Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    প্রমথ চৌধুরী এক পাতা গল্প460 Mins Read0

    অদৃষ্ট

    শ্রীমতী ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী ফরাসী থেকে অদৃষ্ট নামধেয়[২] যে গল্পটি অনুবাদ করেছেন তার মোদ্দা কথা এই যে, মানুষ পুরুষকারের বলে নিজের মন্দ করতে চাইলেও দৈবের কৃপায় তার ফল ভালো হয়।

    [২. ‘Henri Barbusse-এর ফরাসী হইতে’। সবুজপত্র, অগ্রহায়ণ ১৩২৬]

    এ কিন্তু বিলেতি অদৃষ্ট।

    এ দেশে মানুষ পুরুষকারের বলে নিজের ভালো করতে চাইলেও দৈবের গুণে তার ফল হয় মন্দ। এদেশী অদৃষ্টের একটি নমুনা দিচ্ছি। এ গল্পটি সত্য— অর্থাৎ গল্প যে পরিমাণ সত্য হয়ে থাকে সেই পরিমাণ সত্য— তার চাইতে একটু বেশিও নয়, কমও নয়।

    ১

    এ ঘটনা ঘটেছিল পালবাবুদের বাড়িতে। এই কলকাতা শহরে খেলারাম পালের গলিতে খেলারাম পালের ভদ্রাসন কে না জানে? অত লম্বা-চৌড়া আর অত মাথা উঁচু করা বাড়ি, যিনি চোখে কম দেখেন, তাঁর চোখও এড়িয়ে যায় না। দূর থেকে দেখতে সেটিকে সংস্কৃত কলেজ বলে ভুল হয়। সেই সার সার দোতলা-সমান উঁচু করিস্থিয়ান থাম, সেই গড়ন, সেই মাপ, সেই রঙ, সেই ঢঙ। তবে কাছে এলে আর সন্দেহ থাকে না যে এটি সরস্বতীর মন্দির নয়, লক্ষ্মীর আলয়। এর সুমুখে দিঘি নেই, আছে মাঠ; তাও আবার বড়ো নয়, ছোটো; গোল নয়, চৌকোণ। এ ধাঁচের বাড়ি অবশ্য কলকাতা শহরে বড়ো রাস্তায় ও গলি খুঁজিতে আরো দশ-বিশটা মেলে; তবে খেলারামের বসতবাটীর সুমুখে যা আছে, তা কলকাতা শহরের অপর কোনো বনেদী ঘরের ফটকের সামনে নেই। দুটি প্রকাণ্ড সিংহ তার সিংহদরজার দুধার আগলে বসে আছে। তার একটিকে যে আর সিংহ বলে চেনা যায় না, আর পথচলতি লোকে বলে বিলেতি শেয়াল, তার কারণ বয়সের গুণে তার ইটের শরীর ভেঙে পড়েছে, আর তার চুনবালির জটা খসে পড়েছে। কিন্তু যেটির পৃষ্ঠে সোয়ারি হয়ে, নাকে নথ-পরা একটি পানওয়ালী সকাল-সন্ধে পয়সায় পাঁচটি খিলি বেচে, সেটিকে আজও সিংহ বলে চেনা যায়।

    ২

    এই সিংহ-দুটির দুর্দশা থেকেই অনুমান করা যায় যে, পালবাবুদেরও ভগ্নদশা উপস্থিত হয়েছে। বাইরে থেকে যা অনুমান করা যায়, বাড়ির ভিতরে ঢুকলে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়।

