ডুপ্লেক্স
১.
অনন্যার রান্না হয়ে গেছিল সকালের। বর রূপ খেয়ে চলে গেছে খানিকক্ষণ আগে।
ছেলে বুবাই ঘুমাচ্ছে। ওকে আর ওঠায় নি অনন্যা। পরীক্ষা শেষে এক দিন মাত্র ছুটি পেয়েছে, ঘুমাক।
টিভিতে “লীলাময়ী” র রিপিট টেলিকাস্ট চালিয়ে সবে বসেছে, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল।
অনন্যা বিরক্ত হল। নিশ্চয়ই সেলসম্যান।
মনের সুখে গালাগাল দেবে বলে উঠে দরজা খুলে দেখল তারই বয়সী এক মেয়ে দাঁড়িয়ে। অনন্যা বলল “বলুন?”
মেয়েটি বলল “রূপ রায়ের বাড়ি?”
অনন্যা বলল “হ্যাঁ। “
মেয়েটা তার দিকে ডান হাত এগিয়ে দিয়ে বলল “হাই অনন্যা। আমি রুচিরা। তোমার সতীন। গত মাসে আমার আর রূপের বিয়ে হয়েছে”।”
অনন্যা হাঁ করে রুচিরার দিকে তাকাল।
সিরিয়ালের দুটো বিয়ে শেষে তার জীবনেও?
মাথা ঘুরাচ্ছিল, কোন মতে দাঁড়িয়ে বলল “মানে?”
রুচিরা মোবাইল বের করে গ্যালারি খুলল এবং তার এবং রূপের বেশ কয়েকটা ঘনিষ্ঠ ছবি বের করে বলল “গত মাসে অফিস ট্যুরের ঢপ মেরেছিল না? তখন আমরা হানিমুনে গেছিলাম। আন্দামান”।
এবার আর পারল অনন্যা। মেঝেতেই বসে পড়ল।
২
“আমি ভেবেছিলাম চুপ করেই থাকব। তোমায় কিছু বলব না। পরে এত একা লাগতে শুরু করল যে চলে আসাই মনস্থির করলাম। দুটো সংসার চালানোটাও একটু চাপ, তাই না?”
রুচিরা বলল।
অনন্যা স্থবির হয়ে সোফায় বসে আছে। টিভিতে নিজের মত সিরিয়াল চলে যাচ্ছে, কানেও আসছে না কিছু। রুচিরা বলল “তুমি খুব শকড? আমিও হয়েছিলাম যখন প্রথম জানতে পেরেছিলাম।”
অনন্যা বলল “বিয়ের আগে জানতে পেরেছিলেন?”
রুচিরা মাথা নাড়ল “হ্যাঁ। ফেসবুকে আলাপ। তারপর দেখা। বলত না কিছুই। একদিন তুমি ফোন করলে ওকে। হঠাৎ করেই চোখে পড়ে গেল তোমার নামটা ফোনে ওয়াইফ নামে সেভ করা। তখন চেপে ধরতে বলে ফেলল আর কী! আমি রেগে গেলাম। কেন বলেনি এদ্দিন। পরে ঠিক করলাম নাহ, ছাড়ব না। বিয়ে করব আগে। তারপর লাইফটা নরক করব”।
অনন্যা থতমত খেয়ে বলল ” কেমন নরক?”
রুচিরা বলল “আমি আজ থেকে এ বাড়িতেই থাকব”।
৩
বুবাই ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে অনন্যার কাছে এসে রুচিরাকে দেখে চিনতে পারল না। রুচিরার দিকে তাকিয়ে বলল “তুমি কে?”
রুচিরা হেসে বলল “তোমার ছোট মা”।
অনন্যা একটু চমকাল কিন্তু কথা বলল না।
রুচিরা উঠে বুবাইকে কোলে নিয়ে বলল ” এখানে এসে বাঁচলাম বিশ্বাস কর। সারাক্ষণ একা একা থাকা যায় নাকি? আমি ভাগ্যিস এই ডিসিশনটা নিয়েছি”।
বুবাই কাঁদো কাঁদো গলায় বলল “আমি বড় হয়ে গেছি। কারো কোলে উঠি না আমি”।
রুচিরা বুবাইয়ের গাল টিপে বলল ” আমাদের কাছে তো ছোট তুমি বাবা। দেখবে এর পরে তোমার একটা ভাই বা বোন আসবে, তোমায় কত ভালবাসবে”।
লীলাময়ীর বর লীলাময়ীকে ছেড়ে আরেক মহিলার সাথে গিয়ে থাকছে। অনন্যা টিভিতে লীলাময়ীর মুখে নিজের মুখটা দেখতে পেল যেন।
৪
রূপকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। অনন্যা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও পেল না।
রুচিরা কিছুক্ষণ আগে “আমি একটু ঘুমিয়ে নি” বলে তাদের বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।
অনন্যা বরাবরই কথা কম বলে। এবারে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে। বুবাইকে পড়তে বসাতে হত, পারে নি। বুবাই বেশ কিছুক্ষণ ঘুর ঘুর করে বুঝেছে মা পড়তে বসাচ্ছে না কোন কারণে। গম্ভীর হয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে কার্টুন দেখছে। অন্যদিন হলে অনন্যা পিঠে দুটো বাড়ি দিয়ে পড়তে বসিয়ে দিত। এদিন এতটাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আছে যে একেবারেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছে।
কাজের মেয়ে সরস্বতী এসে ঘর ঝাঁট দেওয়া শুরু করেছে। বেডরুম থেকে এসে অবাক গলায় বলল “কে এসচে গো বুদি”?
