Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গল্পমালা – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

    উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এক পাতা গল্প248 Mins Read0

    সহজে কি বড়লোক হওয়া যায়?

    ছেলেবেলায় একটু একগুঁয়েমো প্রায় সকলের থাকে। আমার কথা শুনিয়া কেহ চটিবেন না। চটিলেও বড় একটা অসুবিধা বোধ করিব না। অনেকের অভ্যাস আছে, তাহারা খাঁটি কথা শুনিলে বিরক্ত হয়, কিন্ত কাহাকেও বিরক্ত করা আমার উদ্দেশ্য নহে। আমার নিজের দশা দেখিয়াই আমি উপরের কথাগুলিতে বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছি।

    ছেলেমানুষের একটা রোগ আছে। অনেক কাজ তাহারা আপনা আপনি করিয়া অন্য লোককে বিরক্ত করে, আবার যদি কেহ সেই কাজ তাহাদিগকে করিতে বলিল, অমনি সেই কাজের মিষ্টতাটুকু তাহাদের নিকট হইতে চলিয়া যায়। দাদা প্রথমে বই পড়িতে শিখিয়াছে, তাহার বইয়ে সন্দর সুন্দর ছবি। পড়িবার সময় দাদা বই খুঁজিয়া পাইত না। আমার চোখে পড়িলেই আমি বইখানা হস্তে করিয়া, কেহ খুঁজিয়া না পায় এমন জায়গায় যাইয়া বসিতাম। শেষে, একদিন শুনিলাম ঐ বইখানা আমারও পড়িতে হইবে। আমার আনন্দের সীমা রহিল না; তখন দৌড়িয়া যাইয়া সঙ্গীদের সকলকে খবরটা দিয়া আসিলাম। পরদিন মাষ্টার আসিলেই বই হাতে করিয়া হাজির। মনে করিলাম, প্রথম ছবিটার কথা আজ হইবে। মাষ্টার প্রথমে ছবির পাতে একটুও আসিলেন না-ছবিশূন্য একটা পাতা উল্টাইয়া, এ, বি, সি, ডি করিয়া কি বলিতে লাগিলেন। তখন হইতে আর সে বই আমার ভাল লাগিল না।।

    দাদা স্কুলে যাইবার সময় মাঝে মাঝে আমাকে সঙ্গে করিয়া নিয়া যাইত। দাদাদের মাষ্টার বড় ভালমানুষ। আমি মনে করিলাম, ইস্কুলের সকল মাষ্টারই বুঝি ঐরূপ। বাড়িতে তিন বছর থাকিয়া কয়েকখানা বই শেষ করিলাম। তাহার পর আমাকেও স্কুলে পাঠাইয়া দিল। কয়েক বছর পর বেশ চলিতে চলিতে লাগিলাম; কিন্ত মাষ্টারকে আর তত ভাল লাগে না। কবে বড়মানুষ হইয়া ইস্কুল ছাড়িয়া দিব, এই চিন্তাটা বড় বেশী মনে হইত। তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি, ইংরেজী যে কয়েকখানা বই পড়িয়াছিলাম, তাহার একখানিতে এক সাহেবের কথা লেখা ছিল। তিনি বাড়ি ছাড়িয়া বিদেশে গিযাছিলেন, সেখানে অনেক কষ্ট ভোগ করিয়া শেষটা অনেক টাকা করিয়াছিলেন। সাহেব যে বয়সে ছাড়িয়াছিলেন, মিলাইয়া দেখিলাম আমারও এখন ঠিক সেই বয়স। তবে আর কি চাই! ক্লাসে সতীশের সঙ্গে আমার বড় ভাব; আমি সতীশের সঙ্গে মনের কথাগুলি খুলিয়া বলিয়া ফেলিলাম। কথা শুনিয়া সতীশ যেন আর তার ছোট শরীরটির মধ্যে আঁটে না। তখনই সে লাফাইয়া উঠিল। বোধ হইল বাড়ি হইতে বিদেশে চলিয়া গেলেই বড়লোক হওয়া যাইবে। সতীশ বলিল, ‘কালই চল’। কাল চলাটা তত সহজ বোধ হইল না। কিন্তু বেশী দেরী করা হইবে না, সেটা ঠিক করা হইল।

    একদিন স্কুল হইতে ছুটি পাইয়া বাড়ি আসিলাম; সতীশও আসিল। বাবা বাড়ি ছিলেন না। বাড়ির অন্যান্য লোকও চুপ করিয়া বিশ্রাম করিতেছিল। চুপি চুপি কয়েকখানা কাপড় দিয়া একটি পুটঁলি বাঁধিলাম। তারপর বাবার বাক্স হইতে কতকগুলি টাকা লইয়া দুজনে চোরের মত বাড়ির বাহির হইলাম। পাছে কেহ আসিয়া ধরে, সেই ভয়ে দুজনে মাঝে মাঝে দৌড়াইতে লাগিলাম। এইরূপে স্যা পর্যন্ত হাঁটিয়া এক বাড়িতে যাইয়া উঠিলাম।

    সেই বাড়ির কর্তা আমাদের অবস্থা দেখিয়া বড় দুঃখিত হইলেন। আমাদের সম্বন্ধে যা যা কথা সমস্ত জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। আমরা কোন কথারই ঠিক উত্তর দিই নাই। স্থানে স্থানে দু-একটি কথা গড়িয়া কহিতে হইল। তিনি আমাদের কথায় বুঝিয়া লইলেন যে, আমরা দুজন পথ হারাইয়া ঘুরিতেছি। বলিলেন, ‘কাল আমি একজন লোক দিয়া তোমাদের দুজনকে বাড়ি পাঠাইয়া দিব।’

