মধুবালার সমর্পণ
চিত্তহরণ যখন শশাঙ্ক নারায়ণ রায়চৌধুরীর জমিদার বাড়ি থেকে নিজের গৃহে ফিরে এলেন মধুবালা তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো। ওঁকে দেখেই চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে সোজা হয়ে বসলো। জমিদার বাড়ি থেকে আনা শাড়িখানির ওপরে মধুবালার ভারী লোভ। জমিদার গিন্নির বড় প্রশস্ত মন। বারো হাত চওড়া পাড়ের শাড়ি দেন। রংখানাও থাকে চমৎকার। বাবার থলি থেকে চাল, ফলের সঙ্গেই বেরিয়ে এলো একটা রক্তজবা রঙের শাড়ি। আঁচলে দুটো ছুটন্ত ঘোড়া। ঘোড়া দুটোর দিকে তাকিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো মধুবালা। ঠিক যেন বৈকালে নয়না নদীর তীরে তার দেখা ওই ঘোড়া দুটোর মত। মনের পথে উঁকি দিলো বিদেশি ওই চিকিৎসকের মুখ। যে ফিরে যাওয়ার সময় কথা দিয়েছিলেন আবার আসবেন। আজ থেকেই যেন পথ চেয়ে বসে আছে মধুবালা। ঠিক যেমন তার স্বপ্নে এক বিদেশি রাজপুত্র এসে দাঁড়ায় তেমনই। ওইরকম নীল চোখ যেন এক সমুদ্র ঢেউ।
কারণবিহীন লজ্জায় আরক্ত হলো মধুবালা। নীলকণ্ঠের কাছে কৈফিয়ৎ চাইবে, কেন এমন স্বপ্ন দেখে ও। আর কেনই বা স্বপ্নের ওই মানুষটাকে আজকে ওর সম্মুখে পাঠালেন স্বয়ং নীলকণ্ঠ!
চিত্তহরণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, মধুমা, তোমার সহিত আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। রাতের আহার সমাপ্ত হলে আমরা সে আলোচনায় বসবো।
বুকের ভিতরটা কেঁদে উঠলো চিত্তহরণের। এমন মোমপুতুলিকে প্রাণে ধরে কি করে অর্পণ করবেন জন্ম থেকেই বাকহারা ওই ছেলের হাতে! শশাঙ্ক নারায়ণের গৃহে মধুবালা হয়তো রাজেন্দ্রাণীর মতই বসবাস করবে। কিন্তু স্বামী সুখে বঞ্চিত হবে সে। নিজের অন্তরের গোপন ব্যথা কার কাছে প্রকাশ করবে মধুবালা? শশাঙ্ক নারায়ণের কনিষ্ঠ পুত্র যে কোনোদিন মনের ভাবই প্রকাশ করতে পারবে না মধুবালার কাছে।
চিত্তহরণের মত জমিদারের দেবোত্তর সম্পত্তিতে বাস করে প্রতিবাদ করা চলে না জমিদারের বিরুদ্ধে। তাছাড়া সহায়সম্বলহীন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার পছন্দ-অপছন্দের ভেদাভেদ হতে নেই।
যৎসামান্য আহার সারলেন চিত্তহরণ। মনকে প্রস্তুত করলেন। মধুবালা শশাঙ্ক নারায়ণের কনিষ্ঠ পুত্রকে বিলক্ষণ চেনে। প্রতি বছর নীলকণ্ঠের মন্দিরে গাজন উৎসবের সময়ে সে দণ্ডী কাটে। তার জিভে চরণামৃত দেওয়া হয়। তারপর শশাঙ্ক নারায়ণের নির্দেশে গলার মধ্যে আঙুল প্রবেশ করিয়ে তাকে দিয়ে গোঙানির স্বরে জোর করে বাবা ডাকানো হয়। একবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো সুশান্ত। এক ফিরিঙ্গি হাকিম এসে সে যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছিলো তাকে। তাই সুশান্ত সম্পর্কে মধুবালাকে নতুন করে পরিচিত করানোর অবকাশ নেই চিত্তহরণের।
চিত্তহরণ পুলকিত মুখে বললেন, মধুমা রায়চৌধুরী বাড়ির কাপড়খানা তোমার পছন্দ হয়েছে?
মধুবালা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো, হ্যাঁ, খুব পছন্দ হয়েছে। চিত্তহরণ দীর্ঘশ্বাস গোপন করে হাসি মুখে বললেন, তুমি ভাগ্যবতী মা। তুমি পরম ভাগ্যবতী। জমিদার শশাঙ্ক নারায়ণ স্বয়ং তোমায় নির্বাচন করেছেন তার পুত্রবধূ রূপে। তুমি খুব শীঘ্রই জমিদার গিন্নি হয়ে এ বিষপুরের মস্তকে থাকবে।
মধুবালা বিস্মিত নেত্রে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো পিতার দিকে। তারপর ধীরে কণ্ঠে বললো, উনি কি আমায় ওনার কনিষ্ঠ পুত্রবধূ রূপে বরণ করতে চান?
চিত্তহরণ ইতস্তত করে বললেন, সুশান্ত বড় শান্ত প্রকৃতির ছেলে। ভদ্র, সুসভ্য, চমৎকার তার ব্যবহার।
মধুবালা আকস্মিক চমকে উঠে বললো, কিন্তু তিনি তো বোবা। মুখে যে তাঁর ভাষা নেই। তিনি আমার সাথে কথা বলবেন কি করে বাবা?
