জংলীর ড্রয়িংরুমে
জংলী রিসর্টের সাজানো ড্রয়িংরুমে বেতের চেয়ারে বসে আছে সকলে। গুঞ্জা, রক্তিম, অব্যয়, বর্ণিতা, কুণাল বসে আছে একদিকে। স্বর্ণদীপ বিরক্ত মুখে ঘনঘন মোবাইলের স্ক্রিন ঘাঁটছে। শুভদীপ ঘোষালের মুখে কেউ যেন একপোঁচ ভয় মেশানো নীল রং মাখিয়ে দিয়েছে।
গুঞ্জা খুব সাবধানে বর্ণিতাকে বললো, হ্যাঁ রে অব্যয়ের ওপরে কোনো দোষ পড়েনি তো! বর্ণিতা উত্তর দিলো, পুরোটা ধোঁয়াশায় ভরা আছে। কেন যে সকলকে লগ্নজিতা এখানে ডাকলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না। স্বর্ণদীপ হঠাৎ বিরক্ত হয়ে বললো, না মানে আমি তো বুঝতেই পারছি না, আমরা ভিক্টিম হলাম কি করে! কেন এখানে আমাদের ডেকে আনা হয়েছে!
কুণাল শান্ত গলায় বললো, অব্যয়, তুই হঠাৎ এখানে গা ঢাকা কেন দিয়েছিলিস? রক্তিম একটু বেশিই চুপচাপ, ভাবনার অতলে প্রবেশ করেছে যেন। শিমুল আর ওর মা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। অব্যয় বললো, শিমুল তো এই রিসর্টের ঘরে আল্পনা দিতে আসে। ওকে কেন ডেকেছে লগ্নজিতা জানিস?
বর্ণিতা ঘাড় নেড়ে বললো, আমিও আজ পাতালে হাবুডুবু খাচ্ছি। হতে কি চলেছে সেটাই তো ক্লিয়ার নয়। শুভদীপ ঘোষাল আড়চোখে একবার তাকালো অব্যয়ের দিকে। এই ছোঁড়া প্রায়ই ঢুকতো লাবণ্যের ঘরে। গোপাল অন্তত তাই বলেছে। লাবণ্য নাকি একে বেশ পছন্দ করতো।
রাধারমণ মুখুজ্জে ঘরে ঢুকতেই অব্যয় প্রায় চিৎকার করে উঠলো, তুমি এখানেও এসেছো? মজা দেখতে এসেছো? লাবণ্য খুনের দায়ে আমি অ্যারেস্ট হই কি না দেখতে এসেছো বুঝি? অব্যয়ের কথা শেষ হবার আগেই লগ্নজিতা ঢুকলো। সঙ্গে আরও জনা তিনেক কনস্টেবল এবং আরেকজন অফিসার।
অফিসার চেয়ারে বসেই বললেন, লগ্নজিতা, এবারে শুরু করো প্লিজ।
লগ্নজিতা বলতে শুরু করলো, আপনাদের সকলের সঙ্গে সকলের পরিচয় পর্বটা বরং আমি আগে সেরে নিই।
প্রফেসর অব্যয় বিশ্বাস- ইনি একজন নামী শিল্পী। আর্ট কলেজের প্রফেসর। যিনি রংতুলির খাতিরেই পরিচিত হয়েছিলেন লাবণ্যর সঙ্গে। পরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। লাবণ্য ওনাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করতে শুরু করেন। এমনকি লাবণ্যর আঁকা ছবি উনি নিজের নামে চালিয়ে ছবি প্রদর্শনী অবধি করেন, অবশ্যই লাবণ্যর অনুমতি নিয়ে। ছবি বিক্রির টাকা লাবণ্যের ঘরে পৌঁছে দিতেই উনি লাবণ্যের মৃত্যুর দিনে সকালে ওর ঘরেও আসেন। রানীভবনের অনেকেই ওনাকে দেখেছেন ওই দিন। একজন শিল্পীকে তার যোগ্য নাম না দেওয়ার দোষে উনি দুষ্ট। এবং পুলিশকে সাহায্য না করে উনি নিজে গা ঢাকা দিয়েছিলেন মৃত্যুর দিন থেকেই।
লগ্নজিতার কথা শেষ হতেই স্বর্ণদীপ বলে উঠলো, দেখলি তো বর্নি ওর সবটুকু জালি কেস। এক্সিবিশন করছে তাও শালা অন্যের আঁকা ছবি নিয়ে। রক্তিম, কুণাল, গুঞ্জার চোখে বিস্ময়।
লগ্নজিতা আবার শুরু করলো….
