Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গথ – অৎসুইশি

    কৌশিক জামান এক পাতা গল্প372 Mins Read0

    ২. কাটা হাত

    কাটা হাত

    প্রস্তাবনা

    স্কুলের পর বাসায় যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলাম। তখন খেয়াল হলো কেউ একজন আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুরে দেখি, মোরিনো। পুরো ক্লাসরুম খালি।

    “তুমি বাসায় যাওয়ার আগে কিছু কথা বলতে চাইছিলাম,” বলল সে। সারাদিন আমরা কোন কথা বলিনি। সুতরাং বলা যায় প্রায় চব্বিশ ঘন্টা পর ওর গলার আওয়াজ শুনলাম। “গতকালকে আমি একটা অদ্ভুত মুভি ভাড়া করে এনেছি..”

    মুভিটা নিয়ে কারো সাথে আলাপ করার জন্য ও মারা যাচ্ছিল। আর পুরো ক্লাসে একমাত্র আমিই আছি যার সাথে ও কথা বলে এবং সে আমার সাথে শুধু তখনই কথা বলে যখন আমি একা থাকি, অন্যদের সাথে কথা বলি না যখন। যেজন্যে বাসায় যাওয়ার আগে ছাড়া আমার সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিল না।

    রুমের বাইরে দাঁড়ানো কিছু মেয়ে আমাদেরকে খেয়াল করে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিল। ওদের দেখে আমি বুঝতে পারলাম, ওরা আমাদের নিয়ে কথা বলছে। প্রথম প্রথম, সবাই চিন্তা করত আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা কিনা। কিন্তু আমাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে আমাদেরকে অন্তরঙ্গ মনে হয় না। আমাদের সব কথাবার্তার সময় মুখের অভিব্যক্তিও থাকে ঠাণ্ডা। সুতরাং আমাদের সম্পর্কটা কি ধরনের তা আমাদের ক্লাসমেটদের কাছে একটা বিশাল রহস্যজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তাদের মূল আগ্রহ হলো, আর যাই হোক মোরিনো যে কারো সাথে কথা বলছে এইটাই বিশাল কিছু। ক্লাসের মধ্যে সে রীতিমত লুকিয়ে থাকে। স্কুল ছুটি, তো উধাও। ওর জীবন যাপন সাবমেরিনের মত, সারাক্ষণ সাগরের তলায় পড়ে থাকে।

    গ্রীষ্মকালীন ইউনিফর্ম বাদ দিলে, ও সবসময়ই কালো পরে থাকে। চুল থেকে জুতা পর্যন্ত সবকিছু কালো। মনে হয় যেন ও সর্বশক্তিতে চেষ্টা করে যাচ্ছে অন্ধকারের সাথে মিশে যেতে। আলো ওর কাছে যেন ঘৃণিত কোন বস্তু, সবসময় একশ হাত দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়।

    আমি একবার মোরিনোর শিববা দোকি (আবেদন পত্র) দেখতে চেয়েছিলাম, জানতে, কেন যে ও এই স্কুলে ভর্তি হতে এল।

    “এখানের ইউনিফর্ম একদম সাধারণ আর কালো রঙের, শুধু সে কারনে…তুমি যখন প্রথমে ‘শিবো দোকি’ বললে আমি অন্য অর্থ ভেবেছিলাম…”

    ও ব্ল্যাক বোর্ডে গিয়ে চক দিয়ে কানজিতে লিখল “মরণ ইচ্ছা।” সে যখন হাত তুলে লিখছিল ইউনিফর্মের লম্বা হাতা নেমে গিয়ে ওর হাত বেরিয়ে এসেছিল। ওর ত্বক একদম ফ্যাকাসে সাদা। দেখে মনে হয় যেন কোনদিন সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসেনি।

    মোরিনোর চেহারা সুন্দর ছিল। ছেলেরা আগে মাঝে মধ্যে ওর সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করত। অন্তত একটা ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত…এক শিক্ষক ওর সাথে এমন কিছু করার চেষ্টা করেছিল যেটা কিনা যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। মোরিনো প্রথমে তার মুখে মরিচ পানি স্প্রে করে, তারপর ধীরে সুস্থে একটা ডেস্ক চেয়ার দিয়ে তাকে পিটিয়ে আধমরা করে ফ্লোরের উপর ফেলে রাখে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পুরো ঘটনাটা দেখেছিলাম। এই ঘটনার পর ছেলেরা আর ভয়ে ওর সাথে কথা বলতে আসে না।

    যে ঘটনাটার কথা আমি এখানে বলব সেটা আমাদের সম্পর্ক কিভাবে হল তা নিয়ে নয়। বরং অন্য একটা ব্যাপার, ওর ফ্যাকাসে হাতের দিকে তাকালে যে ঘটনার কথা আমার বার বার মনে পড়ে।

    ঐ বছর বসন্তে, সব টিভিতে একটা ইন্টারেস্টিং কেস দেখাচ্ছিল। কেসটা কাটা হাত নিয়ে। যে কেসের সাথে আমিও জড়িয়ে পড়েছিলাম…গোপনে।

    সময়টা ছিল মে মাসের শেষের দিক। এর আগে মারিনোর সাথে আমার কখনো কথা হয়নি…

    ১

    নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে সিনোহারা চিন্তা করছিল-হাত, স্তন্যপায়ী জীবের অগ্রপদের শেষ অংশ। হাতের বিকাশ হয়েছে এমনভাবে যাতে পাঁচ আঙুল দিয়ে কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে, যেমন কফি কাপ। কিংবা কিবোর্ডে টাইপ করতে পারে। ওর বিশ্বাস, মানুষের মনুষ্যত্বের পেছনে মূল অবদান এই হাতের। এজন্যই জ্যোতিষীরা হাতের রেখা পড়ার চেষ্টা করে। রেখাগুলো নাকি প্রত্যেকটা মানুষের ব্যক্তিত্ব আর ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। হাত হলো অনেকটা আয়নার মত, যা দিয়ে একজন মানুষের অতীত আর ভবিষ্যৎ দেখা যায়।

    ছোটবেলা থেকেই সিনোহারী হাত পছন্দ করে। হাতের প্রতি ওর আকর্ষণ এতটাই বেশি ছিল যে ওর বাবা-মা যখন ওকে বাইরে নিয়ে যেতেন, তখন ও লোকজনের মুখের দিকে তাকাত না, তাকাত তাদের হাতের দিকে। হাত যেভাবে নড়াচড়া করে তা ওকে মুগ্ধ করে। হাতের পেশি, পাঁচটা আঙুল, আঙুলের মাথার নখ, নখের মাথার নতুন চাঁদের মত সাদা অংশ-সবকিছু। আর আঙুলের ছাপ তো আছেই, যা কিনা প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রে অনন্য।

    এলিমেন্টারি স্কুলের ছোট ক্লাসে থাকতে সিনোহারা ওর বোনের ফেলে দেয়া পুতুলগুলোর হাত কাটতো। খেয়াল রাখত যেন কেউ আবার দেখে না ফেলে। পুতুলের ছোট ছোট হাতগুলোর নিজের হাতের তালুতে রেখে দেখত। পুতুল ফেলে দিয়ে শুধু হাতগুলো পকেটে নিয়ে ঘুরত। যখনই সুযোগ পেত ছোট ছোট হাতগুলো স্পর্শ করত পকেটে হাত দিয়ে। প্লাস্টিকের ছোট ছোট হাতগুলো ওকে যেসব গল্প বলত তা ওর মা আর শিক্ষকদের কথার চেয়ে অনেক বেশি ছিল।

    এরপর ও বিড়াল আর কুকুরের সামনের পায়ের থাবা কাটা শুরু করে। গাছ ছাঁটার বড় কাঁচিগুলো থাবা কাটার জন্য চমৎকার যন্ত্র। কুকুর বিড়ালের থাবাগুলোও সিনোহারার কাছে দারুন লাগত। মানুষের হাতের তালুতে তুলতুলে প্যাড নেই, তাই ওগুলো ওর কাছে মজার মনে হতো। প্যাডে চাপ দিলে নখ বেরিয়ে আসে, ওগুলোর মধ্যে চুল জন্মায়। থাবা মানুষের হাতের মত কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে না, ওগুলোর বিকাশ হয়েছে অন্যভাবে, অন্য কারনে।

    সিনোহারা ভালো করেই জানত, বেশিরভাগ মানুষ ওর এই বিশ্বাস মানতে পারবে না যে, মানুষের হাতেই তাদের মনুষ্যত্বের সৃষ্টি। ওর আশেপাশের লোকজনকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পেরেছে ও, মানুষ স্রেফ তাদের মাথা আর মুখ থেকে বের হওয়া ফালতু কথা দিয়ে চলে। আস্তে আস্তে ও যখন বড় হলো, চাকরি করা শুরু করল, নিজের চিন্তা ভাবনা নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখতে শিখল। কিন্তু মাঝে মাঝে ও নিজেকে কেবল হাত নিয়ে চিন্তা করতে দেখতে পেত…পাঁচ আঙুলের ডিজাইন, যা কিনা কেবল ঈশ্বরের পক্ষেই তৈরি করা সম্ভব। এই চিন্তা ওর মাথা থেকে কিছুতেই বের হতে চাইত না।