    খাইবার সময় ভদ্রলোকটি আমাদের সম্মুখে বসিয়া থাকিলেন, আহার শেষ না হওয়া পর্যন্ত উঠিলেন না। একটি কুঠুরিতে আমাদের দুজনের ঘুমাইবার বন্দোবন্ত করিয়া দেওয়া হইল। সেখানে আর কেহ ঘুমাইতে আসিল না। আমি কিছু সুবিধা বোধ করিলাম। ভাবিলাম কর্তা যাহা বলিলেন তাহা কাজে করিলে আর বড়লোক হওয়া হইবে না; সুতরাং কেহ জাগিবার পূর্বে কর্তাকে ধন্যবাদ না দিয়া চলিয়া যাওয়া ঠিক হইল। সতীশকে ডাকিলাম, ‘সতীশ! সতীশ!’-সতীশ কথা কয় না। সতীশের চক্ষে জল পড়িতেছে। কর্তার কথায় সতীশের মন ফিরিয়া গেল নাকি? বাস্তবিকই তাই, অনেক পীড়াপীড়ি করার পর বলিল, ‘আমি তোমার সঙ্গে যাইব না।’ আপনারা কি মনে করিতেছেন? সতীশের কথা শুনিয়া আমার মনের ভাব কিপ্রকার হইল? বড়লোক হওয়ার ইচ্ছাটা আমার এত বেশী হইয়াছিল যে, বাড়ি ছাড়িয়া অবধি আমার বোধ হইতেছিল-যেন বড়লোকের কাছাকাছি একটা কিছু হইয়াছি। সতীশকে আমি কাপরুষ মনে করিতে লাগিলাম। সতীশের মা বাপ আছে, আমারও মা বাপ আছেন। প্রভেদ এই যে, আমি স্বার্থপর; সতীশ তাহা নহে। সতীশের মনে যে-সকল চিন্তা উঠিতেছিল, আমার অন্তঃকরণে তাহা স্থান পাইল না। আমি সতীশের অবস্থা বুঝিতে পারিলাম না। ম বাপের মনে কষ্ট দেওয়া আমার ইচ্ছা ছিল না; কিন্ত নিজের কথা লইয়া এত ব্যস্ত ছিলাম যে তাঁহাদের কথা ভাবিবার অবসরই পাই নাই। নানা চিন্তার মধ্যে ঘুম আসিল।

    ঘুমাইতে ঘুমাইতে স্বপ্নে দেখিলাম যে, আমি বাড়িতে কি একটা কথা লইয়া মার সঙ্গে রাগারাগি করিয়াছি, মা কত সাধিতেছেন, আমার ভ্রুক্ষেপ নাই; রাগ যেন ক্রমেই বাড়িতেছে। মার চক্ষে জল পড়িতেছে দেখিয়া যেন আমার প্রতিহিংসার ভাবটা চরিতার্থ হইতে লাগিল। আমি দাত খিঁচাইয়া মাকে বিদ্রূপ করিতে লাগিলাম। মা আমার হাত ধরিতে আসিলেন; আমি পাশের একটা গাছে উঠিতে চেষ্টা করিলাম। হঠাৎ পা পিছলাইয়া পড়িয়া যাইতেছিলাম; এমন সময় আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। স্বপ্নের কথা ভাবিয়া চক্ষে দুফোঁটা জল আসিল; কিন্ত আবার সে বড়লোক হওয়ার কথা। সতীশের মন ফিরিয়া গিয়াছে। সতীশ জাগিয়া আর যাইতে চাহিবে না, হয়ত আমারও যাওয়া হইবে না। রাত হয়ত আর বেশী দেরী নাই; এই বেলা সতীশকে না বলিয়া যাওয়াই ভাল। আমি আস্তে আস্তে উঠিলাম। আমার কাপড় আর টাকাগুলি লইয়া বাহির হইলাম। রাত্রি তখনো অনেক ছিল, কিন্ত আমার বোধ হইতে লাগিল যেন এই ভোর হইয়া আসিতেছে। একটা বড় রাস্তা ধরিয়া চলিলাম। অনেকক্ষণ হাঁটিলাম, কিন্ত রাত ফুরায় না। রাস্তাটা একটা নদীর ধারে যাইয়া শেষ হইয়াছে; আমিও সেইখানে যাইয়া থামিলাম-তারপর যাই কোথা? রাস্তাটা নিশ্চয়ই ওপার যাইয়া আবার চলিয়াছে, কিন্ত ওপারে যাই কেমন করিয়া? এতক্ষনে রাত ফুরাইল না। হয়ত আরো অনেক দেরী। ঘাটে একখানি নৌকা বাঁধা ছিল-নৌকার ছই নাই। একজন লোককে অনায়াসে ওরূপ নৌকা চালাইতে দেখিয়াছি, আমার বোধ হইতে লাগিল, আমিও পারি। নৌকায় উঠিতে বিলম্ব হইল না। যে লগিটিতে নৌকা বাঁধা ছিল, তাহা তুলিয়া লইলাম। ডাঙ্গায় ভর করিয়া ঠেলিয়া নৌকা জলে ভাসাইয়া দিলাম। জলের গায় এত জোর আগে ভাবি নাই। শোঁ শোঁ করিয়া নৌকার গায় জল বাধিতে লাগিল; নৌকাখানা ঘুরিয়া গেল। হঠাৎ ঘুরিবার সময় তাড়াতাড়ি লগিটি ছাড়িয়া দিলাম। নৌকা ঘুরিয়া ঘুরিয়া ডাঙ্গা হইতে অনেক দুরে যাইয়া পড়িল-স্রোতে ভয়ানক বেগের সহিত ভাসিয়া যাইতে লাগিল, আমি কিছুকাল হতবুদ্ধি হইয়া থাকিলাম।

    বিপদের পরিমানটা প্রথমে তত বুঝি নাই, শেষে কিছু কিছু করিয়া হুঁশ হইতে লাগিল। মাথা ঘুরিয়া গেল। দুহাতে চোখ ঢাকিয়া বসিয়া পড়িলাম। ঢেউগুলি তড়াক তড়াক করিয়া নৌকাখানিকে দোলাইতে লাগিল, তখন মায়ের সেই মুখখানি মনে হইল। কেন বাড়ি ছাড়িয়া আসিলাম? সেই অন্ধকার রাত্রি, ভয়ানক নদী, আর বাড়ির ছোট কুঠুরিটি-সেই কোমল সুন্দর বিছানাটি মনে হইল। দুই চক্ষে জল পড়িতে লাগিল। সেই আঁধারে পড়িয়া, মা মা বলিয়া কাঁদিতে লাগিলাম। কেন সতীশের সঙ্গে গেলাম না, তাহাকে কেন ছাড়িয়া আসিলাম?