চিত্তহরণ কন্যার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের অবাধ্য অশ্রুকণাকে সম্বরণ করে বললেন, ইশারায় সে সব কথা বলতে পারে মধুমা।
মধুবালা আর বাক্যব্যয় না করে নিজের ঘরে প্রবেশ করলো ধীরে ধীরে।
মধুবালার চলে যাওয়ার ছন্দেই পরিষ্কার হলো এ সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। পিতার মান রাখতে হয়তো বিবাহমণ্ডপে বসবে ও কিন্তু সেই চিন্ময়ী প্রতিমা প্রাণবিহীন হবে।
নিরুপায় চিত্তহরণ। শশাঙ্ক নারায়ণের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে যে বিষপুরও তাঁকে পরিত্যাগ করতে হবে। অগত্যা সুশান্ত নারায়ণের ঘরণী হবে মধুবালা, এ স্বয়ং নীলকণ্ঠের নির্ধারিত। নীলকণ্ঠের কোলেই মানুষ হয়েছে মধুবালা। স্ত্রী বিয়োগের পরে যজমান বাড়িতে পৌরহিত্য করতে যাবার পূর্বে পিতার ধুতির একপ্রান্ত আকর্ষণ করে মধুবালা বলতো, আমার ভয় করছে বাবা। চিত্তহরণ নিশ্চিন্তে মেয়েকে নীলকণ্ঠের জিম্মায় রেখে বেরিয়ে যেতেন। তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল মধুবালার কোনো বিপদ নীলকণ্ঠ হতে দেবেন না। কবে থেকে যেন সাজি ভরে নীলকণ্ঠের জন্য পুষ্পচয়ন করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলো। এমনকি রক্তকরবীর মালাটা ও গেঁথে দিতো নিজের হাতে। নীলকণ্ঠকে সাজানো, তার সম্মুখে সংগীত পরিবেশন করা এসবকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে শৈশবকে অতিক্রম করে যৌবনে পা রেখেছিলো মধুবালা। নীলকণ্ঠই তার ইষ্টদেবতা হয়ে গিয়েছিলেন।
চিত্তহরণও কন্যার বিবাহ নিয়ে উদগ্রীব হননি। ভেবেছিলেন বিষপুরের যে নীলকণ্ঠের দুয়ারে সবাই জীবনের বিচার চাইতে আসেন সেই নীলকণ্ঠই মধুবালার ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। তাই কন্যার বিবাহ প্রসঙ্গে তাকে উতলা হতে কেউ দেখেনি। কিন্তু আজ তিনি বড়ই চঞ্চল। মধুবালার স্বহস্তে গোছানো নিপুণ বিছানাতে শুয়েও নিদ্রা ধরা দিলো না।
চিত্তহরণ বাড়ির দরজা খুলে নিস্তব্ধে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে বেরোতেই নয়না নদীর শীতল বাতাস তার শরীরের উত্তেজনা প্রশমিত করলো। নয়নার তীরে বসে রইলেন আনমনে। মধুবালার শৈশবে ডুব দিলেন।
একটু দূরেই সেনাদের ছাউনিতে মশাল জ্বলছে। বল্লভপুরের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চলেছে রুদ্রনগরের বাদশাহ। বিষপুর রুদ্রনগরের অধীনে। তাই বিষপুরের অনেক মানুষই চান রুদ্রনগরের জয় হোক। চিত্তহরণ চান এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ হোক। সাম্রাজ্য দখলের লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের জীবন আজ বিপন্ন। বিষপুরের বাজারে সব খাদ্যদ্রব্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্য সংগ্রহের কারণেই এই মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে।
.
কখন যে ভাবনার অতল গহ্বরে প্রবেশ করেছিলেন চিত্তহরণ মনে নেই। আচমকা ঘোড়ার খুরের আওয়াজ কানের খুব কাছে বাজতে চমক ভাঙলো। সেনাবাহিনী বল্লভপুরের দিকে এগোতে শুরু করেছে। পূবাকাশ কখন যে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে তা খেয়াল করেননি চিত্তহরণ।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই গাছ কেটে প্রশস্ত পথ নির্মিত হয়েছে। সেই পথ দিয়েই চলেছে যুদ্ধবাহিনী। হাতির পিঠের হাওদাতে রয়েছে তাঁবু, খাদ্য, অস্ত্র। আর পদাতিক বাহিনী চলেছে সম্মুখে। পিছনে ঘোড়সওয়ারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
নিজের দৃষ্টির ওপরে চিত্তহরণের বিশ্বাস অবিচল এখনও পর্যন্ত। ভুল তিনি দেখতে পারেন না বলেই তার অটুট বিশ্বাস। অথচ এই মুহূর্তের তিনি দেখলেন একজন ঘোড়াসওয়ার দলছুট হয়ে তীব্র বেগে এদিকেই যেন ছুটে আসছে। চমকিত হয়েই একটা বড় গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেললেন চিত্তহরণ। নেহাত বিশ্বাস নেই, ব্রাহ্মণের হাতে তলোয়ার ধরিয়ে হয়তো নির্দেশ জারি করা হবে, যুদ্ধে যেতে হবে। চিত্তহরণ শুনেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য অপ্রতুল হলে গ্রামের নিরীহ চাষীদের হাতে পর্যন্ত তলোয়ার ধরিয়ে দেয় ওরা। এই বয়সে হাতে রক্ত মাখার ইচ্ছে একেবারেই নেই চিত্তহরণের। সৈন্যবাহিনী চলে গেলে তবেই তিনি বাড়ির পথ ধরবেন এই চিন্তা করেই গাছের গুঁড়ির পিছনে বসে পড়লেন।
দূর থেকেই লক্ষ্য করছিলেন চিত্তহরণ। ওই অশ্বারোহী সৈনিকের প্রস্থানের অপেক্ষায় রইলেন তবে হঠাৎই মনে হলো ওই দলছুট সৈনিক ওঁর গৃহের অভিমুখেই গেলো। সদ্য পূব আকাশ আবির রং ধারণ করেছে। গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে আবছা অন্ধকার তখনও ঘিরে রয়েছে বিষপুরের মাটিকে। তাই স্পষ্ট দেখতে পেলেন না চিত্তহরণ।
.
