বেগম সাহেবা রুকসানার আগমন
মুসাফির যখন সিংহাসনে আরোহণ করেননি তখনই বাদশাহ মিজানুরের ইচ্ছেতেই মুসাফিরের দু দুবার নিকাহ সম্পন্ন হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যের রাজকুমারীর সঙ্গে। মুসাফির নিজে তৃতীয়বার শাদি করলেন ধবলগড়ের বাদশাহ কন্যা রুকসানাকে। রুকসানা অসম্ভব সুন্দরী। সঙ্গে তলোয়ার বিদ্যায় পারদর্শী। রুকসানার সঙ্গে মুসাফিরের পরিচয় নেহাতই কাকতলীয়ভাবে।
সেদিন পশ্চিমীঝঞ্ঝায় আকাশের রং ঘন ধূসর বর্ণ ধারণ করেছিলো। জঙ্গলের পথ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরছিলেন মুসাফির। বাদশাহ মিজানুরের গোপন সংবাদ নিয়ে গিয়েছিলেন ধবলগড় রাজ্যে। তিনটি রাজ্যের মধ্যে মিত্রতার চুক্তি স্বাক্ষরিত করাই উদ্দেশ্য ছিলো। ধবলগড়ের পাশের রাজ্যের হিন্দু রাজা জয়দেব তখন অভিসন্ধি করে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। গুপ্তচরের খবর অনুযায়ী ওই অশ্বমেধের ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া হবে ধবলগড়, রুদ্রনগর, আর ছত্রিনগরের ওপর দিয়ে। যজ্ঞের নিয়ম অনুযায়ী ওই অশ্বমেধ ঘোড়া যে যে রাজ্যের ওপর দিয়ে বিনা বাধায় পার হবে সেই সেই রাজ্য দখল করবেন রাজা জয়দেব। অশ্বমেধ ঘোড়ার পথ আটক যে রাজ্য করবে সেই রাজা জয়দেবের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবেন। রাজ্যের পরিধি বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই এই অভিসন্ধি বলে ধারণা করা হচ্ছিলো।
এমন সংবাদের পরেই বাদশাহ মিজানুর মিত্রতার বার্তা পাঠিয়েছেন পার্শ্ববর্তী দুই রাজ্যের কাছে। এই বিশেষ কাজের জন্য তিনি অন্য কাউকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেননি, নিজের রক্তকেই বিশ্বাস করেছেন।
সেই মিত্রতার কাজ সম্পন্ন করে ধবলগড় থেকে রুদ্রনগরের পথ ধরেছিলেন মুসাফির। মুসাফিরের সঙ্গে ছিল গোটা পাঁচেক সৈন্য। সকলেই ছদ্মবেশ ধারণ করেছিল। আচমকা জঙ্গলের মধ্যে একটি নারীকণ্ঠের আর্তনাদ শুনে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন মুসাফির সফেদ আরবি ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে। নারীকণ্ঠের উৎস খুঁজে বের করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। সৈন্যরা উত্তেজিত হয়ে বলেছিলো, শাহজাদা এ স্থান সুরক্ষিত নয়। বজ্র-বিদ্যুৎ সহযোগে ঝড়ের তীব্র সম্ভবনা আছে। কিন্তু মুসাফির চিরকালই নিজের মনের কথা শুনেছেন। বাড়তি পরামর্শকে মন থেকে পৃথক করে দিয়ে নিজের পথেই সচল থেকেছেন। তাই সৈন্যদের পরামর্শকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে মুসাফির মশাল প্রজ্জ্বলিত করলেন। মশাল ধরে দুপা এগোতেই দেখলেন হাতে তলোয়ার, পরনে বীরের পোশাক, মাথায় পাগড়ি, অথচ হরিণ কালো দুটো চোখ যন্ত্রণাক্লিষ্ট। মশালের আলো তার মুখে ফেলতেই একটু যেন কেঁপে উঠলেন বীরাঙ্গনা। মুসাফিরের দিকে তাকিয়ে তেজী গলায় বললেন, হত্যা করুন আমায়। তবুও ধবলগড়ের গোপন পথ আমি কোনো কিছুর বিনিময়েও জানাবো না।
মুসাফির দেখলেন বীরাঙ্গনার হাত দিয়ে রক্তপাত হচ্ছে। হাতের মশালটা সৈন্যদের হাতে সমর্পণ করে বীরাঙ্গনার পাগড়িটা ঝটিকে খুলে নিয়ে লালচে গোলাপি রঙের কাপড় দিয়ে হাতের ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়ে বললেন, আপনি কে? আকাশের রং ধূসর থেকে দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে ঘন কালোর দিকে চলছে। এখুনি ঝড় উঠবে। সকলকে এই জঙ্গলে গাছ চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করতে হবে। তার আগে জানান আপনি কে, আপনাকে গৃহে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা আমি স্বয়ং করছি।
বীরাঙ্গনা সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি রাজা জয়দেবের গুপ্তচর? মুসাফির স্মিত হেসে বললেন, আমি কে তা বলে আপনার সন্দেহের অবসান করতে না পারায় আমি অত্যন্ত দুঃখিত। তবে এটুকু আমি নিশ্চিতরূপে আশ্বস্ত করতে পারি যে আমার দ্বারা নারী জাতির কোনো ক্ষতিসাধন সম্ভব নয়।