বর্ণিতা সেনগুপ্ত- ও একজন মেকআপ আর্টিস্ট। ফাইন আর্টসের স্টুডেন্ট ছিলো। বাবার চিকিৎসার কারণে মাঝপথে পড়াশোনায় ইতি টেনে বি বেঙ্গলি চ্যানেলের মেকআপ আর্টিস্ট। ভীষণ রকমের সৎ একটি মেয়ে। ওই প্রথম আমাকে জানিয়েছিলো, অব্যয়ের নিজের আঁকা ছবি প্রদর্শনীতে ছিলো না। গুঞ্জার বাড়ির ছবিটা দেখেই ওর বিশ্বাস দৃঢ় হয়। বর্ণিতাই অব্যয়ের এই বনপলাশীর ঠিকানাও আমায় জানায়। একজন সভ্য নাগরিকের কাজ করেছে ও।
.
গুঞ্জা ও রক্তিম-এরা দুজনেই অব্যয়ের ক্লাসমেট। দুজনকে জেরা করে আমি জানতে পারি, অব্যয় লাবণ্যর জন্য গুঞ্জার বুটিক থেকে গিফট কিনেছিলো। এবং রক্তিমকে অব্যয় একবার রানীভবনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো লাবণ্যর সঙ্গে আলাপ করানোর জন্য।
.
কুণাল-অব্যয়ের ক্লাসমেট বলেই উনি আজ এখানে উপস্থিত। এছাড়া এই কেসে উনি একেবারেই জড়িত নন।
.
স্বর্ণদীপ-স্বর্ণদীপের ডিভোর্সি স্ত্রী মনীষার সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝতে পারি স্বর্ণদীপ আজও বর্ণিতাকে মারাত্মক ভালোবাসে। ওর এই উগ্র বর্ণিতা প্রীতির কারণেই ওদের বৈবাহিক সম্পর্কের ইতি ঘটেছে। বর্ণিতার দিকে তাকিয়ে অব্যয় আলতো হাসলো।
লগ্নজিতা বললো, স্বর্ণদীপ সম্ভবত অব্যয়কে ফলো করতে করতেই গিয়ে পৌঁছায় রানীভবনে। তারপর আবিষ্কার করে লাবণ্যর সঙ্গে অব্যয়ের সম্পর্ক। ঠিক তখন থেকেই স্বর্ণদীপ অব্যয়কে ফলো করতে শুরু করে। রানীভবনে ঢোকার রাস্তা সহজ করার জন্যই ও ওই বাড়ির কো-অপারেটিভ ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট ওপেন করে।
স্বর্ণদীপ ছটফট করে বলে উঠলো, তার সঙ্গে লাবণ্য খুনের সম্পর্ক কোথায়! আপনি অকারণে কেসটাকে জটিল করছেন মিস ভট্টাচার্য।
লগ্নজিতা আলতো করে বললো, কুল মিস্টার স্বর্ণদীপ। এতো উত্তেজনা শরীরের পক্ষে ভালো নয়।
স্বর্ণদীপ গোপনে লাবণ্যর সঙ্গে অব্যয়ের কিছু ছবি তুলে নিয়ে গিয়ে বর্ণিতাকে দেখানোর ইচ্ছেতেই ছিলো। কিন্তু রানীভবনের বাড়ির প্ল্যানগুলোর জন্যই সেটা সম্ভব হয়নি। স্বর্ণদীপ তখন মুনলাইটে গিয়েই মিট করে লাবণ্যের সঙ্গে। অব্যয় সম্পর্কে বেশ কিছু নেগেটিভ কথাও সম্ভবত বলেছিলো লাবণ্যকে।
স্বর্ণদীপ ভীষণভাবে চাইছিলো অব্যয়কে ওপেন করতে যাতে বর্ণিতার অব্যয় প্রীতি কমে। এবং তাতে লাভ ওর। সুতরাং লাবণ্য খুনে অব্যয় জড়িয়ে গেলে স্বর্ণদীপের লাভ বই লোকসান নেই।
অব্যয় হেসে বললো, বাহ, পুরোনো বন্ধু!
.