ভোর ভোর ঘুম থেকে ওঠা চিরকালের অভ্যেস। নয়না নদীতে স্নান করে ভিজে কাপড়ে নীলকণ্ঠের গর্ভগৃহ ধোয়া মধুবালার নিত্যদিনের প্রথম কাজ। আজও তার ব্যতিক্রম হবে না। পিতা তাকে একজন মূক পাত্রের সঙ্গে জীবন কাটানোর আদেশ দিয়ে দিয়েছেন। দীর্ঘরাত্রি নির্ঘুম কাটিয়েছে মধুবালা। ক্ষণে ক্ষণে দু-চোখ প্লাবিত হয়েছে অশ্রু বিন্দুতে।
তবুও নীলকণ্ঠের দুয়ারে বিশ্রাম নেই। নেই কর্তব্য ফাঁকি দেওয়ার কোনো রীতি। নীলকণ্ঠ নিষ্ঠুরের মত অপেক্ষা করে আছেন রাজকীয় পুজো পাবার আশায়। আজ মধুবালা নীলকণ্ঠকে কৈফিয়ৎ চাইবে কেন তিনি ওর ভাগ্যরেখাতে এমন একজনের নাম লিখে দিলেন যে কোনোদিন মধুবালা শব্দটাই উচ্চারণ করতে পারবে না। বাবা ছোট থেকেই বলতো, নীলকণ্ঠ নাকি ওর আরেক পিতা। জন্মদাতা নয় রক্ষাকর্তা। বিষপুরের জাগ্রত নীলকণ্ঠের মন্দিরে প্রত্যহ দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা এসে জমায়েত হন। তাদের সকলের মনোস্কামনা পূর্ণ করেন স্বয়ং নীলকণ্ঠ। আর নিত্যদিন তাঁর যে পরিচর্যা করে তার কোনো খেয়াল রাখলেন না তিনি। অভিমানে বুজে এলো মধুবালার গলা।
পিতলের ঘড়া নিয়ে নয়না নদীর উদ্দেশ্যে দুয়ার অতিক্রম করলো। সামনেই যুদ্ধের বেশে দাঁড়িয়ে আছেন এক সৈনিক। মাথায় বর্ম, কোমরে তলোয়ার, পরণে যুদ্ধের বেশ। আচমকা ভীত হয়ে পড়লো মধুবালা। দুয়ারের সম্মুখে এই প্রাতঃকালে সশস্ত্র সৈন্যের উপস্থিতি তার মনে স্বাভাবিকভাবেই ভয়ের সঞ্চার করেছে। মধুবালা ভীত স্বরে বললো, কে আপনি রাজন? কি আমার অপরাধ?
সৈনিক ঘোড়া থেকে মাটিতে লাফিয়ে নামলো। মাথা থেকে লৌহের শিরস্থান খুলে বললো, অপরাধ আপনার অনেক অপরূপা। আপনি যে বিদেশির ক্ষুধানিদ্রা কেড়েছেন। এ চিকিৎসক এখন নিজেই একজন রোগী। কিন্তু এ রোগের ঔষধ আমার কাছে নেই মধুবালা। আপনি আমায় এ অসুখের ঔষধ প্রদান করুন, সুস্থ করে তুলুন আমায়। বল্লভপুরের যুদ্ধক্ষেত্রে চলেছি। যুদ্ধক্ষেত্র প্রাণ দেবো কিনা জানি না, তবে একটা কথা বলতে এলাম, এ নারীতে আমি নিজেকে হারিয়েছি। নিজেকে উদ্ধারের উপায় কি মধুবালা? আপনার কি জানা আছে?
সেই স্বপ্নে দেখা নীল চোখ। সেই সোনালী চুলের দীর্ঘদেহী বিদেশি মানুষটা দাঁড়িয়ে আছেন সামনে।
মধুবালার মনটা গতকাল রাত থেকেই উথালপাতাল। তাই আবেগ প্রশমিত করতে না পেরেই ও বললো, ভিনদেশী রাজপুত্রকে একটা বিশেষ সংবাদ দিতে চাই। আপনি যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিতে চলেছেন আমিও তেমন অপছন্দের জীবনসঙ্গীকে সঙ্গী করে জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে চলেছি। প্রতিমুহূর্তে জীবনটাকে ক্ষয় হতে দেখবো।
প্যাট্রিক না বুঝেই জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছ মধুবালা?
