রানীভবনের তিনতলা
রানীবালাদেবী, আপনার কাছে লাবণ্যের হাজবেন্ডের কোনো ছবি আছে? আর ওই রাধারমণ মুখুজ্জে বলে লোকটির কোনো ছবি?
রানীবালা কিছু বলার আগেই গোপাল বলে উঠলো, আমি জানি। আমার সঙ্গে চলুন।
রানীবালা একটু ইতস্তত করে বললেন, শুভ আপনাকে কোনোরকম সহযোগিতা করতে বারণ করেছে। তবুও আমি মেয়েটার মৃত্যুর কিনারা হোক এটাই চাই। ওর কেউ নেই বলে, এভাবে মারা যাবে এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। আমার স্বামী অনেক কেস লড়েছেন বিনা পয়সায়, শুধু ন্যায় দেওয়ার জন্য।
শুভ হঠাৎ করে কেন যে আপনার ওপরে ক্ষেপে উঠলো বুঝতে পারছি না। যাইহোক, দেরি না করে আপনি গোপালের সঙ্গে যান।
লগ্নজিতা গোপালের সঙ্গে উঠে গেলো ওপরের তলায়। গোপাল বললো, লাবণ্যদিদির একটা অ্যালবাম আছে। তাতে ওদের বিয়ের ছবিও আছে। আমি দেখেছি। আর রাজেশ যখন এ বাড়িতে থাকতো তখনও আমিই একদিন জেঠিমাকে বলেছিলাম, লোকটাকে আমার মোটেই সুবিধার লাগে না।
.
লাবণ্যের ঘরটা খুলতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে নাকে ঝাপটা দিলো। জানলা, দরজা বন্ধ থাকলে অব্যবহারের ফলে যেমন একটা সোঁদা গন্ধ তৈরি হয় ঠিক তেমন। গোপাল ঢুকেই লাইটটা জ্বেলে দিলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, ওই যে কাঠের আলমারিটা, ওর মধ্যে আছে। আমায় একদিন দেখিয়েছিলো লাবণ্যদিদি। ওর বাবা, মা, বোন, ভাইয়ের ছবি।
আলমারির সামনেই ঝুলছিলো একটা চাবি লাগানো রিং। রিংয়ে একটা লক্ষ্মী ঠাকুরের ছবি।
গোপাল আলমারিটা খুলতেই লগ্নজিতা ভিতরে ঝুঁকে পড়লো। গোপালকে বললো, তুমি একটু সরে দাঁড়াও গোপালদা, আমি একবার চেক করে নিই।
তুমি বরং বলো তো, ওদিন কে কে এই ঘরে এসেছিলো। গোপাল একটু মনে করে বললো, ওই প্রফেসরবাবু এসেছিলেন সকালের দিকে। তারপর দাদাবাবু মানে শুভবাবু এসেছিলেন একটু বেলার দিকে। আর তার একদিন আগেই রাজেশ এসেছিলো লাবণ্যদিদির ঘরে। বেশ চেঁচামেচি হয়েছিলো সেদিন।
কিন্তু লাবণ্যদিদি ঠিক কেন মারা গেলো সেটা জানি না। আগেরদিন সন্ধের দিকে রাধারমণ মুখুজ্জে একবার ঢুকেছিলো এই ঘরে। আমি নিজের কানে শুনেছি, সে বলছিলো, বেইমানি করলি তুই? মেরে ফেলবো তোকে। আমার কাছে সব শিখে আমার সঙ্গে বেইমানি।
লাবণ্যদিদি কি বলেছিলো আমি অবশ্য শুনতে পাইনি। লগ্নজিতা বললো, প্রফেসর যে ওইদিন এসেছিলো এটা শুভবাবু জানেন? গোপাল মাথা চুলকে বললো, বলেছি কিনা মনে পড়ছে না তো।
লগ্নজিতার কাছে একটা জিনিস বেশ পরিষ্কার ঘোষাল লোকটা যথেষ্ট ঘোরালো।
দুটো অ্যালবাম পাওয়া গেলো লাবণ্যের আলমারি থেকে। পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে লগ্নজিতা বেশ বুঝতে পারছিলো মেয়েটার জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। নিচের তাকের বেশ কিছু শাড়ি দেখে বোঝা যাচ্ছিলো, গ্রাম্য ছাপ সুস্পষ্ট সেই পছন্দে। আর ওপরের দুটো তাকে রাখা বেশ আল্ট্রা মর্ডান ওয়েস্টার্ন ড্রেস। সম্ভবত এগুলো ও কিনেছিলো মুনলাইটে নিজেকে খাপ খাওয়াতে।
