Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    প্রমথ চৌধুরী এক পাতা গল্প460 Mins Read0

    নীল-লোহিতের সৌরাষ্ট্র-লীলা

    ১

    পুজোর নম্বর ‘বসুমতী’র জন্য একটি গল্প লিখে দিতে বহুদিন থেকে প্রতিশ্রুত আছি। নানা কার্যে ব্যস্ত থাকায় এতদিন লেখায় হাত দিতে পারি নি।

    আজ ঘুম থেকে উঠেই সংকল্প করলুম যে, যা থাকে কপালে একটা গল্প সূর্য ডোববার আগেই লিখে শেষ করব।

    তার পর কলম হাতে নিয়ে দেখি যে, আমার মাথার ভিতর এখন আর কিছুই নেই—এক কংগ্রেস ছাড়া। আর কংগ্রেসের গল্প আমি পারি শুধু পড়তে, লিখতে নয়। কেননা দিল্লিতে আমি যাই নি।

    এ অবস্থায় নিজের মাথা থেকে গল্প বার করা অসম্ভব দেখে একটা অপরের জানা না হোক, আমার শোনা গল্প লেখাই স্থির করলুম।

    এ গল্পটি আমি নীল-লোহিতের মুখে শুনেছিলুম। নীল-লোহিত লোকটি যে কে, তা অবশ্য আপনি জানেন। গত বৎসর এই সময়ে তাঁর সবিশেষ পরিচয় “মাসিক বসুমতীতে দিয়েছি। আর আপনার কাগজের পাঠক সম্প্রদায়েরও অনেকেরই বোধ হয় নীল-লোহিতের কথা স্মরণ আছে।

    আমার জনৈক ব্রাত্য-ক্ষত্রিয় বন্ধু একদিন আমার কাছে প্রমাণ করতে চেষ্টা করছিলেন যে, বর্তমান বেদ জাল, আর এ জাল ব্রাহ্মণরা করেছে। তাঁর বক্তব্য ছিল এই যে, মূল বেদ যখন প্রলয়পয়োধিজলে নিমগ্ন হয়েছিল তখন অবশ্য তার বেবাক অক্ষর ধুয়ে গেছল। এ অকাট্য যুক্তি শুনে আমি হাস্য সংবরণ করতে পারি নি। ফলে বন্ধুবর একেবারে উগ্র-ক্ষত্রিয় হয়ে উঠে আমাকে সরোষে বলেন যে, তাঁর কথা আমি বুঝতে পারব না, যেহেতু, আমরা ব্রাহ্মণরা বাস করি ব্রহ্মার সৃষ্ট জগতে, আর তাঁরা বাস করেন বিশ্বামিত্রের জগতে। কথাটা শুনে আমি প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে যাই। তার পর ভেবে দেখেছি যে, কথাটা সত্য। আমাদের সকলের দেহ শুধু একই মাটির পৃথিবীতে অবস্থান করে, কিন্তু প্রত্যেকের মন আলাদা আলাদা বিশ্বে বাস করে। আমি বাস করি মর্তলোকে, আর নীল-লোহিত বাস করতেন কল্পলোকে। সাদা কথায় আমি বাস করি ব্রিটিশ রাজ্যে, আর নীল-লোহিত বাস করতেন কল্পনারাজ্যে। সুতরাং আমার মুখে নীল-লোহিতের গল্প শুনে শ্রোতাদের দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হবে।

    তখন সবে সুরাট কংগ্রেস ভেঙেছে। কলকাতায় আর কোনো কথা নেই। পাঁচজন একত্র হলেই— সে কংগ্রেস কেন ভাঙল, কি করে ভাঙল, যে জুতোটা উড়ে এসে প্রেসিডেন্টের পায়ে লুটিয়ে পড়ল সেটা বিলেতি পম্প কি পাঞ্জাবী নাগরা, মারহাট্টি চটি কি মাদ্রাজী চাপলি— এই সব নিয়ে তখন আমাদের মধ্যে ঘোর গবেষণা ও মহা বাদানুবাদ চলছে।

