রক্তিম আর গুঞ্জাকে জেরা
তারপর বলুন রক্তিমবাবু, অব্যয়বাবু যে রানীভবনে যেতেন আপনি জানতেন?
রক্তিম কিছু বলার আগেই গুঞ্জা বললো, না না, ও কি করে জানবে? অব্যয়ের সঙ্গে ওর দেখাই তো তেমন হতো না। লগ্নজিতা বিরক্তির স্বরে বললো, গুঞ্জাদেবী, আপনার স্বামী বোবা,কালা বা বুদ্ধিহীন কোনোটাই নয়। তাহলে উত্তরটা আমি ওনার কাছ থেকেই শুনি বরং। গুঞ্জা চুপ করে সোফার একটা হাতলের ওপরে সুতোর কাজের দিকে মনোযোগ দিলো। নিজের ড্রয়িংরুমে নিজেরাই ভয়ে ভয়ে বসে আছে।
স্বর্ণদীপ একদম ঠিকই বলেছিলো, এই পুলিশ অফিসারটা কোনো ভদ্রতার ধার ধারে না। মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে পেটের ভিতরের লুকানো কথা বের করে প্যাঁচে ফেলবে। রক্তিম এমনিতেই একটু পেট পাতলা তাই ভয়ে ভয়ে প্রমাদ গুনলো গুঞ্জা।
লগ্নজিতা আবারও রক্তিমের দিকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে ঘুরে গিয়ে বললো, হ্যাঁ রক্তিমবাবু, আপনি বলুন। আমাকে পুলিশ, গোয়েন্দা না ভেবে বন্ধু ভাবুন। দিয়ে আমার কাজে একটু সাহায্য করুন। এতে আখেরে লাভ আপনাদেরই। আপনাদের উত্তরে আমি সন্তুষ্ট হলে, বারবার আপনাদের কমপ্লেক্সের সামনে পুলিশ ভ্যান দাঁড়াবে না। যতই হোক, মধ্যবিত্ত মানসিকতায় পুলিশদের লোকে এখনও ব্রাত্য করে রেখেছে। তাই কারোর বাড়িতে চা খেতে যেন পুলিশের আসা বারণ। পুলিশ ঢুকলো মানেই কিছু গন্ডগোল আছে। কানাঘুষো, উঁকিঝুঁকি, কৌতূহলী চোখের দৃষ্টি…এসবের থেকে রেহাই পেতে চটপট কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিন দেখি। অব্যয় যে লাবণ্যের বাড়িতে যেত আপনি জানতেন?
রক্তিম গুঞ্জার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে বললো, আমি কি করে জানবো বলুন? ওর কলেজ আর আমার স্কুল সম্পূর্ণ আলাদা দিকে।
আপনার স্কুল তো রানীভবনের কাছেই। তো স্কুল ফেরত কোনোদিন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়নি বলছেন?
রক্তিম ‘না হয়নি’ বলে উড়িয়ে দিতে যাচ্ছিলো। তখনই চোখে পড়লো লগ্নজিতা তীক্ষ্ন নজরে তাকিয়ে আছে রক্তিমের মুখের শিরা-উপশিরার উত্থানপতনের দিকে। সেখানে যেন এক্সরে চলছে, একটা মিথ্যে বললেই বিপবিপ আওয়াজে জানিয়ে দেবে। রক্তিম আমতা আমতা করে বললো, হয়েছিলো একদিন। আমি স্কুল থেকে ফিরছিলাম, তাড়ায় ছিলাম, তাই বিশেষ কথা বলা হয়নি সেদিন।
আর তাছাড়া রানীভবনের কাছে আমার স্কুল নয়। ওখান থেকে বেশ খানিকটা দূর আছে। আমাদের স্কুলের পাশের গলি দিয়েই আমরা শর্টকাট করি। বড় রাস্তা দিয়ে আসি খুব কমদিনই।
লগ্নজিতা আলতো হেসে বললো, গুঞ্জাদেবী একগ্লাস জল পাওয়া যাবে?