অ্যালবামের পাতায় বেশ কিছু ছবি রয়েছে লাবণ্যের বিয়ের। সম্ভবত কোনো মন্দিরে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে রাজেশ ওকে। রাজেশের কয়েকটা সিঙ্গেল ছবিও পেয়ে গেলো লগ্নজিতা।
পরের অ্যালবামটা দেখে চমকে উঠলো লগ্নজিতা। খুবই স্বল্পবেশে লাবণ্যর ছবি, নানা ভঙ্গিমায় তোলা। তবে মেয়েটার চোখ দুটোতে যেন বর্ষার মেঘ টলটল করছে। মেয়েটা যেন বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যামেরার সামনে। লগ্নজিতা দেখছিলো ছবিগুলো খুব মন দিয়ে। হঠাৎ গোপাল বলে উঠলো, এ ওই ছবিবাবুর কাজ। লাবণ্যদিদির অভাবের সুযোগ নিয়ে এসব ছবি তুলে এগুলো দেখে আঁকতো।
গোপাল লোকটাকে দেখে যতটা বোকাসোকা মনে হচ্ছিলো, ততটা যে নয় সেটা ওর সমস্ত বিষয়ে তথ্যের জোগান দেওয়া দেখেই বুঝে নিয়েছে লগ্নজিতা। লোকটা অনেক কিছু জানে। কিন্তু সাবিত্রীর মত অতটা সাবধানী নয়। তাই একে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু তথ্য জোগাড় করার প্ল্যান করলো লগ্নজিতা।
.
লাবণ্যের ঘরে বসে বেশ কিছুক্ষণ গোপালের সঙ্গে কথা বলে ওরা গেলো চারতলায় রাধারমণ মুখুজ্জের ঘরে। গোপাল বললো, কেউ নিজের ঘরের চাবি কি আর দিতে চায়, কিন্তু জেঠিমা বলেছিলো, এখানে থাকতে গেলে এটাই নিয়ম। বাড়িতে কখনো শর্ট সার্কিট হলে তখন কি হবে। এত কম ভাড়ায় এমন বড় বড় ফ্ল্যাট আর পাবে নাকি কেউ কলকাতায়! তাই সবাই জেঠিমার কথাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলো। তখন থেকেই নাম লিখে লিখে চাবির আলাদা আলাদা গোছা রাখা ছিলো আমার কাছে। অবশ্য এই প্রথম আমি সেই চাবির ব্যবহার করছি। এর আগে এদের কারোর অনুপস্থিতিতে এদের ঘর খোলা হয়নি। জেঠিমার কড়া নির্দেশ ছিলো এ ব্যাপারে।
.
চারতলা লেখা চাবির গোছাটা নিয়ে এগিয়ে গেলো গোপাল। লগ্নজিতা বললো, রাধারমণ মুখুজ্জের সঙ্গে লাবণ্যর ঠিক কেমন সম্পর্ক ছিলো তুমি জানো? গোপাল বললো, মুখুজ্জে তো দিনরাত ছবি আঁকা নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। লাবণ্যদিদি আঁকা শিখতে আসতো এখানে। মুখুজ্জে বিনা পয়সায় শেখাতো ওকে। লাবণ্যদিদির আঁকার হাতটা বড় ভালো ছিলো। সেই দেখেই মুখুজ্জে ওকে ছাত্রী করেছিলো। তারপর একদিন দেখলাম লাবণ্যদিদি কাঁদতে কাঁদতে নেমে আসছে ওপর থেকে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কি হয়েছে গো। সে কাঁদতে কাঁদতেই বলেছিলো, স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েদের শরীরটাই তো একটা ক্যানভাস গো গোপালদা। তাই যার ইচ্ছে সেখানে তুলির আঁচড় দিতে পারে। টাকার প্রয়োজনেই লাবণ্যদিদি মুখুজ্জের মডেল হতো।
লগ্নজিতা বললো, গোপালদা, তুমি এবাড়িতে কতদিন ধরে আছো?