শুভদীপ ঘোষাল- একজন অসৎ ব্যবসায়ী। যে ইললিগ্যাল জায়গায় ফ্ল্যাট বানিয়ে কেসে জর্জরিত হয়ে আছে। জেঠুর রানীভবন কব্জা করতে পারলে অনেকগুলো টাকা আত্মসাৎ করতে পারবে। কিন্তু রানীবালাদেবীর দৃঢ়তায় সেটা হচ্ছিলো না। অগত্যা ফ্ল্যাট সিস্টেমে ভাড়া দিতে শুরু করলেন রানীভবনের বিভিন্ন তলা। আর ঠিক তখনই রাজেশ ঘটি এসে উপস্থিত হলো ঘোষালের কাছে বাড়ি ভাড়া নিতে। রাজেশ ঘটি লাবণ্যর স্বামী। বনপলাশী থেকে লাবণ্যকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করে সে পৌঁছায় রানীভবনে। বিয়ে করে কয়েকমাস সংসার করে বউকে বেচে দেওয়া তার পুরোনো পেশা। সে যথারীতি দালালের সঙ্গে কথা বলছিলো সেইসময় শুভদীপ রাজেশকে টাকা অফার করলে শুভদীপের কাছেই লাবণ্যকে বিক্রি করে দিয়ে চলে যায় রাজেশ। শুভদীপ মুনলাইট বারে লাবণ্যকে বিক্রি করে অনেক বেশি টাকায়। লাবণ্য রানীভবনে আর থাকবে না এমন প্ল্যান পাকা হবার পরও শুধুমাত্র রানীবালাদেবীর কারুণ্যে লাবণ্য থেকে যায় রানীভবনে। ওখানেই ওর আলাপ হয় চারতলায় বাস করা রাধারমণ মুখুজ্জের সঙ্গে। ভদ্রলোক অসাধারণ চিত্রশিল্পী।
যাইহোক, আগে রাজেশ ঘটির কথাতে আসি। কদিন আগে রাজেশ খবর পায় লাবণ্য মুনলাইট বারে কাজ করে। এবং রানীভবনেই থাকে। তাই আবারও স্বামীর অধিকার নিয়ে সে হাজির হয় লাবণ্যর সামনে। খেতে পাচ্ছে না এমন নাটক করায় লাবণ্য তার সামান্য রোজগার থেকেও সাহায্য করেছিলো রাজেশকে।
.
মৃণাল, বাদশা হয়তো এখনও সবটা জানে না। এখনও জংলী রিসর্টেই আছে। আবারও লাবণ্যর মতই একজনের খোঁজে রয়েছে ও। ওকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে এসো। আমি ম্যানেজারকে গেটে তালা দিয়ে রাখতে বলেছি, কেউ যাতে পালাতে না পারে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃণাল বাদশার হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে এনে হাজির করলো ড্রয়িংরুমে। সকলের চোখ বাদশার দিকে।
.
কি মিস্টার শুভদীপ ঘোষাল, এই আপনার রাজেশ ঘটি তো?
ঘোষাল ঘাড় নেড়ে বললো, হ্যাঁ, লাবণ্যের স্বামী।
বাদশা ছটফট করে উঠতেই শিমুল গর্জে উঠলো, ওকে ছাড়বেক লাই অফিসার। উ আমার দিদিকে বিক্রি করেছে বটেক। উকে কেটে ফেলবি। লাবণ্যর মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এটা বোধহয় চোখের রোগে নয়। মেয়েটাকে হারানোর কষ্টেই।
শুভদীপ ঘোষাল মিনমিন করে বললো, লাবণ্য আমার কাছে কাজ চেয়েছিলো, তাই আমি ওকে….