বীরাঙ্গনা আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, শীঘ্রই বাম দিকে ঘোড়া চালনা করুন। সামনেই কৃষকদের গ্রাম আছে। একটা আস্তানা জুটে যাবে। ঝড় আসছে তীব্র গতিতে। মুসাফির জানেন না এই একঢাল কেশরাজির অধিকারিণী, চকিত হরিণনয়না কোনো মায়াবিনী কিনা! তবুও ভরসা করতে অন্তর সায় দিলো। বীরাঙ্গনা নিজেই বললেন, দুজন গুপ্ত শত্রুর পশ্চাৎ ধাবন করেই এই জঙ্গলে এসে পৌঁছেছেন তিনি। তাদের তলোয়ারের আঘাতেই হাতের ক্ষত। নিজের ঘোড়াটিকে বেশ কয়েকবার ডাকলেন বীরাঙ্গনা। ঘোড়াটির ডাক দূরে শুনতে পাওয়া গেলেও তার দর্শন পাওয়া গেলো না। অবশেষে মুসাফিরের ঘোড়ায় চড়ে বসলেন বীরাঙ্গনা। মুসাফিরকে নির্দেশের ঢঙে বললেন, বাম দিকে অগ্রসর হন। মুসাফির বিনা বাক্যব্যায়ে মায়াবিনী নারীর দেখানো পথ অনুসরণ করলেন।
কৃষকদের গ্রামের সীমানায় একটি আশ্রয়খানার সামনে ঘোড়া থেকে নেমে মুসাফিরকে বললেন, আসুন। ভিতরে বিশ্রামের বন্দোবস্ত আছে। বীরাঙ্গনার কথা শেষ হবার আগেই মুঠো মুঠো ধুলো উড়তে লাগলো বাতাসে। সৈন্যসহ মুসাফির দ্রুত আশ্রয়খানায় প্রবেশ করলেন।
ভিতরের মশালের আলোয় মুসাফির স্পষ্ট দেখতে পেলেন বীরাঙ্গনার ক্ষতস্থান দিয়ে পাগড়ির কাপড় ভেদ করে রক্ত বিন্দু চুঁইয়ে পড়ছে। মুসাফির অপলক তাকিয়ে দেখছিলেন, মেয়েটার গোটা অঙ্গে অলঙ্কারের কোনো লক্ষণ নেই। নিরালঙ্কার কোনো নারী যে এতটা অপরূপা হতে পারে এ যেন চিন্তার অতীত। বেগমমহলের সকলেই সারাবছর প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণালংকার পরিধান করে থাকে। মুসাফিরের দুই বেগমও স্বর্ণখচিত পোশাক ও হিরের অলংকারে ভূষিত থাকে। তাই এমন নিরালঙ্কার নারীকে দেখার সুযোগ মুসাফিরের তেমন হয়নি। বীরাঙ্গনা নিজের তলোয়ারটা কোমরে গুঁজে নিয়ে পাশের কক্ষে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে কিছু খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা করে ফিরে এলেন। মুসাফিরের ক্লান্ত শরীর আকস্মিক জানান দিলো সে সত্যিই ক্ষুদার্থ। সৈন্যরাও ওই খাদ্য গ্রহণ করলো।
মুসাফির ধীর কণ্ঠে বললেন, আমি একজন চিকিৎসক। আমার কাছে চিকিৎসার সরঞ্জাম বর্তমান। আপনার হাতের ক্ষতটি একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
নিজের কোমর থেকে চামড়ার ঝোলাটা বের করলেন মুসাফির। চিকিৎসার এই প্রাথমিক সরঞ্জাম তাঁর সঙ্গে থাকে সর্বদা। বীরাঙ্গনা নিজেই ক্ষতস্থানের বাঁধা কাপড়টি খুলতে উদ্যত হলে মুসাফির তাকে থামিয়ে দিয়ে বীরাঙ্গনার আহত হাতটি নিজের দিকে টেনে নিলেন।
ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা। ক্ষতস্থান থেকে যথেষ্ট রক্তপাত হয়েছে। মুসাফির নিজের ঝোলা থেকে ঔষধের সরঞ্জাম বের করে ঔষধ তৈরি করে লাগিয়ে দিলেন ক্ষতস্থানে। বীরাঙ্গনা এতক্ষণে বললেন, আমার নাম রুকসানা। আপনি একজন চিকিৎসক জেনে খুশি হলাম। মুসাফির জানতে চেয়েছিলেন রুকসানার বাকি পরিচয়। কিন্তু আর কিছুই বলেননি রুকসানা।
মধ্যরাতের পর ঝড় থেমেছিলো। মুসাফির দেখেছিলেন ঘরের কোণে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে রুকসানা। সম্ভবত ঘুমে অচেতন। বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নেশা ধরে গিয়েছিল রক্তে। সুডোল দুটো হাত, উদ্ধত স্তন, চিকন লালচে ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সংযত করে রাখতে পারেননি মুসাফির। একপা দুপা করে এগিয়ে গিয়েছিলেন রুকসানার দিকে।
কিন্তু ওকে স্পর্শ করার আগের মুহূর্তেই গর্জে উঠেছিলেন রুকসানা। বলে উঠেছিলেন, আর অগ্রসর হবেন না, ধবলগড়ের অতিথিকে আঘাত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। নারীর আব্রুকে বেআব্রু করার শাস্তি ধবলগড়ের বাদশাহ একটু জাঁকজমক করেই দিয়ে থাকেন। খ্যাপা ষাঁড় আর বদ্ধভূমিতে নিজেকে আচমকাই আবিষ্কার করেন দোষী।
মুসাফির চমকে গিয়েছিলেন তেজস্বিনী নারীকে দেখে। মশালের আলোর আভায় তাঁর চোখ দুটো জ্বলছিল। সেখানে একরাশ ঘৃণার প্রতিচ্ছবি দেখে হতোদ্যম হয়েই বসে পড়েছিলেন মুসাফির। বুঝেছিলেন, রুকসানা আর পাঁচজন নারীর মত নয়। সে বৃক্ষকে অবলম্বন করে লতার মত বৃদ্ধি পেতে চায় না।
রুকসানা আর বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করেই রাত্রির তৃতীয় যামে আশ্রয়খানা ত্যাগ করেছিলেন। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন, নারীর অন্তরকে স্পর্শ করুন, শরীর তো বাহ্যিক দুয়ার মাত্র। মুসাফির দেখেছিলেন, রুকসানার চোখের চাহনিতে তখন হারানোর যন্ত্রণা। আর কিছু বোঝার আগেই আশ্রয়খানা ত্যাগ করেছিলেন রুকসানা। বিমর্ষ মুসাফির ফিরে এসেছিলেন রুদ্রনগর রাজ্যে।
.
