শুভদীপের জবাবদিহি
শুভ এতে এতো বিরক্ত হওয়ার কি আছে সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। তোমার জেঠুও উকিল হয়ে কোনো মিথ্যে কেস কোনোদিন নেয়নি। তাই আমিও তার আদর্শেই সত্যের পাশে দাঁড়াতে চাই। লাবণ্য খুন হয়েছে না আত্মহত্যা করেছে এটুকুই জানতে চাই। তাছাড়া আমার বাড়িতে ঢুকে কেউ যদি সত্যিই তাকে খুন করে দিয়ে যায় তাহলে কাল তো আমাকেও মেরে দিয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে অফিসার যখন তদন্ত করতে চাইছে তখন আমাদের তরফ থেকে কেন তাকে সাহায্য করবো না বলতে পারো?
শুভদীপ ঘোষাল বরাবরই জেঠিমার সামনে একটু ঘাবড়ে যায়। উকিলের বউ বলেই কিনা জানে না, কিন্তু জেঠিমার যুক্তির তীক্ষ্নতায় কথার খেই হারিয়ে ফেলে। আজও আমতা আমতা করেই বললো, আসলে কি বলতো জেঠিমা, আমি চাই না রানীভবনের কাউকে এ বিষয়ের মধ্যে জড়িয়ে ফেলা হোক। তাছাড়া লাবণ্যের ঘরে অনেক টাকা ছিলো, খুনির মোটিভ যদি টাকা চুরি করা হতো তাহলে সে ওগুলো ফেলে রেখে যেতো না। তাই বলছি ও নিজের মনের কষ্টেই হয়তো….
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই রানীবালা বললেন, কিন্তু শুভ, মেয়েটার যখন টাকা ছিলো না তখন সে লড়াই করলো আর যখন টাকা এলো তখন সে আত্মহত্যা করলো এটাও কি খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে তোমার!
শুভদীপ প্রমাদ গুনলো। একবার যদি জেঠিমা জানতে পারে যে শুভদীপই লাবণ্যকে মুনলাইট বারে নিয়ে গিয়েছিলো তাহলে হয়তো উকিল ডেকে এ বাড়ির দলিল বদলে ফেলতে চাইবে।
তাই আমতা আমতা করেই বললো, তবুও এসবে জড়ালে এ বাড়ির বদনাম হবে জেঠিমা।
রানীবালাদেবী স্বভাবচিত গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললেন, শুভ আমি বাতের ব্যথায় বাইরে বেরোই না বলে কি বাইরের বাতাস থমকে আছে? সেখানে নিশ্চয়ই এতোক্ষণে কানাকানি হয়েই গেছে যে এ বাড়িতে একজন খুন হয়েছে। আর লাবণ্য যে বারে যেতো বা তার কাছে যে অনেক পুরুষ মানুষ আসতো এই খবরও আশেপাশের বাতাসে নিশ্চয়ই আছে। তাই চাপা দেবার আর কিছু নেই। বরং খুনি এবাড়িতে গা ঢাকা দিয়ে নেই জানলে অন্তত তোমার জেঠুর সম্মানটুকু বাঁচবে।
শুভদীপ শান্ত গলায় বললো, যা তুমি ভালো বোঝো জেঠিমা।
শুভদীপ উঠে চলেই আসছিলো ঘর থেকে। আচমকা জেঠিমা বলে উঠলো, তোমার বাজারে ধার হয়ে গেছে আমাকে তো জানাতে পারতে। অকারণে মেয়ে বিক্রির ব্যবসায় নেমে ঘোষাল বাড়ির বদনামটা না করলেই পারতে! চমকে উঠলো শুভদীপ। তবে কি ওই মহিলা অফিসার সবটা বলে দিয়ে গেছে জেঠিমাকে!
রানীবালাদেবী আড়চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, কত টাকা নিয়েছিলে লাবণ্যকে বেচে মুনলাইট বার থেকে? আর এতো টাকা মার্কেটে তোমার ধার হলোই বা কি করে?
আর লুকিয়ে রেখে বিশেষ উপকার হবে না বুঝেই শুভদীপ বললো, দুটো ফ্ল্যাট আটকে গেছে রেডি হবার পরে। কেউ একজন অকারণে ইনজাংশন জারি করে দিয়েছে। তাই কাস্টমাররা টাকা ফেরত চাইছে। এসব নিয়ে জড়িয়ে আছি। তবে জেঠিমা আমি কিন্তু লাবণ্যকে বেচে দিইনি। লাবণ্যই এসেছিলো যাহোক একটা কাজের খোঁজ করতে। শিক্ষা দীক্ষা তেমন নেই, দেখতেও যে আহামরি তা নয়, তাই মুনলাইটের ম্যানেজারকে বলে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। রানীবালা বললো, মুনলাইটে কি কাজ হয় লাবণ্য জানতো?