    এইভাবে কতক্ষণ ছিলাম বলিতে পারিব না। হঠাৎ নৌকাখানি একদিকে যাইয়া ঠেকিল। চমকিয়া দেখিলাম, কতকগুলি বড় নৌকা, তাহারি একটাতে আমার নৌকা ঠেকিয়াছে। আমি সেই মূহুর্তের জন্য আশ্বস্ত হইলাম। কিন্ত তার পক্ষেণেই নৌকা হইতে কতকগুলি কালো অর্ধ উলঙ্গ লোক বাহির হইয়া কেঁউ মেঁউ করিয়া কি বলিতে লাগিল। আমি বুঝিতে পারিলাম আমাকে গালি দিতেছে তাহারা আমার কথা বুঝিতে পারিল বলিয়া বোধ হইল না। আরো বেশী গালাগালি দিতে লাগিল। ক্রমে অন্যান্য নৌকার লোক আসিয়া গোলমালে যোগ দিল। আমার কথা শুনিয়া সকলেই ঐ লোকগুলিকে গালি দিতে লাগিল। একটি ভদ্রলোক সেখানে ছিলেন। তিনি দয়া করিয়া আমাকে তাঁহার নৌকায় লইয়া গেলেন, নিজ হাতে আমার পুটলিটি যত্ন সহকারে এককোণে রাখিয়া দিলেন। তারপর আমাকে বলিলেন, ‘আমি কা- যাইতেছি; তোমার আপত্তি না থাকিলে আমার সঙ্গে যাইতে পার, আমার বাড়িতে কোন ক্লেশ হইবে না।’ আমি তাঁহার সঙ্গেই চলিলাম।

    কা- ছোট একটি শহরের মত। অনেক লোক। বড়লোকও অনেকগুলি আছেন। আমি যাঁহার সঙ্গে গিয়াছিলাম, তাঁহাকে এখানে কালিদাসবাবু বলিব, তিনিও একজন বড়লোক। এই-সব দেখিয়া শুনিয়া আমার পুরাতন রোগ আবার দেখা দিল। আমি ভাবিতে লাগিলাম, এখানে থাকিয়া বড়লোক হওয়া যায় কি? যায় বই কি। না হইলে ইহারা এত বড় গাড়ি চড়ে কি করিয়া? বোধ হইল যেন কালিদাসবাবু বাড়িতে থাকিয়া হঠাৎ একদিন বড়লোক হইয়া যাইব। একদিন কালিদাসবাবু ডাকিলেন। কালিদাসবাবুর উপর প্রথম হইতেই আমার বড় শ্রদ্ধা হইয়াছিল। যখনই তিনি আমাকে ডাকিতেন, তখনই একখানা সুন্দর কিছু উপহার পাইতাম। আমার বয়সের অনেকেই এখন ভাল কাজ করিতেছেন। কিন্ত আমার যেন তখনো শিশু ভাবটা যায় নাই। কালিদাসবাবু তাহা বেশ বুঝিতেন। যাহা হউক আমি কালিদাসবাবুর নিকট যাইয়া দাঁড়াইলাম। তিনি আমার নাম ধরিয়া বলিলেন, ‘গিরিশ, এখানে তোমার কেমন লাগে?’

    ‘দিব্যি।’

    ‘বটে? তা এখানে থেকে তোমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছা হয় না?’

    ‘কোথায় যাব? এখানেই থাকব।’

    ‘তা বেশ বলিয়া কালিদাসবাবু কপাল হইতে চশমা নামাইয়া ছাপার কাগজ পড়িতে লাগিলেন। কাগজের প্রথম পাতে একটি ছবি। আমার সেই সাহেব। অমি একটু আশ্চর্য হইলাম। অনেকদিন পরে কোনো পরিচিত বন্ধুর সাক্ষাৎ পাইলে যেরূপ হয়, আমারও সেইরূপ হইল। একটি ছোট কথা আমার মুখ দিয়া বাহির হইল, আমি বলিয়া উঠিলাম, ‘আরে।’ কালিদাসবাবু কাগজ নামাইয়া আমার মুখের দিকে চাহিলেন। তাহার অর্থ, ব্যাপারখানা কি?

    আমি বলেলাম, ‘আজ্ঞে ঐ ছবিটে।’

    ‘ইনি একজন বড়লোক ছিলেন। তোমারও বড়লোক হতে ইচ্ছে হয়, না?’

    আমি ভাবিলাম এই বুঝি! হঠাৎ প্রশ্ন হওয়াতে থতমত খাইয়া বলিলাম, ‘বড়লোক কি সবাই হয়?’

    ‘হয় বইকি। ইচ্ছে করলে তুমিও হতে পার।’

    ‘আমি পারি?’

    ‘অবিশ্যি। কাল থেকে তোমাকে স্কুলে পাঠিয়ে দেব ভেবেছি। লেখাপড়া না শিখলে বড়লোক হওয়া যায় না। তাই তোমাকে ডেকেছিলাম। কেমন?’

    আমার বাতাসের ঘর ভাঙ্গিয়া গেল। যার চোটে বাড়ি ছাড়া, সেই আপদ। আমি কোন কথা কহিলাম না।

    কালিদাসবাবু এতে সন্দেহ করেন নাই, সুতরাং কিছু বলিলেন না। এরূপ কথাবার্তা কালিদাসবাবুতে আর আমাতে অনেকদিন হইত। তিনি আমার অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করিতেন। ‘সেই রাত্রিতে নৌকায় কেমন করিয়া আসিলে।’ বাড়ি কোথা। ‘মা-বাপ নাই? ইত্যাদি-আমি প্রায়ই চুপ করিয়া থাকিতাম। কালিদাসবাবুর ইচ্ছা ছিল, সূযোগ পাইলেই আমাকে বাড়ি পাঠাইয়া দিবেন। কিন্ত এসব সম্বন্ধে কোন খবরই আমি তাঁহাকে দিতে চাহিতাম না। তখন তিনি সে-সব বিষয়ে ক্ষান্ত হইয়া সেখানেই আমাকে লেখাপড়া শিখাইবার মনস্থ করিলেন।

    ইস্কুলে যাইয়া অবধি আমার আর মনে শান্তি ছিল না। কয়েকদিন কোনো মতে কাটাইলাম, কিন্ত শেষটা অসহ্য হইয়া উঠিল। কালিদাসবাবুর বাড়িতে থাকা হইবে না। কিন্ত হঠাৎ যাই কোথায়? গেলেও আর এবার হাঁটিয়া যাওয়া যাইবে না। কা-হইতে দুখানা স্টিমার ধু-তে যাতায়াত করিত। সপ্তাহে দুদিন স্টিমার চলে। ধু-যাইতে তিনদিন লাগে। হিন্দুরা এই তিনদিনে চিঁড়ে পুঁটলি-বাঁধিয়া লইয়া জাহাজে উঠে। ভোরবেলা জাহাজ ছাড়ে।