    তারপর এক বসন্তে ও প্রথমবারের মত একটা মানুষের হাত কাটল-একটা বাচ্চার হাত। বাচ্চাটা একটা স্ট্রলারে ঘুমাচ্ছিল। বাচ্চার মা একটু অন্যদিকে গিয়েছিল, আর ও গাছ ছাঁটার কাঁচি দিয়ে কচ করে বাচ্চাটার কব্জি থেকে হাতটা কেটে নেয়।

    কী নরম আর উষ্ণ ছিল ছোট হাতটা! কাটার পর বাচ্চাটা জেগে উঠে চিৎকার করতে থাকে। সেই সাথে হাতটার উষ্ণতাও কমে যেতে থাকে। সিনোহারা বাচ্চার হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। ছোট হাতটা ওর রেফ্রিজারেটরে ভরে রাখে।

    শুধু ঐ বাচ্চাটার হাতটাই একমাত্র নয়। একবার অন্ধকারের মধ্যে সিনোহারা আরেকটা শিশুকে বাড়ি দিয়ে অজ্ঞান করে তারপর তার হাত কেটে নেয়। হাই স্কুলের কিছু ছেলেপেলে আর কয়েকজন বয়স্ক মানুষের হাতও সে কেটেছে। পূর্ণ বয়স্ক মানুষের হাত বেশ মোটা হয়। গাছ ছাঁটার কাঁচি দিয়ে কচ করে কাটা সম্ভব নয়। কাটার জন্য করা খুবই কর্কশ, হাতের কাটা অংশ বিচ্ছিরি দেখাত। ব্যাপারটা সিনোহারার সৌন্দর্য বোধের সাথে একদম খাপ খেত না। কিন্তু সে তো আর হাত কাটার জন্য কাঁধে একটা কুড়াল নিয়ে ঘুরতে পারে না। শেষে মাংস কাটার চাপাতি দিয়ে কাজ চালাতে লাগল। শিকারকে অজ্ঞান করার পর ও নিখুঁত এক কোপে হাড়সহ হাত আলাদা করে ফেলত।

    সিনোহারা কাউকে খুন করেনি। সে সবসময় শুধু ওদের হাতগুলো চাইত, কাউকে খুন করতে চাইত না। অবশ্য হাত ছাড়া বাকি অংশ বাঁচল কি বাঁচল না তাতে ওর কিছু এসে যেত না। ওকে কেউ দেখে না ফেললেই হলো। হাত কেটে নিয়ে সংজ্ঞাহীন দেহগুলো স্রেফ ফেলে রেখে ও চলে আসত।

    খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলো জানিয়েছিল, হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে পাওয়া একজন ভিক্টিমও আক্রমণকারীর চেহারা দেখেনি। ব্যাপারটা সিনোহারার জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল। যদিও আঁধারের মধ্যে গোপনে কাজ সারত ও, কিন্তু ধরা পড়ে যায় কিনা এই নিয়ে সবসময়ই ভয়ে ভয়ে থাকত।

    সিনোহারা হাত ভালবাসত। ওগুলো কেটে আলাদা করতেও ওর ভালো লাগত। শরীরের বাকি অংশ থেকে হাতগুলোকে আলাদা করার পর ওর অন্যরকম একটা নিশ্চিন্ত বোধ হতো। ওর মতে, হাত আলাদা করার ব্যাপারটা আসলেই বেশ সাহসী, নায়কোচিত একটা কাজ ছিল।

    এমন কি ওর কর্মক্ষেত্রেও একটা পুতুলের হাত কেটে নিয়েছিল ও। একটা ছোট সস্তা তুলোর পুতুল। ছোট হওয়ার কারনে পুতুল্টার হাত নিখুঁতভাবে বানানো হয়নি-কোন আঙুল ছিল না, হাতের শেষ ভাগ ছিল মসৃণ, গোলাকার। কারখানায় বানানো পুতুলের হাতের বিকাশ এভাবেই হয়েছিল, আঙুল ছাড়া। ওগুলো কেটে সিনোহারা ওর আর দুনিয়ার মধ্যে তৈরি হওয়া টেনশনের চাপ কমাত। তারপর সবগুলো কাটা হাত নিয়ে রেফ্রিজারেটরের ভেতর সাজিয়ে রাখত। সেটা কাপড়ের পুতুলের হাত হোক আর বিড়াল কুকুরের থাবা হোক, কখনো সেগুলো ফেলত না।

    সিনোহারা একাকি বসবাস করত, কিন্তু ওর বাসাই ওর জীবন ছিল। বাসায় গিয়ে ফ্রিজ খুলে সাজিয়ে রাখা হাতগুলো দেখত। যখন সেগুলো

    স্পর্শ করত, ওর মনে হত সে ওগুলোর মালিকের অতীত দেখতে পাচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে, তাদের জীবনের সব ঘটনা যেন হাতগুলোর মধ্যে জমাট হয়ে আছে। ওগুলো স্পর্শ করার মাধ্যমে ও হাতগুলোর সাথে কথা বলত। হাতগুলো তাকে বলত তাদের মালিকেরা তাদের ব্যবহার করে কী করে প্রেম করেছে, কিভাবে অন্যকে কষ্ট দিয়েছে-সবকিছু।

    খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলো প্রতিদিন সিনোহারার কৃতকর্ম নিয়ে কথা বলত। তারা এটাকে নাম দিয়েছিল-’কাটা হাতের কেস’। নামে সিনোহারার কিছু এসে যেত না। কিন্তু সবাই ওকে ঘৃণা করছে, ওকে একজন অপরাধি হিসেবে দেখছে, এই ব্যাপারটা ওর কাছে ভালো লাগছিল না। সমাজের ভালো খারাপের সংজ্ঞা ওর উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেটা ওর পছন্দ না।

    সন্ধ্যার খবর দেখতে দেখতে সিনোহারা ব্যাপারটা নিয়ে একটা বাচ্চার হাতের সাথে কথা বলল। হাতটা ও রেফ্রিজারেটর থেকে বের করে নিজের হাতে ধরে রেখেছে।

    “তুমি একদম ঠিক কথাই বলেছ,” হাতটার ভাঁজ, পেশি, আঙুলগুলো যেন ওর কথা শুনে এটাই বলল।

    অমনি সিনোহারার রাগ, দুশ্চিন্তা পানি হয়ে গেল। ও টের পেল ভেতর থেকে আবার সাহস মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

    ২

    সকালের ক্লাসে কেমিস্ট্রির টিচার বললেন, “লাঞ্চের সময়ে আমি কেমিস্ট্রি অফিস গোছগাছ করব। কারো হাতে যদি সময় থাকে, আমাকে এসে সাহায্য করলে খুশি হব।”

    টিচারের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল না উনি আসলে আশা করছিলেন যে কেউ সত্যি সত্যি এসে তাকে গোছগাছের কাজে সাহায্য করবে। আসলেও বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রি উনার কথা কানেই তোলেনি। সুতরাং আমি যখন লাঞ্চের সময় উনার অফিসে গিয়ে হাজির হলাম, তখন স্বাভাবিকভাবেই উনি বেশ অবাক হলেন।

    দিনটা ছিল চমৎকার, মনে হচ্ছিল যেন বসন্তের উষ্ণ আলো জানালার বাইরে গলে গলে পড়ছে। কিন্তু কেমিস্ট্রি অফিসের ভেতরটা ছিল বেশ অন্ধকার, আর খানিকটা ঠান্ডা। বাইরে থেকে আসা ছাত্রছাত্রিদের খেলাধুলা আর হাসাহাসির শব্দ পাচ্ছিলাম।

    যাবতিয় কেমিক্যাল, মলিকিউলের মডেল আর ফরমাল্ডিহাইডে সংরক্ষন করা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভর্তি বয়ামের বাক্স দিয়ে কেমিস্ট্রি অফিস ভর্তি ছিল। জানালার পাশে কাঠের ডেস্কগুলোতে নানান ধরনের সাইন্টিফিক বই আর কাগজপত্র রাখা। একটা ডেস্কের উপর পুরাতন মডেলের একটা কম্পিউটার ছিল। বই খাতার আড়ালে লুকিয়ে থেকে উঁকি মারছিল একটা প্রিন্টার। ঘুলঘুলি থেকে আসা আলোতে বাতাসে ভেসে থাকা ধুলো পরিস্কার চোখে পড়ছিল।

    “উমম…প্রথমে চল ময়লাগুলো লেকচার হলে সরিয়ে ফেলা যাক, একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের দিকে ইশারা করলেন। ওটার ভেতর দলামোচা করা কাগজের বলে ভর্তি। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে ময়লার ঝুড়িটা নিয়ে লেকচার হলের দিকে এগুলাম।