তারপর থেকে মুসাফিরকে মন খারাপ নামক এক অতি কঠিন ব্যাধিতে ধরেছিলো। মুসাফির নিজেও চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছিলেন। চিকিৎসা মন্দ করেন না। তারপরেও নিজের এই অদ্ভুত ব্যাধি সম্পর্কে কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। মুসাফিরের সব থেকে প্রিয় স্থান তাঁর মহলের ভিতরের পদ্মসায়র। সেখানে বসে কাব্য রচনা করলে তাঁর মন উৎফুল্ল হয়ে যায়। ইদানীংকালে সেই পদ্মসায়রের গোলাপি পদ্মফুলগুলো যেন চক্ষুশূল হয়ে গেছে।
বাদশাহ মিজানুরের আদেশে ভোজনশালায় রন্ধন হচ্ছে মুসাফিরের পছন্দের খাদ্য। মুসাফিরের দুই স্ত্রী নিয়ম করে স্বামীর মনোরঞ্জনের চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলেন। এছাড়াও রাজ্যের বিখ্যাত কাঞ্চনীরা এসেছিলেন মুসাফিরের সম্মুখে নৃত্যগীত পরিবেশন করতে। তারাও ব্যর্থ মনোরথে ফিরে গেছেন। শেষ পর্যন্ত বাদশাহ মিজানুর ডক্টর প্যাট্রিককে ডাকেন রাজসভায়। প্যাট্রিক মুসাফিরের বন্ধুস্থানীয়। তাই তাকেই জিজ্ঞাসাবাদ করেন। প্যাট্রিক জানান মুসাফিরের শরীরে কোনো ব্যাধির জন্ম হয়নি। হয়েছে মনে। এ অসুখ বড় জটিল। এর কোনো প্রকার ঔষধ নেই। এদিকে মুসাফিরের স্বাস্থ্য ভাঙতে বসেছে। তার চোখে উদাসীন দৃষ্টি। জগৎসংসারের কোনো পার্থিব বস্তুতে যেন তার মন নেই। তিনি কেবল নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকেন দক্ষিণের অলিন্দের সম্মুখে। যেখান থেকে দেখা যায় ধবলগড়ের রাজপ্রাসাদের উঁচু চূড়াটা। প্যাট্রিক নিভৃতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার এমন অসুখের কারণটা কি?
মুসাফির ক্লান্ত কণ্ঠে উত্তর দিয়েছেন, নারীকে যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা একান্ত কর্তব্য প্যাট্রিক। তাকে লালসা করে নয় তাকে সম্মান প্রদান করে বেঁধে রাখা উচিত। বিশেষ করে সে যখন একজন বীরাঙ্গনা হন। প্যাট্রিক বুঝেছিলেন, এ কোনো ভিনদেশী নারীর কেরামতি। কিন্তু কিভাবে তাকে খোঁজা সম্ভব সেটা বোঝেননি উনি। এর কোনো উপায় না পেয়ে বাদশাহ তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারীকে রক্ষা করতে রাজ্যে রাজ্যে খবর পাঠালেন। যে বৈদ্য মুসাফিরের রোগের নিরাময় করতে সফল হবে তাকে রাজবৈদ্যর পদে আসীন করা হবে।
বিভিন্ন রাজ্য থেকে দলে দলে বৈদ্যরা এলেন তাদের চিকিৎসাবিদ্যা সঙ্গে নিয়ে। নানারকমের ঔষধ প্রয়োগ করা হলো মুসাফিরের শরীরে, কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। মুসাফির রোগমুক্ত না হয়ে আরও বিরক্ত হয়ে উঠলেন। কথায় কথায় মেজাজ হারাচ্ছিলেন। রাজবৈদ্য না হতে পারে ব্যর্থ মনোরথে সকলে নিজের রাজ্যে ফিরে গেলেন।
.
