চিত্তহরণ আর যযমান পরিবার
শ্মশান কালীর স্বপ্ন দেখছি চিত্তহরণ প্রায় দিন সাতেক ধরে। গতকাল রাতেও দেখেছি, মায়ের জিহ্বা থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্তবিন্দু মাটিতে পড়ে ভেসে যাচ্ছে আমার বাগানবাড়ি। এর কার্যকারণ কিছু বলতে পারো?
ব্রাহ্মণ জমিদার শশাঙ্ক নারায়ণ রায়চৌধুরীদের বাড়িতে গৃহলক্ষ্মীর পুজোর তালিকা নিতেই এই সন্ধেবেলা চিত্তহরণ এসেছেন বিষপুরের শেষ প্রান্তে।
বিশাল এলাকা নিয়ে শশাঙ্ক নারায়ণের বাড়ি। তিন ভাইয়ের যৌথ পরিবার। প্রতিদিন অন্তত পঞ্চাশ জনের পাত পড়ে তাদের রান্নাবাড়িতে। বিষপুরের সম্ভ্রান্ত জমিদার বলে পরিচিত এই রায়চৌধুরীদের পরিবারটি। বিষপুরে কারোর কোনো প্রয়োজনে হাত উল্টিয়ে সাহায্য করেন স্বয়ং শশাঙ্ক নারায়ণ। তাই এ তল্লাটে তাঁর বেশ সম্মান আছে। যে বাড়ির যাবতীয় পুজো আচ্চা করে থাকেন চিত্তহরণ। রায়চৌধুরী গিন্নি পদ্মবালাদেবীর মনখানিও আকাশের মত উদার। দেবদ্বিজে ভক্তি আছে। ব্রাহ্মণকে দান করেন মুক্তহস্তে। এ বাড়ির সকলেরই চিত্তহরণের ওপরে অপার বিশ্বাস। শশাঙ্ক নারায়ণের বয়েস প্রায় সত্তরের কোঠায়। যদিও তার সুঠাম চেহারা দেখে সেটা আন্দাজ করা সম্ভব নয়।
চিত্তহরণ ভাবিত মুখে বললেন, এ তো বড় চিন্তার বিষয় জমিদার মশাই। একদিন স্বপ্নে শশ্মান কালীর দর্শন পেলে না হয় স্বপ্নদোষ বলে কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু পর পর সাতদিন তাঁর দর্শন তো মোটেই সুবিধের কথা নয়।
অন্দরের মধ্যে থেকে একটু গুঞ্জন উঠলো। এবাড়ির সকল নারীরা অন্দরেই থাকেন। পুজোর আয়োজনের সময় একগলা ঘোমটা দিয়ে তবেই বের হন পরপুরুষের সামনে। চিত্তহরণ আবার বললেন, জমিদার মশাই তাঁকে ভিটাতে আনাটা কি সমীচীন হবে? সে বেটি তো আপনার ভিটাতে অধিষ্ঠিত হতে চাইছে। পদ্মবালা দেবী আশঙ্কার থেকেই বলে উঠলেন, তারপর যদি পুজোয় কোনোরূপ ভ্রান্তি হয়ে যায় তখন তো সমস্ত পরিবার ভিটে ছাড়া হয়ে অনাহারে মরবো। এ বাড়ি তখন শ্মশানে পরিণত হবে।
শশাঙ্ক নারায়ণ ভ্রু কুঁচকে বললেন, এমনিতেও বিষপুর খুব শীঘ্রই শ্মশানে পরিণত হবে। বিষপুর, রুদ্রনগর, পলাশপুর, রামবাতি এগুলো সবই বাদশাহ মিজানুরের অধীনে ছিল যখন তখন হিন্দু-মুসলিম কারোরই কোনো অসুবিধা হয়নি। যে যার নিজের নিজের ধর্ম নিয়ে আনন্দে ছিল। এমনকি আমাদের বিষপুরের নীলকণ্ঠের মেলার সময় দর্শনার্থীদের যাতে কোনোরকম সমস্যা না হয় সেইজন্য বাদশাহ জঙ্গলের ধারে দু দুটো পান্থনিবাস তৈরি করে দিয়েছিলেন। দর্শনার্থীরা ওখানে এসে বিশ্রাম নেয়। রুদ্রনগরে বাদশাহের সভায় অনেক হিন্দুরাও সসম্মানে বিভিন্ন রাজপদে আসীন ছিলেন। আমরা জমিদাররাও কোনো উপদ্রবে পড়িনি কখনও।