অনন্যা কিছু বলার আগে বুবাই গম্ভীর গলায় বলল ” ছোট মা”।
সরস্বতী বলল “সেটা কে?”
অনন্যা কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল “তাড়াতাড়ি কাজ কর তো, বেরোব একটু”।
সরস্বতী বলল ” কুতায় যাবে?”
অনন্যা বলল “শ্মশানে”।
সরস্বতী বলল ” উকানে কী গো বুদি? শুটিং আচে?”
অনন্যা বলল “মরণ আচে, মরণ। তুই কাজ করে যাবি?”
সরস্বতী ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত গতিতে ঘর ঝাঁট দিতে শুরু করল।
৫.
রুচিরা উঠল দুপুরে। চোখ মুখ ফুলিয়ে বসার ঘরে এসে বলল “বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছা করছে খুব।টোমাটো দিয়ে বিরিয়ানি আনাবে? সবাই মিলে খাই?”
বুবাই বিরিয়ানির ভক্ত। নাম শুনেই লাফাতে শুরু করল।
অনন্যা রেগে গিয়ে বলল “বিরিয়ানি না, তুই আমার মাথা খা”!
বুবাই কাঁদতে লাগল। রুচিরা বুবাইকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল “তুমি আবার এইটুকু সোনাকে বকছ কেন বল তো?”
অনন্যা বলল “আমি বাপের বাড়ি যাব৷ তুমি সংসার কর৷ সতীন নিয়ে থাকতে পারব না আমি”।
রুচিরা বলল “এ কেমন কথা? তুমি চলে গেলে রূপকে সাইজ করব কী করে? তুমি আগে ঠিক কর তুমি আমার দলে না ওর দলে?”
অনন্যা কয়েক সেকেন্ড রুচিরার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল “বুবাইকে দাও, অনেক কার্টুন দেখেছে, এবার পড়তে বসাই”!
৬
অনন্যা বুবাইকে পড়াতে বসাল খাওয়ার পর। টিভি চলছিল। রুচিরা টিভি বন্ধ করে অনন্যাকে বলল “ওমা সাউন্ড হচ্ছে ও পড়বে কী করে?”
অনন্যা বলল “তুমি দেখলে দেখো, আমি দরজা বন্ধ করে পড়াই বরং”।
রুচিরা বলল “ধুস, তা হয় নাকি, দাঁড়াও আমি বরং ম্যাগাজিন পড়ি। আছে কোন ম্যাগাজিন?”
অনন্যা ম্যাগাজিনের স্ট্যাকটা দেখাল রুচিরাকে। রুচিরা ম্যাগাজিন পড়তে লাগল বসার ঘরে। অনন্যা বুবাইকে বেশ কয়েকটা অংক করতে দিয়ে বসার ঘরে এসে রুচিরাকে বলল “আচ্ছা তুমি রূপের বন্ধু না তো? কোন ইয়ার্কি মারছ না তো?”
রুচিরা হেসে মাথা নাড়ল “না। একচুয়ালি আমিও যেদিন তোমার ব্যাপারে জানলাম আমারও খুব,রাগ হয়েছিল। আমার ইচ্ছা করছিল তোমাকে মেরে ফেলি। মাথা ঠান্ডা হলে বুঝতে পারলাম আমার মত তুমিও প্রতারিত হয়েছো। তোমাদের সেক্স লাইফ কেমন?”
অনন্যা ইতস্তত করতে লাগল।
রুচিরা বলল “আমাকে বল। আমার সঙ্গে শেয়ার না করলে সমস্যা বাড়বে কিন্তু”।
অনন্যা রুচিরার মুখের দিকে তাকাল।
বলল “পরে বলব। এখন এসব নিয়ে আলোচনা করতে একেবারেই ইচ্ছা করছে না। ইন ফ্যাক্ট আমার মনে হচ্ছে সব ছেড়ে চলে যাই কোথাও”।
রুচিরা বলল “বিয়ের এলবামটা দেখাবে?”
অনন্যা উঠল।
৭
রুচিরা চুপ করে বসে অ্যালবাম দেখছিল। ছবিগুলো দেখা হয়ে গেলে বলল “আমারও এরকম বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল। সমস্যা হল আমি অনাথ। কাকা জ্যেঠুরা আমার বিয়ে দিত না এভাবে। রূপ যখন আমাকে বলেছিল বিয়ের কথাটা আমি ভেবেছিলাম পৃথিবীর সব থেকে খুশি মেয়ে আমি। আমি ভাবতে পারি নি ও গোটা একটা পরিবারকে চিট করছে। তোমার কখনো সন্দেহ হয় নি?”
অনন্যা মাথা নেড়ে বলল “সন্দেহ করার জন্য সময় লাগে। বুবাইকে সামলে আমার দিন কেটে যায়। ওর স্কুল, ওর হোম ওয়ার্ক,সব এত এত থাকে যে আর কোন কিছুর দিকে দেখব কী করে? তাছাড়া আমি ওর ফোন ঘাঁটি না। ঘাঁটার কথা মনেও আসে নি কোন দিন”।
রুচিরা হেসে বলল ” তোমার নাম এখন মোবাইলে ঘর বলে সেভ করা আছে।ওয়াইফ নেই আর। আমি ওর মোবাইল দেখেছি ওর অজান্তেই। প্যাটার্ন লকটা দেখে নিয়েছিলাম একদিন। ঘুমাচ্ছিল ও। আমি ফোন দেখলাম। তোমার চাল এনো, তেল এনো ছাড়া কোন মেসেজ নেই। আর…”
অনন্যা জিজ্ঞাসু চোখে রুচিরার দিকে তাকাল “আর?”