    একদিন আমরা সকলে আড্ডায় বসে উক্ত যুগপ্রবর্তক জুতোটির জাতি-নির্ণয় করতে ব্যস্ত আছি, এমন সময় নীল-লোহিত হঠাৎ বলে উঠলেন যে, তিনি স্বয়ং সশরীরে সুরাটে উপস্থিত ছিলেন এবং ভিতরকার রহস্য একমাত্র তিনিই জানেন; দ্বিতীয় ব্যক্তি যে জানে, প্রাণ গেলেও সে রহস্য সে ফাঁস করবে না।

    এ কথা শুনে একজন eye-witness-এর কথা শোনাবার জন্য আমরা সকলে ব্যগ্ৰ হয়ে উঠলুম, যদিচ আমরা সবাই জানতুম যে, সে কথার সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।

    নীল-লোহিত বললেন, ‘তোমরা যদি তর্ক থামাও তো গল্প বলি।”

    অমনি আমরা সবাই মৌনব্রত অবলম্বন করলুম। তিনি তাঁর সুরাট-অভিযানের বর্ণনা শুরু করলেন। তাঁর কথার অক্ষরে অক্ষরে পুনরাবৃত্তি করতে হলে গল্প একটা নভেল হয়ে উঠবে। সুতরাং যত সংক্ষেপে পারি তাঁর মোদ্দা কথা আপনাদের শোনাচ্ছি— অর্থাৎ মাছ বাদ দিয়ে তার কাঁটাটুকু আপনাদের কাছে ধরে দিচ্ছি।