হঠাৎই মধ্যরাতে দুজন মানুষ সৈন্যদের চোখ বাঁচিয়ে প্রবেশ করলেন নিদ্রিত মুসাফিরের কক্ষে।
মুসাফির এখন বেগমখানায় রাত্রিযাপন বন্ধ করেছেন। নিভৃত কক্ষই তাকে আরাম দেয় বেশি। তাই রাতের নিস্তব্ধ কক্ষে মুসাফির একাই নিদ্রিত ছিলেন। একজন মানুষ নিদ্রিত মুসাফিরের মস্তকে হাত রাখলেন। ধীর স্বরে বললেন, কেমন ছিল সেই নারী? সেকি কোনো শাহজাদী না মায়াবিনী? মুসাফির অর্ধ জাগ্রত অবস্থায় বলতে শুরু করলেন সেই মৃগনয়না নারীর কথা।
আরেকজন মানুষ মশালের আলোয় সাদা কাগজের ওপরে আঁকিবুকি কাটতে শুরু করলো। কাজ শেষ হতে সময় লাগলো প্রায় ঘণ্টা তিনেক।
তখন পুব আকাশে লালচে রং ধরছে। রুদ্রনগরের বড় মসজিদ থেকে ভেসে এলো ভোরের নামাজের সুর। খাতার আঁকিবুকি ছেড়ে মাটিতেই উবু হয়ে বসে ফজরের নামাজ পড়তে শুরু করলেন মানুষটি। অন্য মানুষটি তখন অর্ধ ঘুমে রাখতে চান মুসাফিরকে। জাগ্রত অবস্থায় একটা শব্দও উচ্চারণ করছেন না শাহজাদা মুসাফির। তাই তাকে তন্দ্রাচ্ছন্ন রাখতে পারলেই লাভ।
খাতার আঁকিবুকি যখন শেষ হলো তখন দেখা গেল বীরের পোশাক পরিহিতা এক অপরূপ সুন্দরী নারী। যার কেশরাশিতে নয়নার কালো জলের গভীরতা। যার অধরে সহস্র পদ্ম নতজানু। শিল্পীর আঁকা সে ছবির দিকে মশালের আলোয় অপলক তাকিয়ে থাকলেন অপর মানুষটি। ছবির নারীর অঙ্গে বীরাঙ্গনার পোশাক। নারীর চিরাচরিত লজ্জাভূষন পরিহিত নয় সে। সে নারী যেন বুঝিয়ে দিতে চায় তার উপস্থিতিতে চন্দ্রালোক ম্রিয়মাণ।
শিল্পী ভীত কণ্ঠে বলে উঠলো, সাহেব ভোরের আলো দেখা যায়। নামাজ শেষের পথে…প্রাসাদের প্রহরীরা এবারে জেগে উঠবে একে একে। চলুন শীঘ্রই আমাদের প্রাসাদের বাইরে বেরোতে হবে।
ওপর মানুষটি সচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখলেন, মুসাফির গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছেন আবার।
খুব সন্তপর্নে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে ওরা দুজন আবারও প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন গোপন দরজা দিয়ে।
.
পরদিন প্রাতে বাদশাহ বসেছিলেন সভাকক্ষে।
বাদশাহ মিজানুরের ঘন গোঁফের ভাঁজে দুশ্চিন্তার রেখা সুস্পষ্ট। রুদ্রনগর তো কোনো ছোট পরগনা নয়। ক্রমাগত যুদ্ধ জয়ের ফলে রুদ্রনগরের সীমানা এখন বেশ কয়েকটি রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত। তাই তার দরবারে যে প্রচুর মানুষের ভিড় থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে বাদশাহকে মানুষ প্রজাবৎসল বলেই মানেন। স্থানীয় বাজারে শুল্কের হার বেড়ে গেছে বলেই একদল বণিক এসে দাঁড়িয়েছে তাদের সমস্যা নিয়ে। বাদশাহ মিজানুর আজ যেন একটু অন্যমনস্ক। পুত্রকে নিয়ে দুশ্চিন্তাটা কিছুতেই মন থেকে দূর করতে পারছেন না।
কিন্তু বাদশাহ তো আর সাধারণ গৃহস্থ নন। তাঁর ওপরে গোটা রাজ্যের ভার। সমস্ত প্রজারা তার সন্তানতুল্য। তাই কর্মবিরতি হয় না তাঁর দিনলিপিতে। প্রজারা এসে দাঁড়াচ্ছেন, জানাচ্ছেন তাদের সমস্যা বা আর্জির কথা। বাদশাহ শুনে তার বিধান দিচ্ছেন। সময় এগিয়ে চলেছে দ্রুতগামী নদীর মতই। সভাকক্ষে মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
মন্ত্রী সুজান খান জানালেন, বাদশাহ দ্বিপ্রহরের আহারে যাবেন। তাই আজ আর বাইরের অতিথির প্রবেশ নিষেধ। সভামধ্যে যারা রয়েছেন তারাই তাদের আর্জি জানাতে পারবেন। এমন সময় মন্ত্রী সুজান খানের নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে ফরাসি ডাক্তার প্যাট্রিক ঢুকলেন সভাকক্ষে।
