মুনলাইট বার
নিজের থ্রি কোয়াটার জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখে নিলো ও সার্ভিস রিভলবারটা ঠিক জায়গায় আছে তো! ব্যাগি শার্টটা ইন না করে খুলে দিলো। এমনিতেই জিন্সের পকেটে দুটো দু-টাকার কয়েনকে কসরৎ করে ঢোকাতে হয়। সেখানে সার্ভিস রিভলবারটা এতটাই উঁচু হয়ে আছে যে কেউ তাকালেই নোটিশ করবে। তাই নিজের ঢোলা শার্টটায় ঢেকে নিলো গোপন অস্ত্রটা। আজ লগ্নজিতা একেবারে একা এসেছে। কোনো কনস্টেবলকে সঙ্গে নেয়নি। অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট করার ইচ্ছে ওর নেই। ইউনিফর্মের বাইরে অন্য কিছু পরলেই মা ইদানিং একটু সন্দেহ করে। আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। লগ্নজিতা যখন বেরোচ্ছিলো, মা ঠিক সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো, কোথাও যাচ্ছিস? বাবা ড্রয়িংরুমে টিভির রূপালি পর্দায় চোখ রেখেই বললো, বোধহয় ডেটিংয়ে, সাজগোজ দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।
মা কপালে ভাঁজ ফেলে বললো, ওমা, সেকি! বিয়ের আগেই এমন মেলামেশা একেবারেই ভালো নয়।
যদি কাউকে পছন্দ থাকে, আমাদের বললেই তো আমরা বিয়েটা দিয়ে দিই। লগ্নজিতা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বললো, বাবা, দিস ইজ নট ফেয়ার! বাবা মুচকি হেসে বললো, বাহ, তুই ডেটিংয়ে যেতে পারিস আর তোর মা বিয়ের কথা বললেই আনফেয়ার হয়ে যাবে কেন? আমি আজ তোর মায়ের পক্ষে। এর হেস্তনেস্ত না করে তুই আজ বাড়ির বাইরে পা রাখবি না। যাও তো এককাপ কফি করে আনো, আজ জমিয়ে তোমার দলে লড়বো। মা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলে গেলো, আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না। এই সুযোগে মেয়েকে ইশারায় বাইরে পাঠিয়ে দেবে, আবার অসময়ে এককাপ কফিও পেয়ে যাবে।
এই মিষ্টি মিষ্টি মাটাকে বড্ড আদর করতে ইচ্ছে করে লগ্নজিতার। তাই মাকে জড়িয়ে ধরে একপ্রস্থ আদর করে ও ফিসফিস করে বললো, যেদিন ফার্স্ট ডেটিংয়ে যাবো, সেদিন তোমায় সঙ্গে করে নিয়ে যাবো। বলেই দেবো, এই হচ্ছে তোমার হবু শাশুড়ি, যদি এনার পছন্দ হয় তাহলে বিয়ে ফাইনাল, নাহলে জাস্ট ক্যানসেল। মা সুযোগমত সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করে বললো, সে সৌভাগ্য কি আর আমার কপালে আছে? একজন প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে, আরেকজন চব্বিশঘন্টা কাজের নাম করে যত অকাজ করে যাচ্ছে। যার যা ইচ্ছে করুক, আমি রূপনারায়নপুরে চলে যাব আমার ভাইয়ের কাছে।
খুব ছোট থেকে লগ্নজিতা মায়ের এই এক ডায়লগ শুনে আসছে। বাবার সঙ্গে ঝগড়া হলেই মা বলতো, আমি চলে যাবো রূপনারায়নপুরে। বাবা বলতো, সে দু-দিন চলো, তোমার ভাইয়ের বাড়িতে কাটিয়ে আসি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাই বাবাকে জোরেই বললো, আসছি। এসে তোমার সঙ্গে বাকি বোঝাপড়াটা করে নেবো।
স্নিকারের ফিতেতে টান দিয়ে গাড়িতে উঠলো লগ্নজিতা। বড়বাবু তো প্রস্টিটিউটের মৃত্যু বলে কেসটাকে গুরুত্বই দিতে চাইছেন না। কজ অফ ডেথে সুইসাইড লিখে লাবণ্যর মৃত্যুকে ধামাচাপা দিয়ে ফাইল ক্লোজ করে দিতে চাইছেন। কিন্তু ঘোষালের ওই একটা কথাতেই খিঁচটা রয়ে গেছে। ওটার গিঁট না খোলা পর্যন্ত শান্তি নেই ওর। শুভদীপ ঘোষাল কেন থানায় খবর দেওয়ার সময় বলেছিলো, এখানে একটা মার্ডার হয়ে গেছে। ইমিডিয়েট কিছু ব্যবস্থা করুন। কেন শুভদীপবাবুর মনে হলো, এটা আত্মহত্যা নয়, খুন!
