লগ্নজিতার নিজের কথা
ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরটা নিজের বিছানায় এলিয়ে দিলো লগ্নজিতা। এই সময়ে মায়ের একটা ফোন আসবেই। গতানুগতিক একই কথা, কাজের প্রেসার থাকলেও সময়মত খেয়ে নিবি, হাত-পা ধুবি বাইরে থেকে ফিরে। বিয়ের কথা কিছু ভাবলি? ঝিনুকমাসির মেয়ে কঙ্কনারও বিয়ে হয়ে গেলো জানিস জিতা। আমি অবশ্য সকলকে বলেই দিয়েছি, জিতা নিজে যেদিন রাজি হবে বিয়ে করতে সেদিন দেবো, তার আগে আমি ওকে কোনো জোর করবো না। এসব বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মা লগ্নজিতার বিয়ের প্রস্তাবটাই উত্থান করতে চায় বারংবার। বালিশের পাশে রাখা ফোনটা সময়মতই ভাইব্রেট করে উঠলো। মা কল করছে। ও জানে মা এই একই কথার পুনরাবৃত্তি করবে তবুও মায়ের এই ফোনটার জন্য অপেক্ষা করে থাকে ও। সত্যি বলতে কি কাজের বাইরে এই একটা ফোনই থাকে অপ্রয়োজনীয় অথচ ভীষণরকমের কাছের। ফোনটা ধরতেই মা উত্তেজিত গলায় বললো, জানিস তো আজ তন্ময়ের মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। ভদ্রমহিলা এখনও অনুতপ্ত রে নিজের ছেলের অমন ব্যবহারে। তোকে নিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন। আশীর্বাদ করলেন, তুই যেন অনেক বড় হোস। তন্ময়কে তো প্রায় ত্যাজ্যই করে দিয়েছেন ওনারা। বিরক্তির গলায় লগ্নজিতা বললো, মা আমি এনাফ টায়ার্ড। আমার সময় নেই প্রাক্তনকে নিয়ে গল্প শোনার। তাছাড়া আমি ফেলে আসা দিনের দিকে তাকাতে পছন্দ করি না তুমি তো জানো। তারপরেও আজ হঠাৎ তন্ময় কেন? মা একটু অস্বস্তির গলায় বললো, না মানে ওর মায়ের সঙ্গে মলে দেখা হয়ে গিয়েছিল তাই আর কি। যে ছেলেকে তার নিজের বাবা-মা ত্যাজ্য পুত্র করে তাকে মনে রেখে ‘বিয়ে করবো না’ সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বোধহয় খুব ভুল হবে।
লগ্নজিতা স্থির গলায় বললো, তাকে মনে রেখে নয় মা, স্বাধীনভাবে বাঁচবো বলেই বন্ধনে জড়াতে চাই না। মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, যা ভালো বুঝিস। নে তোর বাবার সঙ্গে কথা বল।
বাবা ফোনটা ধরেই বললো, কেমন আছিস? হলদিয়া কবে আসবি? কাজের প্রেসার খুব? নাকি আবার নেশায় মেতেছিস। এক্স কর্নেল মিস্টার দেবাশীষ ভট্টাচার্যকে শুধু বাবা হিসাবেই নয় তার অভিজ্ঞতার জন্যও সম্মান করে ও। একটু থেমে বললো, বাবা একটা জগাখিচুড়ি কেস নিয়েছি। আমিই ইনভেস্টিগেটিং অফিসার কেসটার, কিন্তু ওই আরকি, সুইসাইড বলে চালিয়ে দেওয়া যেত কিন্তু ওটা মার্ডার, আমি মনে করি। তাই কেসটা নিয়ে ভাবছি একটু।
বাবা অল্প হেসে বললো, ছোটবেলায় আমার সার্ভিস রিভলবারটা হাতে নিয়ে বলতিস, এটা দিয়ে যাকে খুশি মেরে দেওয়া যায়? রাক্ষসদেরও মেরে দেওয়া যায়? এখন বুঝছিস তো, মাথার মধ্যে যদি সত্যি খোঁজার নেশাটা একবার নড়ে ওঠে তাহলে কাউকেই মারা যায় না, যতক্ষণ না আসল খুনিকে তুই আবিষ্কার করতে পারছিস। রেস্ট নে। আর শোন, তোর মাকে দুদুভাতুই রাখ। নিজের মনের মত করে বাঁচ। লগ্নজিতা হেসে বললো, বাবা, ইউ আর মাই ওয়ান এন্ড অনলি হিরো।