কিন্তু বাদশাহের এই আকস্মিক মৃত্যুর পরে সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। শুনেছি বাদশাহ পুত্র মুসাফির নাকি মন্ত্রী সুজান খানের কথায় পরিচালিত হন। আর এ তল্লাটে সুজান খানের তাণ্ডবের কথা সকলেই জানে। নেহাত বাদশাহ বড় ভালোমানুষ ছিলেন তাই সুজান তেমন কিছু করতে পারেনি। এবারে সুযোগ হাতছাড়া করবে না। তাই প্রথম সুযোগেই যুদ্ধে নেমে পড়েছে। বল্লভপুরের সীমানায় অবস্থিত আমাদের বিষপুর। এ যুদ্ধের আঁচে সব ছাড়খার না হয়ে যায়। এমনিতেই তো জমিদারদের ক্ষমতা খর্ব করে দেওয়া হবে এমনই সংবাদ বয়ে আনছে বাতাস।
চিত্তহরণ চিন্তিত গলায় বললেন, হ্যাঁ আজকেই পুজোর সময়ে দেখলাম, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গোপন পথ প্রস্তুত হচ্ছে বল্লভপুরের উদ্দেশ্যে। বিষপুরের সীমানায় বাদশাহের তাঁবুও প্রস্তুত হয়েছে। শেষে কি জাত-ধর্ম বিসর্জন দিতে হবে নাকি জমিদার মশাই?
শশাঙ্ক নারায়ণ বললেন, তাই আমি বলি কি, সে বেটির যদি আমার ভিটেতে আসার ইচ্ছেই থাকে তবে বাগানবাড়ির চত্বরে একটা মন্দির স্থাপন করে তাঁকে আনার ব্যবস্থা যে তোমাকেই করতে হবে চিত্তহরণ। চিত্তহরণ একটু ভেবে বললেন, শ্মশানকালীর প্রতিষ্ঠা তো আমি করতে পারবো না, তান্ত্রিক প্রয়োজন। সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পদ্মবালা দেবী কিছু একটা বলতে উদ্যত হলে তাকে থামিয়ে দিয়ে শশাঙ্ক নারায়ণ বললেন, তুমি আর অমত কোরো না গিন্নী। এ বড় ভয়ানক স্বপ্ন। তাঁকে না প্রতিষ্ঠা করলে সে আমায় ধ্বংস করবে। আমার রক্তে ভাসিয়ে দেবে বাগানবাড়ির উঠোন। তার থেকে বরং তাঁকে নিয়েই আসি। রক্ষা করলে সেই করবে, ধ্বংস করলেও সেই করবে।
চিত্তহরণ নিশ্চিত হয়ে বললেন, তবে আমি পুঁথি দেখে একটা ভালো দিন স্থির করি। যেদিন মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করবেন। চিত্তহরণ শশাঙ্ক নারায়ণের অনুমতি নিয়েই উঠে দাঁড়ালেন, বাড়ি ফিরতে হবে। অনেকটা পথ, সূর্য ডুবে গেছে। যেতে যেতে সন্ধের অন্ধকার নামবে। মধুবালা দুশ্চিন্তা করবে হয়তো।
.