    ২

    নীল-লোহিত সুরাট গেছলেন বি.এন. আর. দিয়ে একটি প্যাসেঞ্জার গাড়িতে, অর্থাৎ একেবারে একলা; তাই তাঁর সঙ্গে অপর কোনো বাঙালি ডেলিগেটের সাক্ষাৎ হয় নি। গাড়ি টিকোতে টিকোতে ছ দিনের দিন সন্ধেবেলায় সুরাট গিয়ে পৌঁছল। নীল- লোহিত সুরাট স্টেশনে নেমে একখানি টঙ্গা ভাড়া করে কংগ্রেস ক্যাম্পের দিকে রওনা হলেন। গুজরাটে টঙ্গা অবশ্য একরকম গোরুর গাড়ি, কিন্তু গুজরাটের গোরু বাঙলার ঘোড়ার চাইতে ঢের মজবুত ও তেজী। তারা ঠিক তাজি-ঘোড়ার মতো কদমে চলে, আর তাদের গলার ঘণ্টা গির্জার ঘণ্টার মতো সা-র-গ-ম সাধে, আর বাইজির পায়ের ঘুঙুরের মতো তালে বাজে। গাড়িতে ছ দিন নীল-লোহিতকে একরকম অনশনেই কাটাতে হয়েছিল। সকালেবেলায় এক গেলাস কাঁচা দুধ ও রাত্তিরে এক মুঠো কাঁচা ছোলার বেশি তাঁর ভাগ্যে আর কিছু আহার জোটে নি। স্টেশনে স্টেশনে অবশ্য লাড্ডু পাওয়া যায়, কিন্তু সে লাড্ডু আকারে ভাটার মতো, আর সে চিজ দাঁতে ভাঙবার জো নেই, গিলে খেতে হয়, আর তা গেলবার জন্য গলার নলী হওয়া চাই ড্রেন-পাইপের মতো মোটা। আর পুরি?— তার একখানা ছুঁড়ে মারলে নাকি প্রেসিডেন্টকে আর দেশে ফিরতে হত না। পৃথিবীতে নাকি এমন জুতো নেই, যার সুখতলা আকারে ও কাঠিন্যে তার কাছেও ঘেঁষতে পারে। এক-একখানি পুরি যেন এক-একখানা খড়ম। সুতরাং নীল-লোহিত যদিও অনশনে মৃতপ্রায় হয়েছিলেন, তবুও সুরাটের বড়ো রাস্তার দৃশ্য দেখে তিনি ক্ষুধা-তৃষ্ণা একদম ভুলে গেলেন। যতদূর যাও, পথের দুপাশে সব জানালাতে যেন সব পদ্মফুল ফুটে রয়েছে। গুর্জরে অবরোধপ্রথা নেই, আর গুর্জররমণীদের তুল্য সুন্দরী সুরপুরীতেও মেলা ভার। এ দৃশ্য দেখতে দেখতে তাঁর মোহ উপস্থিত হল, যেন প্রতি জানালায় একটি করে Juliet দাঁড়িয়ে আছে, আর তিনি হচ্ছেন স্বয়ং Romeo। কিন্তু টঙ্গা এমনি ছুটে চলেছে যে, তিনি কারো কারো কাছে ‘kill the envious moon’ এ কথা-কটি বলবারও অবকাশ পেলেন না। তার পর এক সময়ে তাঁর মনে হল যে, টঙ্গা এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে, আর তাঁর দক্ষিণ ও বাম দুপাশ দিয়েই অসংখ্য সুন্দরীর শোভাযাত্রা চলেছে। নীল-লোহিত যে পথিমধ্যে কারো ভালোবাসায় পড়ে যান নি, তার একমাত্র কারণ— এই নাগরীর হাটে কাকে ছেড়ে কার ভালোবাসায় তিনি পড়বেন? বিবাহ অবশ্য একসঙ্গে দুশো তিনশো করা যায়, কিন্তু ভালোবাসায় পড়তে হয় মাত্র একজনের সঙ্গে—অন্তত এক সময়ে তো তাই। এ দিকে পেট খালি, ও দিকে হৃদয় পূর্ণ; এই অবস্থায় নীল-লোহিত কংগ্রেস-ক্যাম্পে গিয়ে অবতরণ করলেন। সেখানে উপস্থিত হবামাত্র তাঁর রূপের নেশা ছুটে গেল। তিনি প্রথমে গিয়েই টিকেট কিনলেন, তাতেই তাঁর পকেট প্রায় খালি হয়ে এল। তার পর শোনেন যে, কংগ্রেস-ক্যাম্পে আর জায়গা নেই; যার কাছেই যান, তিনি বললেন, স্থানং তিলধারণে।” ছ দিন পেটে ভাত নেই, ছ রাত্তির চোখে ঘুম নেই, তার উপর আবার যদি সুরাটের পথে পথে সমস্ত রাত ঘুরে বেড়াতে হয় তা হলেই তো নির্ঘাত মৃত্যু। নীল-লোহিত একেবারে জলে পড়লেন, আর ভেবে কোনো কূলকিনারা করতে পারলেন না। তাঁর এই দুরাবস্থা দেখে টঙ্গাওয়ালা দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে Extremist ক্যাম্পে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করলে। নীল-লোহিতের নাড়ীতে আবার রক্ত ফিরে এল। টঙ্গা যে পথ দিয়ে এসেছিল, আবার সেই পথ দিয়েই ফিরে চলল। এবার কিন্তু কোনো বাড়ির কোনো গবাক্ষ আর তাঁর নয়ন আকর্ষণ করতে পারলে না- যদিচ প্ৰতি গবাক্ষেই একটি করে সন্ধ্যাতারা ফুটে ছিল। তিনি অকারণে সমস্ত সুরাট-সুন্দরীদের উপর মহা চটে গেলেন, যেন তাঁরাই তাঁর কংগ্রেসের প্রবেশদ্বার আটকে দাঁড়িয়েছে। শেষটায় রাত আটটায় তিনি কংগ্রেসের মহারাষ্ট্র-শিবিরে গিয়ে পৌঁছলেন, এবং পৌঁছেই পকেটে যে কটি টাকা অবশিষ্ট ছিল, সেই কটি টঙ্গাওয়ালাকে দিয়ে বিদায় করলেন। মহারাষ্ট্র শিবিরে লোকের ভিড় দেখে সেখানে রাত কাটাতে তাঁর প্রবৃত্তি হল না। সে যেন একটা Black hole, এক একটা ছোট ঘরে পঞ্চাশ-ষাট জন করে জোয়ান। শুতে না পাই অন্তত খেতে পাব’ এই আশায় তিনি সেখানে থাকাই স্থির করলেন। কিন্তু খাবার আয়োজন দেখে তাঁর চক্ষুস্থির! চার দিকে তাকিয়ে দেখেন শুধু লঙ্কা লঙ্কা আর লঙ্কা! সে লঙ্কা কেউ কুটছে, কেউ বাটছে, কেউ পিষছে, কেউ ছেঁচছে। তার গন্ধতেই তাঁর মুখ জ্বালা করতে লাগল। তিনি ঢোক গিলে মনে মনে বললেন, ‘এখন উপায় কি, নুন দিয়েই ভাত খাব।” কিন্তু ভাত সেদিন তাঁর আর কপালে লেখা ছিল না। সে ক্যাম্পেও তাঁর স্থান হল না। সকলে ধরে নিলে যে, তিনি একজন স্পাই। তাঁর যে একূল ওকূল দুকূল গেল, তার প্রথম কারণ তিনি অজ্ঞাতকুলশীল, আর দ্বিতীয় কারণ এই যে, তাঁর সঙ্গে ব্যাগ বিছানা কিছুই ছিল না। তিনি ঘর থেকে একছুটে বেরিয়ে পড়েছিলেন, সুরাটের লোকের কাছে এই প্রমাণ করবার জন্য যে তিনি হচ্ছেন একজন স্বদেশপ্রেমে মাতোয়ারা সন্ন্যাসী।