    ***

    “কার এত ঠেকা পড়েছে লাঞ্চ বাদ দিয়ে এই কাজ করার?” কেউ একজন আমার পাশ থেকে বিড়বিড় করে বলল, যখন কেমিস্ট্রি টিচার সাহায্য চাইলেন। আমি কি বলেছিলাম মনে নেই, কিন্তু সে আমার উত্তর শুনে হেসেছিল এটুকু মনে আছে। নিশ্চয়ই বোকার মত কিছু একটা বলেছিলাম।

    আমার হাসিখুশি ক্লাসমেটদের সাথে অভিনয় করা আমার জন্য সহজই ছিল। আমি যদি জনপ্রিয় টিভি শো আর অন্যান্য প্রোগ্রাম নিয়ে ঠিক মত কথা বলতে পারি তাহলে তাদের সাথে খাপ খাওয়ানো কোন ব্যাপারই না। সবাই ভাবত আমি মিশুক ধরনের একটা ছেলে। ফলে উটকো ঝামেলা এড়ানো আমার পক্ষে সহজ হতো।

    উটকো ঝামেলাগুলো কি ধরনের? কিন্ডারগার্টেনে থাকতে, আমার মাথায় একবার ভুত চেপেছিল কালো মার্কার দিয়ে পুতুলের মুখ কালো করে দেয়া আর হাত-পা কেটে ফেলা। কিন্তু আশেপাশের মানুষজন এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। আমার মা আর শিক্ষকদের চেহারা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে।

    এরপর থেকে আমি মিথ্যা কথা বলায় পারদর্শি হয়ে উঠলাম। যেমন ধরা যাক, আঁকাআঁকি করার ক্রেয়নের ক্ষেত্রে। কালো ক্রেয়নটা অন্যগুলোর চেয়ে ছোট ছিল, আমি সাবধানতার সাথে বাকি রংগুলোও ছোট করে এক সমানে নিয়ে আসতাম। আঁকাআঁকিতে আমার তেমন একটা আগ্রহ ছিল না, কিন্তু আঁকলে রংধনু, ফুল এইসব হয়তো আঁকতাম। আশেপাশের বড়রা এগুলো দেখে স্বস্তিবোধ করত।

    দুনিয়া কী চায় তা একবার ধরে ফেলায় আমার জন্য সহজ ছিল অন্যদেরকে বোঝানো যে আমার কোন সমস্যা নেই। আমি আমার ক্লাসমেটদের ফালতু গল্পের মধ্যে নিজে থেকে গিয়ে যোগ দিতাম।

    ঐদিন যে আমি কেমিস্ট্রি অফিসে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম তা আমার ক্লাসমেটদের বলিনি। ক্লাসে আমি যার চরিত্রে অভিনয় করি সে এরকম কিছু করবে না। ওরা ভাবতে পারে, গ্রেড বাড়ানোর জন্য এরকম কাজ করছি। আমি সেটা এড়াতে চেয়েছিলাম। তাছাড়া উদার মনে আমি কাজটা করিনি, আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল।

    গুজব শুনেছি যে আমাদের কেমিস্ট্রি টিচার তার কেমিস্ট্রি অফিসের ডেস্কে বসে পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করেন। এমন হতে পারে আবর্জনার ঝুড়িতে তার নোটগুলো পাওয়া যেতে পারে। আমি সেগুলো হাতে পেতে চাইছিলাম।

    প্রথম বর্ষ থেকেই আমি মাঝে মধ্যে এই টিচারকে অফিস পরিস্কারে সাহায্য করে আসছি। তাই আমার জানা আছে তিনি কিভাবে কাজ শুরু করেন-প্রথমে আমাকে বলবেন ময়লাগুলো নিয়ে পাশের লেকচার হলে রেখে আসতে। তারপর আমরা একসাথে অফিস গোছাব। এরপর আবার ময়লা সরানোর সময় তিনিও আমার সাথে হাত লাগাবেন (যে পরিমান আবর্জনা বের হয় তা বহন করতে দু-জনকে লাগে)। গত বছর অন্তত এমনই হয়েছিল।

    তো এখানে সমস্যাটা হলো-ময়লার ঝুড়ি থেকে কাগজগুলো তুলে নেয়ার সময় নেই। তাই আমার একটা প্ল্যানের দরকার ছিল। প্রথমে অন্য ক্লাসরুম থেকে আমি আরেকটা ময়লার ঝুড়ি এনে কেমিস্ট্রি লেকচার হলে লুকিয়ে রাখলাম। তারপর কেমিস্ট্রি অফিসে গিয়ে টিচারকে সাহায্য করতে চাইলাম।

    যদি সবকিছু গত বছরের মতই হয় তাহলে প্রথমে আমাকে ময়লার ঝুড়ি লেকচার হলে বহন করে নিয়ে যেতে হবে। যদি তা না হয় তাহলে কোন এক সময় তার দৃষ্টির আড়ালে আমাকে তা করতে হবে। স্কুলের সব ময়লার ঝুড়ি দেখতে একই রকম, সবগুলোই নীল রঙের। যে কারনে আমার লুকিয়ে রাখা ময়লার ঝুরির সাথে কেমিস্ট্রি অফিসের ময়লার ঝুড়ি গোপনে বদলে ফেলা যাবে।

    আমাদের কাজ শেষ হলে সব ময়লা একসাথে নিয়ে টিচারের চোখের সামনে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হবে। কিন্তু পরীক্ষার নোট ওয়ালা ঝুড়ি কেমিস্ট্রি হলের ডেস্কের তলায় লুকানো থাকবে। পরে আমি সুযোগ মত সেখান থেকে নোটগুলো সরিয়ে নেব।

    আগে যেরকম বলেছি, অফিসে ঢোকার আগেই অন্য ক্লাস রুম থেকে একটা ময়লার ঝুড়ি এনে লেকচার হলে লুকিয়ে রেখেছিলাম। যে রকম আশা করেছিলাম সেরকমই হলো, আগের বছরের মত এবারও টিচার আমাকে অফিসের ময়লার ঝুড়ি নিয়ে লেকচার হলে রাখতে বললেন। সবকিছু মসৃণভাবেই চলছিল।

    আমার প্ল্যান যেন উনি টের না পান সেজন্য যতটা সম্ভব তার নির্দেশ মতই সব কাজ করছিলাম। লেকচার হল আর কেমিস্ট্রি অফিসের মধ্যেই একটা দরজা ছিল, আলাদা করে বাইরে থেকে ঘুরে ঢুকতে হত না।

    এমন সময় প্ল্যানের বাইরে একটা ঘটনা ঘটল। একটু আগে লেকচার হল খালিই ছিল, কিন্তু আমি যখন ময়লা নিয়ে সেখানে গেলাম তখন দেখি রুমের এক কোণায় বসে একটা মেয়ে বই পড়ছে। মেয়েটার চুল লম্বা ঘন কালো। লেকচার হলের হালকা আলোতে তাকে ভুতুড়ে কোন ছায়ার মত লাগছিল দেখতে। ভালো করে তাকিয়ে মেয়েটাকে চিনতে পারলাম। মেয়েটার নাম মোরিনো, বসন্তের টার্মের শুরু থেকে আমার ক্লাসেই পড়ছে।

    মুখ তুলে আমাকে দেখে আবার বইয়ে মনোযোগ দিল সে। দরজা থেকে সবচেয়ে দূরের ডেস্কটায় বসে ছিল। আমি কি করছি না করছি সে ব্যাপারে ওর কোন আগ্রহ ছিল না।

    প্রথমে ভেবেছিলাম, সে-ও বোধহয় সাহায্য করতে এসেছে, কিন্তু না। আমার কেন যেন মনে হলো ও আমার প্ল্যানে কোন বাগড়া দেবে না।

    মোরিনোর সাথে আমার কখনো কথা হয়নি ঠিকই, কিন্তু ওর অস্বাভাবিকতা আমার চোখে পড়েছে। সে কারো সাথে মিশত না। না মেশার কারনে বরং আরো বেশি বেশি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত। ক্লাসে কিছু ছেলেমেয়ে ছিল যারা কিনা হাসিখুশি, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। মোরিনো তাদের উল্টোপথে চলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাত। কেউ তার সাথে কথা বলতে আসলে সে না শোনার ভান করত। একা থাকতে চাইত। একা থাকতে ভালবাসত ও।

    আর এখন সে লেকচার হলের কোনায় বসে বই পড়ছে। আমি ওকে উপেক্ষা করলাম। চুপচাপ লুকানো ময়লার ঝুড়ির সাথে অফিসের ঝুড়ি বদলে ফেললাম। মনে হল না মোরিনো কিছু খেয়াল করেছে।

    তারপর অফিসে ফিরে এলাম, ভাবটা এমন যেন কিছুই হয়নি।

    “ওখানে একটা মেয়ে বসে আছে না? প্রতিদিন লাঞ্চের সময় সে এসে ওখানে বসে থাকে,” কেমিস্ট্রি টিচার বললেন। লেকচার হলটা ছিল স্কুলের সবচেয়ে নিস্তব্ধ স্থান। আলোও কম ছিল সেখানে। আমি বুঝতে পারছিলাম কেন মোরিনো সেখানে যায়। জায়গাটার সাথে আমাদের ক্লাসরুমগুলোর একদমই কোন মিল নেই। জায়গাটা এত চুপচাপ যে মনে হত সময় এসে ওখানে থেমে গিয়েছে। জায়গাটার মধ্যে কেমন জানি একটা অস্বাভাবিকতা ছিল, অনেকটা লাশ কাটা ঘরের মত।