গুঞ্জা ইতস্তত করে সোফা ছেড়ে উঠতেই, লগ্নজিতা বললো, শুধু জল কিন্তু। ডিউটিতে থাকাকালীন আমি আর কিছু খাই না।
গুঞ্জা কিচেনের দিকে যেতেই লগ্নজিতা গলার স্বর আরেকটু নামিয়ে বললো, তো বন্ধুকে ওখানে দেখে একটু আশ্চর্য হয়ে যাননি? মানে কোনো প্রশ্ন জাগেনি, অব্যয় এখানে কি করছিস টাইপ প্রশ্নও করেননি এতটাই তাড়া ছিলো?
রক্তিম ঢোক গিলে বললো, হ্যাঁ করেছিলাম। ও বললো, মডেলের খোঁজে এসেছে। তারপর চোখের ইশারায় বলেছিলো, যদিও তোর মত স্কুলের ড্রয়িং স্যারের কখনোই প্রয়োজন হবে না মডেলের। তবে আলাপ করে দেখতে পারিস, একবারে জংলী ফুলের গন্ধ। নাক থেকে চোখ সব জ্বলবে।
রক্তিম বলেছিলো, কে সে?
অব্যয় ভ্রু নাচিয়ে বলেছিলো, গুঞ্জা ওয়েট করছে, যা ভাগ। তোকে আর টক ফলের স্বাদ নিতে হবে না, বদহজম হয়ে গিয়ে বমি করবি। রক্তিম ওর হেঁয়ালি বুঝতে পারেনি। তাই চলে এসেছিলো।
জলটা শেষ করে লগ্নজিতা বললো, আপনার ফ্ল্যাটটা কিন্তু দুর্দান্তভাবে সাজিয়েছেন। কোনো ডিজাইনারকে দিয়ে করালেন?
গুঞ্জা একটু থতমত খেয়ে বললো, না না আমি নিজেই সাজিয়েছি। আমার নিজস্ব বুটিক আছে। জামাকাপড়ের নয়। ঘর সাজানোর জিনিসপত্রের। আমি নিজের মত করে ডিজাইন করে সমস্ত কিছুকে ইউনিক বানানোর চেষ্টা করি। আমার বুটিকের পিছনেই ওয়ার্কশপ আছে। লগ্নজিতা ওর প্রশ্নের ট্র্যাক খুঁজে পেয়েই আন্দাজে একটা জোরে ঢিল ছুঁড়লো। তো আপনাদের কমন ফ্রেন্ড অব্যয় কোনোদিন আসেনি সেখানে কোনো জিনিস কিনতে? মানে আপনাদের কাছে থেকে যতটুকু শুনেছি তাতে তো একটা জিনিস ক্লিয়ার, অব্যয় মানুষটা একটু ব্যতিক্রমী। তাই ইউনিক জিনিসের খোঁজ যে তিনি করবেন এটাই স্বাভাবিক।
গুঞ্জা একটু ভেবে বললো, হ্যাঁ এসেছিলো দিনদুয়েক। রক্তিম অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, কই আমায় বলিসনি তো?
লগ্নজিতা খেয়াল করলো, এরা দুজনে দুজনকে তুই আর তুমি দুটোই বলে।
গুঞ্জা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, এতে বলার আবার কি আছে? দিনে কত কাস্টমার আসছে। সকলের কথা কি মনে করে বলা সম্ভব? আর তাছাড়া তুইও বলিসনি অব্যয় তোকে এমন একটা মডেলের সঙ্গে পরিচয় করাতে গিয়েছিলো!
লগ্নজিতা বুঝলো, পজেসিভনেসটুকু এখনও এদের সম্পর্কে বেঁচে আছে। তাই সেটুকু যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সেভাবেই বললো, অব্যয় সেদিন ঠিক কি কিনেছিলো আপনার মনে আছে গুঞ্জা?