    নীল-লোহিত মহারাষ্ট্র শিবির থেকে যখন বেরিয়ে এলেন তখন রাত দশটা বেজে গিয়েছে। আর তাঁর অবস্থা তখন এই যে, পেটে ভাত নেই, পকেটে পয়সা নেই, সুরাটে একটি পরিচিত লোক নেই। সভ্যসমাজের মধ্যে তিনি পড়লেন দ্বিতীয় Robinson Crusoe-র অবস্থায়।

    ঘোর বিপদের মধ্যে না পড়লে নীল-লোহিতের বলবুদ্ধি খুলত না। সহজ অবস্থায় নীল-লোহিত ছিলেন আর পাঁচজনের মতো; কিন্তু বিপদে পড়লেই তিনি হয়ে উঠতেন একটি superman, সংস্কৃতে যাকে বলে অতিমানুষ। তাই পথে বেরিয়েই তাঁর শরীর মনে কে জানে কোত্থেকে অলৌকিক শক্তি ও সাহস এসে জুটল। তিনি তাঁর মনকে বোঝালেন যে, তিনি hunger strike করেছেন- সভ্যসমাজের অবিচারের বিরুদ্ধে। অমনি তাঁর ক্ষুধা-তৃষ্ণা মুহূর্তের মধ্যে কোথায় উড়ে গেল। তিনি সংকল্প করলেন যে, এ বিপদ থেকে তিনি আত্মবলে উদ্ধার লাভ করবেন। কি করে যে তা করবেন, সে বিষয়ে অবশ্য তাঁর মনে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না, কিন্তু তাঁর ছিল আত্মশক্তির উপর অগাধ বিশ্বাস। সঙ্গে সঙ্গে জাতিবর্ণনির্বিচারে সকল কংগ্রেসওয়ালার উপর তাঁর সমান অভক্তি জন্মাল, কারণ, তারা যা করতে যায় তা দল বেঁধে ও পরস্পরের হাত ধরাধরি করে। একলা কিছু করবার সাহস ও শক্তি তাদের কারো শরীরে নেই। নীল-লোহিত তাই ‘একলা চলো রে’ বলে সেই অমানিশার অন্ধকারের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এবার তিনি রাজপথ ছেড়ে সুরাটের গলিঘুঁজিতে ঢুকে পড়লেন। সে-সব গলিতে যে অন্ধকারের বান ডেকেছে। রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলোর দুয়োর জানলা সব জেলের ফটকের মতো কষে বন্ধ। চার পাশে সব নির্জন, সব নীরব, নিঝুম, যেন সমগ্র সুরাট শহরটা রাত্তিরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মধ্যে মধ্যে দু-একটা বাড়ির গবাক্ষ দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যেখানেই আলো, সেইখানেই কান্নার সুর। সুরাটে তখন খুব প্লেগ হচ্ছিল।

