আবার বর্ণিতা
আপনার অফিসে আসার ইচ্ছে আমার সত্যিই ছিলো না। কিন্তু ফোনে পেলাম না। বাড়িতে তালা ঝুলছে দেখে ভাবলাম একবার অফিসে ঢুঁ দিয়ে দেখি।
বি বেঙ্গলির অফিস ক্যান্টিনে বসে দুটো কফি অর্ডার করলো বর্ণিতা। লগ্নজিতা আচমকা বলে বসলো, হঠাৎ বি বেঙ্গলি কেন? মানে ফাইন আর্টস নিয়ে পড়ে আপনার বন্ধুরা তো নিজেদের সার্কেলের মধ্যেই আছে। টেক্সটাইল, বুটিক, স্কুল, কলেজ আপনি হঠাৎ টিভি চ্যানেলে এলেন যে! কোনো বিশেষ কারণ? ব্যক্তিগত কজ হলে বলার জন্য প্রেসার দেব না।
বর্ণিতা মুঠোফোন থেকে চোখ সরিয়ে বললো, বি বেঙ্গলিতে আমি অভিনয় করি না। আমি সিনিয়র মেকআপ আর্টিস্ট। আর আপনার নিশ্চয়ই এটুকু ধারণা আছে মেকআপ আর্টিস্টকেও একজন শিল্পীই হতে হয়। মানে আমি বলতে চাইছি, পারফেক্ট মেকআপের জন্য রঙের ধারণা থাকা খুব দরকার। তাই আমি ফাইন আর্টসের ধারে কাছে নেই এমন ভাবাটা বোকামি মাত্র। কেউ একজন আর্ট কলেজে পড়ালেই সে উচ্চপর্যায়ের শিল্পী আরেকজন মেকআপ আর্টিস্ট মানেই সে পথভ্রষ্ট এমনটা ভাবার যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না, বিলিভ মি। লগ্নজিতা বুঝলো, বর্ণিতা ওর কাজটাকে সম্মান করলেও কাজটা খুব মন থেকে ভালোবেসে করে না।
লগ্নজিতা কিছু বলার আগেই বর্ণিতা বললো, সরি। আমি একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম সামান্য প্রশ্নে। আসলে বাবার অসুস্থতার কারণেই ফাইন আর্টস নিয়ে পড়াটা কমপ্লিট না করেই আমি চাকরি জয়েন করি। তারপর কিভাবে যেন বি বেঙ্গলির একজন হয়ে যাই। টিভির পর্দায় যে অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সাজগোজ দেখে লোকে অনুকরণ করে তার স্রষ্টা আমি, এটা ভাবলেই একটা অন্যরকম তৃপ্তি আসে মনে। নতুনভাবে শাড়ি পরানো, চন্দনের টিপে অন্যরকম কারুকার্য বা আইশ্যাডোতে কালারের মিশ্রণ – এগুলো একজন আর্টিস্ট ছাড়া সম্ভব নয়। আমি অনুকরণ করি না, সৃষ্টি করি, এই জন্যই আমি ব্যতিক্রমী। ছোট্ট থেকে আঁকার প্রতি ভালোবাসাই আমাকে নামি মেকআপ আর্টিস্ট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেইজন্য আমি ফাইন আর্টসের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
লগ্নজিতা প্রসঙ্গ পরিবর্তনের আগে কফিতে চুমুক দিয়ে বললো, বহুদিন পরে এত পারফেক্ট কফি খেলাম। ক্যান্টিনের কফিতে তো মুখ দেওয়া যায় না। মনে হয় শরবত করারই অভিপ্রায় ছিলো, নেহাত কফির অর্ডার পেয়ে সামান্য পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে।
বর্ণিতা অন্যমনস্ক ভাবে বললো, অব্যয় খুনি এটা মানতে আমার সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে। কেন জানি না মনে হচ্ছে, ওই লাবণ্য নামক মেয়েটার বাড়িতে ও যেত ঠিকই, কিন্তু খুনটা ও করেনি।