    টিচারের নির্দেশমত আমি সেলফের উপর থেকে বাক্সগুলো নামিয়ে বোতলের ভেতরের কেমিক্যালগুলো পরীক্ষা করে দেখছিলাম।

    অন্যদিকে তিনি কমেপ্রসড বাতাসের একটা ক্যান নিয়ে কম্পিউটারের কিবোর্ডের ধুলো পরিস্কার করছিলেন-লোকটা বেশ খুঁতখুঁতে।

    ঝাড়পোঁছের পুরোটা সময় তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করছিলেন, ময়লার ঝুড়িতে উঁকি দেয়ার সুযোগ ছিল না।

    কাজ শেষ হলে আমরা একগাদা ময়লা টেনে লেকচার হলে নিয়ে গেলাম।

    “আজকাল এরকম লম্বা কালো চুলের মেয়ে দেখাই যায় না, সবাই এখন চুল রং করে,” মোরিনোর দিকে তাকিয়ে টিচার বললেন। মেয়েটার চুলগুলো আসলেই ঘন কালো আর খুবই সুন্দর ছিল। আমি তাকে বললাম যে আমার বোনের চুলও প্রায় একইরকম।

    মোরিনো ওর শুকনো ফ্যাকাসে সাদা হাত দিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল। এত ফ্যাকাসে যে লেকচার হলের হালকা আলোতে মনে হচ্ছিল ওর হাতগুলো রীতিমত জ্বলজ্বল করছিল। দৃশ্যটা এখনো আমার চোখে

    টিচার আর আমি আবর্জনাগুলো নিয়ে ইন্সিনারেটরে পুড়িয়ে ফেললাম। তারপর যে যার দিকে চলে গেলাম। আমি তাড়াতাড়ি লেকচার হলে ফিরে আসলাম। দুপুরের ক্লাস শুরু হওয়ার আগে মাত্র দশ মিনিট বাকি ছিল আমার হাতে।

    হলে ঢুকে দেখি ততক্ষণে মোরিনো চলে গিয়েছে, সম্ভবত ক্লাসেই গিয়েছে। যাক ভালই হল আমার জন্য।

    ডেস্কের নিচে লুকানো ময়লার ঝুড়িটা বের করে আমি ভেতরে হাতরালাম কি আছে দেখার জন্য। সাথে দরজার দিকে একটা চোখ রেখেছিলাম কেউ আসে কিনা দেখার জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যা খুঁজছিলাম সেরকম কিছু ছিল না।

    বরং অদ্ভুত একটা জিনিস পেলাম সেখানে। যত্নের সাথে কাগজের পর কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে রাখা কিছু একটা। কাগজগুলো সরিয়ে আমি একটা পুতুল পেলাম, কবজি থেকে হাতগুলো কাটা।

    ছোট পুতুলটা কাপড়ের তৈরি ছিল। এত ছোট যে হাতের তালুতে এঁটে যায়। পায়ের কোন ক্ষতি হয়নি। ডিজাইন দেখে যা মনে হচ্ছিল তা হল কাটা হাতগুলোতে কোন আঙুল ছিল না। একদম সাধারন ধরনের একটা পুতুল। কিন্তু জিনিসটা আমাকে যা মনে করিয়ে দিল তা হল টিভিতে দেখা কাটা হাতের কেস।

    বিভিন্ন বয়সের শিশু-বুড়ো-নারী-পুরুষকে, যখন তারা রাস্তায় একা হাঁটে, কেউ একজন তাদের অজ্ঞান করে হাতগুলো কেটে নেয়। এমন কি কুকুর-বিড়ালদেরও সামনে থাবা কাটা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। খবরে বলা হচ্ছিল দুটোই একই লোকের কাজ। ঘটনাগুলো এখান থেকে খুব

    একটা দূরে ঘটেনি।

    কেমিস্ট্রি টিচার, মি. সিনোহারা কি পুতুলের হাতগুলো কেটেছেন? কোন রকম খেলা নাকি? না, আমার বিশ্বাস তিনিই এই কাটা হাতের ঘটনাগুলোর পেছনের লোক। যদিও হাত কাটা একটা পুতুল পাওয়া থেকে খুব বেশি অনুমান করা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে হাতগুলো সে কেটেছে সেগুলো ধারে কাছেই কোথাও রেখেছে বলে আমার মনে হয়। আর আমি চিন্তা করলাম, কেন কেমিস্ট্রি টিচার পুতুলের হাতগুলো কাটতে পারেন

    মনে হচ্ছিল তা উড়িয়ে দেয়ার সম্ভাবনা কম। আমার ধারণা ব্যাপারটা স্রেফ তার উদ্যম শক্তির একটা অংশ।

    ***

    হাতকাটা পুতুলটা পাওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই আমি ক্লাসে বসে কাটা হাতের কেসটা নিয়ে চিন্তা করি। মিডটার্ম সামনেই, কিন্তু সেদিকে আমার কোন খেয়াল ছিল না। টিভিতে যেসব ভয়াবহ খবর দেখায়, তার মধ্যে এটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। কালপ্রিটের মত একই কাজ আমিও করতে চাইতাম। আর আমার বিশ্বাস…ঐ মানুষটা ঠিক আমারই মত। কিছু তো পার্থক্য আছেই, কিন্তু তারপরেও কাটা হাতের এই অপরাধির সাথে কোথাও আমার নিজের একটা মিল টের পাচ্ছিলাম।

    সেদিনের পর থেকে আমি প্রায়ই ক্লাসের মাঝের বিরতিতে লেকচার হলের সামনে যোরাঘুরি করতাম যাতে মি. সিনোহারার সাথে দেখা হয়। আমাকে তার মনে ছিল, দেখা হলে হাত নাড়তেন। অল্পবয়সি একজন যুবক, শুকনো ধরনের, মাথায় ছোট ছোট চুল। আমি অনেকবার চিন্তা করেছি কাটা হাতের রহস্যের পেছনে আসলেই এই লোকটা আছে কিনা।

    একবার দেখলাম মি. সিনোহারা লেকচার হলের বাইরে মোরিনোর সাথে কথা বলছেন। মোরিনোর হাতে একটা বই দেখে তিনি বলছিলেন তার সংগ্রহে বইটার পরবর্তি খন্ড আছে। মানসিক ভারসাম্যহীনতার উপর লেখা একটা নন-ফিকশন বই। উত্তরে মোরিনো শুধু বলেছিল “তাই নাকি?” বরাবরের মত ওর চেহারায় কোন অভিব্যক্তি ছিল না।

    ক্লাসে আমি আমার ভন্ডামি চালিয়ে যেতে লাগলাম। সাধারণ একজন হাইস্কুল কিশোর হিসেবে অভিনয় করা, লোকজনের চোখে না পড়া-আমার জন্য সহজ কাজ ছিল। কিন্তু মাথায় সারাক্ষণ কাটা হাতের কেস সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার ঘুরত। এরকম ইন্টারেস্টিং একটা বিষয় বাদ দিয়ে সবার সাথে হাসি খুশি চেহারা করে তারকাদের গুজব নিয়ে কথা বলা বেশ ক্লান্তিদায়ক ছিল। মাঝে মাঝে নিজেকে অপদার্থ মনে হত এত শ্ৰম ক্ষয় করার জন্য।

    দেখা গেল মি. সিনোহারা যেমন বলেছিলেন, মোরিনো আসলেই লেকচার হলে বেশ ভালো সময় কাটায়। যতবার আমি সেখানে উঁকি দিয়েছি, দেখেছি অন্ধকার রুমে সে চুপচাপ বসে আছে।

    ও সবসময় একা থাকত। এমন না যে, ওর সাথে কেউ ঝামেলা করত, কিংবা কোনো ধরনের হেনস্তা করত ওকে। ব্যাপারটা এরকম যে ও ইচ্ছা। করেই সবার সাথে সবরকমের দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করত। ওর পাথরের মত কঠিন নিরবতা দেখলে বোঝা যেত আর দশটা ছেলে মেয়ের আগ্রহের সাথে ওর আগ্রহের বিষয়ের কোনই মিল নেই।

    “জানো নাকি? জুনিয়র হাই স্কুলে থাকতে মোরিনো আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল, একজন আমাকে বলেছিল। সেটা মাথায় আসতেই আমি ওর ফ্যাকাসে সাদা হাতগুলো আবার ভালো করে দেখলাম। ও কেন মরতে চেয়েছিল আমি জানি না, কিন্তু ওর জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা যে সহজ কাজ নয় তা বুঝতে পারছিলাম।