আপনি সম্বোধনে আর মধুবালাকে ডাকা সম্ভব হলো না।
মধুবালার দু-চোখে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। ভগ্ন কণ্ঠে বললো, আমার বিবাহ নির্ধারণ করেছেন আমার পিতা। বিষপুরের জমিদার শশাঙ্ক নারায়ণ রায়চৌধুরীর কনিষ্ঠ সন্তানের সহিত। এ বিবাহ স্থগিত করার ক্ষমতা সম্বলহীন ব্রাহ্মণের নেই।
প্যাট্রিক স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে বললেন, শশাঙ্ক নারায়ণের কনিষ্ঠ পুত্রের চিকিৎসা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল এই নীলকণ্ঠের মন্দিরেই। উনি জন্ম মূক, বাকশক্তিহীন একজন মানুষ। হয়তো মানুষ হিসাবে অত্যন্ত সজ্জন। কিন্তু মধুবালা সে যে তোমার সঙ্গে কখনও বাক্যালাপ করতে পারবে না। কখনও বলতে পারবে না তোমার ওই চোখ নয়নার জোয়ারের ঢেউকেও হার মানায়।
মধুবালা ঈষৎ বিস্মিত হয়ে বললো, আপনি তাকে বিলক্ষণ চেনেন দেখছি। তার মানে গাজনের মেলাতে সে যখন এই মন্দিরে জ্ঞান হারিয়েছিলো তখন এক ফিরিঙ্গি হাকিম তাকে প্রাণদান করেছিলো বলেই শুনেছিলাম পিতার কাছে। সে হাকিম তবে আপনি?
প্যাট্রিক মাথাটা নিচু করে ডান হাতটা বুকে ঠেকিয়ে বললেন, তখন কেন তোমার দর্শন পাইনি জানি না।
মধুবালা এ বিবাহে তুমি রাজি হয়ো না। আমি তোমাকে ভিক্ষে করে আনবো শশাঙ্ক নারায়ণের পুত্রের কাছ থেকে।
মধুবালা হাসিতে শ্লেষ মিশিয়ে বললো, তারপর? আমায় ঘোড়ায় চাপিয়ে নিয়ে যাবেন রুদ্রনগরের বাদশাহের দরবারে? কাঞ্চনী হয়ে সেখানে আমি নৃত্য পরিবেশন করবো? এই কি আপনার অন্তরের ইচ্ছে? প্যাট্রিক কুঞ্চিত হয়ে বললেন, কখনোই নয়। সে সত্যি হতে পারে না। তুমি কাঞ্চনী হতে পারো না। তোমার গলার সুর, তোমার পায়ের ছন্দে শুধু আমার অধিকার।
মধুবালা শিহরিত হলো। থমকে গেলো। তারপরেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললো, কিন্তু আমি যে অন্যের বাগদত্তা। মধুবালার হাতটা নিজের হাতের মাঝে টেনে নিলেন প্যাট্রিক। পিতলের ঘড়া মাটিতে পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলে নিজের পতনের প্রতিবাদ জানালো। মধুবালার হাতটা থরথর করে কাঁপছে।
প্যাট্রিক বললেন, যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সময় আমায় দাও মধুবালা। আমি ফিরেই তোমায় আমার গৃহে নিয়ে যাবো। মধুবালা বিশ্বাস করলো। দু-চোখে জল ভরে এলো। মধুবালা তো এটাই চেয়েছিলো অন্তর থেকে, এমন একজন পুরুষ আসুক তার জীবনে যার প্রেমিকা হয়ে বাঁচবে ও। যার ঘরণী হয়ে বাঁচবে ও। যার সঙ্গে সহমরণে বলি দেবে নিজের এই তুচ্ছ প্রাণটুকু। সুশান্ত সে মানুষ নয়। তার অন্তরাত্মা বিদ্রোহী হয়ে জানিয়েছে সুশান্ত নারায়ণ সে মানুষ নয়।
প্যাট্রিক নিজের শিরস্থান পুনরায় পরিধান করলেন। নিজের কনিষ্ঠা থেকে একটা রক্তবর্ণ রুবির অঙ্গুরীয় খুলে মধুবালার অনামিকায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, এই মুহূর্ত থেকে তোমার ওপরে শুধু আমার অধিকার জন্মালো। ওই পূবের উদীয়মান সূর্যকে সাক্ষী মানলাম। ঘোড়ায় চেপে আবার ওই পথেই চলে গেলেন প্যাট্রিক। পিছনেই আসছে রুদ্রনগরের যুদ্ধবাহিনী। ওই দলে মিশে যেতে হবে। সুজান খান বা বাদশাহ মুসাফিরের নজর এড়িয়ে মিশতে হবে। কারোর যেন কোনো সন্দেহের অবকাশ তৈরি না হয়। মুসাফিরের বলা কথাটা কানে ভাসছে প্যাট্রিকের। এই নারীকে আমি রুদ্রনগরের কাঞ্চনী রূপে দেখতে চাই প্যাট্রিক। তোমাকেই পৌঁছে দিতে হবে একে আমার মহলে।
প্যাট্রিক উপলব্ধি করলেন, মধুবালাকে তিনি ভালোবাসেন। অন্তর দিয়ে ভালোবাসেন। মধুবালারও তাঁকে গ্রহণ করতে কোনো সমস্যা নেই। বরং সে চায় তার স্বপ্নে দেখা বিদেশি আসুক তার জীবনে মহাসমারোহে।