    পালবাবুদের নাচঘরের জুড়ি নাচঘর কোম্পানির আমলে কলকাতায় আর একটিও ছিল না। মেজবাবু অর্থাৎ খেলারামের মধ্যম পুত্র, কলকাতার সব ব্রাহ্মণ কায়স্থ বড়োমানুষদের উপর টেক্কা দিয়ে সে ঘর বিলেতি-দস্তুর সাজিয়েছিলেন। পাশে পাশে টাঙানো আর গায়ে গায়ে ঠেকানো ঝাড়ে ও দেওয়ালগিরিতে সে ঘর চিকমিক করত, চকমক করত। আর এদের গায়ে যখন আলো পড়ত, তখন সব বালখিল্য ইন্দ্ৰধনু তাদের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ক্রমে ঘরময় খেলা করে বেড়াত। সে এক বাহার! তার পর সাটিনে ও মখমলে মোড়া কত যে কৌচ-কুর্সি সে ঘরে জমায়েত হয়েছিল তার আর লেখাজোখা নেই। কিন্তু আসলে দেখবার মতো জিনিস ছিল সেই নাচঘরের সুমুখের বারান্দা। ইতালি থেকে আমদানি করা তুষার ধবল নবনীতসুকুমার মর্মর-প্রস্তরে গঠিত প্রমাণ-সাইজের স্ত্রীমূর্তিসকল সেই বারান্দার দুধারে সার বেঁধে দিবারাত্র ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত— প্রতিটি এক-একটি বিচিত্র ভঙ্গিতে। তাদের মধ্যে কেউ বা স্নান করতে যাচ্ছে, কেউ বা সদ্য নেয়ে উঠেছে, কেউ বা সুমুখের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে রয়েছে, কেউ বা বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কেউ বা সুমুখের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে রয়েছে, কেউ বা বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কেউ বা দুহাত তুলে মাথার চুল কপালের উপর চূড়ো করে বাঁধছে, কেউ বা বাঁ হাতখানি ধনুকাকৃতি করে সামনের দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে— দেখলে মনে হত, স্বর্গের বেবাক অপ্সরা শাপভ্রষ্টা হয়ে মেজবাবুর বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন। সামান্য লোকদের কথা ছেড়ে দিন, এ ভুল মহা মহা পণ্ডিতদেরও হত। তার প্রমাণ— পালপ্রাসাদের সভাপণ্ডিত স্বয়ং বেদান্তবাগীশ মহাশয় একদিন বলেছিলেন, মেজবাবুর দৌলতে মর্তে থেকেই স্বর্গ চোখে দেখলুম। এই পাষাণীরা যদি কারো স্পর্শে সব বেঁচে ওঠে তা হলে এ পুরী সত্যসত্যই অমরাপুরী হয়ে ওঠে।’ এ কথা শুনে মেজবাবুর জনৈক পেয়ারা মোসাহেব বলে ওঠেন, ‘তা হলে বাবুকে একদিনেই ফতুর হতে হত শাড়ির দাম দিতে।’ এ উত্তরে চারি দিক থেকে হাসির তুফান উঠল। এমন- কি, মনে হল যে, ঐ-সব পাষাণমূর্তিদেরও মুখেচোখে যেন ঈষৎ সকৌতুক হাসির রেখা ফুটে উঠল। বলা বাহুল্য যে, এই কলকাতা শহরের উর্বশী মেনকা রন্তা ঘৃতাচীদের নাচে গানে প্রতি সন্ধে এ নাচঘর সরগরম হয়ে উঠত। আর আজকের দিনে তার কি অবস্থা? –বলছি।

    ৩

    এই নাচঘরের এমন আসবাবের ভিতর আছে একটি জরাজীর্ণ কাঠের অতিকায় লেখবার টেবিল আর খানকতক ভাঙা চৌকি। মেঝেতে পাতা রয়েছে একখানি বাহাত্তর বৎসর বয়সের একদম রঙ-জ্বলা এবং নানাস্থানে ইঁদুরে-কাটা কারপেট। এ ঘরে এখন ম্যানেজার সাহেব দিনে আপিস করেন, আর রাত্তিরে সেখানে নর্তন হয় ইঁদুরের— কীর্তন হয় ছুঁচোর।

    এই অবস্থা বিপর্যয়ের কারণ জানতে হলে পালবংশের উত্থান-পতনের ইতিহাস শোনা চাই। সে ইতিহাস আমি আপনাদের সময়ান্তরে শোনাব। কেননা, তা যেমন মনোহারী, তেমনি শিক্ষাপ্রদ। এ কথার ভিতর সে কথা ঢোকাতে চাই নে এই জন্য যে, আমি জানি যে উপন্যাসের সঙ্গে ইতিহাসের খিচুড়ি পাকালে ও দুয়ের রসই সমান কষ হয়ে উঠে।

    ফল কথা এই যে, পালবাবুদের সম্পত্তি এখনো যথেষ্ট আছে। কিন্তু শরিকী বিবাদে তা উচ্ছন্ন যাবার পথে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই ভাঙা ঘর আবার গড়ে তোলবার ভার আপাতত এখন কমন-ম্যানেজারের হাতে পড়েছে। এই ভদ্রলোকের আসল নাম— শ্রীযুক্ত ভূপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, কিন্তু লোকসমাজে তিনি চাটুজ্যে-সাহেব বলেই পরিচিত। এর কারণ, যদিচ তিনি উকিল-ব্যারিস্টার নন, তা হলেও তিনি ইংরেজি পোশাক পরেন— তাও আবার সাহেবের দোকানে তৈরি। চাটুজ্যে-সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের আগাগোড়া পরীক্ষা একটানা ফার্স্ট ডিভিশনেই পাস করে এসেছেন, কিন্তু আদালতের পরীক্ষা তিনি থার্ড ডিভিসনে পাস করতে পারলেন না। এর কারণ, তাঁর Literatureএ taste ছিল, অন্তত এই কথা তো তিনি তাঁর স্ত্রীকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী এ কথাটা মোটেই বুঝতে পারলেন না যে, পক্ষিরাজকে ছক্কড়ে জুতলে কেন না সে তা টানতে পারবে। তবে তিনি অতিশয় বুদ্ধিমতী ছিলেন বলে স্বামীর কথার কোনো প্রতিবাদ করেন নি, নিজের কপালের দোষ দিয়েই বসে ছিলেন যখন সাত বৎসর বিনে রোজগারে কেটে গেল, আর সেই সঙ্গে বয়েসও ত্রিশ পেরুলো, তখন তিনি হাইকোর্টের জজ হবার আশা ত্যাগ করে মাসিক তিনশো টাকা বেতনে পালবাবুদের জমিদারি সম্পত্তির ম্যানেজারের পদ আঁকড়ে ধরতে বাধ্য হলেন। এও দেশী অদৃষ্টের একটা ছোটখাটো উদাহরণ। বাঙালি উকিল না হয়ে সাহেব কৌসুলি হলে তিনি যে Barএ ফেল করে Bench-এ প্রমোশন পেতেন, সে কথা তো আপনারা সবাই জানেন। যার এক পয়সার প্রাকটিস নেই সে যে একদম তিনশো টাকা মাইনের কাজ পায়, এ দেশের পক্ষে এই তো একটা মহা-সৌভাগ্যের কথা। তাঁর কপাল ফিরল কি করে জানেন?–সেরেফ মুরুব্বির জোরে। তিনি ছিলেন একাধারে বনেদী ঘরের ছেলে আর বড়োমানুষের জামাই— অর্থাৎ তাঁর যেমন সম্পত্তি ছিল না, তেমনি ছিল সহায়।