রুচিরা বলল “কিছু না। শুধু বলি রূপের শাস্তি দরকার। খুব বড় কোন শাস্তি”।
অনন্যা বলল ” মানে?”
রুচিরা ঠান্ডা চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল “মে বি ওর বেঁচে থাকার কোন দরকার নেই”।
অনন্যা শিউরে উঠে বলল ” সেকী”!
রুচিরা বলল “আমরা ওকে ঠান্ডা মাথায় খুন করতে পারি। করবে?”
৮
অনন্যা চোখ বন্ধ করল। রূপের মুখটা মনে পড়ছে। ঝগড়া শেষে অপরাধী চোখদুটো মনে পড়ল। সে রুচিরাকে বলল “তোমার যদি মনে হয় তুমি ওকে নিয়ে থাকবে, আমি বুবাইকে নিয়ে সরে যাব। এসব খুন টুন করার কথা বলতে হবে না।”
রুচিরা তার হাত ধরে উত্তেজিত গলায় বলল “যে সব মানুষ একবার পলিগামিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তারা কি সারাজীবনে আবার এক নারীতে সন্তুষ্ট হবে? রূপ আবার অন্য কারো পেছনে ছুটবে। মে বি তোমারই?”
অনন্যা বলল “আমি আসব না তোমাদের মধ্যে। কিন্তু এই মেরে ফেলা ইত্যাদি বোল না। আমার মাথা কাজ করছে না”।
রুচিরা বলল ” তোমার তো লাভ ম্যারেজ। যখন প্রেম করেছিলে কখনো মনে হয় নি রূপ চিট করতে পারে?”
অনন্যা বলল “ওর আমার সাথে বিয়ে হবারই কথা ছিল না। আমার বন্ধুর প্রেমিক ছিল ও”।
রুচিরা বলল ” তারপর?”
অনন্যা বলল “আমি মিথ্যা বলে ওই সম্পর্ক ভেঙেছিলাম। মে বি তার শাস্তি আজ পেতে হচ্ছে। আচ্ছা তুমি তানিয়ার কেউ হও না তো?”
রুচিরা বলল “আমি তোমার সতীন ছাড়া আর কারো কিছু হই না। তারমানে রূপের মত তুমিও চিটার”।
অনন্যা এ কথার উত্তর না দিয়ে বলল “আমি বুবাইয়ের কাছে গেলাম। তুমি কী চাও জানিও। সেভাবেই হবে। আমার মাথা কাজ করছে না”।
৯
বুবাই অংকগুলো করছিল আর অনন্যার ফ্ল্যাশব্যাকের মত পুরনো কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল।
রূপ তানিয়ার প্রেমের কাহিনী তাদের কলেজ বিখ্যাত ছিল। সর্বক্ষণ দুজন একসাথে।
সেদিনটা তানিয়া আসে নি।
সে ফিরছিল। রূপ হঠাৎ করেই তার সামনে বাইক নিয়ে এসে বলল “যাবি?”
অনন্যা কিছু না ভেবে রূপের পিছনে উঠল। গোটা রাস্তা বেশি কথা হয় নি তবে অনন্যা যখন রূপের কাঁধে হাত রেখেছিল,মনে হচ্ছিল তার শরীরে যেন বিদ্যুত খেলছে। মন্দিরতলার মাঠটা পেরোলে নির্জন রাস্তায় রূপকে সে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিল। রূপ বাইক থামিয়ে বলেছিল “কী হয়েছে?’
অনন্যা বলেছিল “আমি তানিয়াকে হিংসা করি রূপ। ও তোকে ছোঁয়, আমার রাগ হয়। আমি তোকে ভালবাসি কোন দিন বুঝিস নি তুই?”
রূপ কয়েক সেকেন্ড থমকে বলেছিল “এসব কী বলছিস? চ নামিয়ে দিয়ে আসি”।
অনন্যা কিছু বলে নি। বাইক থেকে নেমে বলেছিল “চলে যা। আমি যেতে পারব”।
রূপ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে চলে গেছিল।
অনন্যা একা থাকত ফ্ল্যাটে।
একা একা কেঁদেছিল অনেকক্ষণ। রাত এগারোটা নাগাদ কলিং বেল বাজল। দরজা খুলে দেখল রূপ দাঁড়িয়ে আছে। বেহেড মাতাল। সে দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। রূপ ঘরে ঢুকে তাকে পাগলের মত আদর করতে করতে বলেছিল ” ইউ আর ম্যাজিশিয়ান। আমি জানি না তোর শরীরে কী আছে। আমায় টানছিস তুই বিলিভ মি”।
সারারাত পাগলের মত আদর করেছিল দুজনে। পরের দিন সকালে রূপের নেশা কাটল। তাকে বলল “তানিয়া যেন জানতে না পারে”।
অনন্যা হেসেছিল।
রূপ কলেজ পৌঁছনোর আগেই তানিয়াকে ফোন করে অনন্যা বলেছিল কাঁদো কাঁদো গলায় ” আমি সরি রে। রূপ আমাকে প্রপোজ করেছিল৷ কাল সারারাত আমার ফ্ল্যাটে ছিল। আমি ওকে বারণ করলেও শোনে নি”।
তানিয়া মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিল,সেদিনের পর কলেজই যায় নি আর।
১০
বুবাই একটা অংক পারছিল না। অনন্যা দেখিয়ে দিচ্ছিল।
রুচিরা ঘরে এসে খাটে বসে বলল “তোমার শ্বশুর শাশুড়ি আসেন?”
অনন্যা বুবাইয়ের খাতার দিকে তাকিয়েই বলল “আসেন, কম। তবে আমার একার হবেন কেন, তোমারও তো”।
রুচিরা বলল ” তা বটে। কেমন তারা?”