গাড়িটা মুনলাইটের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং-এ পার্ক করার সময়েই একটা গাড়ির ওপরে নজর পড়লো লগ্নজিতার। ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি খেলে গেলো।
মুনলাইটের ভিতরটা আর পাঁচটা বারের মত। পার্থক্য তেমন নেই। শুধু লাইটের ডেকোরেশনটা একটু আলাদা। অন্য বারে বেশ ঝকঝকে লাইট থাকে, কিন্তু এখানে বেশ মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এর নিভু নিভু আলোগুলো। টেবিলে কাস্টমাররা বসে আছে। স্বল্পবসনা মেয়েগুলো এসে তাদের ড্রিংক সার্ভ করছে। লগ্নজিতা বুঝতে পারলো, এভাবেই মদের সঙ্গে মেয়েদের শরীরের নেশা ধরাচ্ছে মুনলাইটের মালিক। অনেক কাস্টমারই ঝিমঝিম নেশার ঘোরে তরল পানীয়ের গ্লাস দিতে আসা মেয়েটার উন্মুক্ত কোমরে হাত দিয়ে তাকে আকর্ষণ করার চেষ্টাও করছে। সমস্ত কাস্টমারই পুরুষ। ইদানিং বিভিন্ন বারে মহিলাদেরও দেখা যায়। ঠোঁটের সামনে সুদৃশ্য গ্লাস নিয়ে লিপস্টিক বাঁচিয়ে রঙিন নেশায় বুঁদ হতে।
কিন্তু মুনলাইটের সব কটি টেবিলেই এই মুহূর্তে পুরুষদের উপস্থিতি। উত্তর দিকের কোণের টেবিলে মাথা নিচু করে বসে আছে যে মানুষটা, সে লগ্নজিতার বিশেষ পরিচিত। তাই অন্য টেবিলে না গিয়ে সোজা চলে গেল আরেকটু পরিচয় বাড়াতে। মনে মনে বললো, ইকবালের খবরে আজ অবধি কোনো ভুল পায়নি লগ্নজিতা। ছেলেটাকে আরেকটু বেশি মাইনে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
টেবিলে বসেই লগ্নজিতা বললো, কি মিস্টার ঘোষাল, একা একাই রয়েছেন দেখে একটু কম্পানি দিতে চলে এলাম। আপনার গ্লাসে তলানি কেন? এই ওয়েটার….
শুভদীপ ঘোষালের আধঘন্টার চেষ্টায় যে নীলাভ নেশাটা চোখের সামনে বুজবুজি কাটছিলো সেটা নিমেষে গায়েব হয়ে গেলো সামনে বসে থাকা লগ্নজিতাকে দেখে।
.
লগ্নজিতার দিকে মৌতাত কেটে যাওয়া চোখে তাকালো শুভদীপ ঘোষাল। তারপর নিজেকে একটু সময় নিয়ে গুছিয়ে বললো, আপনি এখানে?
লগ্নজিতা বললো, লাবণ্য তো এখানেই আসতো তাই না ঘোষালবাবু? আমি আসলে মুনলাইটের ম্যানেজারের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই, তাই এলাম। এসেই যে একজন পরিচিত মানুষকে এখানে দেখতে পাবো এটা অবশ্য ভাবিনি।
ঘোষাল অপ্রস্তুত গলায় বললো, আমি মাঝে মাঝে আসি এখানে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আজকে এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, বেশ টায়ার্ড ছিলাম তাই বসে গেলাম গ্লাস নিয়ে।
লগ্নজিতা মুচকি হেসে বললো, আমার মশাই কপালটা বড্ড ভালো। আজকেই আমি এলাম, আর আপনাকে পেয়ে গেলাম এখানে। নাহলে এই পরিবেশে আমাকে একা ওয়েট করতে হতো।
আপনাকে পেয়ে গিয়ে জমিয়ে গল্প করা যাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ম্যানেজার আসেন।
আরে আপনার গ্লাস ফাঁকা যে…
ওয়েটার এসে দাঁড়াতেই ঘোষাল পরিচিত ভঙ্গিমায় বললো, আমার আর লাগবে না। ছেলেটা বোকার মত বললো, কিন্তু স্যার আপনি যে রোজ দু- পেগ করে নেন?