    ৪

    বলা বাহুল্য, জমিদারি সম্বন্ধে চাটুজ্যে-সাহেবের জ্ঞান আইনের চাইতেও কম ছিল। তিনি প্রথম শ্রেণীতে বি.এল. পাস করেন, সুতরাং এ কথা আমরা মানতে বাধ্য যে, আইনের অন্তত পুঁথিগত বিদ্যে তাঁর পেটে নিশ্চয়ই ছিল; কিন্তু কি হাতে-কলমে কি কাগজে-কলমে তিনি জমিদারি বিষয়ে কোনোরূপ জ্ঞান কখনো অর্জন করেন নি। তাই তিনি তাঁর আত্মীয় ও পরমহিতৈষী জনৈক বড়ো জমিদারের কাছে এ ক্ষেত্রে কিংকর্তব্য, সে সম্বন্ধে পরামর্শ নিতে গেলেন। তিনি যে পরামর্শ দিলেন, তা অমূল্য। কেননা, তিনি ছিলেন একজন যেমনি হুঁশিয়ার, তেমনি জবরদস্ত জমিদার। তার পর জমিদার মহাশয় ছিলেন অতি স্বল্পভাষী লোক। তাই তাঁর আদ্যোপান্ত উপদেশ এখানে উদ্ধৃত করে দিতে পারছি। জমিদারি শাসন-সংস্করণ সম্বন্ধে তাঁর মতামত, আমার বিশ্বাস, অনেকেরই কাজে লাগবে। তিনি বললেন, ‘দেখো বাবাজি, যে পৈতৃক সম্পত্তির আয় ছিল সালিয়ানা দু লক্ষ টাকা, আমার হাতে তা এখন চার লক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং আমি যে জমিদারির উন্নতি করতে জানি, এ কথা আমার শত্রুরাও স্বীকার করে। আর দেশে আমার শত্রুরও অভাব নেই। জমিদারি করার অর্থ কি জান? জমিদারির কারবার জমি নিয়ে নয়, মানুষ নিয়ে। ও হচ্ছে একরকম ঘোড়ায় চড়া। লোকে যদি বোঝে যে, পিঠে সোয়ার চড়েছে, তা হলে তাকে আর ফেলবার চেষ্টা করে না। প্রজা হচ্ছে জমিদারির পিঠ, আর আমলা-ফয়লা তার মুখ। তাই বলছি, প্রজাকে শায়েস্তা রাখতে হবে খালি পায়ের চাপে; কিন্তু চাবুক চালিয়ো না, তা হলেই সে পুস্তক ঝাড়বে আর অমনি তুমি ডিগবাজি খাবে। অপরপক্ষে আমলাদের বাগে রেখে রাশ কড়া করে ধরো কিন্তু সে রাশ প্রাণপণে টেনো না, তা হলেই তারা শির-পা করবে আর অমনি তুমি উল্টো ডিগবাজি খাবে। এক কথায় তোমাকে একটু রাশভারী হতে হবে, আর একটু কড়া হতে হবে। বাবাজি, এ তো ওকালতি নয় যে, হাকিমের সুমুখে যত নুইয়ে পড়বে নেতিয়ে পড়বে, আর যত তার মনজোগানো কথা কইবে তত তোমার পসার বাড়বে। ওকালতি করার ও জমিদারি করার কায়দা ঠিক উল্টো উল্টো।