সৈন্যদলে মিশে গেলেন প্যাট্রিক। কোনো বিরতি নেই, সোজা বল্লভপুর আক্রমণ করবে রুদ্রনগর। বল্লভরাজকে হত্যা করাই এ যুদ্ধের একমাত্র লক্ষ্য। বাদশাহ মিজানুরের আকস্মিক হত্যার প্রতিবাদ। বল্লভপুর রাজ্যকে নিজের রাজ্যের সীমারেখার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিলো না। তবে সব যুদ্ধের উদ্দেশ্যই যুদ্ধ শেষে বদলে যেতে পারে। তাই যদি রুদ্রনগরের জয় হয়, তবে বল্লভপুর রুদ্রনগরের অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য থাকবে বলেই ঘোষণা করেছেন বাদশাহ মুসাফির।
সুজান খান এগিয়ে চলেছেন বীরদর্পে।
বল্লভপুরের সীমানায় আসতেই ঝাঁক ঝাঁক তীর হাওয়ার বেগে ছুটে এলো রুদ্রনগরের সৈন্যবাহিনীর দিকে। কামানে গোলা ভরা হলো, কামানের বারুদে ছত্রভঙ্গ হলো তীরন্দাজ বাহিনী।
এগিয়ে চললো রুদ্রনগরের সেনাবাহিনী। বল্লভপুর ছোট রাজ্য। রুদ্রনগরের সুশিক্ষিত সৈনিকদের সম্মুখে দাঁড়াবার ক্ষমতা তাদের নেই। তাই তারা যে স্বচ্ছ যুদ্ধপদ্ধতি গ্রহণ করবে না এমন ধারণা সুজান খানের আছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কয়েক গজ দূরে তাঁবু খাটানো হলো। পদাতিকবাহিনী পৌঁছে গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে। তার পশ্চাতেই আছে অশ্ববাহিনী।
.
মুসাফিরের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ সুস্পষ্ট। প্যাট্রিক তাঁবুতে বসে আছেন বাদশাহ মুসাফিরের সামনেই।
মুসাফির বললেন, প্যাট্রিক এ ছদ্মবেশ কি আমায় ধারণ করতেই হতো?
প্যাট্রিক বললেন, হুজুর, পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা আছে বলেই এ ছদ্মবেশ আপনার প্রয়োজন। বল্লভরাজ শঠতার আশ্রয় নিয়েই হত্যা করেছিলেন বাদশাহ মিজানুরকে। এবারেও তার উদ্দেশ্য হবে রুদ্রনগরের সিংহাসনকে অভিভাবক শূন্য করে দিশেহারা করে দেওয়া।
মুসাফির নিজের সফেদ গোঁফে হাত বুলিয়ে বললেন, এই শয্যাশায়ী বৃদ্ধ যুদ্ধপ্রাঙ্গণে কি করছে এই সন্দেহও তো দানা বাঁধতে পারে অপরপক্ষের মনে। মুসাফির এই মুহূর্তে এক আশি বৎসরের বৃদ্ধের সজ্জায় সজ্জিত। দেখে বোঝার উপায় নেই সে একজন যুবা পুরুষ।
প্যাট্রিকের কাছে খবর এলো তিনজন সৈন্য গুরুতর অসুস্থ। প্যাট্রিক তার চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়ে এগিয়ে চললেন সৈন্যদের ছাউনির দিকে।
.
মুসাফির কোন তাঁবুতে আছেন তা রুদ্রনগরের সৈন্যরাও জানে না। তাই বাইরে কোনো দেহরক্ষীর দেখা পেলো না প্যাট্রিক। মুসাফির তার মানে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। তাঁবুতে প্যাট্রিক আর মুসাফির দুজনে এতক্ষণ উপস্থিত ছিলেন। এখন মুসাফির একা। এভাবে বল্লভপুর প্রান্তে বাদশাহকে একা তাঁবুতে রাখাটা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। বাদশাহ ছদ্মবেশ ধারণ করেছেন ঠিকই কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে অতর্কিত আক্রমণ হতেই পারে।
তিনজন সৈন্যের শুশ্রূসা করে তাদের ঔষধ প্রদান করেই প্যাট্রিক তাড়াতাড়ি ঘোড়া চালনা করলেন বাদশাহের তাঁবুর দিকে।
তাঁবুর সামনে পৌঁছেই বুঝতে পারলেন বড় কোনো গোলযোগ উপস্থিত হয়েছে। প্যাট্রিক খবর পেয়েছেন রুদ্রনগরের সৈনিকরা বল্লভপুরের প্রাসাদের দিকে এগিয়ে চলেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে বল্লভরাজের সৈন্যবাহিনী নির্মমভাবে পরাজিত হচ্ছে রুদ্রনগরের কাছে। এমতাবস্থায় মুসাফিরের তাঁবুর সম্মুখে ভিড় দেখে চমকে উঠেছেন প্যাট্রিক। দ্রুত ঘোড়া থেকে অবতরণ করে ছুটলেন তাঁবুর প্রান্তে।
.