যেদিন রূপের বাড়ি গেছিল বিয়ে করে, সেদিনের কথা মনে পড়ল অনন্যার। ঘরে ঢুকতেই রূপের মা এল্গাদা কথা শোনাতে শুরু করলেন। কিছুই দেয় নি বাপের বাড়ি থেকে, ভিখিরি বাড়ি ইত্যাদি৷ একটা নতুন বাড়িতে গিয়ে, সম্পূর্ণ অচেনা লোকেদের সামনে বাবা মা সম্পর্কে এসব মন্তব্য নিতে পারছিল না অনন্যা। নিজের অজান্তেই চোখ জলে ভেসে যাচ্ছিল। অথচ দেনা পাওনার কথার সময় রূপ বলেছিল তারা কিচ্ছু নেবে না। সে পণ বিরোধী। অথচ মা যখন এই কথাগুলো বলে চলল রূপ কিচ্ছু বলল না। পেটে খিদে মুখে লাজ কেন হবে? বলে দিলেই পারত সেদিন। অনন্যার মনে হচ্ছিল মাটিতে মিশে যায়। এই হয় বুঝি একটা মেয়ের জীবনে? এভাবেই আপ্যায়ন জানাতে হয় একটা নতুন বাড়িতে? সেদিনই মনে হয়েছিল ভুল করেছিল সে। এর থেকে তানিয়াকেই বরং বিয়ে করতে পারত রূপ। মানুষের রূপ দেখে প্রেমে ভেসে যাওয়ার থেকে বরং তার পরিবারের সঙ্গে থাকা দরকার আগে। বিয়ের আগে এবং বিয়ের পরেও মানুষ কত পাল্টে যায়। কলকাতা আসার আগের রূপের সঙ্গে পরের রূপকে মেলাতে পারত না অনন্যা। বলতও না কিছু। নিজের পছন্দের বিয়ে। কী বলবে?
অনন্যা রুচিরাকে বলল “ভালই”।
রুচিরা হাসল ” আমায় রূপ মিথ্যে বলেছিল, ওর নাকি বাবা মা দুজনেই মারা গেছে”।
অনন্যা চমকে রুচিরার দিকে তাকাল।
১১
“বিয়েটা হল মেয়েদের বোকা বানাবার প্রসেস৷ আসলে মেয়েরা এসেছেই পৃথিবীতে বোকা হতে। একটা বাড়িতে বেড়ে ওঠা, সেখানে নিজের ঘর বানানো। বড় হতে না হতে বিয়ে করে আরেকটা বাড়ি। কত প্রতিশ্রুতি থাকে বল তো বিয়ের আগে৷ ভাবা যায় না জাস্ট। তারপর যেন আসল দুনিয়াটা সামনে আসতে শুরু করে৷ খেটে যাও, রান্না করে যাও সারাটাজীবন ধরে। এটাই কাজ। কি বিচ্ছিরি বল?”
ম্যাগাজিন ঘাটতে ঘাটতে রুচিরা বলল।
অনন্যা এ কথার উত্তর না দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ তুলল “তুমি চেঞ্জ করবে? লাইট কিছু পরবে? আমার থেকে নিতে পার”।
রুচিরা বলল “রূপ যখন আদর করে অন্য কোন নামে তোমায় ডেকেছে কখনও?”
অনন্যা বলল “না”।
রুচিরা বলল “তুমি তানিয়া নামটা বললে, এখন মনে পড়ল। আমায় একবার তানিয়া বলে ডেকেছিল। হু ইজ দিস তানিয়া?”
অনন্যা অবাক হলেও সামলে নিয়ে বলল “ওর এক্স”।
রুচিরা হেসে ফেলল “জানতাম এরকম কিছুই। আমি জিজ্ঞেস করায় বলেছিল ও নাকি আমাকে এই নামটা দিয়েছে। পরে কিন্তু কখনও এ নামে ডাকে নি”।
অনন্যা বলল “উইকেন্ডে অফিস আছে বলে তারমানে তোমার কাছে যেত রূপ”।
রুচিরা বলল ” হ্যাঁ। আর সারাসপ্তাহ প্রচন্ড কাজের চাপ বোঝাত। সবসময় নাকি হিল্লিদিল্লি করে বেড়াতে হচ্ছে। তুমি জানো ওর জন্য আমি একটা ছেলেকে ডাম্প করেছিলাম?”
অনন্যা বলল “তুমি রূপের মধ্যে কী দেখেছিলে?”
রুচিরা বলল “সুন্দর দেখতে। ফরসা। মাথা ঘুরতে আর কী লাগে বল?”
অনন্যা বলল “আমিও তাই দেখেছিলাম”।
রুচিরা বলল “এবার ফোন কর তো। পাবে এখন। লাঞ্চের পর পাওয়া যায়৷ ফোন করে বাড়ি আসতে বল। কিছু একটা ছুতো কর। আমি অন্য ঘরে লুকিয়ে থাকব। আসুক। আমাকে এখানে দেখে কী করে ওর মুখটা দেখতে চাই আমি”।
অনন্যা ফোন বের করল।
১২
রূপের ফোন রিং হল এই বার৷ ও ফোন ধরে বলল “হ্যাঁ সোনা বল”।
রূপের ” সোনা” শব্দটা যেন অনন্যার বুকে তীরের মত বিঁধল। চোখে জল চলে এল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলল “তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসতে পারবে?”
“কেন বল তো? কী হয়েছে?”
রূপের গলা উদ্বিগ্ন৷
অনন্যা বলল “এসো৷ বলছি”।
রূপ এবার রাগল ” আরে সিরিয়াস কিছু না হলে আসব কেন? তুমি কি ভাব অফিসে আমি ইয়ার্কি মারতে আসি?”
