গুঞ্জার অভিমান
তুই কখনো বলিসনি তো অব্যয় তোর বুটিকে এসেছিলো? গুঞ্জা সোফার কুশনে নতুন কভার পরাতে পরাতে বললো, তুইও তো বলিসনি স্কুল থেকে ফেরার পথে অব্যয় তোকে কোনো এক রানীভবনে যেতে বলেছিলো? সেখানে একজন লাবণ্য বলে কেউ আছে?
রক্তিম আমি বোধহয় ভীষণ রকমের বোর হয়ে গেছি না রে তোর কাছে? রক্তিম ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই বললো, অলটাইম একই গেম খেলবি না আমার সঙ্গে। অকারণে সব দোষ বলের মত আমার দিকে ছুঁড়ে দিবি না। আমার বলার মত কিছু ছিলো না। কারণ অব্যয়ের এসব খামখেয়ালিপনাকে আমি জাস্ট ছেলেমানুষি ভেবেছি। শিল্পীর উড়ন্ত মনের টান ভেবে গ্রাহ্য করিনি। কিন্তু তোর বুটিকে ও দু-দু-বার এলো, গিফট কিনলো, তা সত্ত্বেও তুই কেন বললি না রে আমায়?
এখনও কি অব্যয় সম্পর্কে আগ্রহ আছে তোর?
গুঞ্জা অভিমানী গলায় বললো, তোর বুঝি তাই মনে হয়? ঠিক কখন মনে হয় রে? যখন তোর জন্য যত্ন করে লাঞ্চ বানাই? যখন যত্ন করে তোর টিফিন বক্স গুছিয়ে দিই, যখন মনে করে তোর ওয়ালেট থেকে ঘড়ি …সব গুছিয়ে রাখি, নাকি যখন বিছানায় তোর শরীরে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দিই তখন?
কখন তুই আমার অস্তিত্বের মধ্যে অব্যয়কে খুঁজে পাস?
রক্তিম আলগোছে বললো, সেদিন যখন অব্যয়ের এক্সিবিশনে গিয়েছিলাম, তখন ওর প্রত্যেকটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তোর মুগ্ধ দৃষ্টি আর প্রশংসা আমি দেখেছিলাম গুঞ্জা। আমি মানছি অব্যয় শিল্পী হিসেবে খুব বড় মাপের, কিন্তু তোর চোখে ওর প্রশংসা দেখতে আমার ভালো লাগে না।
গুঞ্জার চোখে গাঢ় হয়ে এলো অভিমানী মেঘ। সেদিকে তাকিয়েই ল্যাপটপ বন্ধ করে সোফায় এসে গুঞ্জার পাশে বসলো রক্তিম। গুঞ্জা ফিসফিস করে বললো, আমাকে নিয়ে এখনও পজেসিভ তুই? রক্তিম অন্যমনস্ক গলায় বললো, হলেই বা তোর কি! কতটুকু সময় দিস তুই আমায়!
স্বর্ণদীপ ঠিকই বলে বুঝলি, আঁতলামি করেই অব্যয় মেয়েদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নেয়। তোরা আঁতেল পুরুষকে কেন এতো পছন্দ করিস বলতো?
স্বর্ণদীপ বলছিলো, অব্যয়ের এসব ন্যাকামি ছিলো জানতাম, কিন্তু এমন চরিত্রের দোষ ছিলো জানতাম না তো? এভাবে লুকিয়ে একটা ওই পাড়ার মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করার চেয়ে আমাদের বর্নি তো অনেক বেটার রে। তাছাড়া রং-তুলিতে যার মন পড়ে থাকে তার মনই কিনা আচমকা মাংসাশী হয়ে গেলো!
গুঞ্জা লক্ষ করলো যতক্ষণ পর্যন্ত রক্তিম জানতো না অব্যয় ওর বুটিকে এসেছিলো ততক্ষণ পর্যন্ত ও অব্যয়কে খুনি মানতে রাজি ছিলো না। কিন্তু এখন অবলীলায় বলছে, কে জানে ওই মেয়েটাকে মেরে দিয়েই অব্যয় বেপাত্তা নাকি!
গুঞ্জা দৃঢ় গলায় বললো, খুনটা অব্যয় করেনি বুঝলি। তার থেকে অনেক বেশি চান্স যারা ওকে আজীবন হিংসা করেছে তাদের করার। কারণ লাবণ্য খুনের মামলায় অব্যয়কে ফাঁসিয়ে দিলে অনেক মেয়ের হৃদয় থেকে ওই আঁতেলের নামটা মুছে যাবে কিনা। তাই ভালো করে ভেবে বল তো, ওই নামটা মুছে গেলে কার কার উপকার হয়?
স্বর্ণদীপের তো হয়ই, কারণ বর্নির চোখে অব্যয়কে ছোট করার প্রচেষ্টা ওর আজকের নয়। এই মুহূর্তে জানলাম, আমার চোখে ওর প্রশংসা দেখলে আরেকজনেরও বেশ আক্রোশই হয়। তাহলে ভেবে দেখিস তো, লাবণ্য খুনে অব্যয়ের নামটা নিখুঁতভাবে ঢুকে গেলে কাদের লাভ?