    একদিন নদীর ধারে বেড়াইতে যাইয়া দেখি একখানা স্টিমার এইমাত্র ঘাটে আসিয়া থামিল। পরের দিন ভোরে চলিয়া যাইবে। হঠাৎ স্টিমারে উঠিয়া ধু-চলিয়া যাইতে বড় ইচ্ছা হইতে লাগিল। বাড়ি আসিয়া কেহ না দেখে এমন ভাবে আমার কাপড়-চোপড় সব একত্র জড় করিলাম। কালিদাসবাবুর বাড়ি আসিবার কালে সঙ্গে করিয়া যে টাকা আনিয়াছিলাম, তাহার একটিও ব্যয় হয় নাই। কালিদাসবাবুও মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছামত খরচ করিবার জন্য দু-একটি টাকা দিতেন। আমি সমস্তই সঞ্চয় করিতাম। শুনিয়াছিলাম, বড়লোকেরা সহজে টাকা খরচ করিতে চাহে না।

    যাত্রার উপযোগী সমস্ত জিনিস প্রস্তত রাখিয়া ঘুমাইলাম। মনে একটা চিন্তা থাকিলে সহজে ঘুম হয় না, ঘুম হইলেও শীঘ্রই ভাঙ্গিয়া যায়। আমারও তাই হইল, বড় কামরার ঘড়িতে চারটা বাজিল, আমি অমনি উঠিলাম। সঙ্গে পুটলি। পুটুলিতে কয়েকখানা কাপড়, একজোড়া চটী জুতো, নগদ কিছু টাকা, কালিদাসবাবু মাঝে মাঝে যে উপহার দিতেন সেগুলি-কয়েকখানা ছবি, একটা বড় ছুরি আর আমার স্কুলের পুস্তকগুলি। পুস্তকগুলি কেন সঙ্গে লইলাম বলিতে পারি না। তবে কালিদাসবাবু বলিয়াছিলেন, ‘লেখাপড়া না শিখিলে বড়লোক হওয়া যায় না।’ তাহাতেই মনে কেমন করিয়া একটা ভয় রহিয়া গিয়াছিল। এইরূপ সাজ-সজ্জা করিয়া, ছাতাটি হাতে করিয়া, বিছানার চাদরখানা পুটলির উপর জড়াইয়া আস্তে বাহির হইলাম, স্টিমার ঘাটে আসিতে অধিকক্ষণ লাগিল না। সেখানেই মুদীর দোকান আছে, সেই দোকান হইতে চিড়ে কিনিয়া বিছানার চাদরের এক কোণে বাঁধিয়া লইয়া, জাহাজের একজন লোক আমাকে একটা জায়গা দেখাইয়া দিল, আমি সেইখানে যাইয়া বসিলাম। জাহাজে বিশেষ কিছু ঘটনা হইল না। তবে সঙ্গে যে টাকা আনিয়াছিলাম, তাহ প্রায় শেষ হইয়া আসিল। নিয়মিত সময় জাহাজ ধু-পৌছিল।

    রামলোচনবাবু আমাদের ওদিককার লোক, তিনি ধু-তে থাকেন, সেখানকার একজন নামজাদা উকীল। আমি ভাবিলাম দেশের একজন লোক, তাঁর কাছে গেলে তিনি অবশ্যই কিছু খাতির করিবেন। জাহাজ হইতে তীরে উঠিয়াই তাঁহার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। একটি ভদ্রলোক তাঁহার বাড়ি দেখাইয়া দিলেন। আমি আস্তে আস্তে বাড়ির একজন চাকরের মতে লোককে যাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘রামলোচনবাবুর এই বাড়ি’? সে লোকটা আমার কথার উত্তর দেওয়া দূরে থাকুক, আমার দিকে একবার ফিরিয়াও চাহিল না। মুখ বিকৃত করিয়া একটা বড় ঘরে চলিয়া গেল। অগত্যা আমি অন্য লোকের আশ্রয় গ্রহন করিলাম। সে যাহা বলিল তাহাতে জানিলাম, আমি যাহাকে রামলোচনবাবুর চাকর মনে করিয়াছিলাম, তিনিই রামলোচনবাবু। তাই অত রাগ! আমি ভয়ে ভয়ে রামলোচনবাবুর ঘরের দরজায় দাঁড়াইলাম। তিনি একটা তাকিয়া ঠেস দিয়া বসিয়া রহিয়াছেন। অত কালো আমি আর দেখি নাই। মোটা বেশী নন, কিন্ত প্রায় বুকের উপর কাপড় পরেন। গোঁপগুলি সোজা সোজা, চুল অধিকাংশ পাকিয়া গিয়াছে। কানে একটা কলম, হাঁটুর উপর পর্যন্ত কাপড় টানিয়া বসিয়াছেন। উরুদেশের উপর একটা লম্বা খাতা রাখিয়া তাহাই দেখিতেছেন, আর মাঝে মাঝে কাহার উদ্দেশ্যে মুখ বাকাইতেছেন। তাকিয়ার একটা অংশ কলম মুছিবার স্থান বলিয়া বোধ হইল। কিছুকাল পরে দেখিলাম যে তাহা নহে। পাশে একটি মাটির দোয়াত, তাহা হইতে ঘাটিঁয়া এক কলম লইয়া খাতায় কি যেন লিখিলেন। তারপর কলমটি মাথায় চুলে ঘষিয়া কানে বসাইয়া হাতের দুটি আঙুল তাকিয়ার ঐ স্থানটিতে পুছিলেন। তার পরক্ষণেই এক হাতের কনুই তাকিয়ার উপর রাখিয়া, একখানা পা আমার দিকে বাড়াইয়া ‘ভাউ’ শব্দ উদগার করিলেন। শেষটা আমার দিকে মুখ তুলিয়া চাহিলেন। প্রথম প্রশ্ন হিন্দী ভাষায় হইল; তাহার পর বাঙলা।

    ‘কি চাই?’

    ‘আজ্ঞে আমি অনেক দূর থেকে এসেছি-

    ‘আমিও অনেক দূর থেকে এসেছি।’

    ‘আমার নিবাস সু-

    ‘আমারও নিবাস সু-। তারপর?’