    নীল-লোহিত ছাড়া অপর কেউ এই শ্মশানপুরীর মধ্যে ঢুকলে ভয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ত। কিন্তু তিনি ঘণ্টা-দুই এই অন্ধকারের ভিতর সাঁতরাতে সাঁতরাতে শেষটায় কূলে গিয়ে ঠেকলেন। হঠাৎ তিনি একটা বাড়ির সুমুখে গিয়ে উপস্থিত হলেন, যার দোতলার ঘরে দেদার ঝাড়লণ্ঠন জ্বলছে, আর যার ভিতর দিয়ে নিঃসৃত হচ্ছে স্ত্রীকণ্ঠের অতি সুমধুর সংগীত।

    নীল-লোহিত তিলমাত্র দ্বিধা না করে নিজের মাথার পাগড়িটি খুলে সেই বাড়ির বারান্দার কাঠের রেলিংয়ে লাগিয়ে দিয়ে, সেই পাগড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলেন।

    তাঁর পায়ের শব্দ শুনে ঘর থেকে একটি অপ্সরোপম রমণী বেরিয়ে এলেন। তার পর দুজনে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে রইলেন। এমন সুন্দরী স্ত্রীলোক নীল-লোহিত জীবনে কিম্বা কল্পনাতে ইতিপূর্বে আর কখনো দেখেন নি। নীল-লোহিতের মনে হল যে, রমণীটি সুরাটের সকল সুন্দরীর সংক্ষিপ্তসার। তাঁর সর্বাঙ্গ একেবারে হীরেমানিকে ঝকঝক করছিল। নীল-লোহিতের চোখ সে রূপের তেজে ঝলসে যাবার উপক্রম হল, তিনি মাটির দিকে চোখ নামালেন।

    প্রথম কথা কইলেন স্ত্রীলোকটি। তিনি হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কে?” নীল-লোহিত উত্তর করলেন, “বাঙালি”।

    “সুরাটে কেন এসেছ?”

    “কংগ্রেস ডেলিগেট হয়ে।”

    “কংগ্রেস ক্যাম্পে না গিয়ে এখানে কেন এলে?”

    “পথ ভুলে।”

    “টঙ্গায় চড়লে টঙ্গাওয়ালা তো তোমাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যেত।”

    “আমার ব্যাগ বিছানা সব স্টেশনে হারিয়ে গিয়েছে। টাকাকড়ি সব ব্যাগের ভিতরে ছিল। তাই টঙ্গা ভাড়া করবার পয়সা কাছে না থাকায় হেঁটে বেরিয়েছিলুম। তার পর তিন-চার ঘণ্টা ঘোরবার পর এখানে এসে পৌঁচেছি।”

    “এ বাড়িতে ঢুকলে কিসের জন্য?”

    “আলো দেখে ও সংগীত শুনে।”

    “পরের বাড়িতে না বলা-কওয়া প্রবেশ করতে তোমার দ্বিধা হল না?”