    এ কথা শুনে চাটুজ্যে-সাহেব আশ্বস্ত হলেন; মনে মনে ভাবলেন যে, যখন তিনি ওকালতিতে ফেল করেছেন, তখন তিনি নিশ্চয়ই জমিদারিতে পাস করবেন। কিন্তু তাঁর মনের ভিতর একটু ধোঁকাও রয়ে গেল। তিনি জানতেন যে, তাঁর পক্ষে রাশভারী হওয়া অসম্ভব। তাঁর চেহারা ছিল তার প্রতিকূল। তিনি ছিলেন একে মাথায় ছোটো তার উপর পাতলা, তার উপর ফর্সা, তার পর তাঁর মুখটি ছিল স্ত্রীজাতির মুখমণ্ডলের ন্যায় কেশহীন—অবশ্য হাল-ফেশান অনুযায়ী দুসন্ধ্যা স্বহস্তে ক্ষৌরকার্যের প্রসাদে। ফলে, হঠাৎ দেখতে তাঁকে আঠারো বৎসরের ছোকরা বলে ভুল হত। রাশভারী হওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব জেনে তিনি স্থির করলেন যে, তিনি গম্ভীর হবেন। মধুর অভাবে গুড়ে যেমন দেবার্চনার কাজ চলে যায়, তিনি ভাবলেন, রাশভারী হতে না পেরে গম্ভীর হতে পারলেই জমিদারি শাসনের কাজ তেমনি সুচারুরূপে সম্পন্ন হবে।

    তারপর এও তিনি জানতেন যে, মানুষের উপর কড়া হওয়া তাঁর ধাতে ছিল না। এমন-কি, মেয়েমানুষের উপরও তিনি কড়া হতে পারতেন না। তাই তিনি আপিসে নানারকম কড়া নিয়মের প্রচলন করলেন এই বিশ্বাসে যে, নিয়ম কড়া হলেই কাজেরও কড়াক্কড় হবে। তিনি আপিসে ঢুকেই হুকুম দিলেন যে, আমলাদের সব ঠিক এগারোটায় আপিসে উপস্থিত হতে হবে, নইলে তাদের মাইনে কাটা যাবে। এ নিয়মের বিরুদ্ধে প্রথমে সেরেস্তায় একটু আমলা-তান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছিল, কিন্তু চাটুজ্যেসাহেব তাতে এক চুলও টললেন না, আন্দোলনও থেমে গেল।

    ৫

    পাল-সেরেস্তার আমলাদের চিরকেলে অভ্যাস ছিল বেলা বারোটা সাড়ে-বারোটার সময় পান চিবতে চিবতে আপিসে আসা, তার পর এক ছিলিম গুড়ুক টেনে কাজে বসা। মুনিব যেখানে বিধবা আর নাবালক— সেখানে কর্মচারীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত হয়। কিন্তু তারা যখন দেখল যে, ঘড়ির কাঁটার উপর হাজির হলেই হুজুর খুশি থাকেন, তখন তারা একটু কষ্টকর হলেও বেলা এগারোটাতে হাজিরা সই করতে শুরু করে দিলে। অভ্যেস বদলাতে আর কদিন লাগে?

    মুশকিল হল কিন্তু প্রাণবন্ধু দাসের। এ ব্যক্তি ছিল এ কাছারির সবচেয়ে পুরানো আমলা। পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়সের মধ্যে বিশ বৎসর কাল সে এই স্টেটে একই পোস্টে একই মাইনেতে বরাবর কাজ করে এসেছে। এতদিন যে তার চাকরি বজায় ছিল, তার কারণ— সে ছিল অতি সৎলোক, চুরি-চামারির দিক দিয়েও সে ঘেঁষত না। আর তার মাইনে যে কখনো বাড়ে নি, তার কারণ সে ছিল কাজে অতি ঢিলে।

    প্রাণবন্ধু কাজ ভালোবাসত না, পৃথিবীতে ভালোবাসত শুধু দুটি জিনিস;—এক তার স্ত্রী, আর এক তামাক। এই ঐকান্তিক ভালোবাসার প্রসাদে তার শরীরে দুটি অসাধারণ গুণ জন্মেছিল। বহুদিনের সাধনার ফলে তার হাতের লেখা হয়েছিল যেরকম চমৎকার, তার সাজা তামাকও হত তেমনি চমৎকার।

    আপিসে এসে তার নিত্যনিয়মিত কাজ ছিল— সর্বপ্রথমে তার স্ত্রীকে একখানি চিঠি লেখা। গোড়ায় ‘প্রিয়ে, প্রিয়তরে, প্রিয়তমে’ এই সম্বোধন এবং শেষে ‘তোমারই প্রাণবন্ধু দাস’ এই দ্ব্যর্থ-সূচক স্বাক্ষরের ভিতর, প্রতিদিন ধীরে সুস্থিরে ধরে ধরে পুরো চার পৃষ্ঠা চিঠি লিখতে লিখতে তার হাতের অক্ষর ছাপার অক্ষরের মতো হয়ে উঠেছিল। এইজন্য আপিসের যত দলিলপত্র তাকেই লিখতে দেওয়া হত। এই অক্ষরের প্রসাদেই তার চাকরির পরমায়ু অক্ষম হয়েছিল।