    ‘মহাশয় যদি-’

    ‘ম-হ-শ-য় যদি? কি-ঞ্চি-ৎ-সা-হা-য্য? দক্ষিন হস্তের ব্যপার আমার কাছে নাই। হিঁয়াসে চলে যাও।’

    আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে বিলম্ব করিলাম না। কোথা যাইব ঠিক নাই, কিন্তু রামলোচনবাবুর বাড়িতে আর পদার্পণ করা হইবে না। রাস্তায় বাহির হইয়া একজনের কাছে জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি বলিলেন, ‘যে কোন মুদীকে পয়সা দিলেই থাকবার জায়গা আর খেতে দিবে।’ মুদীর দোকান খুঁজিয়া লওয়া কঠিন বোধ হইল না। দু’দিন মুদীর দোকানে খাইলাম। কিন্ত এরূপ ভাবে খাইলে বেশিদিন পয়সায় কুলাইবে না, এই চিন্তায় রাত্রিতে ঘুম হয় না। একদিন প্রাতকালে উঠিয়া মুদীর পয়সা হিসাব করিয়া দিলাম। তারপর পুটলিটি হাতে করিয়া বাহির হইলাম। রাস্তায় কতদূর হাঁটিয়া দেখি, একটা বড় বাড়ি। এ বাড়ির কর্তা রামলোচনবাবুর মত নাও হইতে পারেন। আস্তে আস্তে বৈঠকখানার দিকে গিয়া দেখিলাম কর্তা বসিয়া আছেন, আর ইয়ার গোছের একটা অভ্যাগত লোক তাঁহার সহিত কথা বহিতেছেন। আমি দাঁড়াইবামাত্রই কর্তা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কে বাপু?’

    আমি।-‘আমি পথিক, কষ্টে পড়েছি-।’

    ইয়ার।-‘বড় খিদে পেয়েছে বুঝি?’

    আমি কোন উত্তর করিলাম না; ইয়ার-বাবু উত্তর দিকে আঙুল নির্দেশ করিয়া চোখ বড় করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিতে লাগিলেন-

    ‘হোটেল আছে। বাবুরচি লোক দিব্যি রাঁধে-রোজ পাঁচ টাকাতেই চলে।’

    আমি নিরাশ হইয়া বাবুর দিকে তাকাইলাম, বাবু ইয়ারের উপর অত্যন্ত রাগ করিয়া বলিলেন, ‘নিজের বাড়িতে একটি লোককে খেতে দিত পার না, অন্য লোকের বাড়ি এসে চাষামো কর। আর আমার বাড়ি এসো না।’ বলা বাহুল্য, বাবুর উপর আমার ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালবাসা, সম্মান ইত্যাদি যত হইতে পারে,সব কটা জন্মিয়া গেল। বাবু আমাকে বলিলেন, ‘তোমার অন্য কোনরূপ কষ্ট না হ’লে আমার বাড়িতে তোমার থাকবার জায়গা আর খাবার বন্দোবস্ত হতে পারে।’

    ‘আজ্ঞে আমি অমনি থাকতে চাই নে। আপনার কিছু কাজ করে দেব, তার পরিবর্তে যদি কিছু খাবার দেন, তা হলে ভাল হয়।’

    ‘উত্তম! তুমি ইংরেজি লিখতে পার?’

    ‘কিছু কিছু ইংরেজি পড়েছিলাম বটে, কিন্ত ভাল লেখা পড়া জানি না।’

    ‘কতদূর পড়েছ?’

    আমি বলিলাম।

    ‘বেশ, তাতেই হবে।’

    আমি বাবুর বাড়ি রহিলাম। কাজের মধ্যে এই, বাবুর চিঠিপত্র সব একটা নকল করিয়া রাখিতে হয়।

    এখানে থাকিয়া মাঝে মাঝে বাড়ির কথা ভাবিতাম। বড়লোক হইবার জন্য কত কষ্ট পাইলাম, কিন্ত বড়লোক হইবার ত লক্ষণ দেখিতেছি না। কেবল বাড়ি হইতে চলিয়া অসিলেই কি বড়লোক হওয়া যায়? আরো কিছু চাই, আমার তাহা নাই। এইরূপ যতই ভাবিতে লাগিলাম, ততই বাড়ি ফিরিবার ইচ্ছা হইতে লাগিল। শেষটা ঠিক করিলাম বাড়ি যাইতে হইবে। আমার হাতে যে কিছু টাকা আছে, তাহাতে পথ খরচা চলিবে না। সুতরাং এবার স্টিমারে যাওয়া হইবে না। বৈ-তীর্থ এখান হইতে বেশি দূরে নয়; সেখানে গেলে সঙ্গী পাওয়া যাইতে পারে। এইরূপ চিন্তার পর মনে করিলাম, বাবুর নিকট হইতে বিদায় লইয়া বৈ-যাইব; সেখানে সঙ্গী পাইলে তাহাদের সহিত বাড়ি যাইব।

    কর্তার নিকট হইতে বিদায় লইয়া বৈ-আসিতে বড় বেশী দেরি হইল না। জায়গাটা দেখিতে বড় সুন্দর, একটি ছোট পাহাড়, তার উপরে তীর্থস্থান। পাথরের গায়ে সিড়ি কাটা আছে। সেই সিড়ি দিয়া উপরে উঠিতে হয়। অনেকগুলি সিড়ি; উঠিতে অনেক্ষেন লাগে। আমি উঠিতে উঠিতে তিনবার বিশ্রাম করিলাম। প্রথমেই যাহাকে দেখিলাম, তাহার নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম, যাত্রীরা কোথায় থাকে?’ সে বলিল, যাত্রীদের থাকিবার ভাল জায়গা নাই। প্রায় সকলেই পাণ্ডাদের বাড়িতে থাকে। উপরে যে দেব মন্দির, সেই পুরোহিতদের নাম পাণ্ডা। পাণ্ডা খুঁজিতে অধিকক্ষণ ঘুরিতে হইল না। প্রথমে যে পাণ্ডা আমাকে দেখিল, সেই হাত ধরিয়া আমাকে তাহার বাড়ি লইয়া গেল।