অনন্যা রুচিরার দিকে ভ্যাবাচ্যাকা চোখে তাকাল। কী বলবে বুঝতে পারল না। রুচিরা ইশারায় বোঝাল শরীর খারাপ বলতে। অনন্যা বলল “আমার শরীর ভাল্লাগছে না”।
রূপ বলল ” পাশের বাড়ির কাকুকে বল। মেডিসিন স্টোর থেকে ওষুধ নিয়ে আসবে।”
অনন্যা বলল “আমার একটু বেশিই খারাপ লাগছে রূপ”।
রূপ একটু থমকে বলল ” ঠিক আছে। আসছি। তোমার খুব খারাপ লাগলে নার্সিং হোমে যেও।”
অনন্যা বলল “বুবাইকে রাখব কোথায়? তুমি এসো আগে”।
রূপ বলল ” ওকে বাবা আসছি”।
ফোন কেটে গেল।
অনন্যা রুচিরাকে বলল “আসছে”।
রুচিরা হেসে তার ফোন বের করে রূপকে ফোন করল। স্পিকারে দিল ফোন। ফোন একবার রিং হতেই রূপ ধরল ” হ্যাঁ বল জানু”।
রুচিরা গলায় ন্যাকামি এনে বলল “জানু, আসবে এখন? খুব একা লাগছে।”
রূপ আমতা আমতা করে বলল “আমার খুব জরুরি মিটিং পড়ে গেছে বাবু। আমি কাল যাব?”
রুচিরা অভিমান আনল “আমি এখন ওয়েট হলাম আর তুমি কাল আসবে? কাল আমি কী করব?”
রূপ একটু থেমে বলল “ওকে, আসছি জানু”।
ফোনটা কাটতেই অনন্যার ফোন বাজল। অনন্যা ধরল ” হ্যালো”।
রূপ বলল ” শোন না, আমি খুব জরুরি মিটিং এ ফেঁসে গেছি। তুমি বরং কাকুদের কাছে বুবাইকে রেখে নার্সিং হোমে যাও। আমি চলে যাব”।
অনন্যার চোখে জল চলে এল।
১৩
“তুমি কাঁদছো কেন? কাঁদার কিছু নেই। একটা মিথ্যা সম্পর্কের জন্য চোখের জল নষ্ট করছ কেন? আজ আমি সেক্সের জন্য রূপকে ডাকলাম বলে ও তোমাকে মিথ্যে বলল। কাল অন্য কোন মেয়ের জন্য আমাকে মিথ্যে বলবে। বা হয়ত তৃতীয় কেউ আছেও, আমি জানি না”।
অনন্যা অবাক হয়ে রুচিরার দিকে তাকাল ” এরপরেও কেউ?”
রুচিরা কাঁধ ঝাঁকাল, “হতেও পারে৷ সব কিছু সম্ভব।ওর পিছনে একটা গোয়েন্দা লাগাব ঠিক করেছি, কী করে কোথায় যায় সব বের করব”।
অনন্যা বলল ” তার দরকার হবে না। যা পারে করুক”।
রুচিরা বলল “তুমি সব এভাবে ছেড়ে দিচ্ছ কেন? এত সহজে?”
অনন্যা বলল “কী করব? আমার কি কিছু করার আছে? কাউকে জোর করে আটকানোর মধ্যে আমি নেই। বরং সব শেষ করে জীবনটাকে নতুন করে শুরু করব”।
রুচিরা বলল ” তোমার রূপের কথা মনে পড়বে না?”
কলিং বেল বেজে উঠল। অনন্যা বলল “এক মিনিট”।
রুচিরা বলল “ওকে”।
অনন্যা উঠে দরজা খুলল।
একজন পুরুষকে নিয়ে অনন্যা বেডরুমে এসে রুচিরাকে বলল “ও রুহান। আমার বয়ফ্রেন্ড। রূপ যখন না থাকে…”
১৪
রুচিরা হাঁ করে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল “মানে?”
অনন্যা হাসল “আমি ভাবছিলাম তুমি ওর বন্ধু নাকি, আমাকে ভয় পাওয়াতে এসেছো। পরে বুঝলাম তা নয়, তুমি সত্যিই ওর বিয়ে করা বউ। রুহানের ব্যাপারে এখন সবাই জানলেই বা কী বল। বোস রুহান”।
রুহান খানিকটা ঘাবড়েছিল রুচিরাকে দেখে। চুপ করে বসল।
অনন্যা বলল “রুহান বুবাইকে পড়ায়৷ এখনো কিছু করে না। একদিন নিশ্চয়ই করবে। সেদিন আমি রূপকে ছেড়ে যাব ভেবে রেখেছি”।
রুচিরা বলল “বাট ইউ আর চিটিং হিম”।
অনন্যা গম্ভীর হয়ে বুবাইকে বলল ” যা ওই ঘরে কার্টুন দেখ”।
বুবাই যেতে অনন্যা রুচিরার দিকে তাকিয়ে হি হি করে হেসে বলল “আমার বর তোমার সাথে শুয়ে বেড়াবে আর আমি অন্য কারো সাথে শুলে সেটা চিটিং? মানে সিরিয়াসলি?”
রুচিরা বলল “মানে আমি জানি না কী বলব, কিন্তু সামহাউ আমার মনে হচ্ছে কাজটা তুমি ঠিক করছ না”।
অনন্যা উঠে রুহানের কোলে বসল। রুহানের মাথা বুকে জড়িয়ে রুহানের কোকড়া চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল “তুমি রূপকে নাও, এ বাড়িতে থাকো, আমার কিছু বলার নেই। রুহান রোজ আসবে, আমায় আদর করবে তুমি কিছু বলবে না। ডিল?”