    তারপর প্রাণবন্ধু ঘণ্টায় ঘণ্টায় তামাক খেত— অবশ্য নিজ হাতে সেজে। পরের হাতে সাজা-তামাক খাওয়া তার পক্ষে তেমনি অসম্ভব ছিল— পরের হাতের লেখা চিঠি তার স্ত্রীকে পাঠানো তার পক্ষে যেমন অসম্ভব ছিল। সে কল্কেয় প্রথমে বেশ করে ঠিকরে দিয়ে তার উপর তামাক এলো করে সেজে তার উপর আলগোছে মাটির তাওয়া বসিয়ে, তার উপর আড় করে স্তরে স্তরে টীকে সাজিয়ে, তার পর সে টীকের মুখাগ্নি করে হাতপাখা দিয়ে আস্তে আস্তে বাতাস করে ধীরে ধীরে তামাক ধরাত। আধঘণ্টা তদবিরের কম যে আর ধোঁয়া গোল হয়ে, নিটোল হয়ে, মোলায়েম হয়ে, নলের মুখ দিয়ে অনর্গল বেরোয় না— এ কথা যারা কখনো হুকো টেনেছে, তাদের মধ্যে কে না জানে?

    এই চিঠি লেখা আর তামাক সাজার ফুরসতে প্রাণবন্ধু আপিসের কাজ করত এবং সে কাজও সে করত অন্যমনস্কভাবে। বলা বাহুল্য যে সে ফুরসৎ তার কত কম ছিল। এর চিঠি ওর খামে পুরে দেওয়া তার একটা রোগের মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এ সত্ত্বেও সমগ্র সেরেস্তা যে তাকে ছাড়তে চাইত না, সত্য কথা বলতে গেলে তার আসল কারণ এই যে, প্রাণবন্ধু সেরেস্তায় হুঁকোবরদাবির কাজ করত— আর সবাই জানত যে, অমন হুকোবরদার মুচিখোলার নবাববাড়িতেও পাওয়া দুষ্কর। তার করস্পর্শে দা-কাটাও ভেলসা হয়ে, খরসানও অম্বুরি হয়ে উঠত।

    প্রাণবন্ধুর উপরে সকলে সন্তুষ্ট থাকলেও, সে সকলের উপর সমান অসন্তুষ্ট ছিল। প্রথমত তার ধারণা ছিল যে, তার মাইনে যে বাড়ে না, তা সে চোর নয় বলে। অথচ তার বেতনবৃদ্ধির বিশেষ দরকার ছিল। কেননা, তার স্ত্রী ক্রমান্বয়ে নূতন ছেলের মুখ দেখতেন। বংশবৃদ্ধির সঙ্গে বেতনবৃদ্ধির যে কোনোই যোগাযোগ নেই, এই মোটা কথাটা প্রাণবন্ধুর মনে আর কিছুতেই বসল না। ফলে তার মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে গেল যে, আপিসের কর্তৃপক্ষেরা গুণের আদর মোটেই করেন না। সুতরাং তার পক্ষে, কি কথায়, কি কাজে, কর্তৃপক্ষের মন জুগিয়ে চলা সম্পূর্ণ নিরর্থক। শেষটা দাঁড়াল এই যে, প্রাণবন্ধু যা খুশি তাই করত, যা খুশি তাই বলত— কারো কোনো পরোয়া রাখত না। কর্তৃপক্ষেরাও তার কথায় কান দিতেন না; কেননা, তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন যে, প্রাণবন্ধু হচ্ছে স্টেটের একজন পেনসানভোগী।

    ৬

    এই নূতন ম্যানেজারের হাতে পড়ে প্রাণবন্ধু পড়ল মুশকিলে। সে ভদ্রলোক বেলা এগারোটায় আপিসে আর কিছুতেই এসে জুটতে পারলে না। ফলে তাকে নিয়ে হুজুর পড়লেন আরো বেশি মুশকিলে। নিত্য তার মাইনে কাটা গেলে বেচারা যায় মারা- আর না কাটলেও তাঁর নিয়ম যায় মারা। এই উভয়-সংকটে তিনি তাকে কর্ম হতে অবসর দেওয়াই স্থির করলেন। এই মনস্থ করে তিনি তার কৈফিয়ত চাইলেন, তার পর তার জবাবদিহি শুনে অবাক হয়ে গেলেন। প্রাণবন্ধু তাঁর সুমুখে দাঁড়িয়ে অম্লানবদনে বললে, “হুজুর, আটটার আগে ঘুমই ভাঙে না। তার পর চা আর তামাক খেতেই ঘণ্টাখানেক কেটে যায়। তার পর নাওয়া-খাওয়া করে এক ক্রোশ পথ পায়ে হেঁটে কি আর এগারোটার মধ্যে আপিসে পৌঁছানো যায়?”