লগ্নজিতা কিছু বলার আগেই বর্ণিতা বললো, থামুন আপনি। একজন শিল্পীকে আপনি দেহব্যবসায়ীর তকমা পরিয়ে দিলেন নির্দ্বিধায়? লজ্জা করে না আপনার! কলকাতায় কি আর কোনো কাজ পেতে পারতো না মেয়েটা! লগ্নজিতা, প্লিজ শুভদীপ ঘোষাল আর রাজেশ কিন্তু একই অপরাধে অপরাধী। তাই একেও ছেড়ে দিও না। অব্যয় শক্ত করে ধরলো বর্ণিতার হাতটা। ফিসফিস করে বললো, লাবণ্য মেয়েটা সত্যিই বড় দুঃখী ছিলো গো। আমি জানতাম তোমাকে বললে হয়তো তুমি বুঝবে। কিন্তু সাহস করে কোনোদিন বলতে পারিনি।
লগ্নজিতা বললো, রাজেশ ওরফে বাদশা এখন লাবণ্যের বোন শিমুলকে কলকাতা নিয়ে যাবার প্ল্যান কষেছিলো। রাজেশের পিছনে নিশ্চয়ই কোনো নারী পাচারকারী চক্র আছে। আমরা অবশ্যই সেটা খুঁজে বের করবো।
রাধারমণ মুখুজ্জে- লাবণ্য যে জাত শিল্পী সেটা অব্যয় ছাড়াও আরেকজন জেনে গিয়েছিল রানীভবনের। সেটা হলো রাধারমণ মুখুজ্জে। মুনলাইটের নীলাভ আলোয় স্বল্প ড্রেসধারী লাবণ্যকে চিনতে ভুল করেনি রাধারমণ। পরের দিনই রানীভবনের ভাড়াটে লাবণ্যর দরজায় টোকা পড়েছিলো। দরজা খুলতেই মডেল হবার ডাক পড়েছিলো লাবণ্যর কাছে। সস্তায় নেকেড মডেল উনি পাচ্ছিলেন না বোধহয়!
বর্ণিতা একটু উদাস গলায় বললো, আমাদের কবিগুরু যদিও লাবণ্যকে তীব্র আত্মসম্মানের সঙ্গে এঁকেছিলেন। শিক্ষিত, গুণী একজন মেয়ে। যে অমিতের মত তুখোড় বুদ্ধিধরকেও পরাস্ত করতে পারে নিমেষে। বাস্তবের লাবণ্যরা বোধহয় এমনই পরাস্ত হয় অভাবের কাছে।
লগ্নজিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, হ্যাঁ লাবণ্যও নতিস্বীকার করেছিলো অভাবের তাড়নায়।
দিনের পর দিন ঘন্টার পর ঘন্টা ওকে বসিয়ে রেখে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে পাঁচশো কি ছয়শো টাকা।
এই রাধারমণ মুখুজ্জে আসলে কলকাতার খুব অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে। অল্প বয়েস থেকে মদের নেশা ধরায় বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। তাতে অবশ্য তার নামে সম্পত্তির পরিমাণ কিছু কম ছিলো না। পৈতৃক সম্পত্তির বেশ বড় পরিমাণ পেয়েছিলেন। রানীভবনের একটা তলা ভাড়া নিয়েছিলেন নিজের স্টুডিও করবেন বলে। দেশে-বিদেশে যার নাম শিল্পী হিসেবে ছড়িয়ে পড়বে একদিন এই স্বপ্ন দেখা মানুষটাকেই যখন লাবণ্যর মত একজন দু-পয়সার প্রস বলে বসলো, স্যার আপনার আঁকা ছবিতে মানুষের চোখ এতো কথাহীন কেন? মানুষ তো কত কথা বলে চোখের মাধ্যমে। আমি তো মুখের থেকে বেশি কথা বলি চোখে। আপনি যখন আমায় এঁকেছেন তখন আমার শরীরের প্রতিটা ভাঁজ নিখুঁত এঁকেছেন, অথচ আমার চোখদুটো এমন ভাষাহীন কেন? তখন রাধারমণ মুখুজ্জের মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিলো। বিবস্ত্র লাবণ্যের হাতে তুলি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এঁকে দেখাও, দেখি চোখ কেমন বাঙময় হয়। অনুভূতিশীল লাবণ্য সাদা ক্যানভাসে এঁকেছিলো রাধারমণ মুখুজ্জেকে। যার চোখে ছিলো নামের লোভ, ভ্রূতে ছিল ওপরে ওঠার সুতীব্র বাসনা।
নিজের ছবি দেখে চমকে উঠেছিলেন রাধারমণ। লাবণ্যকে বিনাপয়সায় আঁকা শেখাবেন বলেছিলেন। লাবণ্যর আঁকায় যে টুকিটাকি ভুল ছিলো সেগুলো নিখুঁত করায় মেতে উঠলেন রাধারমণ।
