লাবণ্যের বাড়িতে লগ্নজিতা
পুরোনো টালির চাল, অর্ধেক টালিই ভঙ্গুর হয়ে গেছে। মাটির দু-কুঠুরি ঘর, একফালি উঠোনে বসে একজন মহিলা নারকেলের কাঠি দিয়ে ঝাঁটা বানাচ্ছে। বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে করে এই সাতহারা গ্রামে পৌঁছেছে লগ্নজিতা। লাবণ্যর মায়ের চিঠিতে এখানের পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প ছিলো। বনপলাশী থেকে খুব বেশি দূরে নয়। পায়ে হেঁটে দু-কিলোমিটার মত হবে। বাড়িটা গ্রামের প্রথমেই।
লগ্নজিতা শান্ত স্বরে বললো, আপনিই লাবণ্যের মা? মহিলা একটু চমকে উঠে বললো, কে আপনি বটে? লাবণ্য আর বেঁচেক লাই, সে মরে গেছেক। তার ইজ্জত লিয়ে আর টানাটানি করবেক লাই। যান ইখান থিকে। কথা শেষ করার আগেই একটি মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো উঠানে। মেয়েটা বললো, কে মা?
মহিলা বিরক্ত হয়ে বললো, তুই যা কেনে! ইখানে আসবিক লাই।
মুখে লাবণ্যের সঙ্গে মিল আছে। লাবণ্যর মুনলাইটে ঢোকার আগের মুখের সঙ্গে মেয়েটার মুখের বেশ মিল দেখেই লগ্নজিতা বললো, তুমি বুঝি লাবণ্যর বোন? শিমুল একটু থমকে বললো, হ্যাঁ তো? আপনার জেনে কি হবেক? শিমুলের কথায়ও দেহাতি টান রয়েছে। তবে চেষ্টা করলে সে টান বর্জিত ভাবেও কথা বলতে পারে এটা লক্ষ করলো লগ্নজিতা।
লগ্নজিতা বললো, তোমার দিদি অনেকগুলো টাকা পাঠিয়েছে তোমাদের জন্য। ওর ছবি বিক্রির টাকা।
শিমুল হেসে বললো, ছবি বিক্রির না দেহ বিক্রির? আমরা এখন সব জানি। দিদির বর আমাদের এসে সবটা বলেছে। বলেছে যে সে মুনলাইট হোটেলে নিজেকে বেচতো। তাইতো জামাইবাবু ওকে নিয়ে ঘর করতে রাজি হয়নিকো।
মহিলা আবার বললেন, তুই ঘরকে যা শিমুল। আপনাকে বলছি না, আমাদের কুনো টাকার দরকার লাই। সে মরে গেছেক।
লগ্নজিতা অবাক হয়ে ভাবছিলো রাজেশ ঘটি ওরফে বাদশার বুদ্ধির তীক্ষ্নতা সম্পর্কে। যখন দেখেছে রানীভবনে গিয়ে আর লাবণ্যকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করা যাবে না, তখন এসেছে লাবণ্যর নামে বদনাম করে এদের কাছে ভালো হতে। এরপর বোধহয় শিমুলকে নিয়ে গিয়ে কলকাতায় বিক্রির প্ল্যান করেছে।
লগ্নজিতার মেজাজ গরম হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখুনি গিয়ে বাদশাকে অ্যারেস্ট করতে। কিন্তু সেটা বোধহয় এভাবে সম্ভব নয়। কারণ লগ্নজিতা প্রমাণ করতে পারবে না যে রাজেশ লাবণ্যকে বিক্রি করেছিলো শুভদীপ ঘোষালের কাছে। শুভদীপ সেদিন ভয়ে স্বীকার করেছিলো ঠিকই যে রাজেশ ওর কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলো, কিন্তু সেটা বোধহয় এভাবে লগ্নজিতা প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু শিমুলকে বাদশার হাত থেকে বাঁচাতে হবে। মুহুর্তে ভেবে নিলো লগ্নজিতা। তারপর বললো, শিমুল তোমার দিদি মারা যাবার আগে একটা চিঠি লিখেছিলো তোমার মাকে। এই নাও।
শিমুল কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো, জানেন, দিদি যখন পালিয়ে গিয়েছিলো তখন গোটা গ্রামের লোকজন আমাদের নামে নিন্দে করেছিলো। গালি দিচ্ছিলো। আমরা শুধু কাঁদতাম। আমাদের বাবা নেই। মা অনেক কষ্টে মানুষ করেছিলো। ছোট থেকেই দিদি আর আমি দুজনে আঁকতাম। দিদির ইচ্ছে ছিলো খুব বড় আঁকিয়ে হবে। দিদির সঙ্গে যে বাদশাদার সোহাগ চলছে দিদি আমাকেও কোনোদিন বলেনি। হঠাৎই পালিয়েছিল। অনেকদিন পরে দিদির চিঠি এলো বাড়িতে। তারপর কিছু কিছু টাকা পাঠাতো দিদি। আমিই মায়ের হয়ে উত্তর দিতাম দিদিকে। আমি অল্প লেখাপড়া শিখেছি। লিখতে পড়তে পারি।
লগ্নজিতা বললো, তোমার দিদি কি তোমায় শিমু বলে ডাকতো? শিমুল ঘাড় নেড়ে বললো, হ্যাঁ। মা ওকে লাবু আর আমায় শিমু ডাকে।