শুভদীপ ঢোক গিলে বললো, পরে জেনেছিলো। তাছাড়া ওর বরই তো ওকে ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলো। আমি আর কি করবো?
রাজেশ যে শুভদীপের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা পেয়েছিলো সেটা আর জানানো হলো না জেঠিমাকে। তার আগেই জেঠিমা গম্ভীর গলায় বললেন, এবারে তুমি এসো, আমার আহ্নিকের সময় হয়ে গেছে।
.
শুভদীপ আনমনে লাবণ্যের ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। মনে পড়ে গেলো লাবণ্যের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আছে নিজের আঁকা একটা নিজের ছবি। মেয়েটা বোধহয় আয়নার সামনে বসে নিজেকে এঁকেছিলো। তখনও মুনলাইটের দরজায় পা রাখেনি লাবণ্য। তাই কপালে সিঁদুরের বড় টিপ আর সিঁথিতে সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে।
এমন লাবণ্যকেই প্রথম দেখেছিলো শুভদীপ এই বাড়ির উঠানে। রাজেশ ঘটির পিছনে সংকোচে দাঁড়িয়ে ছিলো জড়সড় হয়ে।
রাজেশ ঘর ভাড়া চেয়েছিলো, আধার কার্ড দেখেই ওদের ভাড়া দিয়েছিলো। কয়েকমাস পরেই রাজেশকে দেখেছিলো একটা দালালের সঙ্গে কথা বলতে। সন্দেহ হয়েছিলো শুভদীপের। রাজেশকে চেপে ধরতেই বলে দিয়েছিলো, লাবণ্যকে বিক্রি করতে চায়। ওর নাকি এটাই বিজনেস। বিয়ে করে নিয়ে আসে গ্রামগঞ্জ থেকে তারপর কলকাতায় এসে বিক্রি করে দেয়। দু-দিন স্বামী-স্ত্রী-র নাটক করে, তারপর পালায়। কিন্তু লাবণ্যের গায়ের রংটা শ্যামলা বলে ভালো দাম পাচ্ছে না এবারে। শুভদীপ তখন মুনলাইট বারের রেগুলার কাস্টমার। ম্যানেজারকে একদিন কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেছিলো, এই ড্রিংক সার্ভ করার মেয়েগুলোকে কোথা থেকে কেনে?
ম্যানেজার জিভে চুকচুক করে আওয়াজ করে বলেছিলো, এসব শহুরে মেয়ে নয়। গ্রামের সাধারণ মেয়ে ছিলো। আমি রীতিমত গ্রূমিং করে তাদের রেডি করেছি। আসলে কি জানেন ঘোষাল, গ্রামের দিকের সোজা সহজ মেয়েগুলো বড্ড তাড়াতাড়ি প্রেমে পড়ে যায়। আর সেই সুযোগে হাতবদল হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। এখানে যাদের দেখছেন সব মেয়েগুলো সংসার সাজাবে এই আশায় গ্রাম থেকে একজনের হাত ধরে এসেছিলো শহরে। সেই সব তথাকথিত স্বামীগুলোই ওদের বিক্রি করে দিয়েছে। আমি কাউকে ডিরেক্ট কিনেছি কাউকে দু-হাত বদল করে।
শুভদীপের বাজারে ধার বাড়ছিলো, রাজেশ খদ্দের খুঁজছিলো। মাথার মধ্যে একটা টুনি বাল্ব যেন ঝিলিক দিয়ে উঠেছিলো। মুনলাইটের ম্যানেজার বলেছিলো, তেমন চাঙ্গা মেয়ে হলে লাখ পাঁচেক মত দিই।
পরের দিনই লাবণ্যকে রাজেশের কাছ থেকে এক লাখ টাকায় কিনে নিয়েছিলো শুভদীপ। রাজেশ চলে যাবার পরে লাবণ্যকে মুনলাইটে নিয়ে যাবে এমনই প্ল্যান করেছিলো শুভদীপ। হঠাৎই জেঠিমা লাবণ্যের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বললো, ওর স্বামী চলে গেছে বলে ওকে তাড়িয়ে দিস না যেন, আহা অসহায় মেয়ে। কদিন বিনা ভাড়াতেই থাকুক ও।
