, সে নাকি কোথায় একটা কাজ পেয়েছে।
তারপর থেকে সত্যি বলতে কি ওই ভাড়া দেবার দিনেই দেখা হতো মেয়েটার সঙ্গে। যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন যেমন রোগা, শ্যামলা, গ্রাম্য ছিল তেমনটি আর ছিলো না। বড্ড বেশিই পরিবর্তন হয়েছিল ওর মধ্যে। শহুরে স্টাইলিশ মেয়েরা যেমন হয়। রাজেশ আর ফিরে আসেনি। লাবণ্য একাই থাকতো। আরেকটা কথা ম্যাডাম, আমার এই বাড়িতে একটা ব্যাংক আছে, তাই এখানে কে কখন ঢুকছে তা খোঁজ রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
লগ্নজিতা বললো, তা এমন একটা অসহায় মেয়ের খোঁজ খবর নিতেও কখনো যাননি বলছেন তিনতলায়? ভ্রু কুঁচকে ঘোষাল বললো, আমার চরিত্রের দোষ আছে বলে তো কেউ জানে না এ অঞ্চলে, এখন আপনাদের হাতে পড়ে কি সে দোষেরও ভাগীদার হতে হবে?
লগ্নজিতা সুর বদলে বললো, তা লাবণ্য খুন হয়েছে এটা আপনাকে প্রথম কে বললো? একটু সাবধানী গলায় শুভদীপ বললো, ওই যে গোপাল খবর দিলো। বাড়ির কেয়ারটেকার। রেগুলার পাম্প চালিয়ে ও সকলকে বলে আসতো, ডাইরেক্ট লাইনে যেন খাবার জলটা ধরে রাখে। সেদিনও সন্ধের দিকে পাম্প চালিয়েছিল রাতের জল ধরার জন্য, তখনই লাবণ্যকে ডেকে পায়নি। ভেবেছিল বাইরে গেছে। কিন্তু কোলাপসিবল দিয়ে দেখেছিল ড্রয়িংয়ে লাইট জ্বলছে। তাই কোলাপসিবল ঠেলে ভিতরে ঢুকেছিলো। তালাও দেওয়া ছিলো না দরজায়। তারপর ওই আবিষ্কার করেছিল লাবণ্য সিলিং থেকে ঝুলছে।
লগ্নজিতা রেগে গিয়ে বললো, খুন হয়েছে বুঝলেন কি করে? ঘোষাল অবাক হয়ে বললো, আপনাদের থানার একজন অফিসারই তো সব দেখে বললেন এটা মার্ডার। কারণ ঘরের ভিতরে কোনো জিনিসই নাকি মেঝেতে পড়ে ছিলো না। আর খাটের ওপরে কোনো টুল ছিলো না। খাট থেকে ফ্যান নাগাল পাবে না লাবণ্যের যা হাইট তাতে। তবে হ্যাঁ, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে এসেছে শ্বাসরোধ করে মারা গেছে। তাই খুন কিনা সেটা জানা যায়নি।
লগ্নজিতা বিরক্ত হয়ে বললো, এগুলো আমি জানি, আমার জুনিয়র এগুলো বলেছে। আমি বলতে চাইছি আপনি কেন থানায় ফোন করে বলেছিলেন যে আপনার এক ভাড়াটে খুন হয়েছে? উনি তো সুইসাইডও করতে পারেন। ঘোষাল ছটফট করে বললো, অসম্ভব। যখন ওর খাওয়ার টাকা ছিলো না, তখন ও আত্মহত্যা করেনি আর যখন ওর ব্যাগভর্তি টাকা রয়েছে তখন সুইসাইড কেন করবে?
লগ্নজিতা তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে বললো, তার মানে পুলিশ আসার আগেই আপনি ওর ঘর চেক করেছিলেন তাই তো? ঘোষাল বললো, কি মুশকিল, আরে আমার ভাড়াটিয়া সন্ধেবেলা রহস্যজনকভাবে মারা গেল, কিছুটা তো বুঝতেই হবে!
লগ্নজিতা এবার ওর নিজস্ব পদ্ধতিতে ক্রস করতে শুরু করলো, তাহলে গোপাল গিয়ে আপনাকে ফোন করলো তাই তো? আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
ঘোষাল বললো, আমি আমার এই অফিসে ছিলাম। শ্যামবাজারেই ছিলাম। দুজন স্টাফও ছিলো। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।
লগ্নজিতা বললো, আপনার জেঠিমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। ঘোষাল একটু আমতা আমতা করে বললো, আসলে লাবণ্যকে জেঠিমা খুবই ভালোবাসতেন তাই মুছড়ে পড়েছেন। বয়েস হয়েছে তো কখন যে কি বলেন। ওনার সঙ্গে কথা বলে বিশেষ কিছু লাভ হবে না। লগ্নজিতা ঝটিতে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, বেশ মিস্টার ঘোষাল আজ চললাম, আবার দেখা হবে আপনার সঙ্গে। সেদিন আমি রানীভবনের ভিতরে ঢুকবো। আজ বাইরে থেকেই বিদায় নিলাম। লগ্নজিতা বেশ বুঝতে পারছিলো, ঘোষাল মিথ্যে বলছে। সেই অসংগতির সূত্রটা খুঁজে বের করতে হবে ওকে।
.