লাবণ্যও বাধ্য ছাত্রীর মত শিখছিলো, নিজেকে আরও উন্নত করছিলো। ঘটনাক্রমে আচমকাই অব্যয় গিয়ে হাজির হয় রাধারমণ মুখুজ্জের কাছে। আর তারপর লাবণ্যর সঙ্গে তার পরিচয়। লাবণ্য এতোদিন জানতো, যেকোনো কিছুর বিনিময়ে মানুষ শরীর চায়। অব্যয় প্রথম পুরুষ যে শরীরকে ছাপিয়ে ওর মনকে স্পর্শ করেছিলো। তাই লাবণ্যর একান্ত আঁকার খাতায় বারবার আঁকা হয়েছে অব্যয়কে।
অব্যয়ও চমকে উঠেছিলো লাবণ্যর আঁকা দেখে। যেকোনো দক্ষ শিল্পীকে সে বলে বলে ছক্কা হাঁকানোর ক্ষমতা রাখতো। অব্যয়ের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব জমে উঠেছিলো। অব্যয়ও নিজের অবসরে ওকে শিখিয়েছিলো নিজের সবটুকু বিদ্যে।
রাধারমণ মুখুজ্জে ভেবেছিলেন, লাবণ্যের ছবি নিয়ে প্রদর্শনী করবেন। চড়া দামে বেচবেন সেইসব ছবি। তারপর লাবণ্যকে নামেমাত্র টাকা দিয়ে আত্মসাৎ করবেন সবটুকু। কিন্তু বাঁধ সাধলো লাবণ্যর সিক্সথ সেন্স। রাধারমণ মুখুজ্জে যখন কলকাতার নামী হলে নিজের এক্সিবিশনের অ্যানাউন্স করে ফেসবুকে পোস্ট করতে শুরু করে, ঠিক তখনই লাবণ্য তার নিজের আঁকা সব ছবি নিয়ে এসে দিয়ে যায় অব্যয়ের ফ্ল্যাটে। অব্যয়কে অনুরোধ করে এগুলো যেন কিছুতেই ও মুখুজ্জেকে না দেয়।
তার কয়েকদিনের মধ্যেই অব্যয় সেইসব ছবি দিয়ে প্রদর্শনী করে।
সেখানেও উপস্থিত হয়েছিলেন রাধারমণ মুখুজ্জে। নিজের চোখে দেখে এসেছিলন লাবণ্যের সৃষ্টিকে।
রাগে তিনি দিগ্ব দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যান।
খুঁজে বের করেন লাবণ্যের বনপলাশীর বাড়ির ঠিকানা। মুনলাইটের স্বল্প পোশাকের লাবণ্যের বেশ কয়েকটি ছবি নিয়ে শুরু করেছিলেন ব্ল্যাকমেইল। বনপলাশীর ঠিকানা আর ওর ছবি সামনে ফেলে শুরু করেছিলেন লাবণ্যকে ভয় দেখাতে।
এদিকে অব্যয় লাবণ্যর ছবি বিক্রি করে অনেক টাকাই এনে দিয়েছে লাবণ্যের সামনে। লাবণ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, ফিরে আসবে বনপলাশীতে। তখনই রাজেশের আগমন ঘটেছিলো, শিমুলের সঙ্গে রাজেশের পরিচয় হয়েছে শুনে ভয়েই লাবণ্য ওকে কিছু টাকাও দিয়েছিলো। অব্যয় যা টাকা দিয়েছিলো লাবণ্যকে তার থেকে হাজার দশেক টাকা কম ছিলো ওই ব্যাগে।
ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে নিয়েছিলো লাবণ্য। ফিরে আসবে বনপলাশী, সেই জন্যই বাড়ি ভাড়া মিটিয়ে দেবে বলে শুভদীপ ঘোষালকে ডেকেওছিলো নিজের ঘরে।
শুভদীপ আসার আগেই ওই ঘরে ঢুকেছিলেন রাধারমণ। লাবণ্যকে প্রেসার দিতে শুরু করে ওকে একমাসে এঁকে দিতে হবে অন্তত দশটা ছবি। লাবণ্য অস্বীকার করেছিলো। তখনই ধস্তাধস্তি শুরু হয়। রাধারমণ রাগের মাথায় লাবণ্যকে বিছানায় ফেলে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে দিয়েছিলেন। তারপর ওরই কাপড়ে ওকে টাঙিয়ে দিয়েছিলেন ফ্যানে। উঠে এসেছিলেন নিজের ঘরে। এবং কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন রানীভবন থেকে।
অব্যয় বলে উঠলো, হ্যাঁ আমিও দু-দিন লাবণ্যকে ধমকাতে শুনেছিলাম। লাবণ্যকে জিজ্ঞেস করলেও ও কিছু বলেনি। বরাবরের চাপা স্বভাবের ছিলো মেয়েটা। কিছুতেই বলতে চাইতো না কিছু।
রাধারমণ বললো, অফিসার দেখছি বেশ ভালো যাত্রাপালা লিখতে পারেন। তা আমিই যে ওকে খুন করেছি তার প্রমাণটা ঠিক কি যদি একটু খোলসা করেন!