অব্যয়কে প্রথম দেখার দিন থেকে আজ পর্যন্ত ওর সঙ্গে হওয়া অব্যয়ের সব টুকরো কথাই মনে আছে গুঞ্জার। কিন্তু এক্ষেত্রে বেশি জড়ানো ঠিক নয় বুঝেই বললো, সরি ঠিক মনে করতে পারছি না।
একটা কাঠের শঙ্খ বের করে টেবিলে রেখে লগ্নজিতা বললো, এটা কি আপনার বুটিক থেকে কেনা ?
কাঠের শঙ্খটার মুখে মানে যেখানে ফুঁ দিয়ে শঙ্খনিনাদ তোলা হয় সেইখানে গোটা পাঁচেক ফুটো রয়েছে। যেগুলোকে ব্যবহার করা হয় ধুপদানি হিসাবে। লাবণ্যের ঘরে ঢুকে গোটা চারেক বিষয়ের ওপরে নজর আটকেছিলো লগ্নজিতার। তারমধ্যে এই ইউনিক ধুপদানিটা অন্যতম।
গুঞ্জা বললো, হ্যাঁ এটা আমার বুটিক থেকেই কিনেছিলো অব্যয়। এছাড়া কিছু বিডসের মূর্তি কিনেছিলো। তার মধ্যে…
ওকে কথাটা শেষ না করতে দিয়েই লগ্নজিতা বললো, এটা কি না দেখুন তো। এর নিচেও লেখা আছে ‘রাজনন্দিনী বুটিক’। একটা অদ্ভুত সুন্দর নটরাজ মূর্তি। গুঞ্জার নিজের হাতের ডিজাইন করা।
গুঞ্জা একটু অস্বস্তি গলার স্বরে মিশিয়েই বললো, এগুলো আপনার কাছে কি করে এলো?
লগ্নজিতা সেন্টার টেবিলের কাঁচের ওপরে জিনিস দুটো নামিয়ে রেখে বললো, লাবণ্যের ঘর থেকে। গুঞ্জার মুখটা মুহূর্তে কালচে হয়ে গেলো। নজর এড়ালো না লগ্নজিতার। আলতো করে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে বললো, লাবণ্য সম্পর্কে অব্যয় তার মানে কোনো বন্ধুর কাছেই সেভাবে কিছু বলেনি! কেন বলেনি? লাবণ্যর সঙ্গে সম্পর্কটাকে আড়াল করে রাখতে চেয়েছিলো হয়তো। ওর কথার সূত্র ধরে গুঞ্জা বললো, আর বর্ণিতা বোকার মত ওর জন্য বিয়ে না করে একা একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকলো।
রক্তিমের ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। লগ্নজিতা ইশারায় বললো, রিসিভ করে নিন। রক্তিম উঠে গেলো পাশের ঘরে।
লগ্নজিতা বললো, আপনার ডিজাইন করা জিনিসদুটো লাবণ্যের রুমে পাওয়া গেছে জেনে আপনি একটু আপসেট মনে হলো, কেন গুঞ্জাদেবী? এগুলো কেনার সময় কি অব্যয়বাবু আপনাকে বিশেষ কিছু বলেছিলো? যদি একান্ত ব্যক্তিগত না হয় তাহলে বলতে পারেন। আমার কেসের কাজে লাগতে পারে।
গুঞ্জার মনে পড়ে গেলো অব্যয়ের ওর বুটিকে প্রথমদিন আসার মুহূর্তটা। গুঞ্জা কাউন্টারের পিছন দিকে বসে হিসেব মেলাচ্ছিলো সারাদিনের।
কেউ একজন ব্যারিটন ভয়েসে বলেছিলো, সবুজে তোকে ভারি মানায় তো। ঠিক যেন বসন্তের নতুন পাতা! ইস কলেজে ভারি ভুল হয়ে গেছে, আমি যদি ভালো করে দেখতাম তাহলে রক্তিম ব্যাটাকে সুযোগই দিতাম না। গুঞ্জা কিছু বোঝার আগেই চুলের ব্যাকক্লিপটা এক টানে খুলে দিয়ে বলেছিলো, খোলা চুলে আনমনা লাগে বেশি। সঙ্গে আকর্ষণীয়, বুঝলি!