গোপাল বললো, বাবু যখন অসুস্থ হলো তখন থেকেই আমি বাবুর সঙ্গে সঙ্গে ছিলাম। জেঠিমার গ্রামের লোক আমি। কাজের সন্ধানে কলকাতা এসেছিলাম। লগ্নজিতা বললো, পড়াশোনা কোথায় শিখলে তুমি? গোপাল হাত কচলে বললো, গ্রামের স্কুলে মাধ্যমিক পাশ করে পালিয়ে এসেছিলাম কলকাতা। তারপর বাবুই আমায় পড়িয়েছে কিছুটা।
বাবুর সঙ্গে থাকতে থাকতে কম মানুষ তো দেখলাম না। শিখলাম অনেক কিছুই। এটুকু হলফ করে বলতে পারি, মুখুজ্জে মোটেই ভালো লোক ছিলো না। প্রফেসরবাবু নিজের খেয়ালে বাঁচা মানুষ, লাবণ্যদিদিকে ভালোবাসতো। আর রাজেশ ঘটি তো বউয়ের পয়সা মেরে নেবার জন্যই জুটেছিলো।
লগ্নজিতা বললো, আর শুভদীপ ঘোষাল কেমন লোক বলে তোমার মনে হয়?
গোপাল ঘরটা খুলে বললো, গভীর জলের মাছ। ওনাকে বোঝা আমার কম্ম নয়। তবে জেঠিমার যত্ন করেন খুব। লাবণ্যদিদির ঘরে আসতেন মাঝে মাঝে। সেটা অবশ্য জেঠিমাকে লুকিয়ে।
আমায় বলতেন, অসহায় মেয়ে তাই সুবিধা-অসুবিধা দেখাটা আমাদের কর্তব্য রে। জেঠিমাকে বলিস না।
ঘন্টাখানেক থাকতেন তারপর বেরিয়ে যেতেন।
লগ্নজিতা বুঝলো, অসহায় মেয়েটির সবরকম সুবিধা সকলেই নিয়েছে। অফিস থেকে বড়বাবু বলেছেন, এসব মেয়েদের এভাবেই মৃত্যু হয়, এদের নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। তার থেকে পৌরসভার মেয়রের বাড়ির পাশে ড্রেন নিয়ে যে ঝামেলাটা চলছে সেটা দেখাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
লগ্নজিতার জেদ চেপে গেছে। একটা মেয়ের আর কোনো উপায় ছিলো না বলে এই পেশা বেছে নিয়েছিলো। সে সমাজের চোখে অত্যন্ত খারাপ চরিত্রের। আর বাকিরা সমাজের গণ্যমান্য মানুষের তালিকায় জায়গা দখল করে থাকবে এটা মেনে নেওয়াটা ওর সইবে না। তাই ঘোষাল থেকে মুখুজ্জে, প্রফেসর থেকে রাজেশ ঘটি …কে আছে এই মৃত্যুর পিছনে সেটা ও খুঁজে বের করবেই।
যে মেয়েটা আর্টিস্ট হতে পারতো, যে মেয়েটা গৃহবধূ হতে পারতো, তাকে এই পথে যেতে বাধ্য করে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের সকলকে একই টেবিলে বসিয়ে প্রশ্ন করবে লগ্নজিতা।
রাধারমণ মুখার্জীর ঘরে অজস্র ক্যানভাস, কোনটাতে একটা ছবি অসমাপ্ত আবার কোনটাতে যত্ন করে সাদা কাপড় টাঙানো। এদিক ওদিক দেখতে দেখতেই চোখে পড়লো লাবণ্যর সম্পূর্ণ নগ্ন ছবি। মেয়েটার চোখে অসহায়তা। গোটা শরীরে যৌবনের ঢল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামটুকুও নিখুঁতভাবে ফুটিয়েছে শিল্পী। অদ্ভুত আঁকার হাত তো তোমাদের মুখুজ্জেবাবুর।