    এ জবাব শুনে হুজুর যে অবাক হয়ে রইলেন, তার কারণ তাঁর নিজেরও অভ্যেস ছিল ঐ সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে ওঠা। তারপর চা-চুরুট খেতে তাঁরও সাড়ে নয়টা বেজে যেত। সুতরাং পায়ে হেঁটে আপিসে আসতে হলে তিনি যে সেখানে এগারোটার ভিতর পৌঁছতে পারতেন না, এ কথা তিনি মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে অস্বীকার করতে পারলেন না। সেই অবধি প্রাণবন্ধুর দেরি করে আপিসে আসাটা চাটুজ্যে-সাহেব আর দেখেও দেখতেন না। ম্যানেজারের উপর প্রাণবন্ধুর এই হল প্ৰথম জিত।

    দুদিন না যেতেই চাটুজ্যে-সাহেব আবিষ্কার করলেন যে, প্রাণবন্ধুকে ডেকে কখনো তম্মুমূর্তে পাওয়া যায় না। যখনই ডাকেন, তখনই শোনেন যে প্রাণবন্ধু তামাক সাজছে। শেষটায় বিরক্ত হয়ে একদিন তাকে ধমক দেবামাত্র প্রাণবন্ধু কাতরস্বরে বললে, “হুজুর, আমি গরিব মানুষ, তাই আমাকে তামাক খেতে হয়, আর তা নিজেই সেজে খেতে হয়। পয়সা থাকলে সিগারেট খেতুম, তা হলে আমাকে কাজ থেকে এক মুহূর্তের জন্য ও উঠতে হত না। বাঁ হাতে অষ্ট প্রহর সিগারেট ধরে ডান হাতে কলম চালাতুম।”

    এবারও হুজুরকে চুপ করে থাকতে হল; কেননা, হুজুর নিজে অষ্টপ্রহর সিগারেট ফুঁকতেন, তার আর এক দণ্ডও কামাই ছিল না। তিনি মনে ভাবলেন, প্রাণবন্ধু যা খুশি তাই করুক গে, তাকে আর তিনি ঘাঁটাবেন না।

    কিন্তু প্রাণবন্ধুকে আবার তিনি ঘাঁটাতে বাধ্য হলেন। একখানি জরুরি দলিল, যা একদিনেই লিখে শেষ করা উচিত ছিল, সেখানা প্রাণবন্ধু যখন দুদিনেও শেষ করতে পারলে না তখন তিনি দেওয়ানজির প্রতি এই দোষারোপ করলেন যে, তিনি আমলাদের দিয়ে কাজ তুলে নিতে পারেন না। দেওয়ানজি উত্তর করলেন যে, তিনি সকলের কাছে কাজ আদায় করতে পারেন, কিন্তু পারেন না এক প্রাণবন্ধুর কাছ থেকে। যেহেতু প্রাণবন্ধু আপিসে এসে আপিসের কাজ না করে নিত্যি ঘণ্টাখানেক ধরে আর কি ইনিয়ে বিনিয়ে লেখে।

    প্রাণবন্ধুর তলব হল এবং কৈফিয়ত চাওয়া হল। হুজুরের উপর দু-দুবার জিত হওয়ায় তার সাহস বেজায় বেড়ে গিয়েছিল। সে ম্যানেজার সাহেবের মুখের উপরে এই জবাব করলে, “হুজুর, আমার লেখার একটু হাত আছে তাই লিখে লিখে হাত পাকাবার চেষ্টা করি।”

    “তোমার হাতের লেখা যথেষ্ট পাকা, তা আর বেশি পাকাবার দরকার নেই। আর যদি আরো পাকাতে হয় তো আপিসের লেখা লিখলেই হয়— বাজে লেখা কেন?”

    “হুজুর, হাতের লেখার কথা বলছি নে। আমার প্রাণে একটু কাব্যরস আছে, তাই প্রকাশ করবার জন্য লিখি। আর সে কথা বাজে নয়। গরিব মানুষের না হলে সে লেখা সব পুস্তক আকারে প্রকাশিত হত। আমাকে তাই ঘরের লোকের পড়ার জন্যই লিখতে হয়। যদি আমার পয়সা থাকত, তা হলে তো ছাইপাঁশ লিখে দেশের মাসিক পত্র ভরিয়ে দিতে পারতুম।”