    “যে জ্বলে ডোবে, সে বাঁচবার জন্য হাতের গোড়ায় যা পায় তাই চেপে ধরে। আমি উপবাসে মৃতপ্রায়। কিছু খেতে পাই কি না দেখবার জন্য এখানে প্রবেশ করেছি— বাড়ি কার তা ভাববার আমার সময় ছিল না। ঝাড়-লণ্ঠন দেখে বুঝলুম— এ বাড়িতে অন্নকষ্ট নেই; আর গান শুনে বুঝলুম, এ বাড়িতে প্লেগ নেই।”

    নীল-লোহিতের কথা শুনে স্ত্রীলোকটির মনে করুণার উদয় হল। তিনি তাঁকে ঘরের ভিতর নিয়ে গিয়ে বসালেন। আর দাসীদের ডেকে বললেন নীল-লোহিতের জন্য খাবার আনতে। তাই শুনে নীল-লোহিতের ধড়ে আবার প্রাণ এল। তিনি এক-নজরে ঘরটি দেখে নিলেন। নীচে কাশ্মীরি গালিচা পাতা, আর ঘর-পোরা বাদ্যযন্ত্র। তিনি গৃহকর্ত্রীকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি হেসে উত্তর দিলেন, “তোমরা যা হতে চাচ্ছ, আমি তাই।”

    “অর্থাৎ?”

    “আমি স্বাধীন।”

    এর পর বড়ো বড়ো রুপোর থালায় করে দাসীরা দেদার ফল-মিষ্টি নিয়ে এসে হাজির করলে। নীল-লোহিত আহারে বসে গেলেন। সে আহারের বর্ণনা করতে হলে দুখানি বড়ো বড়ো ক্যাটলগ তৈরি করতে হয়। একখানি ফলের, আরখানি মিষ্টান্নের। সংক্ষেপে ভারতবর্ষের সকল ঋতুর ফল আর সকল প্রদেশের মিষ্টান্ন নীল-লোহিতের সুমুখে স্তূপীকৃত করে রাখা হল। তিনিও তাঁর এক সপ্তাহের ক্ষুধা মেটাতে প্ৰবৃত্ত হলেন। তিনি সেদিন আহারে স্বয়ং কুম্ভকর্ণকেও হারিয়ে দিতে পারতেন।

    তাঁর আহার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময়ে ফটকে কে অতি আস্তে ঘা দিলে। গৃহকর্ত্রী একটি দাসীকে নীচে গিয়ে দুয়োর খুলে দিতে আদেশ করলেন। মুহূর্তের মধ্যে একটি ভদ্রলোক এসে সেখানে উপস্থিত। নীল-লোহিত দেখেই বুঝতে পারলেন যে, তিনি বম্বে অঞ্চলের একজন হোমরা-চোমরা ব্যক্তি। তিনি যে অগাধ ধনী, তা তাঁর উদরেই প্রকাশ। ভদ্রলোক নীল-লোহিতকে দেখেই আঁতকে উঠে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর সেই ভদ্রলোকটির সঙ্গে গৃহকর্ত্রীর অনেকক্ষণ ধরে গুজরাটিতে কি কথাবার্তা হল। তারপর সেই ভদ্রলোকটি নীল-লোহিতকে সম্বোধন করে অতি অভদ্র হিন্দিতে বললেন যে, আহারান্তে তাঁকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, নচেৎ তিনি তাঁকে পুলিসের হাতে সঁপে দেবেন। এ কথা শুনে স্ত্রীলোকটি বললেন যে, তা কখনোই হতে পারে না। সমস্ত রাত পথে পথে ঘুরে বেড়ালে বাঙালি ছোকরাটি প্লেগে মারা যাবে। আর ছোকরাটি যে চোর-ডাকাত নয় তার প্রমাণ তার চেহারা— “এইসা খপসুরত” ছোকরা চোর-ডাকাত কখনোই হতে পারে না।