ঘোষাল প্রায় চিৎকার করে বললো, আউট।
লগ্নজিতা নিজের সফটড্রিঙ্কে ঠোঁট ঠেকাতেই সাদা গ্লাসে ওর লিপস্টিকের ছাপ লেগে গেলো। ঘোষাল সেদিকে তাকিয়ে বললো, মেয়েদের এই রঙেতেই মিষ্টি লাগে। বিয়েটা করে নিন ম্যাডাম। কতদিন আর শীতের সন্ধেতে চোর-ডাকাতের পিছনে ছুটবেন বলুন তো! লগ্নজিতা একটুও উত্তেজিত না হয়েই বললো, আপনি একটা পাত্র দেখে দিন না ঘোষালবাবু। আপনি তো সকলেরই কিছু না কিছু উপকার করেছেন, আমারও নাহয় একটা করলেন। বিশেষ করে নিরীহ মেয়েদের দুঃখ তো আবার আপনার একেবারে সহ্য হয় না তাই না?
গলার স্বরটা একটু দৃঢ় করে লগ্নজিতা বললো, আপনি লাবণ্যকে কতদিন বিনা ভাড়ায় রেখেছিলেন যেন?
শুভদীপ একটু ইতস্তত করে বলেছিল, এই মুহূর্তে মনে নেই কতদিন, তবে রাজেশ চলে যাবার পরে যতদিন রোজগার শুরু করতে পারেনি ততদিন বিনাভাড়ায় ছিলো।
লগ্নজিতা ভ্রু কুঁচকে বললো, তারপর নিরুপায় লাবণ্য একটা কাজের সন্ধানে আপনার কাছে এলো। তখন আপনি ওকে এই চাঁদে পৌঁছানোর রাস্তাটা দেখিয়ে দিলেন, তাই না শুভদীপবাবু?
শুভদীপ বিরক্তির সঙ্গে বললো, আমি? আমি কেন তাকে কাজ দেখে দিতে যাব? লাবণ্য আমার জেঠিমার বাড়ির ভাড়াটে ছিলো মাত্র। আমার সঙ্গে তার কোনোরকম সম্পর্কই ছিলো না। শুধু মাসের একটা দিন দেখা হতো, সে এসে ভাড়া দিতো, আমি রসিদটা সাইন করে দিয়ে দিতাম। দ্যাটস এনাফ। নাথিং এলস।
লগ্নজিতা মিষ্টি স্বরে বললো, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মিথ্যে কথা বলে কেসটাকে ভুল দিকে চালিত করা এবং অপরাধীকে আড়াল করার অভিযোগে আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করতেই পারি।
ঘোষাল গ্লাসের তলানি তরলটুকু গলায় ঢেলে মুখ বিকৃত করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই ম্যানেজার এগিয়ে এসে বললেন, বলুন ম্যাডাম। কি করতে পারি আপনার জন্য। আমি একটা কাজে বেরিয়েছিলাম, তাই আপনাকে ওয়েট করতে হলো। এক্সট্রিমলি সরি। লগ্নজিতা ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বললো, এনাকে তো আপনি বেশ ভালো চেনেন ম্যানেজারবাবু। ইনি একজন সম্ভ্রান্ত প্রমোটার। শহর জুড়ে এনার বিজনেস। আপনার বারের বহু পুরোনো খদ্দের। তাই না? ম্যানেজার কিছু না বুঝেই বললেন, বিলক্ষণ চিনি। ওনার দাক্ষিণ্যে অনেক কাস্টমারও পাই।
লগ্নজিতা দেরি না করেই বললো, ওনার দাক্ষিণ্যেই তো লাবণ্যকে পেয়েছিলেন তাই না?