সুজান খান তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন। ওনার কথার এমন অবাধ্য হওয়ার সাহস স্বয়ং সেনাপতি বা নগরপালেরও নেই। সেখানে এক ভিনদেশী চিকিৎসকের এত সাহস! নেহাত বেগমমহলের আশীর্বাদের হাত ওনার মাথার ওপরে আছে তাই, নাহলে সুজান খানের তীক্ষ্ন তলোয়ার ধর থেকে মুন্ডুটা পৃথক করতে সময় নিতো না। প্যাট্রিক সুজান খানের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই প্রায় ছুটে গেলেন বাদশাহের কাছে। সভাকক্ষে এ আচরণ অবশ্যই দণ্ডনীয় অপরাধ।
বাদশাহ স্বয়ং বিরক্ত হয়ে বললেন, বিদেশি বলে কি কোনোদিনই সহবত শিখবে না হাকিম? মন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার দুঃসাহস তোমায় কে দিলো? মনে রেখো বাদশাহ মিজানুর কিন্তু বেগমখানার পরামর্শে চলা শিরদাঁড়াহীন মরদ নয়। তাই রুদ্রনগরে অন্য প্রজাদের যেমন খাতির বেগমখানার চিকিৎসকেরও তেমন খাতির। প্যাট্রিক সাহেব এতটুকু ভীত না হয়েই বললেন, বাদশাহ আমায় আমার কর্মের জন্য সঠিক শাস্তি প্রদান করুন। কিন্তু রুদ্রনগরের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী এই মুহূর্তে সংকটজনক শারীরিক অবস্থায় আছেন। তাঁর অসুখ নিরাময়ের ঔষধ নিয়েই আমি আপনার দরবারে হাজির হয়েছি। এই ঔষধটি আনিয়ে দিতে হবে বাদশাহকে। আমি রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে দিতে পারবো বলেই আশা রাখি।
সভার মধ্যে বাদশাহ সামান্য উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। গতকালই রাজবৈদ্য জানিয়ে গিয়েছেন, মুসাফিরের শারীরিক অবস্থা সংকটজনক। সঠিক খাদ্য ও ঘুমের অভাবে সে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। মাত্র একমাসের মধ্যে মুসাফিরের শরীরের এই অবনতি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না বাদশাহ। তাই তার জীবনদায়ী ঔষধের কথা শুনে সামান্য বিচলিত হয়ে বললেন, বলো হে বিদেশি হাকিম কি সেই ঔষধের নাম। আমার একমাত্র পুত্রের জন্য আমার কলিজা হাজির। তবে হ্যাঁ, একটি শর্ত আছে। যিনি মুসাফিরকে আরোগ্য দান করতে পারবেন তাকে রুদ্রনগর রাজ্যের রাজবৈদ্যর পদে আসীন করা হবে। আর যিনি নিরাময়ের আশ্বাস দিয়ে ব্যর্থ হবেন তাকে হত্যা করা হবে রুদ্রনগরের গুমঘরে। কি সাহেব শর্তে রাজি তো?
প্যাট্রিক এদেশের অনেক নিয়মের সঙ্গেই পরিচিত এখন। আইন কানুন যে খুব বেশি কাজ করে না রাজা-বাদশাহের নিয়মে সেটা ও জানে। প্রাণদণ্ডের ভয় পেলেও সাহসে ভর করে শিল্পীর আঁকা ছবিটা বাদশাহের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, রাজি। তবে হজুর আমার কিন্তু সঠিক ঔষধটাই চাই।
বাদশাহ গোটানো কাগজ খুলে দেখলেন, সেখানে এক বীরাঙ্গনা নারীর ছবি। আকস্মিক চমক সম্বরণ করে মিজানুর বললেন, এমন রসিকতার হেতু কি সাহেব?
প্যাট্রিক হাত জোড় করে বললেন, রসিকতা নয় হুজুর। এই নারীই ছোট নবাবের আরোগ্য এনে দেবে। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেও বাদশাহ আর একটি বাক্যও উচ্চারণ না করে রাজসভা ত্যাগ করলেন।
.
আশেপাশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে গুপ্তচর পাঠানো হলো। প্রত্যেকের উদ্দেশ্য একই। ওই নারীর বাসস্থান ও জন্মবৃত্তান্ত খুঁজে আনা। প্যাট্রিকও দিন গুনছেন। ওদিকে মুসাফিরের দেহের অবনতি হচ্ছে ক্রমশ। দুই বেগম চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। কিন্তু মুসাফিরের ওই একই বক্তব্য, ঘৃণা ঘৃণা….তার চোখে আমি ঘৃণা দেখেছি।
ঠিক কি কারণে এমন উদ্ভ্রান্তের মত ব্যবহার করছেন একজন সুস্থ স্বাভাবিক বুদ্ধিমান মানুষ সেটাই বিস্মিত করছে সমগ্র প্রাসাদের মানুষকে। বেগম, বাদশাহ থেকে শুরু করে প্রহরীগুলোর পর্যন্ত মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ সুস্পষ্ট। কি হলো শাহজাদার?
.
রুদ্রনগরের গুপ্তচর সংবাদ আনলেন, ছবির নারী একজন বাদশাহ কন্যা। নাম রুকসানা বেগম। ধবলগড়ের শাহজাদী। তলোয়ার চালনায় পারদর্শী। তীরও চালান বাতাসের বেগে।
.