    এ কথা শুনে ভদ্রলোকটি ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। আবার দুজনে বাগবিতণ্ডা শুরু হল। শেষটায় উভয়ের মধ্যে এই আপস হল যে রাত্তিরে নীল-লোহিতকে চাকরদের সঙ্গে থাকতে হবে, কিন্তু সকালে উঠেই তাঁকে এ বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে।

    ঘুমে নীল-লোহিতের চোখ বুজে আসছিল, তাই তিনি দ্বিরুক্তি না করে নীচে গিয়ে চাকরদের ঘরে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু তিনি মনে মনে সংকল্প করলেন যে, ঐ বোম্বেটের অপমানের প্রতিশোধ না নিয়ে তিনি দেশে ফিরবেন না।

    পরের দিন ঘুম থেকে উঠে নীল-লোহিত চোখ তাকিয়ে দেখেন যে, বেলা দশটা বেজে গিয়েছে। তিনি মুখ হাত ধুয়ে সবে গালে হাত দিয়ে বসেছেন, এমন সময় উপর থেকে হুকুম এল যে— “বাইজি বোলাতা।” উপরে গিয়ে দেখেন যে স্ত্রীলোকটি নূতন মূর্তি ধারণ করেছেন। সাজসজ্জা সব বাঙালি রমণীর ন্যায়। শরীরে জহরতের সম্পর্ক নেই, গহনা আগাগোড়া সোনার, আর তাঁর পরনে ঢাকাই শাড়ি, গায়ে একখানি বুটিদার ঢাকাই চাদর। তিনি নীল-লোহিতকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তিনি এখন কোথায় যেতে চান। নীল-লোহিত উত্তর করলেন, কংগ্রেস-ক্যাম্পে। স্ত্রীলোকটি বললেন, সে হতেই পারে না। গত রাত্তিরের আগন্তুক ভদ্রলোকটি যদি তাঁর সাক্ষাৎ পান তা হলে তাঁর বিপদ ঘটবে— হয় গুণ্ডা, নয় পাহারাওয়ালার হাতে তাঁকে বিড়ম্বিত হতে হবে। অতএব পত্রপাঠ দেশে ফিরে যাওয়া তাঁর পক্ষে কর্তব্য। স্ত্রীলোকটি তাঁর জন্য ব্যাগ, বিছানা, দেশে ফেরবার রেল-ভাড়ার টাকা ইত্যাদি সব ঠিক করে রেখেছেন।

    কিন্তু কংগ্রেসে যাওয়ায় বিপদ আছে, এ কথা শুনে নীল-লোহিত জেদ ধরে বসলেন যে, তিনি কংগ্রেসে যাবেনই যাবেন। সেই সুন্দরী তাঁকে অনেক কাকুতি-মিনতি করলেন; কিন্তু নীল-লোহিত কিছুতেই তাঁর গোঁ ছাড়লেন না।”ভয় পেয়েছি” এ কথা স্ত্রীলোকের কাছে স্বীকার পুরুষমানুষে সহজে করে না। আর উক্ত স্ত্রীলোকটি ছিলেন যেমন সুন্দরী, নীল-লোহিতও ছিলেন তেমনি বীরপুরুষ। অনেক বকাবকির পর শেষটায় স্থির হল উক্ত স্ত্রীলোকটি স্বয়ং নীল-লোহিতকে সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেসে যাবেন— নিজের দাসী সাজিয়ে। তিনি বললেন যে, তিনি সঙ্গে থাকলে কেউ নীল-লোহিতের কেশাগ্রস্ত স্পর্শ করবে না।