ম্যানেজার কি বলবে বুঝতে না পেরে শুভদীপের দিকে তাকালেন। শুভদীপ চোখের ইশারায় কিছু বোঝাবার আগেই লগ্নজিতা বললো, মিস্টার ঘোষালের আজ বোধহয় একটু বেশিই তাড়া ছিলো। ওনাকে আর অকারণে আটকে রাখবো না। আপনি আসুন ঘোষালবাবু।
ঘোষাল আর কথা না বাড়িয়ে হালকা পায়ে চলে গেলো বারের বাইরে।
ম্যানেজার ইতস্তত করে বললেন, কিন্তু ম্যাডাম আমরা তো পারমিশন নিয়েই এই বার চালাচ্ছি।
লগ্নজিতা ম্যানেজারের ঘ্যানঘ্যানানিতে কান না দিয়েই বললো, লাবণ্য ঘটি এখানে কি কাজ করতো?
ম্যানেজার নিজের রুমাল দিয়ে ঘামটুকু মুছে নিয়ে বললেন, এই যে টেবিলে টেবিলে ড্রিংক সার্ভ করছে মেয়েগুলো, লাবণ্যও এদের মতই ছিলো। আমি মাইনেও দিতাম ভালো। লগ্নজিতা নাক কুঁচকে বললো, শুধু ড্রিংক সার্ভ করতো? আর কাস্টমারদের যদি পছন্দ হয়ে যেত তখন আপনি কি করতেন? ম্যানেজার হাতের আঙুল কামড়ে বললেন, সেটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। ওরা যদি সেই কাস্টমারদের সঙ্গে কোথাও বাইরে মিট করতো তার দায় তো আমার নয়।
লগ্নজিতা জিভে একটা টুকটুক আওয়াজ তুলে বললো, সেতো বটেই। আপনি আবার ব্যক্তিস্বাধীনতায় বড্ড বিশ্বাসী কিনা। তার মানে ওই মেয়েগুলোর কাছ থেকে কোনোরকম কমিশন আপনি খেতেন না তাই তো? তা বেশ। অত্যন্ত সৎ এবং পরোপকারী বার মালিকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি খুব খুশি হলাম।
তো লাবণ্যকে আপনার কাছে কে নিয়ে এসেছিলো?
ম্যানেজার একটা বড় ঢোক গিলে বললেন, শুভদীপ ঘোষাল। উনিই একদিন বিকালবেলায় লাবণ্যকে নিয়ে এসে বললেন, মেয়েটা একটা কাজ চায়, স্বামী ওকে ছেড়ে চলে গেছে। দেখুন যদি কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন। আমার মায়া লেগেছিলো মেয়েটাকে দেখে। নিরীহ মুখচোরা মেয়ে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি কি কাজ জানো? মেয়েটা সংকোচে বলেছিলো, আঁকতে জানে, ভালো সেলাই জানে, রান্না জানে। মেয়েটার মধ্যে একটা আর্টিস্টিক ব্যাপার ছিলো। লগ্নজিতা কথাটা শেষ না করতে দিয়েই বললো, সেই জন্যই তাকে প্রস্টিটিউশনের কাজে ঢুকিয়ে দিলেন? ম্যানেজার অত্যন্ত দক্ষতায় জিভ কামড়ে বললেন, ছি ছি একেবারেই নয়। আমি তো তাকে বললাম, ড্রিংক সার্ভ করতে হবে টেবিলে টেবিলে, এছাড়া আমার বারে আর মেয়েদের কাজই বা কি! লাবণ্য বলেছিলো, এত ছোট ড্রেস পরতে হবে? মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছিলো দেখে আমি বলেছিলাম, অন্য কাজের জোগাড় করতে পারলে তোমায় ডাকবো। তো লাবণ্য আমার হাত দুটো ধরে বলেছিলো, ওর খুব বিপদ। তাই কাজটা ওকে করতেই হবে। আমার মায়ার শরীর, তাই আমি বললাম, তাহলে কাল থেকেই লেগে পড়ো। ওই গাইয়া মেয়ের পিছনে খরচ কম হয়নি। রীতিমত মেকওভার করাতে হয়েছিলো। তবে চটপটে মেয়ে নিজের কাজটা বুঝে নিয়েছিলো।