বুটিকটা এক চক্কর দিয়ে বলেছিলো, করেছিস কি! এত দুর্দান্ত কালেকশন। ইউনিক সব পিস। আমাকে বর্ণিতা বলেছিলো বটে, তুই নাকি একটা ব্যাপক বুটিক খুলেছিস। আমার তো মাথার অবস্থা জানিস, সেখানে অর্ধেক জিনিসের স্থান সংকুলান হয়। তাই বুটিকের নামটা মাথা থেকে জাস্ট বেরিয়ে গিয়েছিলো। এখন একটা গিফট কিনবো বলে রাজনন্দিনীর সামনে দাঁড়ালাম। কাঁচের বাইরে থেকেই মালকিনকে দেখে মনে হলো, তাহারে যে চিনি চিনি মনে হয়।
গুঞ্জা অকস্মাৎ চমকটা কাটিয়ে উঠে বললো, আমার বুটিকে দ্য গ্রেট আর্টিস্টের পায়ের ধূলি পড়লো বলে কথা, বল কি খাবি।
অব্যয় হেসে বলেছিলো, নেহাতই যদি খাওয়াতে চাস তাহলে পাশেই একটা চাইনিজ কর্নার আছে, এনিথিং নিয়ে আসতে বল। গুঞ্জা কনককে খাবারের অর্ডার দিয়ে বললো, বল কি ধরনের গিফট চাস? কাঠের শঙ্খটা হাতে তুলে অব্যয় বলেছিলো, এটা তোর ডিজাইন? অসহ্য রকমের সুন্দর তো।
গুঞ্জাদের ব্যাচের একটা মেয়েও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না, যে তার রাতের স্বপ্নে একদিনও অব্যয় এসে উপস্থিত হয়নি প্রেমিক রূপে।
রক্তিমের সঙ্গে প্রেমের অনেক আগে থেকেই অব্যয়কে ভালো লাগতো গুঞ্জার।
স্বর্ণদীপ রেগে গিয়ে বলতো, তোরা যে ঠিক কি দেখিস ওই প্লে বয়টার মধ্যে কে জানে! দিনরাত ফ্লার্ট করে বেড়াচ্ছে। আর মুখে বড় বড় কথা। ভালোবাসা বা সম্পর্কের বন্ধনে জড়ালে যদি রংতুলি পালায় আমায় ছেড়ে, তাই এসব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখি!