ধবলগড়ের বাদশাহের সঙ্গে কয়েকদিন আগেই মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন উনি। একে অপরকে যে কোনো সমস্যায় সাহায্য করবার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়েছেন। রুকসানা বেগম যদি ধবল কন্যা হয় তাহলে বৈবাহিক বার্তা পাঠানো অতি সহজ। তাতে রাজনৈতিক ভাবেও পুষ্ট হবে রুদ্রনগর। দক্ষিণ দিক নিয়ে আর ভাবিত হতে হবে না রুদ্রনগরকে। তখন বরং বল্লভপুর নিয়ে ভাবলেই চলবে। বল্লভপুরের রাজার সঙ্গে যুদ্ধংদেহী মনোভাব মিজানুরের বহু বছর ধরে। শুধু মাঝের বিষপুরের মানুষদের কথা ভেবেই যুদ্ধ থেকে বিরত থেকেছেন মিজানুর। বিষপুর হিন্দু প্রধান স্থান। বিষপুরের প্রান্তে অবস্থিত বল্লভপুরের সঙ্গে যুদ্ধ উপস্থিত হলে বিষপুরের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। তখন হিন্দু জমিন্দাররা জোটবদ্ধ হবে মিজানুরের বিরুদ্ধে। মুসলমান রাজা তাদের স্বার্থ চিন্তা করেননি বলে রব তুলবে। মিজানুর অকারণ যুদ্ধনীতিতে বিশ্বাসী নন। বরং তীক্ষ্ন ক্ষুরধার বুদ্ধির মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রেই সন্ধিনীতিতে আস্থা রাখেন। তাই বল্লভরাজের ওপরে ক্ষোভ থাকলেও এখনও যুদ্ধে অবতীর্ণ হননি। তবে খুব শীঘ্রই বল্লভপুর আক্রমণ করতে হবে বলে খবর এনেছেন মন্ত্রী সুজান খান। বল্লভপুরের রাজা নাকি তেমনই চক্রান্ত রচনা করেছেন রুদ্রনগরকে নিয়ে। তাই দক্ষিণের ধবলগড়কে আত্মীয়ের বন্ধনে বেঁধে রাখলে সময়ে উপকারে আসবে। আর দেরি না করে শাহজাদী রুকসানার সঙ্গে রুদ্রনগরের একমাত্র উত্তরাধিকারীর বিবাহ প্রস্তাবের বার্তা পাঠালেন মূল্যবান উপহার সহযোগে। ধবলগড়ের বাদশাহ প্রত্যুত্তরে সম্মতি জানালেন। তার কন্যা রুকসানার সঙ্গে নিকাহ দিতে প্রস্তুত হলেন।
.
বাদশাহ মিজানুর প্যাট্রিককে ডেকে হুমকি দিলেন, এ ঔষধ যদি মুসাফিরকে আরোগ্য দান করতে না পারে তবে সাহেবের মৃত্যুদণ্ড অবশ্যম্ভাবী। দিল্লির সুলতান এসেও রক্ষা করতে পারবে না ফরাসি ডাক্তারকে। প্যাট্রিক নির্ভীক চিত্তে বলেছেন, মৃত্যুদণ্ড শিরধার্য। এদিকে মুসাফির বিবাহে অনাগ্রহী।
মুসাফিরের দুই বেগম খালেদা ও রোকেয়া সোহরকে সুস্থ করতে ব্যর্থ হয়ে বেগম জাহানারার ভর্ৎসনা সহ্য করেছে। তাই মুসাফিরের তৃতীয় বিবাহে তাদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। বেগমমহলে আরেকজনের আধিপত্য বাড়বে কল্পনায় বরং বিরক্ত।
বাদশাহ মিজানুরের একটাই উদ্দেশ্য, রুদ্রনগরের সিংহাসনের ভাবী বাদশাহকে সুস্থ করে তোলা।
মুসাফিরের অনিচ্ছাতেই তার তৃতীয় নিকাহের আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে।
বিবাহবাসরে জমকালো পোশাকের আড়ালে হয়তো রুকসানাকে ঠিকমত চিনতে পারেননি মুসাফির। অথবা তার অন্যমনস্কতাই এর কারণ। কিন্তু রাজকীয় সজ্জায় সজ্জিত পালংকে বসে প্রথম যখন রুকসানার অবয়বের আবরণ উন্মোচন করলেন মুসাফির তখন আকস্মিকতায় চমকে উঠলেন। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে অপলক তাকিয়ে ছিলেন রুকসানার দিকে। রুকসানা মৃদু হেসে বলেছিলেন, আপনার কামনা বড়ই শক্তিশালী। তাই ধবলগড়ের শাহজাদী সে ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হলো।
বেশ কয়েকমাস পরে বাদশাহ মিজানুর তার সন্তানের অধরে স্বতঃস্ফূর্ত হাসি দেখলেন। শরীরের প্রতি অবহেলায় চোখের নিচে যে অন্ধকার জমেছিল তা নিমেষে যেন মুছে গেলো।
প্যাট্রিককে ডাকা হলো ভর্তি সভায়। আজ তার বিচার হবে। মিজানুরের সঙ্গে আজ মুসাফিরও রয়েছেন উপস্থিত। প্যাট্রিক তার বন্ধু স্থানীয়। তাই হুজুর যখন তাকে কাঠগড়ায় চড়াতে চাইছেন, তার প্রতিবাদে দু-একশব্দ বলার অভিপ্রায়েই আজ তাঁর এই উপস্থিতি। নচেৎ বাদশাহের এই বিচারসভার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই মুসাফিরের। তিনি তাঁর কাব্য আর চিকিৎসা নিয়েই বেশ আছেন।