লগ্নজিতা একটা ছোট্ট কাঠের পুঁতি বের করে বললো, মৃত্যুর সময় এটা লাবণ্যের হাতের মুঠোয় ছিলো মুখুজ্জে মশাই। দেখুন তো আপনার হাতের রিষ্টলেটে একটা কাঠের বিড কম আছে মনে হচ্ছে।
শ্বাসরোধ করার সময়েই লাবণ্যর হাত মুঠো হয়ে যায়। তাই তার ভিতরের এটা ওর মৃতদেহের সঙ্গেই চলে গিয়েছিলো পোস্টমর্টেমে।
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, কোনো মহিলার গলার হারের অংশ এটা। আজ আপনার হাতের রিষ্টলেটে দেখে স্যাঙ্গুইন হলাম।
শুভদীপ বললো, হ্যাঁ, লাবণ্য আমায় ডেকেছিলো বলেই আমি ঢুকেছিলাম রানীভবনে। কিন্তু লাবণ্যর ঘরে ঢোকার আগেই গোপাল এসে বলেছিলো, শিগগির চলুন সর্বনাশ হয়ে গেছে।
আমার সন্দেহ হয়েছিলো, ঘরে কোনো টুল নেই। ঘরের চাদর টান টান করে পাতা। লাবণ্যর যা হাইট তাতে বিছানা থেকে ফ্যানে নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়।
লগ্নজিতা বললো, হ্যাঁ তখনই আপনি নার্ভাস হয়ে বলে ফেলেছিলেন, খুন হয়েছে। পরে অবশ্য আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা অনেকেই করেছিলো। আসলে কি জানেন, বেওয়ারিশ লাশের মৃত্যু তদন্ত করার থেকে নিজেকে আড়াল করতে সকলে ভালোবাসে। রাধারমণ বনপালাশীতে এসে উঠেছিলো কারণ ও জানতো পুলিশ হয়তো লাবণ্যর বাড়ির খোঁজ করতে আসবে। তখন ও দূর থেকে দেখবে বিষয়টা কোনদিকে এগোচ্ছে। সেইমত কলকাতা ফিরবে ও।
অব্যয় বললো, নিজেকে এই মুহূর্তে একজন চিত্রশিল্পী ভাবতে জাস্ট ঘৃণা হচ্ছে। মানুষের নামের লোভ এতোটা ভয়ঙ্কর হতে পারে আপনাকে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না মুখুজ্জে মশাই।
এই জন্যই লাবণ্য বলতো, মুখুজ্জের কাছ থেকে সাবধান, বড্ড লোভ ওর।
লগ্নজিতা বললো, গাড়িতে তোলো বাদশা আর রাধারমণকে। শুভদীপ ঘোষালকে থানায় হাজিরা দিতে হবে।
স্বর্ণদীপ বর্ণিতার দিকে তাকিয়ে বললো, তুই বোধহয় ঠিকই চিনেছিলি অব্যয়কে। ও আর পাঁচজনের থেকে বড্ড আলাদা।
সকলেই উঠে চলে এলো। আজ রাতটা জংলীতে কাটিয়ে কাল ভোরে রওনা দেবে কলকাতা।
বর্ণিতা উঠে দাঁড়াতেই অব্যয় বললো, একাকীত্ব শব্দটা কবিতা বা ছবিতে ভীষণরকমের সুন্দর। কিন্তু মধ্যরাতের নিস্তব্ধতায় একটা বিশাল হাঁ করে গিলে খেতে আসে। একমাত্র যে আমার সবটুকু বোঝে তাকে পাশে পেতে ইচ্ছে করে তখন। আমার এলোমেলো অগোছালো স্বভাবটাকে যে আপন করে নিয়ে এতোগুলো বছর অপেক্ষা করছে আমার জন্য তাকে আর ফিরিয়ে দেওয়া উচিত হবে না বোধহয়। লাবণ্য বারবার বলতো, বাবু, বিয়ে করে সংসার করো, বর্ণিতা দিদিমণি অপেক্ষা করছে।
লাবণ্য চলে যাওয়ার পরে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি, জীবন বড্ড ক্ষণস্থায়ী। বর্ণিতা প্লিজ, আমায় ক্ষমা করে দাও।