    মধ্যাহ্নভোজনের পর নীল-লোহিতকে পাঞ্জাবী রমণীর বেশ ধারণ করতে হল। পরনে চুড়িদার পাজামা, পায়ে নাগরা, গায়ে কুর্তা ও মাথা-মুখ-ঢাকা ওড়না। এসব সাজসজ্জা গৃহকর্ত্রীর একটি পাঞ্জাবী দাসীর কাছ থেকেই পাওয়া গেল। আর সে সব কাপড় নীল-লোহিতের গায়ে ঠিক বসে গেল। কেননা পাঞ্জাবী স্ত্রীলোক ও বাঙালি পুরুষ মাপে প্রায় এক। তার পর দুজনে একটি আধ-বন্ধ ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে কংগ্রেসে গিয়ে মেয়েদের গ্যালারিতে বসলেন। কংগ্রেসের কাজ শুরু হল, এমন সময় হঠাৎ নীল- লোহিত দেখতে পেলেন যে, উক্ত ভদ্রলোক কংগ্রেসের হোমরা-চোমরাদের মধ্যে বসে আছেন। এ দেখে তিনি আর তাঁর রাগ সামলাতে পারলেন না, ডান পায়ের নাগরা খুলে তাঁকে ছুঁড়ে মারলেন। সেই নাগরাটাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে প্রেসিডেন্টের পায়ে গিয়ে লুটিয়ে পড়ল। মহা হৈ চৈ পড়ে গেল। নীল-লোহিতের কাণ্ড দেখে স্ত্রীলোকটি মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে রইলেন। তার পরেই নিজেকে সামলে নিয়ে নীল-লোহিতের হাত ধরে তিনি কংগ্রেসের তাঁবুর বাইরে এসে গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফিরলেন। আর, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আবার নীল-লোহিতকে বাঙালি সাজিয়ে ব্যাগ-বিছানা সমেত সেই গাড়িতেই তাঁকে স্টেশনে পাঠিয়ে দিলেন। স্টেশনে নীল লোহিত ব্যাগ খুলে দেখেন, তার ভিতর পাঁচশো টাকার নোট আর সেই স্ত্রীলোকটির একখানি ছবি রয়েছে। সেই টাকা দিয়ে টিকিট কিনে তিনি দেশে ফিরলেন।

    সুরাট কংগ্রেসের যুগপ্রবর্তক জুতো যে নীল-লোহিতের পাদুকা, এ কথা শুনে আমরা সকলে স্তম্ভিত হয়ে গেলুম।

    নীল-লোহিতের মুখে এই অপূর্ব কাহিনী শুনে আমরা সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলুম— কেননা তাঁর এই গল্প সম্বন্ধে কি বলব কেউ তা ঠাউরাতে পারলুম না। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকবার পর রামযাদব তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তিনি সেই সুরাট-সুন্দরীর পাঁচশত টাকা বেমালুম হজম করে ফেললেন? নীল-লোহিত উত্তর করলেন— “না। আমি কাশীতে গিয়ে সেই পাঁচশো টাকা দিয়ে অন্নপূর্ণার পূজা দিয়ে এসেছি।” আবার সকলেই চুপ করলেন। তার পর মোহিনীমোহন জিজ্ঞাসা করলেন, “সে ছবিখানা তোমার কাছে আছে?” নীল-লোহিত উত্তর করলেন, “হাঁ, আছে।” দ্বিতীয় প্রশ্ন হল— “সেখানি দেখাতে পার?” উত্তর “দেখতে ইচ্ছে হয়,

    কিনে দেখতে পার।” প্রশ্ন— “সে ছবি বাজারে কিনতে পাওয়া যায়?” উত্তর– “দেদার।” প্রশ্ন— “কি রকম?”

    “উত্তর “নূরজাহানের ছবি দেখলেই সেই সুরাট-সুন্দরীকে দেখতে পাবে। এ দুটি স্ত্রীলোকই এক ছাঁচে ঢালাই।”

    এরপর কিছু বলা বৃথা দেখে আমরা সভা ভঙ্গ করে চলে গেলুম।

    আশ্বিন ১৩৩০

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
    Next Article প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    Related Articles

    প্রমথ চৌধুরী

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Our Picks

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.