মায়ের চোখে জল পড়ে, মায়ের চোখ অপারেশন করতে হবে। দিদিকে লিখেছিলাম। দিদি বলেছিলো, টাকা নিয়ে আসবে এখানে। তারপর হঠাৎই দিদির মৃত্যুর খবর পড়লাম কাগজে। ওই যে সূর্য মাস্টারের ছেলে দেখালো খবরটা। আমরা জানতাম না দিদি কার সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলো। দিদিই একদিন একটা ছবি পাঠিয়েছিলো ওদের বিয়ের। তাই বাদশাদাকে চিনেছি। দিদি যদিও বাদশাদার নাম লিখেছিলো রাজেশ। বাদশাদাই জংলী রিসর্টের মালিককে বলে আমার কাজ করে দিয়েছিলো। আমি এখন ওই রিসর্টে কাজ করি। বাদশাদা বলেছে, দিদি নাকি বিয়ের পর পরই ওকে ছেড়ে একটা বারে গিয়ে নাচতো, শরীর বিক্রি করতো। তাই রাগ করে বাদশাদা ওকে ছেড়ে চলে এসেছে।
মহিলা এতক্ষণে বললেন, মেয়ে না দেখুক, বাদশা আমাদের ঘরের ছেলের মত বটে। সে আমার শিমুলকে একটা কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছেক, আমাকে এসেও সাহায্য করে গেছেক।
লগ্নজিতা বুঝলো, রাজেশ ঘটি বেশ বড় খেলুড়ে। লাবণ্যকে শেষ করে এখন শিমুলকে তুলতে এসেছে।
লোকটা বোধহয় এভাবেই এখানে রিসর্টে কাজ করে, আর এখানে স্থানীয় মেয়েদেরকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে।
লগ্নজিতা বললো, তোমরা ভুল জানো শিমুল। ওর নাম রাজেশ ঘটি, এখন নাম নিয়েছে বাদশা। ও লাবণ্যকে একজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলো বিয়ের পরে। আমি একজন পুলিশ অফিসার। আমি বাদশাকে খুঁজছি। লাবণ্য নির্দোষ। বাদশাই ওকে অনেক টাকার বিনিময়ে বেচে দিয়ে পালিয়ে এসেছে। এই দেখো, তোমার দিদি চিঠিতে লিখেছে, রাজেশকে বিশ্বাস করিস না তোরা। ও আমার কাছে টাকা চাইতে এসেছিলো। আমি দিইনি তাই আমাকে ভয় দেখিয়ে গেছে। শিমু ওর ফাঁদে পা দিস না। কারোর কথায় তুই কলকাতা আসবি না। আমি খুব তাড়াতাড়ি আসছি গ্রামে।
শিমুল দাঁত চেপে বললো, একটু দাঁড়ান অফিসার। আমি এখুনি এক কোপে ওই বাদশার মুণ্ডুটা আলাদা করে দেবো। একটা দা নিয়ে আসি কেনে!
লগ্নজিতা শিমুলকে শান্ত করে বললো, আমি নিজেই ওকে অ্যারেস্ট করবো।
তার আগে তোমার দিদির খুনিকে ধরতে হবে।
লাবণ্যের মা ডুকরে কেঁদে বললেন, মেয়েটাকে খুন করে দিলো বটে! আমায় চিঠিতে লিখেছিলো, শহরে নিয়ে গিয়ে চোখ কাটিয়ে দেবেক।
লাবণ্যর মা কাঁদছে। লগ্নজিতা শিমুলকে বললো, সাবধানে থাকো। বাদশাকে বাড়িতে ঢুকতে দিও না। এই নাও তোমার দিদির টাকা এগুলো। ছবি বিক্রি করে সে রোজগার করেছে। বড় কালো ব্যাগটা শিমুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো লগ্নজিতা। লাবণ্যর ঘর থেকে সেদিন টাকার ব্যাগটা নেওয়ার সময়েই ভেবেছিলো, এটা ওর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার। একটা কাজ মিটলো বনপালাশীতে এসে।
.
গাড়িতে উঠতেই বর্ণিতার ফোন, ম্যাডাম আমি সকলকেই কল করে দিয়েছি। সবাই আসছে জানালো।
শুভদীপ ঘোষাল ফোনটা রিসিভ করেই বললো, ম্যাডাম আমি আপনার কাছে সত্যিটা স্বীকার করছি, লাবণ্যকে খুনটা আমি করিনি। তবে সেই মুহূর্তে সত্যিই ওই ঘরে কোনো টুল বা চেয়ার ছিলো না। তাই আমারও মনে হয় এটা খুন।
লগ্নজিতা গম্ভীর গলায় বললো, বুঝেছি আপনি শার্লক হোমসের সেকেন্ড এডিশন। এখুনি বনপলাশী পৌঁছোন। ঘোষাল হকচকিয়ে বললো, বনপলাশী? কিন্তু কেন?
লগ্নজিতা বিরক্ত সুরে বললো, আমি বলছি তাই।
ফোনটা রেখে দিয়েই লগ্নজিতা ড্রাইভারকে বললো, রংবেরং হোটেলে চলো।
হোটেলে ঢুকেই নিজের আইডেন্টিটি কার্ডটা বের করলো লগ্নজিতা। একটা ছবি বের করে বললো, কোন রুমে আছেন ইনি?
রিশেপসনিস্ট একটু কাঁপা গলায় বললো, রুম নম্বর নাইন ম্যাডাম।
লগ্নজিতা সার্ভিস রিভলবারটা আরেকবার চেক করে নিলো।
.