    অভিনয় বন্ধ করে দিলে আমার অবস্থা হয়তো ওর মত গিয়ে দাঁড়াবে। যদি আমার আশেপাশের লোকজন বুঝতে পারে আমি কতটা নিষ্ঠুর আর অনুভূতিহীন তাহলে আমার জীবন কতখানি কঠিন হতে পারে? মনে মনে আমার বর্তমান অবস্থা আর যেটা হতে পারে সেটার তুলনা করলাম-খুব একটা পার্থক্য হবে মনে হলো না। সবদিকেই আমি একা।

    পুতুলটা পাওয়ার তিন দিন পর একটা নতুন পরিকল্পনা দাঁড় করালাম।

    ৩

    মি, সিনোহারার বাসা ছিল একটা নির্জন এলাকায়। সাধারণ দোতলা বাড়ি। বাড়ির পাতলা সাদা দেয়াল সূর্যের আলো পড়ে হলদেটে দেখাত। আশেপাশে কেউ ছিল না, একমাত্র শব্দ যেটা পাওয়া যাচ্ছিল সেটা ছিল মাথার উপর দিয়ে প্লেন উড়ে যাওয়ার শব্দ।

    দ্বিতীয় বর্ষের হোমরুম টিচার ছিলেন মি. সিনোহারা। ঐ ক্লাসের একজনকে আমি চিনতাম। সে আমাকে ঠিকানা দিয়ে জোর গলায় বলেছিল টিচার সেখানে একাই থাকেন।

    হাতঘড়ি দেখলাম। মঙ্গলবার সব শিক্ষকদের মিটিঙে থাকার কথা। সুতরাং তিনি বাড়ি ফেরার আগে অনেকটা সময় হাতে পাচ্ছি।

    কেউ দেখছে না নিশ্চিত হয়ে গেট দিয়ে ঢুকে বাড়ির পেছনের দিকে গেলাম। একটা ছোট উঠোনের মত জায়গা, কাপড় ঝুলানোর ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে। উঠোনের দিকে মুখ করা একটা বড় জানালা ছিল, কিন্তু ভেতর থেকে লক করা। হাতে একটা ভোয়ালে পেঁচিয়ে ঘুষি দিয়ে জানালা ভাঙলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম বোঝার জন্য কেউ কিছু শুনেছে কিনা, তারপর লক খুলে ঢুকলাম ভেতরে। পা থেকে জুতো আগেই খুলে নিয়েছি।

    কাটা হাতের কেসের কালপ্রিটটা হাত কেটে সাথে করে নিয়ে যেত। কেউ জানে না হাতগুলোর কি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করে ওগুলো দেখে অপরাধি লোকটা আনন্দ পায়, আবার কেউ কেউ মনে করে সে ওগুলো রান্না করে খায়। সত্যিটা আসলে কি তা কেউই জানে না। যেটাই হোক, অপরাধির বাসায় কোন না কোন প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। আজ রাতে আমার কাজ হল মি. সিনোহারার বাসায় সেরকম কোন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজে দেখা।

    জানালা ভেঙে যে রুমে ঢুকেছি সেটা ছিল লিভিং রুম। মেঝেতে কাঁচের টুকরো পড়েছিল, তাই সাবধানে পা ফেললাম। বাসার সবকিছু সুন্দর করে গোছানো, এমনকি টেবিলের উপর ম্যাগাজিন আর রিমোটগুলোও পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা।

    আমি যতটা সম্ভব কম শব্দ করার চেষ্টা করলাম। ভয় হচ্ছিল মি. সিনোহারা হয়তো তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে সামনের দরজায় চাবি ঢোকানোর শব্দ যেন আমার কান এড়িয়ে না যায়। আমাকে দেখে ফেলার আগেই দৌড়ে পালাতে হবে।

    মেঝে পলিস করা ছিল। যদিও আলো নেভানো ছিল আর চারপাশে অন্ধকার, তারপরেও জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় ভালো মতই সব দেখতে পারছিলাম।

    সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় খেয়াল রাখলাম দেয়াল কিংবা রেলিঙে যেন হাত না লাগে। মি. সিনোহারা যদি আসলেই অপরাধি হয়ে থাকেন, তাহলে হাতের ছাপ কোথাও পেলেও সম্ভবত পুলিশকে জানাবেন না। কিন্তু তারপরেও আমি যে এখানে এসেছিলাম তার কোন প্রমাণ রেখে যেতে চাই না।

    দোতালার বেডরুমে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার আর কিছু বুকশেলফ ছিল। বইগুলো সাইজ অনুসারে সাজানো। কোথাও এক বিন্দু ধুলোও পড়ে নেই।

    মি. সিনোহারা যে হাত কাটা অপরাধি তার কোথাও কোন সূত্র নেই।

    আমি আমার ডান হাতে আঙুল চেপে পালস পরীক্ষা করলাম। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু দ্রুত ছিল। এর অর্থ আমার টেনশন হচ্ছিল। আচ্ছা, ডাক্তাররা হাত কাটা লোকজনের পালস কিভাবে পরীক্ষা করেন?

    ঘড়ি দেখলাম। মিটিং এতক্ষণে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। মি, সিনোহারা যদি স্কুল থেকে বের হয়ে সরাসরি বাসায় ফেরেন, তাহলে আমার উচিত হবে এখনই বেরিয়ে যাওয়া।

    দোতালার অন্য রুমগুলি চেক করলাম, দুটো তাতামি ফ্লোরের রুমে খালি শেলফ আর ওয়ারড্রব। মি. সিনোহারা কাউকে আক্রমণ করেছেন তার কোন চিহ্ন নেই কোথাও।

    প্রত্যেকটা রুম চেক করার পর আমি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছি কোন কিছু ভুল করিনি কোথাও, স্টুডেন্ট আইডি, ইউনিফর্মের বোতাম, টেক্সটবুক কিংবা কোন মোজা। আমাকে চিনে ফেলতে পারে এরকম কিছু ফেলে যাওয়া হবে বিশাল রকমের ভুল। ঠিকমত মনোযোগ দিলে সেরকম ভুল হওয়ার সুযোগ কম।

    কোন কিছু ফেলে যাইনি নিশ্চিত হয়ে আমি আবার নিচে নেমে এসে কিচেনে ঢুকলাম।

    মি. সিনোহারা কি নিজে রান্না করেন? খুব বেশি থালাবাসন ছিল না, যা ছিল তা সুন্দর করে সাজানো। সিঙ্কে কিছু রাখা নেই। দেখে মনে হচ্ছিল কেনার পর থেকেই কাপ আর রান্নার জিনিসপত্র এনে কিচেনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, কখনো ব্যবহার করা হয়নি।

    টেবিলের উপর একটা রাইস কুকার ছিল, একা একজন মানুষের জন্য সাইজটা একটু বড়ই বলা যায়। উনার পরিবার কিংবা অতীত সম্পর্কে কোন কিছু আমার জানা নেই। আগে কি আরো কোন আত্মীয় সাথে থাকত? না হলে এরকম বড় রাইস কুকার কেনার অর্থ কি?

    জানালা দিয়ে আসা আলোতে স্টেইনলেস স্টিলের সিঙ্ক একদম চকচক করছিল। একমাত্র শব্দ যেটা কানে আসছিল তা হল রেফ্রিজারেটর থেকে আসা গুনগুন শব্দ। নয়তো চারদিকে একদম কেমিস্ট্রি লেকচার হলের মত নিরবতা বিরাজ করছে। আমার সে রকমই অনুভূতি হচ্ছিল।

    কিচেনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি আবার আমার পালস পরীক্ষা করলাম। কব্জির চামড়ার নিচে রক্তের শিরাগুলো অবিচল রক্ত বহন করছে। পালস এখন স্বাভাবিক। তারপর আবার হঠাৎ দ্রুত হয়ে গেল, যেন যে কোন সময় ফেটে যাবে।

    নাকে একটা বাজে গন্ধ আসছিল। মনে হচ্ছে কোন কিছুতে পচন ধরেছে, ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করেছে। গন্ধটা পেয়েই আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।

    গন্ধটা কোত্থেকে আসছে তা খুঁজতে লাগলাম। কাপ বোর্ড কিংবা ড্রয়ারে কিছু ছিল না। রেফ্রিজারেটরের উপর দৃষ্টি গিয়ে স্থির হল আমার।

    হাতের ছাপ যেন না পড়ে সেজন্য রুমাল দিয়ে রেফ্রিজারেটরের হাতল ধরে টানলাম। বাজে গন্ধটা বেড়ে গেল। আমার অনুমানই সঠিক-মি, সিনোহারাই কাটা হাতের অধি।

    ফ্রিজের আলোতে দেখা গেল ভেতরে সেলফের উপর সারি সারি কাটা হাত। আঙুল আর নখ সমান করে সেগুলো পিয়ানোর কি-এর মত করে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পেছন দিকে কিছু ছোট বাটিতে ককর আর বিড়ালের সামনের পায়ের থাবাগুলো রাখা। লেকচার হলের ময়লার ঝুড়িতে পাওয়া পুতুলের হাতগুলো ফ্রিজের দরজায় খুঁজে পেলাম। ওগুলো দেখে মনে হচ্ছিল কাপড়ের বল, কিন্তু রং পুতুলের মত হওয়ায় চিনতে অসুবিধা হয়নি।

    অনেক আগে থেকেই আমার ধারণা ছিল অপরাধি নিশ্চয়ই হাতগুলো সংরক্ষন করছে। এই ধারনার পেছনে কোন ভিত্তি না থাকলেও আমার মনে হয়েছিল, কারন আমি হলেও একই কাজ করতাম। আর দেখা গেল আমার ধারনাই সঠিক।

    একটা হাত তুলে নিলাম, একজন নারীর হাত। হাতের লাল নেইলপলিশ জায়গায় জায়গায় উঠে গিয়েছিল, আর ঠান্ডায় জমে বেশ ভারিও লাগছিল হাতটাকে।

    মৃত ত্বকের স্পর্শ…না ঠিক মৃত বলা যাবে না, সব ভিক্টিমই বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে, শুধু তাদের হাতগুলো নেই…কিন্তু এটাও ঠিক যে তাদের কাটা হাত তো মৃতই..

