বিষপুরের তাঁবুতে মুসাফির
নিজের প্রিয় কলমের দিকে তাকিয়ে মুসাফির ভাবছিলেন, অবশেষে তিনি বাধ্য হলেন এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে। রুকসানার জেদ তাকে পরাজিত করলো। সুজান খানের কূটনৈতিক বুদ্ধি ওঁর মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হলো। পরাজিত হলো ওঁর কাব্যময় অন্তরটা। ওঁকে একমাত্র অনুভব করতে পারে প্যাট্রিক। তাই তো প্যাট্রিককে এত আপন মনে হয় ওর।
আগামীকাল সূর্যোদয়ের পর থেকেই রুদ্রনগরের সশস্ত্র সেনাবাহিনী নিয়ে সুজান খান এগিয়ে যাবেন বল্লভপুরের দিকে, মুসাফিরের নেতৃত্বে। এই নেতৃত্ব বিষয়টাই ভয়ঙ্কর দোলাচল শুরু করেছে মুসাফিরের অন্তরে। রুকসানাকে খুশি করতে অসিচালনা রপ্ত করেছেন ঠিকই, কিন্তু দক্ষ সৈনিকদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তাদের রণনীতিকে মোকাবিলা করা যে কতটা কঠিন হবে সেটা চিন্তা করেই ভীত হয়ে পড়ছেন বাদশাহ।
পিতার মৃত্যুর পরবর্তীকালে রুদ্রনগরের সর্বাপেক্ষা আলোচিত বিষয় ছিলো বল্লভরাজকে হত্যা করা এবং বাদশাহ মিজানুরের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া। শুধু রুকসানা বা মাতা জাহানারা নয় সমগ্র রুদ্রনগরের বাসিন্দা অপেক্ষা করে আছে এই জয়ের। এই যুদ্ধের জয়বার্তা রুদ্রনগরে পৌঁছালেই রুকসানা রুদ্রনগরের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেবেন উপহার সামগ্রী। এ যেন বাদশাহ মিজানুরের আত্মার শান্তি কামনায় দু-হাত ভরে দান করবেন রুকসানা। বাদশাহ মিজানুরের প্রিয় ছিলেন রুকসানা। বাদশাহের প্রশ্রয়েই রুদ্রনগরের হারেম মহলে কিছুটা মুক্ত বাতাস প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়েছেন রুকসানা বেগম। তাই মিজানুরের হত্যার প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত তাঁর নিদ্রা নেই।
.
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুসাফিরের ইচ্ছে করছিলো, যুদ্ধ শিবির থেকে পালিয়ে যেতে। ব্যর্থ রাজার থেকে পলাতক রাজার খেতাব অনেক বেশি সম্মানের।
ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা হাতে মুসাফিরের তাঁবুতে প্রবেশ করলেন প্যাট্রিক। প্যাট্রিকের কপালে চিন্তার ভাঁজ এই প্রথম লক্ষ্য করলেন মুসাফির। এ যাবৎকাল প্যাট্রিককে সদা দুশ্চিন্তামুক্ত হাসি মুখেই দেখেছেন মুসাফির। এ চিন্তার হেতু কি জিজ্ঞেস করতে প্যাট্রিক বললেন, হুজুর একটা চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছি। সুজান খান এ যুদ্ধজয়ের সমস্ত গৌরব নিজের মুকুটের পালকে পরতে ব্যস্ত হয়েছেন। ছোটি বেগম সাহেবাও যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থাকবেন শুনলাম ছদ্মবেশে। আপনি কি এ বিষয়ে অবগত আছেন হুজুর? আকস্মিক এমন সংবাদে মুসাফির বিস্মিত হয়ে বললেন, এ সংবাদ তুমি কোথায় পেলে প্যাট্রিক?
প্যাট্রিক অন্যমনস্কভাবেই উত্তর দিলেন, সুজান খানের শিবিরে রুদ্রনগরের সংবাদবাহক এসেছেন। তিনিই গোপনে এ খবর পেশ করলেন। ছোটি বেগম সাহেবা উপস্থিত থাকবেন শুনেই সুজান খান আপনাকে ওনার সম্মুখে অপদার্থ প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সেনাপতির কাছে নির্দেশ গেছে সেনাবাহিনী যেন সুজান খানের নির্দেশ মেনে চলে যুদ্ধক্ষেত্রে। মুসাফিরের বিস্ময়ের ঘোর তখনও অপসৃত হয়নি। বাদশাহী রক্ত কথা বলে উঠলো। রুকসানা তার বড় আদরের। সোহাগের ভালোবাসার বেগম। তারপরেও বেগমের এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। হারেমের বেগম আসবে যুদ্ধক্ষেত্রে!
রুদ্রনগরের রাজপ্রাসাদকে কলুষিত করছে রুকসানা। রুদ্রনগরের এত বৎসরের গৌরবময় ইতিহাসের পাতায় কালির আঁচড় কাটতে চলেছে রুকসানা। এ অন্যায় ক্ষমার অযোগ্য। রুকসানার সমগ্র আবদার হাসি মুখে মেনে নিয়েছেন মুসাফির। ওর দাবি মেনেই বল্লভপুরের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চলেছেন। এরপরেও রুকসানার বিশ্বাস অর্জন করতে পারেননি মুসাফির! কলমের কালি খাতার কাগজে গড়িয়ে পড়লো। ক্ষুব্ধ বাদশাহ প্যাট্রিকের দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, এ সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের উপায় বলো হাকিম। বেগমের এ অন্যায় আমি মেনে নেবো না।
প্যাট্রিক একটু চিন্তা করে বললেন, হুজুর আগামীকাল প্রাতে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবে রুদ্রনগরের সৈনিকরা। ওদিকে বিষপুরের আমাদের এই শিবিরের সংবাদ পৌঁছে গেছে বল্লভপুরেও। গুপ্তচরের আনা খবরে জানা যায় বল্লভরাজ তৈরি তার সেনাবাহিনী নিয়ে। এমত অবস্থায় বেগম সাহেবার আগমন সংবাদের সত্যতা যাচাই করার সময় নেই। এত স্বল্প সময়ে আপনি বরং একটি পত্র লিখুন বেগমকে। তাকে নিষেধ করুন তিনি যেন যুদ্ধক্ষেত্রে না আসেন।
মুসাফিরের ক্রোধ প্রতিহত হলো। ধীর মস্তিষ্কে ভেবে বললেন, সংবাদবাহককে ডেকে পাঠাও প্যাট্রিক। আমি পত্র লিখে দিচ্ছি। রুকসানার এ রণক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়া চলবে না। এ আমার নির্দেশ। রুদ্রনগরের বাদশাহ মুসাফিরের নির্দেশ।
চিঠি প্রস্তুত হলো, খাম বন্ধ হলো। মুসাফিরের নিজস্ব সীলমোহর বসানো হলো খামে। বন্ধমুখ খাম সংবাদবাহকের হাতে দিয়ে প্যাট্রিক বললেন, হারেমের অন্দরে পৌঁছে দিতে হবে এ পত্র। সূর্যোদয়ের আগেই। তেজী আরবি ঘোড়ায় চেপে রওনা দিলো পত্রবাহক।