রুচিরা ফ্যাল ফ্যাল করে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল “দ্যাট ইজ সো রং”।
অনন্যা রুহানের কপালে চুমু খেয়ে বলল “আমার বর তোর খাট গরম করে সেটা খুব রাইট, না রে মাগী?”
রুচিরা মাথা নিচু করে বলল “শিট”।
১৫
রুহান বুবাইকে পড়াতে বসেছে ড্রয়িং রুমে।
অনন্যা ফোন বের করে রূপকে ফোন করল। রূপ ধরল না। অনন্যা ঠান্ডা গলায় রুচিরাকে বলল “ওকে ধরে দাও”।
রুচিরা নিজের ফোনটা অনন্যার দিকে এগিয়ে গেল। রিং হতে ফোন ধরেই রূপ বলল ” আসছি বেবি আসছি। ট্যাক্সি নিয়েছি”।
অনন্যা বলল “আমি অনু বলছি। তোমার বেবি আমাদের বাড়ি এসছিল। এখানে চলে এসো”।
রূপের হতভম্ব গলা ভেসে এল “মানে?”
অনন্যা বলল “বাড়ি এসো। মানে বোঝাচ্ছি”।
রূপ আর কিছু বলার আগেই অনন্যা ফোনটা কেটে দিল।
রুচিরার দিকে তাকিয়ে বলল “তুমি ওকে নিয়ে আলাদা থাকতে পারো। আমার আপত্তি নেই। দেখো আমিও জানি রুহান আর আমার সম্পর্কটা শুধু শারীরিক। ও আমাকে বিয়ে করবে না। করা সম্ভবও না। আমি হাই মেন্টেনেন্স মেটিরিয়াল। তবে আইন আমার পক্ষে। আমি রূপের এডাল্টারি প্রমাণ করে দেব। পেছন মারা রূপকে নিয়ে তুমি থাকো। বাকি জীবনটা আমি খোরপোষের টাকায় আরামসে কাটিয়ে দিতে পারব। সব সময় তো সেক্সের ইচ্ছা আসে না। যখন আসবে রুহানকে ডেকে নেব৷ আইডিয়াটা ভাল না? আর তুমি কী ভেবেছিলে, রূপ অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াচ্ছে আমি বুঝতে পারি নি? সব বুঝেছিলাম। তবে ঘাটাইনি। ভেবেছিলাম সুতো ছাড়ি। ঘুড়ি কদ্দুর যায় দেখি৷ আমার কাছে ফোর নাইন্টি এইটের অস্ত্র তো আছেই। ঠিক সময় খেলে দিতে পারলে বারোটা বেজে যাবে। তুমি জল খাবে? হাল ভাল লাগছে না তোমার”।
কথাগুলো বলে অপ্রকৃতস্থর মত হাসতে শুরু করল অনন্যা।
১৬
“এই যে প্রি ওয়েডিং শ্যুট করে লোকে বিয়ের আগে, মেয়েগুলোর কী হাস্যকর দশা হয় বিয়ের পরে সেটা কেউ দেখায়? বরের বাড়িতে হেনস্থা, রান্না করা, সেক্স করতে না চাইলেও সেক্স করা, ঘর মোছা, বাসন বাজা এ সব কিছুর ভিডিও করতে পারি তো, বল?”
অনন্যা হাসি থামিয়ে রুচিরার দিকে তাকাল।
রুচিরা বলল “আমার এখানে আসা ভুল হয়েছে। সংসার দুটো আলাদা হলেই ভাল হত।”
অনন্যা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল “একদম ঠিক করেছ। সবার সব জানা উচিত। রিলেশনস শুড বি ট্রান্সপারেন্ট৷ রূপ আমাদের জানাক ওর আর কোন রিলেশন আছে নাকি, আমরাও জানাই। সবাই সবকিছু এপ্রুভ করি। উই লিভ ইন এ গ্রোন আপ সোসাইটি। এখন এসব নিয়ে চাপ নিয়ে লাভ নেই”।
রুচিরা অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল “তোমাকে আমি এরকম ভাবি নি”।
অনন্যা আবার হাসতে হাসতে বলল “লীলাময়ী ভেবেছ? মাইরি তুমি মেয়ে না হলে তোমাকে মদন বলে ডাকতাম”।
১৭
রুহান পড়িয়ে চলে গেছিল।
রূপ এল আধ ঘন্টা পরে। অনন্যা দরজা খুলল। রূপ হতভম্ব হয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল “আমি জানতে পারি কী হচ্ছে এখানে?”
অনন্যা বলল “তোমার দ্বিতীয় বউ এসেছে। ও এখানেই থাকবে বলছে”।
রূপের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল ” ও”।
অনন্যা বলল “তুমি চাপ নিও না। এসো, বস। কফি করছি, খাও”।
রুচিরা এসে দাঁড়িয়েছিল। রূপ ওর দিকে তাকিয়ে বলল ” তুমি এখানে?”
অনন্যা বলল “ও আমাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছিল”।
রূপ মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে বলল “আমি ভুল করেছি। অনেক বড় ভুল করেছি। আমি জানতাম এরকমই হবে। আমি এবার কী করব?”
বুবাই বাবাকে দেখে লাফাত্ব লাফাতে এসে বলল “বাবা কী এনেছ?”