রক্তিম অবাক হয়ে বললো, বাবা, তুই তো দেখছি মিস লগ্নজিতার সহকারী হয়ে গেলি। শোন, স্বর্ণদীপের লাভ হতে পারে, কিন্তু আমার নয়। আমি জ্ঞানত কোনোদিন অব্যয়ের খারাপ চাইনি। বরং আমাদের ব্যাচের একজন অন্তত শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে দেখে আমার গর্বই হয়েছে। আমি বরাবরই বলি, শিল্পীরা অমন একটু এলোমেলো হয়। হিসেব করে কাজ করা ওদের কম্ম নয়। তাই অব্যয় আচমকা মিসিং বলে এতো চিৎকার চেঁচামেচির দরকার নেই। হয়তো নিরিবিলিতে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত সে। তাই অব্যয় খুনের মামলায় জড়ালে আমি অন্তত তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবো।
ঠিক এই কারণেই এই সোজা সরল ছেলেটাকে ভালো লাগে গুঞ্জার। বেশিক্ষণ কোনো অভিব্যক্তিকেই গোপন করে রাখতে পারে না রক্তিম। রাগ, অভিমান, আনন্দ সবকিছুই গুঞ্জার সামনে দাগহীন কাঁচের মত পরিষ্কার। গুঞ্জা কিছু বলার আগেই রক্তিম বললো, এসব ঠিক আছে। কিন্তু তোর চোখে ওর জন্য সম্ভ্রম দেখলে মটকাটা জাস্ট গরম হয়ে যায়।
গুঞ্জার কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে রক্তিম ফিসফিস করে বললো, শুধু এই একটা জিনিসের অধিকারে কেউ সামান্যতম ভাগ বসালেও সেটা আমার সহ্য হয় না। গুঞ্জা রাগতে গিয়েও হেসে ফেলে বললো, তোর এতো দেখার ক্ষমতা যখন, তখন আমার চোখে লোকের জন্য সম্ভ্রম দেখিস আর তোর জন্য ভালোবাসা, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, অহংকার এগুলো দেখতে পাস না? রক্তিম আর দেরি না করে গুঞ্জার নরম ঠোঁটের মধ্যে নিজের ঠোঁট দুটো মিশিয়ে দিয়ে বললো, তুই শুধু আমার। এ রাজ্যের আমিই সম্রাট, আমিই সেনাপতি।
গুঞ্জা নিজের দুটো হাত দিয়ে ওকে চেপে ধরে বললো, বদলে যাস না প্লিজ।
.
গুঞ্জা ওর বন্ধন মুক্ত হয়ে বললো, আমার চিন্তা হচ্ছে বর্নিটার জন্য। মেয়েটা অব্যয়কে বড্ড ভালোবাসে রে। এই ঘটনাটা শোনার পর থেকে যতবার ওকে ফোন করেছি ওর গলাটাতে কেমন যেন মন খারাপের সুর বেজেছে। রক্তিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ও বোকার মত অব্যয়ের জন্য অপেক্ষা করে। আমি জানি অব্যয় আমাদের মত দশটা পাঁচটা জীবনকে কোনোদিন বেছে নেবে না। বর্নিকে একটু বোঝাতে পারিস তো, এভাবে মরীচিকার পিছনে না ছুটে, নিজের জীবনটা নিয়ে ভাবতে।
গুঞ্জা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললো, সবার জীবনে তো তুই নেই, যে অব্যয় নামক মোহ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারবে। তবুও আমি চেষ্টা করবো ওকে বোঝানোর। এতোবছরে বোঝেনি, আর আজকে বুঝবে বলে মনে হয়না যদিও, তবুও ট্রাই করবো।
রক্তিম একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললো, কুণাল বলছিলো জানিস তো, এই অফিসার মানে এই লগ্নজিতা ভট্টাচার্য নাকি এরকম অনেক কেসই সাফল্যের সঙ্গে সমাধান করেছে। মহিলার নাকি এটা নেশা। আমার ধারণা লাবণ্য মৃত্যুর কারণও এ ঠিক বের করবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আমাদের বন্ধুগ্রুপের কেউ যেন এর সঙ্গে জড়িয়ে না থাকে!
জানিস, লগ্নজিতা মনীষাকে মিট করেছিলো। স্বর্ণদীপের নতুন গার্লফ্রেন্ড পরিচয়ে। স্বর্ণদীপ মনীষার মুখে চেহারার বর্ণনা শুনে বুঝেছে ওটা লগ্নজিতাই ছিলো। ভেবে দেখ, কি মারাত্মক বুদ্ধি মহিলার। মনীষাও ওদের ফেলে আসা জীবনের সবটুকু উগড়ে দিয়েছে ওই অফিসারের কাছে।
গুঞ্জা ভয়ে ভয়ে বললো, আমার না কেমন একটা ভয় করছে, অব্যয় সত্যিই জড়িত নয় তো এই কেসে!
.