গোপাল ছবিটার দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বললো, সারাদিন জামা-কাপড় ছাড়া ঠায় বসিয়ে রেখে লাবণ্যদিদিকে বোধহয় চারশো না পাঁচশো টাকা দিতো। লগ্নজিতা অপলক তাকিয়ে বললো, লাবণ্যের টাকার এত প্রয়োজন কেন হতো জানো তুমি গোপালদা? গোপাল মাথা নিচু করে বললো, সে কথা দিদিমণি কাউকে বলতে বারণ করেছিলো। আজ তো আর সে নেই, তাই কথা রাখার দায়িত্বও নেই। দিদিমণির বাবা নেই। বাবা ছোটতেই ছেড়ে চলে গেছে। ওরা দুই বোন আর মা। কাকার সংসারে অবহেলায় মানুষ। মা অনেক কাজ করে ওদের মানুষ করেছে। মা এখন অসুস্থ। তাই মাকে টাকা পাঠাতো। কাউকে বলতে বারণ করেছিলো যে ওর মায়ের টিবি আছে। তাহলে যদি ওকে আর এবাড়িতে থাকতে না দেয় তাই। রাজেশ হারামজাদা নাকি ওকে বুঝিয়েছিলো, কলকাতায় গিয়ে ওর মায়ের ভালো হসপিটালে চিকিৎসা করাবে। সে হারামজাদা তো বউকে এই বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। লাবণ্যদিদি আর লজ্জায় গ্রামে ফেরেনি। কাকার বাড়ি থেকে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে এসে বিয়ে করেছিলো তো, তাই আর গ্রামমুখো হয়নি। এখান থেকেই মাকে চিঠি লিখতো। ও খুব ভালো আছে, রাজেশ ভালো রেখেছে, টাকা পাঠিয়ে বলতো, তোমার জামাই পাঠাচ্ছে।
লগ্নজিতার বুকটা ভারী হয়ে গেলো। এই কম বয়সেই ও জীবনে অনেক কেস দেখেছে, তবে খুন, ছিনতাই, রাহাজানি দেখে দেখে ওর চোখ সয়ে গেছে। তারপরেও অচেনা এই মেয়েটার ছবির দিকে তাকিয়ে বুকটা মুচড়ে উঠলো। সেকি, ওর মা নাকি বলে, জিতার শরীরের কোনো রক্তকণিকায় নাকি মায়া-দয়া শব্দটাই নেই। তাহলে এই যন্ত্রণাটা কিসের! রাধারমণ মুখুজ্জের আরও কিছু ছবি ঘেঁটে লগ্নজিতা বললো, তুমি জানো গোপালদা লাবণ্যর বাড়ি কোথায়?
গোপাল বললো, জানি। এবাড়িতে সে একমাত্র আমাকেই বিশ্বাস করে সবটুকু বলেছিলো। জেঠিমাকে সে সম্মান করতো আর আমাকে….
গলাটা সামান্য ধরে এলো গোপালের।
সেদিন ঠিক কি হয়েছিলো?
গোপাল সবটুকু বলে দম নিয়ে বললো, আমিই শুভ দাদাবাবুকে খবর দিয়েছিলাম। শুভ দাদাবাবু ভয় পেয়ে থানায় ফোন করে বলেছিলো, এখানে খুন হয়ে গেছে।
দিদিমণি সত্যিই কি লাবণ্যদিদিকে কেউ খুন করে রেখে গিয়েছিলো? বড় চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিলো, পাঁচটা কথা বললে, একটার উত্তর দিতো। কে জানে মনে দুঃখ জমেছিলো নাকি! জীবনে তো কম ঠকেনি সে! লগ্নজিতা বেশ কয়েকটা পয়েন্ট নোট করে নিয়ে বললো, আমি আবার আসবো গোপালদা। ব্যাংকের কেউ বা ওপরের কলেজের ছেলেদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিলো না লাবণ্যর, তাইতো?