আবার অন্যরকম ভাবে ছক সাজাতে হয়েছিলো শুভদীপকে। মাস পাঁচেক পরে যখন লাবণ্যের হাত একদম ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো তখনই একদিন সন্ধেবেলা ওর ঘরে ঢুকেছিলো শুভদীপ। ওর খোঁজ-খবর নিতে। তখনই কথায় কথায় একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিলো লাবণ্য। লাবণ্যর সঙ্গে একটাই শর্ত হয়েছিলো, ওর আসার খবর যেন ও কোনোদিন না দেয় জেঠিমাকে। তবেই কাজের ব্যবস্থা করে দেবে শুভদীপ। মেয়েটার গোটা শরীর জুড়ে সতেজ সারল্য ছিলো। পাশে বসলে বুনো ফুলের গন্ধ পাওয়া যেতো। বাজারের নামীদামী পারফিউমের মতো নজরকাড়া সুবাস নেই তাতে কিন্তু মাতাল করার ক্ষমতা আছে। শুভদীপ বলেছিলো, আগে নিজেকে শহুরে করতে হবে তারপর কাজ পাবে। লাবণ্য ঘাড় নেড়ে বলেছিলো, রাজি।
মুনলাইটে যখন ওকে নিয়ে গিয়েছিলো শুভদীপ তখনও লাবণ্যর মুখে মাটির ছোপ। তার কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েটাকে দেখে আর নিজেই চিনতে পারছিলো না ও। ভাড়ার টাকাটা শুভদীপের হাতে দিয়ে বলেছিলো, রাজেশের থেকে কত টাকা দিয়ে কিনেছিলেন আমাকে? আর এখন কত দিয়ে বেচলেন? আপনার লোকসান হয়নি তো? না ক্যাশ ছয়লাখ লাভ করেছিলো শুভদীপ। একটাই শর্ত লাবণ্য আর কোনো ক্লাবে বা বারে কাজ করতে পারবে না। সাতলাখ দিয়ে মুনলাইট সারাজীবনের মত কিনে নিয়েছিলো লাবণ্যকে। শুভদীপ মাঝে মাঝে জেঠিমাকে লুকিয়ে যেতো লাবণ্যের ঘরে।
সেই মুখচোরা মেয়েটা মুনলাইটের আলোর ঝলকানিতে হারিয়ে গিয়েছিলো খুব তাড়াতাড়ি। শুভদীপ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে লাবণ্য বলতো, কি মাংস খেতে ভালোবাসেন আপনি, কাঁচা না ঝলসানো?
মেয়েটা যেন চুম্বকের মত টানতো ওকে। কিন্তু কোনোদিন ওকে ছুঁয়েও দেখেনি শুভদীপ। মেয়েটার চোখে ছিলো ওর জন্য অনেকখানি ঘৃণা। ওই ঘৃণার পাহাড় পেরিয়ে ওর শরীরের দিকে হাত বাড়াতে পারেনি শুভদীপ। মেয়েটা আত্মহত্যা করেনি বোধহয়, খুনই হয়েছে, কিন্তু করলো কে? মুনলাইটের সঙ্গে ওর কোনো ঝামেলা হয়েছে বলে তো মনে হয়নি। ম্যানেজার এখনও লাবণ্যের জন্য আফশোস করে। তাহলে কে? অফিসার বোধহয় শুভদীপকেই সন্দেহের তালিকায় প্রথমে রেখেছে। কিন্তু শুভদীপ যখন এ ঘরে ঢুকেছিলো তখন লাবণ্যের শরীরটা ঝুলছে সিলিং থেকে। পাশের একটা কালো চামড়ার ব্যাগের চেন খোলা, বেশ কয়েকটা টাকার বান্ডিল উঁকি দিচ্ছিলো। ঘাবড়ে গিয়েই থানায় ফোনটা করেছিলো শুভদীপ। গোপাল আঁতকে উঠে বলেছিলো খুন…খুন…
শুভদীপও থানায় বলে বসেছিলো খুন হয়েছে। এখন কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যদি শুভদীপকে খুনি সাব্যস্ত করে ওই মিস লগ্নজিতা তাহলে কি হবে! জেল হয়ে যাবে নাকি ওর!
লগ্নজিতার ফোন নম্বরটা ডায়াল করলো শুভদীপ। তার থেকে বরং সব সত্যিটুকু স্বীকার করাই শ্রেয়।
.