লগ্নজিতা বললো, কেন মনে হলো যদি একটু ক্লিয়ার করে বলেন। মানে অব্যয়বাবু কিন্তু আজও কলেজে অনুপস্থিত। এবারে হয়তো ওনাকে খোঁজার জন্য আমাকে ফোর্স নিয়োগ করতে হবে। বা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন। আমি ওয়েট করছিলাম, যদি উনি ফিরে আসেন তাহলে আর এসব করতে হতো না। যেহেতু ওনার বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ কিছু নেই, তাই আমি এভাবে খুঁজে বের করার পক্ষপাতী ছিলাম না। কিন্তু এখন একটা জিনিস ক্লিয়ার হলো, লাবণ্যের সঙ্গে ওর ভীষণ ভালো রিলেশন ছিলো। তাই লাবণ্যর মৃত্যুর তদন্তে ওনাকে আমার দরকার বিশেষভাবে।
বর্ণিতা ভীত গলায় বললো, ম্যাডাম একটা কথা বলবো?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই।
আপনি ওভাবে মানে ক্রিমিনাল খোঁজার মত করে ওনাকে খুঁজবেন না প্লিজ। এতে অব্যয়ের কেরিয়ারের প্রবলেম হবে।
লগ্নজিতা তাকিয়ে দেখলো বর্ণিতার চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া। নিজের মনেই হেসে ফেললো। আর সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে মনে মনে বললো, ধন্য তুমি। এমনভাবে সৃষ্টি করেছো নারীদের যে তারা শুধু ক্ষমাই করে গেলো। অব্যয়কে বর্ণিতা এত ভালোবাসে, তারপরেও সে লাবণ্যের কাছে যায় শুনেও তার কোনো ক্ষতি হোক চায় না।
ভালোবাসা শব্দটাকে বড্ড জটিল মনে হয় লগ্নজিতার। তাই এর আগে পরে চিরস্থায়ী বা আপেক্ষিক কোনো উপমাই বসাতে পারে না নিশ্চিন্তে। সেক্সপিয়ারের দ্য ট্রাজেডি অফ ওথেলো পড়লেই বোঝা যায়, ভালোবাসা কত নিষ্ঠুর হয়। তাই অব্যয়কে খুনির তালিকা থেকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দিতে পারছে না লগ্নজিতা।
বর্ণিতা হালকা গলায় বললো, লাবণ্য কি ভালো ছবি আঁকতো? জানেন আপনি?
লগ্নজিতা একটু ভেবে বললো, কেন বলুন তো?
বর্ণিতা বললো, একটা কথা আমি সকলের কাছে থেকে গোপন করে রেখেছি, আপনাকে বলবো সিদ্ধান্ত নিলাম। হয়তো আপনার কেসের ক্লু হতে পারে।
লগ্নজিতার বেশ ভালো লাগছিলো বর্ণিতার সঙ্গে কথা বলতে। মেয়েটার মধ্যে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। সহজ সরল অথচ দুর্দান্ত একটা ব্যক্তিত্ব আছে ওর আচরণে। লগ্নজিতা বললো, আমি যেদিন লাবণ্যের ভাড়া বাড়িতে গিয়েছিলাম সেদিনের দৃশ্যটা আমি বলছি আপনাকে। তাহলে আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন। আপনাদের শিল্পীদের তো একটা আলাদা চোখ থাকে।
বর্ণিতা নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, আধঘন্টা আমার ব্রেক আছে। আপনাকে এর মধ্যেই শেষ করতে হবে কিন্তু।
লগ্নজিতা একটু গুছিয়ে নিয়ে শুরু করলো।
আমি রানীভবনে গিয়েছিলাম লাবণ্যের দিদির পরিচয়ে। কিন্তু রানীভবনের মালকিন স্বয়ং রানীবালা মানুষটি ক্ষুরধার বুদ্ধি ধরেন। হয়তো জাঁদরেল উকিলের সহধর্মিণী বলেই বুদ্ধিটা তার বেশি খোলে এই বয়সেও।