ফোনটা রাখতেই বহু দিন পরে আবার তন্ময়ের মুখটা মনে পড়লো। কি অদ্ভুত রকমের বিশ্বাস করতো ও তন্ময়কে। মনে করতো তন্ময় ওর জন্য নিজের জীবন অবধি দিয়ে দিতে পারে। যেদিন প্রথম জেনেছিলো তন্ময় শুধু ওকেই ভালোবাসে না, আরেকটা জিনিসও মারাত্মক ভালোবাসে সেটা হলো টাকা; নিজের মায়ের সব গয়না চুরি করে বেচে দিয়েছে সেদিন প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছিলো ও। দ্বিতীয় ধাক্কাটা অবশ্য তন্ময় বেশ জোরেই মেরেছিলো লগ্নজিতার ভালোবাসার ঘরে।
লগ্নজিতাকে বলেছিলো, তুমি তো একমাত্র সন্তান তোমার বাবার, তাহলে নিশ্চয়ই তোমাদের তিনতলা বাড়িটা আর সমস্ত সম্পত্তি আমিই পাব? ব্যাংকের সামান্য কেরানি বলে লগ্নজিতা কোনোদিন ওকে কম ভালোবাসেনি। কিন্তু এই আগ্রাসী লোভের কারণেই তন্ময়কে দূরে ঠেলে দিয়েছিলো ও। আর যাইহোক লোভী মানুষটাকে প্রেমিক ভাবতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল ওর। নিজেকে শক্ত করেছিলো ও। দাঁড়িপাল্লায় বসিয়েছিলো আত্মসম্মান আর ভালোবাসাকে। একটু হলেও আত্মসম্মানের পাল্লাটা নীচে নেমে গিয়েছিল। তাই ভালোবাসাকে বিদায় জানিয়েছিলো ও, তন্ময়ের সঙ্গে ব্রেকআপ করার সময় শুকনো চোখে তাকিয়ে লগ্নজিতা বলেছিলো, বিশ্বাস বড্ড ঠুনকো বস্তু। ভীষণরকমের ভঙ্গুর। একবার ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না। জোর করে জোড়া লাগলেও আবার সেই ভাঙার দাগে দাগে ফাটল ধরে। সেই ফাটল দিয়ে খুব সহজেই গলে পালিয়ে যেতে পারে ভালোবাসা নামক চিরসুখী অনুভূতিটা। অগত্যা এখানেই ইতি টানলাম আমাদের সম্পর্কের। লোভী চকচকে দৃষ্টির সামনে পরাজিত হলো আমার ভালোবাসা। তন্ময়ের বাবা-মাও জানতো ওদের সম্পর্কের কথা। দুই বাড়িতেই কোনো আপত্তি ছিল না সম্পর্কটা ঘিরে। কিন্তু লগ্নজিতা হাঁসফাঁস করে বেরিয়ে এসেছিলো ওই ভালোবাসা নামক ফাঁদ থেকে। বর্ণিতার মুখটা মনে পড়ে গেলো লগ্নজিতার। মেয়েটাও ওর মতই বিশ্বাস করে অব্যয়কে। তাই অব্যয় যে লাবণ্যের বাড়িতে যেতে পারে এটাই যেন অবিশ্বাস্য ছিলো বর্ণিতার কাছে। লগ্নজিতা সেদিন বর্ণিতার চোখে বিশ্বাসভঙ্গের কষ্ট দেখেছিলো। ইদানীং অবশ্য বিভিন্ন কেস হ্যান্ডেল করে করে কষ্ট-যন্ত্রণার অনুভূতিগুলো বেশ হালকা হয়ে গেছে। আগের মত বুকের বাম দিকে চেপে বসে থাকে না। এখন অফিসার লগ্নজিতা ভট্টাচার্য বডিকে পোস্টমর্টেমে পাঠিয়েই চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে প্রজাপতি বিস্কিটে কামড় দিতে দিতে বলতে পারে, ভদ্রলোকের বাচ্চা-কাচ্চা আছে নাকি? ওনার স্ত্রী কি করেন? মারা গেলেন কিভাবে, লরি অ্যাক্সিডেন্টে?
.
নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটলো ওর। একসময় লগ্নজিতার বুকের বামদিকে লাবডুব আওয়াজ হতো, ভয়ে-দুঃখে-আনন্দে। রাস্তা দিয়ে শবযাত্রীরা যখন বলো হরি হরি বোল করে এগিয়ে যেত ও তখন ওদের হলদিয়ার বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে মায়ের আঁচলে মুখ ঢাকতো। অজানা মৃত মানুষটির কথা ভেবে চোখে জল আসতো। মনে হতো আহা রে ওদের বাড়ির লোক না জানি কত কাঁদছে। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো, মেয়ে আমার ডাক্তারি কোনোদিন পড়তে পারবে না। এমন নরম মন নিয়ে কি ডাক্তারি পড়া যায়? তখন কি আর মা ভেবেছিলো তার মেয়ে এনকাউন্টার বিশেষজ্ঞ হবার জন্য বিশেষ ট্রেনিং নিতে চায়! বদলে যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় মানুষ আর তার মানসিকতা। নরম সংবেদনশীল মনটা বারবার আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে শক্ত একটা খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয় নিজেকে। কখনো কষ্টে রক্তক্ষরণ চললেও সেটা চুঁইয়ে বাইরে আসার অবকাশ থাকে না কখনো।
লগ্নজিতা এখন এতটাই কঠিন করে গড়েছে নিজেকে যে জন্ম আর মৃত্যু ওর কাছে একইরকম ভাবে ধরা দেয়। বর্ণিতা, কুণাল, স্বর্ণদীপ, রক্তিম, গুঞ্জা এদের সঙ্গে বা অব্যয়ের অফিস কলিগদের সঙ্গে আলোচনা করে যেটুকু বুঝেছে তাতে অব্যয় নামক প্রফেসরটি বেশ আত্মঅহংকারী। কলেজ লাইফ থেকেই নিজেকে নিয়ে সচেতন। এরা ওকে যতটা বন্ধু ভাবে সম্ভবত ও ভাবে না। বাবা,মা, দাদা পরিবারের সঙ্গে কোনো সদ্ভাব নেই। কলিগরা বলেছেন, অত্যন্ত ভদ্র মানুষ, কাজপাগল, বিশেষ করে ছবি পাগল মানুষ। ক্লাস কামাই করেন না। তবে একটু উদাসীন টাইপ। সে নাহয় শিল্পীরা অমন একটু পাগলাটে গোছের হয়। আর পাঁচটা সাংসারিক মানুষের মত একই গোত্রে তাদের ফেলা যায় না। বর্ণিতা মেয়েটা সেই কলেজ থেকেই অব্যয়কে ভালোবাসে একনিষ্ঠ ভাবে। অথচ একটা জিনিস লগ্নজিতার খটকা লেগেছে। সব বন্ধুদের ওর ফার্স্ট এক্সিবিশনে নিমন্ত্রণ করলেও কেন বর্ণিতাকে জানালো না? অথচ বর্ণিতাই একমাত্র উপযাচিত হয়ে যেত ওর সঙ্গে দেখা করতে। তাই অন্য বন্ধুদের থেকে বর্ণিতার সঙ্গেই যোগাযোগ বেশি ছিলো। অথচ ওকেই এড়িয়ে গেলো জীবনের ফার্স্ট এক্সিবিশনে। লগ্নজিতার এতদিনের বিশ্বস্ত স্পাই পরিষ্কার জানিয়েছে অব্যয়ের রীতিমত লাবণ্যর ঘরে যাতায়াত ছিলো। যদিও ঘোষালবাবু সেভাবে কিছু বলতে পারলেন না। পারলেন না, নাকি বললেন না! অব্যয়ের বন্ধুরা তো কেউই বিশ্বাস করতে রাজি নয় যে ও লাবণ্যের মত একজন অর্ধশিক্ষিত প্রস্টিটিউটের কাছে যেতে পারে। ওর বন্ধু কুণাল বললো, যে কোনো হাইক্লাস মেয়ে নাকি অব্যয়ের জন্য ফিদা, তাই ওর পক্ষে লাবণ্যের কাছে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। লাবণ্য যে মুনলাইটে যেত এবং বিজনেস করতো সে খবর লগ্নজিতার কাছে আছে। বাড়িতে বোধহয় রানীবালা দেবীর জন্যই লিমিটেড লোকজন আসতো। অব্যয় মুনলাইটে যেত না, লাবণ্যের ঘরে আসতো সেটাও জানে ও। বিষয়টা ক্রমাগত জটিল হয়ে যাচ্ছে। লাবণ্যকে মেরে দিয়ে কার কি লাভ সেটাই তো বোঝা গেলো না। ওর ঘরে ব্যাগের মধ্যে এতগুলো টাকা এলো কোথা থেকে! কেউ যদি টাকার লোভে ওকে মেরে দেয় তাহলে টাকাগুলো কেন ফেলে রেখে গেলো! লগ্নজিতা চোখ বন্ধ করলো। ঘুমাতে হবে, একটা গভীর ঘুম। মস্তিষ্কের বিশ্রাম দরকার। ভাবো লগ্নজিতা ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো। তন্ময়ের মত পরিত্যক্ত স্মৃতি এসে যেন কোনো ভাবেই তোমার চিন্তাশক্তিকে এলোমেলো না করে দিতে পারে। আফশোস হচ্ছে লগ্নজিতার। কেন যে লাবণ্যের মৃত্যুর খবরটা পেয়ে নিজে না এসে জুনিয়রকে পাঠালো, কে জানে ওর ঘরে কোনো প্রমাণ লোপাট হলো নাকি? বড়বাবু মানুষটাও বড্ড ক্যাজুয়াল সব ব্যাপারে। হয়তো নোটিসই করেননি তেমন কোনো ক্লু ছিল। বড়বাবুও তো সঙ্গে ছিলেন। আগামীকাল আচমকা হানা দিতে হবে রানীভবনে। ঘোষাল লোকটা ঝানু ব্যবসাদার। ওকে না জানিয়ে যেতে হবে। নাহলে লাবণ্য সম্পর্কে কিছুই জানা যাবে না।
.