    এই উত্তরে চাটুজ্যে-সাহেবের আঁতে ঘা লাগল। তিনি যে আপিসে বসে মাসিক পত্রিকার জন্য ইনিয়ে-বিনিয়ে হরেকরকম বেনামী প্রবন্ধ লিখতেন আর সে লেখাকে সমালোচকেরা ছাইপাঁশ বলত, এ কথা আর যার কাছেই থাক, তাঁর কাছে তো আর অবিদিত ছিল না। তিনি আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলেন না, চক্ষু রক্তবর্ণ করে বলে উঠলেন, “দেখো, তোমার হওয়া উচিত ছিল— “তাঁর কথা শেষ করতে না দিয়েই প্রাণবন্ধু বলে ফেলল, “বড়োমানুষের জামাই। কিন্তু অদৃষ্ট তো আর সবারই সমান নয়।”

    রোষে ক্ষোভে হুজুরের বাকরোধ হয়ে গেল। তিনি তাকে তর্জনী দিয়ে দরজা দেখিয়ে দিলেন, প্রাণবন্ধু বিনা বাক্যব্যয়ে স্বস্থানে প্রস্থান করল— আর এক ছিলিম ভালো করে তামাক সাজতে।

    প্রাণবন্ধুর কিন্তু হুজুরকে অপমান করবার কোনোই অভিপ্রায় ছিল না। সে শুধু নিজে সাফাই হবার জন্য ও-সব কথা বলেছিল। হিসেব করে কথা কওয়ার অভ্যাস তার কস্মিনকালেও ছিল না, আর পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়সে একটা নূতন-ভাষা শেখা মানুষর পক্ষে অসম্ভব।

    ৭

    চাটুজ্যে-সাহেব দেওয়ানজিকে ডেকে বললেন, “প্রাণবন্ধুকে দিয়ে আর চলবে না, তার জায়গায় নূতন লোক বাহাল করা হোক।” নূতন লোক খুঁজে বার করবার জন্যে দেওয়ানজি সাত দিনের সময় নিলেন। এর ভিতর তাঁর একটু গূঢ় মতলব ছিল। তিনি জানতেন, প্রাণবন্ধুর দ্বারা কস্মিনকালেও কাজ চলে নি, অতএব যে-চাকরি তার এতদিন বজায় ছিল, আজ তা যাবার এমন কোনো নূতন কারণ ঘটে নি। তাছাড়া তিনি জানতেন যে হুজুরের রাগ হপ্তা না পেরোতেই চলে যাবে আর প্রাণবন্ধু সেরেস্তার যে কাজ চিরকাল করে এসেছে, ভবিষ্যতেও তাই করবে— অর্থাৎ তামাক সাজা। ফলে প্রায় হয়েছিলও তাই। যেমন দিন যেতে লাগল, তাঁর রাগও পড়ে আসতে লাগল, তারপর সপ্তম দিনের সকালবেলা চাটুজ্যে সাহেব রাগের কণাটুকুও মনের কোনো কোণে খুঁজে পেলেন না। তিনি তাই ঠিক করলেন যে, এবারকার জন্য প্রাণবন্ধুকে মাপ করবেন। তারপর তিনি যখন ধরা-চুড়ো পরে আপিস যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, তখন তার স্ত্রী তাঁর হাতে একখানি চিঠি দিয়ে বললেন, “দেখো তো, এ চিঠির অর্থ আমি কিছুই বুঝতে পারছি নে।”