যত ভাও খাওয়া লেকচার বুঝলি। আর তোরা মেয়েরা ওকে নিয়ে হ্যাংলামি করিস বলেই ওর এত বেশি অহংকার। এসব শোনার পরেও অব্যয়ের প্রতি এতটুকু আগ্রহ কমেনি গুঞ্জার বা অন্য কারোর।
আসলে অব্যয়ের উপস্থিতিটাই ছিল ভীষণ রকমের জমকালো। ওর গলার স্বর, ওর অগোছালো অথচ অতি সচেতনভাবে চুজ করা পোশাক-আশাক।
ওর কথা বলার ওই অন্যমনস্ক ধরনটাই চুম্বকের মত আকর্ষণ করতো গুঞ্জাকে। তবে কোনোদিন কাউকে বলেনি ও। কারণ অব্যয় যে অধরা সেটা বেশ বুঝেছিলো। বর্ণিতা অব্যয়কে ভালোবাসে এ কথা গোটা ক্লাস জানতো। কিন্তু গুঞ্জারও যে দুর্বলতা ছিল ওর প্রতি সেটা বোধহয় গুঞ্জার একান্ত মনটা ছাড়া আর কেউই জানে না।
তারপরে আচমকাই রক্তিম ওকে প্রপোজ করে বসে। তখনও গুঞ্জার মনে অব্যয়ের নিঃশব্দ পদচারণা। কিন্তু অব্যয়ের মনের কোনো অলিগলিতেও যে গুঞ্জার নামের প্রথম অক্ষরও নেই সেটা ও বেশ জানতো। তাই রক্তিমকে প্রথমে না করলেও ধীরে ধীরে ওদের সম্পর্কটা জমাট বেঁধেছিল অব্যয়ের সক্রিয়তায়। অব্যয়ের একটা অদ্ভুত স্বভাব ছিলো, কোনো বন্ধু-বান্ধব প্রেমে পড়লে তাকে ও বিশেষভাবে সাহায্য করতো।
অব্যয়, বর্ণিতা, স্বর্ণদীপ, কুণাল, রক্তিম আর গুঞ্জাদের বন্ধুত্বটা ছিল চোখে পড়ার মত। ওরা মোটামুটি ক্যান্টিনে বা সিনেমায় একসঙ্গেই যেত।
অব্যয়ই জোর করে রক্তিম আর গুঞ্জাকে সব জায়গায় পাশাপাশি বসিয়ে দিয়ে বলতো, এখন থেকেই অভ্যেস কর। রক্তিমের সহজ সরল ব্যবহারের জন্যই হয়তো ধীরে ধীরে গুঞ্জার মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলো রক্তিম। বর্ণিতার আর কাউকে ভালোবাসা হয়ে ওঠেনি কখনও। অব্যয় নামক মরীচিকাকে আগলে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস করতে গিয়ে ঘর বাঁধাই হলো না এখনও। স্বর্ণদীপ ভীষণ রকমের আগ্রহী ছিলো বর্ণিতাকে নিয়ে। কিন্তু বর্ণিতা অব্যয় নামের গন্ডির মধ্যেই আটকে থাকলো আজীবন। তবে গুঞ্জা যতই আইনত রক্তিমের স্ত্রী হোক, যতই ভালোবাসুক ওকে, তবুও অব্যয় সামনে এসে যেদিন দাঁড়িয়েছিলো ওর বুটিকে সেদিন অদ্ভুত এক উত্তেজনায় ফিরে গিয়েছিলো কলেজের দিনগুলোতে। অব্যয় নামক ব্যক্তিটির বোধহয় একটা আলাদা সম্মোহক ক্ষমতা আছে। কাঠের শঙ্খটা ওর হাতে দিয়ে গুঞ্জা বলেছিলো, এটা আসলে ধুপদানি। রোজ তোর আঁকার স্টুডিওতে একটা করে ধুপ জ্বালাবি। এটা তোকে আমি গিফট করলাম। অব্যয় ওর মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বলেছিলো, এমা তাহলে তো রোজ তোর কথা মনে পড়বে আমার। তারপর যদি বাইচান্স তোর প্রেমে হড়কে যাই তখন তো রক্তিম শালা চাঁদা তুলে পেটাবে আমায়। সুন্দরী বউ আর দুর্মূল্য বই কিন্তু পাবলিক একটু সামলে-সুমলেই রাখে বুঝলি কিনা!