    ওখানে ডান-বাম সব রকমের হাতই ছিল। কিছু হাতের নখ কালো হয়ে গেছে। কিছু হাতের ত্বক তখনো সুন্দর মসৃণ।

    হাতগুলোর উপর নিজের হাত বোলালাম। মনে হচ্ছিল আমি যেন মি. সিনোহারার ভেতরটা ফুটো করে দেখতে পাচ্ছি। সাধারন মানুষ বিষয়টা বুঝতে পারবে না, আমি নিশ্চিত মি. সিনোহারা নিজেও জানেন কেউ যে তাকে বুঝতে পারবে না। কিন্তু আমার জন্য কল্পনা করা সহজ ছিল, তিনি একা এই কিচেনে দাঁড়িয়ে তার হাতের সংগ্রহের উপর হাত বোলাচ্ছেন।

    হাতগুলো যেহেতু তার রেফ্রিজারেটরে রাখা, তিনিই হাত কাটার অপরাধি। পুলিশকে খবরটা জানানোর কোন ইচ্ছা আমার নেই। হয়তো আমার উচিত তাদের জানানো, কিন্তু সেরকম কোন আগ্রহ আমার ছিল না। বরং আমার অন্য একটা পরিকল্পনা ছিল।

    আমি নিজেও কারো হাত কাটতে চাইছিলাম। মি. সিনোহারার সংগ্রহ দেখার পর ইচ্ছেটা এখন আরো বেড়ে গেল।

    ফ্রিজের ভেতর তাকালাম। কত ধরনের হাত সেখানে রাখা। যে কোনটা আমি নিতে পারতাম, কিন্তু যে কোন একটা নিলেই হবে না, বিশেষ একজনের হাত আমি চাই। সাথে আনা ব্যাগে হাতগুলো সব ভরে নিলাম।

    ***

    স্কুলের কাজ শেষে সিনোহারা যখন বাসায় ফিরল তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বাসায় ঢুকে লিভিং রুমের দিকে যেতে গিয়ে সে টের পেল কিছু একটা ঠিক নেই। জানালাটা ভাঙা। মেঝেতে কাঁচের গুঁড়ো পড়ে আছে। জানালাটা খোলা থাকায় ঘরের ভেতর ঠান্ডা বাতাস ঢুকছিল। কেউ একজন চুরি করে ওর বাসায় ঢুকেছে!

    প্রথম যে জিনিসটা সিনোহারার মাথায় এল তা হল রেফ্রিজারেটরের ভেতর রাখা হাতগুলো। সোজা কিচেনে গিয়ে রেফ্রিজারেটর খুলল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সব হাত উধাও। সেদিন সকালেও সে সব হাত সেখানে দেখে গিয়েছে। মানুষের হাত, পুতুলের হাত, পশুর থাবা সব উধাও! ফ্রিজ একদম খালি। শুধু হাতের সাথে রাখা অল্প কিছু খাবার পড়ে ছিল।

    কিছু একটা ওকে খোঁচাচ্ছিল, কিন্তু বুঝতে পারছিল না সেটা কি। লিভিং রুমের কাঁচের টুকরাগুলো পরিস্কার করা দরকার। হাত হারানোর শোকে ওর মাথা তখন ঠিকমত কাজ করছিল না।

    দোতলায় গিয়ে কম্পিউটার অন করে সামনে বসল।

    কেউ একজন জানালা ভেঙে ঢুকে সব হাত চুরি করে নিয়ে গেছে, সবগুলো হাত।

    এক ফোঁটা পানি কম্পিউটারের ডেস্কের উপর পড়ল। সিনোহারা হঠাৎ উপলদ্ধি করল সে কাঁদছে।

    তার পুরো জীবনে সে কখনো কোন মানুষের সাথে এতটা অন্তরঙ্গ হতে পারেনি যতটা এই হাতগুলোর সাথে হয়েছিল। কেউ যদি তাকে হাতগুলোর সাথে দেখত তাহলে মনে করত সে সেফ চুপচাপ বসে আছে, কিন্তু না, সিনোহারা আসলে ঐ ঠান্ডা নির্বাক হাতগুলোর সাথে কথোপকথন করত, ওগুলোকে স্পর্শ করার মাধ্যমে।

    সারা শরীর জুড়ে এমনভাবে ক্রোধের ঢেউ উঠে এল যে সিনোহারার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। পুলিশকে এই চুরির খবর জানানো সম্ভব নয়। কিন্তু হাতগুলো যে-ই নিয়ে থাক সিনোহারা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে।

    সে কখনো কাউকে খুন করেনি, কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম ঘটবে। যেভাবেই হোক সে এই চোরকে ধরবেই। ওর হাতগুলোও সে কেটে নেবে, তারপর গলা টিপে মারবে। কিংবা বুকে ছুরি বসিয়ে দেবে।

    কিন্তু কথা হলো, চোরকে সে কিভাবে খুঁজে পাবে? সিনোহারা ডেস্কে কনুই রেখে চিন্তা করতে লাগল।

    কিবোর্ডটা নোংরা হয়ে ছিল। পাশে রাখা কমপ্রেসড বাতাসের ক্যানের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল সিনোহারা। ওর চোখ জোড়া কিবোর্ডের উপর আটকে গেল।

    কোন সন্দেহ নেই চোর জিনিসটা ফেলে গিয়েছে। আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। জিনিসটা খুবই ছোট, সহজে চোখ এড়িয়ে যায়। ভাগ্য ভালো সিনোহারা সেটা খেয়াল করেছে।

    এখন সে বুঝতে পারল রেফ্রিজারেটরের সামনে কি কারনে মনটা খুতখুত করছিল তখন। কারণটা একদম পরিস্কার। অবহেলা করে হাত চোর একটা ভুল করেছে আর সেই ছোট্ট ভুলই চোরের পরিচয় ফাস করে দিয়েছে…

    ৪

    পরদিন সকালে কাজে যাওয়ার সময় সিনোহারা সাথে একটা চাপাতি নিল। এই চাপাতি সে হাত কাটার কাজে ব্যবহার করে। জিনিসটা বেশি বড় না, ব্যাগে সহজে লুকিয়ে রাখা যায়। অন্য শিক্ষকদের সাথে কুশল বিনিময়ের সময় তারা টেরও পেল না সিনোহারার ব্যাগে কি আছে।

    সকালবেলাটা সবসময়ই দৌড়ের উপর থাকতে হয়। টিচারদের রুমের বাইরে ছাত্রছাত্রিরা দ্রুত চলাফেরা করছিল। প্রথম সেমিস্টারের মিডটার্ম প্রায় চলে এসেছে, যার যার ডেস্কে বসে শিক্ষকরা প্রশ্নপত্র তৈরি করতে ব্যস্ত।

    শিক্ষকদের একজন সিনোহারাকে জিজ্ঞেস করলেন ওর প্রশ্নপত্রের কি অবস্থা। ও হেসে উত্তর দিল। জীবনটা সে এইরকম হেসেই পার করছে। লোকগুলোকে আসলে ওর অসহ্য লাগে।

    হাত, হাত, হাত।

    হাতগুলো ওর কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে হাত, তারপর মানুষ। মানুষের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোন মানে নেই।

    সকালে সিনোহারার ক্লাস ছিল, তাই হাত চোরের সাথে দেখা করার সময় পায়নি। কিন্তু সে জানে কে চোর। চোরকে ধরে আগে জানতে হবে হাতগুলো কোথায় আছে।

    মাত্র এক রাত পার হয়েছে, সিনোহারা নিজেকে শান্ত করতে চাইছে। এই ভেবে যে হাতগুলো এখনো নিরাপদে আছে। কোথায় আছে জানার পর সে চাপাতি দিয়ে চোরের হাতগুলো কেটে নেবে। শরীরের সাথে হাতগুলোর মারা যাওয়ার কোন মানে নেই। তাই আগে হাতগুলো কেটে নিতে হবে।

    সকালের শেষ ক্লাস ছিল হোম রুম ক্লাস। সবাই দ্রুত হাতে ব্ল্যাক বোর্ড থেকে তার লেখা খাতায় তুলে নিচ্ছিল। ক্লাসের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিয়াল্লিশ। হাতের সংখ্যা আটচল্লিশ।১১১১১