    পাণ্ডার বাড়ি দুদিন থাকিয়াই বুঝিতে পারিলাম যে বিষয়টা তত সুবিধাজনক নহে। আমি যে সময় গিয়াছি সে সময় যাত্রীরা প্রায়ই আসে না। সঙ্গী পাইতে হইলে আরো তিনমাস অপেক্ষা করিতে হইবে। তিন মাসের ত কথাই নাই, পাণ্ডা মহাশয় যেরূপ করিলেন, তাহাতে তৃতীয় দিনেই আমাকে পৃষ্ঠ ভঙ্গ দিতে হইল। তৃতীয় দিন সকালে পাণ্ডা আসিয়া বলিলেন, ‘দেখিবি? চল্’ আমি চলিলাম। অনেক জিনিস দেখা হইল। শেষে এক জায়গায় গেলাম; সেটি একটি বড় মন্দির। মধ্যে গহ্বর, গহ্বরের নীচে ছোট এক ঝরণার মত। পাণ্ডা বলিল, ‘এখানে পূজা করিতে হইবে।’ কত লাগিবে তাহারও হিসাব দেওয়া হইল। আমি দেখিলাম, তা হলে আমার বাড়ী যাওয়া হয় না। আমি বলিলাম আমি ছেলেমানুষ, পূজা কি করিব?’ পাণ্ডা চটিয়া গেল; সেদিন হইতে আর আমাকে তাহার বাড়িতে জায়গা দিল না। অগ্যতা আমার সেখান হইতে প্রস্থান করিতে হইল। কিছুদূর গেলেই কতকগুলি ছোট ছোট ছেলে আসিয়া ‘পয়সা’ ‘পয়সা’ করিয়া আমাকে ঘিরিয়া ধরিল। আমি কোন মতেই পয়সা দিতে চাহিলাম না। তাহারা ক্ষেপিল। কেহ গাল দেয়, কেহ কাপড় ধরিয়া টানে, কেহ দূর হইতে ছোট ছোট ঢিল ছুঁড়িয়া ফেলে। আমার মাথ গরম হইয়া গেল। কাছে একখানা ছোট কাঠ পড়িয়াছিল, রাগের চোটে তাহাই হাতে করিয়া লইয়া ছেলেগুলিকে তাড়া করিলাম। মুহূর্তের মধ্যে সকলে অদৃশ্য হইল। আমার যেন ভূত ছাড়িল। সেখান হইতে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়িয়া পাহাড়ের প্রায় অর্ধেক পথ আসিয়া পড়িলাম। তখন মনে হইল, জুতা জোড়াটি ফেলিয়া আসিয়াছি। কিন্ত ইহার পূর্বের পঁচিশ মিনিটের মধ্যে পাহাড় সম্বন্ধে যেটুকু জ্ঞান লাভ করিয়াছিলাম, তাহাতে মনে ভয়ানক আতঙ্ক উপস্থিত হইতে লাগিল। আমি জুতার আশা পরিত্যাগ করিলাম। চলিবার সময় সর্বদাই চটি জোড়াটি পুটুঁলিতে বাঁধিয়া লইয়া যাইতাম, এক্ষণে তাহাই খুঁজিয়া লইলাম।

    পাহাড়ের নীচে নামিতে অনেক বেলা হইল। একটু একটু করিয়া ক্ষুধা বাড়িতে লাগিল কোনো দোকানে যাইতে হইলে অন্তত এক প্রহর চলিতে হইবে। সেই রোদে আর এক ঘন্টা চলাই অসম্ভব বোধ হইতে লাগিল। পথের ধারে দু-একটি গাছ দেখিলেই ইচ্ছা হইতেছিল যে সেইখানে শুইয়া পড়ি। কিন্ত একদিকে তৃষ্ণায় গলা শুকাইয়া যাইতেছে এবং অন্যদিকে ক্ষুধায় পেট জ্বলিতেছে। কি করিব কিছু ঠিক করিতে না পারিয়া পথের ধারে একটি বাড়ি খুজিয়া লইলাম। বাড়িতে উঠিয়া একটা বড় ঘরে গেলাম; সেখানে দুটি ছেলে বসিয়াছিল। আমি তাহাদের নিকট আমার ক্ষুধার কথা জানাইলাম, তাহারা ‘তুই’ ‘তুই’ করিয়া আমার কথার উত্তর দিতে লাগিল। একজন বলিল-

    ‘বাঙালী লোক চোর আর খ্রীষ্টান; বাঙালী লোককে কিছু দিব না।’

    ‘আমি ভদ্রলোক ব্রাহ্মন; চোর নই।’

    ‘যা তুই এখান থেকেঃ C-r-i-p crip : d-a-s-h dash.’

    আমার তখন ঠাট্রার মেজাজ ছিল না। তথাপি এর পর আর হাসি থামাইতে পারিলাম না। তখন তাহাদের ধরণে কথা কহিতে লাগিলাম-

    ‘ওর মানে কি হোল?’

    ‘ ও ইংরাজি। Ram is ill. I will not let him run in the sun বাঙালী লোক চোর; যা তুই এখান থেকে।’

    তোরা ইস্কুলে পড়িস?’

    এবার যেন তাহারা কিছু ভয় পাইল। আমাদের মাষ্টার বড় বই পড়ে।’

    ‘তোমাদের মাষ্টারের চাইতে আমি কি কম একটা কিছু? এই দেখ ত!’

    আমার পুঁটুলিতে যে বইগুলি ছিল, তাহার মধ্যে Lamb’d Tales ও ছিল। সেইখানা এখন বাহির করিলাম।

    এইলা একটু পরিবর্তন দেখা গেল। তাহাদের মুখভঙ্গিতে বুঝা গেল যেন তাহারা মনে করিয়া লইয়াছে যে আমি একটা কিছু হইব। একজন মাথ চুলকাইতে চুলকাইতে উঠিয়া গেল। যে রহিয়া গেল, আমি তাহাকে আশ্বস্ত করিয়া তাহার সহিত আলাপ পরিচয়ের চেষ্টা করিতে লাগিলাম। তাহার কথায় বুঝা গেল যে তাহার দুভাই। সে ছোট। বাবা নাই; মা আছেনঃ ইস্কুলে পড়ে; টাকা আছে, চাকর চাকরানী আছে। বলা বাহুল্য, সে বাড়িতে তখনকার জন্য আমার বিশ্রামের সংস্থান হইল।