গত তিনদিন অবশ্য তিনি এক নতুন খেলায় মাতোয়ারা। রুকসানা বেগমের রহস্য উন্মোচনে। রুকসানাকে তিনি এখনও স্পর্শ করে উঠতে পারেননি। রুকসানা শর্ত আরোপ করেছেন, তিনি বাদশাহ কন্যা। তাঁর ধমনীতে বইছে সুলতানি রক্ত। তাই তিনি সম্মান করবেন সেই শাহজাদাকে, যার হাতে তলোয়ার বশ্যতাস্বীকার করে। যার রক্ত মাটিতে পড়লে জন্ম নেবে আরেকটা যুদ্ধের।
রুকসানা সত্যিই সুলতান কন্যা। বিয়ের মেহেন্দি হাতে নিয়েই সে বেগমমহলের নিজস্ব কক্ষে তলোয়ার চালনা করে নিজের দৈনন্দিন অনুশীলন বজায় রেখেছেন। প্রহরী থেকে বাঁদীরা নাকি চমকে দেখেছে রুকসানার অসি চালনা। এমন তলোয়ার চালনা নাকি যুদ্ধে পারদর্শী কোনো সৈনিকের পক্ষেই সম্ভব। রুকসানার আচার-আচরণ, বাচনভঙ্গিমা কোনোটাই রুদ্রনগরের বেগমমহলের মত নয়। তাই স্বয়ং জাহানারা বেগম মুসাফিরের প্রথমা পত্নী খালেদার ওপরে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন রুকসানাকে রুদ্রনগরের সহবত শেখানোর জন্য।
যদিও রুকসানা বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়ার মেয়ে নন। তাঁর মধ্যে জন্মগত এক স্বাধীন সত্ত্বা আছে। যেটা তাঁকে আর পাঁচজন বিবি-বেগমের থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করে। রুকসানার চলার ছন্দে নূপুরের রিনিঝিনি নেই। নেই মণিমাণিক্যের প্রতি কোনোরূপ অগ্রহ। বরং রাজ্যের প্রজারা কেমন আছেন সেদিকে তাঁর নজর বেশি। মুসাফিরের সঙ্গে একান্তে পদ্মসায়রের ধারের সাজানো বেদীতে বসে আলাপচারিতার সময়েও রুকসানা জিজ্ঞেস করেছেন, আপনাদের এ রাজ্যের সীমানায় অবস্থিত বিষপুরের মানুষরা জঙ্গলের বুনোহাতির ভয়ে শঙ্কিত থাকে কেন? বিষপুরে তো আপনাদের আদেশ জারি আছে। তবে কেন আপনারা এর সমাধানে অগ্রসর হননি?
মুসাফির জীবনে এই প্রথমবার শুনলেন, বিষপুরের জঙ্গলে জংলী হাতির বাস। তারা রাত্রি হলেই ওই অঞ্চলের মানুষের ক্ষয়ক্ষতি করে! মুসাফিরের দৃষ্টি অনুসরণ করেই রুকসানা বলেছিলেন, হুজুর দায়িত্ব থেকে দূরে সরে গিয়ে কাব্যচর্চা হয় না। কাব্যে আপনি জীবনের ছবি আঁকুন। যেখানে প্রজারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বাস করেন, আপনি তাদের ক্রন্দনরত অবয়বের কাব্য লিখুন। পদ্মসায়রের গোলাপী পদ্ম আর বেগমের অধরের লালিমায় অবশ্যই আপনার একাধিপত্য থাকবে।
রুকসানার চোখে নিজেকে এমন অপদার্থের রূপে দেখে নিজের প্রতি একটা বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছিল মুসাফিরের। তাই সদ্য বিবাহিত শাহজাদা এখন রাজসভায় বসেন।
.
প্যাট্রিকের সোনালী দাড়িতে সামান্য দুশ্চিন্তার ভাবও নেই। রুদ্রনগরের গুমঘরে গিয়েও তিনি মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসা করবেন এমন অভিপ্রায়েই বসে আছেন দোষীর আসনে।
রুদ্রনগরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রহিম খান দাঁড়িয়ে আছেন একেবারে শেষ প্রান্তে। বাদশাহের বিচারের পরে রহিম খানের ওপরেই দায়িত্ব পড়ে অভিযুক্তদের ভিন দেশে ছেড়ে দিয়ে আসা হবে নাকি রুদ্রনগরের গুমঘরে বন্দি করা হবে!
ঢং করে ঘণ্টা বাজতেই সচকিত হলেন সকলে।
বাদশাহ মিজানুর তার সভায় আদালত বসালেন। একে একে অভিযুক্তদের ডাকা হচ্ছে, বিচার হচ্ছে সকলের। কেউ কেউ বিনাশর্তে মুক্তিও পেয়ে যাচ্ছে।
সভার সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান ফরাসী চিকিৎসক প্যাট্রিকের বিচার শোনার জন্য। বেগমমহলে যার অবাধ যাতায়াত। রুদ্রনগরের ভবিষ্যৎ বাদশাহ যার বন্ধুস্থানীয়। স্বয়ং জাহানারা বেগম যাকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন তার অপরাধটাই বা ঠিক কি! উৎসুক চোখগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন বাদশাহ। মুসাফির পিতার সিংহাসনের পাশেই বসে আছেন। মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া। প্যাট্রিকের অপরাধটা তার কাছেও বড়ই ধোঁয়াশা।
একমাত্র নির্লিপ্ত চাহনিতে বাদশাহের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন ধন্বন্তরী চিকিৎসক প্যাট্রিক।
মিজানুর গম্ভীর গলায় বললেন, একজন বিদেশিকে আমরা কতটা বিশ্বাস করতে পারি মহামন্ত্রী সুজান খান?