লগ্নজিতার গলার কাছটা একটু ভারী হয়ে গিয়েছিলো। এমন কত মেয়ে এই শহরে রোজ বলি হচ্ছে নিরুপায়ভাবে। সে আঁকতে পারে, ভালো সেলাই পারে, রান্না পারে এসব গুণগুলো ধর্তব্যের মধ্যেই ধরা হয় না। তার দুটো স্তন আর একটা যোনিছিদ্রের মূল্য অনেক বেশি বেড়ে যায় সকলের কাছে। লাবণ্যর অসহায় মুখটা কল্পনা করেই চোখ দুটো জ্বলে উঠলো লগ্নজিতার। দাঁত চেপে বললো, শুভদীপ ঘোষালকে কত দিয়েছিলেন আপনি? ম্যানেজার ইতস্তত করে বললেন, আজ আর মনে নেই। অনেকদিন আগের কথা তো। তবে লাবণ্যকে আমি সব সময় মাইনে ঠিক সময়ে দিয়ে দিতাম। মেয়েটা আমার বারের লক্ষ্মী ছিলো। দুটো গ্লাস নিয়ে এসে বললেন, এই দেখুন এই গ্লাস পেন্টিংগুলো ওর করা। আমি জোর করিনি। অবসর সময়ে ও নিজেই করছে দেখে আমি আঁকার সরঞ্জাম এনে দিয়েছিলাম। লগ্নজিতা দেখলো, একটা গ্লাসে একটা মেয়ে নৃত্যের ভঙ্গিমায় বসে আছে। আরেকটা গ্লাসে দুটো পাখি ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে প্রেমালাপ সারছে। কি অদ্ভুত মেয়েটার হাতের কাজ। সেদিন অবশ্য ওর ঘরে ঢুকেও তাই মনে হয়েছিলো লগ্নজিতার। মেয়েটা অত্যন্ত গুণের মেয়ে ছিলো। রাজেশ ঘটি আর শুভদীপ ঘোষালের মত মানুষরাই আসলে বেশ্যা বানায়, তারপর নিজেরা ভালোমানুষ সেজে সমাজের উপরিস্থলে বসবাস করে নিশ্চিন্তে। লোকে এদের সম্মান করে, আর লাবণ্যকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
ম্যানেজার করুণ গলায় বললেন, কি যে হলো মেয়েটার, কেন যে আত্মহত্যা করে বসলো কে জানে! তিনদিন আগেও তো মাইনে নিয়ে গেলো, তখনও তো বুঝতে পারিনি এমন করবে। লগ্নজিতা এসব সাজানো ন্যাকামিতে বিশ্বাসী নয়। ম্যানেজারকে বললো, আপনার এখানে যতজন মেয়ে আছে ডাকুন সকলকে। আমার কথা আছে তাদের সঙ্গে।
ম্যানেজার ইতস্তত করে বললেন, কাস্টমার রয়েছে টেবিলে এখন এসব করলে বদনাম হয়ে যাবে ম্যাডাম। লগ্নজিতা শীতল গলায় বললো, এক এক করে ডাকুন। মেয়েগুলোর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে চন্দ্রকলা নামক মেয়েটার ফোন নম্বর আর বাড়ির অ্যাড্রেস জেনে বার থেকে বেরিয়ে এলো ও। এই চন্দ্রকলার সঙ্গেই লাবণ্যের বন্ধুত্ব ছিল সব থেকে বেশি। গাড়িটা স্টার্ট দিয়েই ভাবলো, এই শুভদীপ ঘোষালকে আর লোভহীন ব্যবসাদার ভাবার কোনো কারণ নেই। লাবণ্যকে বিনাভাড়ায় রেখেছিলো বলে যে দুর্দান্ত গল্পটা ও ফেঁদেছিলো তার এইটটি পার্সেন্ট মিথ্যে। লাবণ্যকে মুনলাইটে সাপ্লাই দিয়েও মোটা অংকের টাকা কামিয়েছে শুভদীপ। ইকবালকে বলতে হবে শুভদীপের এই মুহূর্তের বিজনেস কন্ডিশানটা জানতে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো এগারোটার দিকে দৌড় লাগিয়েছে ঘন্টার কাঁটাটা। গাড়িতে আরেকটু স্পিড তুলে বাড়ির দিকে ছুটলো লগ্নজিতা। কাল সকালে থানার কাজ মিটিয়ে কোথায় কোথায় যেতে হবে তার একটা লিস্ট বানালো মনে মনে।