গোপালদা একটু ভেবে বললো, না ছিলো না। তবে একদিন একজন লম্বা মত লোক ব্যাংকে এসে আমাকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেছিলো। প্রফেসরবাবু এখানে কার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, এ বাড়িতে কে কে থাকে, লাবণ্যদিদির খোঁজ নিচ্ছিল। জিজ্ঞেস করছিলো, প্রফেসরবাবু কবে কবে আসে এখানে। লাবণ্যদিদির সঙ্গে কথা বলা যায় কিনা! আমি তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। লগ্নজিতা একটা ছবি বের করে জিজ্ঞেস করলো, দেখো তো এই লোকটা কিনা! গোপাল উত্তেজিত হয়ে বললো, হ্যাঁ এই তো এই লোকটাই।
গোপাল বললো, আসলে ব্যাংক থাকায় নানারকম লোক আসছে চব্বিশঘন্টা। কত নজর রাখি বলুন তো? তবে আমি যেহেতু সব তলায় গিয়ে জল ভরার কথা বলে আসতাম তাই চোখ কান খোলা রেখে দেখার চেষ্টা করতাম।
লগ্নজিতা রানীবালাদেবীর ঘরে ঢুকতেই উনি বললেন, অভাগী কি ভালোবাসা খুঁজতে ওপরে পাড়ি দিলো? নাকি ভালোবাসা এসেই তাকে ওপরে পাঠিয়ে দিলো? কি বুঝতে পারলেন অফিসার?
লোভ লোভ, মেয়েটার বড্ড লোভ। ভালোবাসা, সংসার এসব কি এতোই সহজ জিনিস রে। আহা, উহু করবে ঠিকই, কিন্তু কেউ ক্লাবে যাওয়া মেয়েকে ঘরের বউ করবে না। এই সত্যিটা সে অভাগী বুঝলো না।
.
রানীবালাদেবী একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন, লাবণ্যের মায়ের চিঠি। লেটার বক্সে এসে পড়েছিলো। লাবণ্যকে আর দেওয়ার সুযোগ হয়নি। ওর ব্যাগের টাকাগুলো তো আপনাদের থানায় জমা রেখেছেন। এই নিন, ওর মায়ের চিঠিতে যদি ঠিকানা পান, তাহলে টাকাটা ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। মা-মেয়ের পার্সোনাল চিঠি পড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। তবে টাকাগুলো ওর বাড়িতে পৌঁছে গেলে খুশি হবো।
.
আর একটা কথা, সাবিত্রীর কাছে শুনেছি লাবণ্য মারা যাবার আগে নাকি হঠাৎই একটা দাড়িওয়ালা লোক ওর ঘরে দিন দুই এসেছিলো। সাবিত্রীর ধারণা রাজেশই ছদ্মবেশে এসেছিলো।
.
ভদ্রমহিলার বাচনভঙ্গিমাটা ভীষণ আকর্ষণীয়। স্পষ্ট উচ্চারণে মার্জিতভাবে নির্দেশের সুরে অনুরোধ করেন রানীবালাদেবী। রানীভবনের মালকিন। যে রানীভবনের বর্তমান মূল্য কয়েক কোটি টাকা।
.
লগ্নজিতা রানীভবন থেকে বেরিয়েই গেলো শুভদীপ ঘোষালের অফিসে। গদির ওপরে বসে ল্যাপটপে কিছু একটা হিসেব কষছিলো শুভদীপ। ওকে দেখে ভূত দেখার ঢঙে বললো, ম্যাডাম এবারে তো আপনি পিছন ছাড়ুন। আমি তো কবেই আপনাদের থানায় জানিয়ে দিয়েছি, এটা খুন নয়, আত্মহত্যা! কলকাতায় কি অপরাধ এতোটাই কমে গেছে, যে একটা বাজারের মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে পড়ে আছেন! উত্তেজনায় হালকা কাঁপছিলো ঘোষালের গলাটা।
লগ্নজিতা নির্লজ্জের মতই সামনের চেয়ারে ঝুপ করে বসে পড়ে বললো, আপনি বড্ড রেগে যান মিস্টার ঘোষাল। বিজনেস ম্যানদের কিন্তু আরেকটু ধৈর্যের দরকার। লাবণ্যের মুনলাইটে যাওয়ার পিছনে আপনার হাত আছে। শুধু ভাড়াটের কাছে মাসের একদিন যে আপনি যেতেন না সেটা আপনার জেঠিমা না জানলেও, আমি জানি।