    সে চিঠি এই—

    “প্রিয়ে প্রিয়তরে প্রিয়তমে,

    আজ তোমাকে বড়ো চিঠি লিখতে পারব না, কেননা আর-একখানি মস্ত চিঠি লিখতে হয়েছে। জানই তো আমাদের ছোকরা হুজুর আমাকে নেকনজরে দেখেন না, কেননা আমি চোর নই, অতএব খোসামুদেও নই। বরাবর দেখে আসছি যে, পৃথিবীতে গুণের আদর কেউ করে না, সবাই খোসামোদের বশ। কিন্তু আমাদের এই নূতন ম্যানেজারের তুল্য খোসামোদ-প্রিয় লোক আমি তো আর কখনো দেখি নি। একমাত্র খোসামোদের জোরে যত বেটা চোর তাঁর প্রিয়পাত্র হয়েছে। যাদের হাতে তিনি পাকাকলা হয়েছেন, তাদের মুখে হুজুরের সুখ্যাতি আর ধরে না। অমন রূপ, অমন বুদ্ধি, অমন বিদ্যে, অমন মেজাজ একাধারে আর কোথাও নাকি পাওয়া যায় না। এসব শুনে তিনিও মহাখুশি। প্রিয়পাত্রেরা কাগজ সুমুখে ধরলেই অমনি তাতে চোখ বুজে সই মেরে বসেন। এঁর হাতে স্টেটটা আর কিছুদিন থাকলে নির্ঘাত গোল্লায় যাবে। জমিদারির ম্যানেজারি করার অর্থ ইনি বোঝেন, গম্ভীর হয়ে কাঠের চৌকিতে কাঠের পুতুলের মতো খাড়া হয়ে এগারোটা পাঁচটায় ঠায় বসে থাকা। ইনি ভাবেন, ওতে তাঁকে রাশভারী দেখায়, কিন্তু আসলে কিরকম দেখায় জান?— ঠিক একটি সাক্ষীগোপালের মতো। ইনি আপিসে ঢুকেই একটি কড়া হুকুম প্রচার করেছেন যে, কর্মচারীদের সব এগারোটায় হাজির হতে হবে আর পাঁচটায় ছুটি। আমি অবশ্য এ হুকুম মানি নে। কেননা, যারা কাজের হিসেব জানে না তারাই ঘণ্টার হিসেব করে, সেই পুরুতদের মতো যারা মন্ত্র পড়তে জানে না, কিন্তু ঘণ্টা নাড়তে জানে। খোসামুদেরা বলে, ‘হুজুরের কাজের কায়দা একদম সাহেবি।’ ইনি এতেই খুশি, কেননা এঁর মগজে সে বুদ্ধি নেই, যা থাকলে বুঝতেন যে, লেফাফা-দুরস্ত হলে যদি কাজের লোক হওয়া যেত তা হলে পোশাক পরলেও সাহেব হওয়া যেত। এঁর বিশ্বাস ইনি সাহেব, কিন্তু আসলে কি জান? মেমসাহেব। অন্তত দূর থেকে দেখলে তো তাই মনে হয়। কেন জান?— এঁর পুরুষের চেহারাই নয়। এঁর রঙটা ফ্যাকাসে— সাবান মেখে, আর দাড়ি-গোঁফের লেশমাত্র নেই, কিন্তু আছে একমাথা চুল, তাও আবার কটা সে যাই হোক, একটু বিপদে পড়ে এই মেমসাহেবের মেমসাহেবকে একখানি চিঠি লিখতে বাধ্য হয়েছি। আজ দুদিন থেকে কানাঘুষো শুনছি যে, হুজুর নাকি আমাকে বরখাস্ত করবেন। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায় না, আমার মতো গুণী লোকের চাকরির ভাবনা নেই। তবে কিনা, অনেক দিন আছি বলে জায়গাটার উপর মায়া পড়ে গেছে মুনিবকে কিছু বলা বৃথা, কেননা, তিনি মুখ থাকতেও বোবা, চোখ থাকতেও কানা। তাই তাঁকে কিছু না বলে যিনি সেই মুনিবের মুনিব, তাঁর অর্থাৎ তাঁর স্ত্রীর কাছে একখানি দরখাস্ত করেছি। শুনতে পাই আমাদের সাহেব মেমসাহেবের কথায় ওঠেন বসেন। এ কথায় বিশ্বাস হয়, কারণ এর স্ত্রী শুনেছি ভারি সুন্দরী— প্রায় তোমার মতো। তারপর এই অপদার্থটা তার স্ত্রীর ভাগ্যেই খায়— শুধু ভাত নয়, মদও খায়, চুরুটও খায়। ইনি বিদ্যের মধ্যে শিখেছেন ঐ দুটি। সে যাই হোক, এঁর গৃহিণীকে যে চিঠিখানা লিখেছি, সে একটা পড়বার মতো জিনিস। আমার দুঃখ রইল এই যে, সেখানি তোমার কাছে পাঠাতে পারলুম না। তার ভিতর সমান অংশে বীররস আর করুণরস পুরে দিয়েছি, আর তার ভাষা একদম সীতার বনবাসের। শুনতে পাই কর্ত্রীঠাকুরানী খুব ভালো লেখাপড়া জানেন। আমার এই চিঠি পড়েই তিনি বুঝতে পারবেন যে, তাঁর স্বামী ও তোমার স্বামী এ দুজনের মধ্যে কে বেশি গুণী। আশা করছি, কাল তোমাকে দশ টাকা মাইনে বাড়ার সুখবর দিতে পারব।

    তোমারই প্রাণবন্ধু দাস।”

    চাটুজ্যে সাহেব চিঠিখানি আদ্যোপান্ত পড়ে ঈষৎ কাষ্ঠহাসি হেসে স্ত্রীকে বললেন—”এ চিঠি তোমার নয়, ভুল খামে পোরা হয়েছে।”

    বলা বাহুল্য, পত্রপাঠমাত্র প্রাণবন্ধুর বরখাস্তের হুকুম বেরোল। চাটুজ্যে-সাহেব সব বরদাস্ত করতে পারেন, একমাত্র স্ত্রীর কাছে অপদস্থ হওয়া ছাড়া। কেননা, তিনি ও ছিলেন প্রাণবন্ধুর জুড়ি, পত্নীগতপ্রাণ।

    এই চিঠিই হল প্রাণবন্ধু দাসের স্ত্রীর যথার্থ অদৃষ্ট-লিপি, আর সে লিপি সংশোধনের কোনোরূপ উপায় ছিল না, কেননা তা ছাপার অক্ষরে লেখা।

    অগ্রহায়ণ ১৩২৬

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
    Next Article প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    Related Articles

    প্রমথ চৌধুরী

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Our Picks

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.