    আমার জন্য একটি ছোট ঘর নিদিষ্ট করা হইল। আমি তাহাতে যাইয়া বসিলাম। তখন সকলের খাওয়া হইয়া গিয়াছে, সুতরাং নতুন আহারের আয়োজন করা হইল। একজন আসিয়া আমাকে স্নান করিতে বলিল। আমি কাছের একটা পুকুর হইতে স্নান করিয়া আসিলাম। আসিয়া দেখিলাম যে জল-খাবারের জন্য কতকগুলি ভিজানো চাল আর কিছু সন্দেশ লইয়া বড় ছেলেটি আমার ঘরে বসিয়া আছে। চালগুলি ভিজিয়া ঠিক ভাতের মত হইয়াছে। সেখানে খাবার সময় ঐরূপ চাল অনেককে খাইতে দেখিয়াছি। আমি খাইতে বসিলাম। ছেলেটি আমার কাছে বসিয়া রহিল। তাহার ভাব ভঙ্গিতে বোধ হইতে লাগিল যেন কিছু বলিতে আসিয়াছে। কিছুকাল পরেই সে আমার গায় মাথায় হাত বুলাইতে লাগিল। আমি কিছু চমৎকৃত হইয়া তাহার দিকে চাহিলাম, সে বলিল, ‘মা ব’লে দিয়েছেন আপনি ব্রাহ্মণ, আপনি শাপ দিলে আমার অনিষ্ট হবে। আমি আপনাকে মন্দ কথা বলেছি।’

    ‘তোমার উপর রাগ করি নাই। তোমার কথায় আমার কিছুমাত্র অনিষ্ট হয় নাই। আমি ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিব, যেন তিনি তোমার ভাল করেন।’ তাহাকে বুঝানো কিছু কষ্টকর বোধ হইল। কিন্ত শেষটা সে যেন সুখী হইল এবং বলিল, ‘তবে যাই, মা’র কাছে বলিগে।’

    বেলা প্রায় শেষ হইয়া আসিলে সেই ছেলে দুটির নিকট হইতে বিদায় লইয়া বাহির হইলাম। সেদিন রাত্রিতে এক বাজারে মুদীর দোকানে ছিলাম। তারপর দুই দিন ঐ ভাবে গেল। সারদিন পথ চলিতাম; কেবল দু-বেলা খাবার জন্য কোনো মুদীর দোকানে উঠিতাম। রাত্রিতে কোন মুদীকে পয়সা দিয়া তাহার ঘরে থাকিবার জায়গা পাইতাম। তৃতীয় দিন রাত্রিতে থাকিবার জন্য আর মুদীর ঘর পাইলাম না। কাজেই একজন গৃহস্থের বাড়ি যাইতে হইল। গৃহস্থ জায়গা দিতে কোনো আপত্তি করিলেন না। কিন্ত খাওয়া শেষ হইলে ‘কড়া’ ‘বগুণো’ সব দেখাইয়া বলিলেন, ‘কাল চলে যাবার আগে এইগুলো মেজে দিয়ে যেতে হবে। তুমি বাঙালী, তোমার এঁটো কে নেবে?’ আমি মহা বিপদে পড়িলাম। বলিলাম, ‘ওগুলো আমি ছুঁই নাই। তবে আমি যা যা ছুঁয়েছি সেগুলো দাও, এখনি মেজে দিচ্ছি।’ একখানা থালা আর একটি বগুণো (বগুণোতে ডাল ছিল) আমার ঘাড়ে চাপিল। তিনি বাড়ির কাছে একটা পুকুর দেখাইয়া দিলেন; আমি তথায় যাইয়া সমস্ত পরিস্কার করিয়া আসিলাম। প্রায় অর্ধঘন্টা সময় লাগিল।

    পরিশ্রমের পর সুনিদ্রা হইল। পরদিন গৃহস্থ ডাকিয়া ঘুম ভাঙ্গাইলেন, উঠিয়া দেখি সূর্য উঠিয়াছে। তাড়াতাড়ি পুঁটুলি হাতে করিয়া বাহির হইলাম। গৃহস্থের নিকট বিদায় লইবার সময় ফা-যাইবার পথ জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন, ‘একটা বড় মাঠ, তারপর একটা পাহাড়, তারপর ফা-। একই পথ, ভূল হবার জো নাই।’

    কিছুদূর হাঁটিয়াই একটা মাঠে আসিলাম। সেখানে পথিকদিগের জন্য একটা ঘর আছে। তথায় একজনার সাহিত সাক্ষাৎ হইল। তাহার সঙ্গে একটা ঘোড়া। সে আমাকে দেখিয়াই বলিল, ‘বেশ, চল। একজন সঙ্গীর জন্য বসিয়াছিলাম। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সঙ্গীর প্রয়োজন কি?’ সে বলিল, ‘তুমি আর কখনো এখানে চল নাই? একা গেলে খেয়ে ফেলবে!’ আমার ভয় হইল।

    মাঠের এপাশ থেকে ওপাশ দেখা যায় না। অতি কম চওড়া পথ; দশ বারো হাত অন্তর ছোট ছোট খসখসের ঝোপ। জীবজন্তুর মধ্যে এক জাতীয় পাখি। পাখিটি একটি চড়াই অপেক্ষা কিঞ্চিৎ বড়, গায়ের রং সবুজ; ঠোট সরু এবং লম্বা, স্বভাব অত্যন্ত চঞ্চল। ক্রমাগত একই রূপ শব্দ করিতেছে-”টিরিরণ টিরিরণ টিরিরণ।” লেজে একটা নতুনত্ব আছে। লেজের মধ্যদেশ হইতে প্রায় দেড় ইঞ্চি লম্বা একটি সূচীর মত বাহির হইয়াছে। আমার সঙ্গী বলিল, ‘শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ছুঁচ চুরি করেছিলেন। তাতেই ঐ শাস্তি।’ অন্য কিছু না থাকাতে ঐ পাখিকেই বারবার ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলাম।

    বেলা আন্দাজ চারিটার সময় ছোট একটি ঘর দেখিতে পাইলাম। সঙ্গী বলিল, ‘আজ এখানেই থাকিতে হইবে।’ আমি প্রতিবাদ করিয়া বলিলাম, ‘চারটের সময় বসে থাকতে হবে কেন?’