এমনকি সামান্য ভাড়াটের খোঁজ নিতে আপনি কখনো কখনো দুপুরের নিস্তব্ধতাকেও কাজে লাগিয়েছেন। লাবণ্যের ভাতঘুমের সময়ে আপনার উপস্থিতি ওকে কখনো কষ্ট দেয়নি মিস্টার ঘোষাল? আপনার যেন কটা সন্তান মিস্টার ঘোষাল? আপনারা সকলেই কি ওই বাড়িটাতে থাকেন? ঘোষালের বাড়ির দিকে আঙুল তুলে ইঙ্গিত করলো লগ্নজিতা।
শুভদীপ ঘোষাল ভেঙে পড়ার গলায় বললো, প্লিজ ম্যাডাম। এই বয়সে বেইজ্জত করবেন না ফ্যামিলির চোখে। বলুন কি কি জানতে চান। যেটুকু জানি সত্যি বলবো কথা দিচ্ছি। লগ্নজিতা হেসে বললো, বিজনেস ম্যান আর পুলিশ দুজনকেই আমি বিশ্বাস করি না মশাই। দুজনের কেউ কথা দিয়ে কথা রাখে না।
আগের দু-দিন আপনি যে লেভেলের মিথ্যে বলেছেন, তাতে বিজনেস ম্যানদের সম্পর্কে আমার ধারণাটাকে আরও দৃঢ় করে দিয়েছেন। আর পুলিশকে বিশ্বাস না করার একটা কারণ আপনাকে বলি, পুলিশরা যখন দেখে একজন ক্রমাগত মিথ্যে বলছে, তখন তার সততার প্রতি কোনোরকম আস্থা রাখতে না পেরে তাকে দেওয়া কথারও খেলাপ করে ফেলে বেখেয়ালে। গলার স্বরে দৃঢ়তা এনে লগ্নজিতা বললো, আমি দুটো কায়দায় জেরা করি। সত্য অনুসন্ধানকারী লগ্নজিতা ভট্টাচার্য মানুষকে এবং তার পেশাকে সম্মান করে, তার সঙ্গে বন্ধুর মত মিশে সাহায্য চায়। তার সত্য অনুসন্ধান করতে যারা হেল্প করে লগ্নজিতা তাদের ভোলে না। আর এস আই লগ্নজিতা ভট্টাচার্য বড্ড বেয়াদপ। কথা দিয়েও কথা না রাখার ইতিহাস তার ঝুলিতে খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। আচমকা তাকে না জানিয়ে ভোররাত্রে কেউ শহর ছাড়বে ভেবে এয়ারপোর্টের দিকে এগুলো ধরুন, তখন লগ্নজিতা ভট্টাচার্য তাকে ডিরেক্ট নিজের কাস্টডিতে নিয়ে চলে আসে। সে জেরা হয় অন্যরকম পদ্ধতিতে। তাই মিস্টার ঘোষাল, সিদ্ধান্ত আপনার… আপনি কার কাছে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন। সত্য অনুসন্ধানী লগ্নজিতার সামনে নাকি এস আই ভট্টাচার্যর সামনে!
শুভদীপ ঘোষাল ভীতু গলায় বললো, ম্যাডাম আমি আজকে যা বলবো সব সত্যি বলবো। ক্যাশবক্সে হাত রেখে বলছি। লগ্নজিতা রেকর্ডারটা অন করে বললো, বলতে পারেন। রাজেশ ঘটি লাবণ্যকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আপনার কাছ থেকে ঠিক কত টাকা নিয়ে গিয়েছিলো মিস্টার ঘোষাল? লাবণ্যের আগে আপনি আর কটা মেয়েকে মুনলাইটে কাজ দিয়েছিলেন?
মুনলাইট বারের কত পার্সেন্ট শেয়ার আপনার নামে? রিয়েল এস্টেটের বিজনেসে তো বেশ কিছুদিন ধরে ঝাড় খাচ্ছেন আপনি, ঠিক কত টাকা লোকসানে যাচ্ছে আপনার বিজনেস?
লগ্নজিতার ক্রমাগত প্রশ্নে কপালে ভাঁজ পড়লো শুভদীপের। মুখে অন্ধকারের আস্তরণ ঘন হচ্ছিলো। ও বেশ বুঝতে পারছিলো, লগ্নজিতা ভট্টাচার্য প্রমাণ না নিয়ে কাজে নামেনি।
শুভদীপ ঘোষাল ঢোক গিলে বলতে শুরু করলো লাবণ্যর রানীভবনে পদার্পন থেকে মুনলাইট জার্নি….মৃত্যুর দিন ঠিক কে কে এসেছিলো লাবণ্যের কাছে!