সুজান খান একটু হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, আজ্ঞে হুজুর বিদেশিরা আমাদের শত্রু, তাদের নিপাত করাই কর্তব্য। বিশ্বাস করা নেহাত অনুচিত। সভায় উপস্থিত সিংহভাগ রাজকর্মীরা সুজান খানের সমর্থনেই হাত তুললেন। বাদশাহ মিজানুর বললেন, এক্ষেত্রে বড়ই বিচিত্র অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হলাম আমি।
আমার সমগ্র রুদ্রনগরের বৈদ্য, হাকিমরা যখন পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলো যে তারা মুসাফিরকে রোগমুক্ত করতে পারবে না, তখন আমি ঘোষণা করেছিলাম, যে মুসাফিরকে সুস্থতা প্রদান করতে সক্ষম হবে তাকেই রুদ্রনগরের রাজবৈদ্যর পদে আসীন করা হবে। এই পরীক্ষায় একমাত্র উত্তীর্ণ হয়েছেন, বিদেশি হাকিম প্যাট্রিক। এক বিচিত্র উপায়ে তিনি জানতে পেরেছিলেন, রুকসানা বেগমই হলেন মুসাফিরের রোগমুক্তির একমাত্র ঠিকানা। মৃত্যুদণ্ড শিয়রে অপেক্ষমান জেনেও প্যাট্রিক মুসাফিরকে ফিরিয়ে দিয়েছে স্বাভাবিক জীবনে।
তাই আমার বিচারে আজ থেকে রুদ্রনগরের রাজবৈদ্য নিযুক্ত হলেন একজন ভিনদেশী চিকিৎসক প্যাট্রিক। যিনি এ স্থানকে ভালোবাসেন।
.
বিচারকক্ষে উপস্থিত অনেকেরই যে এ বিচার পছন্দ হয়নি সেটা তাদের মুখভঙ্গিমায় সুস্পষ্ট হলো। বাদশাহ অবশ্য সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই কাছে ডাকলেন প্যাট্রিককে। প্যাট্রিক ইতস্তত করে বললেন, হুজুরের করুণায় রুদ্রনগরে বড়ই সুখে আছেন তিনি। তার মনে গভীর প্রশান্তি বিরাজমান। কিন্তু বন্ধুস্থানীয় মুসাফিরকে সুস্থ করার বিনিময়ে কোনো পুরস্কারের দাবি তিনি করতে পারেন না। এ তার চিকিৎসা ধর্মের অবমাননা করা হয়। মানুষের জীবন দান তার অবশ্য কর্তব্য।
.
রুদ্রনগরের মন্ত্রীসভার অনেকেই বিস্মিত হলেন। এমন সুখের, ঐশ্বর্যের পদ কেউ বিনাশর্তে পরিত্যাগ করতে পারে এমন কষ্টকল্পনায় তারা অভ্যস্ত নন। মুসাফিরের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা। প্যাট্রিককে চিনতে তাঁর ভুল হয়নি। সে প্রকৃত বন্ধু। সভাকক্ষের অনেকেই ভাবছেন— বেগমমহলের স্নেহভাজন চিকিৎসকের কি আর মণি মুক্ত, জহরতের অভাব হবে! হারেমে যার অবাধ যাতায়াত সেই বিদেশিকে অনেকেই নেকনজরে দেখেন না। আজ আবার স্বয়ং বাদশাহের বিচারে তিনি রাজবৈদ্যের পদ পাওয়ার পরে মৃদু অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে রুদ্রনগরের মন্ত্রীমহলে।
প্যাট্রিক নির্লোভ কণ্ঠে বললেন, আমি এই রুদ্রনগরের জন্য প্রাণ ত্যাগ করতে রাজি। যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে প্রস্তুত। হুজুরের সমস্ত রকম হুকুম মানতে বাধ্য থাকবো, কিন্তু এ রাজপদে বসে অর্থ সঞ্চয় করতে পারবো না।
উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত হলেন! বাদশাহ মিজানুরের দেওয়া পদকে অস্বীকার করার ক্ষমতা দেখে। একটু ভীত স্বয়ং মুসাফিরও। সভা কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন বাদশাহ মিজানুর। বললেন, এমন নির্লোভ মানুষ এ রাজ্যে বিরল। তাই রাজবৈদ্য পদে আসীন না হলেও প্যাট্রিক বাদশাহ পরিবারভুক্ত মানুষ হলেন আজ থেকে।
বিদেশীর ভাগ্যলিখন দেখে ঈর্ষান্বিত হলেন অনেকেই। মিজানুর বললেন, একটা পুরস্কার প্রাপ্য রইলো প্যাট্রিকের। তিনি যখন চাইবেন রুদ্রনগর দিতে বাধ্য থাকবে। সেদিনের মত সভা ভঙ্গ হলো।
.
সেদিন থেকে প্যাট্রিক মুসাফিরের আরও কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন।
.
উন্মুক্ত বাতায়নে দাঁড়িয়ে মুসাফির জিজ্ঞেস করেছিলেন, বলো হে প্যাট্রিক, নারীর মন জয় করার কি বিশেষ চিকিৎসা তোমার জানা আছে? গজদন্তের গহনা, হিরের ফুলদানি, বহুমূল্যের বস্ত্র সকলে পরাজিত হয়েছে। রুকসানা বেগমের কঠিন হৃদয়ের তল খুঁজে চলেছি, জয় করতে চাই। প্যাট্রিক নিজের কোমরবন্ধনী থেকে এক ঝটকায় তলোয়ারটা খুলে নিয়ে মুসাফিরের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, একমাত্র অসি চালনায় পারদর্শী হয়ে রুকসানাকে পরাজিত করতে পারলে তবেই এ হৃদয়ের ওপরে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারবেন আপনি। নচেৎ নয়। এ হৃদয়ের ঔষধ পৃথক। মূল্যবান গহনাতে এ হৃদয় বশ্যতা স্বীকার করবে না হুজুর।
.
প্যাট্রিকের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশংসার চাহনিতে মুসাফির বললেন, ধন্য তোমার চিকিৎসা জ্ঞান। তুমিই সঠিক নির্ণয় করেছো।