    সঙ্গী বলিল, ‘মাঠে রাত হলে বাঘে খাবে।’ বাঘে খায় এরূপ ইচ্ছা আমার ছিল না। সুতরাং সে রাত্রির জন্য ঐ ঘরেই থাকিলাম। রাত্রিতে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া অনেক প্রকার শব্দ শুনিতে পাইলাম। সে-সব নাকি হাতির শব্দ। সৌভাগ্যক্রমে হাতিগণ আমাদের কোন খবর লইতে আসিলেন না। কিন্ত পরদিন উঠিয়া দেখি ঘোড়াটি নাই। ঘোড়ার স্বামী অনেক আক্ষেপ করিল।

    মাঠ পার হইতে প্রায় চারটা বাজিল। মাঠ যে জায়গায় শেষ হইয়াছে, সেখানেও দেখিলাম একটি ছোট ঘর। সেখানে আসিলে সঙ্গী বিদায় লইয়া অন্য পথে গেল। আমি আমার নিদিষ্ট পথে আস্তে আস্তে চলিলাম। কিছুদূর যাইয়া একটি মাহুতকে পাইলাম, সে হাতি লইয়া ফা- চলিয়াছে। আমি চারি আনা পয়সা দিব বলাতে সে আমাকে তাহার হাতির পিঠে একটু স্থান দিল। মহাসুখে ফা-আসিলাম। কালিদাসবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে সাহস পাইলাম না। রাত্রিতে একটী মুদীর দোকানে থাকিয়া পরদিন ভোরে রওনা হইলাম।

    পথে যে-সকল ছোটখাট ঘটনা হইয়াছিল, তাহা বলিবার প্রয়োজন নাই। তবে একদিনের কথা আবশ্যক। দুই প্রহরের পর আর মানুষের সাড়া শব্দ পাইলাম না। বেলা যতই কমিয়া আসিতে লাগিল, ততই ক্রমাগত নির্জন স্থানে যাইয়া পড়িতে লাগিলাম, তারপর কেবল একটা মাঠ; দুই ধারে উলুবন এবং অন্যান্য দুই একটি ছোট ছোট গাছ। এরূপ জায়গায় সন্ধ্যা হইল। কি করি, কোথায় যাই! প্রাণপণে দৌড়িতে লাগিলাম। পথ এত সংকীর্ণ যে দুই পাশের গাছে গা লাগে। থাকিয়া থাকিয়া আমার বুক গুড় গুড় করিয়া উঠিতে লাগিল। এমন সময় হঠাৎ যেন পিঠে একটা কি লাগিল। চমকিয়া ফিরিয়া দেখিলাম একজন পাহাড়ী লোক। সে আমাকে কি একরকম ভাষায় বলিল-‘তুই কোথায় যাস? তোর প্রাণের ভয় নাই?’ এই বলিয়া সে আমাকে তাহার পিছু পিছু যাইতে সংকেত করিল। আমি সহজেই সে আজ্ঞা পালন করিতে লাগিলাম। সে দুই হাতে উলবন সরাইয়া শুয়োরের মত দৌড়াইতে লাগিল, আর মাঝে মাঝে আমাকে ডাকিয়া বলিতে লাগিল ‘আরে আয়, মরে যাবি।’ আমি হতবুদ্ধি হইয়া তাহার অনুসরণ করিতে লাগিলাম।

    কতক্ষণ এইরূপে চলিলাম বলিতে পারি না। অবশেষে একটা বড় নদীর ধারে আসিলাম, সেখানে দেখিলাম আরো কয়েকজন লোক বসিয়া আছে। পাহাড়ী বলিল, যতক্ষণ নৌকা আসিয়া ও-পারে না যায়, ততক্ষন এখানে বসিয়া থাকিতে হইবে। আমি তাহাদের সঙ্গে মাটিতে বসিলাম। অন্যান্য সকলে পুঁটলি হইতে খাবার খুলিয়া খাইতে লাগিল। পাহাড়ীর সঙ্গে কতকগুলি কমলালেবু ছিল। সে আমাকে তাহার খাবারটা খাইতে দিল। আমি তাহাই খাইয়া, নাক মুখ কাপড়ে ঢাকিয়া সেইখানেই শুইয়া পড়িলাম। অন্যান্য লোকেরা আমাকে বলিতে লাগিল ‘ঘুমিও না, খেয়ে ফেলবে।’ তেমন অবস্থায় ঐরূপ উপদেশ বাক্যের অত্যন্ত আবশ্যক ছিল, কারণ সমস্ত দিনের পরিশ্রমে আমার গা অবশ হইয়া আসিতেছিল। এবং একটু পরেই অতি নিকটে ‘ঘ্যাঁওর’ ‘ঘ্যাঁওর’ করিয়া বাঘ ডাকিতে লাগিল। সমস্ত রাত্রি চারিপাশে দূরে নিকটে হিংস্র জন্তুর শব্দ হইতে লাগিল। সে রাত্রির কথা আমার জীবনে আর কখনো ভুলি নাই। নৌকাওয়ালা ওপারে বসিয়া সুখভোগ করিতেছে; সেখানে নৌকা বোঝাই না হইলে ফিরিয়া আসিবে না। সমস্ত রাত্রি আমাদের প্রান হাতে করিয়া সেই ভয়ানক স্থানে বসিয়া থাকিতে হইল। পরদিন নৌকা আসিলে আমরা ওপারে গেলাম।

    ইহার তিনদিন পর বাড়ির কাছে বাজারে আসিলাম, সেখানে দই, চিড়ে, সন্দেশ ইত্যাদি যাহা কিছু মনে হইল উদরস্থ করিয়া পথকষ্টের প্রতিহিংসা বিধান করিলাম। দুইটার সময় বাড়ি আসিলাম। তখন বাহির বাটিতে কেহ ছিল না। গা ভয়ানক কাঁপিতে লাগিল; শীতে অস্থির হইয়া গেলাম। আশে পাশে যে কয়খানা লেপ কাঁথা ছিল, উপর্যুপরি গায় দিয়া বিছানায় পড়িলাম। শক্ত জ্বর হইল। ফাঁকি দিয়া বড়লোক হওয়ার স্বপ্নটা ভালরকমেই ভাঙ্গিয়া গেল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্য ব্রিদিং মেথড – স্টিফেন কিং
    Next Article পুরাণের গল্প – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

    Related Articles

    উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

    টুনটুনির বই – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

    July 15, 2025
    উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

    পুরাণের গল্প – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

    July 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.