তাঁবুর সামনে একজন দীর্ঘদেহী পুরুষের দ্বিখণ্ডিত মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। তাকে ঘিরেই কোলাহল করছে রুদ্রনগরের সৈনিকরা। এই অপরিচিত ব্যক্তিটি কে সেই নিয়েই চলছে জল্পনা।
সুজান খান যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছেন। সেনাপতিও উপস্থিত নেই। সকলের মনে একটাই প্রশ্ন এ ব্যক্তিটি কি কারণে প্রবেশ করেছিল রুদ্রনগরের সেনা ছাউনিতে? আর একে হত্যাই বা কে করলো?
চিন্তিতভাবেই মুসাফিরের তাঁবুতে প্রবেশ করলেন প্যাট্রিক। একমাত্র তাঁরই অবাধ প্রবেশ হুজুরের দরবারে। মুসাফির একমুখ সাদা দাড়ির জঙ্গল সরিয়ে বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলে প্যাট্রিক। এদিকে তো হুলুস্থুল হয়ে গেলো।
প্যাট্রিক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বললেন, আপনাকে কি কেউ অতর্কিতে আক্রমণ করতে এসেছিল হুজুর?
মুসাফির চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, এই ছদ্মবেশের অভ্যন্তরে যে রুদ্রনগরের বাদশাহ আত্মগোপন করেছে এ কথা ওই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিটি কিভাবে জানলো? আমি তাঁবুতে বসেছিলাম। প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদ চর্চার একটি নিদর্শন এসে পৌঁছেছে আমার কাছে। ওই পুঁথিটিই মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করছিলাম। আচমকা আমার সম্মুখে দেখলাম ওই মৃত ব্যক্তি ও আরেকজন ব্যক্তির সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে। বিস্মিত আমি অপলক তাকিয়ে দেখলাম, একজন ব্যক্তি অতর্কিতে তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওই মৃত ব্যক্তির ওপরে। মৃত ব্যক্তির হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেলো উদ্ধত তলোয়ার। আমার অচেনা দেহরক্ষী ওকে দ্বিখণ্ডিত করে টেনে ফেলে দিলো বাইরে। আমার সামনে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল। আমি এখনও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আছি প্যাট্রিক। কে ওই রক্ষাকর্তা? সে কেন আমার প্রাণ রক্ষা করতে উপস্থিত হয়েছিল? কেন সে কোনো পুরস্কার দাবি না করেই হারিয়ে গেলো? কে ওই মানুষটি? যে নিজের প্রাণের বাজি রেখে আমায় রক্ষা করল, সে কে প্যাট্রিক? আমার রুদ্রনগরের সেনাবাহিনীর কেউ? নাকি অপরিচিত কেউ? সংবাদ চাই প্যাট্রিক। আর এ সংবাদ কিভাবে পৌঁছালো বল্লভপুরে যে আমি ছদ্মবেশে আছি। এ তো শুধু তিনজন জানে। সুজান খান, তুমি আর রুকসানা। এ পরিকল্পনা অবশ্য রুকসানার। সেই আমাকে বলেছিলো, আমি যেন ছদ্মবেশে উপস্থিত থাকি যুদ্ধক্ষেত্রে।
.
প্যাট্রিকের দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুসাফির বললেন, তোমাকে অবিশ্বাস করতে সায় দিচ্ছে না। সুজান খানকে অবিশ্বাস করলে এ যুদ্ধ ভিত্তিহীন। সুজান ছিল আমার পিতার বফাদার। রুদ্রনগরের বর্তমান মন্ত্রী। তার ওপরে রুদ্রনগরের সিংহাসন অনেকাংশে নির্ভরশীল। রুকসানা বেগম প্রাণ থাকতে এ কথা আর কাউকে বলবে না। তাহলে আমার সন্দেহ কোন দিকে ধাবিত করবো প্যাট্রিক?
প্যাট্রিক একটু অভিমানী গলায় বললেন, হুজুরের আঙুল কি আমার দিকে নির্দেশ করছে? আমার আপত্তি নেই। প্রাণদণ্ড মঞ্জুর হোক।
মুসাফির বললেন, প্যাট্রিক এ কি রহস্য করার সময়! আমি চিন্তিত। যতক্ষণ না গোপন শত্রুকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত রুদ্রনগর সুরক্ষিত নয়।
তাঁবুর সামনে আবারও হইহট্টগোল শুনে বাইরে বেরিয়ে এলেন প্যাট্রিক। সঙ্গে মুসাফির তাঁর ছদ্মবেশ সামলে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালেন।
সুজান খান ফিরেছেন যুদ্ধ থেকে। বল্লভপুরের প্রাসাদ দখল করে বীরবিক্রমে ফিরেছেন। সঙ্গে বল্লভরাজকে বন্দি করেও এনেছেন।
উল্লাস চলছে সৈন্য শিবিরে।
এদিকে রক্ষী একজন সৈনিককে আটক করেছে। এর সন্দেহজনক উপস্থিতির জন্যই রক্ষী আটক করেছে। সুজান খান নির্দেশ দিলেন, তল্লাশি করা হোক। বাদশাহ স্বয়ং বললেন, শান্ত হও। এই সৈনিকই আমার জীবন রক্ষা করেছে আজ। প্রাণদণ্ড এর শাস্তি নয়।
সেই মুহূর্তেই সৈনিক নিজের পোশাকের ভিতর থেকে বের করে আনলো বেগমমহলের সীলমোহর।
সুজান খান মাথা নিচু করে সম্মান জানালেন।
প্যাট্রিক দেখলেন ছদ্মবেশী রুকসানা বেগম দৃঢ় পদক্ষেপে প্রবেশ করলেন বাদশাহের তাঁবুতে।
বাদশাহ স্থবিরের মত দাঁড়িয়ে বললেন, বেগম তুমি? আমি পত্র পাঠিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তোমায় অনুপস্থিত থাকতে বলেছিলাম। রুকসানা একটানে খুলে ফেললেন নকল দাড়ি গোঁফ। বললেন, ক্ষমা করবেন হুজুর। আপনি শুধু রুদ্রনগরের বাদশাহ নন। আমার আমানত। তাই তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।
মুসাফির বয়স্কব্যক্তির পোশাক পরিত্যাগ করে বললেন, কিন্তু তুমি চিনলে কি করে আমায়? আর ওই গোপন শত্রুটি কে?