    সিনোহারা বুঝিয়ে বলল মিডটার্মে কী কী থাকবে, কিন্তু ওর মাথায় খালি চুরি যাওয়া হাতগুলোর চিন্তা ঘুরছিল। চোর খাবার রেখে ওর হাতগুলো নিয়ে গিয়েছে। সিনোহারা সাথে সাথে ব্যাপারটা খেয়াল করলেও তখন এর অর্থ বুঝেতে পারেনি।

    অবশেষে ঘন্টা বাজল, ক্লাস শেষ হলো। সকালের সব ক্লাস শেষ। লাঞ্চের সময় এখন।

    সিনোহারা রুম ছেড়ে বের হলো। ব্যাগ থেকে চাপাতিটা আনতে যাচ্ছে। টিচারদের অফিসে ওর ব্যাগটা রাখা। হলওয়েতে ভিড় আর চিৎকার চেঁচামেচি, কিন্তু এসবের কিছুই সিনোহারার কানে ঢুকছিল না।

    সে কয়েক মিনিট টিচারদের রুমে অপেক্ষা করে কেমিস্ট্রি হলের দিকে পা বাড়াল।

    ***

    লাঞ্চের সময় শুরু হতেই আমি কেমিস্ট্রি লেকচার হলের দিকে পা বাড়ালাম। দরজা খুলে দেখি ভেতরে কেউ নেই, ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সাথে সাথে বাইরের সব আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল, ভেতরের বাতাস মনে হয় স্থির হয়ে আছে। যেন সময় এখানে এসে থেমে গিয়েছে।

    পালস মাপলাম, অনেক দ্রুত চলছে। চামড়া শরীরের উপর চেপে বসেছে মনে হচ্ছিল। অনেক টেনশন হচ্ছিল।

    গতকাল রাতে বাসায় ফেরার পর মি, সিনোহারা কি করলেন? যখন দেখলেন হাতগুলো নেই তখন তার মনের অবস্থা কি দাঁড়িয়েছিল? তিনি কি অনেক রেগে গিয়েছিলেন? অনুমান করা ছাড়া আমার কিছু করার নেই।

    সকালে তাকে আমি দেখিনি-দেখলেও ভান করতাম যেন কিছু জানি। তিনি আমাকে ধরতে পারবেন না, যদিনা আমি কোন ভুল করে থাকি। ভুল করে থাকলে খবর আছে। কিন্তু আমি প্রায় নিশ্চিত, তিনি জানেন না হাতগুলো আমি চুরি করেছি। কিন্তু আপাতত প্রার্থনা করা ছাড়া পুরোপুরি নিশ্চিত হবার কোন উপায় নেই।

    হতে পারে আমি হয়তো কোন ভুল করেছি, খেয়াল করিনি-কিন্তু সেটা করে থাকলেও এখন জানার কোন উপায় নেই। যদি করেই থাকি তাহলে মি, সিনোহারা অবশ্যই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ছুটে আসবেন। সেক্ষেত্রে আমার জীবন এখন হুমকির সম্মুখীন।

    নির্জন লেকচার হলে, অন্ধকারের ভেতর দাঁড়িয়ে আমি যখন এসব আকাশ পাতাল ভাবছিলাম তখন শুনতে পেলাম কেউ একজন দরজার ঠিক বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।

    ***

    দরজা খুলে সিনোহারা লেকচার হলে ঢুকল। ভেতরে একজনকে দেখা যাচ্ছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সিনোহারার রাগ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

    ইচ্ছা হচ্ছিল গিয়ে ওর গলা চেপে ধরে, কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করল। মুখে হাসি ফুটিয়ে সামনে গেল। ওর অন্য পরিকল্পনা আছে। ভান করতে হবে যেন ও কিছু জানে না।

    “হ্যালো মি. সিনোহারা,” কথাটা শুনে সিনোহারা মনে মনে হাসল, বাহ বাহ দারুন অভিনয়। নিশ্চয়ই সিনোহারাকে দেখে মনে মনে হাসছে। হয়তো হাত হারিয়ে সিনোহারা কেমন কষ্ট পাচ্ছে তা দেখার জন্যই এখানে বসে আছে। রাগ লুকিয়ে সিনোহারা ওর কাছাকাছি এগিয়ে গেল। প্ল্যানটা সফল করতে ওর শিকারের কাছাকাছি যেতে হবে। কোনভাবে টের পেতে দেয়া যাবে না যে ও চোরকে চিনে ফেলেছে।

    বোকাটা বুঝতে পারেনি, বুঝলে এতক্ষণে উঠে দৌড় দিত। সিনোহারা কোন সন্দেহ না জাগিয়ে ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। চোর পুতুলের হাতগুলোও সাথে করে নিয়ে গিয়েছে। ওগুলো যে হাত তা কারোর বুঝতে পারার কথা না। কারন ওগুলোতে কোন আঙুল ছিল না, স্রেফ কাপড় দিয়ে পেঁচানো তুলোর বল। কিন্তু তারপরেও চোর সেগুলো হাতগুলোর সাথে নিয়ে গিয়েছে।

    শুধুমাত্র একজনের পক্ষেই জানা সম্ভব, ওগুলো হাত…এমন একজন যে ঘটনাক্রমে হাত কাটা পুতুলটা খুঁজে পেয়েছে। পুতুলটা পাওয়ামাত্র নিশ্চয়ই সে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে বুঝে ফেলেছে যে, সিনোহারাই কাটা হাতের কেসের কালপ্রিট।

    সিনোহারা ওর কাঁধে হাত রাখল। মেয়েটা আস্তে করে ওর দিকে ফিরল। “কি ব্যাপার?”

    ভালো অভিনয় করতে পারে, সিনোহারা ভাবল।

    সে কেমিস্ট্রি অফিসের ময়লার ঝুড়িতে পুতুলটা ফেলে দিয়েছিল। মোরিনো ছাড়া আর কারো সেটা হাতে পাওয়ার কথা নয়। ল্যাব পরিস্কার করার পুরোটা সময় সে লেকচার হলে ছিল। অন্য যে ছেলেটা পরিস্কার করার কাজে সাহায্য করছিল তার সময় ছিল না ময়লার ঝুড়ি ঘেঁটে দেখার।

    “মি. সিনোহারা আপনার হাতটা সরান প্লিজ। আমার পড়ায় সমস্যা হচ্ছে।”

    এই মেয়েটা সবসময় লেকচার হলের কোণায় বসে বই পড়ে। ও ভুরু কুচকাল-মেয়েটার চেহারায় এতটা অভিব্যক্তিও সিনোহারা আগে দেখেনি।

    আগেরদিন সিনোহারা কিবোর্ড পরিস্কার করতে গিয়ে একটা লম্বা কালো চুল পেয়েছিল। সারা বাড়ির সব জায়গা বাদ দিয়ে চুলটাকে উড়ে এসে কিবোর্ডের উপরই পড়তে হল? ব্যাপারটা কি কাকতালীয় কিছু হওয়া সম্ভব? সিনোহারার নিজের চুল ছোট। সুতরাং চুলটা তার নিজের হতে পারে না। তার মানে অনুপ্রবেশকারী যেই ছিল তার ছিল লম্বা চুল।

    আর বইয়ের সেলফে…মেয়েটা যেই বইটা পড়ছে তার পরবর্তি খন্ড ওর সেলফে ছিল। কিন্তু সেলফে একটু বেরিয়ে ছিল বইটা। ভালো করে খেয়াল না করলে চোখে পড়বে না। সিনোহারা সবসময়ই ওর বইগুলো একদম নিখুঁতভাবে গুছিয়ে রাখে, কোন বই পাঁচ মিলিমিটার বেরিয়ে থাকবে তা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই মেয়েটা বইটা দেখতে পেয়ে বের করে হাতে নিয়েছিল।

    ওর মনে কোন সন্দেহ নেই মোরিনোই ওর হাতগুলো চুরি করেছে।

    সিনোহারা মোরিনোর কাঁধে ওর মুষ্টি আরো জোরালো করল, যেন ভেঙেই ফেলবে।

    মোরিনো সঙ্কুচিত হয়ে গেল।

    “হাতগুলো কোথায় রেখেছ বল আমাকে,” যতটা সম্ভব ভদ্র গলায় সিনোহারা হুকুম দিল।

    কিন্তু মোরিনো তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গেল, বলল ব্যথা পাচ্ছে সে। যে বইটা পড়ছিল সেটা মাটিতে পড়ে গেল।

    “হাতগুলো কোথায়?” সে আবার প্রশ্ন করল, চাপ একটু কমাল যাতে মেয়েটার কানে কথা যায়। মেয়েটা এমনভাবে মাথা নাড়ল যেন ও কি নিয়ে কথা বলছে বুঝতে পারছে না।

    না জানার ভান করছে, ভাবল সিনোহারা। সাথে সাথে হাত দিয়ে মেয়েটার সরু গলাটা টিপে ধরল সে।

