নৃত্যরত মধুবালা
একটা উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ির মধ্যে একা একা থাকতে মাঝে মাঝে দমবন্ধ হয়ে যায় মধুবালার। গ্রাম থেকে দূরে ওদের এই দেবোত্তর সম্পত্তি হিসাবে পাওয়া বাড়িটা। এদিকে হাটবার ছাড়া লোকজন তেমন আসে না। আর পাঁচজনের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাবা বারংবার নিষেধ করে দিয়েছেন। ও নাকি স্বয়ং নীলকণ্ঠের সন্তান। তাই ওকে সাধারণের মাঝে মিশতে নেই।
নীলকণ্ঠের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ও বহুবার প্রশ্ন করেছে, কেন ও এমন একাকী? নীলকণ্ঠ কোনোদিন ওর প্রশ্নের উত্তর দেননি। অভিমানে গর্ভগৃহে বসেই কেঁদেছে ও।
আজকে সকালেও বাবা নিষেধাজ্ঞা জারি করে গেছেন মধুবালা যেন নয়নার ধারে না যায়। একমাত্র কল্লোলিনী নয়নার সঙ্গেই ও মনের গোপন কথা বলতে পারে। তার কাছেও যেতে বাধা আছে শুনে মনটা আচমকাই বিদ্রোহী হয়ে উঠলো মধুবালার। ওকে কি কেউ কখনও ভালোবাসবে না?
পায়ে ঘুঙুর দুটো পরে নিয়ে বাবার অনুপস্থিতিতে, পায়ে তাল দিতে শুরু করলো। ওর গলায় ঈশ্বরপ্রদত্ত সুর। আনমনে গাইতে শুরু করলো মধুবালা। মন্দিরের বাইরে এসে পৌঁছেছে কখন ও নিজেও জানে না। নয়নার জলে অস্তগামী সূর্যের রঙের খেলার দিকে তাকিয়েই ওর ঘুঙুরে বোল উঠলো। শরীরী বিভঙ্গে মাতোয়ারা হয়ে আপন মনে নাচছিল মধুবালা। দুটো ময়না পাখিও ওর সঙ্গে সঙ্গত দিচ্ছিলো। ঘামে ভিজে যাওয়া বুকের ওপরের স্বচ্ছ উত্তরীয়টা গোছাতে গিয়েই চোখ পড়লো মানুষটার দিকে।
এক বিদেশি তার নীলাভ চোখে অপার বিস্ময় মিশিয়ে বললেন, বোঁজু (হ্যালো)…
মধুবালা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো বিদেশির সোনালী চুলের দিকে। বিদেশি আবার বললেন, আপনি কি কাঞ্চনী? এমন অপূর্ব সুন্দরী, এমন সুন্দর সুর আপনার গলায়, পায়ে এমন মনোহরণকারী ছন্দ…মধুবালা কাঞ্চনী শব্দের অর্থ না জেনেই ভয়ে ভয়ে বললো, আমার নাম কাঞ্চনী নয়, আমি মধুবালা।
বিদেশির পশ্চাতে আরেকজন পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন, মধুবালা এতক্ষণ খেয়ালই করেনি। তিনি বললেন, প্যাট্রিক ওনাকে আমাদের বেগমমহলের কাঞ্চনী করে নিয়ে গেলে কেমন হয়!
মধুবালা তখনও ঠিক বুঝতে পারছিল না এরা ঠিক কি বলতে চাইছে। বিদেশি মধুবালাকে সতর্ক করার ঢঙে বললেন, আপনার সম্মুখে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর পরিচয় সম্পর্কে আপনি কি আদৌ অবগত?
মধুবালার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দ্রুত শ্বাসের কারণে শরীরের ওঠানামা অব্যাহত রয়েছে। বিদেশি সেদিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি স্বর্গের অপ্সরী? তাঁর ভাঙা বাংলা বুঝতে তেমন অসুবিধা হচ্ছিল না মধুবালার। কিন্তু আরেকজন উষ্ণীষধারী পুরুষের স্পষ্ট বাংলাগুলো বুঝতে ওর বেশ কষ্ট হচ্ছে। বেগমখানা, কাঞ্চনী এসব কি বলছেন উনি?