রুকসানা বললেন, বাদশাহ ও এখন বল্লভপুরের গুপ্তচর। নাম রাজ্জাক আলী। আগে আমাদের রুদ্রনগরের বফাদার সৈনিক ছিল। সেনাপতি হবার গোপনবাসনা থেকেই ওর মধ্যে লোভের জন্ম নেয়। রুদ্রনগরের সেনাবাহিনী ওকে বহিষ্কার করে। সেই থেকেই ও বন্ধুত্ব জমিয়েছে বল্লভপুরের সঙ্গে। যেহেতু রুদ্রনগরের নাড়িনক্ষত্র জানে তাই বল্লভরাজ ওকে গুপ্তচরের পদে আসীন করেছে। অসিচালনায় রাজ্জাক যথেষ্ট পারদর্শী। তাই আপনাকে হত্যা করতে এসেছিলো ও। আমি যেমন আপনার কনিষ্ঠার গাঢ় সবুজ বিরল সিংহলী পান্নাটা দেখে আপনাকে সনাক্ত করতে পেরেছি, রাজ্জাকও বহুদিন রুদ্রনগরে থাকার ফলে সম্ভবত ঐটা দেখেই শনাক্ত করেছে আপনাকে।
মুসাফির বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন, বেগম আমার ওপরে এমন আক্রমণ আসতে পারে জেনেও তুমি আমায় যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছিলে? আবার আমায় রক্ষা করতেও যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছো, এ কাজের কি বিচার হয় বেগম! আর রুদ্রনগরের হারেমের নিয়মভঙ্গের শাস্তিই বা কি হবে?
রুকসানা নির্ভীক চিত্তে বললেন, বাদশাহ আপনি রুদ্রনগরের রক্ষাকর্তা। যে বল্লভপুর পূর্বে রুদ্রনগরের ক্ষতিসাধন করেছে, তাকে দমন করা আপনার কর্তব্য। আপনিই আপনার প্রজাদের আল্লাহ। তাই আপনাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়েছিলাম। আপনি উপস্থিত থাকলে সমগ্র সেনাবাহিনী উজ্জীবিত হবে। আপনার ওপরে প্রাণঘাতী আক্রমণ হতে পারে এই আশঙ্কা থেকেই গতকাল থেকে আমি ছদ্মবেশে আপনাকে অনুসরণ করে চলেছি।
আর হারেমের নিয়মশৃঙ্খলা লঙ্ঘন করার শাস্তিস্বরূপ আপনি নিজে হাতে আমায় হত্যা করুন। আপনার তলোয়ার স্নান করুক রুদ্রনগরের ছোটি বেগমের রুধির ধারায়।
মুসাফির রুকসানাকে আলিঙ্গন করে বললেন, রুদ্রনগরের বাদশাহ অভিযুক্তকে এক অভিনব শাস্তি দিতে প্রস্তুত। অভিযুক্ত কি সে শাস্তি মস্তকে ধারণ করতে প্রস্তুত?
রুকসানা অভিমানী স্বরে বললেন, বেগম তার প্রাণ বাজি রাখতে প্রস্তুত প্রাণাধিকের প্রাণরক্ষার কারণে।
মুসাফির বললেন, তবে আজ থেকে রুদ্রনগরের হারেমের সব ভার তোমার রুকসানা। তুমি তাদের উন্মুক্ত করতে পারো, চালনা করতে পারো। আজ থেকে হারেমের মুক্ত বেগম তুমি।
রুকসানা আপ্লুত হয়ে দেখছিলেন বাদশাহকে। এমন নিয়মভঙ্গ হয়তো রুদ্রনগরের প্রজারা মেনে নেবে না প্রথমে। কিন্তু বাদশাহের অনুমতি থাকলে ইতিহাস রুকসানা বেগমকে মনে রাখবে আজীবন। হারেমের অন্ধকারময় জীবনে এই প্রথম কোনো আলোকবর্তিকা প্রবেশ করাতে পারবেন রুকসানা। এ নজীরবিহীন ঘটনা বোধহয় এই প্রথম।
রুকসানা বাদশাহকে আলিঙ্গন করে বললেন, আর আমাদের জাহাজ মহল? সেটা কবে হবে বাদশাহ?
মুসাফির বললেন, এবারে হবে। কুয়ামু পর্বতের মাথায় জাহাজের আকারে সে মহল আমি গড়ে দেবো তোমায় রুকসানা।
রুকসানা বললেন, আমি ওখানে দাঁড়িয়ে চাঁদ ধরবো নিজের মুঠোয়।
.