    মোরিনোর চোখগুলো মনে হচ্ছিল বেরিয়ে আসবে, অবাক হয়ে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায়। সিনোহারা ওকে খুন করতে যাচ্ছে, কেউ বাঁচাতে পারবে না। ও হাতের চাপ বাড়াল। মিনিট খানেকের মধ্যেই মেয়েটার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসবে-ব্যাপারটা চিন্তা করে ও একটু উৎফুল্ল বোধ করছিল। এমন সময় মেয়েটার হাতে একটা ছোট সিলিন্ডার চোখে পড়ল, কোন ধরনের স্পে। কিন্তু যখন সে খেয়াল করল তখন যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে, মোরিনো ওর চোখের দিকে তাক করে স্প্রে করে দিয়েছে। হিস হিস শব্দের সাথে মনে হল ওর চোখগুলোতে আগুন ধরে গেল।

    ***

    মোরিনোর সাথে সবসময় একটা মরিচের পানির স্প্রে ক্যান থাকে। সে সেটা মি. সিনোহারার মুখের উপর স্প্রে করে দিল। তারপর সাহায্য চাওয়ার আগে একটা চেয়ার তুলে তার মাথায় বাড়ি লাগাল। কোন চিৎকার করেনি-স্রেফ শান্তভাবে জোর গলায় সাহায্য চেয়েছে।

    এক মিনিট পর কিছু শিক্ষার্থী আর শিক্ষকেরা দৌড়ে এল। ভিড়ের মাঝখানে পড়ে মি. সিনোহারা তার চোখ ডলছিলেন।

    পোডিয়ামের নিচের লুকানো জায়গা থেকে বের হতে আমাকে ভিড় সরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো।

    উপসংহার

    মি. সিনোহারা গ্রেফতার হলেন। কিন্তু কাটা হাতের কেসের অপরাধি হিসেবে নয়। বরং এরচেয়ে অনেক কম একটা অপরাধি জন্য শাস্তি দেয়া হল তাকে। কেউ তার আসল অপরাধ টের পায়নি, অন্তত এখন পর্যন্ত নয়।

    তিনি আর আমাদের শিক্ষক নেই, স্কুল ছাড়তে হয়েছে তাকে। এখন পর্যন্ত নতুন কোন হাত কাটা ভিক্টিম পাওয়া যায়নি।

    সে হাতগুলো আমি চুরি করেছিলাম সেগুলো বাড়ির পেছনের উঠোনের মাটি খুঁড়ে চাপা দিয়েছি। ওগুলোর কোন প্রয়োজন নেই আমার। হাতগুলোর প্রতি উনার যেরকম ভালবাসা ছিল, আমার সেরকম কিছু ছিল না।

    আমি তাকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলাম যে মোরিনো তার হাতগুলো চুরি করেছে।

    যখন আমি রেফ্রিজারেটরে হাতগুলো দেখলাম তখন নিশ্চিত হয়েছিলাম আমার ধারণা মতই তিনি হাত কেটে সংগ্রহে রাখেন। তার বাসায় ঢোকার আগেই আমার পরিকল্পনা ছিল পুতুলের হাতগুলো ব্যবহার করে তার সন্দেহ মোরিনোর উপর ফেলার। আমি খুশি যে তিনি বুদ্ধিমানের মত (?) পুতুলের হাতের সূত্র ধরতে পেরেছিলেন। আমি যে ময়লার ঝুড়ি অদল বদল করতাম সেটা তার জানা ছিল না।

    কালো চুলটাও আমি ফেলে এসেছিলাম-মোরিনোর চুল যেরকম দেখতে। আসলে সেটা ছিল আমার বোনের চুল। আমার মনে আছে মি, সিনোহারা তার অফিসের কম্পিউটার কমপ্রেসড বাতাসের ক্যান দিয়ে পরিস্কার করছিলেন। সুতরাং আমি আশা করছিলাম বাসার কম্পিউটারের কিবোর্ডের উপর থাকা চুলটা তার চোখে পড়বে।

    সেটা যদি চোখে নাও পড়ে সেজন্য বাড়তি ব্যবস্থা ছিল বইটা একটু এগিয়ে রাখা।

    আমার ইচ্ছা ছিল মি. সিনোহারাকে নিশ্চিত করা যে মোরিনো তার হাতগুলো চুরি করেছে, যাতে তিনি ওর হাতগুলো কেটে ওকে খুন করে ফেলেন। তাহলেই পরিকল্পনাটা সম্পূর্ণ হতো। তারপর তিনি কাটা হাতগুলো ফ্রিজে নিয়ে রাখতেন আর আমি সেগুলো চুরি করতাম। অবশ্য এই পরিকল্পনায় কিছু ফুটো ছিল। এমন কোন গ্যারান্টি ছিল না যে, তিনি ওকে খুন করলেও হাতগুলো বাসায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু ভালো সম্ভাবনা ছিল।

    মোরিনোর সুন্দর সাদা ফ্যাকাসে হাতগুলো শুধু পেতে চাইছিলাম আমি।

    “তুমি কি আমাকে শেখাবে কি করে এরকম হাসি দাও?” পরেরদিন সে আমাকে প্রশ্ন করল। সেবারই প্রথম মোরিনো আমার সাথে কথা বলে।

    কারো সাথে কথা বলার সময় হাসি আমি। কিন্তু ভেতরে আমার কোন অভিব্যক্তি থাকে না-মোরিনো কোনভাবে সেটা ধরতে পেরেছিল। যে। অভিনয় আর কেউ বুঝতে পারেনি সেটা ওর চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি।

    এরপর থেকে আমরা দুজনই কথা বলার জন্য কোন সঙ্গি পেলাম। আমাদের সম্পর্ক অনেকটাই শীতল ধরনের, বন্ধুত্ব বললে ভুল বলা হবে-কিন্তু ওর সাথে কথা বলার সময় আমার কোন অভিনয় করার প্রয়োজন পড়ত না। অভিব্যক্তিহীন চেহারায় থাকতে পারতাম। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে একটা তৃপ্তিকর অনাগ্রহ ধরনের ব্যাপার ছিল, যে কারনে আমি আমার অমানুষিক আর অনুভূতিহীন চেহারা প্রকাশ করতে পারতাম।

    ***

    গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হতে না হতেই সবাই কাটা হাতের কেসের কথা বেমালুম ভুলে গেল। এদিকে আমাদের দ্বিতীয় সেমি. শুরু হলো।

    সূর্যাস্তের আলোয় ক্লাসের ভেতরটা হলুদ হয়ে আছে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস এসে আমার সামনে বসা মোরিনোর কালো লম্বা চুলগুলো নিয়ে খেলছে।

    “তো এই মুভিটায় সত্যিকারের বিকলাঙ্গদের অভিনয় করানো হয়েছে। কাহিনিটাও অদ্ভুত, ওরা একটা দেহাবশেষ বহন করছিল, “

    ও যখন বলছিল, আমি তখন বিড়বিড় করে মুভিটার নাম বললাম। মোরিনোকে একটু অবাক দেখাল। ওর অভিব্যক্তিতে তেমন কোন বদল না হলেও আমি ঠিকই ধরতে পেরেছিলাম।

    “একদম ঠিক।”

    একজন জার্মান মহিলা মুভিটা বানিয়েছেন। আমি যত মানুষকে চিনি তার মধ্যে খালি মোরিনো আর আমারই এই ধরনের অস্বাভাবিক ব্যাপার স্যাপারে আগ্রহ রয়েছে।

    “তোমার কি কাটা হাতের কেসের কথা মনে আছে?” আমি প্রশ্ন করলাম।

    “গত বসন্তের সময়ে যেটা ঘটেছিল?”

    “সেসময় তুমি যদি ভিক্টিমদের একজন হতে তাহলে এখন কী করতে?”

    মোরিনো ওর হাতগুলোর দিকে তাকাল। “ঘড়ি পরা অনেক কঠিন হয়ে যেত। কেন জিজ্ঞেস করছ?” বলল সে, একটু দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল ওকে।

    ওর কোন ধারণা নেই যে লোকটাকে ও ধরাশায়ী করেছিল কাটা হাতের কেসের অপরাধি সে-ই ছিল। আমি মাঝে মাঝে ওর হাতগুলোর দিকে নজর দেই। হয়তো ভালই হয়েছে মি. সিনোহারা ওগুলো কাটতে পারেননি বলে। ওগুলোকে হয়তো জ্যান্তই বেশি ভালো দেখায়-কে জানে মি, সিনোহারা হয়তো কাটতে গিয়ে ওগুলোকে ভুল জায়গায় কেটে ফেলতেন।

    “এমনি,” আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম।

    ওর হাতগুলো আমি চাইছিলাম, কারন ওগুলোতে সুন্দর একটা দাগ আছে। ও যখন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সেসময়ের ক্ষত থেকে সৃষ্ট দাগ।

    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅর্থশাস্ত্র – চাণক্য
    Next Article জু – অৎসুইশি

    Related Articles

    কৌশিক জামান

    জু – অৎসুইশি

    August 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.