বর্ণিতা বললো, ক্ষমা তো আমিও চাইবো। লাবণ্য খুনের ঘটনায় একমুহূর্তের জন্য হলেও আমি তোমায় ভুল বুঝেছিলাম। ওই সময়টুকুর জন্য ক্ষমা করো আমায়।
এই নাও, লাবণ্য শুধু আমার কাছে তোমার গল্প শুনে তোমায় এঁকেছিলো, দেখো হুবহু তুমি। আমি চমকে গিয়েছিলাম। বর্ণিতা তাকিয়ে দেখলো, একটা সাদা কাগজে ওর মুখের আদলে একটা মেয়ের মুখ। নীচে লেখা অব্যয়ের বর্ণিতা।
নিজের অজান্তেই একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়ের জন্য দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো ওর চোখ দিয়ে।
রক্তিম বাইরে বেরিয়ে এসে লগ্নজিতাকে বললো, ম্যাডাম পুলিশের পোশাকে নয়, কোনো ডিউটি নিয়েও নয় এমনিই একদিন আসবেন আমাদের ফ্ল্যাটে। আপনার বাকি কেস সলভের গল্পগুলো শুনতে চাই আমরা। আপনি ঠিক কখন জানতে পারলেন রাধারমণই খুনি?
লগ্নজিতা বললো, যখন রাধারমণের ঘরে ঢুকে দেখলাম, লাবণ্যের একটা ছবির ওপরে কালো কালি দিয়ে ক্রস করা। আর নীচে লেখা….বেইমান।
তখন থেকেই খুঁজে বেরিয়েছি রাধারমণের সঙ্গে লাবণ্যর কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিলো। অব্যয় এবং গোপাল দুজনেই জানিয়েছিলো লাবণ্যর সঙ্গে ঝগড়া হচ্ছিলো রাধারমণের।
ওর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সার্চ করে দেখি অব্যয়ের প্রদর্শনীর ঠিক দিন পনেরো আগে ওর প্রদর্শনীর ডেট দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া। অথচ ওই হলে গিয়ে শুনলাম বুকড হয়েও ওখানে রাধারমণ কোনো প্রদর্শনী করেনি। এদিকে বর্ণিতা জানালো অব্যয়ের কাছ থেকে গুঞ্জার কেনা ছবিটা অব্যয়ের আঁকা নয়। লাবণ্যর আঁকা কিছু ছবি দেখে বর্ণিতা আমায় বলেছিলো, গুঞ্জার কাছে যে ছবিটা রয়েছে সেই এঁকেছে এগুলোও। তখনই আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছিলো, রাধারমণ কেন লাবণ্যর ছবির নীচে বেইমান লিখেছে। বাকিটা নিজের বুদ্ধিতে দুইয়ে দুইয়ে চার করেছি।
স্বর্ণদীপ হেসে বললো, যাক অবশেষে অব্যয়কে আপনি কলঙ্কমুক্ত করলেন। লগ্নজিতা বললো, আমি শুধু সত্যের সন্ধান করেছি মাত্র।
লগ্নজিতার কাঠিন্যের আড়ালের নরম মনটাতে ছায়া ফেললো শিমুল আর লাবণ্যের মায়ের অসহায় দুটো মুখ। মনে মনে বললো, লাবণ্য আরেকটু শক্ত হয়ে জন্মিও তুমি।
ওর আর দুয়েকটা কাজ বাকি আছে। রানীবালাদেবীর কাছে যেতে হবে। সবটুকু ওনাকে জানাতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত শরীরে নিজের রুমের দিকে এগোলো লগ্নজিতা।
.
যখন আমার ক্লান্ত চরণ অবিরত বুকে রক্তক্ষরণ
খুঁজে নিয়ে কোনো নির্জন কোণ…..
.
এগিয়ে চললো লগ্নজিতা আরেকটা সত্যের সন্ধানে।
সমাপ্ত