মধুবালা ঘাড় নেড়ে বললো, না মহাশয়, আমি ওনাকে চিনি না। বিদেশি মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, উনি হলেন রুদ্রনগরের বাদশাহ মহম্মদ মুসাফির।
মধুবালা স্তম্ভিত হয়ে হাত জোড় করে বললো, আমার প্রণাম গ্রহণ করুন।
মুসাফির স্মিত হেসে বললেন, আপনি তার মানে হিন্দু নারী। আপনার সহবত সেটাই প্রমাণ করে।
মধুবালা কিছু বলার আগেই মুসাফির বললেন, প্যাট্রিক আমার যতদূর জ্ঞান আছে তাতে আমাদের রুদ্রনগরের বেগমমহলে এখনও কোনো হিন্দু নারীর প্রবেশ ঘটেনি। মধুবালা প্রথম হিন্দু কাঞ্চনী হিসাবে যদি বেগমখানায় যায় তাহলে কেমন হবে? প্যাট্রিক তখনও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন মধুবালার দিকে। মধুবালার গোলাপের পাঁপড়ির মত ঠোঁট দুটো নয়না নদীর জলের মত তিরতির করে কাঁপছে।
প্যাট্রিক সেদিকে তাকিয়েই বললেন, মহান বাদশাহের তৃতীয় বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে কয়েক মাসে আগেই। নতুন বেগম আপনার জন্য অপেক্ষারতা। বল্লভপুরের যুদ্ধ সমাপ্ত করে প্রাসাদে ফিরতে হবে দ্রুত। তাই এই মুহূর্তে আর কোনো নারী অপহরণের দায় নেওয়াটা আবশ্যিক নয়। মুসাফির কাব্যের ঢঙেই বললেন, আহা, প্যাট্রিক মাঝে মাঝে তুমি বড় বেরসিক হয়ে যাও। বেগমরা তো আমার শাদি করা নারী। আমি এমন নারীর সন্ধানে আছি যে শুধু আমার কাব্য লেখার প্রেরণা হবে। কখনও সে আমার ইচ্ছায় গেয়ে উঠবে। কখনও বৃষ্টির শব্দে নেচে উঠবে…সে আর পাঁচজন কাঞ্চনীর মত রইস খানদানে জলসা বসাবে না। সে কাঞ্চনী হবে আমার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ। আমার যুদ্ধ শেষের ক্লান্ত শরীরের বিশ্রাম।
বাদশাহ মিজানুরের কোনো গুন মুসাফির পাননি এটা বলা অনুচিত হবে। বাদশাহ মিজানুরেরও ছিলো নারীর প্রতি অমোঘ আকর্ষণ। যতগুলো যুদ্ধ তিনি জিতেছেন সব রাজ্য থেকে তাদের বেগমখানাকে উজাড় করে এনে বাড়িয়েছেন রুদ্রনগরের হারেম। মিজানুরেরও একাধিক বেগম আছে রুদ্রনগরের হারেমে। মুসাফির ইতিমধ্যেই তৃতীয় বিবাহ সমাপ্ত করেছেন। তাই নারীদের প্রতি এদের অমোঘ আকর্ষণ প্যাট্রিকের অজানা নয়।
এমন সারল্যে ভরা মুখখানির দিকে তাকিয়ে অজানা এক ব্যথা অনুভব করলেন প্যাট্রিক। হারেমে বন্ধ থাকবে এই নারী? মুসাফিরের মন বহালানো একমাত্র কাজ হবে এই সুদর্শনা সুরেলা কণ্ঠীর? ভেবেই শিউরে উঠলেন প্যাট্রিক। ঘুঙুরের শব্দ শুনে বাদশাহকে বলাই উচিত হয়নি যে এখানে কোনো কাঞ্চনীর বাস আছে কিনা খুঁজে দেখতে। প্যাট্রিক ভেবেছিলেন যদি কাছে পিঠে কাঞ্চনীরা বাস করে তাহলে কিছু অর্থের বিনিময়ে তাঁবুর মধ্যে বসে থাকা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেবার জন্য প্রস্তুত মানুষগুলোকে একটু উজ্জীবিত করা যাবে নাচ-গান শুনিয়ে। কিন্তু এ যে গৃহস্থ ঘরের অবিবাহিতা কন্যা, বাদশাহ একে কামনা করে বসলেন!
কি মহাবিপদ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে তার গুরুত্ব না বুঝেই মধুবালা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদের সামনে।
মুসাফিরের রক্তপাত অপছন্দের, রাজ্য পরিচালনাও তেমন পছন্দের কাজ নয়। কিন্তু প্যাট্রিক জানেন সুন্দরী বিদুষী নারীদের প্রতি মুসাফিরের আগ্রহ মারাত্মক। ভিনদেশী হলেও প্যাট্রিক জানেন যে হিন্দু গৃহস্থ নারীদের কাঞ্চনী হওয়ার থেকে মৃত্যু অনেক বেশি গর্বের। তাই মুসাফিরকে সংযত করতেই বলে বসলেন, এবারে আমাদের ফিরতে হবে বাদশাহ। সুজান খান আমাদের না দেখে মনে হয় চারিদিকে খুঁজতে পাঠিয়ে দেবেন।
মুসাফির কাতর স্বরে বললেন, আহা প্যাট্রিক তুমি হঠাৎ এমন বেরসিক কেন হয়ে উঠলে। মধুবালা আপনি আমাদের একটু শীতল পানীয় পান করাতে পারেন, আমরা বড়ই তৃষ্ণার্ত।
মধুবালা ঈষৎ ঘাড় নেড়ে অতিথি সেবার উদ্দেশ্যেই বললো, ভিতরে আসুন। আমার বাড়ির ভিতরে স্বয়ং নীলকণ্ঠের বাস। আমার পিতা পূজারী ব্রাহ্মণ। প্যাট্রিকের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা করে মুসাফির মধুবালাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে লাগলেন। প্যাট্রিক ইতস্তত করে এগিয়ে গেলেন ওদের পশ্চাতে।