ঠিক সেই মুহূর্তে শশাঙ্ক নারায়ণ বৈঠকখানা ঘরে যেন একটা কামান দাগলেন। প্রসন্ন মুখে বললেন, চিত্তহরণ তোমার কন্যাটি তো বিবাহযোগ্যা হলো। তার কি বন্দোবস্ত করলে? পাত্রস্থ করতে হবে তো কন্যাকে? শুনেছি রূপে-গুণে তোমার কন্যাটি অনন্যা। চিত্তহরণ কথার সূত্র খুঁজে না পেয়ে বিগলিত কণ্ঠে বললেন, আজ্ঞে মেয়েটি আমার খুবই লক্ষ্মীমন্ত। মা মরা মেয়ে, আদর তেমন পায়নি। নিজের মত করেই বেড়ে উঠেছে।
শশাঙ্ক নারায়ণ বললেন, মা লক্ষ্মীর কৃপায় ভাণ্ডার আমার পরিপূর্ণ। তবে ছোট ছেলেটির জন্য একটি সদবংশজাত কন্যার সন্ধানে আছি। যদি আপত্তি না থাকে তো তোমার কন্যার সঙ্গে আমার কনিষ্ঠ পুত্রের বিবাহ হতে পারে।
চিত্তহরণ কি বলবেন সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। শশাঙ্ক নারায়ণের কনিষ্ঠ সন্তানটি কথা বলতে পারে না। জ্ঞানগম্মি যে কম আছে তা নয়। বাবার সেরেস্তায় হিসেবপত্রও লেখে। তবে মুখে শব্দ নেই। মধুবালার মুখটা মনে পড়ে গেলো চিত্তহরণের।
মেয়েটা কি রাজি হবে? হয়তো বাবার সম্মানার্থে মুখে কিছু বলবে না। কিন্তু মনোকষ্টে থাকবে মধুবালা। চিত্তহরণেরই বা সে সামর্থ কোথায় যে বিষপুরের জমিদার শশাঙ্ক নারায়ণের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করবেন? চিত্তহরণের একটু ইতস্তত মুখভঙ্গিমা দেখেই পদ্মবালাদেবী বললেন, সকলের মত নেওয়া প্রয়োজন। পূজারী পুরোহিতের গৃহের কন্যাকে এ বাড়ির বউ করে আনতে সকলে সম্মত হবে কিনা এটাও তো …পদ্মবালাকে কথা শেষ না করতে দিয়ে শশাঙ্ক নারায়ণ রায়চৌধুরী গম্ভীরভাবে বললেন, এটা আমার অনুরোধ নয়, এটা আমার আদেশ। চিত্তহরণ সৎ ব্রাহ্মণ। কন্যাটিকেও নিশ্চয়ই সুশিক্ষায় মানুষ করেছে। অতএব সুশান্ত নারায়ণের সঙ্গে চিত্তহরণের কন্যার বিবাহ দেওয়াই আমি মনস্থির করলাম। চিত্তহরণ, আমি জমিদার বলে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করবো না এমন নয়। সমাজের নিয়ম মেনে আমরাই আসবো তোমার গৃহে, পাত্রী দেখতে।
চিত্তহরণ জানেন সুশান্ত বয়েসে অন্তত বছর আঠেরো-কুড়ির বড় হবে মধুবালার থেকে। কিন্তু এই মুহূর্তে এ সম্বন্ধ ফিরিয়ে দেবার মত সাহস ওঁর অবশিষ্ট নেই।
তাই চিত্তহরণ হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে শশাঙ্ক নারায়ণকে বলে এলেন, আপনার যেদিন ইচ্ছে হবে সেদিন আমার কুঁড়েতে পদধূলি দেবেন। শশাঙ্ক নারায়ণ হেসে বললেন, এই একটাই কাজ আমায় অসম্পূর্ণ রেখে পরপারে যেতে হতো। সুশান্তর বিবাহটা সম্পন্ন হলেই এ জীবনের দায়িত্ব থেকে মুক্তি। জোরে একটা শান্তির শ্বাস নিলেন শশাঙ্ক নারায়ণ রায়চৌধুরী।
চিত্তহরণ ধীর পায়ে অবসন্ন শরীরে বাড়ির পথ ধরলেন।