তাই আমাকে দেখেই বলেছিলেন, আমি পুলিশের লোক উনি বুঝেছেন, তবুও লাবণ্যের ব্যাপারে আমাকে সবরকম সাহায্য উনি করবেন। আমি যখন লাবণ্যের ঘরে ঢুকেছিলাম তখনই খেয়াল করেছিলাম, মেঝেময় দুর্দান্ত আল্পনা দেওয়া, ঘরের দেওয়ালে বেশ কিছু আঁকা। আর বিভিন্ন শৌখিন জিনিসে ঘর ভর্তি। খুব যে দামি জিনিস তা নয়, তবে রুচিটা যে খুবই শৈল্পিক সেটা আমার মত চোর-ডাকাতের পিছনে ছোটা মানুষের চোখেও ধরা পড়েছে। ওখান থেকেই তো আপনার বন্ধু গুঞ্জার বুটিক থেকে কেনা দুটো গিফট পেলাম। অব্যয়বাবুই লাবণ্যকে উপহার দিয়েছিলো বুঝতে পারলাম।
বর্ণিতা একটু অন্যমনস্ক গলায় বললো, লাবণ্যের আঁকা কোনো ছবি আমায় দেখাতে পারবেন অফিসার? লগ্নজিতা বললো, পারবো। আমি সঙ্গে কয়েকটা এনেও রেখেছি থানায়।
বর্ণিতা বললো, মেয়েটার মধ্যে তার মানে একটা শিল্পী লুকিয়ে ছিলো, শুধু দেহপসারিনী নয়। আমারও সেটাই মনে হচ্ছিলো, অব্যয় শুধু শারীরিক টানে লাবণ্যের কাছে ধরা দেয়নি। অব্যয় শিল্পী চেনে। অব্যয়ের চোখে আমি অবশ্য কোনোদিনই শিল্পী হয়ে উঠতে পারিনি। ও বলতো, বর্নি তুমি বড্ড বেশি সাজানো গোছানো। ঠিক যেন শৌখিন ব্যালকনিতে রাখা বনসাই গাছ। বুনো গন্ধটাই নাকি নেই আমার মধ্যে। শিল্পীরা একটু এলোমেলো অগোছালো হবে, কারণ রংতুলিতেই তারা জীবন খুঁজে পায়। তাই নিজেদের গোছাতে পারে না মোটেই। কবিগুরুর ভাষায় বলতে গেলে, সময় কোথায় সময় নষ্ট করার। বর্ণিতার চোখের দৃষ্টিতে আলতো ধূসরতা। অপ্রাপ্তির যন্ত্রণাটুকুকে মুহূর্তে লুকিয়ে নিতে পারে মেয়েটা, এটা চোখের সামনে দেখতে পেলো লগ্নজিতা।
বর্ণিতা আচমকা বললো, লাবণ্যের আঁকা ছবিগুলো কবে দেখাবেন আমায়?
লগ্নজিতা বললো, আপনি চাইলে আজ সন্ধেতে দেখা করতে পারি আমরা। বর্ণিতা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, আমায় এবারে উঠতে হবে ম্যাডাম।
তাহলে সন্ধেতে মিট করছি।
লগ্নজিতা দেখলো, বর্ণিতা যেন হঠাৎ করেই উঠে চলে গেলো। ফোনের দিকে তাকিয়েই কি ওর মধ্যে এই দ্রুততা এলো? কারোর মেসেজ এলো কি ওর মেসেজবক্সে? লগ্নজিতার তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে বর্ণিতার আকস্মিক পরিবর্তনটা নজর এড়ালো না। তবুও লগ্নজিতা সৌজন্যবশত বললো, কফি উইথ স্ন্যাকস- এ বসি তাহলে? আপনার অ্যাড্রেসে কাছাকাছিই হবে বোধহয়। বর্ণিতা ঘাড় নেড়ে বললো, ওকে, তাই হবে।
ওর চলে যাওয়ার ভঙ্গিমাতে তাড়াটা একটু যেন বেশিই ছিলো।
লগ্নজিতা চলে গেছে। সন্ধের সময় লাবণ্যের আঁকা ছবিগুলো দেখাবে ওকে।
.
মেসেজটা না ঢুকলে হয়তো আরও দশমিনিট কথা বলতো বর্ণিতা ওর সঙ্গে। কিন্তু এই মেসেজটা পাওয়ার পরই উদ্বেল হয়ে উঠেছে ওর মন। লগ্নজিতা যাতে বুঝতে না পারে সেই জন্যই বর্ণিতা উঠে এলো ওর চোখের সামনে থেকে।
‘এটা আমার নতুন নম্বর, পারলে কল করো’।
কেন কে জানে, বর্ণিতার মনে হলো এটা অব্যয়ের নম্বর। এদিক ওদিকে তাকিয়ে নম্বরটা ডায়াল করলো ও। ওদিকে রিং বাজছে।