তাঁবুর বাইরে সুজান খান অপেক্ষারত। নিজেকে রুকসানার বাহুডোর থেকে উন্মুক্ত করে বাইরে বেরিয়ে এলেন মুসাফির। বল্লভরাজ বন্দি হয়েছে রুদ্রনগরের সেনাপতির হাতে। তাকে এই মুহূর্তে হত্যা করে পিতৃঋণ পরিশোধ করতে পারেন মুসাফির। পিতার হত্যাকারী এখন তাদের দখলে। মুসাফির রক্ত ঝরানোর শাসনব্যবস্থা চান না। তাই নির্দেশ দিলেন বল্লভপুরের বাদশাহকে বন্দি করে রাখা হোক রুদ্রনগরের কারাগারে। রুকসানা তাঁবুর ভিতরে বসেই শুনলেন বাদশাহের নির্দেশ। বুঝলেন মুসাফিরের মধ্যে কবির ভাগ বেশি, বাদশাহের ভাগ কম। তাই তিনি নৃশংস খুনি হতে পারেন না। নতুন নিয়ম কায়েম হোক রুদ্রনগরের শাসনব্যবস্থায়। হারেমে প্রবেশ করুক মুক্ত বাতাস। রাজ্যের মানুষের মুখে ঘুরুক রুকসানা আর মুসাফিরের প্রেমকাহিনী।
মুসাফিরের নির্দেশে হাতির মাথায় রাজকীয় হাওদা বাঁধা হলো, তাতে করেই রাজ্যে ফিরবেন ছোটি বেগম। ইতিমধ্যেই তাঁর বীরত্বের কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে বল্লভপুর সীমান্ত পেরিয়ে বিষপুর থেকে রুদ্রনগরের পথে। এমনকি ধবলগড়েতেও পৌঁছে গেছে তাদের কন্যার বীরত্বের কাহিনী।
বল্লভপুর জয় করে সদর্পে এগিয়ে চলেছে সেনাবাহিনী। প্যাট্রিকের মন উচাটন। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেলো এই যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে আছেন। মধুবালাকে কথা দিয়েছিলেন ফেরার পথে সাক্ষাৎ করবেন। মধুবালা হয়তো পথ চেয়ে বসে আছে। প্যাট্রিকের দ্রুত অশ্বচালনা লক্ষ্য করেই বাদশাহ মুসাফির বললেন, হাকিম আজ বড়ই উতলা যেন। বাদশাহের যুদ্ধ জয়ের আনন্দে তুমি কি উপহার হিসেবে দেবে আমায়? প্যাট্রিক বিচলিত হয়ে বললেন, হুজুরকে অদেয় কিছুই নেই। কিন্তু হুজুরকে উপহার দেবার ধৃষ্টতা কি আমার আছে!
মুসাফির বিষপুরে প্রবেশের আগেই মধ্যাহ্নভোজনে বসে প্যাট্রিককে বললেন, নীলকণ্ঠ মন্দিরের সেই কাঞ্চনীকে তুমি নিশ্চয়ই বিস্মৃত হওনি হাকিম? ওকেই পুরস্কার হিসেবে আমার চাই প্যাট্রিক। এ দায়িত্ব তোমায় অর্পণ করলাম। প্যাট্রিক বললেন, কিন্তু মধুবালা তো কাঞ্চনী নয়। সে তো ব্রাহ্মণ কন্যা হুজুর! তাকে অপহরণ করা কি সম্ভব?
বাদশাহ মুচকি হেসে বললেন, ব্রাহ্মণ কন্যা কখনও গান-নাচ করে না বাইজিদের মত। ও নির্ঘাত কাঞ্চনী। হিরে জহরতের লোভে নিজেকে বিক্রয় করবেই। তোমার এ উপহার আমার আর রুকসানার পদ্মমহলে শোভা পাবে। আমার একান্ত সম্পত্তি করে রাখবো একে। তুমি জানো আমি সঙ্গীত পিপাসু সঙ্গে রূপেরও পিপাসু। রুকসানা বেগমের সম্মুখে কোরান ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি অন্য নারীতে আসক্ত হবো না। তাই এই কাঞ্চনীকে আমি স্পর্শ করবো না। শুধু তার কণ্ঠের সুরে, ঘুঙুরের বোলে আর রূপের ছটায় আমি মোহিত হতে চাই। দর্শন সুখকে আমরা কবিরা কাব্যে বড় উচ্চাসনে বসিয়েছি প্যাট্রিক। দেহজ সুখ নয়, এ শুধু আঁখির তৃপ্তি, মনের আরাম।
.
অজান্তেই প্যাট্রিকের মুষ্টিবন্ধ হয়ে গেল। চোখের সামনে কল্পনা করলেন, কাঞ্চনীর পোশাক পরে বাদশাহের সম্মুখে তার মন বহলাতে নৃত্য পরিবেশন করছে মধুবালা। তার আঙুলে প্যাট্রিকের রক্তাম্বর চুনি। চোখটা বন্ধ করে নিলেন প্যাট্রিক। অমোঘ নির্দেশ দিলেন বাদশাহ, আজ রাত্রেই অপহরণ করে নিয়ে এসো ওই কাঞ্চনীকে। রুদ্রনগরের এখন উৎসবের বাতাবরণ। আমরাও উপভোগ করতে চাই নৃত্যগীতের মাধ্যমে।