সে যাইহোক উপহারের জিনিস গরিব প্রফেসর কোনোদিন ফেরায় না।
গুঞ্জার বুটিক থেকে আরও বেশ কিছু জিনিস কিনেছিলো অব্যয়। তারপর বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে যাওয়ার সময় বলেছিলো, একাকীত্ব বড় কষ্টের গুঞ্জা। যখনই মনে হয় হাজার মনের ভিড়ে আমার জন্য ভাবার কোনো মানুষ নেই তখন কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে যায় জানিস। উড়নচণ্ডী ছেলে তো, তাই বাবা-মাও ত্যাজ্য করেছে বলতে পারিস।
গুঞ্জা বলেছিলো, বর্ণিতা তো এখনও তোর অপেক্ষায়। শুরু করতেই পারিস যে কোনো দিন।
অব্যয় গুঞ্জার কানের কাছে মুখ এনে বলেছিলো, বর্ণিতা বড্ড পলিশড রে। জংলী বুনো গন্ধ নেই ওর উপস্থিতিতে। ভালোবাসা-সেটাও যেন শ্বেত পাথরের থালায় সাজিয়ে চারিদিকে গোলাপ, জুঁইয়ের মত নামী ফুলের সম্ভারে পরিবেশন করে ও।
বাঁধভাঙা হালছাড়া নৌকাটাকে ঠিক কোনদিকে নিয়ে যাবো ভাবতে ভাবতেই দুজনে সেই নৌকাতেই ডুবে যাওয়ার ইচ্ছেটাই নেই এই গোছানো ভালোবাসার। তাই বর্ণিতা হয়তো খুব ভালো স্ত্রী হতে পারবে প্রফেসর অব্যয় বিশ্বাসের। কিন্তু বিশ্বাস কর, উড়নচণ্ডী অব্যয়ের প্রেমিকা নয়।
তোর গিফটটা আমি সাজিয়ে রাখবো। ভালো থাকিস।
ঝড়ের মতই বেরিয়ে গিয়েছিলো অব্যয়।
গুঞ্জার হেল্পিং হ্যান্ড মল্লিকা অপলক তাকিয়েছিলো ওর চলে যাওয়ার দিকে। তারপর মোহাবিষ্টের মত বলেছিলো, তোমার বন্ধু? কি দারুণ কথা বলেন। ম্যানলি লুক।
গুঞ্জা হেসে বলেছিলো, এই বয়সেও অব্যয় তার মানে বাইশের হৃদয়ে ঝড় তোলার ক্ষমতা রাখে!
মল্লিকা লজ্জায় পালিয়েছিলো স্টোররুমের দিকে। ওর চোখেও অপার কৌতূহল আর ভালোলাগার মেলবন্ধন দেখেছিলো গুঞ্জা। ঠিক যেমন থাকতো ওদের কলেজের দিনগুলোতে। এমন একজন প্রেমিকের মনেও হাহাকার আছে, একাকিত্বের যন্ত্রণা আছে এটা হয়তো অনেকেই বুঝবে না। কিন্তু গুঞ্জা বোঝে, অব্যয়ের না পাওয়া আর খুঁজে ফেরার কষ্টটা বুঝেছিলো গুঞ্জা।
লগ্নজিতা আচমকা বলেছিলো, কি ম্যাডাম, আপনি কি হারিয়ে গেলেন নাকি!