রূপ প্রতিদিনই বুবাইয়ের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে। আজ তাড়াহুড়োয় ভুলে গেছে। অনন্যা মিষ্টি গলায় বুবাইকে বলল “এখন গিয়ে অংক কর। এই ঘরে এলে মেরে ঠ্যাং খোড়া করে দেব”।
বুবাই বুঝল মা রেগে আছে। অনন্যা রেগে থাকলে এরকম মিষ্টি গলাতেই কথা বলে। সে পালাল।
রূপ গেলে অনন্যা বলল ” শোন রূপ, আমার ডিভোর্স লইয়ারের সাথে কথা বলাই আছে। আপাতত তোমার এগেইন্সটে একটা এডাল্টারি আনছি। বাচ্চা তো আমার কাছেই থাকবে। আমার আর বুবাইয়ের ভরণপোষণ তুমিই দেবে। তারপর ফুটোর জন্য এই মাগীর কাছে শোবে না কার কাছে গিয়ে শোবে সে ঠিক করে নিও”।
রূপ বলল,”আমায় ক্ষমা কর অনন্যা”।
অনন্যা বলল,”তানিয়ার সঙ্গে যোগাযোগটা যে তোমার এখনও আছে সেটাও আমি জানি। রুচিরাকে সেটা তুমি বলবে না আমি বলব? রুচিরা,চাইলে তুমিও রূপের এগেইন্সটে প্রতারণার মামলা করতে পার”।
রুচিরা বলল “কে তানিয়া?”
অনন্যা রূপের দিকে একবার তাকিয়ে রুচিরাকে বলল “তোমার বরের আসল নায়িকা”।
১৮
ঘরের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। রুচিরা কেঁদে ফেলল। বলল “রূপ তুমি জানো তুমি মানসিক রুগী?”
রূপ এ কথার উত্তর দিল না। চুপ করে বসে রইল।
অনন্যা বলল “৭৩ নং বকুলবাগান লেন। সারারাত রূপ সেদিন আমার কাছে ছিল৷ কখন ছিল? যখন ওর সঙ্গে তানিয়ার তুমুল প্রেম৷ আমি ওকে বিশ্বাস করতে পারি নি কখনোই। একসময় মনে হল না, শরীর যখন দিয়েছি তখন ওকে আমাকেই বিয়ে করতে হবে। তানিয়া সরল বটে কিন্তু রূপ আমার সঙ্গে বিয়ের পরেও তানিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করল আমার অজান্তেই। ও ভেবেছিল আমি কিছু জানতে পারব না। তারপর তোমার সঙ্গে। রূপ একজন মারাত্মক পারভার্ট এবং পলিগ্যামাস মানুষ। আমি কিচ্ছু বলি নি। বুবাইকে মানুষ করে গেছি আর দেখে গেছি রূপ কদ্দুর যেতে হবে। ম্যারেজ সারটিফিকেট যার থাকে তার অনেক ক্ষমতা থাকে। রূপ খুব বড় ফেঁসেছ বস। খুব বড়। তানিয়ার দেওরের নাম জানো কী রুচিরা? রুহান। রুহানকে রূপ প্ল্যান্ট করে এ বাড়িতে যাতে ওর সঙ্গে আমি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি তার জন্য। ভেবেছিল এসব দেখিয়ে আমাকে ও ডিভোর্স দেবে বা ব্ল্যাকমেইল করে বাকি সম্পর্কগুলো চালিয়ে যাবে। ও বুঝতে পারে নি ও ডালে ডালে চললেও আমিও পাতায় পাতায় চলেছি। তানিয়া এবং রুচিরার সঙ্গে সমস্ত ছবি আমার কাছে আছে রূপ। আপাতত তোমার মাইনের ৭৫% আমাকে দিও। এছাড়াও ১০ লাখ টাকা দিও। পরে কী কী লাগবে আমিই চেয়ে নেব”।
হাসতে হাসতে বলল অনন্যা।
রূপ অনন্যার পায়ে পড়ে গেল ” আমাকে ক্ষমা কর প্লিজ। এত টাকা আমি কোথায় পাব?”
অনন্যা বলল “বাড়ি বেচে দাও। ওই রুচিরা বা তানিয়া ডাইনির বাড়ি গিয়ে থাকো। আমার ছেঁড়া যায় তোমার কী হবে সেটা ভাবতে”।
বুবাই কোত্থেকে এ ঘরে এসে বলল ” ছেঁড়া যায় মানে কী বাবা?”
১৯
অনন্যা রূপকে বলল “পলিগ্যামি ভাল না খারাপ, সে তর্কে আমি যাব না। আমার বয়স কম ছিল, আমি তোমার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু কেউ সহজলভ্য হলেই যে তোমাকেও তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হবে, এটাই বা তুমি কি করে ভাবলে? নিজের বউকে অন্য কারো সঙ্গে জড়িয়ে দিয়ে ভাবলে তুমি যা খুশি করে বেড়াবে? একবারও ভাবলে না বুবাইয়ের কথা?”
রূপ অনন্যার দিকে তাকিয়ে বলল “শোন, আমি তোমায় খোরপোষ বাবদ যা লাগে দেব, তবে ওত টাকা ডিমান্ড কোর না, এতটাকা দিলে আমি নিজে কী খাব?”
অনন্যা বলল “খাবে না। না খেয়ে থাকলে আশা করি তোমার উত্থিত পুরুষাঙ্গ খানিকটা ঠান্ডা হবে। কী ভেবেছিলে তুমি? এভাবেই সারাজীবন চলে যাবে? আর কেউ কিছু বুঝতে পারবে না?”
রূচিরা এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। এবার বলল “আমি কোথায় যাব?”
অনন্যা বলল “তুমি তো ওর বউ বাচ্চা আছে জেনেও ওকে বিয়ে করে এ বাড়িতে মজা দেখতে এসেছিলে! তুমি কী করবে আমি কেন বলব বল?”