গুঞ্জা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলেছিলো, এটা আমি অব্যয়কে উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম। তাই লাবণ্যের ঘরে পেয়েছেন শুনে একটু চমকে গিয়েছিলাম। লগ্নজিতা বললো, আপনাদের এই বন্ধুকে খুঁজে পেতে হবে আমাকে খুব তাড়াতাড়ি। এমন লেডিকিলার প্রফেসরের সঙ্গে তো দেখা করতে হচ্ছে! একজন পুরোনো বন্ধুর দেওয়া উপহার দিয়ে দিচ্ছে কদিনের পরিচিতকে। ঠিক কি সম্পর্ক ছিলো অব্যয়ের সঙ্গে লাবণ্যের! শুধু শরীরের টানে যখন কোনো শিল্পী এসব জায়গায় যায় তখন তো মনের আদানপ্রদান খুব বেশি হয় বলে শুনিনি। আর ইনি বন্ধুর বুটিক থেকে ইউনিক কালেকশন নিয়ে গিয়ে দেহপসারিনীকে দিচ্ছেন! বিশেষ করে যারা ঘন্টার হিসেবে নিজেকে বিক্রি করেন তেমন কাউকে! ইন্টারেস্টিং। ভেরি ইন্টারেস্টিং।
রক্তিম আবারও এসে জয়েন করলো ওদের আলোচনায়। লগ্নজিতা বললো, দেখুন রক্তিমবাবু, প্রফেসর অব্যয় বিশ্বাস দায়িত্ব নিয়ে লাবণ্যের মৃত্যুর সব দায় কাঁধে নিতে চাইছেন। আমি চেষ্টা করলেও ওর দিক থেকে সন্দেহের চোখটা ঘোরাতে পারছি না। লাবণ্য খুনের আগের দিন থেকে কলেজ না যাওয়া, বিনা নোটিশে এতদিন কামাই সে করে না সাধারণত। আমার ইনফর্মারের খবর অনুযায়ী লাবণ্য খুনের দু-দিন আগেও ওনাকে দেখা গেছে ওই বাড়িতে ঢুকতে। লাবণ্যের ঘর থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রায় দু-লক্ষ মত টাকা। এত হার্ড ক্যাশ কে ওকে দিলো সেটা যথেষ্ট সন্দেহজনক। উনি নিরুদ্দেশ হয়ে নিজের দিকে সন্দেহের তীরটা ঘুরিয়ে দিলেন। এখন আমার প্রধান কাজ ওকে খুঁজে বের করা। রক্তিমবাবু, আপনাদের যদি কোনো কল করেন উনি, প্লিজ সঙ্গে সঙ্গে ইনফর্ম করবেন আমায়। আমার কার্ড, বলেই নিজের কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে গুঞ্জার দিকে তাকিয়ে বললো, আপনাকে কল করলেও জানাবেন প্লিজ।
ভালো থাকবেন, আবার এসে হাজির হবো কোনো এক সন্ধেতে। রাগ করবেন না যেন।
দৃঢ় পায়ে রক্তিমদের সাজানো ড্রয়িংরুম পেরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো লগ্নজিতা।। গুঞ্জা ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো, লগ্নজিতা তো বয়েসে গুঞ্জাদের থেকে ছোটই হবে, অথচ কথাবার্তা, সাহসে যেন অনেকটা এগিয়ে। কে জানে কেন, নিজেদের সব বিপদ ভুলে হঠাৎ করেই লগ্নজিতার প্রশংসা করে উঠলো গুঞ্জা। বললো, দেখো রক্তিম, শুধু পোশাকে আধুনিক হওয়া নয়, নিজের কাজ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে লগ্নজিতা ভট্টাচার্য। ওর দৃঢ়চেতা ভঙ্গিমার প্রেমে পড়ে গেলাম আমি।
রক্তিম একটু ব্যঙ্গাত্মক হেসে বললো, দেখিস বুড়ো বয়েসে এসে আবার নতুন করে কারোর প্রেমে পড়িস না, সে যত পূর্ব পরিচিতই হোক। গুঞ্জা বুঝলো, অব্যয় ওর বুটিকে আসার ঘটনাটা সচেতনভাবে এড়িয়ে গিয়েছিলো গুঞ্জা রক্তিমের কাছে, তাই এই খোঁচাটা রক্তিম দিলো ইচ্ছাকৃতভাবেই। এতক্ষণ জেরার পরে আর কোনো বিতর্কে জড়াতে ইচ্ছে করছিলো না গুঞ্জার। তাছাড়া ওর দেওয়া গিফটটা লাবণ্যকে দিয়ে দিয়েছিলো অব্যয়, শোনার পর থেকেই নিজের ওপরে বিরক্ত লাগছিলো ওর। কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো গুঞ্জা। যাবার সময় জিজ্ঞেস করে গেলো, কফি খাবে তো?
রক্তিম অন্যমনস্ক স্বরে বললো, খাবো।
.