রুচিরা বলল “আমিও তো প্রতারিত”।
অনন্যা বলল “তো? আচ্ছা শোন রূপ, আধঘন্টা সময় দিলাম। এই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। আমার একাউন্ট নাম্বার তোমার কাছে আছে। টাকা পাঠিয়ে দেবে মাসের শুরুতেই নইলে কিন্তু আমি বুঝে নেব”।
রূপ বলল “কোথায় যাব আমি?”
অনন্যা বলল “বাকিদের সঙ্গে প্রেম করার সময় আমায় জিজ্ঞেস করে করেছিলে? তাহলে এখন কেন জিজ্ঞেস করছ?”
রুচিরা বলল “ভুলেও আমার বাড়িতে আসার কথা ভেবো না রূপ। ওখানেও তোমার জন্য কোন লাল কার্পেট রাখা নেই”।
রূপ কয়েক সেকেন্ড বসে দাঁড়াল। অনন্যা এবং রুচিরার দিকে একবার করে তাকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
২০
রূপ বেরিয়ে যেতে রুচিরা কাঁদছিল। অনন্যা ওর দিকে তাকিয়ে বলল “বাড়ি যাও”।
রুচিরা বলল ” আমার সব শেষ হয়ে গেল”।
অনন্যা বলল “আমার সব শুরু হল বুঝি?”
বুবাই খেলছিল নিজের মনে। অনন্যাকে বলল “মা আজ বিরিয়ানি খাব”।
অনন্যা মনে মনে বলল ” হ্যাঁ তোর বাবার আবার বিয়ে লেগেছে বিরিয়ানিই তো খাবি”।
মুখে বলল “পড়তে বস বায়না না করে”।
রুচিরা বলল “আমি রূপকে দেখে কখনোই বুঝি নি ও এরকম”।
অনন্যা বলল “কাকে দেখে বোঝা যায়? কোন পুরুষকে? যে মানুষ সামনে একরকম, মুখ ফিরলে তারাই অন্যরকম। আমার পাশের বাড়ি এক কাকু ছিল, একদিন পাড়া থেকে পিকনিক ছেড়েছিল। ফেরার সময় বাস অন্ধকারে খারাপ হয়ে গেল। কাকুটা হঠাৎ কোত্থেকে এসে অন্ধকারে আমার বুকে হাত দিয়েছিল। আতঙ্কে আমি কোন কথা বলতে পারি নি। ওর দুই মেয়ে আমার সঙ্গে পড়ত। কাউকে বলতে পারি নি উনি এরকম করেছিলেন। আমাদের প্রত্যেক মেয়ের জীবনেই এরকম চেপে রাখা, চমকে দেওয়া অনেক অনেক গল্প আছে। তুমিও ভেবে নিও, রূপ এরকম কেউ ছিল। তবে ছেড়ো না ওকে। ওকে ছাড়লে কিন্তু ও আবার অন্য কারো জীবন নষ্ট করবেই। যে পুরুষ বহু নারীর স্বাদ পেয়ে যায়, সে অনেকটা নরখাদকের মত হয়ে যায়”।
রুচিরা বলল ” আমি ওর জন্য যে ছেলেটাকে ডাম্প করেছিলাম তাকে ফোন করব? ফিরে যাব ওর কাছে?”
অনন্যা বলল “ক্ষমা চাও। দেখো কী বলে”।
রুচিরা বলল ” ও এখনও আমাকে মেসেজ করে। ভালবাসে আমি বুঝি”।
অনন্যা শব্দ করে হেসে বলল “ভালবাসে না, বাল বাসে।আর কাউকে জুটাতে পারে নি তাই তোমার কাছে আসতে চায়”।
রুচিরা মাথা নিচু করে বলল ” আমি যাই। আর কোন দিন আসব না। ভেঙে গেলাম বড্ড”।
অনন্যা উঠে দরজা খুলে দিয়ে বলল “হু, এসো। আশা করি আর কোন দিন আসবে না। মনে রেখো আমি তোমাকে দেখতে পারব না কোন দিন”।
রুচিরা মাথা নিচু করে বলল “সরি। ক্ষমা করে দিও। আসি”।
বেরিয়ে গেল রুচিরা।
অনন্যা রান্না বসাল। মাংস। ঝাল ঝাল করে।
আধ ঘন্টা পরে কলিং বেল বাজল।
অনন্যা দরজা খুলে দেখল রূপ দাঁড়িয়ে।
বেশ খানিকক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দুজনেই হেসে দিল।
রূপ বলল “উফ রুচিরা মেয়েটাকে গলা নামাতে দম বেরিয়ে যাচ্ছিল। গলায় ফাঁস হয়ে গেছিল পুরো। বাঁচলাম আজ।”
অনন্যা মুখ বেকিয়ে বলল “কপাল ভাল যে আমার মত বউ পেয়েছিলে যে তোমাকে এসব থেকে বাঁচায়। আমার যা রূপ দেখেছে তাতে আর জীবনেও এ দিকে ফিরবে না”।
রূপ বলল ” মাথা খারাপ মেয়েটার। বউ আছে জানার পর থেকেই ঝামেলা করছিল। আমি জানতাম ও আজ কালের মধ্যেই আসবে। ম্যানেজ দিয়ে বাঁচালে”।
অনন্যা বলল “ওর গয়নাগুলো তোমার কাছেই রাখা তো? আমাকে দিও কাল, ডিজাইন পছন্দ হলে সেগুলোই পরব নইলে চেঞ্জ করব”।
রূপ অনন্যার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল “তোমার রুহান থাক, আমার তানিয়া, মাঝে মাঝে রুচিরার মত দু চারটে কেচ্ছা করলে এভাবেই সামলে নিও মাইরি”।
অনন্যা মুচকি হেসে বলল “একদম”।